ছোটবেলায় গরমের দিনে আমরা গাছের ছায়ায় বসে মাটিতে ষোলগুটির ছক এঁকে গুটি খেলতাম। এক পক্ষে ষোলগুটি করে উভয় পক্ষে দু’টি ভিন্ন রঙের মোট বত্রিশ গুটির প্রয়োজন হতো। গুটি চালের প্রথমেই খুব সতর্কতার সাথে চাল দিতে হতো। পাশে বসে সমজদাররা স্মরণ করিয়ে দিতো যেন হিসাব-নিকাশ করে প্রথম চালটা দেয়া হয়। তারা সব সময়ই বলতো প্রথম চালে যদি ভুল হয় তবে বাম হাত পিঠের নীচে পড়ে যাবে। আর সুবিধা করতে পারবে না। খেলার মাঝামাঝি এসেই ভবিষ্যৎ ফলাফল টের পাওয়া যেত। খেলার বাকি সময়টা প্রায়শ খেলার জন্যেই খেলতে হতো সে সময় পাশে উপদেষ্টার অভাব হতো না। একেক জনের একেক মত। এটা চাল দাও ওটা চাল দাও শুনতে শুনতে মূল খেলোয়াড় অনেকটা বোকা বনে দর্শকে পরিণত হতো। খেলার কোমর ভেঙে গেলে ঐসব উপদেশে তেমন লাভ হতো না।
শিয়াল কিন্তু খুব ধূর্ত পশু। বাড়ির পোষা কুকুরের বাচ্চা থেকে শুরু করে হাঁস-মুরগি খুব চিকন কৌশলে পাকড়াও করে চম্পট দেয়। আমাদের ছোটবেলায় দেখতাম শিয়ালের অত্যাচারে বাড়িতে হাঁস-মুরগি পোষা খুবই কষ্টকর ছিল। ঘরের সবচেয়ে বাছা হাঁসটা বা মুরগিটা নিয়ে ঠিক দুপুরে অথবা সন্ধ্যায় চম্পট দিতো। বিশেষ করে আষাঢ়ের ঘন বর্ষায় যখন দিনের বেলায় অঝোরে বৃষ্টি হতো তখন বাড়ির হাঁসগুলো দল বেঁধে পুকুরের কিনারায় ঝিমিয়ে বসে থাকতো। ঐ সময়টাই শিয়ালের জন্য মোক্ষম সময়। ধূর্ত শিয়াল চুপি চুপি পুকুর পাড়ে এসে ঝাঁকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে একটা নিয়ে চম্পট দিতো। বাকি হাঁসগুলো যখন গলা ফাটিয়ে চিৎকার দিয়ে উঠতো তখন বুঝা যেত একটা সর্বনাশ ঘটে গেছে। মুষলধারা বৃষ্টির মধ্যে ছাতা বা জোংরা মাথায় দিয়ে ছু ছু চিৎকার দিতে দিতে পুকুর পাড়ে এসে দেখা যেত ততক্ষণে শিয়াল হাঁস মুখে নিয়ে মাঠের মাঝখানে চলে গেছে। তার মুখের হাঁসটা ডানা ঝাপটাচ্ছে। মাঠের মাঝখানে শিয়াল দাঁড়িয়ে পেছন দিকে তাকিয়ে দেখতো গেরস্থরা কি করছে। এ অবস্থায় আমাদের হাউ কাউই সার। লাভের অংক শূন্য। বাড়ির পাশে ঘন বনের ছোট টিলাটা শিয়ালদের আখড়া। শিয়ালের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে শিয়াল উচ্ছেদের জন্যে বড়-ছোটরা মিলে বাড়ির পোষা কুকুরগুলোকে নিয়ে টিলা ঘেরাও দেয়া হতো। টিলার যে দিকটা খাড়া নীচু সেদিকে শক্ত করে জাল বসানো হতো। জালগুলো মোটা রশির তৈরি বড় বড় ফাঁকওয়ালা। যেন আর্মির ট্রেনিং নেট। বাকি তিন দিক থেকে লাঠিসোটা নিয়ে পুরো জঙ্গল পেটা আর হই হুল্লোড় চলতো। সাথে কুকুরগুলো বীরদর্পে ঘেউ ঘেউ করে দাপট চালিয়ে যেত। সেই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে শিয়াল প্রাণ বাঁচাতে নীরব দিকে দৌড় দিয়ে জালে লাফ দিলে চার ঠ্যাং চার ফাঁকে ঢুকে আটকা পড়ে যেত। যত চেষ্টাই করুক ধূর্ত শিয়াল কিন্তু নিজেকে আর ছুটাতে পারছে না। কারণ পা তো মাটির নাগাল পাচ্ছে না।
বর্তমান রাজনীতির অঙ্গনে সবচেয়ে উত্তপ্ত বিষয়টি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা। তা নিয়ে সরকারি দল আর বিরোধী দল মুখোমুখি অবস্থান। পরিস্থিতিটা একটু ঠা-া মাথায় চিন্তা করলে কেন যেন মনে হয় শিয়াল ধরার মতো। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা দেশের সাধারণ মানুষ ছাড়া প্রকৃতপক্ষে আমাদের দেশের ক্ষমতা প্রত্যাশী কোনো দল কি চায়? আজ যেমন রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন দল শিয়ালের মুরগি ধরার মতো তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার টুঁটি ধরে হত্যা করলো, সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা কি বর্তমান বিরোধী দল, যখন ক্ষমতায় ছিল তখনও তো তারা এর জন্ম দিতেই চায় নাই। বর্তমান ও অতীতের ক্ষমতাসীন উভয় পক্ষের উদ্দেশ্য একটাই। যাতে ছলে বলে কলে কৌশলে ক্ষমতা ছাড়তে না হয়। পরিস্থিতি দেখে আমাদের ছোটবেলার ষোলগুটি চালের কথা কেন যেন মনে পড়ে। বর্তমানে ক্ষমতাসীন দলের অনেক বড় বড় নেতা-নেত্রীরা নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা কোনো অবস্থাতেই মানবে না বলে হুঙ্কার দিচ্ছেন, তা কি তাদের জন্যে খুবই নিরাপদ? ব্যাপারটা যদি এ রকম হয় যে ক্ষমতাসীন সরকার বিরোধী দলের বর্তমান দাবি মোটেই মানলো না। তারা তাদের কথায় অনড় থাকলো। বিরোধী দলও তাদের তত্ত্বাবধায়ক দাবি নিয়ে আরও উত্তপ্ত হয়ে উঠলো। দেশের আপামর জনগণ দেখলো ক্ষমতাসীন দল তাদের পছন্দের দাবিটি মানছে না। তাতে জনগণও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো। সাথে আগুনে পেট্রোল ঢালার মতো বিরোধী দল বর্তমান সরকারের শাসনামলে যত গুম, খুন, হত্যা, সন্ত্রাস, ছাত্রলীগ-যুবলীগের অপকর্ম, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অশান্তি, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, বিশ্বজিৎ হত্যা, সাগর-রুনি হত্যা, লাখ লাখ বিনিয়োগকারীর শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারী, পদ্মা সেতু কেলেঙ্কারী, কুইক রেন্টাল, ডেসটিনি, হলমার্ক, ইউনি-পে-২, বিসমিল্লাহ গ্রুপ, রেলের কালো বিড়াল, রানা প্লাজা ধ্বংস, শাপলা চত্বরে হেফাজত তাড়ানো, গ্রামীণ ব্যাংকের ৮৬ লাখ গ্রাহক ক্ষেপানো প্রভৃতির কিচ্ছা-কাহিনী কৃতকার্যতার সাথে জনগণের দিলে জাগরুক রাখবে। এই দাবি না মানা অবস্থায় বিরোধী দল যখন বুঝতে পারবে গাজীপুর নির্বাচনের পূর্বাবস্থার মতো দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বিরোধী দলের দাবির সাথে সম্পূর্ণ একমত তখন বিরোধী দল সরকারি দলের ওপর এই দাবির চাপটি বাহ্যিকভাবে অব্যাহত রাখলো। সরকারি দলও গোঁয়ার্তুমি আর নিজ দর্প রক্ষার উন্মাদনায় অনড় থাকলো। এমতাবস্থায় বিরোধী দল ব্যাপক জনতাকে নিয়ে এই চাপ অব্যাহত রাখাটা তিন দিকে জঙ্গল পেটানোর মতো হবে। পরিবেশ পাকা হলে বিরোধী দল দলীয় সরকারের অধীনে ধীরে সুস্থে নির্বাচনে অংশ নিয়ে নিল। অংশ নিয়ে ব্যাপক জনতাকে সাথে করে কারচুপি আর ভোটচুরি প্রতিহত করতে পারলো। তখন তো বর্তমান বিরোধী দলের জন্যে এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল না হওয়াই সাপেবর হবে। তখন কি সরকারি দলের পলিটিক্স শিয়াল ধরার মতো হবে না? তারা যদি দৌড়ে একবার জালে পড়তে পারে তখন তো পায়ে মাটি নাগাল পাবে না। সেই অবস্থায় যত গর্জন আর হুঙ্কারই দিক না কেন সেই জাল থেকে ছুটা সম্ভব হবে না। তাতে তাদের কপাল পেটানোর মতোই অবস্থা হবে।
সরকারি দলের কিছু কিছু নেতা যেসব হুঙ্কার দিচ্ছেন তাতে কেন যেন মনে হয় তারা আঁচ করতে পারছেন যে তাদের গুটি চালে বোধহয় ভুল হয়ে গেছে। সম্প্রতি পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফলাফল জাতীয় নির্বাচনে কোনো রকম প্রভাব বিস্তার করবে না বলে যে দাবি করা হচ্ছে তা তো তাদের নিজের মনকে চোখঠার মারার মতো। সিটি করপোরেশনে যে মানুষগুলো ভোট দিয়েছে তারাই তো জাতীয় নির্বাচনেও ভোট দেবে। কাজেই প্রভাব বিস্তার করবে না কিভাবে বুঝতে পারছি না।
একটি রাজনৈতিক দলের রাজনীতির গুটি চালে ভুল হওয়াটা শুধুমাত্র ঐ দলটির বিপর্যয় ডেকে আনে না। তাতে অন্যান্য দল, জাতি এমনকি রাষ্ট্রেরও সর্বনাশ ডেকে আনে। এর প্রতিক্রিয়া জাতিকে দীর্ঘদিন ভুগতে হয়। আমাদের জাতীয় জীবনে এর বহু নজীর আছে। এখনও সেই যাতনা জাতি ভুগছে। বহু ক্ষয়ক্ষতির পর জাতীয় নির্বাচন পদ্ধতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার প্রবর্তন রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল। কোন বুদ্ধি বিকাশের কারণে এই প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থাকে হত্যা করে অশান্তি, অনিশ্চয়তা আর অবিশ্বাসের রাস্তা খোলা হলো তা বুঝা মুশকিল। সত্যি কথা বলতে কি পরিবেশ পরিস্থিতির গতি-প্রকৃতিতে কেন যেন মনে হয় এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন করলেও যা হবে না করলেও সরকারি দল ও তাদের মোর্চার জন্য তাই হবে। ক্ষমতাসীন দলটির অতীত রাজনীতির ভুলের ফিরিস্তির সাথে মনে হয় তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা হত্যার আরেকটি ভুল যোগ হতে যাচ্ছে। এখনও যদি বর্তমান সরকার মত পরিবর্তন করে লুপ্ত ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন করে তবে জাতি একটি প্রতিষ্ঠিত পদ্ধতিতে ফিরে আসবে এবং বর্তমান ক্ষমতাসীন দলকে যদি আল্লাহ বাঁচিয়ে রাখেন তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্যে বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের গেটে কাঙ্গালরা যেভাবে ভিক্ষা খোঁজে সেভাবে এই পদ্ধতি বহালের জন্যে পুনরায় ভবিষ্যৎ ক্ষমতাসীনদের দুয়ারে ভিক্ষা খুঁজতে হবে না।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন