বুধবার, ১৪ আগস্ট, ২০১৩

সরকারের সীমাহীন দুর্নীতি ও ব্যর্থতা বনাম মেকি বিলবোর্ড


বর্তমান সরকারের বিগত সাড়ে চার বছরে বিচার বিভাগকে প্রশ্নবিদ্ধ করা, সাংবাদিক হত্যাকা- ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ, জামায়াতকে ধ্বংসের নানা উদ্যোগ, শেয়ার কেলেঙ্কারি, পদ্মা সেতুতে দুর্নীতি, রেলের কালো বিড়ালের টাকার বস্তা, হলমার্কের অবৈধ ঋণ এবং ব্যাংকিং খাতের লুটপাট, বিরোধী রাজনীতিক ইলিয়াস আলী গুম, হেফাযতকে দমন, জিএসপি স্থগিত, গণতন্ত্রকে গলা টিপে হত্যাসহ সীমাহীন দুর্নীতি ও ব্যর্থতা ধামাচাপা দিতে সবশেষে বিলবোর্ডের মাধ্যমে মেকি উন্নয়নের জোয়ারে দেশ ভাসাচ্ছে। পাঁচটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে শোচনীয় পরাজয়ের জ্বালা সইতে না পেরে পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনে বিজয়ের নেশায় নিত্যনতুন ফন্দি আটছে। এ সরকার যতই কলা কৌশল করছে সবই তাদের বিপক্ষে যাচ্ছে।
জামায়াত নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে ৪২ বছর পূর্বের মীমাংসিত যুদ্ধাপরাধের ইস্যুকে ইস্যু বানিয়ে যুদ্ধাপরাধের রায়ের পর আপিল নিষ্পত্তির আগেই প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর কিছু কিছু মন্ত্রীদের দ্বারা পূর্বাহ্নে রায় কার্যকরি করার দিন ক্ষণের ঘোষণা দেয়া হচ্ছে। এর দ্বারা প্রমাণ হচ্ছে এ মামলা এবং রায় পূর্বপরিকল্পিত এবং উদ্দেশ্য প্রণোদিত। এ সরকার সংবিধান থেকে সকল কাজে আল্লাহ্র উপর বিশ্বাস ও আস্থা বাদ দিয়েছে। শতকরা ৯০ ভাগ জনগণের প্রাণের দাবি কেয়ারটেকার সরকারের দাবি সংবিধান থেকে বাদ দিয়েছে। হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ কর্তৃক একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধনকে অবৈধ ও আইনগত কর্তৃত্ব বহির্ভূত ঘোষণা করা হয়েছে। নিবন্ধন বাতিলের পক্ষে অন্যতম যুক্তি : দলটি সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক মনে করে আল্লাহকে অথচ বাংলাদেশের সংবিধানে সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক বলা হয়েছে জনগণকে। এটি সংবিধানের ৭ ও ২৬ নম্বর অনুচ্ছেদের পরিপন্থী। সংবিধানে দল করার মৌলিক অধিকার দেয়া হয়েছে; তবে কোনো দলের গঠনতন্ত্র সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক হলে, দলের নীতিতে ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ বৈষম্য সংগঠন বা দল করা যাবে না। যেহেতু জামায়াতের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী জামায়াতের আমীরের নেতৃত্বে কোনো অমুসলিম এবং নারী আসতে পারবে না কাজেই এটি বাংলাদেশের সংবিধান বিরোধী। এটির কারণে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল হওয়ার যোগ্য। বর্তমান সরকার যদি হাইকোর্টকে দিয়ে এটি বাস্তবায়ন করেন তাহলে ইসির কি কোন অস্তিত্ব থাকে? আর এ অজুহাতে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করতে হলে তো আওয়ামী লীগ আর জাসদ ছাড়া বাকী সব দলের নিবন্ধনই বাতিল করতে হবে। তাহলে এ দেশে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ কি?
পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ক্ষমতাসীন দলের পটুয়াখালীর দশমিনা থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য গোলাম মাওলা রণির হাতে সাম্প্রতিক লাঞ্ছিত হন বেসরকারি টেলিভিশন ইনডিপেনডেন্টের অপরাধবিষয়ক ‘তালাশ’-এর রিপোর্টার ইমতিয়াস সানি ও ক্যামেরাম্যান মহসিন মুকুল। মুকুলকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি করা হয়েছে। পরে শাহবাগ থানায় পাল্টাপাল্টি মামলা হয়েছে। অবশেষে জনরোষ থেকে বাঁচার জন্যে সরকার রণিকে গ্রেফতার করে কারাগারে প্রেরণ করে। দলের ছত্রছায়ায় সরকারি প্রভাব খাটিয়ে রণি অতি অল্প সময়ে শত শত কোটি টাকার মালিক হন। এছাড়া খুলনার চার সাংবাদিক- দৈনিক সংগ্রামের খুলনা ব্যুরো প্রধান শেখ বেলাল উদ্দিন, খুলনার স্থানীয় দৈনিক জন্মভূমির সম্পাদক হুমায়ুন কবির বালু, দৈনিক সংবাদের খুলনা ব্যুরো প্রধান মানিক চন্দ্র সাহা এবং স্থানীয় দৈনিক পূর্বাঞ্চলের সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার হারুন-অর রশীদ খোকন হত্যার বিচার পায়নি তাদের পরিবার। এর মধ্যে সাংবাদিক বেলাল ও হারুন হত্যার নামকা ওয়াস্তে বিচার হলেও প্রকৃত খুনীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে বলে নিহতদের পরিবারের অভিযোগ। ২৪ জুলাই জাতীয় প্রেসক্লাব চত্বরে বিএফইউজে ও ডিইউজে’র আয়োজিত ইফতার মাহফিলে গত সাড়ে চার বছরে সাংবাদিকদের ওপর দমন-পীড়নের কঠোর সমালোচনা করে বিএনপির চেয়ারপার্সন ও সংসদে বিরোধী দলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া বলেন, এই সরকারের আমলে ১৮ জন সাংবাদিক হত্যা করা হয়েছে। দেড় বছরেও বিচার তো দূরের কথা এখনো উদ্ঘাটন হয়নি সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরোয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যাকা-ের রহস্য। সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির তথ্য সংগ্রহ করার জন্য সাগর-রুনিকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ করে তিনি বলেন, বাসায় গিয়ে তাদের নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। বাসার কোনো জিনিসপত্র চুরি হয়নি। কেবল ল্যাপটপটা নিয়ে গেছে। কারণ ঐ ল্যাপটপে সরকারের অপকর্মের তথ্য প্রমাণ ছিল। মামলার তদন্ত নিয়ে নিহতদের পরিবারের সদস্যদের মধ্যেও নেমে এসেছে হতাশা। ডিএনএ প্রতিবেদনের দোহাই দিয়ে সময় পার করছে তদন্তকারী সংস্থা র‌্যাব। আমার দেশ পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ। সত্য সংবাদ প্রকাশের জন্যে আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে সরকার অন্যায়ভাবে গ্রেফতার করে নির্যাতন করছে। হেফাযতে ইসলামের উপর নির্মম অত্যাচারের ছবি সম্প্রচার করায় ডিটিভি এবং ইসলামিক টিভির চ্যানেল দুটি বন্ধ করে রাখা হয়েছে। দিগন্ত টিভি ও ইসলামিক টিভির ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের দাবি জানান বেগম খালেদা জিয়া। সাংবাদিক নির্যাতনের ভয়ে অনেকেই এ সরকারের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছে না।
এ সরকার ক্ষমতায় আসার পর সবচেয়ে বড় বিপর্যয় হয় শেয়ারবাজারে। প্রায় ৩৫ লাখ বিনিয়োগকারী সর্বস্ব হারিয়ে রাস্তায় বসে পড়ে। ঢাকা ও চট্টগ্রামে পুঁজি হারিয়ে দু’জন আত্মহত্যা করেন। বেসরকারী গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) তথ্যানুযায়ী, শেয়ারবাজার থেকে ৪০ হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়েছে। গণমানুষের দাবি ছিল শেয়ার কেলেঙ্কারির হোতাদের বিচার করা। কিন্তু সে প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। ইব্রাহিম খালেদের তদন্তে জড়িতদের নাম উঠে এলেও কাউকেই বিচারের আওতায় আনতে সক্ষম হয়নি বর্তমান সরকার।
মহাজোটের নির্বাচনী ইশতেহারে অন্যতম প্রতিশ্রুতি ছিল পদ্মা সেতুর বাস্তবায়ন। এ পদ্মা সেতুর দুর্নীতির কেলেঙ্কারি দীর্ঘদিন পত্রিকার হেডলাইন জুড়ে থাকে। কানাডীয় প্রতিষ্ঠান এসএনসি লাভালিনের কর্মকর্তার ডায়েরি সূত্রে মন্ত্রী-উপদেষ্টাসহ কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তির ঘুষ-কমিশনের কথা ফাঁস হয়। বিষয়টি পদ্মা সেতুর মূল অর্থায়নকারী সংস্থা বিশ্বব্যাংকের দৃষ্টিতে আসার পর তারা ব্যবস্থা নিতে বলে। কিন্তু সরকারের নানা টালবাহানায় বিশ্বব্যাংক কঠোর অবস্থা নেয়। বাড়তে থাকে দূরত্ব। সরকার বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে টানাপোড়েন কমানোর পরিবর্তে এক পর্যায়ে পাল্টা চ্যালেঞ্জ করে বসে। ব্যাপক আলোচনা-সমালেচনার মুখে মন্ত্রিত্ব ছাড়তে বাধ্য হন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন। অন্যদিকে, বেশ কিছুদিন উপদেষ্টার পদ থেকে দূরে ছিলেন ড. মসিউর রহমান। বর্তমানে তিনি আবার সক্রিয়। বিশ্বব্যাংক সরকারের এমন কর্মকা-ে ক্ষুব্ধ হয়ে অর্থায়ন প্রত্যাহার করে নেয়। পরে এডিবি, জাইকাসহ অন্য দাতাসংস্থাও সরে দাঁড়ায়। জটিলতার অবসান এখনো হয়নি। দক্ষিণাঞ্চলসহ দেশবাসীর দীর্ঘদিনের স্বপ্নের এ সেতু নিয়ে বহু টালবাহানা এবং নাটক করেও এ সেতুর কাজ শুরুই করতে পারেনি মহাজোট সরকার।
এ সরকারের আমলে আরেকটি বহুল আলোচিত দুর্নীতির চিত্র ফুটে উঠে আওয়ামী লীগের বর্তমান দফতরবিহীন মন্ত্রী অতি কথনের নায়ক সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে নিয়ে। তিনি রেলমন্ত্রী থাকাকালে তাঁর এপিএস ফারুক তালুকদারকে টাকার বস্তাসহ বিজিবি সদর দফতরের গেটে আটক করা হয়। গাড়ির চালক স্বীকারোক্তি জবানবন্দী দিয়েছিলেন, এই টাকা মন্ত্রীকে ঘুষ দেয়ার জন্যে রেলের পূর্বাঞ্চলের জিএম বস্তায় করে নিয়ে আসেন। চাকরি দেয়ার কথা বলে এ ঘুষ হিসেবে এ টাকা সংগৃহীত হয়। এ ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার জন্যে অনেক পানি ঘোলা করার পর রেলমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে দফতরবিহীন মন্ত্রী করা হয়েছে। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের দুর্নীতি নিয়ে যখন পত্রিকার হেডলাইন ছিল সরগরম ঠিক তখনই পত্রিকার ব্যানার হেডে পরিণত হয় সৌদি দূতাবাস কর্মকর্তা খালাফ আল আলীর হত্যাকা-ের ঘটনা। অভিজ্ঞ মহল মনে করেন, সবকিছুই যেনো কাকতালীয়ভাবে ঘটে যাচ্ছে।
দুর্নীতির আরেকটি নজিরবিহীন ঘটনা রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক থেকে হলমার্ক গ্রুপের ঋণ কেলেঙ্কারি। বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের ইতিহাসে এমন ভূঁইফোড় প্রতিষ্ঠানকে হাজার হাজার কোটি টাকা দিয়ে দেয়ার ঘটনা আর একটিও ঘটেনি। সরকারের গত সাড়ে চার বছরে শুধু হলমার্ক নয়, ব্যাংকিং খাতের পুরোটাই ছিল নানা কেলেঙ্কারিতে ভরা। বিসমিল্লাহ গ্রুপের ব্যাংকিং খাত লুটে নেয়ার ঘটনাও ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি করে। তাছাড়া বিভিন্ন ব্যাংক নামসর্বস্ব কোম্পানিকে বিপুল অর্থ দিয়েছে, যা ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসছে। সরকার হস্তক্ষেপ করার পরও এখন পর্যন্ত ইউনিপে টু ও ডেসটিনির গ্রাহকরা তাদের অর্থ ফেরত পাননি।
জোট সরকারের ব্যর্থতার আরও একটি আলোচিত ঘটনা হলো বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক এম ইলিয়াস আলী গুম। গত বছর ১৭ এপ্রিল রাতে বাসায় ফেরার পথে রাজধানীর বনানী থেকে নিখোঁজ হন ইলিয়াস আলী ও তার গাড়িচালক আনসার আলী। ১৫ মাস পেরিয়ে গেলেও তাদের সন্ধান মেলেনি। প্রধান বিরোধী দলের কেন্দ্রীয় একজন নেতার গুম হওয়ার ঘটনাটি দেশ-বিদেশে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়।
গত ৬মে হেফাজতে ইসলামের ঢাকা অবরোধকালে হেফাজতের উপর দমন-পীড়ন চালিয়ে তাদেরকে ছত্রভঙ্গ করা হয়। বিশেষজ্ঞ মহলের অভিমত, সরকারের দলীয় ক্যাডাররা কুরআন শরীফে আগুন দিয়ে কৌশলে হেফাযতের নামে চালিয়ে দেয়। রোডের লাইট অফ করে হেফাজত কর্মীদের উপর অমানবিক নির্যাতন চালায়। সাম্প্রতিককালে হেফাযত প্রধান আল্লামা শফীর বক্তব্যের ভিডিওচিত্রে অন্যের কণ্ঠস্বর ডার্বিং করে শফীর বক্তব্য বিকৃত করে হেফাযতের প্রতি জনমতকে ক্ষেপিয়ে তোলা হয়। হেফাযতের উপর সীমাহীন দমন-পীড়নের লোমহর্ষক ঘটনা থেকে মিডিয়ার দৃষ্টি ভিন্নখাতে প্রবাহিতের নামে রেশমা নাটক মঞ্চস্থ করেছে বর্তমান সরকার। গত ২৪ জুলাই জাতীয় প্রেসক্লাব চত্বরে বিএফইউজে ও ডিইউজে’র আয়োজিত ইফতার মাহফিলে সরকারের দমন-পীড়নের কঠোর সমালোচনা করে বিএনপির চেয়ার পার্সন ও সংসদে বিরোধী দলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া বলেন, হেফাযতে ইসলামের নেতা-কর্মীদের ওপর গণহত্যা চালানো হয়েছে। সেদিন তাদের নেতা-কর্মীরা বলেছিল, আমরা আমাদের আমীরের বক্তব্য শুনেই যাবো। কিন্তু সেদিন সরকার আল্লামা শফীকে শাপলা চত্বরে আসতে দেয়নি। ফলে নেতা-কর্মীরা বাধ্য হয়ে সেখানে অবস্থানের ঘোষণা দেয়। কিন্তু সরকার বাতি নিভিয়ে নিরীহ আলেম-ওলামাদের ওপর কিভাবে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে তা সবারই জানা। সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, সেদিন মতিঝিলে হেফাযতের নেতা-কর্মীদের দমন করতে এক লাখ ৫৫ হাজার গুলী চালানো হয়েছে। দিগন্ত ও ইসলামিক টিভি সরকারের এসব হত্যাকা-ের খবর প্রচার করছিল বলেই দুটি চ্যানেলের সম্প্রচার বন্ধ করে দিয়েছে এ সরকার। সেদিন সরকার অনেক হেফাযত কর্মীকে খুন করে গুম করেছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের জিএসপি (জেনারেলাইজড সিস্টেম অব প্রেফারেন্স) স্থগিতের কারণ : বিশ্লেষক মহলের ধারণা, পোশাক শিল্পে সরকার দলীয় সন্ত্রাস, শ্রমিক নিরাপত্তা, যুক্তরাষ্ট্রকে ডিঙ্গিয়ে ভারতের সাথে অতি মাখামাখি, শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও তাঁর গ্রামীণ ব্যাংক ইস্যু নিয়ে দু’দেশের সম্পর্কে টানাপোড়েন। এ ব্যাপারে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কোন কার্যকর ভূমিকা রাখতে না পারায় যে দূরত্ব সৃষ্টি হয় তার ব্যবধান দিনে দিনে বৃদ্ধি পাওয়া। তাছাড়া পদ্মাসেতু নিয়ে নীতিনির্ধারকদের খামখেয়ালী আচরণ এবং এরই জের ধরে মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে দীর্ঘ সময় ধরে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাত থেকে বঞ্চিত হতে হয়। রানা প্লাজা ধসে এক হাজার ১৩২ জন গার্মেন্টস শ্রমিক নিহত, রেশমা নাটক মঞ্চস্থ এবং শ্রমিক নিরাপত্তাহীনতা জিএসপি স্থগিতের প্রধান কারণ। এ ব্যাপারে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেন, ‘বাংলাদেশ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত শ্রমিক অধিকারের মানদ- অনুযায়ী পরিবেশ উন্নয়নের কোনো পদক্ষেপ নেয়নি কিংবা নিচ্ছে না। এ কারণে জিএসপি তালিকা থেকে বাংলাদেশকে বাদ দেয়াই শ্রেয়।’ বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডব্লিউ মোজেনা বলেছেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের জিএসপি একেবারে বাতিল করা হয়নি বরং স্থগিত করা হয়েছে।’ অবশ্য পরবর্তীতে ১৬ দফা কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের শর্তে জিএসপি পুনর্বহালের শর্ত দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। অভিজ্ঞ মহলের আশঙ্কা, এ সরকারের আমলে জিএসপি স্থগিতাদেশ আদৌ প্রত্যাহার নাও হতে পারে।
রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানার বিপুল স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের সন্ধান পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ধসে পড়া রানা প্লাজার জমির প্রকৃত মালিক ছিলেন রবীন্দ্রনাথ নামক হিন্দু ভদ্রলোক। উপরে আওয়ামী সরকার সংখ্যালঘুদের দরদী সাজলেও রবীন্দ্রনাথকে সাভার থেকে উৎখাত করে জোড়পূর্বক তার জমি দখল করে সেই জমিতেই রানা প্লাজা তৈরি করেছিল এই যুগলীগ নেতা সোহেল রানা। এছাড়াও তার সম্পদের মধ্যে রয়েছে ধামরাইয়ের কালামপুরে একাধিক ইটভাটা, সাভার বাজার রোডে ৮ তলা রানা টাওয়ার, বাজার রোডে ৬ তলা ভবন, রানা প্লাজার পেছনে ৫ তলা ভবন, মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর উপজেলার জয়ম-পে ২ তলা বাড়ি এবং তার নামে ৫টি ব্যাংক একাউন্ট। রাজনৈতিক প্রভাব ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিভিন্ন অবৈধ পন্থায় সোহেল রানা রাতারাতি বিপুল পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়েছেন। নামে-বেনামে তার কোটি কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ রয়েছে। এসব সম্পদ কিছু নিজ নামে, কিছু স্ত্রী ও বাবার নামে রেখেছেন তিনি। তিনি পৌর যুবলীগের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক, তার বাবার নাম আবদুল খালেক। ২৮-৩০ বছর বয়সের এই যুবক এখন অজস্র টাকার মালিক। সবই হয়েছে বর্তমান সরকারের আমলে। দুই বোন এক ভাইয়ের মধ্যে সোহেল রানা দ্বিতীয়। সাভার পৌরসভা শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সোহেল রানা দুই মাস আগে পৌর যুবলীগের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়কের পদ পান। এক হাজার ১৩২ জন গার্মেন্টস শ্রমিক হত্যার নায়ক রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানাকে দলীয় কর্মী হিসেবে অস্বীকার করেন খোদ প্রধানমন্ত্রী। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহিউদ্দিন খান আলমগীর রানা প্লাজার কলাপসিবল ধাক্কার কারণে বিল্ডিং ধস হতে পারে মর্মে অবাস্তব বক্তব্য দিয়ে দেশে-বিদেশে গণমাধ্যমে সমালোচনার পাত্র হন। অভিজ্ঞ মহলের ধারণা, জনরোষের কারণে সোহেল রানাকে গ্রেফতার করা হলে আইনের দীর্ঘসূত্রিতার একপর্যায়ে হয়তো বিষয়টি ধামাচাপা পড়ে যাবে। এছাড়া সরকার দলীয় সন্ত্রাসীদের হাতে বিকাশ হত্যা, আওয়ামী লীগ, যুব লীগ এবং ছাত্রলীগের চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি এবং নিজেদের পরস্পর গ্রুপের মধ্যেই স্বার্থ ভাগাভাগি নিয়ে হতাহতের ঘটনা প্রায় নিত্যদিনের শিরোনাম হয়ে আসছে পত্রিকায়।
সাম্প্রতিক কাওরান বাজার মোড়ের একটি হোটেলে জিয়া স্মৃতি পাঠাগার আয়োজিত ‘বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তারেক রহমানের ভূমিকার প্রয়োজনীয়তা’ শীর্ষক আলোচনা ও ইফতার মাহফিলে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, আওয়ামী লীগ বারবার দাবি করলেও তারা কখনো গণতন্ত্রের চর্চা করেনি। এখন গণতন্ত্রকে হরণ করা হ্েচ্ছ, সংগঠন করার অধিকারও কেড়ে নেয়া হচ্ছে। প্রকাশ্যে গুলী করে মানুষ হত্যা করা হচ্ছে, ক্রসফায়ারে হত্যা করা হচ্ছে, খুন, গুমও দেশের সহজ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারপরও সরকারের মন্ত্রীরা বলছেন এখন নাকি গণতন্ত্রের উৎকৃষ্ট সময় চলছে। তিনি আরো বলেন, সত্য প্রকাশের দায়ে পত্রিকা বন্ধ হলে, জনগণের মৌলিক অধিকার কেড়ে নিলে কখনো গণতন্ত্র বিকশিত হতে পারে না। গণতান্ত্রিক দেশে বিরোধীদল যদি কথা বলতে না পারে, পত্রিকায় সরকারের বিরুদ্ধে খবর প্রকাশের জন্য বন্ধ করে দেয়া হয়, মানুষের মৌলিক অধিকার কেড়ে নেয়া হয়, সে দেশে দণতন্ত্র বিকশিত হয় না। আওয়ামী লীগ যখনই ক্ষমতায় এসেছে তখনই সকল ধরনের মৌলিক অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে। তারা জাতীয় সংসদে ১১ মিনিটের মধ্যে সব দলের রাজনীতি বন্ধ করে বাকশাল কায়েম করেছি। ১৯৭৪ সালে যখন তারা ক্ষতায় ছিলো তখন তাদের দুঃশাসনের জন্য দেশে দুর্ভিক্ষ হয়েছিল। আন্তর্জাতিক বিশ্ব বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ আখ্যা দিয়েছিল। শেখ মুজিবুর রহমান নিজ দলীয় কর্মীদের ব্যাপারে বলেছিল, সবাই পায় সোনার খণি আমি পেয়েছি চোরের খণি। এসব আমরা ভুলে যাইনি। আওয়ামী লীগ বার বার দাবি করলেও তারা কখনোই গণতন্ত্রের চর্চা করেনি বরং তারা গণতন্ত্রের জন্য হুমকি। বিশ্লেষক মহলের অভিমত, গণতন্ত্রের মানসকন্যা খ্যাত বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরোধী দলে থাকাকালে ১৭৩ দিন হরতাল করেছিল। সেটি যদি তাঁর জন্যে গণতান্ত্রিক এবং সাংবিধানিক অধিকার হয় তাহলে বর্তমান সরকার বিরোধী ১৮ দলীয় জোটের অন্যতম শরীক দল জামায়াতে ইসলামী সাংবিধানিক অধিকার অনুযায়ী হরতাল দিলে সরকারের ভাষায় তা সন্ত্রাস ও তা-ব হয় কিভাবে? এভাবে গণতন্ত্রের অপব্যাখ্যা দিয়ে জনগণের উপর এ সরকার নিজেই গণহত্যা চালিয়ে এযাবত বিরোধীদলের ডাকা হরতালে জামায়াত-শিবিরের প্রায় ২৪০ জন নেতা-কর্মীকে নির্বিচারে গুলী করে হত্যা করা হয়। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে জামায়াত-শিবিরের ৪৩ হাজার নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করে কারাবন্দী করে। উদ্দেশ্যমূলক জামায়াত-শিবিরের ৫ লক্ষাধিক নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে ২৬ হাজার মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করছে এ সরকার। রিমান্ডে নিয়ে পঙ্গু করে দেয়া হয়েছে জামায়াত-শিবিরের ৪ শতাধিক নেতা-কর্মীকে। চোখ তুলে ফেলা হয়েছে, পা কেটে দেয়া হয়েছে এমন নেতা-কর্মীর সংখ্যা ১৫ জন। জামায়াত ও শিবিরের ৮ জন নেতা-কর্মীকে গুম করেছে এ জালেম সরকার। টানা ৫৫ দিন রিমান্ডে নিয়ে ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি মোঃ দেলাওয়ার হোসেনের উপর নির্মম নির্যাতন চালিয়ে তাকে পঙ্গু করে দেয়া হয়েছে।
মহাজোট সরকারের মেকি উন্নয়নমূলক ব্যানারের কঠোর সমালোচনা করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, দেড় কোটি মিটারের ব্যানারে আওয়ামী লীগের দেড় কোটি ভোট কমবে। আওয়ামী লীগ সরকারের অপকর্ম ও দুর্গন্ধ ঢাকার জন্য ব্যানার ছাপানো হয়েছে। তিনি বলেন, বর্তমান সরকারের আমলে সাংবাদিক হত্যাকা- ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ, শেয়ার কেলেঙ্কারি, পদ্মা সেতুতে দুর্নীতি, রেলের কালো বিড়ালের টাকার বস্তা, হলমার্কের অবৈধ ঋণ এবং ব্যাংকিং খাতের লুটপাট, বিরোধী রাজনীতিক ইলিয়াস আলী গুম, হেফাযতকে নির্যাতন, জিএসপি স্থগিত, গণতন্ত্রকে গলা টিপে হত্যা, ডেসটিনির কেলেঙ্কারি, ইসিকে আজ্ঞাবহে পরিণতের ঘটনা ঘটেছে এ কথা ব্যানারে ছিল না। এসব যদি লেখা হয় তাহলে দেড় কোটি মিটারে নয় দেড় লাখ কোটি মিটার ব্যানারে লিখেও শেষ করা যাবে না। কাওরান বাজার মোড়ের একটি হোটেলে জিয়া স্মৃতি পাঠাগার আয়োজিত ‘বাংলাদেশে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তারেক রহমানের ভূমিকার প্রয়োজনীয়তা’ শীর্ষক আলোচনা ও ইফতার মাহফিলে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, সরকার যতই নতুন বিলবোর্ড লাগিয়ে উন্নয়নের কথা বলুক না কেন, জনগণ তাদের প্রত্যাখ্যান করেছে। দেশবাসী জানে সরকার গত সাড়ে চার বছরে একটি নির্বাচনী ওয়াদাও বাস্তবায়ন করতে পারেনি। তিনি বলেন, তারা যদি এতই উন্নয়ন করে থাকে তাহলে তত্ত্বাবধায়কের অধীনে নির্বাচন দিতে আপত্তি কোথায়? তিনি বলেন, নির্দলীয় সরকারের অধীনে তারা জয় পাবে না জেনেই দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে চায়। কিন্তু তাদের সে আসা কোনদিনই পূরণ হবে না।
অভিজ্ঞ মহল মনে করে, উপরোক্ত দুর্নীতি ও ব্যর্থতার কারণে পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে চরম ভরাডুবির পর দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনী বৈতরণী পারের মানসে বিরোধী দলের মধ্যে ভাঙ্গন সৃষ্টি চেষ্টা, বিরোধী জোটকে নানাভাবে দুর্বল করা, সরকারি প্রশাসনভুক্ত দলীয় ক্যাডারদের ব্যবহার, কালো টাকার বিপুল পুঁজিকে কাজে লাগানো এবং ইসিকে দিয়ে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের মাধ্যমে জনগণকে বোঝানের চেষ্টা করা এ সরকারের আমলেই নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা, সিটি করপোরেশন নির্বাচনে একেকটি নির্দিষ্ট এলাকায় নির্দিষ্ট তারিখে ভোট হয়। তখন নির্বাচন বহির্ভূত অন্যান্য এলাকার বিরোধীদলীয় জনশক্তি ফ্রি থাকায় ভোটকেন্দ্র পাহারার সুযোগ পায়। যার ফলে সরকারদলীয় সন্ত্রাসী, প্রশাসন এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী বিরোধীদলীয় কর্মীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে বড় ধরনের কারচুপিতে সক্ষম হয় না। সাম্প্রতিককালে পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিরোধীদলের বিজয় ছিনিয়ে আনার পেছনে এটিও একটি উল্লেখযোগ্য কারণ। পর্যবেক্ষক মহল মনে করে, গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনকালে গাজীপুর জেলার আশিটি থানার ৬০টি থানাতেই ভারপ্রাপ্ত কমকর্তা হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন ছাত্রলীগের প্রাক্তন কর্মীরা। তা না হলে গাজীপুরে বিএনপির নির্বাচিত মেয়র আবদুল মান্নানের প্রাপ্ত ভোটের পরিমাণ বহুলাংশে বেড়ে যেতো। তাছাড়া তত্ত্বাবধায়ক ছাড়াই এ সরকারের আমলে নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব, এটি প্রমাণের জন্যে কৌশল হিসেবে বিরোধীদলকে আকৃষ্ট করার নিমিত্তে ঐ সমস্ত স্থানীয় নির্বাচনে বড় ধরনের কোনো কারচুপি সরকার করেনি। কিন্তু একই সাথে একই সময়ে যখন এ সরকারের অধীনে ৩০০ সীটে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে তখন বিরোধী দলীয় সকল জনশক্তি নির্বাচনী কর্মকা-ে স্ব স্ব এলাকায় ব্যস্ত থাকবে। এ সুযোগে দলীয় সন্ত্রাসী, সরকারি প্রশাসন এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে প্রভাবিত করে নিজের পক্ষে সাগর চুরির মতো ভোট কারচুপির সুযোগ নিতে পারে সরকার। কাজেই এ সরকারের অধীনে জাতীয় নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads