বাংলায় একটা প্রবাদ আছে, ‘পিপীলিকার পাখা গজায় মরিবার তরে’ পিপীলিকা কঠোর পরিশ্রমী ও সংঘবদ্ধ জীবন যাপন করে। মৃত্যুকালে পিপীলিকার যেমন পাখা গজায় তেমনি তার উড়ারও সখ জাগে। আর যখনই উড়তে যায় তখনই যেখানে সেখানে ধপাস করে পড়ে আর মরে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে ৬৪ বছর বয়সের একটি সংগঠিত দল আ’লীগেরও পিপীলিকার মতো পাখা গজিয়েছে আর উড়ে বহুদূর যেতে চায়। তাদের টুয়েন্টি টুয়েন্টি ওয়ান ভিশন বা তারা ২০২১ সাল পর্যন্ত যে কোন মূল্যে ক্ষমতায় থাকতে চায়। এজন্যে প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন বিষয়ে তার পরামর্শক বা উপদেষ্টা নিয়োগ করেছেন। তার উপদেষ্টাদের মধ্যে এমন লোকও আছেন যার সাথে বাংলার বা বাংলাদেশের মানুষের কোন পরিচয় ও সম্পর্ক পর্যন্ত নেই। বর্তমান মন্ত্রী পরিষদে ও সংসদে এমন কিছু সদস্য আছেন যাদের জনসমর্থন ও জনসম্পৃক্ততা বলতে গেলে শূন্যের কোঠায়।
২০০১ এর নির্বাচনে যে সকল বাম দল তাদের দলীয় প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেছে তাতে দেখা গেছে বর্তমান সরকারের শিল্পমন্ত্রী সাম্যবাদী দলের প্রধান দিলীপ বড়ুয়া সর্বমোট ৯৭২টি ভোট পেয়েছিলেন, যা বৈধ ভোটের ০.০ শতাংশ। তিনি দলীয় প্রধান হিসেবে মান-সম্মানসহ জামানত হারিয়েছিলেন। বাসদের খালেকুজ্জামান পেয়েছিলেন সর্বমোট ২০৯৪৬টি ভোট, যা মোট ভোটের ০.০৪ শতাংশ। ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন পেয়েছিলেন সর্বমোট ৪০৪৮৪টি ভোট, যা মোট ভোটের ০.০৭ শতাংশ। জাসদের সভাপতি বর্তমান সরকারের তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু সর্বমোট ভোট পেয়েছিলেন ১১৯০৭২টি, যা মোট ভোটের ০.২১ শতাংশ। বর্তমান সংসদে যারা আছেন তাদের মধ্যে গ্রাম-গঞ্জের হাটে-বাজারের পালাগানের গায়িকা, বাউল শিল্পী, নাট্যকার, নাট্যাভিনেতা ও নাট্যাভিনেত্রী আর সিনেমার নায়ক ও নায়িকা ইত্যাদি।
বিভিন্ন কারণে ৬৪ বছরের পুরনো দল আ’লীগ তাদের স্বকীয়তা হারিয়ে জনবিচ্ছিন্ন হওয়ার কারণে আজ হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে বিডিআর বিদ্রোহের নামে সেনা কর্মকর্তাদের হত্যা, শেয়ার বাজার লুট, পদ্মা সেতু দুর্নীতি, হলমার্ক কেলেঙ্কারি, খুন, গুম, ধর্ষণ, টেন্ডারবাজি, বিশ্ববিদ্যালয়ের হল ও ক্যাম্পাস দখল, যুবক, ডেসটিনি ও ইউনিপে এ সকল সামাজিক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অর্থ আত্মসাৎ, ধর্ম তথা ইসলাম বিদ্বেষ, কথিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আর আস্তিক-নাস্তিক প্রশ্নে জাতিকে দ্বিধাবিভক্ত করা, রাতের অন্ধকারে হেফাজতে ইসলামের নিরীহ নিরপরাধ কর্মী, এতিম, হাফেজ ও আলেমদের হত্যা, আলেম ওলামা ও ইসলামী ব্যক্তিত্বদেরকে নির্যাতনের কারণে কুমিল্লা, সিলেট, বরিশাল, খুলনা, রাজশাহী ও সর্বশেষ গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে জনগণ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর আ’লীগ খেই হারিয়ে ফেলেছে এবং তাদের টুয়েন্টি টুয়েন্টি ওয়ান ভিশন এর ব্যাপারে দারুণভাবে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। যার ফলে ভূতের ভয়ে মানুষ যেমন আবোল-তাবোল বকে আর হাল্লা-চিল্লা করে ভূত তাড়ানোর চেষ্টা করে আ’লীগও তেমনই আচরণ করছে। মনোবিজ্ঞানের মতে মানুষ যখন হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে তখন হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে আত্মহননের পথ বেছে নেয়। তারই প্রকাশ ঘটেছে আ’লীগ সরকারের রাতের অন্ধকারে অন্যের বিলবোর্ড দখল করে নিজেদের উন্নয়ন কর্মকা- প্রচার করার মাধ্যমে, যা বাংলাদেশের রাজনীতিতে নজীরবিহীন।
বাস্তবতার সাথে আ’লীগের প্রচারিত উন্নয়ন কর্মকা-ের কোন মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। খেলায় কোন সরকারের আমলে কে কয়টা বেশি সোনা, রূপা আর ব্রোঞ্জ পদক পেলো তা যদি উন্নয়নের চিত্র হয় আর এটা যদি উন্নয়নের বিলবোর্ডে শোভা পায় তা হলে এ সরকারকে মানুষ পাগল ছাড়া আর কি বলতে পারে? সাধারণ মানুষ খেলায় সোনা রূপা আর ব্রোঞ্জ এর হিসাব করে না, মানুষ হিসাব করে ক্ষমতাসীন দলের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ১০ টাকা কেজি চাল আর বিনামূল্যে সার পেলো কি না? ঘরে ঘরে চাকরি হলো কি না? চাল ডাল তৈলসহ নিত্যপণ্যের বাজার দর মানুষের নাগালে আছে কি না? খুন গুম ধর্ষণ হামলা আর মামলা ইত্যাদি থেকে সাধারণ মানুষ নিরাপদে আছে কি না। তা-ই সাধারণ মানুষের বিবেচ্য বিষয়।
সাধারণ মানুষ রাস্তার মোড়ে উন্নয়নের বিলবোর্ডে পদ্মা সেতু আর উড়াল সেতুর ছবি দেখতে চায় না, বঙ্গোপসাগরে তলিয়ে যাওয়া পদ্মা সেতু দেখতে চায় পদ্মা নদীর ওপরে। যারা পদ্মা সেতুকে বঙ্গোপসাগরে ডুবিয়েছে তাদের বিচার ও শাস্তি চায়। রেলওয়ের কালো বিড়ালের বস্তা ভর্তি টাকার হিসাব ও তার দৃষ্টান্তমূলক বিচার আর শাস্তি দেখতে চায়। শেয়ার বাজার লুটের কারণে প্রায় ৩৪ লাখ পরিবারের দেড় কোটিরও বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। উন্নয়নের বিলবোর্ডে কতজন শিক্ষকের পদ সৃষ্টি করে দেশের উন্নয়ন করা হয়েছে তা জানতে চায় না। তারা শেয়ারবাজার থেকে লুটে নেয়া তাদের পুঁজি ফেরত চায়। যুবক, ডেসটিনি আর ইউনিপে থেকে লুটে নেয়া গ্রাহকদের টাকা ভুক্তভোগী গ্রাহকগণ ফেরত পেতে চায়। সাধারণ মানুষ যুদ্ধাপরাধের বিচার আর আস্তিক নাস্তিক প্রশ্নে বিভক্ত জাতির ঐক্য ও শান্তি চায়।
আ’লীগ তাদের অতীত ঐতিহ্য অনুযায়ী বিভিন্ন বিজ্ঞাপনী সংস্থা ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের বিল বোর্ড রাতের অন্ধকারে চর দখলের বা অন্যের জমি দখলের মতো দখল করে তাদের উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরেছে। আ’লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ বলেছেন, ‘বর্তমান সরকারের কোন ব্যর্থতা, দুর্নীতি ও দায়বদ্ধতা নেই’। অথচ টিআইবির বার্ষিক রিপোর্টে দেখানো হয়েছে ‘দেশের সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত হচ্ছে রাজনৈতিক দল (ক্ষমতাসীন আ’লীগ) ও পুলিশ’। তাছাড়াও মাহবুবুল আলম হানিফের মন্তব্য সম্পর্কে দেশের শীর্ষস্থানীয় প্রায় সবকয়টি জাতীয় দৈনিকে জনমত জরিপে দেয়া হলে দেখা গেছে ৮৭.৫৪% থেকে ৯৬.৬৪% লোক হানিফের মন্তব্যে দ্বিমত পোষণ করেছেন। গত ২৯/০৭/২০১৩ ইং দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় জনমত জরিপে প্রশ্ন করা হয়েছিল যে, আ’লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ বলেছেন, ‘বর্তমান সরকারের কোন ব্যর্থতা, দুর্নীতি ও দায়বদ্ধতা নেই’। আপনি কি তার সাথে একমত? তাতে ৯৬.৬৪% মানুষ বলেছেন, না। একই প্রশ্ন ছিল দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকাতেও, তাতে ৯০.৫৭% মানুষ বলেছেন, না। দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায়ও এমনই প্রশ্ন করা হয়েছিল, তাতে দেখা গেছে ৮৭.৫৪% মানুষ না বলেছেন।
হানিফের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মন্তব্য করেছেন, এমন কোন খাত নেই যেখানে আ’লীগ সরকার দুর্নীতি করছে না’। মির্জা ফখরুলের বক্তব্যকে পত্রিকার জনমত জরিপে দিলে তাতে দেখা গেছে ৭৬.২৭% মানুষ বক্তব্যের পক্ষে হ্যাঁ বলেছেন। টিআইবির রিপোর্ট সম্পর্কেও জাতীয় দৈনিকে জনমত জরিপে দেয়া হয়েছিল, তাতে বেশিরভাগ মানুষই টিআইবির রিপোর্ট সঠিক বলেছেন। জরিপের প্রশ্ন ছিল, ‘দেশের সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত হচ্ছে রাজনৈতিক দল (ক্ষমতাসীন আ’লীগ) ও পুলিশ’। আপনি কি একমত ? তাতে ৯৭.৫৩% মানুষ বলেছেন হ্যাঁ।
আ’লীগ সরকারের উন্নয়নের বিলবোর্ড সম্পর্কে বিশিষ্ট সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড: মাহফুজ উল্লাহ তার প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, টেন্ডার ছিনতাই, ব্যালট বাক্স ছিনতাই, হত্যার পর লাশ ছিনতাই, দুর্নীতির মাধ্যমে মানুষের টাকা ছিনতাই এর সাথে আ’লীগের ছিনতাই তালিকায় যোগ হলো রাতের অন্ধকারে বিলবোর্ড ছিনতাই। ড: পিয়াস করিম বলেছেন, উন্নয়নের বিজ্ঞাপনী বিলবোর্ড প্রমাণ করে আ’লীগের অসহায়ত্ব। বিকল্পধারার মাহি-বি চৌধুরী তার প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, আ’লীগের বিজ্ঞাপনী বিলবোর্ড প্রমাণ করে তারা অত্যন্ত অসহায় হয়ে পড়েছে। বিশিষ্ট আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড: তুহিন মালিক বলেছেন, ব্যর্থতার রাজ্যে সরকারের বিলবোর্ড, অমাবস্যার চাঁদ যেন পদ্মা সেতুর খুঁটি।
সাধারণ জনগণ উন্নয়নের বিলবোর্ড দেখে মন্তব্য করতে শোনা গেছে, আ’লীগ ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে মাথায় সাদা পট্টি আর হাতে তসবিহ নিয়ে পিতৃ অপরাধের ক্ষমা চেয়ে ভোট প্রার্থনা করে ধোঁকা দিয়েছিল, ২০০৮-এর নির্বাচনে ১০ টাকা কেজি চাল, বিনামূল্যে সার আর ঘরে ঘরে চাকরি দেয়ার কথা বলে জনগণের সাথে প্রতারণা করেছিল আর আগামী নির্বাচনে জনগণকে ধোঁকা দেয়ার জন্যে উন্নয়নের বিজ্ঞাপনী বিলবোর্ডের নামে মিথ্যাচারের আশ্রয় নিচ্ছে। ঈদের দিন জাতীয় ঈদগাহে ঈদের জামাত শেষে পল্টন থেকে বাসে চড়ে সায়েদাবাদ যাচ্ছিলাম। পত্রিকা হাতে এক হকার বাসে উঠে বলছে, তাজা খবর, আজকের খবর পড়–ন, বিশেষ ব্যবস্থায় পত্রিকা বের করা হয়েছে, দাম মাত্র তিন টাকা। যাত্রীদের একজন বললেন, চুপ থাক, তা না হলে সরকার আবার আগামীকাল উন্নয়নের বিলবোর্ডে লিখে দেবে, ‘আমাদের সরকারের আমলে ঈদের দিনেও বিশেষ ব্যবস্থায় পত্রিকা বের করা হয়েছে’। সরকারের উন্নয়নের বিলবোর্ডে এমন হাস্যকর ও উদ্ভট সব তথ্য আছে যার সাথে দেশ ও জাতির উন্নয়নের লেশমাত্র সম্পর্ক নেই। যার ফলে এ সকল বিলবোর্ড সরকারের ব্যর্থতারই প্রমাণ বহন করে। আর যারা সর্বত্র ব্যর্থ তাদের আত্মহননের প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়াই স্বাভাবিক।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন