সব সময়তো আর খেয়াল করিনি তবে যতোদূর মনে পড়ে পৃথিবীর যে বিপুল দেশে দেশে রাস্তার ধারে বড় বিলবোর্ড দেখেছি তাতে নানা ধরনের বিজ্ঞাপনই ছিলো। কোনো দেশের ভাষা বুঝেছি। কোনো কোনো দেশের ভাষা মোটেও বুঝিনি। কিন্তু বিমান বন্দর থেকে বেরুলেই বিশাল বিশাল বিলবোর্ড দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। কোনো কোনো বিলবোর্ডতো রীতিমতো তাকিয়ে থাকার মতোÑএতোই সুন্দর। দেশের শিল্প বা সেবা খাত বিপুল অংকের অর্থ ব্যয় করে রাস্তার ধারে বিলবোর্ড বসায়। এগুলো কার্যত এসব কোম্পানীর পণ্যের বিজ্ঞাপন। কিন্তু চলমান রাস্তার পাশে বলে বিলবোর্ডে খুব বেশি কথা লেখা থাকে না। যেন যানবাহনে ধাবমান মানুষ ঝটপট পড়ে ফেলতে পারে।
১৯৮৭ সালে চীনের বিমানবন্দরে নেমে বেইজিং বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে দেখলাম হিটাচির বিলবোর্ড। স্পষ্ট ইংরেজিতে লেখা হিটাচি। তার নিচে ছোট করে চাইনিজ ভাষাও হিটাচি লেখা আছে। ডানপাশে কিছু একটা পণ্যের ছবি। চট করে মনে হলো চীনে কেন ইংরেজি ভাষা? তারপর বোধকরি সঠিক জবাবই পেলাম নিজের কাছে। চীনে বিদেশি যারা আসবে তারাও জানুক হিটাচি এখানে কারখানা বসিয়েছে। কিংবা পণ্য বিপণন শুরু করেছে। এসব লক্ষ্য সামনে রেখেই শিল্প কিংবা সেবাখাত রাস্তার ধারে বিলবোর্ড দিয়ে থাকে। ঐ যে বলছিলাম, কোনো কোনো বিলবোর্ড রীতিমতো চোখ আটকিয়ে রাখে। কিছুদিন আগে এমন কয়েকটি বিজ্ঞাপন দিয়েছিলো একটি সেবাখাত। গ্রামের পথ ধরে স্বামী দিগন্তের বহুদূর পর্যন্ত চলে গেছে। পিছনে দাঁড়িয়ে আছে স্ত্রী। শেষ কথা কি বলা হবে? তারা মোবাইল কানে তুলে নিলেন। এমনি একটি ছবি।
এই যে আমার মনে রয়েছে এটাই সম্ভবতো ঐ বিলবোর্ডের প্রধান সাফল্য। আমাদের এই মহানগরেও বিলবোর্ড আছে। পথের পাশে হলেই হয় না। বোর্ডগুলো এমন জায়গায় বসাতে হয় যাতে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ঢাকা মহানগরীর বিলবোর্ডগুলোও মোটামোটি তেমনিভাবেই স্থাপিত হয়েছে। এসব বিলবোর্ডে নানা ধরনের বিজ্ঞাপন ছিলো। সেবা খাত, আবাসন খাত ছিলো তার মধ্যে প্রধান। এছাড়াও কিছু বিলবোর্ডে ছিলো আফটার সেভ বা এই ধরনের কোনো কিছুর বিজ্ঞাপন। সব সময় যে এসব বিজ্ঞাপন মানুষের চোখে পড়েছে বা পড়ে এমন কোনা কথা নেই। ঢাকা শহরের জ্যামে বসে থাকলে গাড়ি জানালা দিয়ে মুখ বের করলে তখন বিজ্ঞাপনগুলো চোখে পড়ে। অনেক সময় কিছুই করার থাকে না বলে সেগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়ি। অনেক সময় এসব বিলবোর্ড দ্রুত পার হয়ে যায়। কোথায় কী লেখা আছে চেয়েও দেখি না। যদি কোনো দিন দেখি এই আশায় বিজ্ঞাপন দাতারা বিলবোর্ডে অনেক কিছু লিখে রাখে।
কিন্তু কয়েকদিন আগে হঠাৎ করে একযোগে ঢাকা ও তার আশেপাশের সকল বিলবোর্ড বেআইনীভাবে দখল করে সরকারের সাফল্য গাঁথার ফিরিস্তি সাঁটিয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু সাংবাদিকদের চোখ বন্ধ থাকে না। পরদিনই বেশ কয়েকটি সংবাদ পত্রে বেদখল বিলবোর্ড নিয়ে ছবি ছাপা হলো। তাতে সরকারের কেবল সাফল্য গাঁথা। যে সাফল্য মানুষ দেখতে পায়নি সেসব সাফল্যের কীর্তনও আমরা ঐ বিলবোর্ডগুলোতে দেখলাম। সাধারণত বিলবোর্ডের বিজ্ঞাপনে যে সু-রুচির প্রকাশ থাকে সে সু-রুচির প্রকাশ বিজ্ঞাপনগুলোতে ছিলো না। সাধারণত বাংলা সিনেমার পোস্টারে যে ভাষায় যেমন অক্ষরে বক্তব্য তুলে ধরা হয় বলতে গেলে তেমন ভাষায় তেমন অক্ষরে এবং তেমন অঙ্কন শৈলীতে বিজ্ঞাপনগুলো রচিত হয়েছে। শেখ হাসিনা বা শেখ মুজিবের ছবির পরিচ্ছন্নতা বিষয়ে মনোযোগ দেওয়ার যোগ্যতা ঐ বিজ্ঞান দাতাদের ছিলো না।
সেটা সম্ভবতো প্রয়োজনও ছিলো না। দখলবাজ আওয়ামী লীগ সরকার সেগুলো দখল করে একটা চমকের সৃষ্টি করতে চেয়েছিলো। সেই সঙ্গে সরকারকে হয়তো কেউ কেউ বলেছিলো যে, আওয়ামী লীগ আমলে কিছুই হয়নি কিছুই হয়নি যারা বলে তারা দেখুক আওয়ামী লীগ সরকার দেশের কী বিপুল উন্নয়ন ঘটিয়েছে। ১৯৯৬-২০০১ এ ভারতের সঙ্গে ৩০ বছর মেয়াদি ভারতের স্বার্থানুকূল চুক্তির স্বপক্ষে তৎকালীন পানিমন্ত্রী সংসদে যখন ভারতের কাছ থেকে কতো কিউসেক পানি পাওয়া গেছে তখন এক বিরোধী দলীয় এমপি পয়েন্ট অফ অর্ডারে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, মাননীয় মন্ত্রী এতো যে কিউসেকের হিসাব দিচ্ছেন কিন্তু লুঙ্গী পরে পদ্মা পাড় হয়ে এলাম, কিন্তু কিউসেক তো ভিজলো না।
আওয়ামী লীগের বিলবোর্ড জবরদখলের পরিণতিও এমনি হবে। এই দখল যদি আরো বেশি দিন থাকে নাগরিকরা রাজপথ পেরিয়ে যাবেন। গ্রামের সিনেমা হলের সামনে টানানো বিলবোর্ড সদৃশ পর্দার মতো উন্নয়নের ফিরিস্তির দিকে ফিরেও তাকাবে না। তাছাড়া শেখ হাসিনার সরকারের এসব উন্নয়ন গপ্পো মানুষ যে বিশ্বাস করেছে এমন ভাবারও কোনো কারণ নেই। কিন্তু বিপত্তি বেধেছে ভিন্নস্থানে। এদিকে আবার কারা সকল বিলবোর্ড জবরদস্তি মূলক দখল করে সরকারের উন্নয়ন বিলবোর্ড টানালো এই কথা কেউ স্বীকার করতে চাচ্ছে না। না সরকার না আওয়ামী লীগ কেউই বুক ফুলিয়ে সামনে এসে বলল না যে, এই বিলবোর্ড আমরাই টানিয়েছি।
তাহলে কে টানালো? সে দায়দায়িত্ব আসলে কেউই নিচ্ছে না। অথচ দৈনিক প্রথম আলো লিখেছে যে, তাদের তিনটি বিলবোর্ড উদ্ধারের জন্য সংশ্লিষ্ট সংস্থার কর্মীরা চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু কয়েকজন মাস্তান প্রকৃতির লোকের বাধায় তাদের সে চেষ্টা বিফল হয়ে যায়। তারা তাদের বিলবোর্ড উদ্ধার করতে পারেনি। এসব বিলবোর্ড সিটি কর্পোরেশনের অনুমতি নিয়ে স্থাপন করতে হয়। তার জন্য সিটি কোর্পোরেশনকে ভাড়া দেন এক শ্রেণীর ব্যবসায়ীরা। এদের কাছ থেকে আবার ভাড়া নেন বিজ্ঞাপন দাতারা। তাহলে সিটি কর্পোরেশন দায়িত্ব নিক। কিন্তু সিটি কর্পোরেশনও অপারগ। মন্ত্রীদের কেউ কেউ বলছেন, এতে দোষের কিছু নেই। বিএনপির এরকম সাফল্য থাকলে তারাও বিলবোর্ডে সে কথা জানান দিক। কিন্তু যারা বিপুল অংকের টাকা খরচ করে বিলবোর্ডে বিজ্ঞাপন দিয়েছে তারা এখন ‘মি. নো বডিতে পরিণত’ হয়েছে। সবাই জানে সরকার করেছে। কিন্তু সরকার স্বীকার করছে না বলে কেউই কিছুই বলতে পারছে না।
আওয়ামী লীগের গুন্ডামার্কা দখলবাজির চেহারা এমনই। দখল করেছিতো করেছিই। মাস্তান মজুদ রেখেছি। ক্ষমতা থাকলে বিলবোর্ড থেকে আওয়ামী উন্নয়ন গাঁথা সরিয়ে নিজেদের পণ্যের বিজ্ঞাপন বের করো, না পারলে তফাৎ যাও। এটাই আওয়ামী লীগের প্রকৃত চরিত্র। কিন্তু এই দখলবাজি এই লুণ্ঠন এই সীমাহীন সিনাজুড়ি একদিন জনগণ মাথায় মুগুড় মেরে থামিয়ে দিতে বাধ্য হবে। সেইবোধ আওয়ামী লীগের মাথায় মুগুর না পরা পর্যন্ত কখনো তৈরি হয়নি। তৈরি হয় না।
ন্যায্য কথা হচ্ছে যেহেতু কেউই এইসব বিলবোর্ড দখলের দাবি করেনি তাহলে যারা এতে বিজ্ঞাপন দিয়েছেন তারা স্বাভাবিকভাবে সেটা নামিয়ে ফেলবেন। কিন্তু নামাতেতো পারছেন না। ভয়, কাকে যে ভয়? তাও আবার নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। মনে হয় আওয়ামী লীগের উন্নয়ন কর্মকান্ডের বিলবোর্ড হাওয়ায় উড়ে এসে ঢাকা মহা নগরের বিলবোর্ড গুলোতে খাপে খাপে সেঁটে গেছে। কিন্তু খুলতে গেলেই বিপত্তি। বাধা দিচ্ছে নাম না জানা মাস্তানেরা। তারাও আকাশ থেকে ফুঁড়ে বের হয়নি। আশেপাশেই আছে। হয়তো সশস্ত্র বন্দুকধারী কিংবা চাকুবাজ। হাওয়া থেকে আসা সেঁটে যাওয়া পর্দাগুলো খুলে ফেলতে গেলেই কোত্থেকে কে যেন এসে দাঁড়ায়। কিন্তু আশ্চর্য এই যে, সরকারের পুলিশ বাহিনীও এই বেআইনী দখল মুক্ত করে দিতে এগিয়ে আসে না। এটা মনে হয় সরকারের এক দস্যু বৃত্তির উদাহরণ।
এ সরকার অবশ্য বরাবরই দখলপ্রবণ। এদের রক্তের ভেতরে দখলের নেশা। যেমন এরা দখল করে নিয়েছে পিজি হাসপাতাল, যমুনা বহুমুখী সেতু প্রভৃতি স্থাপনাসহ বহু প্রতিষ্ঠান। সেখানে কৃতিত্ব কিছুই নেই। কেবল সাইনবোর্ড পরিবর্তন করে করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু সেতু, বঙ্গবন্ধু কৃষি বিশ্ব বিদ্যালয়, ফজিলাতুন্নেসা ছাত্রী হল। এমনি নানান নামে নানান প্রতিষ্ঠান। এগুলোর জন্য অবশ্য টুকটাক আইনটাইন করতে হয়েছিলো। কিন্তু সামান্য বিলবোর্ড দখলে আর আইন কিসের। মাত্র কিছু দিনের জন্য বিলবোর্ডগুলো যদি এরা দখলে নিয়েই থাকে তাহলে দোষের কী আছে? কিন্তু সরকার কী সত্যি সত্যি খেয়াল করছে যে, এসব বিলবোর্ডের দিকে এখন আর কেউ ফিরেও তাকায় না।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন