রবিবার, ২৫ আগস্ট, ২০১৩

আইনের দৃষ্টিতে পুলিশের ক্ষমতা ও প্রয়োগ


আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যে কয়টি শাখা আইনগতভাবে তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করে থাকে তার মধ্যে পুলিশ, র‌্যাব এবং বিজিবি অন্যতম। আইনগতভাবে এ সকল কাজের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধান করার দায়িত্ব প্রধানত নি¤œ আদালতের। এ তিনটি শাখা ছাড়া অন্য যে সংস্থাগুলো এ ধরনের কাজ করে তারা তা করে হয় অবৈধভাবে অথবা এই তিন শাখার ছদ্মাবরণে।
দেশের মানুষের প্রয়োজনীয় শিক্ষার অভাব অথবা শিক্ষা কারিকুলাম গণমুখিতার পরিবর্তে কেরানী তৈরীর জন্য প্রণীত হওয়া ইত্যাদি কারণেই এ দেশের তথাকথিত শিক্ষিত মানুষগুলোও জানে না কোন কাজটি আইনানুগ আর কোনটি নয়। ফলে আইন রক্ষাকারী এই সকল বাহিনী প্রায়শই যখন বেআইনী কার্যে জড়িয়ে পড়ে যা আইনের দৃষ্টিতে দ-নীয় অপরাধও বটে তখন এদেশের নিরীহ ও শান্তিপ্রিয় মানুষগুলো প্রতিবাদের পরিবর্তে “উপরের নির্দেশে বাধ্য হয়ে কৃত কাজ” বলে মেনে নিয়ে তাদের সকল অপকর্মের এক ধরনের দায়মুক্তি দিয়ে দেয়।
একই ধারণা আমাদের দেশের অধিকাংশ বুদ্ধিজীবী এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলোরও। ফলে বাহিনী সদস্যরাও তাদের সকল ধরনের বেআইনী কার্যেই এক ধরনের দায়মুক্তি অনুভব করে দিনে দিনে তা বৃদ্ধি করেই চলেছে। কিšুÍ না, যে  বেআইনী কার্যটি দেশের একজন সাধারণ মানুষ করলে আইন তাকে অপরাধী সাব্যস্ত করে দ- দেয় সেই একই কার্য যদি কোন আইন রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য করেন তাহলে তার উপরও এই একই দ- প্রযোজ্য হয়। বরং আইনের দর্শনটি তাদের জন্য আরও কঠোর। তা হলো, আইন রক্ষাকারীই যদি জেনেশুনে বেআইনী কার্যে লিপ্ত হয় তবে তার শাস্তি হবে বিধানে উল্লেখের সর্বোচ্চ। আমাদের পার্শ¦বর্তী দেশেও আইন রক্ষা বাহিনীর হাতে ধর্ষণের মত অপরাধের ক্ষেত্রে বর্ধিত শাস্তির বিধান রয়েছে।
সম্প্রতি অপরাধ দমনের চাইতে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনে সরকার আইন রক্ষাকারী  বাহিনীকে ব্যবহার করে খুন, গুম, গ্রেফতার, গ্রেফতারোত্তর পায়ে গুলী করে গুরুতর আহত করা, অস্ত্র-বিস্ফোরক ‘নিজেরা রেখে’ মিথ্যা মামলা রুজু করানো অতঃপর আদালত থেকে রিমান্ডে নিয়ে অমানবিক নির্যাতন করে তাদের পঙ্গু করে দেয়ার মত ঘটনা অহরহ ঘটাচ্ছে। এছাড়াও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে রাজনৈতিক কর্মীদের দ- প্রদান, জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক যথাযথ বাছ-বিচার না করে গ্রেফতারকৃতদের রিমান্ডে দেয়া ইত্যাদির মতো কার্যকলাপ সরকার করাচ্ছে বলেও বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা তথা ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করছেন। কোন অভিযোগেরই আনুষ্ঠানিক নিরপেক্ষ কোন তদন্ত করছে না সরকার। ফলে এই সকল বেআইনী কার্যক্রম ক্রমান্বয়েই আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাহিনী সদস্যরা মনে করছেন যেহেতু তারা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আদেশে এই বেআইনী কাজগুলো করছেন তাই এতে তাদের কোন দায় নেই অথবা ভাবছেন ‘ফৌজদারী-দ-বিধি তাদের জন্য প্রযোজ্য নয়’। তাদের এই মনে করার পিছনে অবশ্য দীর্ঘ প্রায় তিন দশক ধরে চলে আসা এক ধরনের অলিখিত দায়মুক্তির অভিজ্ঞতা কাজ করছে।
দেশের বর্তমান সরকার ব্যবস্থায় একটি রাজনৈতিক দল ক্ষমতা-দায়িত্বগ্রহণ করে থাকে পাঁচ বছরের জন্য। সেই দলের অসংখ্য নেতা-কর্মীর মধ্য থেকে সরকার পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত হন সীমিত কয়েকজন। যার অধিকাংশের মেয়াদকাল তার চেয়েও কম। সঙ্গত কারণেই সেই দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে তাদের সেই ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করার লক্ষ্যে ন্যায়-অন্যায় বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়ার প্রবণতা থাকতেই পারে। বিশেষ করে সেক্যুলার রাজনৈতিক দর্শনে যারা বিশ্বাসী অর্থাৎ যারা পরকাল বিশ্বাস করেন না, পার্থিব জগত দুনিয়াতেই সবকিছু শুরু ও শেষ বলে মনে করেন, তাদের ক্ষেত্রে এটাই বাস্তবতা। কিšুÍ একজন সরকারি কর্মচারী? গড়পরতা ২৫ বছর বয়সী একজন সরকারি কর্মচারী যদি সৃষ্টিকর্তার অনুগ্রহে বেঁচে থাকেন, সুস্থ ও কর্মক্ষম থাকেন তবে ৫৯ বছর বয়স পর্যন্ত অর্থাৎ প্রায় ৩৫ বছর পর্যন্ত তিনি তার ক্ষমতা-দায়িত্বের গ্যারান্টি রাষ্ট্রের নিকট থেকে পেয়ে থাকেন। সময়ের সাথে সাথে সেই ক্ষমতা-দায়িত্বের পরিধি বৃদ্ধি পেতে থাকে। তাই আদেশ প্রদানকারী রাজনৈতিক পরিচালক এবং তা বাস্তবায়নকারী সরকারি কর্মচারীদের কাজকর্মের পদ্ধতি ও মাত্রা হয়ে থাকে ভিন্ন। এই প্রক্রিয়াতেই আমাদের ঔপনিবেশিক প্রভু ইংরেজরা রক্ষা করেছিলেন ক্ষমতা ও দায়িত্বের ভারসাম্য।
প্রসঙ্গের প্রয়োজনেই পেছনের ইতিহাসটা একটু আলোকপাত করছি। আমরা আমাদের অক্ষমতাকে ঢাকার জন্য প্রায়শই উপনিবেশিক আইন-শাসন প্রক্রিয়াকে দায়ী করে বক্তব্য-বিবৃতি দিয়ে থাকি। দর্শক-শ্রোতারাও তা খুব পছন্দ করে হাত তালি দেয়। কিšুÍ এ পর্যন্ত কাউকে সুনির্দিষ্টভাবে বলতে শুনলাম না ঔপনিবেশিক কোন আইনটির কোন ধারা আমাদের স্বাধীনতাত্তোর প্রণীত আইনের তুলনায় অগণমুখী অথবা  কোন অপরাধকর্মের বিধানটি তারা তাদের প্রণীত আইনে রেখে যাননি। সতেরশ খ্রিস্টাব্দের গোড়ার দিকেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মাধ্যমে সাম্রাজ্য সম্প্রসারণবাদী বৃর্টিশ ইংরেজরা এ দেশে পদার্পণ করেছিল। সুচতুর এবং উচ্চশিক্ষিত ইংরেজরা বণিকের ছদ্মাবরণে আসলে এদেশের শাসনক্ষমতা গ্রহণের প্রক্রিয়া তখন থেকেই শুরু করে দেয়। প্রায় চল্লিশ বছর গ্রাউন্ড ওয়ার্ক সম্পন্ন করার পর ১৭৫৭ সালে পলাশীর বিশ্বাসঘাতকতার মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে তারা এদেশের শাসনভার গ্রহণ করে। এরপর আরো দীর্ঘ প্রায় একশ বছর এদেশ-এদেশের মানুষ, সেই মানুষগুলোর শিক্ষা-সংস্কৃতি, আচার-আচরণ, কামনা-বাসনার মাত্রা ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ করে প্রথম অপরাধ ও অপরাধী সম্পর্কিত যে আইন তারা প্রণয়ন করে, তারই নাম “দ-বিধি ১৮৬০”। এর পরপরই “পুলিশ আইন ১৮৬১” প্রণয়নের মাধ্যমে সৃষ্টি করা হয় সেই আইন প্রয়োগের জন্য একটি বাহিনী। আমরা বলি, “এ দেশের মানুষকে শাসন-শোষণ করার জন্য সেই আদলেই সৃষ্টি করা হয় এই পুলিশ বাহিনী।” এতদসত্ত্বেও “অসীম ক্ষমতার অধিকারী” সেই পুলিশ যাতে দেশের নিরীহ-নিরপরাধ মানুষগুলোর ওপর হায়েনার মূর্তিতে আবির্ভূত হতে না পারে তা প্রতিরোধে তারা বিভিন্ন অবয়বে বিধান রাখে সেই দ-বিধি আইনে। অর্থাৎ বাহিনী সৃষ্টির পূর্বেই তারা প্রণয়ন করে বাহিনীর আচার-আচরণ ও শাস্তি সম্পর্কিত বিধি-বিধান। ১৮৬০-৬১ সালে দ-বিধি-পুলিশ আইন প্রণীত হলেও এর আলোকে কোনো অপরাধীকে বিচারের আওতায় আনার পদ্ধতি-প্রক্রিয়া কি হবে তা এই উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থানের অবস্থা ভেদে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ তখন সিদ্ধান্ত নিতেন। এরপর প্রায় চল্লিশ বছর পর পাক-ভারত উপমহাদেশের সমগ্র অঞ্চলের জন্য একইরকম পদ্ধতির প্রচলন করা হয় “ফৌজদারী কার্যবিধি ১৮৯৮” প্রণয়নের মাধ্যমে। অবশ্য এরমধ্যে তারা প্রণয়ন করে সাক্ষ্য গ্রহণ-প্রদান সংক্রান্ত আইন যা “সাক্ষ্য আইন ১৮৭২” নামে পরিচিত। অর্থাৎ আগমনের পর প্রায় দুইশত বছর এদেশ তথা এদেশের মানুষ সম্পর্কে নিবিড় পর্যবেক্ষণ সমাপনান্তে পৃথিবীর সবচাইতে জ্ঞানী, সুশিক্ষিত ও আইন সুরক্ষাকারী জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত, যে জাতির সাম্রাজ্যে তখন সূর্য অস্তগামী হত না, সেই বৃটিশরা প্রণয়ন করে একটি পূর্ণাঙ্গ ফৌজদারী অপরাধ আইন ব্যবস্থা। যা খুব ছোট-খাট সংশোধনী ছাড়া প্রায় অবিকল অবস্থায়ই এখন পর্যন্ত এই উপমহাদেশে বলবৎ আছে। বিদ্যা-শিক্ষা ও বিবেক-বুদ্ধি থেকে অনেক দূরে সরে যাওয়া জাতি হিসাবে শুধু আমরাই নয় এমনকি তুলনামূলক অগ্রসর এই উপমহাদেশের অন্যান্য কোন জাতিও সেই “ঔপনিবেশিক আইন থেকে” পরিপূর্ণভাবে বের হয়ে নতুন কিছু প্রণয়নের যোগ্যতা এখন পর্যন্ত প্রদর্শন করতে পারেনি।
স্বাধীনতাত্তোর এদেশে পুলিশের কার্যক্রম পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস সৃষ্টিকারী এই বিভাগটি ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত সেই সময়কার রক্ষীবাহিনী সৃষ্ট সরকারের কাছে দেশের অন্যান্য বাহিনীর মতই ছিল নিতান্তই গুরুত্বহীন ও তল্পিবাহক একটি বাহিনী। ফলে তৎকালীন ক্ষমতাসীনদের সকল বৈধ-অবৈধ আদেশ-নির্দেশ পালনই তখন তাদের একমাত্র দায়িত্ব হিসাবে তারা গণ্য করত।
১৯৭৫ এর পট পরিবর্তনের পর দেশে ক্রমান্বয়ে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসা শুরু হলে পুলিশী কার্যক্রমকে সময়ানুগ ও দ্রুততম উপায়ে জনগণের দ্বারপ্রান্তে তাদের সেবা পৌঁছে দেবার লক্ষ্যে ১৯৭৬ সালে ঢাকা মেট্রোপলিটল পুলিশ অধ্যাদেশ এবং ১৯৭৯ সালে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে এই বাহিনীকে জনমুখী ও আধুনিকায়ন করার প্রথম উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এই সময় পুলিশের সর্বস্তরের নিয়োগের ক্ষেত্রেও নেয়া হয় বিশেষ সতর্কতা। মেধা ও সুস্বাস্থ্যকে একমাত্র  যোগ্যতা বিবেচনা করা হত ঐ সময়কার নিয়োগসমূহে। এতে খুব অল্প সময়েই তার সুফল পেতে শুরু করে এদেশের মানুষ। এ ধারা অব্যাহত থাকে আশির দশকের প্রথম কয়েক বছর। কিন্তু তারপরই আবার শুরু হয় সামরিক শাসন। সামরিক শাসনে পুলিশ পরিণত হয় আজ্ঞাবহ বাহিনীতে। কেননা, এইসময় দেশে প্রচলিত সিভিল আইনের পরিবর্তে স্থান পায় সামরিক আইন।
১৯৭০ থেকে ১৯৯০ এই বিশ বছর শুধু ক্ষমতাসীনদের আজ্ঞা পালন করতে করতে পুলিশ প্রায় ভুলেই যায় আইন তাদের কি দায়িত্ব-কর্তব্য নির্ধারণ করে দিয়েছে বা তার ব্যত্যয় ঘটলে কি শাস্তি পেতে হবে। বরং সে জায়গায় তাদের মনে স্থান করে নেয় যে ভয়ঙ্কর দর্শনটি তা হলো, “ক্ষমতাসীনদের আদেশ পালনই, হোক তা আইনের দৃষ্টিতে বৈধ বা অবৈধ, তাদের একমাত্র দায়িত্ব ও কর্তব্য।”
দুর্ভাগ্য এ দেশের নিরীহ-শান্তিপ্রিয় ও আইন মান্যকারী পরিশ্রমী মানুষগুলোর। কেননা ১৯৯১ পরবর্তীতে জনগণের ভোটে নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার পদ্ধতি চালু হবার পরও কোন সরকারই হয় বেখেয়ালভাবে অথবা নিজের ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করার মানসে ১৯৭৬-১৯৮২ এর মত কোন কার্যক্রম আর গ্রহণ বা বাস্তবায়ন করেনি। বরং এই সময়ের কোন কোন সরকার তাদের প্রতিপক্ষ বিরোধী দল ও মতকে দমন-পীড়নে এই বাহিনীকে যথেচ্ছ অপব্যবহার করায় পুলিশের পূর্ববর্তী কোন বেআইনী আচরণের জন্য পরবর্তীতে তাদের দায়বদ্ধ করেনি। উল্টো পূর্ববর্তীদের প্রদর্শিত পথগুলোকে আরও ভয়ঙ্করভাবে অপব্যবহার করে আসছে এদের দিয়ে। এরই ধারাবাহিকতা আজ আমাদের সর্বস্তরে আস্থা ও নিরাপত্তাহীনতা। এভাবে একটা স্বাধীন দেশ চলতে পারে না।
আমরা এখন দেখার চেষ্টা করি বৃর্টিশ ঔপনিবেশিকদের তৈরি সেই আইনে সংশ্লিষ্ট কি কি বিধান উল্লেখিত আছে।
১. যে আইন দিয়ে পুলিশ বাহিনীর সৃষ্টি সেই পুলিশ আইন ১৮৬১ এর ধারা পুলিশ-২৩ এ বলা হয়েছে : “সকল পুলিশ অফিসারের কর্তব্য বলিয়া গণ্য হইবে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের সকল বৈধ আদেশ দ্রুত পালন বা কার্যকরী করা।”
একইভাবে ঢাকা মহানগর পুলিশ অধ্যাদেশ ১৯৭৬ এর ধারা ডিএমপি-১৫ এ বলা হয়েছে: “পুলিশ অফিসারগণের সাধারণ কর্তব্য হইবে স্বীয় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার আইনসঙ্গত নির্দেশসমূহ আইনসঙ্গত উপায়ে কার্যকরী করিবার চেষ্টা করা।”
বৈধ বা আইনসঙ্গত আদেশ পালন প্রসঙ্গের বিষয়টি পরিষ্কার করার জন্য ছোট্ট একটি উদাহরণের অবতারণা করছি-ধরা যাক একজন পুলিশ ইন্সপেক্টর/সাব-ইন্সপেক্টর একটি গাড়িতে ভ্রমণ করছেন যে গাড়িতে আছেন একজন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বা রাজনৈতিক ক্ষমতাসম্পন্ন কোন এমপি বা মন্ত্রী। হঠাৎ দেখা গেল যে, গাড়ির সামনে মোটর সাইকেল আরোহী এক যুবক যাকে বার বার হর্ণ দেবার পরও এই গাড়িকে সাইড দিচ্ছে না। এতে আরোহী ব্যক্তিটি ভীষণ বিরক্ত হচ্ছেন। অবশেষে কোনভাবে মোটর সাইকেলটিকে ওভারটেক করা সম্ভব হল এবং ড্রাইভার তার গাড়ি আড় করিয়ে সেই যুবকটিকে যখন ব্লক করে ফেলল তখন গাড়িতে থাকা উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বা রাজনৈতিক ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তিটি উপস্থিত ইন্সপেক্টর/সাব-ইন্সপেক্টরকে উদ্দেশে করে বলে উঠলেন, “হেই অফিসার তুমি নিচে নেমে তোমার বিভলভার দিয়ে ঐ যুবকের যেকোন এক চোখ বরাবর গুলী করে দাও। ব্যাটা চোখে দেখে না? ও’র এত বড় সাহস আমাদের গাড়িকে সাইড দেয় না।”
এ ক্ষেত্রে আদেশটি কি বৈধ বা আইনসঙ্গত? না কিছুতেই নয়। মোটরসাইকেল আরোহী যুবকের এই অপরাধের জন্য তাকে ঐ রাস্তায় এমন শাস্তি দেয়া যায় না যাতে সে তাৎক্ষণিকভাবে মৃত্যুবরণ করে। সুতরাং, এই আদেশটি অবৈধ ও বেআইনী। তাই এই আদেশ অনুসরণে যদি সেই অফিসার যুবকটিকে গুলী করে হত্যা করে তাহলে সে এই বলে পাড় পাবে না যে, “আমার ঊর্ধ্বতন কর্র্র্তৃপক্ষের আদেশে আমি গুলী করেছি তাই আমার এতে কোন দায় নেই; সব দায় আদেশ দানকারীর।”
এটা বলে সেই অফিসার সাধারণ মানুষ বা আদালত কোথাও সেই হত্যাকা-ের দায় থেকে রেহাই পাবেন না। কখনই না। এরকম পরিস্থিতি হলে আদেশ দানকারীর শাস্তি যাই হোক না কেন পালনকারীর শাস্তি হবে মৃত্যুদ- বা ন্যূনতম যাবজ্জীবন কারাদ-। বরং আদেশ দানকারী ব্যক্তিটি যদি পুলিশ অফিসার না হয়ে  কোন রাজনীতিবিদ হন তাহলে ঘটনা পরবর্তী বিচার চলাকালে তিনি আদেশ প্রদানের বিষয়টি অস্বীকারও করতে পারেন বা নিদেনপক্ষে তিনি আইন জানতেন না বলে আদালতের কাছে অজুুহাতও দেখাতে পারেন  যেটি ঐ আদেশ পালনকারী ঐ পুলিশ অফিসারের পক্ষে কখনই সম্ভব বা সুযোগ হবে না। 
এক্ষেত্রে বৈধ বা আইনসঙ্গত আদেশ কোনটি হতো? যদি বলা হতো: “ঐ যুবককে গাড়িসহ আটক কর। তার বৈধ ড্রাইভিং লাইসেন্স তথা মোটরসাইকেলের বৈধ লাইসেন্স আছে কি না চেক করো অতঃপর বেপরোয়া গাড়ি চালনার শাস্তি বিধানের জন্য তাকে আদালতে সোপর্দ করার ব্যবস্থা করো।”
সুতরাং, ঊর্ধ্বতন বা ক্ষমতাবান কোন ব্যক্তির অবৈধ বা বেআইনী আদেশ পালন কোন অফিসারকেই কখনো তার কৃত অপরাধ হতে রক্ষা করতে পারে না। অন্তত আইন তাই বলে।
আইনের পরিভাষায় অপরাধ এবং অপরাধী কাকে বলে?
 এ সংক্রান্তে বর্তমানে যে সকল আইন বলবৎ রয়েছে তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ফৌজদারী কার্যবিধি আইন ১৮৯৮ এবং দ-বিধি আইন ১৮৬০। কার্যবিধি আইন দ্বারা সমুদয় কার্য পদ্ধতি এবং দ-বিধি আইনে অপরাধের দ-ের বিধান উল্লেখ করা হয়েছে।
সেই কার্যবিধি আইনের ধারা কার্য-৪(ণ) এ অপরাধ সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, “অপরাধ হইতেছে সেই সকল কার্য বা কার্যে বিরতি যাহা বর্তমানে বলবত কোন আইনে শাস্তিযোগ্য করা হইয়াছে।” অর্থাৎ যে কার্যটি আইনের দৃষ্টিতে অপরাধ বলে বর্ণনা করা হয়েছে শুধুমাত্র সেইসকল কার্য অপরাধ বলে গণ্য হবে। আর যিনি এই কার্যটি সম্পন্ন করবেন বা সহায়তা করবেন বা ক্ষেত্রবিশেষে যা রোধ করা তার আইনী দায়িত্ব তাহা রোধ করা হতে বিরত থাকবেন তিনিই অপরাধী বলে গণ্য হবেন।
আইনে অপরাধের গুরুত্ব ভেদ আছে। কোন কোন অপরাধকে গুরুতর আবার কোন কোন অপরাধকে তুলনামূলক লঘু বিবেচনা করে দ-ের মেয়াদ নির্ধারণ করা হয়েছে। যেমন খুন-গুম, ধর্ষণ ইত্যাদিকে গুরুতর অপরাধ বিবেচনা করে তার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ-ের বিধান রাখা হয়েছে। আবার গুরুতর আহত করা, হত্যার চেষ্টা করা ইত্যাদির জন্য ১০ বছর বা যাবজ্জীবন কারাদ- এবং অন্যায়ভাবে আটক ও নির্যাতন ইত্যাদি অপরাধের জন্য ৩-৫ বছর পর্যন্ত শাস্তির বিধান রয়েছে। অর্থাৎ যে যেমন অপরাধ করবেন তার শাস্তির মাত্রা তেমনই হবে।
অপহরণ ও গুম
অপহরণ ও গুম সম্পর্কে ধারা দ--৩৬৪ এ বলা হয়েছে: “যে ব্যক্তি কোন ব্যক্তিকে, এইরূপ উদ্দেশ্যে অপহরণ বা হরণ করে যাহাতে অনুরূপ ব্যক্তি খুন হইতে পারে বা খুনের বিপদ কবলিত হইতে পারে বলিয়া আশঙ্কার সৃষ্টি হয়, তবে সেই ব্যক্তি এই ধারার অপরাধে দোষী হইবে। যাহার শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদ-”।
উদাহরণ: ‘ক’ খুন করিবার উদ্দেশ্যে যহাকে তাহার ঘর হইতে বলপূর্বক ছিনাইয়া লইয়া যায়। ‘ক’ এই ধারায় বর্ণিত অপরাধ করিয়াছে।
এ বিষয়ে উচ্চ আদালতের নির্দেশগুলো এরকম:
(১) জোর করিয়া লইয়া যাইবার পরে যদি ভিকটিম খুন হয় তবে আসামীকে ৩৬৪ ধারায় চার্জ না করিয়া খুনের জন্য (দ--৩০২) বা খুনের সহায়তার জন্য চার্জ করা উচিত। [২৯ ডিএলআর ১ এসসি] এবং  [১ ডিএলআর ১৭২]
 (২) ভিকটিমকে খুনের উদ্দেশ্যে অপহরণ করা অথবা ভিকটিমকে এমন একটি বিপদের মুখে ফেলিতে হইবে যাহাতে সে খুন হইয়া যাইতে পারে বলিয়া তাহার মনে ভীতির সঞ্চার হয়। এমন ধরনের অপহরণের ক্ষেত্রেই ৩৬৪ ধারা প্রযোজ্য হয়।  [হাফেজ আবুল খায়ের বনাম রাষ্ট্র; ৩০ ডিএলআর (১৯৭৮) (৩সি) ২]
(৩) দ--৩৬৪ ধারার অপরাধ শাস্তিযোগ্য করিতে হইলে অপহরণকারীর যে দুষ্ট অভিপ্রায় ছিল তাহা প্রমাণ করিতে হয়। প্রত্যক্ষ বা চাক্ষুষ প্রমাণের অনুপস্থিতিতে বাদীকে পারিপার্শিক অবস্থা এবং অপরিবর্তনীয় ঘটনা দ্বারা প্রমাণ করিতে হয় যে, যেকোন যুক্তিসঙ্গত ব্যক্তি অথবা স্বাভাবিক বিচার-বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তির বিবেচনাও ইহা অনুমিত যে, ভিকটিমকে হত্যা করিবার অভিপ্রায়েই অপহরণ করা হইয়াছিল।         [৩৩ ডিএলআর ৯৭]
অস্ত্র ও বিস্ফোরক আইনের বিধানাবলী
 অস্ত্র আইন, ১৮৭৮ এর ধারা অস্ত্র-১৪ ও ১৯(চ) এবং বিস্ফোরক উপাদানাবলী আইন, ১৯০৮ এর ধারা বিস্ফোরক-৫ এর বর্ণনানুযায়ী, “যদি কেউ কোন আগ্নেয়াস্ত্র বা বিস্ফোরক পদার্থ নিজ দখলে রাখেন তবে তার শাস্তি হতে পারে সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদ- বা ১৪ বছরের কারাদ-”।
লক্ষণীয় যে, এই যদি কেউ আইন রক্ষা বাহিনীর সদস্য যদি হন তাহলে তার প্রতি “এই ধারা প্রযোজ্য হবে না” এমন কোন ব্যাখ্যা বা নির্দেশনা আইনে দেয়া নেই।
হরহামেশাই আমরা শুনে থাকি বিশেষ করে গত ১১/০৩/২০১৩ তারিখে বিএনপি’র কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে উদ্ধারকৃত বিস্ফোরক বোমা উদ্ধারের বিষয়ে পরদিনই দৈনিক আমার দেশে একটি খবর প্রকাশিত হয় যার সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিন্নরূপ:
ককটেল উদ্ধার নাটক পুলিশের পরস্পরবিরোধী বক্তব্য
গতরাতে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ইতিহাসের জঘন্যতম পুলিশি তা-বের সময় ককটেল উদ্ধারের নাটক সাজানো হয়েছে। তবে পুরো তা-ব টেলিভিশনে লাইভ সম্প্রচার হওয়ায় ককটেল উদ্ধারের পুরো বিষয়টি যে নাটক ছিল তা অনেকের চোখেই পরিষ্কারভাবে ধরা পড়েছে। আবার ককটেল উদ্ধারের স্থান ও সংখ্যা নিয়ে পুলিশ ও ডিবি কর্মকর্তাদের পরস্পরবিরোধী বক্তব্যে বিষয়টি আরও খোলাসা হয়ে গেছে। দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলের  কেন্দ্রীয় দফতরে অভাবনীয় তা-বকে জায়েজ করার জন্য ককটেল নাটকের অবতারণা করা হয়েছে বলে মনে করছেন বিএনপি  নেতারা....।’ 
উপরিউক্ত বর্ণনাটি যদি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত/অনুসন্ধান সাপেক্ষে সত্য প্রমাণিত হয় তাহলে ঐ বিস্ফোরক পদার্থ অবৈধভাবে দখলে রাখার জন্য কি সংশ্লিষ্ট উদ্ধারকারীদের মধ্যেই কেউ দায়ী হয়ে যায় না? উত্তর যদি হ্যাঁ হয় তাহলে কি তাদের শাস্তি হওয়া উচিত হয় বিধানে উল্লেখের সর্বোচ্চ? এ প্রশ্নটিও থাকল সম্মানিত পাঠকের প্রতি।
পুলিশের গ্রেফতারের ক্ষমতা
মামলা সংক্রান্তে কোন ব্যক্তিকে গ্রেফতারের ক্ষেত্রে পুলিশ নি¤œবর্ণিত তিন ধরনের যে কোন এক বা একাধিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে থাকে।
     (১) এজাহারনামীয়/বর্ণিত আসামী।
     (২) এজাহারে নাম/বর্ণনা নেই তবে তদন্তকালে পুলিশের নিকট কেউ প্রকাশ্য সাক্ষ্য-প্রমাণ প্রদান করলে।
     (৩) এজাহারেও নাম/বর্ণনা নেই আবার পরিচয় প্রকাশের ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত কোন সাক্ষীর নিকট থেকে প্রকাশ্য কোন সাক্ষ্য-প্রমাণও পাওয়া যাচ্ছে না, এরকম ক্ষেত্রে তা সবিস্তার কেস ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ করার মাধ্যমে মামলার সাথে সম্পৃক্ত করে।
তবে এক্ষেত্রে সম্পৃক্তকৃত ব্যক্তিটির পূর্ববর্তী ও বর্তমান স্বভাব-চরিত্র ও আচরণ, ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট থাকার স্বপক্ষে সুদৃঢ় ও বিশ্বাসগ্রাহ্য যৌক্তিকতা ইত্যাদি বিষয় সততা ও সুবিচারিক মন নিয়ে তদন্তকারী কর্মকর্তাকে দেখতে হয়।
এজাহার বর্ণিত আসামী এবং তদন্তকালে প্রকাশ্য সাক্ষ্য-প্রমাণ দেয়ায় সংশ্লিষ্ট আসামীকে গ্রেফতারের ক্ষেত্রে পুলিশের আইনী কিছু বাধ্য-বাধকতা আছে (ধারা দ--২২১ দ্রষ্টব্য)।
কিন্তু গোপন সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া আসামী গ্রেফতারের স্বাধীন ও একছত্র ক্ষমতা তদন্তকারী কর্মকর্তার। তাই এ ধরনের ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে পর্যাপ্ত ও আদালতে প্রমাণ করার মত যথেষ্ঠ সাক্ষ্য-যুক্তি উপস্থাপন করা যাবে মর্মে নিশ্চিত না হয়ে গ্রেফতার করা হলে তা হয়রানিমূলক গ্রেফতার হিসেবে গণ্য হয় এবং তার একক দায়-দায়িত্ব গ্রেফতারকারী কর্মকর্তার উপর বর্তায়। এ ধরনের হয়রানিমূলক আটকের কারনে ভুক্তভোগী সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দ--৩৪২ বা ২২০ ধারায় অভিযোগ করতে পারেন। যার সর্বোচ্চ শাস্তি ৭ বছরের কারাদ-।
অন্যদিকে এজাহার বর্ণিত আসামী এবং তদন্তকালে প্রকাশ্য সাক্ষ্য-প্রমাণ দেয়ায় কোন ব্যক্তিকে আইনী বাধ্য-বাধকতার কারণে পুলিশ গ্রেফতারে বাধ্য হলেও তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট যদি প্রতীয়মান হয় যে, এজাহার বর্ণনা বা প্রকাশ্য সাক্ষ্য যাই দেয়া হোক গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিটি ঘটনার সাথে আদৌ জড়িত কিনা তা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণের জন্য আরো তদন্তের প্রয়োজন। তাহলে কার্য-৪৯৬ বা ৪৯৭(২) ধারা অনুযায়ী তাঁকে জামিন দিয়ে দিবেন। ধারা পিআরবি-৩১৭(খ) সেই নির্দেশনাই দেয়।
গ্রেফতারকৃত আসামীকে জামিন বা রিমান্ড প্রদানের ক্ষেত্রেতো বটেই তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তার গৃহীত পদক্ষেপগুলো যথাযথ হচ্ছে বা হয়েছে কিনা তা  দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার মূল দায়িত্ব নিন্ম আদালতের সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্টেট বা জজের।
নির্দোষ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মিথ্যা এজাহার দায়ের বা প্রকাশ্য মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান করবেন তার বিরুদ্ধেও আইনে রয়েছে সুস্পষ্ট বিধান। ধারা দ--১৮২, ২১১ এবং ১৯৩ মোতাবেক এর সর্বোচ্চ শাস্তি ৭ বছরের কারাদ-। ধারা দ--১৯৪ এ বলা হয়েছে, সেই মিথ্যা সাক্ষ্য উদ্ভাবন যদি হয় মৃত্যুদ-যোগ্য কোন অভিযোগের এবং সেই মৃত্যুদ- যদি আদালতের রায়ে কার্যকর হয়ে যায় তবে সাক্ষ্য উদ্ভাবনকারীর শাস্তিও হবে মৃত্যুদ-।
মামলার কেস ডায়েরিতে মিথ্যা ও মনগড়া তথ্য লিপিবদ্ধকারী তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও আনয়ন করা যায় ক্ষেত্রভেদে দ--১৯৩ ও ২২০ এর অভিযোগ; যার সর্বোচ্চ শাস্তিও ৭ বছরের কারাদ-।
আইন রক্ষাকারী বাহিনীর কতিপয় অতি উৎসাহী সদস্য যে সকল কাজগুলো বুঝে অথবা আইন না জেনে করছেন তাদের তথা এদেশের শান্তিপ্রিয় আইন মান্যকারী জনগণের উদ্দেশ্যেই আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস। আমার লেখার শুরুতেই বলেছি এ অবস্থা একদিনে হয়নি। যথাযথ সম্মানের সাথেই বাধ্য হয়েই উল্লেখ করছি, এক সময় এ দেশের সেরা মেধাবী, উচ্চ শিক্ষিত ও পরোপকারী-নির্লোভ মানুষগুলোই রাজনীতিতে আসতেন। যাদের সকল চিন্তা-চেতনা আবর্তিত হতো দেশ ও জনগণের কল্যাণকে ঘিরে। তাঁরা কখনই নিজের সুখ-সুবিধার কথা ভাবতেন না বা রাজনীতিকে জীবন-জীবিকার একমাত্র পেশা হিসবে গণ্য করতেন না। সেই কারণেই পৃথিবীর সেই সময়কার সর্ববিষয়ে শক্তিশালী বৃর্টিশদের পরাধীনতা থেকে আমরা মুক্ত হতে পেরেছিলাম। বর্তমানে সে সময় বা পরিবেশ কোনটিই নেই। এখন মেধাবীরা হয় বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে অথবা যারা সে সুযোগ না পাচ্ছে তারা সিভিল-মিলিটারী সার্ভিসে আসছে নতুবা অন্যান্য পেশায় নিজেকে নিয়োজিত করছে। রাজনীতিতে মেধাবী ব্যক্তির পদচারণা এখন বলতে গেলে  বিরল। কিšুÍ দেশের রুল্স অব বিজনেস রয়েছে অপরিবর্তিত। অর্থাৎ সিভিল-মিলিটারী অফিসার তথা অন্য পেশাজীবীরা যতই মেধাবী বা দক্ষ হোন না কেন কাজ করতে হচ্ছে উচ্চতর কর্তৃত্বাধীন রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের অধীন এবং আদেশেই। ফলে জ্ঞান বা বিদ্যাচর্চা ক্রমান্বয়ে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। কিšুÍ এ অবস্থা আর বেশিদিন চলবে বলে মনে হচ্ছে না। কেননা, অক্ষম রাজনৈতিক ব্যক্তিরা নিজেদের দুর্বলতা আড়াল করার জন্য এমন এমন সব ইস্যু সৃষ্টি করে এ দেশের মানুষকে বিভ্রান্ত করে রাখছে যা বর্তমান প্রজন্ম বিশেষ করে যাদের জন্ম ষাটের দশকে ও তার পরে তারা তা মানতে পারছে না। তার সাম্প্রতিক প্রমাণ শাহবাগ স্কোয়ার এবং শাপলা স্কোয়ার কেন্দ্রিক তরুণদের জাগরণ। যদিও উভয় স্কোয়ারের তরুণ ও নবীনরা অনভিজ্ঞতার কারণে তাদের আকাক্সক্ষার চূড়ান্তরূপ আনতে সক্ষম হয়নি কিšুÍ তাতে কি? মতলববাজ রাজনীতিবিদদের জন্য একটা বার্তাতো রাখতে পেরেছে।
স্বাধীনতাত্তোরকাল থেকে এখন পর্যন্ত শাসকশ্রেণী আইন রক্ষাকারী বাহিনীকে ক্রমবর্ধমান হারে তাদের নিজ স্বার্থে ব্যবহার করায় কেউই তাদের পূর্ববর্তী অবৈধ ও বেআইনী কর্মকা- নিয়ে কোন প্রশ্ন তোলেনি, এটি ঠিক কিন্তু তাই বলে ভবিষ্যতেও যে তুলবে না এমনটি ভেবে “মন যা চায় তাই করা” থেকে এখনও যদি সংশ্লিষ্টরা বিরত না হন তবে ভবিষ্যতে কষ্ট পেতে হতে পারে তাদের নিজেদের তথা নির্ভরশীল সন্তান-সšুÍতির। উপরšুÍ ব্যবস্থা যে একেবারে নেয়া হচ্ছে না তাওতো নয়। দায়িত্ব পালনকালীন সময়ের সত্য-মিথ্যা, কম-বেশি অভিযোগে সিভিল-মিলিটারি-পুলিশ প্রমুখ বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নিয়মিত একাধিক মামলাতো ইদানীং হয়েছে ফলশ্রুতিতে ইতোমধ্যে অনেকে দীর্ঘদিন কারাবরণ করেছেন বা করছেনও। গ্রেফতার বা কারাবরণ এড়াতে অনেকেই রয়েছেন পলাতক।
২৫ মে ২০১৩ তারিখে একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত খবরে সত্য-মিথ্যা ঐ সকল অভিযোগে অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তা ও তাদের পরিবারের সদস্যদের অসহায়ত্ব ও দুর্গতির কিছু চিত্র বর্ণনা করা হয়েছে। সেই প্রতিবেদনে যাদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে তারা অনেক দোষী না।
এদের মধ্যে শুধু মাত্র প্রফেশনাল জেলাসী ও তার সাথে কিছু রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থে ব্যর্থ হয়ে ক্ষমতাবানরা তাদের এই দুর্গতি করেছেন। বর্তমানে তারা যথেষ্ট পরিমাণ আর্থিক ও নিরাপত্তা ঝুঁকিতে থাকলেও সেই সকল অফিসার বা তাদের পরিবারের সদস্যরা মনের দিক থেকে এখনো অনেক মজবুত আছেন এই মনোবলে যে তারা কোন অন্যায় করেননি। বিনা অন্যায়ে তাদের প্রতি যে জুলুম চলছে তা সাময়িক  কিšুÍ যারা প্রকৃতই অপরাধ করে বিপদে আছেন বা আল্লাহ না করুন ভবিষ্যতে থাকবেন তাদের কি সেই মনোবল থাকবে? তারা কি সেই করুণ পরিণতির কথা কখনও চিন্তা করছেন?
সরকারি কর্মচারীদের রাষ্ট্র ও আইন কর্তৃক প্রদত্ত ক্ষমতা-দায়িত্বের দু’টি দিক রয়েছে। একটি  উপভোগ্যতা অপরটি বেদনা। উপভোগ্যতা হলো কর্তৃত্ব-সম্মান-মর্যাদা-বৈভব ইত্যাদি আর বেদনা হলো তা পালনে ব্যর্থতার গ্লানি ও পরিণামে শাস্তি।
ধারা কার্য-৪(ণ) এর বর্ণনানুযায়ী “বলবৎ আইনে নিষিদ্ধ কোন কার্য করা এবং আইনগতভাবে যা কেউ করতে বাধ্য তা না করা” ‘অপরাধ’ বলে গণ্য হয়।
এদের বিরুদ্ধে কর্তব্য পালন সম্পর্কিত অভিযোগের ধরনও হয়ে থাকে দুই ধরনের। একটি উদাসীনতার কারণে কর্তব্যচ্যুতি অন্যটি পূর্ব-পরিকল্পনা মতে উদ্দ্যেশ্যমূলক জেনে-শুনে কর্ম করা বা আইনানুগভাবে কর্ম করা হতে বিরত থাকা। অভিযোগ প্রথম ধরনের প্রমাণ হলে তা হয় অসদাচরণ বা কর্তব্যে-গাফিলতি, যার ধরণ প্রশাসনিক এবং সর্বোচ্চ শাস্তি চাকরিচ্যুতি। কিন্তু যদি তা হয় দ্বিতীয় ধরনের তবে তা বিবেচিত হয় অপরাধ হিসেবে, যার ধরন আইনী এবং শাস্তি আইনে বর্ণিত বিধান অনুযায়ী কারাদ- বা মৃত্যুদ-।
বর্তমান প্রচলিত আইনে সাধারণ মানুষ আর সরকারি কর্মচারীগণের আইনানুগ বিচারের সম্মুখীন করবার ক্ষেত্রে একমাত্র পার্থক্য হলো : সাধারণ মানুষকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে কারও কোন অনুমোদনের প্রয়োজন হয় না, শুধু যুক্তিগ্রাহ্য সত্য সাক্ষ্য-প্রমাণ দ্বারা অপরাধী প্রমাণ করতে পারলেই হয়। কিšুÍ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর ক্ষেত্রে বাড়তি একটু ব্যবস্থা ধারা কার্য-১৯৭ এর বিধান অনুযায়ী সরকারের অনুমোদনের প্রয়োজন হয় মাত্র। তার চেয়ে বেশি কিছু নয়।
ধারা কার্য-১৯৭ এ বলা হয়েছে, “কোন জজ, কোন ম্যাজিস্ট্রেট অথবা কোন সরকারি কর্মচারী যখন কোন অপরাধে অভিযুক্ত হন, যাহা তিনি তাহার সরকারি দায়িত্ব পালনকালীন সময়ে করিয়াছেন বলিয়া দাবি করা হইয়াছে, তখন সরকারের পূর্ব-অনুমতি ব্যতীত কোন আদালত সেই অভিযোগ আমলে নিবেন না”।
মিথ্যা সময়ের সাথে সাথে এলোমেলো হয়ে যায় কিন্তু সত্য চিরদিন অবিচল ও স্থির থাকে। তাই স্মৃতি ভ্রষ্ট না হওয়া পর্যন্ত সত্য নির্ণয় বা সত্য প্রমাণ কখনই কঠিন হয় না।
যে সকল কাজগুলো বর্তমানে যারা করছেন তা  যৌক্তিক ও যথাযথ আইনসম্মত উপায়ে হয়েছে কি না; কোন রাগ-অনুরাগ, বৈধ-অবৈধ সুবিধা প্রাপ্তির আশায় কাউকে সšুÍষ্ট করার উদ্দেশ্যে কারো প্রতি জুলুম-অত্যাচার হয়েছিল কি না; তাদের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী আচরণ যথার্থ ছিল কি না; তাদের কোন বেআইনী কর্মকা-ের কারণে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কিনা ইত্যাদি বিষয়গুলো প্রকাশ্য তদন্ত/অনুসন্ধানের মাধ্যমে সত্য উদঘাটন করার নিমিত্তে প্রতি জেলায় এমন একটি তদন্ত/অনুসন্ধান কমিটি সরকার যদি গঠন করে দেয়, যার সদস্য হন একজন অতিরিক্ত জেলা জজ, একজন এডিসি, একজন এডিএসপি, সংশ্লিষ্ট পিপি এবং সংশ্লিষ্ট প্রেসক্লাবের সভাপতি। অতঃপর এমন গঠিত একটি কমিটি যদি তদন্ত/অনুসন্ধানপূর্বক কোন মতামত দেয় তাহলে তা কি উপেক্ষা করা কারও পক্ষে সহজ হবে? তখন কি অবৈধ বা বেআইনী মৌখিক আদেশদাতাগণ তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলবেন, “ও’র কোন দোষ নেই সব দোষ আমার?” তাদের পূর্বসূরিরা যারা ইতিপূর্বে কর্তৃত্ববানদের আদেশ পালন করে এখন বিপদে আছে তাদের পাশে কি সেই সময়কার কর্তৃত্ববানরা দাঁড়িয়েছে? নাকি অবলীলায় বলে গেছে, “আমি কিছু জানি না; আমি এমন বেআইনী কথা বলতে যাব কেন? আমি শুধু কাজটি করতে বলেছি, সেই কাজ আইনানুগভাবে করার দায়িত্ব তো সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার।”
তাই আইন রক্ষাকারী ভাইদের সনির্বন্ধ অনুরোধ করি, আপনারাতো আমাদের মত এ দেশেরই সন্তান, আমাদেরই কারো না কারো ভাই বা পুত্র, স্বামী বা পিতা। অন্তত সেই সকল পিতা-মাতা, ভ্রাতা-ভগ্নি, সন্তান-সšুÍতির কথা বিবেচনা করেও এখনো সংশ্লিষ্ট আইন এবং উচ্চতর আদালতের নির্দেশনাগুলো মেনে চলুন। তাতে আমরাও বর্তমানে একটু শান্তিতে থাকি আশা করা যায় আপনারাও বর্তমান-ভবিষ্যৎ সবসময়ই ভাল থাকবেন।
এছাড়াও আপনাদের মনে আছে কি না জানি না তাই আমি একটু স্মরণ করিয়ে দেই। আপনাদের পূর্ববর্তীদের হাতে ২০০২ সালে ‘অপারেশন ক্লীনহার্ট’ নামক ‘অপারেশন’ এর ফলে যে ৪১ জন ব্যক্তি বিচার বহির্ভূত হত্যাকা-ের শিকার এবং অজানাসংখ্যক ব্যক্তি আহত হয়েছিলেন তাদের সেই সকল বেআইনী কাজের ‘দায়মুক্তি’ কিন্তু তারা তাদের  সেই সময়কার সংখ্যাগরিষ্ঠতাপ্রাপ্ত পরিচালকদের নিকট থেকে আইনগতভাবে আদায় করতে সক্ষম হয়েছিলেন। অভিজ্ঞতার আলোকেই বলছি আপনারাও ভবিষ্যতের জন্য আপনাদের পরিচালকদের নিকট তাদের ‘একান্ত সেবাদাস’ হিসেবে সে নিবেদন করে রাখতে পারেন। কেননা, পরিসংখ্যাগত দিক থেকে কিšুÍ আপনাদের দ্বারা হতাহতের সংখ্যা পূর্বসূরিদের চাইতে অনেক বেশি।
বর্তমান শাসকদলের বিরুদ্ধে একটি প্রচলিত সাধারণ প্রবাদ হলো, এরা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না বরং ইতিহাস সৃষ্টি করে। গত সাড়ে চার বছরে অনেক ইতিহাস সৃষ্টির মধ্যে অন্যতম একটি দৃষ্টান্ত তারা তৈরি করেছেন তা হলো, দায়িত্ব পালনকালীন সময়ের সত্য-মিথ্যা, কম-বেশি অভিযোগে সিভিল-মিলিটারি-পুলিশ প্রমুখ বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলা গ্রহণের অনুমোদন প্রদান এবং সেই অভিযোগে ইতোমধ্যেই অনেকের দীর্ঘদিনের কারাবরণ। গ্রেফতার বা কারাবরণ এড়াতে অনেকেই দীর্ঘদিন যাবত পলাতকও আছেন। পত্রিকান্তরে যতদূর জানা গেছে, এই সকল কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আইন নিষিদ্ধ কর্ম করা অথবা আইনগতভাবে যে কর্মটি করতে তারা বাধ্য ছিলেন তা করা হতে বিরত থাকার অভিযোগ আনয়ন করা হয়েছে। সুতরাং, সাধু সাবধান !

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads