বুধবার, ৭ আগস্ট, ২০১৩

বাঙালি মুসলমানের ঈদ


বাঙালি মুসলমানের সর্ববৃহৎ ও সর্বপ্লাবী জাতীয় উৎসব ঈদ। অন্য কোনো জাতীয় দিবসের সাথে এর তুলনা চলে না। ঈদের সাথে কিংবা লাগোয়া যেকোনো জাতীয় উৎসব কিংবা দিবস ম্লান হয়ে ধরা দেয়। এর কারণ জাতির মন, মনন ও জীবনযাপনে ঈদের প্রভাব অপ্রতিহত। একটি জাতিসত্তাকে বোঝার জন্য এই বৈশিষ্ট্যটিই যথেষ্ট। জাতির ধর্মজীবনকে জীবনঘনিষ্ঠ ও প্রাণময় করে পাওয়ার এ উপমা অনেক প্রশ্নের জবাব পাইয়ে দেয়। উৎসব শব্দটির অর্থ আনন্দ প্রকাশ। উৎসব আনন্দলাভের মাধ্যমও। বলা যায় আনন্দানুষ্ঠান। উৎসব পরিবারকেন্দ্রিক হতে পারে। সমাজকেন্দ্রিকও হতে পারে। কালের বিবর্তনে উৎসবের রূপ বদলায়। কোনোটি বিলুপ্ত হয়। আবার কোনোটি নতুন সৃষ্টি হয়। উৎসবগুলোর কোনোটিতে থাকে সমাজ-সভ্যতা ও জাতীয়তার ছাপ। কোনোটিতে সরাসরি ধরা পড়ে ধর্মের প্রাণস্পর্শী জীবনবোধ। আবার কোনোটিতে রাজনীতির ছাপও থাকতে পারে। উৎসবের পুরনো ধারা এখন নানা বর্ণ ও বৈচিত্র্যে পূর্ণ। তবে সব অনুষ্ঠানের মূলেই রয়েছে আনন্দলাভ। কোনোটি নির্মল ইবাদতকেন্দ্রিক, কোনোটি শুধুই বস্তুবাদী। প্রাচীনকালে মানুষের প্রধান পেশা ও কাজ ছিল কৃষি। কৃষির সাথে যোগ ছিল অনেক উৎসবের। সেসব নিয়ন্ত্রিত হতো চান্দ্রমাস দ্বারা। পরে জাতীয় সংস্কৃতিতে তার চারিত্রিক উপাদান যোগ হতে থাকে। প্রাচীনকালের কৃষিভিত্তিক উৎসবগুলো ছিল স্বতঃস্ফূর্ত, যা পরে নগরকেন্দ্রিকতা ও ভোগবাদী বিশ্বাসের কারণে স্বতঃস্ফূর্ততা হারিয়েছে, যদিও বাণিজ্যিক গুরুত্ব অনেকখানি বেড়েছে। উৎসবের সাথে ধর্মের যোগ থাকলেও সব উৎসব ধর্মীয় কারণে উদ্ভূত হয়নি। বিনোদনের মানবিক চাহিদা থেকেও হয়েছিল এবং তা হয়েছিল স্বতঃস্ফূর্তভাবেই। পরে সেগুলো সাধারণ উৎসবে পরিণত হয়। প্রত্যেক জাতির উৎসবে জাতিগত বৈশিষ্ট্য ধরা পড়ে। সেখানে বিশ্বাস ও ধর্মের উপস্থিতি অনিবার্য। মুসলমানদের উৎসবগুলো জীবনঘনিষ্ঠ এবং ইবাদতকেন্দ্রিক হয়ে থাকে। ঈদ উৎসব বা আনন্দ এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ঈদের সাথে রমজানের আত্মশুদ্ধির কথাও বলা যেতে পারে। কারণ রোজার সাথে ঈদের সম্পর্ক প্রত্যক্ষ। কালে কালে বিভিন্ন অঞ্চলের লোকসংস্কৃতিও এসবের ওপর প্রভাব ফেলেছে। তাতে বদল হয়েছে ধর্মের অবিমিশ্র ও শুদ্ধ রূপেরও। যে কারণে বাংলাদেশের মুসলমানের সাথে আরব, মধ্যপ্রাচ্য ও ইন্দোনেশিয়ার মুসলমানদের ধর্মীয় জীবনচর্চা এক হলেও উৎসব অনুষ্ঠানে রকমফের সহজেই চোখে পড়ে। এর মুখ্য কারণ, পোশাক-আশাক ও খাদ্যাভ্যাসে জাতীয় বৈশিষ্ট্য বিশেষভাবে প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশের তো বটেই, বিশ্বের মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব ঈদ। রমজান শেষে ঈদুল ফিতর পালিত হয়। ঈদের সামাজিক অর্থ উৎসব। আর আভিধানিক অর্থ পুনরাগমন বা বারবার ফিরে আসা। অন্যান্য সামাজিক উৎসবের মতো ঈদও বারবার ফিরে আসে। এখন ঈদের সাথে লোকজ সংস্কৃতির মেলবন্ধন স্পষ্ট। ইসলাম লোকজ উৎসব ও সংস্কৃতিকে নিরুৎসাহিত করে না। বরং বিশ্বাসের গভীরতা দিয়ে আত্মস্থ করে নেয়। তবে লোকজ উৎসব উদযাপনে পরিসীমা ও লক্ষ্য স্মরণ করিয়ে দেয়। আদি যুগে উৎসব পালনে কৃষিজীবী মানুষের লোকায়ত বিশ্বাসের প্রভাব ছিল। সেই আদি যুগেও ধর্মবিশ্বাস অনুপস্থিত ছিল না। তাই লোকজ উৎসবেও পরে কিছু ধর্মীয় রীতিনীতি যুক্ত হয়। আমাদের সমাজে বর্তমানে ঈদ উৎসব দুটি যতটা গুরুত্বের সাথে পালিত হচ্ছে, আগে সেভাবে হতো না। কারণ তখন ঔপনিবেশিক সরকারের পৃষ্ঠপোষকতার অভাব ছিল। সে সাথে ছিল জনগণের দারিদ্র্য এবং ধর্ম সম্পর্কে অজ্ঞতা। লোকায়ত সমাজ-সংস্কৃতির সাথে একাকার করে আত্মস্থ করার জাতীয় মানসের অভাববোধের বিষয়টিও কম গৌণ ছিল না। মুঘল যুগে ঈদের দিন যে হইচই বা আনন্দ হতো তা মুঘল ও বনেদি পরিবারের উচ্চপদস্থ এবং ধনাঢ্য মুসলমানদের মধ্যে কিছুটা হলেও সীমাবদ্ধ ছিল। তার সাথে সাধারণ মানুষের ব্যবধান না থাকলেও কিছু দূরত্ব ছিল। তাই ঈদ এ দেশে জাতীয় উৎসবে রূপান্তর হতে সময় নিয়েছে। তবে মুঘলরা যে ঈদের গুরুত্ব দিতেন তা বোঝা যায় বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় খোলামেলা গণমুখী শাহি ঈদগাহের উপস্থিতি দেখে। সুফিসাধকদের ভূমিকা ছিল এ ক্ষেত্রে আলাদা, অধিকতর গণমুখী। উনিশ শতকের শেষ দিকে ঈদের আনুষঙ্গিক আনন্দ হিসেবে যুক্ত হয় একটি নতুন উপাদান লোকজ মেলা। সে ধারা আজো কমবেশি অব্যাহত রয়েছে। বর্তমানে ঈদ উপলক্ষে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কিছু ঈদ আনন্দমেলার আয়োজন করা হয়। সামর্থ্যরে জোড়াতালির ভেতরও ঈদবাজার এখন অনেক বেশি জমজমাট ও উৎসবমুখর। ১০০ বছরে বাঙালি মুসলমানদের ঈদ যাপনের বিবরণে দেখা যায়, ঈদ উৎসবের একটি প্রধান অঙ্গ ছিল বিশেষ ধরনের খাওয়া-দাওয়া। মফস্বল ও গ্রামাঞ্চলের খাবারের মধ্যে কিছু ফারাক থাকত। কোরমা-পোলাও শহরেই বেশি প্রচলন ছিল। গ্রামে ঘরে প্রস্তুত নানা রকমের পিঠা, সেমাই ও জর্দার প্রচলন ছিল। মেয়েরা পিঠার ওপর আঁকতেন জ্যামিতিক ধারার ছবি, লতাপাতা ও ফুল। এ ক্ষেত্রে জীবজন্তু বা প্রাণীর ছবি সতর্কতার সাথে পরিহার করা হতো। তবে শহরে এ ধরনের লোকজ উপাদানের অভাব ছিল। শহরে ঈদের খাওয়ার তালিকায় প্রধান হয়ে উঠত শাহিখানা ও ঘরে তৈরী মিষ্টান্ন। ঢাকায় উনিশ শতকে ঈদের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল ঈদ মিছিল। মাঝখানে কিছু দিন বন্ধ থাকার পর কয়েক বছর আগে থেকে আবার এ মিছিল চালু হয়েছে। পুরান ঢাকায় এ মিছিল বেশ বর্ণাঢ্য ও গণসম্পৃক্ত হয়ে উঠেছে। তবে এর সাথে ধর্মীয় আবেগ এখনো পুরোমাত্রায় যুক্ত হয়নি। উল্লেখ্য, আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখ এবং দ্বীনদার মানুষ যে অনুষ্ঠানে শরিক হন না সে অনুষ্ঠান ধর্মীয় স্বীকৃতি পায় না। তবে আলেম সমাজ নেতিবাচক বক্তব্য না দিলে লোকজ উৎসবে গণছোঁয়া বহু গুণ বৃদ্ধি পায়। এখন ঈদের সাথে কিছু স্থানীয় সাংস্কৃতিক উপাদান যুক্ত হয়েছে, যার অনেকগুলো এসেছে বিভিন্ন লোকাচার থেকে। ঈদের চাঁদ দেখেই মেহেদি রাঙানোসহ নানা উৎসবে মেতে ওঠা তার মধ্যে অন্যতম। চাঁদ রাতে ইবাদতের সংযম ভেঙে বাঁধনহারা আনন্দে মেতে ওঠাও নতুন সংযোজন। ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় বিনোদন সন্ধানও এখন নতুন মাত্রা যোগ করেছে। অনেক ক্ষেত্রে স্থানীয় বা শহুরে সংস্কৃতিও সরাসরি প্রভাব ফেলেছে ঈদ উৎসবে। বিগত শতকের ত্রিশ-চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে ঢাকায় ঈদের দিন রমনা, আরমানিটোলা বা অন্যান্য মাঠে অনুষ্ঠিত হতো নানা ধরনের খেলাধুলা। এ ছাড়া ছিল নৌকাবাইচ, ঘুড়ি ওড়ানো, ঘোড়দৌড় ইত্যাদির বিশেষ আয়োজন। বিগত শতকের শুরুতে রাজনৈতিকভাবে মুসলিম স্বাতন্ত্র্য আন্দোলন শুরু হলে ঈদ উৎসব নতুন গুরুত্ব লাভ করে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান হওয়ার পর পূর্ব বাংলা তথা বাংলাদেশে দুটি ঈদই জাতীয় ধর্ম উৎসবে রূপান্তরিত হয় এবং রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে আসছে, যা এখনো জাতীয় উৎসবের মর্যাদা পাচ্ছে। জীবনঘনিষ্ঠ হওয়ার কারণে সাম্য-মৈত্রীর মেলবন্ধনে ঈদ উৎসব এখন ধনী-দরিদ্র মিলে সার্বজনীন হয়ে গেছে। আর্থসামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে ঈদ উৎসবের কিছু বৈশিষ্ট্য এখন দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে। নগরায়ন, মধ্যবিত্তের প্রসার বিভিন্ন উৎসবের বিশ্বাসগত থেকে উৎসারিত আমেজে পরিবর্তন ঘটিয়েছে। সাধারণ মানুষের ঈদ মানে পরিবার-পরিজনদের সাথে মিলিত হওয়া। নতুন কাপড়চোপড় কেনা এবং ঈদের দিন যথাসাধ্য উন্নতমানের খাবারের আয়োজন করা। জীবনের সুখ-দুঃখ ভাগ করে নেয়া। সব সীমাবদ্ধতার পরও ঈদ বাঙালি-অবাঙালি সব মুসলমানের প্রধান জাতীয় ও ধর্মীয় উৎসব। ঈদ ও ফিতর শব্দ দুটিই আরবি। ঈদ অর্থ উৎসব বা আনন্দ। ফিতর অর্থ বিদীর্ণ করা, উপবাস ভঙ্গকরণ, স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাওয়া। পবিত্র রমজান মাসে সিয়াম সাধনা ও সংযম পালনের পর শাওয়াল মাসের ১ তারিখে সিয়াম বা রোজা ভঙ্গ করে স্বাভাবিক কর্মজীবনে ফিরে যাওয়ার আন্দময় দিনটি ঈদুল ফিতর নামে অভিহিত। পবিত্র রমজানের নতুন চাঁদ দেখে সিয়ামের মাস শুরু হয়, শাওয়াল মাসের নতুন চাঁদ দেখে রোজা ভঙ্গ করা হয়। এই এক মাস মুসলমানেরা আনুষ্ঠানিক ইবাদত ও সংযমী আচরণের মাধ্যমে সব কুপ্রবৃত্তিকে দমন করে রাখে। এ কারণে ফিতর শব্দটি নিজের মনের ওপর বিজয় অর্থেও ব্যবহৃত হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন ধর্মে যেসব প্রধান ধর্মীয় উৎসব উদযাপিত হয়, সেগুলোর মধ্যে ঈদুল ফিতর হচ্ছে সময়ের মাপে কনিষ্ঠতম, কিন্তু আয়োজন-প্রয়োজনে ব্যাপকতর। এই মহান ও পুণ্যময় উৎসবের উদযাপন শুরু হয় আজ থেকে ১৩৮৮ সৌর বছর আগে থেকে। ইসলামের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ সা:-এর মদিনাতে হিজরতের অব্যবহিত পরই ঈদুল ফিতর উৎসব পালন শুরু হয়। আরবদের ইহুদি ধ্যানধারণা ও জাহেলি প্রথার পরিবর্তে দুই ঈদ ছিল আল্লাহর রাসূলের পক্ষ থেকে মুসলমানদের জন্য ঘোষিত উপহার। ইসলামি আদর্শে উজ্জীবিত আরববাসী রাসূলুল্লাহ সা:-এর নির্দেশে শুরু করল ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা উৎসব উদযাপন। এর আগে পৌত্তলিক ভাবনায় অগ্নিপূজকদের নওরোজ এবং মূর্তিবাদীদের মিহিরজান নামে দুটি উৎসবে মদিনাবাসী শরিক হতো। আরবরা অশ্লীল ও কুরুচিপূর্ণ ওকাজ মেলায় আদিম উচ্ছ্বলতায় মেতে উঠত। সেগুলো ছিল উচ্চবিত্তের খেয়ালিপনার উৎসব। এর পরিবর্তে জন্ম নিলো শ্রেণিবৈষম্য-বিবর্জিত, পঙ্কিলতা ও অশালীনতামুক্ত ইবাদতের আমেজমাখা সুনির্মল আনন্দে ভরা ঈদআনন্দ। আমেজের দিক থেকে পবিত্র ও স্নিগ্ধ, আচরণের দিক থেকে প্রীতি ও মিলনের উৎসব ঈদুল ফিতর। ইসলামের ধর্মীয় উৎসব হিসেবে ঈদুল ফিতরের আনুষ্ঠানিকতার দিকটি প্রধানত মুসলমানদের মধ্যেই সীমিত থাকে। তবে ইসলাম সাম্য-মৈত্রী, শান্তি-সম্প্রীতির ধর্ম ও ঈদের অর্থ আনন্দ বিধায় প্রকারান্তরে ঈদ সব মানবের জন্যই কল্যাণ বয়ে আনে। জাতীয় জীবনে এর রূপময়তা সর্বত্র চোখে পড়ে। সব ক্ষেত্রে এর ইতিবাচক প্রভাব অসাধারণ হয়ে ধরা দেয়। ভিন্ন ধর্মের মানুষও ঈদের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সুফল ভোগ করে। গতানুগতিক জীবনধারার অধ্যাত্মবাদের সাথে যোগ হয় প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর ভিন্নমাত্রিক জীবনধারা। ঈদের আর্থসামাজিক গুরুত্বও অপরিসীম। দান-সদকা, ফিতরা এবং জাকাতদানের মাধ্যমে আমাদের সমাজে বিরাজমান দুষ্ট ক্ষতের মতো শ্রেনিবৈষম্য কিছুটা হলেও সহনীয় হয়। প্রচুর অর্থপ্রবাহ এবং ব্যবসায়-বাণিজ্যের প্রাচুর্য ধনতান্ত্রিক সমাজে সব শ্রেণীর মানুষকে কিছুটা হলেও সুবিধাভোগী করে। বাংলাদেশে এ দিনটি আজকাল খুবই জাঁকজমকের সাথে পালিত হয়। সবাই এ দিন সাধ্যানুযায়ী ভালো পোশাক পরে। উন্নতমানের খাবারের আয়োজন করে। আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীরাও এ আনন্দের অংশীদার হয়। দরিদ্র ও গরিবদের ঈদের আনন্দে শরিক করা জরুরি ভাবা হয়। মুসলমানেরা এ দিন কৃতজ্ঞচিত্তে খুতবাসহ ঈদের দুই রাকাত নামাজ আদায় করেন। আত্মীয়স্বজনের সাথে কুশল বিনিময় করেন। পদমর্যাদা কিংবা বয়স নির্বিশেষে সবাই কোলাকুলিসহ সালাম ও শুভেচ্ছার হাত বাড়িয়ে দেয়। আত্মীয়স্বজন ও পুণ্যবানদের কবর জিয়ারত করা হয়। বর্তমানে ঈদকার্ড বিনিময় একটি জনপ্রিয় প্রথায় পরিণত হয়েছে। নির্দিষ্ট হারে গরিবদের ফিতরা বা শর্তহীন অনুদান বিতরণ করা ধর্মীয় দিক থেকে বাধ্যতামূলক। তা ছাড়া গরিবদের সাধ্যমতো খাদ্য, বস্ত্র ইত্যাদিও দান করা হয়। আটষট্টি হাজার গ্রামের দেশ বাংলাদেশের সর্বত্র ঈদ উদযাপিত হয়। এ উপলক্ষে সাধারণত তিন দিন সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়। এর ফলে গ্রামপ্রধান বাংলাদেশের শহরবাসী নিজ নিজ গ্রামে গিয়ে পরিবার-পরিজন ও আত্মীয়স্বজনের সাথে সম্মিলিতভাবে ঈদ উৎসব পালন করতে পারে। এ সময় বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় হজরত মুহাম্মদ সা:-এর জীবন দর্শন, ঈদের তাৎপর্য ও ইসলামের আদর্শভিত্তিক মূল্যবান প্রবন্ধাদি নিয়ে সমৃদ্ধ ঈদ সংখ্যা প্রকাশিত হয়। রেডিও-টেলিভিশন বিশেষ অনুষ্ঠানমালা প্রচার করে। শহর, গ্রাম সর্বত্র ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকা মহানগরীর জাতীয় ঈদগাহ ময়দান, বায়তুল মোকাররম কেন্দ্রীয় মসজিদসহ অন্যান্য মসজিদ ও ময়দানে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়। গ্রামাঞ্চলেও ঈদ উৎসবে সর্বত্র প্রাণপ্রাচুর্য থাকে অপরিমেয়। সকালে ঈদের নামাজ পড়ে প্রত্যেকে ঘরে ফেরে। দিনভর এক বাড়ির লোক অন্য বাড়িতে শুভেচ্ছা বিনিময় করতে যায়। অনেকেই বিশেষ সৌজন্য সাক্ষাতে মিলিত হয়। অতীতের ঝগড়াবিবাদ ভুলে পরস্পর পরস্পরের প্রতি মৈত্রী বন্ধনে আবদ্ধ হয়। এ সময় গ্রামবাংলায় এক আনন্দঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়, যার কোনো তুলনা হয় না। তা ছাড়া আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতি, নাটক-নভেল, সমাজ ভাবনা এবং জীবনধর্মী সব আবেদন-নিবেদনে ঈদ এখন নিত্যপ্রসঙ্গ ও অপরিহার্য। এটা যেন আনন্দ উপভোগের সবচেয়ে প্রভাবশালী ও প্রভাব বিস্তারকারী অনুষ্ঠান। ঈদ উৎসবে গ্রামবাংলার অনেক স্থানে ঈদের মেলা বসে। মূলত পল্লীবাসীর এ এক মিলনমেলা। নদীতীরে, গ্রাম্য বাজারের কাছে বটতলায় এসব মেলা জমে ওঠে। সব শ্রেণীর মানুষ এসব অনুষ্ঠানে পৃষ্ঠপোষকতা করে। নদীবহুল বাংলাদেশের কোনো কোনো অঞ্চলে ঈদ উপলক্ষে নৌকাবাইচের আয়োজন করা হয়। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যায় এ নৌকাবাইচ খুবই আকর্ষণীয় হয়ে থাকে। প্রতিযোগিতায় বিজয়ী নৌকাকে পুরস্কার প্রদান করে উৎসাহিত করা হয়। গ্রামবাংলার কোথাও কোথাও ঈদ উপলক্ষে গ্রামীণ খেলাধুলারও আয়োজন করা হয়। এর পাশাপাশি বর্তমানে ফুটবল, ক্রিকেট ইত্যাদি প্রীতি খেলারও আয়োজন করা হয়। এসব খেলা ঈদ উৎসবকে ভিন্ন মাত্রায় প্রাণবন্ত করে তোলে। ঈদ উৎসবের প্রভাব এখন সর্বপ্লাবী। তাই এটি জাতীয় উৎসব। সবার উৎসব। বর্ণ-গোত্র এবং ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সবার উৎসব। রোজা আত্মশুদ্ধির ইবাদত। আত্মত্যাগের ইবাদত। ইবাদতকেন্দ্রিক এমন উৎসবের নজির ঈদ ছাড়া আর কোনো উপমা মিলে না। 


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads