সোমবার, ১৯ আগস্ট, ২০১৩

ঐশী সমাজের জন্য এক বড় প্রশ্ন


পুলিশ কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমান ও তার স্ত্রী স্বপ্না রহমানের খুনের ঘটনায় আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে জনমনে। বাবা-মা খুন হওয়ার পর থেকে পলাতক ঐশী গত শনিবার দুপুর আড়াইটার দিকে পল্টন থানায় এসে আত্মসমর্পণ করে। এরপর পুলিশ তাকে আটক করে। আটক করা হয়েছে ঐশীর বয়ফ্রেন্ড জনি ওরফে রনি, বান্ধবী তৃষা, গৃহকর্মী সুমীসহ আরও ৫ জনকে। এ হত্যাকা-ের সাথে ঐশী জড়িত বলে জানিয়েছে পুলিশ। ঐশীর আরও দুই বয়ফ্রেন্ডকে খুঁজছে পুলিশ। প্রাথমিক তদন্ত শেষে পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, বখে যাওয়া মেয়ে ঐশীর উচ্ছৃঙ্খল জীবন যাপনে বাধা দেয়াতেই খুন হয়েছেন স্পেশাল ব্রাঞ্চের পরিদর্শক মাহফুজুর রহমান ও তার স্ত্রী। মাদকাসক্ত হওয়ায় কয়েক মাস ধরে ঐশীকে একরকম বাসায় আটকে রাখা হতো। কিন্তু আটকের এ জীবন সে মেনে নিতে পারেনি। তাই বাবা-মাকে হত্যার পরিকল্পনা করে সে।
অসৎ সঙ্গ পুলিশ কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমানের মেয়ে ঐশীর জীবনে ডেকে এনেছে বিপর্যয়। পড়ার টেবিল থেকে তাকে টেনে নিয়ে গেছে রাজধানীর অভিজাত পল্লীর ডিসকো বার এবং হেরোইন ও ইয়াবার জগতে। ঐশী গত ২ বছর ধরে লেখাপড়া বাদ দিয়ে বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে হেরোইন, ইয়াবা সেবন ও ঢাকার ডিজে পার্টি এবং ডিসকো বারে সময় কাটাতো। বাবা-মা খুন হওয়ার পরও শনিবার রাতে তার গুলশানে একটি ডিসকো বারে যাওয়ার কথা ছিল বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে। আদরের সন্তান ঐশীকে উচ্ছৃঙ্খল জীবন যাপন থেকে ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করেন মা এবং বাবা। কিন্তু তাদের সব চেষ্টাই বিফলে যায়। অবশেষে বাধ্য হয়ে মেয়েকে ঘর থেকে বের হওয়ার ওপর কড়াকড়ি আরোপ করেন তারা। এর খেসারত হিসেবেই সস্ত্রীক জীবন দিতে হলো পুলিশ কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমানকে।
বাবা-মাকে খুনের দায়ে ভ্রষ্ট মেয়ে ঐশীর বিরুদ্ধে সবাই এখন ঘৃণা প্রকাশ করছে। কিন্তু প্রাণচঞ্চল এই কিশোরীর এমন অধঃপতনের দায় কি একা শুধু তারই? সে তো কোনো অন্ধকার সমাজে বাস করতো না। আলো ঝলমলে এ রাজধানীর একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে সে ‘ও’ লেভেলে পড়তো। সে বসবাস করতো একটি শিক্ষিত পরিবারে। তারপরও এ কিশোরী বয়সে সে কি করে হেরোইন ও ইয়াবার জগতে প্রবেশ করলো? কোনো অশিক্ষিত জাহেল তাকে এ পথে নিয়ে যায়নি। ঐশীকে এ পথে নিয়ে গেছে তার আধুনিক বয়ফ্রেন্ডরা। রাজধানীর অভিজাত পল্লীর ডিসকো বার ও ডিজে পার্টি তাকে উন্মাতাল করতে বিশেষভাবে প্রণোদনা দিয়েছে। শুধু এক ঐশী নয়, উচ্ছৃঙ্খল এ পথে নিজেদের সর্বনাশ ডেকে আনছে আরও বহু কিশোর-কিশোরী ও যুবক-যুবতী। কিন্তু প্রশ্ন হলো, অভিজাত পল্লীর এসব ডিসকো বার ও ডিজে পার্টি সম্পর্কে আমাদের প্রশাসন ও সমাজপতিরা কি অবহিত নন? এ ব্যাপারে তো আমাদের রাজনীতিবিদ, সুশীল সমাজ, মিডিয়া ও পুলিশ বাহিনীকে তেমন সরব হতে দেখছি না। আমাদের কিশোর-কিশোরী ও যুব সমাজকে অসৎ সঙ্গ ও অসৎ পরিবেশ থেকে রক্ষার ব্যাপারে তো অভিজাতদের বাইরেও সমাজ ও প্রশাসনের দায়িত্ব রয়েছে। তাই বখে যাওয়ার জন্য শুধু ঐশী একা দায়ী নয়। নিজ নিজ জায়গায় আরও অনেকে তাদের দায় এড়াতে পারেন না। ঐশী তো একদিনে ভ্রষ্ট হয়নি। হেরোইন, ইয়াবা ও ডিজে পার্টি পর্যন্ত পৌঁছতে তার অনেক সময় লেগেছে। ‘ও’ লেভেল পর্যন্ত বেড়ে ওঠার এই সময়টায় তার পরিবার, স্কুল, সমাজ ও রাষ্ট্র তার প্রতি যথাযথ দায়িত্ব পালন করলে ঐশীকে আজ হয়তো ভ্রষ্ট মেয়ে হিসেবে পরিচিত হতে হতো না। আমরা জানি, শিশু-কিশোরদের বেড়ে ওঠার জন্য নির্মল আনন্দ-বিনোদন খুবই প্রয়োজনীয় বিষয়। কিন্তু আমাদের পরিবার, স্কুল, সমাজ ও রাষ্ট্র কি শিশু-কিশোরদের জন্য কাক্সিক্ষত বিনোদনের ব্যবস্থা করতে পেরেছে? অসৎ সঙ্গ ও অসৎ পরিবেশ থেকে রক্ষার জন্য যে নৈতিক জ্ঞান ও মেরুদ- প্রয়োজন, দেশের শিক্ষা কারিকুলাম কি আমাদের শিশু-কিশোরদের তা দিতে সমর্থ হয়েছে? শিশু-কিশোরদের বিনোদন চাহিদা মেটাতে আমাদের টিভি চ্যানেলগুলো ব্যর্থ হওয়ায় শিশু-কিশোর ও তরুণরা এখন গভীর রাত পর্যন্ত জেগে বিভিন্ন হিন্দি ও ইংরেজি চ্যানেল দেখে। ঐসব চ্যানেলে তো অশ্লীল ও ক্রাইম ছবির কোনো অভাব নেই। আর মোবাইল ফোনসহ বিভিন্ন যোগাযোগ মাধ্যমেও এখন এতটাই অবারিত হয়ে গেছে যে, তার মন্দ ব্যবহার আমাদের কিশোর-কিশোরী ও তরুণ-তরুণীর জীবনে বিষফল বয়ে আনছে। তাই আজ ভ্রষ্ট মেয়ে হিসেবে শুধু ঐশীকে নিন্দাবাদ করলে চলবে না, আত্মসমালোচনার মাধ্যমে নিজেদের দায়িত্বও উপলব্ধি করতে হবে অভিভাবক, স্কুল, সমাজ এবং রাষ্ট্রকেও। সংশ্লিষ্ট সবাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে দায়িত্ব পালন করলে হয়তো বখে যাওয়ার হাত থেকে আমরা ভবিষ্যতে রক্ষা করতে পারবো আরও বহু ঐশীকে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads