বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ বিরোধী দলগুলোর পাশাপাশি অন্য সব দল ও মহলের পক্ষ থেকেও সংবিধানে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের বিধান যুক্ত করার দাবি শক্তিশালী হতে শুরু করেছে। আহ্বান জানানো হচ্ছে সংলাপের মাধ্যমে সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য। উল্লেখযোগ্যদের মধ্যে একদিকে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং গণফোরাম নেতা ড. কামাল হোসেন এই দাবি জানিয়েছেন। অন্যদিকে বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজীনা ও চীনের রাষ্ট্রদূত লি জুন আহবান জানিয়েছেন সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতায় আসার জন্য। প্রথমে রাষ্ট্রদূতদ্বয়ের বক্তব্য উল্লেখ করা যাক। গত ১২ আগস্ট বিএনপির চেয়ারপারসন ও বিরোধী দলের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে এক বৈঠক শেষে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজীনা বলেছেন, গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য বাংলাদেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে সংলাপ দরকার। তিনি আশা প্রকাশ করে বলেছেন, সংলাপ বা আলোচনা হলেই সমঝোতার একটি পথ বেরিয়ে আসবে। বেগম খালেদা জিয়াও মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে অনেকাংশে একমত পোষণ করে বলেছেন, সংলাপ বা আলোচনার ব্যাপারে তার নিজের এবং ১৮ দলীয় জোটের আগ্রহ রয়েছে। কিন্তুু এটুকুই যথেষ্ট নয়। সমান আগ্রহ থাকতে হবে প্রধানমন্ত্রীরও।
মার্কিন রাষ্ট্রদূতের পর দৃশ্যপটে এসেছেন চীনের রাষ্ট্রদূত লি জুন। গত ২১ আগস্ট এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধী দলের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মধ্যে সরাসরি সংলাপের উদ্যোগ নেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। রাষ্ট্রদূত লি জুন বলেছেন, চীন মনে করে, আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রক্রিয়া নিয়ে দুই নেত্রীর মধ্যে সমঝোতায় পৌঁছানোটা জরুরি। বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে প্রথমবারের মতো প্রকাশ্যে বলতে গিয়ে রাষ্ট্রদূত বলেছেন, অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনসহ অনেক বিষয়েই প্রধান দুই দলের মধ্যে অনেক মিল রয়েছে। বিরোধ শুধু নির্বাচনের পদ্ধতি নিয়ে। এ ব্যাপারে মিডিয়ার মাধ্যমেই দল দুটির মধ্যে আলোচনা চলছে। কিন্তু সংকট কাটিয়ে উঠতে হলে দুই নেত্রীর মধ্যে সরাসরি সংলাপ হতে হবে। উভয় দলেই তার বন্ধু রয়েছেন জানিয়ে রাষ্ট্রদূত জানিয়েছেন, তাদের সঙ্গে তিনি কথা বলতে শুরু করেছেন। এরই ধারাবাহিকতায় অচিরেই তিনি দুই নেত্রীকে সংলাপে বসানোর উদ্যোগ নেবেন। রাষ্ট্রদূতের বিশ্বাস, বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতারা তাদের প্রজ্ঞার পরিচয় দেবেন। রাষ্ট্রদূত অবশ্য বলে রেখেছেন, তিনি উদ্যোগ নিলেও জনগণই এদেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে। তবে চীনের কাছে বাংলাদেশের শান্তি, স্থিতিশীলতা, নিরাপত্তা ও উন্নয়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এদিকে ২২ আগস্ট কাদের সিদ্দিকীর দল কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সঙ্গে বৈঠককালে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, নির্দলীয় সরকার ছাড়া এদেশে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন সম্ভব নয়। এ ব্যাপারে প্রধান দুই দলকে একটি সমঝোতায় আসতেই হবে। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের কাছেও একই অভিমত ব্যক্ত করে তিনি বলেছেন, দেশে অশান্তির কালো মেঘ ঘনিয়ে আসছে। কোনো ব্যক্তি বা দলের ইচ্ছার কারণে অশান্তি নেমে এলে জনগণ ক্ষমা করবে না। দেশে অবশ্যই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে এবং তা হতে হবে নির্দলীয় সরকারের অধীনে। এজন্য রাজনৈতিক নেতাদের প্রতি আকুল আবেদন জানিয়ে ড. ইউনূস বলেছেন, তাদের উচিত আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে অবিলম্বে একটি সমঝোতায় পৌঁছানো। কারণ, সময় খুব কম। অন্যদিকে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে ড. কামাল হোসেনও সংলাপের একই আহ্বান জানিয়েছেন। সংবিধানের অধীনে নির্বাচন করার প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রীর অনমনীয়তার সমালোচনা করে ড. কামাল জানতে চেয়েছেন, তিনি কোন সংবিধানের কথা বলছেন? প্রধানমন্ত্রী যে সংবিধানের কথা বলছেন সেটা তাদের ইচ্ছামতো সংশোধিত সংবিধান। কারণ, পঞ্চদশ সংশোধনীর জন্য জনগণের কোনো ম্যান্ডেট ছিল না। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী মেনিফেস্টোতেও বলা হয়নি যে, সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হবে। কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী সংবিধান সংশোধন করেছেন এবং সে সংবিধানের অধীনেই নির্বাচন করতে চাচ্ছেন। ড. কামাল হোসেনের মতে জনগণের সঙ্গে এর চাইতে বড় বেঈমানী ও প্রতারণা আর কিছু হতে পারে না। বিরোধী দলের দাবি অনুযায়ী সংবিধান সংশোধনের আহ্বান জানিয়ে ড. কামাল বলেছেন, সংবিধান এমন কোনো বিষয় নয় যে, তা পরিবর্তন করা যাবে না। উল্লেখ্য, ড. ইউনূসের সঙ্গে বৈঠককালে কাদের সিদ্দিকীও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানিয়েছেন। অন্যদিকে সুজনের অনুষ্ঠানে সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, বর্তমান জনপ্রশাসন আইনের অধীনে সরকারি কর্মকর্তাদের দিয়ে নিরপেক্ষ নির্বাচন করা সম্ভব নয়। ক্ষমতাসীন দলের নেতারা যে এরই মধ্যে সরকারি খরচে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেছেন তারও উল্লেখ করেছেন তিনি।
এভাবেই দেশী-বিদেশী বিভিন্ন মহল থেকে সংলাপের মাধ্যমে সংকট কাটিয়ে ওঠার আহ্বান জানানো হচ্ছে। প্রথমে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বক্তব্যের জবাবে বেগম খালেদা জিয়ার বক্তব্য লক্ষ্য করা দরকার। তিনি বলেছেন, সংলাপ বা আলোচনার ব্যাপারে তার নিজের এবং ১৮ দলীয় জোটের আগ্রহ রয়েছে। কিন্তুু এটুকুই যথেষ্ট নয়। সমান আগ্রহ থাকতে হবে প্রধানমন্ত্রীরও। বলার অপেক্ষা রাখে না, বেগম জিয়ার বক্তব্য শুধু তাৎপর্যপূর্ণ নয়, সম্পূর্ণ সত্যও। কারণ, সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতায় পৌঁছানোর প্রশ্নে প্রথম থেকে প্রধানন্ত্রীই নেতিবাচক অবস্থান নিয়ে বসে আছেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি তো প্রত্যাখ্যান করে চলেছেনই, একই সঙ্গে বিরোধী দলকে নির্বাচনই হবে না বলে ভয়ও দেখাচ্ছেন তিনি। বলে বেড়াচ্ছেন, বাংলাদেশে আর কোনো অসাংবিধানিক সরকারের প্রয়োজন নেই। অসাংবিধানিক কাউকে আনার চেষ্টা করবেন না। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলেই বরং নির্বাচন সুষ্ঠু হয় এবং জনগণ যাকে খুশি তাকে ভোট দিতে পারে। প্রধানমন্ত্রী প্রসঙ্গক্রমে ঘোষণা করে চলেছেন, নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে সংবিধান অনুযায়ী এবং তার সরকারের অধীনেই।
সংকটও ঘনীভূত হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর এই অনমনীয় মনোভাব ও কঠোর অবস্থানের জন্যই। কারণ, তত্ত্বাবধায়ক নামের যে সরকারকে উদাহরণ বানিয়ে বিরোধী দলকে তিনি ভয় দেখাচ্ছেন সে সরকার তো ছিল তাদেরই ‘আন্দোলনের ফসল’! কথাটা প্রধানমন্ত্রী নিজেও সে সময় জোর গলায় বহুবার বলেছিলেন। প্রশ্ন হলো, নিজেদের আন্দোলনের সে ‘ফসল’কে নিয়েই বা তার এত ভীতি ও সংশয় কেন? আমরা তো মনে করি, সব পক্ষ যদি সততার সঙ্গে গণতন্ত্র ও সংবিধানকে সমুন্নত রাখতে পারে এবং কোনো বিশেষ নেত্রী যদি ক্ষমতায় আসতে পারবেন না বলে লগি-বৈঠার হত্যা-সন্ত্রাসের মতো ভয়ংকর পথে পা না বাড়ান তাহলে কোনো অসাংবিধানিক শক্তি বা গোষ্ঠীর পক্ষেই ক্ষমতা দখল করা সম্ভব হওয়ার কথা নয়। সেটা না করে কেউ যদি নিজেই গাছের গোড়া কেটে ওপরে ওপরে পানি ঢালার অভিনয় করেন তাহলে আর যা-ই হোক, গণতন্ত্র ও সংবিধানকে সমুন্নত ও বাধাহীন রাখা সম্ভব হবে না। এই সহজ কথাটা না বোঝার কোনো কারণ থাকতে পারে না। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী সহজ ও গণতন্ত্রসম্মত সে পথটিতে আসতেই চাচ্ছেন না। তা সত্ত্বেও দুই নেত্রীকে সংলাপে বসানোর জন্য বিশেষ করে চীনের এই উদ্যোগকে সম্ভাবনাময় মনে করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, গণতন্ত্র এবং গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল ও কার্যক্রমের কথা যতোই বলা হোক না কেন, প্রমাণিত সত্য হলো, ক্রমাগত ঘনীভূত হয়ে ওঠা রাজনৈতিক সংকট কাটিয়ে উঠতে হলে সিদ্ধান্ত আসতে হবে প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধী দলের নেতার কাছ থেকে। অন্যদিকে এ দুই প্রধান নেত্রীই পরস্পরের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে রেখেছেন। রাজনৈতিক বিরোধিতা ও ভিন্নমত তো রয়েছেই, দু’জনের মধ্যে ব্যক্তিগত সম্পর্কও এত বেশি অবন্ধুসুলভ যে, তারা এমনকি কেউ কারও সঙ্গে কথা পর্যন্ত বলেন না। গণতন্ত্রে এ এক অবিশ্বাস্য বিষয়। মূলত সে কারণেই দেশী-বিদেশী কোনো মহলের উদ্যোগই এ পর্যন্ত সফল হয়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ অনেক দেশই প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে উদ্যোগ নিয়েছে। প্রশ্নসাপেক্ষ হলেও ভারতের রাষ্ট্রদূতও জোর তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু দুই নেত্রীর সম্পর্কের বরফ গলেনি, গলবে এমন সম্ভাবনাও লক্ষ্যযোগ্য হয়নি। সব মিলিয়ে সবার জন্য বরং হাল ছেড়ে দেয়ার অবস্থাই হয়েছে। উদ্যোগ গ্রহণকারীদের কেউ কেউ প্রকাশ্যে হতাশা পর্যন্ত ব্যক্ত করেছেন।
সামগ্রিক এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতেই চীনের রাষ্ট্রদূত লি জুনের উদ্যোগ নেয়ার ঘোষণা মানুষের মনে আশাবাদের না হলেও আগ্রহের সৃষ্টি করেছে। কারণ, বাংলাদেশের জন্য চীন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বন্ধুরাষ্ট্র। সমরাস্ত্রের সরবরাহ থেকে ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিক্ষা-স্বাস্থ্যসহ রাষ্ট্রীয় উন্নয়নের সব ক্ষেত্রেই চীনের রয়েছে বিরাট ইতিবাচক ভূমিকা। বড়কথা, কোনো কোনো ‘বন্ধু’ নামধারী রাষ্ট্রের মতো চীন কখনও বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করেনি। রাষ্ট্রক্ষমতার রদবদলের লক্ষ্যে চীন কখনও ১/১১ ঘটানোর মতো কোনো ষড়যন্ত্রেও যুক্ত হয়নি। এসব কারণেই চীনের প্রতি সাধারণ মানুষের মতো রাজনৈতিক দলগুলোরও বিশেষ সমীহ রয়েছে। একই কারণে চীনের পক্ষ থেকে সত্যিই কোনো উদ্যোগ নেয়া হলে দুই নেত্রীর কেউই একবাক্যে নাকচ করে দেবেন না বলেই সাধারণ মানুষের ধারণা। সচেতন মহল অবশ্য মনে করেন, তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়ার আগে চীনের রাষ্ট্রদূত নিশ্চয়ই সমস্যার মূল কারণগুলো সম্পর্কে জেনে নেবেন। তিনি যে এরই মধ্যে জেনেও নিয়েছেন সে সম্পর্কে জানা গেছে তার বক্তব্য থেকেই। তিনি সঠিকভাবেই চিহ্নিত করেছেন, কোন ধরনের সরকারের অধীনে নির্বাচন অুনুষ্ঠিত হবে সেটাই সমস্যার মূল কারণ। প্রধান দুই নেত্রীর অবস্থান ও মনোভাব সম্পর্কেও নিশ্চয়ই তিনি জেনে নেবেন। আমরা তাকে শুধু এটুকুই স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, উচ্চ আদালতের বিতর্কিত ও বিভক্ত যে রায়ের আলোকে প্রধানমন্ত্রী সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে বাতিল করেছেন সে রায়টিতেই পরবর্তী দুটি জাতীয় নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে বলে অভিমত দেয়া হয়েছিল। কিন্তু ক্ষমতাসীনরা রায়ের একটি অংশের ভিত্তিতে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করেছেন বলেই সংকটের সৃষ্টি হয়েছে।
এর কারণ সম্পর্কেও নিশ্চয়ই মাননীয় রাষ্ট্রদূতের জানা রয়েছে। সে কারণটি হলো, আওয়ামী লীগের মতো কোনো ফ্যাসিস্ট দলের নেতৃত্বে গঠিত কোনো সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে না। ইতিহাসও সে সাক্ষ্যই দেয়। রাষ্ট্রদূতের অবগতির জন্য অন্য দুটি তথ্যের একটি হলো, নির্বাচনকালীন সরকারের প্রশ্নে বেগম খালেদা জিয়া নমনীয়তা যথেষ্টই দেখিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ওই সরকারের নাম তত্ত্বাবধায়ক না হয়ে নির্দলীয় বা অন্য কিছু হলেও তার আপত্তি নেই। যে কোনো নাম দেয়া যেতে পারে কিন্তু নির্বাচনকালীন সরকারকে অবশ্যই দলনিরপেক্ষ হতে হবেÑ অন্তত শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন হতে দেয়া হবে না। রাষ্ট্রদূতের জন্য প্রাসঙ্গিক অন্য তথ্যটি হলো, খালেদা জিয়া নমনীয়তা দেখালেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কিন্তু সর্বশেষ উপলক্ষেও ঘোষণা করেছেন, তিনি সংবিধান থেকে ‘এক চুলও’ নড়বেন না। অর্থাৎ নিজেদের চাপিয়ে দেয়া সংবিধানের আড়াল নিয়ে প্রধানমন্ত্রী তার সরকারের অধীনেই নির্বাচন করতে চাচ্ছেন। এমন অবস্থায় চীনের রাষ্ট্রদূতের পক্ষে সংলাপের উদ্যোগ খুব সহজে সফল হবে বলে মনে হয় না। শুধু তা-ই নয়, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর কঠোর অবস্থান ও অনমনীয় মনোভাবের কারণে রাষ্ট্রদূত লি জুনের উদ্যোগ ব্যর্থও হয়ে যেতে পারে যেতে পারে বলে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। তা সত্ত্বেও বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থেই আমরা তার সাফল্য কামনা করি। দুই নেত্রী, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের বিষয়টিকে যথোচিত গুরুত্ব দেবেন এবং রাষ্ট্রদূতকে একেবারে ‘বেচারা’ বানিয়ে ফেলবেন না বলেও আমরা আশা করতে চাই।
প্রসঙ্গক্রমে ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং ড. কামাল হোসেনের দিকেও দৃষ্টি ফেরানো দরকার। ২২ আগস্টের পৃথক দুটি অনুষ্ঠানের অন্য সব বক্তাও নির্দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন করার দাবি জানিয়েছেন। তারা সেই সঙ্গে জাতীয় সংসদের আসন্ন অধিবেশনে সংবিধান সংশোধন করে নির্দলীয় সরকারের বিধান যুক্ত করার জন্যও তাগিদ ও পরামর্শ দিয়েছেন। শান্তি ও স্থিতিশীলতাসহ বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থেই এই দাবি ও পরামর্শের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করা দরকার। কারণ, আবারও ক্ষমতায় আসার পথ পরিষ্কার করার জন্যই যে সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনী আনা হয়েছেÑ একথা প্রমাণিত হয়েছে প্রথম থেকেই। উদ্দেশ্যে সততা ছিল না বলেই ক্ষমতাসীনরা উচ্চ আদালতের দেয়া বিতর্কিত ও বিভক্ত রায়ের একটি মাত্র অংশকে অজুহাত বানিয়েছেন। অথচ একই রায়ের অন্য অংশে পররবর্তী দুটি জাতীয় নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হতে পারে বলে অভিমত দেয়া হয়েছিল। ক্ষমতাসীনদের এই অপকৌশলকেই জনগণের সঙ্গে ‘বেঈমানী ও প্রতারণা’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন ড. কামাল হোসেন। বিষয়টি অবশ্যই স্বাভাবিক নয়। কারণ, মূলত নির্বাচনকালীন সরকারের প্রশ্নেই রাজনৈতিক সংকট তৈরি হয়েছে। সে সংকট এরই মধ্যে এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যখন জনগণের পাশাপাশি বিদেশীরা পর্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। পরিস্থিতি অত্যন্ত আশংকাজনক হয়ে পড়েছে বলেই ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মতো রাজনীতিবিমুখ নোবেল বিজয়ীকেও বলতে হয়েছে, দেশের ওপর অশান্তির কালো মেঘ ঘনিয়ে আসছে এবং অশান্তি নেমে এলে জনগণ দায়ীদের ক্ষমা করবে না। কারা এজন্য দায়ী সেকথা নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না। আমরা মনে করি, ড. ইউনূসের অন্য একটি মন্তব্যও যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। রাজনীতিকদের মধ্যে সমঝোতা প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেছেন, ‘সময় খুব কম’।
সময় আসলেও দ্রুত পেরিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে ক্ষমতাসীনরা শুধু ‘আওয়ামী’ হিসেবে চিহ্নিত সংবিধানের দোহাই দিচ্ছেন না, প্রধানমন্ত্রী এই ঘোষণা পর্যন্ত দিয়ে বসেছেন, তারা সংবিধান থেকে ‘এক চুল’ও নড়বেন না। বলাবাহুল্য, এমন অনড় মনোভাব ও কঠোর অবস্থান গণতন্ত্রসম্মত তো নয়ই, সমঝোতায় পৌঁছানোর পথেও বিরাট প্রতিবন্ধক হয়ে উঠবে। বাস্তবে উঠেছেও। আর সে কারণেই বিরোধী দলের সব দাবি ও আহ্বান হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে, বিদেশীদের উদ্যোগও সফল হতে পারছে না। গণতন্ত্রের প্রশ্নে আদৌ সদিচ্ছা থেকে থাকলে প্রধানমন্ত্রীর উচিত অবিলম্বে চিন্তা ও সিদ্ধান্তে পরিবর্তন আনা এবং সংসদের আসন্ন অধিবেশনে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের বিধান যুক্ত করে সংবিধান সংশোধন করা। পুনরুল্লেখ করে হলেও বলা দরকার, এ ব্যাপারে বিরোধী দলের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া বহুদিন ধরেই নমনীয়তা দেখিয়ে চলেছেন। তিনি বলেছেন, নির্বাচনকালীন সরকারের যে কোনো নাম দেয়া যেতে পারে কিন্তু সরকারকে অবশ্যই দলনিরপেক্ষ হতে হবে। বলার অপেক্ষা রাখে না, গণতন্ত্রকে সমুন্নত রাখার এবং দেশকে শান্তি ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নেয়ার পাশাপাশি দেশী-বিদেশী সকল মহলের আহ্বান ও পরামর্শের প্রতি সম্মান দেখানো এখন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। এ ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের রাষ্ট্রদূতের পরামর্শ ও আহ্বানও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ও সময়োচিত বলা যায়। প্রধানমন্ত্রীর উচিত, এই আহবানে সাড়া দেয়া এবং সংবিধান সংশোধন করে দেশকে সংঘাত ও অনিশ্চয়তার অশুভ পরিণতি থেকে রক্ষা করা। নিজেদের স্বার্থেও প্রধানমন্ত্রীকে ‘এক চুল’ বিষয়ক ঘোষণা থেকে নড়তেই হবে। কারণ, তিনি নিশ্চয়ই জানেন, স্বৈরশাসকদের পরিণতি কোনো দেশে কোনো সময়ই ভালো হয়নি। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম হতে পারবে না। অশুভ সে পরিণতির প্রধান শিকার প্রধানমন্ত্রীকেই হতে হবে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন