বিলবোর্ড কাহিনী দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক মন্দ উদাহরণ হয়ে থাকবে। গত ৩ আগস্ট রাতের আঁধারে বর্তমান মহাজোট সরকারের সাফল্যগাঁথা সংবলিত বিলবোর্ডে ছেয়ে গিয়েছিল রাজধানী ঢাকা। গত রোববার (১১ আগস্ট) আবার রাতের আঁধারেই বেসরকারি বিজ্ঞাপনদাতা প্রতিষ্ঠানের বিলবোর্ডের ওপর থেকে সরকারের গুণকীর্তন করে প্রচারিত ব্যানারগুলো সরিয়ে নেয়ার দৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। উল্লেখ্য যে, ‘উন্নয়নের অঙ্গীকার ধারাবাহিকতা দরকার’ শিরোনামে বিভিন্ন ছবি সংবলিত ব্যানার সেঁটে দেয়া হয় প্রায় দুই হাজার বেসরকারি বিলবোর্ডের ওপর। ঈদের আগ মুহূর্তে জবরদখল করে সরকারের পক্ষে এমন প্রচারণা চালানো হয় ঢাকা ও ঢাকার আশপাশের এলাকায়। যদিও এই প্রচারণার দায় সরকার নেয়নি, তবুও এ ধরনের জবরদখল ও নজিরবিহীন প্রচারণা নিয়ে জনসাধারণ থেকে শুরু করে বিভিন্ন মহলে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে। দেশী-বিদেশী মিডিয়ায়ও এ নিয়ে নেতিবাচক বক্তব্য আসায় বেকায়দায় পড়ে সরকার। সরকারে থাকা প্রাজ্ঞ রাজনীতিবিদরাও ইমেজ সঙ্কটে পড়ার আশঙ্কা উল্লেখ করে বিলবোর্ড প্রোপাগান্ডার বিপক্ষে কথা বলেন। অবশেষে বাধ্য হয়েই বিলবোর্ড সরানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তবে কারা এসব বিলবোর্ডে ব্যানার লাগিয়েছিল এবং কারাইবা তা খুলে ফেলছে সে ব্যাপারে স্পষ্ট করে কেউ কথা বলতে চাইছেন না। এসব কাজে জড়িত শ্রমিকদের সাথে কথা বললে তারা জানান, যাদের নির্দেশে আমরা এগুলো লাগিয়েছিলাম তাদের নির্দেশেই খুলে ফেলছি।
রাতের আঁধারে বিলবোর্ড দখল এবং রাতের আঁধারে অপসারণের কাজকে কেউই ভাল চোখে দেখছেন না। রাজধানী ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ মোড়ের বাণিজ্যিক বিলবোর্ডগুলো দখল হয়ে যাওয়ায় ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে সাধারণ মানুষের মধ্যে। তারা বলছেন, উন্নয়ন করাই সরকারের দায়িত্ব, এটা এভাবে ঢাকঢোল পিটিয়ে করার কি আছে? তাছাড়া বিলবোর্ডে দেয়া সব তথ্য বিনা প্রশ্নে মেনে নিতে পারছেন না নাগরিকরা। এমনকি আওয়ামী লীগের উদারপন্থী অনেক নেতা-কর্মীরও প্রশ্ন, জনগণের টাকায় এমন বাহারি বিলবোর্ড স্থাপন কেন? তাছাড়া সিটি করপোরেশন থেকে ভাড়া নেয়া বিলবোর্ড দখল করে সরকার ও দলের প্রচারণা চালানো একটি অনৈতিক কাজ। কেউ এ বিষয়টিকে ভালভাবে নিচ্ছেন না। এদিকে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীরাও বিলবোর্ড দখলের বিষয়টিকে সরকারের অগণতান্ত্রিক ও স্বেচ্ছাচারী মনোভাবের প্রকাশ বলে মনে করছেন। বর্তমান সরকারের উন্নয়নের ফিরিস্তি সংবলিত বিলবোর্ড নিয়ে চরম বিস্ময় ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বিজ্ঞাপনদাতা প্রতিষ্ঠান ও বিজ্ঞাপনী সংস্থাগুলো। জানা গেছে, ঈদের মওসুমে বিজ্ঞাপনদাতারা তাদের বিভিন্ন পণ্য যেমন পোশাক, কসমেটিকস তথা ঈদ উপকরণের ব্যাপক প্রচারের স্বার্থে অধিক মূল্যে বিলবোর্ডগুলো ভাড়া নিয়েছিল। কিন্তু ঈদের ঠিক আগ মুহূর্তে তাদের সেসব বিলবোর্ডের ওপর কোনো অনুমতি ছাড়াই সরকারি প্রচারণার ব্যানার সেঁটে দেয়া হয়। এতে বিজ্ঞাপনদাতারা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। ফলে বিজ্ঞাপনদাতাদের চাপের মুখে পড়তে হয় বিজ্ঞাপনী সংস্থাগুলোকে। এমন জবরদখলের প্রতিবাদ করতে গিয়ে তারা পড়েন হুমকির মুখে। ফলে ভয়ে কেউ মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছেন না এখন।
বিলবোর্ড দখল করে সরকারের উন্নয়নগাঁথা তুলে ধরার নামে যেভাবে নির্বাচনী প্রচারণা চালানো হচ্ছে, তা দেশের গণতান্ত্রিক পরিবেশ এবং আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের জন্য এক অশনি সঙ্কেত। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, বিলবোর্ড দখল করে সাফল্যগাঁথা প্রচারের মাধ্যমে যে আগ্রাসী মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে, তাতে মনে হয় আসন্ন নির্বাচনে যে কোনোভাবে বিজয়লাভে বর্তমান সরকারি দল বদ্ধপরিকর। কিন্তু গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য নির্ভর করতে হয় জনমতের উপর। আর জনগণ যাতে অবাধে তাদের রায় প্রদান করতে পারে সেজন্য প্রয়োজন হয় লেভের প্লেয়িং ফিল্ড। এ কারণেই বিরোধী দল বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে চাইছে না, বরং তারা চাইছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, বর্তমান সরকার ও সরকারি দলের সাফল্যগাঁথা প্রচারে যেভাবে বিলবোর্ড জবরদখল করা হয়েছে তাতে আবারও এ কথাই প্রমাণিত হলো যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া বর্তমান সময়ে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। দেশের জনগণও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন চায়। এখন সরকার বিষয়টি উপলব্ধি করলেই মঙ্গল।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন