মঙ্গলবার, ২৭ আগস্ট, ২০১৩

আমরা কি অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের মতো?


সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতার পালাবদলের জন্য একটি অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সব দলের অংশগ্রহণে আনন্দমুখর পরিবেশে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন যথাসময়ে অনুষ্ঠিত হোক সেটাই গণতন্ত্রে বিশ্বাসী দেশবাসীর প্রত্যাশা; কিন্তু তাদের এ প্রত্যাশা কি পূরণ হবে? নির্বাচন-পূর্ব আবহাওয়া বার্তায় এ রকম আভাস খুব কমই মিলছে। বরং একটা দুর্যোগের আশঙ্কায় দেশবাসী আজ শঙ্কিত। দেশের প্রধান বিরোধী দল বলছে, নির্বাচন হতে হবে নির্দলীয়, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে এবং এ দাবি আদায়ের জন্য তারা দেশব্যাপী দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলবে। পক্ষান্তরে, ক্ষমতাসীন দল বলছে, অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের মতোই আমাদের দেশেও আসন্ন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। অর্থাৎ তাদের অধীনেই। এ ব্যাপারে তারাও অনমনীয়। প্রয়োজনে বিরোধী দলের আন্দোলনকে তারা কঠোর হাতে দমন করবে। এর ফলাফল যে ভয়াবহ একটা বিশৃঙ্খলা সে কথা কে না বুঝছে? ক্ষমতাসীন দল জানে, তাদের জনপ্রিয়তায় যে ধস নেমেছে, তাতে সুষ্ঠু নির্বাচনে তারা আর ক্ষমতায় থাকতে পারবে না। সুতরাং যেকোনো উপায়েই হোক তাদের অধীনেই নির্বাচন করতে হবে। বিরোধী দল জানে, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে তাদেরকে ক্ষমতায় যেতে দেয়া হবে না। সে জন্য তাদের চাই নির্দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন। এখন বিবেচনার ভার ছেড়ে দিতে হবে জনগণের ওপর। দেখতে হবে জনগণ কোন্ ধরনের সরকারের অধীনে কী ধরনের নির্বাচন চায়। বিরোধী দল সন্দেহ করছে ক্ষমতাসীন দলের অধীনে কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না। তাদের সন্দেহ যদি অমূলক হয় সেটা খারাপ; কিন্তু রাতের আঁধারে যারা অন্যের বিলবোর্ড দখলের মতো অনৈতিক ও বেআইনি কাজ করছে, যারা প্রশাসনকে চরমভাবে দলীয়করণ করেছে এবং নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন ও শক্তিশালী করার পরিবর্তে যারা একে দুর্বল করার প্রয়াসে লিপ্ত তারা যে নির্বাচনকে নিজেদের পক্ষে প্রভাবিত করবে না তার কি কোনো গ্যারান্টি আছে? ক্ষমতাসীন দলের অন্যান্য দেশের মতো নির্বাচনপলিসি গ্রহণযোগ্য হতো যদি আমাদের দেশের গণতন্ত্রটাও অন্যান্য দেশের গণতন্ত্রের মতো হতো; কিন্তু আমাদের দেশের গণতন্ত্রের অবস্থা তো অনেকটাই সাভারের এক সময়ের রানা প্লাজার মতো। দুর্বল ভিতের ওপর নিম্নমানের সামগ্রী দিয়ে নির্মিত বহুতল প্লাজাটি যেমন কয়েকজন দুর্বৃত্তের ধাক্কাধাক্কিতেইধসে গেছে, আমাদের গণতন্ত্রও তেমনই দলীয় রাজনীতির মাতাল হাওয়ায়যেকোনো সময় মুখ থুবড়ে পড়ে। অনেক কষ্টে সেটাকে আবার লাইফ সাপোর্ট দিয়ে চাঙ্গা করতে হয়। জননেত্রীতন্ত্র ও দেশনেত্রীতন্ত্রের আঘাতে যে গণতন্ত্র প্রতিনিয়ত জর্জরিত হয়, তাকে নিয়ে অন্তত কোনো আদর্শিক কথা বলা চলে না। গণতন্ত্র কাকে বলে তার ছোট্ট একটা উদাহরণ দিচ্ছি। পত্রিকান্তরে জানতে পেরেছিলাম, ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী কোথাও যাওয়ার পথে একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকেছিলেন কফি খাওয়ার জন্য। ওয়েটপারসন ছিলেন একজন বুড়ি। তিনি তার কাছে সরাসরি গিয়ে কফি চাইলেন। বুড়ি তাকে কাস্টমারের লম্বা লাইন দেখিয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে সিরিয়ালি আসতে বললেন। প্রধানমন্ত্রীর তাড়া থাকায় তিনি ওই লাইনে না দাঁড়িয়ে পাশের রেস্টুরেন্টে চলে গেলেন। সম-অধিকারের প্রশ্নে এটাই হচ্ছে প্রকৃত গণতন্ত্র। আমাদের গণতন্ত্রে কি এ ধরনের ঘটনা ঘটার আদৌ কোনো সম্ভাবনা আছে? আব্রাহাম লিঙ্কন গণতন্ত্রকে বলেছিলেন জনগণের সরকার, জনগণের জন্য সরকার এবং জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত সরকার। এর মানে অবশ্য এই নয় যে, একটা দেশের সব জনগণ একটা দলকে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় বা সরকারে পাঠান। সরকার নির্বাচিত হয় সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ভোটে; কিন্তু নির্বাচনের পর সরকারকে হতে হয় জনগণেরই সরকার কিংবা জনগণের জন্যই সরকার; কিন্তু আমাদের দেশে কী ঘটে? এখানকার জনগণ সুস্পষ্টভাবে দুভাগে বিভক্ত- সরকারদলীয় জনগণ এবং বিরোধীদলীয় জনগণ। এখানে সরকার হয় নিজেদের দলীয় জনগণের সরকার। এখানে সরকারি জনগণের চাকরি হয়, বিরোধী জনগণের হয় না। সরকারি জনগণ ঠিকাদারি পায়, বিরোধী জনগণ পায় না। সরকারি জনগণ চাঁদাবাজির সুযোগ পায়, বিরোধী জনগণ পায় না। সরকারি জনগণ ভূমিদখল, নদীদখলের সুযোগ পায়, বিরোধী জনগণ পায় না। সরকারি জনগণ রাতারাতি বড়লোক হওয়ার সুযোগ পায়, বিরোধী জনগণ পায় না। পৃথিবীর অন্য কোনো গণতান্ত্রিক দেশে কি এ ধরনের জন-বিভাজন রীতি চালু আছে? গণতন্ত্রের একটা প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, অন্যের মতের প্রতি শ্রদ্ধা ও সহিষ্ণুতা। আপনি যেটা বলছেন সেটাকেই একমাত্র সত্য বলে মনে করা উচিত নয়। বরং অন্য কেউ ভুল বলুক আর শুদ্ধ বলুক সেটা আপনার মনোযোগ দিয়ে শোনা উচিত। পরে আলোচনার মাধ্যমে বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখা উচিত কার মতটা ভালো ও গ্রহণযোগ্য। এটাই হচ্ছে প্রকৃত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া; কিন্তু আমাদের দেশের রাজনীতিতে এহেন প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। এখানে সরকারি দল যা বলে সেটাই একমাত্র সত্য আর বিরোধী দল যা বলে সেটা একদমই অযৌক্তিক। এখানে বিরোধী দলের কোনো কথাই সরকারের সহ্য হয় না। কেউ সরকারের সমালোচনা করলে তার কণ্ঠ স্তব্ধ করে দেয়া হয়। সেটা যদি কোনো পত্রিকা বা টিভি চ্যানেল হয় তাকেও রাতের আঁধারে বন্ধ করে দেয়া হয়। এখানে দুই দলের দুই নেত্রীর রাজনৈতিক সম্পর্ক এতই ভালো যে, তারা ঈদে ও নববর্ষে দূতের মাধ্যমে কার্ড পাঠিয়ে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন এবং দেশের মানুষ গভীর আগ্রহে সে সংবাদ পত্রপত্রিকায় পড়েন। এ দেশের দলীয় রাজনীতি এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, একই গ্রামের একই খালের ওপর একটি আওয়ামী সাঁকো এবং তার পাশেই একটি জাতীয়তাবাদী সাঁকোর প্রয়োজন হয়। অন্য দেশের সংসদীয় গণতন্ত্রে বিরোধী দলকে ছায়া সরকার হিসেবে অভিহিত করা হয়। তারা সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা করে সরকারি নীতিনির্ধারণে ভূমিকা রাখে। আর আমাদের দেশের বিরোধী দল একটানা ৮৯ কার্যদিবস সংসদে অনুপস্থিত থাকে; কিন্তু বেতন-ভাতাসহ যাবতীয় সুযোগ-সুবিধার পুরোটাই ভোগ করে। এই হচ্ছে আমাদের গণতন্ত্র। যাই হোক, আবারো নির্বাচনের কথায় ফিরে আসি। নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে কোনো আলোচনা হবে বলে মনে হচ্ছে না। দুদলই টেবিলের পরিবর্তে মাঠকে বেছে নিচ্ছে তাদের সমস্যা সমাধানের জন্য। এতে কী হবে? নেত্রীতে-নেত্রীতে যুদ্ধ হবে, নলখাগড়ার প্রাণ যাবে। তাতে তাদের আচরণে কিংবা সাজগোজে কোনো পরিবর্তনর ঘটবে না। জনগণের রক্তগঙ্গায় স্নাত হয়ে একদল ক্ষমতা ধরে রাখার চেষ্টা করবে কিংবা আরেক দল ক্ষমতায় যাওয়ার চেষ্টা করবে; কিন্তু আমরা যারা আমজনতা তারা তো এটা চাই না। আমরা চাই একটা সুষ্ঠু নির্বাচন এবং সে নির্বাচনে যারাই ক্ষমতায় আসবে তাদেরই আমরা স্বাগত জানাব। তাই সরকারি দলের প্রতি আমাদের সনির্বন্ধ অনুরোধ, অন্য দেশের সাথে আমাদের তুলনা করবেন না। আমরা আমরাই। আপনারা আমাদের জনগণের নাড়ির স্পন্দন বুঝতে চেষ্টা করুন। দেশের বেশির ভাগ জনগণ যেভাবে নির্বাচন চায় সেভাবেই নির্বাচন দিন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পেছনে একটাই যুক্তি, এর অধীনে আগের সব নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে। আপনারা তো দেশের অনেক উন্নতি করেছেন। তাহলে আর সুষ্ঠু নির্বাচনকে ভয় পাচ্ছেন কেন? তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে অসাংবিধানিক বলছেন কেন? একে সাংবিধানিক করতে আপনাদের কয় মিনিট লাগবে? আদালতের দোহাইও না দেয়াই ভালো। আমাদের দেশে তো আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে মঞ্চ বানিয়ে গগনবিদারী চিৎকার করে সারা দেশ কাঁপিয়ে তোলা হয় এবং সেখানে আপনাদেরই অনেকের দেহ ছুটে যায় আবার কারো মন ছুটে যায়। আপনারা যেকোনো সময় সংসদে যেকোনো বিল আনতে পারেন এবং যেকোনো আইনও পাস করিয়ে নিতে পারেন। আপনারা চাইলেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধানে পুনর্বহাল করতে পারেন। অতএব আবারো আপনাদের প্রতি সবিনয় অনুরোধ জানাচ্ছি, দেশ ও জাতির বৃহত্তর কল্যাণের কথা ভেবে আপনাদের মাথা থেকে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করার পরিকল্পনাটা নামিয়ে ফেলুন, ঠিক যেভাবে অন্যায়ভাবে দখলকৃত অন্যের বিলবোর্ড থেকে আপনাদের উন্নতির ফিরিস্তিগুলো নামিয়ে ফেলেছেন। জনগণ আপনাদের প্রশংসাই করবে। 


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads