বৃহস্পতিবার, ২৯ আগস্ট, ২০১৩

শেষ সময়ের দৌরাত্ম্য


মহাজোট সরকারের মেয়াদ ফুরিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে নানামুখী অপকর্ম ও দৌরাত্ম্যও সীমা ছাড়িয়ে যেতে শুরু করেছে। এসবের মধ্যে রাজনৈতিক বিবেচনায় খুনের মামলা পর্যন্ত প্রত্যাহারের মতো বিষয়গুলো তো রয়েছেই, চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজির কথাও মানুষের মুখে মুখে আলোচিত হচ্ছে। টেন্ডার যেমন কেবল আওয়ামী লীগের লোকজনই পাচ্ছে, চাঁদাবাজিও তেমনি যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সোনার ছেলেরাই বেশি করছে। চাঁদাবাজির ক্ষেত্রও সম্প্রসারিত হয়েছে ব্যাপকভাবে। আগে চাঁদাবাজরা প্রধানত বড় বড় ব্যবসায়ী-শিল্পপতি ও ঠিকাদারদের গিয়ে পাকড়াও করতো, ইদানীং তারা কোনো বাছ-বিচারই করছে না। পাড়া মহল্লার দোকানদার ও ফুটপাতের ক্ষুদে ব্যবসায়ী থেকে চাকরিজীবী পর্যন্ত কাউকেই ছাড় দিচ্ছে না সোনার ছেলেরা। ওদিকে দেশের প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষই যেহেতু আওয়ামী লীগের সমর্থক নয় সেহেতু চাঁদাবাজদের টার্গেটও হচ্ছে বেশিরভাগ মানুষ। সোনার ছেলেরা চাঁদা চেয়েই থেমে পড়ছে না, অস্ত্রের মুখে বা যে কোনো পন্থায় আদায়ও করে ছাড়ছে। যারা দিচ্ছেন না বা সঙ্গতি না থাকায় দিতে পারছেন না তাদের ওপর অস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে সোনার ছেলেরা। এ অবস্থা শুধু রাজধানীতে নয়, চলছে সারা দেশেই। প্রকাশিত খবরে জানা যাচ্ছে, সরকারের মেয়াদ শেষ হয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে আওয়ামী চাঁদাবাজ-সন্ত্রাসীদের দৌরাত্ম্যও বহুগুণে বেড়ে গেছে। কিন্তু পুলিশ ও র‌্যাবসহ কোনো বাহিনী বা সংস্থাই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে না। বরং অভিযোগ রয়েছে, থানা-পুলিশ করতে গিয়ে অনেকে আরো বেশি বিপদে পড়ছেন! একই কারণে সহজে থানায়ও যাচ্ছেন না কেউ।
বলার অপেক্ষা রাখে না, সন্ত্রাসের সঙ্গে সর্বাত্মক চাঁদাবাজি আসলেও সীমা ছাড়িয়ে অত্যন্ত মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। এর শিকারও হচ্ছে সমাজের সব শ্রেণীর মানুষÑ অবশ্য আওয়ামী লীগের ‘সৌভাগ্যবান’ লোকজন ছাড়া! বিষয়টি গুরুতর শুধু নয়, খুবই আপত্তিকরও। কারণ, ক্ষমতাসীন দলের প্রশ্রয়ে চলতে থাকা চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকা-ের পরিণামে দেশীয় ঠিকাদার-ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা তো বটেই, বিদেশী কোনো ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানও দেশের কোথাও নিরূপদ্রবে কোনো কাজ করতে পারেনি, এখনও পারছে না। নিজেদের বিনিয়োগ রক্ষার স্বার্থে অনেকে বাধ্য হয়ে চাঁদা দিয়েছেন সত্য কিন্তু তারা বাংলাদেশ থেকে ব্যবসাও গুঁটিয়ে নিয়েছেন। চাঁদার অর্থে সন্ত্রাসী-চাঁদাবাজদের পকেট এবং অভিযোগ অনুযায়ী আওয়ামী লীগের দলীয় তহবিল ভারী হলেও একদিকে নানামুখী উন্নয়ন কর্মকা- বাধাগ্রস্ত হয়েছে, অন্যদিকে বাংলাদেশের ইমেজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিদেশে। দুর্নাম রটে যাওয়ায় বিদেশীরা সহজে আর বাংলাদেশে আসার নাম করেননি। এর ফলে আর্থিক সহায়তাই শুধু বন্ধ হয়ে যায়নি, সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কে টানাপোড়েনেরও সৃষ্টি হয়েছে। নতুন নতুন ক্ষতির কবলে পড়েছে বাংলাদেশ। পদ্মা সেতুকেন্দ্রিক ঘটনাপ্রবাহের উল্লেখ না করেও বলা দরকার, ক্ষমতাসীনদের জন্য বিষয়টি না বোঝার কোনো কারণ নেই। তা সত্ত্বেও চাঁদাবাজ-সন্ত্রাসীরা যেমন থেমে যায়নি, সরকারও তেমনি নেয়নি দমনমূলক ব্যবস্থা।
এখানে ক্ষমতাসীনদের উদ্দেশে কোনো রাখ-ঢাক নেই। পাছে দল ছেড়ে দেয় এমন চিন্তায় তারা ‘সোনার ছেলে’ আর পাড়া-মহল্লার ‘ছোট ভাইদের’ বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আদৌ আগ্রহী নন। তাছাড়া প্রায় ক্ষেত্রে অর্থের ভাগ ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের পকেটেও গিয়ে জমা হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। লজ্জার বিষয় হলো, অনেক ক্ষেত্রে নাম আসছে এমনকি মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদেরও। কিন্তু কোনো ক্ষেত্রেই সরকারের তৎপরতা চোখে পড়েনি, এখনও পড়ছে না। এর কারণও সহজবোধ্য। চাঁদার ‘ভাগ’ চলে যাচ্ছে বিশেষ কিছু নেতার পকেটেও। ‘বখড়া’ পাচ্ছে পুলিশসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর কর্মকর্তারাও। অর্থাৎ দেশজুড়ে চাঁদাবাজি চলছে একটা সামগ্রিক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে। বলা বাহুল্য, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী হুকুম দিলেও ‘ছোট ভাই’ এবং ‘সোনার ছেলেদের’ বিরুদ্ধে কেউ টু শব্দটিও করতে পারবেন না। কারণ তারা তো যথাস্থানগুলোতে ‘ভাগ’ না দিয়ে নিজেরাই সব সাবাড় করে ফেলছে না! তাছাড়া এগিয়ে আসছে নির্বাচনের সময়। তখন তো সোনার ছেলে ও ছোট ভাইয়েরাই উদ্ধার করে দেবে আওয়ামী লীগকে! আর যদি আবারও লগি-বৈঠার মাধ্যমে নতুন কোনো আন্দোলনের ‘ফসল’ ঘরে তোলার প্রশ্ন থেকে থাকে তাহলে তো তাদের কোনো বিকল্পই নেই! এজন্যই মাঝে-মধ্যে ‘কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে’ এবং ‘কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না’ বলে কলেরগানের ভাঙা রেকর্ড বাজানোর বাইরে কোনো ব্যবস্থাই নেয়া হচ্ছে না। সবকিছু জানে বলে চাঁদাবাজ-সন্ত্রাসীরাও কাউকে পাত্তা দিচ্ছে না। ফলে দেশী-বিদেশী ঠিকাদার ও বড় ব্যবসায়ীরা তো বটেই, প্রত্যেক শ্রেণী ও পেশার মানুষও অসহায় হয়ে পড়েছেন। মানুষ এ থেকে রেহাই চায়। শেষ সময় হলেও সরকার ও প্রশাসন বিষয়টার নজর দিন।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads