মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল
১৯৯১ সালে এ
যাবৎকালের সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বিএনপি-আওয়ামী লীগের
ইচ্ছা ও সম্মতিতে দেশ ফিরে পেয়েছিল সংসদীয় পদ্ধতির সরকারব্যবস্থা। তার পর থেকেই
যত বিপত্তি। আকাক্সা ও তাচ্ছিল্য হিসেবে তৎকালীন আওয়ামী লীগ-প্রধান নির্বাচনের
আগে সংবাদমাধ্যমে বলেছিলেন, ‘বিএনপি সর্বোচ্চ ১০টি আসন
পাবে।’ কিন্তু নির্বাচনের ফলাফলে সেই বিএনপি পেল দেশ
পরিচালনার দায়িত্ব। অমনি লাগল অহংবোধে, শুরু হলো
রণপ্রস্তুতি, আওয়ামী লীগ-প্রধান সদম্ভে
ঘোষণা দিলেন কারচুপির নির্বাচনে বিজয়ী সরকারকে এক দিনের জন্যও শান্তিতে থাকতে
দেবো না। মন্ত্রিপরিষদের শপথ অনুষ্ঠান বয়কট, সংসদে প্রথম
থেকেই শপথ গ্রহণে অনীহা, অধিবেশনে অনুপস্থিতি; একপর্যায়ে সংসদ বর্জন এবং সংসদ থেকে পদত্যাগ করে শান্তিতে থাকতে
না দেয়ার ওয়াদা তিনি রাখলেন। এসব কর্মকাণ্ডের একাংশে তখন আওয়ামী লীগের সাথে
জামায়াত ছিল একান্ত বিশ্বস্ত সঙ্গীÑ যদিও এখন
আওয়ামী লীগের ডিকশনারিতে জামায়াত হচ্ছে যুদ্ধাপরাধী-জঙ্গি। সে মেয়াদ এ সংসদ
পূর্ণ সময় অতিক্রম করেছে। জামায়াত-আওয়ামী লীগ সংসদ মেয়াদ সমাপ্তির প্রায় এক
বছর আগে পদত্যাগ করে রাজপথে বেশুমার জ্বালাও-পোড়াও,
মানুষ মারার হিংসাত্মক প্রতিবাদ শুরু করে। অধ্যাপক গোলাম আযম থিওরি
আবিষ্কার করলেনÑ শেখ হাসিনা সেটা বাজারজাত
করলেন। থিওরিটি হলো নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার। সালিসের তালগাছ নিয়ে
নিলেন শেখ হাসিনা এবং তার আন্দোলনের সঙ্গী জামায়াত-জাতীয় পার্টি তত্ত্বাবধায়ক
সরকারের দাবি মেনে একে সাংবিধানিক রূপ দিতে ষষ্ঠ পার্লামেন্টে বিল পাস করা হয়
বর্তমান বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়ার বলিষ্ঠ তত্ত্বাবধানে। সপ্তম
পার্লামেন্টে বিএনপি ইতিহাস সৃষ্টিকারী রেকর্ড গড়ে সর্বাধিক ১১৬ আসন জিতে প্রধান
বিরোধী দলে বরণীয় হলো। এখানে কিন্তু একটা বড় বিস্ময় ইতিহাস রক্ষণ করে রেখেছে।
সালিসে তালগাছ দাবিকারীরা বলেন, বিএনপি ওই
নির্বাচনে হেরে গেছে। কিন্তু সংসদীয় গণতন্ত্রে বাংলাদেশের ইতিহাসে এতসংখ্যক আসন
নিয়ে বিরোধী দলে কেউ এর আগে কিংবা এখন অব্দি আসেনি,
প্রমাণ হয়েছে ১৯৯৬-এর ১৫ ফেব্রুয়ারির প্রধান বিরোধী দলবিহীন
নির্বাচন নিন্দনীয় হলেও ওই নির্বাচন দিয়ে গঠিত জাতীয় সংসদে একক দায়িত্বে ‘নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার’-ব্যবস্থার বিধান পাস করায় দেশ পরিচালনায় বেগম খালেদা জিয়ার ১৯৯১-৯৬
সময়কালীন ত্রুটি-বিচ্যুতিতে অখুশি মানুষেরা বিশ্বাসযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য জাতীয়
নির্বাচনব্যবস্থা সংবিধানে সংযুক্ত করায় বিএনপিকে সপ্তম সংসদ নির্বাচনে
সাধ্যানুযায়ী পুরস্কৃত করেছে। এটা হচ্ছে জনমতের সালিস মেনে তালগাছের দাবি ছেড়ে
দেয়ার একটি সৎসাহসী নমুনা। অনেক কারণের মধ্যে এটাও অন্যতম কারণ যে, শত ষড়যন্ত্র ও বিপর্যয়ের মধ্যেও প্রতিটি সংসদ নির্বাচনে বেগম
জিয়া আরপিও অনুযায়ী কখনো সর্বোচ্চ পাঁচ, কখনো তিন আসনে
সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। সেটাও কোনো বিএনপি প্রভাবিত এলাকা নয়, বরং বাংলাদেশের মানচিত্রের দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর ও রাজধানী
ঢাকায়ও বটে। শান্তিপ্রিয় নির্বিরোধী মানুষেরাই নাকি বেশিসংখ্যক বিএনপির সমর্থক।
এর পেছনে একটা ইতিহাসগত ঐতিহ্য আছে বলে আমার মনে হয়। ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ এবং জীবন
রক্তের অশান্ত যুদ্ধের পর স্বাধীন দেশে মানুষ শান্তির প্রত্যাশায় ব্যাকুল ছিল।
কিন্তু শাসক দল আওয়ামী লীগ ক্ষমতার দম্ভে রাজনীতি,
অর্থনীতি, শিক্ষাঙ্গন, সংস্কৃতি অঙ্গনসহ সব সেক্টরে অশান্তি প্রযোজনা করল। মানুষ প্রচণ্ড
রকম আশাহত হয়ে মুুক্তির প্রত্যাশায় ছিল। তাই ভ্রাতৃসঙ্ঘাতে যখন আওয়ামী লীগ আরো
অশান্ত, তখন মানুষ দৃশ্যপটে আবার
একাত্তরের তেজোদীপ্ত জাতির উজ্জীবনী শক্তিকে একত্র করার সৃষ্টিশীল, সাহসী নায়ক জিয়াউর রহমানকে পেয়ে নতুন আশায় বুক বাঁধল। কারণ
প্রকৃতির বিধানে দুর্যোগ-দুর্বিপাক আসে ঠিকই, আবার প্রকৃতির
নিয়মেই এক সময় তার অবসান হয়। যুদ্ধের ব্যাপক রক্তপাতের পরও শান্তি আসে। এভাবেই
দীর্ঘ ২১ বছর প্রচেষ্টার পর সহযোগী জামায়াত-জাতীয় পার্টির শক্তি ঋণ করে ১৯৯৬ সালে
আবার এলো আওয়ামী লীগ; কিন্তু প্রায় একই চেহারায়।
মনে রাখা দরকার ১৯৭২-৭৫এর আওয়ামী নেতারা কেউই কিন্তু ১৯৯৬-এর ওই সময় মানুষের
কাছে ক্যাপ্টেন হিসেবে গ্রহণযোগ্য হননি, হয়েছেন
ক্ষমতাকালীন রাজনীতি থেকে যোজন যোজন মাইল দূরে থাকা বঙ্গবন্ধুকন্যা নব্য ক্যাপ্টেন
শেখ হাসিনা। তার আলোয় আলোকিত হয়েছেন দীর্ঘ আওয়ামী রাজনীতির পোড় খাওয়া
প্রখ্যাত রাজনীতিকেরা। এখন প্রশ্নÑ ১৯৯১ থেকে বেগম
জিয়ার আলোয় আলোকিত বিএনপি কিংবা ১৯৯৬ থেকে শেখ হাসিনার আলোয় আলোকিত আওয়ামী
নেতারা কি সাধারণ মানুষের রাজনীতির অনুষঙ্গগুলো অনুভব করতে পারছেন, নাকি পারলেও দলীয় বৃত্তের নির্ধারিত সীমারেখা ভেদ করতে সাহস
পাচ্ছেন না? সূর্যের আলোয় আলোকিত এসব
চন্দ্র, গ্রহ, নক্ষত্ররা কি সূর্যের মুখের দিকে তাকিয়েই বসে থাকবেন, আলোবঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কায়? নাকি বিবেকের
স্বচ্ছ আলো প্রজ্ব¡লিত করে নীতিনির্ধারণী
পর্যায়ে সৎসাহস নিয়ে বলবেন, সাধারণ মানুষের
নীরব ও সরব অভিরুচির কথা? ভুলে যাওয়া ঠিক হবে না
অত্যন্ত হৃদয়স্পর্শী দেশের গান ‘ও আমার দেশের
মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা’-এর ভেতর কয়েক পঙ্ক্তিতে আছে ‘অনেক তোমার খেয়েছি মাÑ অনেক পরেছি যে’ এখন তোমার অশেষ ঋণ শোধ করার পালাÑ
জাতীয় কিছু অঙ্গীকারের কথা। সে ক্ষেত্রে হারানোর আশঙ্কা কিন্তু
কমে যায় যদি বলার মতো করে বলা যায়। এ প্রসঙ্গে যেন জনসনের একটি উদ্ধৃতি বোধ হয়
প্রযোজ্যÑ ‘বক্তা যদি ভালো হয় তাহলে
গল্প খারাপ হলেও তা শ্রুতিমধুর হয়।’ সে ক্ষেত্রে
প্লেটোর সেই বিখ্যাত বাণীÑ ‘বন্ধুর সাথে এমন ব্যবহার করো
যেন বিচারকের দরবারে যেতে না হয়। আর শত্রুর সাথে ব্যবহারে এমন হও যে, বিচারকের দ্বারস্থ হলে তুমি জয়ী হও।’ বাণীটি বোধ করি মাথায় রাখা দরকার। কারণ বাংলাদেশের সংবিধান
অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনার মূল ম্যান্ডেট তো জনগণের হাতে। সুতরাং রাষ্ট্র
পরিচালনার দায়িত্ব কোন দলকে দেবে সে রায় দেয়ার মালিক তো জনগণ। সমীকরণটি হলো
রাজনীতিতে নীতির গলা টিপে হত্যা করলেও কিন্তু স্বার্থ আদায়ের জন্য অবশ্য ওই
বিচারক জনগণের দ্বারস্থ হতেই হবে। ক্রাউন সিমেন্টের একটি বিজ্ঞাপন চিত্রের ভাষায়
বলতে ইচ্ছে করে, ‘বোঝা গেছে ব্যাপারটা।’ দেশটাকে বর্তমান সময়ের মতো ক্ষমতাসীনদের মদদে দুই ভাগে বিভক্ত
করার চেষ্টা কিন্তু গোড়াতে শুরু হয়েছিল স্বাধীনতার পরপরই। বিভক্তির রাজনীতির
সুযোগে গোপাল ভাঁড়ের আগুন লাগা ঘরে আলু পুড়ে সিদ্ধ করার মতো ছোট
স্বার্থান্বেষীরাও কিন্তু ফায়দা নিচ্ছে সাময়িক হলেও। তাদের শিকার হচ্ছে সেই
বিচারক জনগণ। দুর্নীতি, ঘুষ, খুন, গুম, অপমান, লাঞ্ছনা যেন বর্তমান
স্বাভাবিক সমাজব্যবস্থা। অনাচার-অত্যাচার বাংলাদেশে বিভিন্ন সময় হয়েছে, কিন্তু বর্তমানকালীন দুঃসময়ের তুলনা কোথায়? ২০১৩-এর ফেব্রুয়ারি-মার্চে রাষ্ট্রযন্ত্র ২০০-এর বেশি সাধারণ
মানুষ হত্যা করল। নিহত হলো পুলিশও। চরম দুঃখ ও আশ্চর্যের ধাক্কা লাগে বারবার, যখন দেখা যায় রাষ্ট্রক্ষমতার সর্বোচ্চ থেকে সর্বনিম্নরা সবাই
প্রকাশ্যে শুধু পুলিশ হত্যার কথা আবেগমথিত কণ্ঠে বলেছেন। আর ক্ষমতার হালুয়ার
ভিক্ষুকেরা সেটার পক্ষে সাফাই কথা লিখেছেন। অমানবিকভাবে নিহত হতভাগ্যদের দায়ী করা
হচ্ছে তাদের নিজেদের মৃত্যুর জন্য। প্রতিবাদকারী নিহত-আহতদের প্রতিবাদী ভাষাকে বলা
হচ্ছে তাণ্ডব-নাশকতা। ক্ষমতাবানেরা পুলিশ পাহারায় দলীয় ক্যাডার সমর্থকদের দ্বারা
বিভিন্ন মঞ্চ তৈরি করে দুধকলা দিয়ে পুষছে। আর বিরোধী দলকে দুষছে। এই মঞ্চের বিরূপ
প্রতিক্রিয়ায় চারুকলার এক ছাত্রসহ এখন পর্যন্ত চার শিশু জীবন দিয়েছে ফাঁসির
অভিনয় করতে গিয়ে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কচি অন্তরে কী ঘৃণার বীজ বপন করা হচ্ছে
একবার ভাবুন। যে শিশুটির এখন আবদার করার কথা খেলনার,
রঙিন বেলুন কিংবা চকলেটের তাকে দিয়ে আবদার করানো হচ্ছে ফাঁসির মতো
মানবিক মূল্যবোধহীন জিনিস! যারা করাচ্ছেন তাদের ভেবে দেখা উচিত, পৃথিবীর পাপ-পুণ্যের বিচারের জন্য ও তো আল্লাহ রাব্বুল আলামিন
পরকালে সাত গ্রেডের দোজখ এবং আট গ্রেডের বেহেশত রেখেছেন। সব পাপের একই দণ্ড
ন্যায়সঙ্গত হলে তো আল্লাহ শুধু একটি দোজখ রাখলেই পারতেন, সাতটি কেন? অতএব সব গ্রেডের অপরাধের
শাস্তির জন্য শুধু ফাঁসির দাবি করে ন্যায়বিচার হয় না। পৃথিবীর বিচারব্যবস্থায়ও
তো সশ্রম-বিনাশ্রম কারাদণ্ড কিংবা শুধু অর্থদণ্ড,
দশ বছর, পাঁচ বছর, যাবজ্জীবন বিভিন্ন গ্রেডের সাজা রয়েছে বিভিন্ন অপরাধের জন্য। যা
প্রয়োগে আবার প্রয়োজন সন্দেহাতীত প্রমাণ। শুধু আবেগ কিংবা প্রতিহিংসার প্রয়োগ
দেখতে চাইলে বিচারব্যবস্থাকে ওই সব মঞ্চের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে হবে। আল্লাহর
সৃষ্টির সেরা একমাত্র (RATIONAL) র্যাশনাল মানব
সমাজে কি সেটা আদৌ প্রযোজ্য? প্রতিপক্ষকে
শান্তিপূর্ণভাবে নির্দোষ দাবি করার সুযোগও দেয়া যাবে না? গণতন্ত্রের নামে প্রতিবাদ সমালোচনার জবাব আলোচনায় বা সঠিক আইনি
প্রক্রিয়ায় না দিয়ে বর্তমান সরকার দিচ্ছে ভীতি সৃষ্টি করে, হত্যা করে, হামলা করে, গ্রেফতার করে। ক্ষমতাধরেরা উচ্চকণ্ঠে বলেনÑ ‘অনেক ধৈর্য ধরেছি, আর নয়’, বলেনÑ ‘গুলি করবে না তো পুলিশ কি বসে
বসে আঙুল চুষবে’। এত ধ্বংসযজ্ঞ, এত লাশ, এত আতঙ্ক উপহার দেয়ার পরও
শাসকেরা এই উগ্র বিধ্বংসী কথাবার্তা দ্বারা গোটা জাতিকে আতঙ্কিত করে রেখেছেÑ শুধু প্রয়োজন এ সালিসের তালগাছ নেয়ার মানসিকতায়। প্রকৃতির কথা
তারা ভুলে বসে আছেন। স্বাভাবিক বাতাসের প্রবাহ বন্ধ হলে ঝড় হয়, স্রোতকে বাঁধ দিয়ে ঠেকাতে গেলে প্লাবন হয়Ñ আর সেই প্লাবনে ‘তালগাছ’ও কিন্তু উপড়ে যায়, ভেসে যায়। এখন
বাংলাদেশে রাজনৈতিক প্রকৃতি ঠিক কখন তার স্বাভাবিক দায়দায়িত্ব পালন করবে সেটা
দেখার প্রতীক্ষায় সাধারণ মানুষ। কিন্তু অসাধারণ মানুষ যারা, তারা অনেকেই নীরব কেন? নীরব থাকার
পক্ষে কেউ কেউ আবার যুক্তি দেখান, বর্তমানে
ক্ষমতাসীনদের এই বেপরোয়া শক্তি ব্যবহার তাদের ভীতিরই বহিঃপ্রকাশ। যেমনটি ক্ষমতাধর
লখিন্দর একটি মাত্র সাপের ভয়ে নিñিদ্র লোহার
বাসরঘর তৈরি করেছিলেন। পাকিস্তানি ক্ষমতাধরেরা আচমকা আক্রমণে স্বাধীনতাকামী
মানুষকে হত্যা করে নিজেদের ভীতি দূর করতে চেয়েছিল,
কিন্তু পরিণতি আমাদের সবার জানা। প্রয়াত চলচ্চিত্রকার কাজী জহির ‘ময়নামতি’ নামে একটি চমৎকার সামাজিক ছবি
নির্মাণ করেছিলেন। ময়না হলো নায়িকা এবং মতি হলো নায়কের নাম। মাঝখানে এক ধনাঢ্য
ব্যক্তির হাবাগোবা পুত্রধনের নজর পড়ল ময়নার রূপ-সৌন্দর্যে। কিন্তু ময়না তাকে
পাত্তাই দেয় না। একই সময়ে অতি ধূর্ত এক গ্রামবাসীর নজরে ব্যাপারটি আসতেই সে হাবা
পুত্রধনের ঘনিষ্ঠ হয়ে নিয়মিত তাকে খুশি করতে থাকল,
বানানো তথ্য দিয়ে যে ময়নার বাবা মেয়েজামাই হিসেবে হাবাকে পছন্দ
করেছে। হাবা খুশি হয়ে পকেট উজাড় করে অতি ধূর্তকে দিয়ে যাচ্ছে। একদিন বিপত্তি
ঘটতে ঘটতে আবার থেমে গেল। বাবার খামারের বিরাট হাঁসের পাল, লাঠি হাতে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে চপলা ময়না। পিছু পিছু একটু দূর
থেকে হাবাকে নিয়ে অতি ধূর্ত ব্যক্তিটি ময়নার রূপের ঝলকানি দেখছে আর ময়নাও
দুষ্টুমি করে মুখ ফিরিয়ে একটু হাসে আবার নাচের ভঙ্গিতে লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁস
তাড়ায়। এমন সময় ওই পথেই আসছিল ময়নার বাবা। হাবা অতি ধূর্তকে চেপে ধরল, তুমি যা বলো তা যদি সত্যি হয় তাহলে আজ ময়নার বাবাকে আমার সামনে
জিজ্ঞেস করোÑ সে কী বলে আমি নিজে শুনব। অতি
ধূর্ত ডাকতে ডাকতে ময়নার বাবার কাছে পৌঁছে জোরে জোরে বললÑ চাচা, ওই হাবা আপনার একটা প্রিয়
জিনিস চায়। চাচার জিজ্ঞাস্য কী চায়? অতি ধূর্ত এবার
আস্তে করে হাসিমুখে বললÑ আপনার হাঁসের একটা বাচ্চা।
চাচা হাসি দিয়ে বললÑ হ্যাঁ-হ্যাঁ, দেবো-দেবো। হাবা মস্তখুশি। সে তো বুঝল না অতি ধূর্ত হাঁসের কথা
আস্তে বলে বেশ জোরে কিন্তু বাঁশের ব্যবস্থা করে ফেলল। ঠিক যেন ‘বাংলালিংক’ মোবাইলের বিজ্ঞাপন চিত্র।
চটপটে স্ত্রী বাজার থেকে হাঁস আনতে বললে স্বামী বাজার থেকে প্রকাণ্ড এক বাঁশ নিয়ে
ঘরে আসে। শুধু তাই নয়, স্ত্রীর তীক্ষè চিৎকারে উত্তর দেয়Ñ আরো বড় লাগবে? বুঝুন সেই সংসারের অবস্থা! বর্তমান মহাজোট সংসারেরও কিন্তু সে রকম
পরিবেশ হয়েছে বলে মন হয়। মানুষ বড় হাঁস বললে তারা প্রকাণ্ড সাইজের বাঁশ মনে
করে। যন্ত্রণাকিষ্ট, আতঙ্কিত মানুষ যদি ব্যথায়
চিৎকার করে বলেÑ ‘দাঁত ভাইঙ্গা গেছে’ সরকার তার তাবৎ রাষ্ট্রশক্তিকে চিৎকার দিয়ে একত্র করতে করতে বলতে
থাকে ‘বাঁধ ভাইঙ্গা গেছে’
প্রতিহত করোÑ প্রতিরোধ করো।
বহুলপ্রচারিত একাধিক দৈনিকের খবর অনুযায়ী ঢাকা সেনানিবাসের মতো সুরক্ষিত এলাকায়
এক মেজরের বাসায় চুরি করে ৬৩ ভরি স্বর্ণালঙ্কার,
চারটি হীরক খণ্ড এবং নগদ প্রায় অর্ধলক্ষ টাকা ১৬-১৯ এপ্রিলের কোনো
এক সময় নিয়ে গেছে চোর বা চোরেরা। আঁতকে ওঠা চিত্তে ভাবতেই ইচ্ছে করে চোর হয়তো
সম্পদ প্রাপ্তির তৃপ্তির অতিরিক্ত হিসেবে ভাবতে পারেÑ মেজর মনে করছে অন্য সবাই বোধ হয় ‘মাইনর’ হু হু দেখিয়ে দিলাম মাইনর নয়Ñ আসলেই আমি বা
আমরা হচ্ছি সিনিয়র মেজর, প্রসঙ্গটা ছিল চলচ্চিত্র
কিংবা বিজ্ঞাপন চিত্র নিয়ে। চলচ্চিত্র জগতে তাবৎ দুনিয়ার হলিউডের খুব কাছাকাছি
অবস্থান হচ্ছে বলিউডের (বোম্বে ভিত্তিক)। বলিউডের ডাকসাঁইটে দুই অভিনেতা হচ্ছেন
শাহরুখ খান ও সালমান খান। ভারতের জাতীয় পুরস্কার জয়ী এক পরিচালকের নাম হচ্ছে
জানকি বিশ্বনাথান। তিনি তার আগামী চলচ্চিত্র ‘বাকরাপুর’-এ একটি অন্যতম কেন্দ্রীয় চরিত্রে এক ছাগলের নাম দিয়েছে শাহরুখ।
একটি ছোট ছেলে এবং তার ছাগলকে নিয়েই চলচ্চিত্রটি হবে কমেডিধর্মী। এই নামকরণের
কারণ এবং এ ব্যাপারে শাহরুখ খান অসন্তুষ্ট হবেন কি না জানতে চাইলে পরিচালক বললেন, ‘ভারতের গ্রামাঞ্চলে প্রিয় অভিনয়শিল্পীদের নামানুসারে পোষা
প্রাণীদের নাম রাখার একটা প্রবণতা আছে। পোষা ছাগলের ব্যাপারে সরেজমিনে দেখেছি
শাহরুখ নামটিই বেশি। সালমান খানের নামেও আমরা বেশ কিছু ছাগল পেয়েছি। আর শাহরুখ
শব্দের অর্থ তো রাজকীয় রূপ। তার অসন্তুষ্টির কথা বলছেন, আমরা জানি শাহরুখ খানের রসবোধ অনেকের চেয়ে বেশি। আশা করছি, ব্যাপারটিকে তিনি কৌতুক হিসেবেই নেবেন। এখন এই কৌতুকের যৌতুক কী
আসে হাঁস নাকি বাঁশ সেটা দেখতে অপেক্ষা করতে হবে। যদিও আমাদের দেশে এ ধরনের যৌতুক
হাঁস নয় বাঁশ হিসেবেই আসে। রাজাকারকে রাজাকার বললে মুক্তিযুদ্ধের বীর উত্তমকে
কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে জামিন নিতে হয় গ্রেফতারি পরোয়ানা মোকাবেলা করতে। মানহানি
মামলায় ঢাকার বাইরে ফরিদপুরে গিয়ে জামিন নিতে হবে তরুণ বিরোধীদলীয় সংসদ
সদস্যকে। ক্ষমতার বলয়ের বাইরে বলে কিছু রাজাকারের ফাঁসি হবে, আর ক্ষমতার বলয়ে থাকার পুরস্কার হিসেবে রাজাকার হবেন মন্ত্রী আর
রাজাকারের পরবর্তী প্রজন্ম হবে একমাত্র মেয়েজামাই। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় আইন
মন্ত্রণালয়ের আংশিক ভাগিদার হবেন রাজাকার-ভ্রাতা। রাজাকার পাকিস্তানি প্রশাসক
হবেন এমপি। এই বিভক্তি ক্রমাগত উগ্র করা হচ্ছে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়। তাই
স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, গণতন্ত্রের বহুল আলোচিত মূল
বিষয় গণতান্ত্রিক সহনশীলতা বর্তমান সরকারের নির্বাচিত ইশতেহারে থাকা সত্ত্বেও
তারা উল্টো পথে হাঁটছেন কেন? অনেক জবাব আছে, কিন্তু বিশেষ প্রণিধানযোগ্য বোধ করি এ রকমটা যে, স্বৈরাচারী শাসকেরা তাদের মেয়াদের শেষ প্রান্তে এসে যখন অনুভব
করতে থাকেন ন্যায়পন্থা, আইন ও জনসমর্থন দ্বারা তারা
আর ক্ষমতায় ফিরতে পারবেন না তখন তারা নিজেদের কুকীর্তি ও অপশাসন থেকে দৃষ্টি
সরিয়ে জনগণের মতিভ্রম ঘটাতে অশান্তি সৃষ্টির নানা উপাদান তৈরি করে দেয়। অশান্তি
সৃষ্টির দায়ভার ক্ষমতার প্রতিযোগীদের ওপর চাপিয়ে দেয়। প্রতিবাদ ও প্রতিরোধকে
শক্তির দ্বারা ধ্বংস করতে চায়। যাতে তাদের নগ্নতা এবং প্রকৃত সত্য প্রকাশিত না
হয়ে পড়ে, সে জন্য তারা অশান্তি-নৈরাজ্যের
নতুন নতুন ফ্রন্ট খোলে। ক্ষমতার এই ফেরিওয়ালারা কিন্তু লজ্জা নামক জিনিসটি গায়ে
মাখে না। অনাচারের জন্য স্বগোত্রীয়দের বিচারের কথা মুখে বললেও কার্যত তাদের
আঁচলের নিচে লুকিয়ে রাখে। তবে নাউমি উলফ (NAOMI
WOLF) নিকট অতীতে ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বক্তৃতায় বলেছেন, ÔONLY A HANDFUL OF PATRIOTS TRY TO HOLD BACK TIDE OF TYRANNY
FOR REST OF US, AND THEIR END ENDOUR AGAIN CREATE THE NATIONAL UPSURGE.Õ যে ব্যাপারে
একটি জ্বলন্ত উদাহরণ হলো সাম্প্রতিক হেফাজতে ইসলামের সমাবেশ। প্রতিবাদ জানালেন
আল্লামা শফী এবং তার সঙ্গীরাÑ হতাশা কাটিয়ে
জেগে উঠল লাখো মানুষ। কোনো বাধা-ষড়যন্ত্র-রক্তচক্ষুকে তারা ভ্রƒক্ষেপ করল না। দেশ-জাতিকে আলোড়িত করে অগণিত মানুষ রাস্তায় নেমে
খাবার, পানীয়, শুশ্রƒষার উপকরণ বিতরণ করল হৃদয়ের দরদেÑ
অকৃপণহস্তে। জানান দিয়ে দিলো জুলুমের বিরুদ্ধে তাদের ঘৃণার। ধর্মে
আঘাতকারী, সৃষ্টিকর্তার অবিশ্বাসীদের
সঙ্কেত দিয়ে গেলÑ মানবতার কল্যাণ অবহেলাকারীদের
দৌরাত্ম্য বন্ধ করার। এ দিকে বিএনপি এদের সমর্থন দিয়ে একই সাথে জোরেশোরে চাইছে
নির্বাচন কালীন দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার। আর আওয়ামী লীগ বলছে, ‘রোজ কিয়ামত হবেÑ কিন্তু
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা আর ফিরে আসবে না।’ (৩০ মার্চ
বগুড়ায় ১৪ দলের জনসভায় মোহাম্মদ নাসিম)। অর্থাৎ রোজ কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার পরও
আওয়ামী লীগ থাকবে, নাসিম সাহেব প্রেসিডিয়াম
মেম্বার থাকবেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী
লীগ সরকার থাকবে এবং তাদের অধীনেই আবার নির্বাচনও হবে, কোনো অবস্থায় তত্ত্বাবধায়ক দেয়া হবে না। আবার প্রধানমন্ত্রী গত
বছর ৩০ জুলাই বিদেশে বসে বিদেশী মিডিয়াকে বলেছেন,
নির্বাচনের সময় অন্তর্বর্তী সরকার হতে পারে। সেই সরকারে বিরোধী দল
চাইলে অংশীদারিত্ব দিতে পারি। একটা ছোট মন্ত্রিসভা করে ইলেকশন দিতে পারি। সবাই
মিলে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারি ইত্যাদি। তার কথার তাৎপর্য কিন্তু সব সম্ভাবনার
প্রত্যাশা, সুনির্দিষ্ট কোনো প্রস্তাবনা
নয়। বরং তত্ত্বাবধায়ক শব্দটির ব্যাপারে আপত্তি থাকলে সেটা বাদ দিয়ে নির্বাচন
কালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ বা অন্তর্বর্তী কালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার শব্দটি
গ্রহণ করে ব্যবস্থা নেয়ার সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা বিএনপির পক্ষ থেকে দেয়া
হয়েছে। এমন কি বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন, মেয়াদ শেষে এ
ব্যবস্থা নেয়া হবে ঘোষণা যদি প্রধানমন্ত্রী দেনÑ
তাহলে হরতাল, অবরোধের মতো
আন্দোলন কর্মসূচি আর দেবেন না। তবুও এখনো এটা বিলিয়ন ডলার কোশ্চেন, আসলে সরকারের পরিকল্পনা ঠিক কী? এখন পর্যন্ত যা
দৃশ্যমান তাতে প্লেটোর সেই কথারই প্রতিফলন পদে পদেÑ
‘ন্যায়বিচারের রূপ একটি, আর শতরূপ হচ্ছে
অত্যাচারের। এ কারণেই ন্যায়বিচার করা অপেক্ষা অত্যাচার করা সহজ।’ অনেকে সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে অবশ্য আশাবাদী। তারা বলছেন, নির্বাচনে অংশ নেয়ার জন্য বিএনপির ওপর অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক
চাপ রয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ও গণতন্ত্রের স্বার্থে
নির্বাচনপ্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে বিএনপি সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেবে। তবে এ
জন্য সরকারকেই অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। কারণ নির্দলীয় নিরপেক্ষ
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের মাধ্যমে চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট সৃষ্টির জন্য
সরকারই দায়ী। হামলা-মামলা, নির্যাতন, গ্রেফতার বন্ধ করতে হবে। গুম হওয়া সব নেতাকে সন্ধান দিতে হবে
ইত্যাদি। সাধারণ মানুষেরও প্রস্তাব সহিংসতা কোনো সমাধান আনবে না। দেশের কথা মাথায়
রেখে সংলাপে বসতে হবে। আর সংলাপে বসে ‘সালিস মানি, কিন্তু তালগাছ আমার’ মনোবৃত্তি
ছাড়তে হবে প্রথমেই, না হলে ক্ষমতার স্বপ্ন যত
সুখকরই হোক, বাস্তব বড় রূঢ়; কখনো ক্ষমাহীন। আমাদের বিশিষ্ট সঙ্গীতশিল্পী সুবীর নন্দী তার একটি
গানে বলেছেন, ‘বৈশাখী মেঘের কাছে জল চেয়ে
তুমি কাঁদবেÑ আমি চাই না’। গানটির এক জায়গার পঙ্ক্তিগুলো এ রকমÑ ‘ঝড়ের আকাশে পূর্ণিমা চাঁদ দুরাশাÑ
সে সাধ তোমার ভেঙে যেতে পারে সহসা। তাই অনুরোধ স্বপ্নের কথা
স্বপ্নেই ভুলে যাও না।’ আসি, আল্লাহ হাফেজ। আইনজীবী, সভাপতি, জাতীয়তাবাদী যুবদল
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন