সোমবার, ১২ আগস্ট, ২০১৩

জয়কে দিয়ে জয় হবে না

সিরাজুর রহমান

আমরা যখন পত্রিকা সাংবাদিকতা করতাম তখন নির্বাচন ছিল ভিন্ন রকমের। এবং সাংবাদিকতাও। নির্বাচন এগিয়ে এলে সব পত্রিকাই ভোট রঙ্গনির্বাচনী রঙ্গ জাতীয় কলাম প্রচার করত। নির্বাচন নিয়ে এখন আর রঙ্গ হয় না, এখন শুধু রক্ত ঝরে। মিডিয়া সাংবাদিকেরা মালিকপক্ষের চাকরি করেন। মালিকদের সমৃদ্ধি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায়। রুটি-রুজির গরজে সাংবাদিকদের ঢাল-তলোয়ার নিয়ে সরকারের পক্ষে লড়াই করতে হয়। ফ্রিল্যান্স সাংবাদিকতা যারা করেন কিংবা বাইরে থেকে যারা কলাম লেখেন, তাদের কেউ কেউ সরকার ও শাসকদলের কাছ থেকে অতীতে যেসব বদান্যতা পেয়েছেন এবং বর্তমানেও পাচ্ছেন তা স্মরণে রাখেন। তারাও যেন রুটিরুজির গরজে সরকারের তাগিদে রক্তারক্তি করে যাচ্ছেন। বলতে গেলে তাদের কারো কারো অস্তিত্ব নির্ভর করে এ সরকারের হাজার অন্যায়-অবিচারের যুক্তি সন্ধানের ওপর। নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকার আর শাসকদলও প্রচুর রক্তারক্তি করেছে। ৫-৬ মে মধ্যরাতে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে যে গণহত্যা হয়ে গেল, তাও এ নির্বাচনের সাথে সম্পর্ক-বর্জিত নয়। সরকার গদি আঁকড়ে থাকতে চায় বিদেশী প্রভুদের অনুগ্রহে। সে অনুগ্রহ অর্জনের জন্য হয়তো ইসলামের বিরুদ্ধে সশস্ত্র অবস্থান নিয়ে থাকতে পারে শেখ হাসিনার সরকার। হেফাজতে ইসলামের ৮-১০ লাখ সমর্থকের শাপলা চত্বরে অবস্থান ধর্মঘট বিদেশী প্রভুদের আতঙ্কিত করে। সুতরাং পাইকারি হত্যা ও আতঙ্ক দিয়ে এ আন্দোলনকে সাময়িকভাবে হলেও ছত্রভঙ্গ করে দেয়া নিতান্তই প্রয়োজনীয় ছিল সরকারের জন্য। শোনা যায়, সে গণহত্যায় বিদেশীরাও মদদ দিয়েছিল সরকারের বাহিনীকে। এই সরকার গোড়া থেকেই ফাউলের ওপর নির্ভর করে রাজনীতির খেলা খেলেছে। সামনাসামনি ও নিরপেক্ষ খেলার সাহস নেই তাদের। তারা প্রতিপক্ষের হাত পিঠমোড়া করে বেঁধে লড়াই করতে চায়। বিরোধী দলগুলোর কত হাজার কর্মীকে কয়েদ করে রাখা হচ্ছে, তার সঠিক হিসাব এ সরকারের কাছ থেকে আশা করা যায় না। সত্যতা ও স্বচ্ছতা এ সরকারের বৈশিষ্ট্য নয়। বিদেশী প্রভুদের মনোরঞ্জনের লক্ষ্যে ইসলামি সন্ত্রাসী কিংবা জামায়াতি বলে কয়েক হাজার টুপি-দাড়ি পরিহিত এবং মসজিদে যাওয়া লোককে গ্রেফতার করা হয়েছে। লক্ষণীয় যে, জামায়াতে ইসলামী আজ পর্যন্ত নিষিদ্ধ দল নয়। কিন্তু পৌনে পাঁচ বছর ধরে শুধু জামায়াতের নেতাকর্মী এমনকি সাধারণ সদস্য হওয়ায় কয়েক হাজার লোককে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের হত্যা করার খবর তো প্রায়ই পাওয়া যায়। শাসক দলে এমনকি মন্ত্রিসভায়ও এমন লোকও আছেন মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা ও অন্যান্য যুদ্ধাপরাধের মতো অভিযোগ আছে তাদের বিরুদ্ধে। তারা সবাই আওয়ামী দীঘিতে পুণ্যস্নান করে নবজন্ম লাভ করেছেন। এখন তারা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। অন্য দিকে যুদ্ধাপরাধের বিচারের নামে বিতর্কিত ট্রাইব্যুনালে এবং অধিকতর বিতর্কিত পদ্ধতিতে বিচার করে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের ফাঁসির দণ্ড দেয়া হচ্ছে। একজনকে ফাঁসির বদলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়ায় সরকারি উসকানিতে তাদের কর্মীরা এবং শাহবাগে সরকারের অবৈধ সন্তানেরা ফাঁসি ফাঁসিধ্বনি তুলে রক্তলিপ্সা জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করছে। বিএনপির দুই প্রৌঢ় নেতাও আছেন এই তথাকথিত বিচারপ্রক্রিয়ায় আসামির তালিকায়। দেশে ও বিদেশে সে জন্যই এ বিচারকে বলা হচ্ছে রাজনৈতিক বিচার। হুকুমের আসামির বিচার ভবিষ্যতেও হবে কারাবন্দী বিএনপি নেতাকর্মীর সংখ্যা আরো বেশি। এ সরকার ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে সোয়া সাত হাজার দুর্নীতির মামলা মওকুফ করে দিয়েছে। খুন-খারাবি, চুরি-ডাকাতি সব রকমের মামলা ছিল তার ভেতর। ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত ডজন দুয়েক আসামিকে রাষ্ট্রপতির নামে মুক্ত করা হয়েছে। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মিগ-২৯ এবং কোরিয়া থেকে ফ্রিগেট ক্রয় ইত্যাদি বিভিন্ন ব্যাপারে দুর্নীতির পাঁচটি মামলা ছিল সেই তালিকায়। কিন্তু গদি পাওয়ার পর থেকে বিএনপি ও অন্যান্য দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে অসংখ্য ভুয়া মামলা সাজিয়েছে সরকার। বাংলাদেশের সব মানুষই জানেন ককটেল বোমা নিক্ষেপ, গাড়ি ভাঙা ইত্যাদি কর্ম করে থাকে সর্বনিম্ন স্তরের কর্মীরা এবং হুজুগে পড়ে পাড়ার ও রাস্তার বেকার ছেলেরা। কিন্তু সচিবালয়ে ককটেল বোমা ছোড়া ও এয়ারপোর্ট রোডে একটি গাড়ি ভাঙচুর করার ব্যাপারে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ এই দলের ৪০-৫০ জন শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে মামলা করেছে সরকার। অভিযোগ হয়েছে তারা নাকি হুকুমের আসামি। এবং এই অলীক অভিযোগে তাদের দীর্ঘ দিন ধরে কাশিমপুর জেলে কয়েদ করে রাখা হয়েছে; মাঝে মধ্যে রিমান্ডেনিয়ে দৈহিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো হয়েছে তাদের ওপর। বাংলাদেশের মানুষ আশা করে আছে কোনো-না-কোনো দিন অজস্র হত্যা-দুর্নীতি-নির্যাতনের, শাপলা চত্বরের গণহত্যার দায়ে হুকুমের আসামি প্রধানমন্ত্রী ও অন্য মন্ত্রীদের বিচার হবে। প্রশাসন আর পুলিশ তো বটেই বাংলাদেশের দলীয়কৃত আদালত ও নির্বাচন কমিশনও সরকারের ইচ্ছা পূরণের জন্য সদা উদগ্রীব। আদালত রায় দিয়েছেন এবং নির্বাচন কমিশন সেই রায় পালনের জন্য উদগ্রীব যে রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করতে হবে। সরকারের অভিযোগ জামায়াত নাকি সন্ত্রাসী দল। নতুন প্রজন্মের বাংলাদেশীদের জন্য আমার করুণা হয়। এ দেশ স্বাধীন করার, এ দেশের গোড়ার বছরগুলোর সর্বনাশা কর্মকাণ্ডের ইতিহাস জানার সুযোগ তাদের দেয়া হয়নি। কিন্তু যারা সেই ইতিহাস মোটামুটিও জানেন তারা অবশ্যই জানেন বাংলাদেশের রাজনীতিতে সহিংসতা, গুপ্তহত্যা ও পর্বতপ্রমাণ দুর্নীতি আমদানি করেছে আওয়ামী লীগ। অন্য দলগুলো অপেক্ষাকৃত নতুন। ছোটখাটো আকারে কিছু অপকর্ম তারা আওয়ামী লীগের কাছ থেকেই শিখেছে। জামায়াতের বিরুদ্ধে যুদ্ধের আসল রহস্য কিন্তু জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার সরকারের প্রকাশ্য যুদ্ধের ইতিহাস অন্য রকমের। ২০০৭-০৮ সালে দুই বছর বাংলাদেশে একটা বর্ণচোরা সামরিক সরকারের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মার্কিন নাগরিক ফখরুদ্দীন আহমেদ। সেই সময় আমেরিকায় বসবাসকারী সজীব ওয়াজেদ জয় ও অন্য একজন মার্কিন নাগরিক কার্ল চিয়াভাচো যৌথভাবে এক প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। সেই প্রবন্ধে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের গদি সুরক্ষিত করার জন্য যে রূপরেখা দেয়া হয়েছিল, ধর্মীয় রাজনীতি নির্মূল করা ছিল তার একটি প্রধান দিকনির্দেশ। জয় বিদেশে নিজেকে বাংলাদেশ প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা বলে পরিচয় দেন এবং সেই পরিচয়ে ব্যবসায় করেন। হয়তো তার ডিজিটাল পরামর্শেই শেখ হাসিনা গোড়া থেকেই জামায়াতকে ধ্বংস করার পরিকল্পনা নিয়েছিলেনÑ জামায়াতের কোনো সন্ত্রাসের কারণে নয়। সজীব ওয়াজেদ জয় শৈশবে মায়ের সাথে ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয়ে ছিলেন। পরে তার শিক্ষাও হয়েছে ভারতের স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে। আরো পরে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে যান, মার্কিন মহিলাকে বিয়ে করেন। যুক্তরাষ্ট্রে প্রচুর বিত্ত-সম্পত্তির অধিকারী হয়েছেন তিনি। বস্তুত তার বিপুল সম্পদের উৎস সম্পর্কে মার্কিন ও কানাডীয় সরকার কৌতূহলী। সুতরাং বাংলাদেশ সম্পর্কে তার জ্ঞান প্রশস্ত হওয়ার কোনো কারণ নেই এবং বাংলাদেশের রাজনীতিতে তার বর্তমান আগ্রহ স্বার্থসংশ্লিষ্ট হতে বাধ্য। শেখ-ভগিনীদ্বয়ের সন্তানেরা পিতৃপরিচয়ের চেয়ে নানার পরিচয়েই পরিচিত হতে ভালোবাসেন। সজীব ওয়াজেদ জয় এবার অন্তত বাবার গ্রামের কথা মনে করেছেন, রংপুরের পীরগঞ্জে দাদার বাড়ি যাওয়ার তাগিদ বোধ করেছেন তিনি। কিন্তু রহস্যটা কারোই জানতে বাকি নেই। জয় পীরগঞ্জ থেকে সংসদ নির্বাচনে দাঁড়াতে চান, বাবার পরিচয়ে তিনি ভোটভিক্ষা করেছেন। বাংলাদেশের আইনেও আছে নির্বাচনপ্রার্থীরা রাষ্ট্রীয় যানবাহন ইত্যাদিসহ কোনো রাষ্ট্রীয় সম্পদ ব্যবহার করতে পারবেন না। জয় সপরিবার প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে থাকছেন, প্রধানমন্ত্রীর দেহরক্ষী বাহিনীর নিরাপত্তা ভোগ করছেন এবং প্রধানমন্ত্রীর সাথে সরকারি হেলিকপ্টারে পীরগঞ্জ গিয়েছিলেন। শ্বশুরবাড়ি দূরের কথা, স্বামীকেও অতটা পাত্তা দিতেন না শেখ হাসিনা। ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অণুবিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ মিয়া তার বাড়ি সুধা সদনে থাকতে পারেননি। এর পর থেকে জীবনের অবশিষ্ট বছরগুলো তিনি বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির অতিথি হয়ে ছিলেন। সাড়ে চার বছর পর এবার হঠাৎ প্রধানমন্ত্রীর শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার শখ হলো। নির্বাচনের সময় স্বামীর পিত্রালয়ের কথা তার মনে পড়ে ভোটের আশায়। কিন্তু পীরগঞ্জের মানুষ কি এতই বোকা যে শ্বশুরবাড়ি ও দাদার বাড়ির জন্য হঠাৎ দরদে তারা গলে যাবেন? আওয়ামী লীগ কি বাংলাদেশের? অনেকেই বলেছেন এবং এই লেখক একাধিকবার লিখেছেন, যুদ্ধাপরাধের বিচার ও জামায়াতের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ সরকারের সর্বাত্মক যুদ্ধ নিতান্তই রাজনৈতিক ব্যাপার। প্রধানমন্ত্রীর ডিজিটাল উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের উক্তি থেকে তা আরেকবার প্রমাণ হলো। জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের রায়ে উল্লসিত জয় বলেছেন, ‘জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল আওয়ামী লীগের জন্য অসাধারণ বিজয়। এ নিবন্ধন বাতিলের প্রতিবাদ হয়েছে পাকিস্তান থেকে। জয় তাই ঘোষণা করেছেন, ‘জামায়াত বাংলাদেশ নয়, পাকিস্তানের।আওয়ামী লীগ ১৯৪৯ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত ছিল পাকিস্তানের একটা রাজনৈতিক দল। কিন্তু কয়েক বছর ধরে এ দলের সমর্থন বাংলাদেশের চেয়ে ভারতে বেশি। ভারতীয় নেতারা এখন আর গোপন করেন না যে, যেকোনো মূল্যে তারা শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগকে গদিতে রাখতে চান। জয়ের সর্বশেষ উক্তির পর বাংলাদেশীরা এখন আওয়ামী লীগকে ভারতীয় কোনো দলের শাখা বলে মনে করতে পারেন। নিবন্ধন বাতিলের বিষয়টি এখন উচ্চ আদালতে আপিলসাপেক্ষ। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত কী হবে এখনো বলা যাবে না। কিন্তু মন্ত্রীরা আর আওয়ামী লীগ নেতারা জামায়াতের ভবিষ্যৎ নিয়ে হাইকোর্টের রায়ের প্রেক্ষিতে উল্টোপাল্টা মন্তব্য করে যাচ্ছেন। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু বলেছেন, জামায়াত কোনো রাজনৈতিক দল নয়। টুকু সাহেব হয়তো স্টুপিড, নয়তো ইতিহাস কাকে বলে তিনি জানেন না। অতীতে এই দলের সাথে আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনা যেসব লেনদেন করেছেন, সেগুলো তাহলে কিসের ভিত্তিতে হয়েছিল? কয়েকটি দৃষ্টান্ত দিলে কি তার মস্তিষ্কে কিছু জ্ঞানের আলো ঢুকবে? ১৯৮৬ সালের এপ্রিল মাসে বিএনপি, আওয়ামী লীগ ও জামায়াতসহ সব রাজনৈতিক দল এক বৈঠকে জেনারেল এরশাদের সংসদ নির্বাচন বর্জন করতে একমত হয়েছিল। কিন্তু জামায়াতকে দলে টেনে শেখ হাসিনা সেই ঐকমত্য ভঙ্গ করে সেই বছরের ৬ মের নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। ১৯৯৫-৯৬ সালে জামায়াতকে দলে নিয়ে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়কপদ্ধতি চালুর দাবিতে দেশজোড়া সহিংস আন্দোলন করেছিলেন। আওয়ামী লীগ তার দলের প্রেসিডেন্ট প্রার্থীকে দোয়া নেয়ার জন্য জামায়াতের আমির অধ্যাপক গোলাম আযমের কাছে পাঠিয়েছিলেন। বালির উত্তাপ সূর্য যখন মধ্যাকাশে থাকে তার উত্তাপে বালি এতই গরম হয় যে তাতে পা দেয়া যায় না। কিন্তু সূর্য ডুবলে হিম হয়ে যায় সেই বালি। আওয়ামী লীগ নেতাদের বর্তমানের লম্ফন-কুর্দন আর হাঁকডাকও বালির উত্তাপের মতো। দেশে তাদের কোনো সমর্থন নেই। একটি বিদেশী শক্তির সমর্থনের জোরে এত বেশি তড়পাচ্ছেন তারা। কিন্তু বাংলার সুপ্রাচীন একটি প্রবাদের কথা তারা ভুলে যাচ্ছেন : চোরের দশ দিন আর গৃহস্থের এক দিন। সোফোকিসের এক নাটকে একটি সংলাপের অনুবাদ আমি করেছিলাম, ‘কাল হবে অন্য দিন, যে দিনেতে শেষ হবে অতীতের সব অবিচার। কিন্তু সেই দিনের প্রতীক্ষায় বাংলাদেশের মানুষকে আরো কিছু অবিচারের জন্য প্রস্তুত হতে হবে। মনে হচ্ছে সরকারপ্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে বাদ দিয়েই নির্বাচন করার ষড়যন্ত্র করছে। তাদের নির্বাচন কমিশন আশা করছে লোকদেখানো নির্বাচন করে কোনো রকম একটি ফল ঘোষণা করলেই বিদেশী প্রভুদের খুঁটির জোরে সেই ফল তারা বহাল রাখতে পারবে। এ অবস্থায় বিএনপি ও ১৮ দলের জোটের উচিত ছিল অবিলম্বে তত্ত্বাবধায়কপদ্ধতি ফিরিয়ে আনতে সরকারকে বাধ্য করা, নতুবা সরকারকে বিদায় করা। সেই ভয় সরকারের আছে। সে জন্যই বিএনপিতে ভাঙন ধরানোর কোনো চেষ্টার ত্রুটি তারা করছে না। মন্ত্রীদের ও শাসক দলের নেতাদের উল্টোপাল্টা কথাবার্তার সেটাও একটা উদ্দেশ্য। তারা বিরোধী দলের সমর্থকদের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করছেন। তা ছাড়া শোনা যাচ্ছে একটা গোয়েন্দা বাহিনীকেও এ লক্ষ্যে সক্রিয়ভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। ২০০৮ সালের অক্টোবরে বিএনপিকে ভেঙে দেয়ার যে চেষ্টা এই সংস্থা করেছিল, সে কথা বাংলাদেশের মানুষের বিশেষ করে বিএনপি নেতাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয়। মওদুদ কার উপকার করছেন? বিএনপির আন্দোলন প্রায়ই আমাকে একটা কাহিনী মনে করিয়ে দেয়। বাড়িতে ডাকাত পড়েছিল। ডাকাতেরা কাচারিঘরের সামনে আসতেই লোকটি অন্দরমহলে গিয়ে লুকোয়। তার পর ডাকাতেরা ঘরে ঢুকলে সে টঙে উঠে লুকিয়ে থাকে। এ কাহিনী বন্ধুদের বলার সময় সে বারবার করে বলছিল, ‘আমি কি সাহস ছাড়ি?’ বিএনপির আন্দোলনও সে রকমেরইÑ তারা কখনো এগোয় আর কখনো পেছোয়। খালেদা জিয়া চূড়ান্ত আন্দোলনের কয়েকটি সময়সূচি ঘোষণা করেছিলেন, কিন্তু ঘোষিত সময়ে কিছুই ঘটেনি। তার ওপর নেতাদের পরস্পরবিরোধী কথাবার্তা কর্মী ও সমর্থকদের মনেও হতাশা আর বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। একটা দৃষ্টান্ত দিলেই যথেষ্ট হবে। বেগম জিয়া ওমরাহ করতে সৌদি আরবে গিয়েছিলেন। তার আগে পর্যন্ত ঘোষণা ছিল যে ঈদের পরই চূড়ান্ত আন্দোলন শুরু হবে। কিন্তু তার বিদেশে অবস্থানের কয়েক দিনের মধ্যে সিনিয়র নেতা মওদুদ আহমদ কয়েক প্রকারের উক্তি করেছেন। তিনি প্রথমে বলেছেন অক্টোবর মাসে লাগাতার হরতাল করা হবে। তার পরই আবার তিনি বলেছেন, সেপ্টেম্বর মাসে আন্দোলন শুরু হবে, প্রয়োজনবোধে অক্টোবর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত লাগাতার হরতাল হবে। সাধারণ মানুষ জানে ঈদের পর আগস্ট মাসেরও প্রায় তিন সপ্তাহ অবশিষ্ট আছে। এ সময় বিএনপি নেতারা কি নাকে তেল দিয়ে ঘুমোবেন? শেখ হাসিনা যদি সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে কিংবা অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে নির্বাচন ডেকে বসেন (খুব সম্ভবত সেটিই তার পরিকল্পনা) তা হলে তার পরে লাগাতার হরতাল ডেকে কার কী লাভ হবে? মওদুদ সাহেবেরা উল্টোপাল্টা সময়সূচি ঘোষণা করে কার উপকার করছেন জানি না, কিন্তু বিএনপির কোনো উপকার তারা করছেন না। ভবিষ্যতে কী হবে, বাংলাদেশের মানুষের কপালে কী আছে আল্লাহই জানেন। আপনাদের সবাইকে পবিত্র ঈদের আন্তরিক মোবারক। 


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads