বাংলাদেশের রাজনৈতিক জীবন
শুরু হয় সংসদীয় গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থা চালুর মাধ্যমে। আওয়ামী লীগের
রাজনৈতিক ইতিহাস দীর্ঘ দিনের। কিন্তু এটি সঠিক পথে দেশ পরিচালনা করতে সক্ষম হয়নি।
বাস্তবে দলটির কার্যকলাপ নেতানেত্রীরা শুধু মুখে বলেই থাকেন। যেসব গুণ একটি দলের
জনপ্রিয়তা বাড়াতে পারে সেগুলোর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উপাদান হলো গণতন্ত্র। কিন্তু
দলটি ১৯৭৫ সালে গণতন্ত্রের গলা টিপে হত্যা করে প্রতিষ্ঠা করে বাকশাল। নেতাকর্মীরা
লোভ-লালসা পরিহার করে ব্যক্তিস্বার্থ, দলীয় স্বার্থ
ও পারিবারিক স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠতে পারেননি। দলটি ১৯৭৪ সালে জনপ্রিয়তা হারায়।
এমনকি এক বিভীষিকা, অরাজকতা ও বিশৃঙ্খল পরিবেশ
সৃষ্টি হয় দেশজুড়ে। দক্ষ প্রশাসনের অভাবে শিল্পকারখানাগুলো প্রচুর লোকসানের
সম্মুখীন হয়। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর এর প্রভাব পড়ে। অর্থনৈতিক স্থবিরতা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি এবং সর্বোপরি ক্ষমতাসীন দলের
অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসে সংবিধান পরিবর্তন করে
সংসদীয় গণতন্ত্র পরিত্যাগ করে একদলীয় রাষ্ট্রপতি শাসনব্যবস্থা কায়েম করা হয়।
ফলে দলটি প্রায় বন্ধুহীন হয়ে পড়ে। এমনই একটি শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে ১৯৭৫ সালের
নভেম্বর মাসে দেশপ্রেমিক সিপাহি জনতা তৎকালীন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর
রহমানকে জাতীয় বৃহত্তর স্বার্থে ক্ষমতায় নিয়ে আসে। সেদিন তিনি যদি সিপাহি জনতার
ডাকে সাড়া না দিতেন তাহলে দেশ গৃহযুদ্ধের দিকে ধাবিত হতো। ক্ষমতা গ্রহণের পর তিনি
ঘোষণা করেন, জনগণের ক্ষমতা জনগণকে ফিরিয়ে
দেয়া হবে। জিয়াউর রহমান জানতেন, সামরিক শাসন
কোনো স্থায়ী ব্যবস্থা নয়। জনগণ এ ব্যবস্থা দীর্ঘ দিন মেনে নেবে না। তিনি এক ঐতিহাসিক
ঘোষণার মাধ্যমে একদলীয় বাকশাল পদ্ধতি বাতিল করে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা
প্রবর্তন করেন। প্রশাসন বেসামরিকীকরণ করার প্রক্রিয়ার একপর্যায়ে জিয়াউর রহমান ১৯৭৮
সালের ১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)
প্রতিষ্ঠা করেন। তারই সুদৃঢ় নেতৃত্বে ১৯ দফা কর্মসূচি নিয়ে দল যাত্রা শুরু করে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন,
যুদ্ধ করেছেন। তিনি স্বাধীনতার মহান ঘোষক। তিনি গ্রামগঞ্জে, দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় ভ্রমণ করেছেন। খাল কেটেছেন, জনগণের সাথে একাত্ম হয়ে তাদের সুখ-দুঃখের সাথে মিশে গেছেন। তিনি
বুঝতে পেরেছিলেন, এ দেশের সাধারণ মানুষ চায়
সহজ সরল, সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব একমাত্র
বেঁচে থাকার তাগিদে। দেশকে উপনিবেশবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, সম্প্রসারণবাদ ও আধিপত্যবাদ থেকে রক্ষায় তিনি ছিলেন সচেষ্টÑ শহীদ জিয়ার নেতৃত্বে ও ব্যক্তিত্বে ছিল সততা ও সত্যবাদিতা।
ক্ষমাশীলতা ও সমঝোতার রাজনীতিই ছিল জিয়ার রাজনৈতিক দর্শন। উৎপাদন ও উন্নয়নই তার
রাজনৈতিক লক্ষ্য। ১৯৭৫ সালে আওয়ামী আমলে বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ির খেতাব দেয়া
হয়। রাষ্ট্রপতি জিয়া সেই বদনাম ঘুচাতে সক্ষম হয়েছিলেন। দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়
অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার। বিএনপির সামাজিক,
রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্মসূচি সমাজের রাজনৈতিক সচেতন লোকদের মধ্যে
ব্যাপক সাড়া জাগায়। ব্যক্তিগত বিনিয়োগ উৎসাহিত করার কারণে জিয়াউর রহমান
শিল্পোদ্যোক্তাদের মধ্যে সমাদৃত হন। কৃষি উপকরণ সরবরাহের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন
বৃদ্ধির নীতি গ্রহণ করার কারণে কৃষকেরা বিএনপির প্রতি ব্যাপক সাড়া দেন। জিয়াউর
রহমানের খাল কাটা কর্মসূচি পল্লী উন্নয়ন পরিকল্পনা,
তার পল্লী এলাকায় প্রতিনিয়ত ভ্রমণের কারণে পল্লীর জনগণের মধ্যে এ
ধারণা হয় যে, বিএনপি সরকার অবহেলিত পল্লী
এলাকার উন্নয়নের জন্য সত্যিই আগ্রহী। এরই ফলে কৃষি ও শিল্প উৎপাদন ছিল
আশাব্যঞ্জক। জাতীয় ঐক্যের ক্ষেত্রে জিয়াউর রহমানের অবদান অবিস্মরণীয়। তিনি
জাতীয় ঐক্যের খাতিরে সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দিয়ে এর স্থলে
সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর বিশ্বাস স্থাপন করেন। জনগণের মধ্যে ব্যাপক সমর্থন থাকা
সত্ত্বেও জিয়াউর রহমান মৃত্যুর পর তৎকালীন সেনাবাহিনী প্রধান হুসেইন মুহম্মদ
এরশাদ নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে ১৯৮২ সালের মার্চ মাসে ক্ষমতা দখল করেন।
বিএনপির এ দুর্দিনে বেগম খালেদা জিয়া এর নেতৃত্ব গ্রহণ করেন এবং অবৈধ এরশাদ
সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করার জন্য আন্দোলন গড়ে তোলেন। আওয়ামী লীগের অসহযোগিতা
সত্ত্বেও বেগম খালেদা জিয়ার আপসহীন সুদৃঢ় নেতৃত্বে এরশাদ সরকারের পতন হয়। এর
জন্য যে সংগঠনের ভূমিকা স্মরণ করতে হয় তা হলো রাষ্ট্রপতি জিয়ার সৃষ্টি ছাত্রদল।
স্বাধীনতাকামী জনগণ জাতীয়তাবাদ ও ইসলামি মূল্যবোধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ১৯৭৫-৮১
পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি জিয়ার এবং পরবর্তী সময়ে বেগম খালেদা জিয়ার জাতীয়তাবাদ
শক্তির পতাকাতলে সমবেত হয়ে স্লোগান তুলেছিল জাতীয়তাবাদী শক্তির পক্ষে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে জিয়াউর রহমান এক ব্যতিক্রমধর্মী জননন্দিত পুরুষ। বাংলা
সাহিত্যে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের অভ্যুদয়কে রবীন্দ্রনাথসহ অনেকেই
ধূমকেতুর সাথে তুলনা করেছেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে জিয়াউর রহমানের সাড়া জাগানো
আগমনের সাথে সাহিত্যে নজরুলের উপস্থিতির আশ্চর্য মিল খুঁজে পাওয়া যায়। জীবনের
গতিপথ ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হলেও তারা দু’জনই ছিলেন
সৈনিক। নজরুল ইসলাম ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক বাহিনীর বাঙালা পল্টনের একজন নন-কমিশন
অফিসার হিসেবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। জিয়াউর রহমানও পাকিস্তান
সেনাবাহিনীর বেঙ্গল রেজিমেন্টের একজন কোম্পানি কমান্ডার হিসেবে ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত
যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তখন বীরত্ব ও রণনৈপুণ্যের সাথে জিয়াউর রহমানের
ব্যক্তিত্বের বিকাশ ও তার প্রতিভার বিচ্ছুরণ ঘটতে থাকে। তখন থেকেই রণক্ষেত্রে ও
জাতীয় দুর্যোগে জিয়াউর রহমানের অবদান অনস্বীকার্য। তিনি হচ্ছেন সঙ্কট ও
সন্ধিক্ষণের নেতা। রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার পর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্মসূচি
বাস্তবায়নের সাথে গোটা দেশকে তিনি কর্মযোগ আন্দোলনে নামিয়েছিলেন, তার দৃষ্টান্ত সারা বিশ্বে বিরল। ক্ষমতায় থেকে এত জনপ্রিয়তা
বিশ্বে খুব কম নেতাই পেয়েছেন। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে তার সাফল্য ছিল অতুলনীয়।
জোট নিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলো, কমনওয়েলথ ও মুসলিম বিশ্বসহ
সারা বিশ্বে অপরিসীম শ্রদ্ধা তিনি অর্জন করেছিলেন। জনগণের কাছে তার প্রভাব ছিল
কিংবদন্তির মতো। দেশের জনসাধারণ তার মৃত্যুতে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন। বেগম
খালেদা জিয়া তার যোগ্য উত্তরসূরি। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর দৃঢ়তার সাথে তিনি
বিএনপির হাল ধরেন। তিনি তার স্বামী হত্যার প্রতিশোধ নিতে চাননি। অত্যন্ত
ধৈর্যসহকারে তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদ এবং বহুদলীয় গণতন্ত্রের সহাবস্থানের মূল
দর্শন প্রচারণায় নেমেছিলেন। তিনি ইতিবাচক প্রচারণাকে বিবেচনায় রেখে ’৯০-এর গণ-অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে ডালভাতের আশ্বাস
দেন। তিনিও সমগ্র দেশের মানুষের মণিকোঠায় বিএনপির কর্মসূচি সফলভাবে উপস্থাপন করেন
এবং ’৯১-এর নির্বাচনে বেগম খালেদা জিয়া ও জাতীয়তাবাদী
দল বিজয়ী হয়। জাতীয়তাবাদী দলের সহনশীলতা, ধৈর্য, ভদ্রতা, মার্জিত আচরণ এ দলের জনপ্রিয়তার
কারণ। চারদলীয় জোটের প্রচেষ্টায়, দেশনেত্রী বেগম
খালেদা জিয়ার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে ২০০১ সালে জোটের বিপুল বিজয়ে প্রমাণিত হলো দেশের
জনসাধারণ শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের দর্শন জাতীয়তাবাদী ও ইসলামি মূল্যবোধের
পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ। ১৮ দলীয় জোট সেই রাজনীতিকে এগিয়ে নিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন