রবিবার, ১৮ আগস্ট, ২০১৩

মিসরের ঘটনাবলি ও বাংলাদেশ


এখন এক চমৎকার সমাজব্যবস্থার কথা চিন্তা করা হচ্ছে। তার নাম গণতন্ত্র+ ধর্মনিরপেক্ষতা=স্টুপিড। এই যে স্টুপিড বললাম, চার দিকে তখন সমালোচনার ঝড় বয়ে যেতে পারে। কারণ আমি মনে করেছি যে, রাজনীতিতে ধর্মকে অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে। একটি কথা এখন ধারাবাহিকভাবে অস্বীকার করা হচ্ছে যে, জাতি গঠনে ধর্মের কোনো ভূমিকা থাকতে পারে। ভূমিকা যদি থাকে, তাহলে নাকি জাতি গঠনের কোনো উপায় নেই। হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে কিংবা অন্য কোনো প্রক্রিয়ায় তাদের বিলোপ অবধারিত। এ প্রচারণা সবটাই যে সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্র, এটি এখন আর গোপন নেই। পৃথিবীর মুসলিমপ্রধান দেশগুলোতে এমন কোনো সহিংস কাজ নেই, যা সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তকারীরা করতে পারে না। এটি শুধু আজকের কথা নয়। ইতিহাসের দীর্ঘ পথপরিক্রমার কথা। তুরস্ক বা আলজেরিয়া এর উদাহরণ। তুরস্ক তো ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যই হতে পারছিল না। তাদের দীর্ঘকাল ধরে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির কাছে মস্তক অবনতির পরীক্ষা দিতে হচ্ছিল। কিন্তু তার পরও সেখানকার মানুষকে তাদের মুসলমানিত্ব থেকে সরানো যায়নি। আবার ইউরোপীয় ইউনিয়নে তাদের অন্তর্ভুক্তি খুব বেশি দিন ঠেকিয়ে রাখা যায়নি। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি আলজেরিয়ায় এমন কোনো ভয়াবহ রক্তপাতমূলক নিকৃষ্ট কাজ নেই, যা করেনি। কিন্তু আলজেরিয়ায় মুসলমানদের উত্থান রোধ করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। সে দেশে শেষ পর্যন্ত মুসলমানদের বিজয় হয়েছে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি যা করেছে, তা হলো সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের সেনাবাহিনীকে নানা কৌশলে তাদের হাতে রেখেছে। এই কৌশল যে কত রকমের, সে কথা একবাক্যে বোঝানো সম্ভব নয়। ট্রেনিং, নগদ অর্থ, অবিরাম পরামর্শ। এভাবেই দেশে দেশে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি তাদের পুতুলদের অবিরাম ক্ষমতায় বসিয়ে এসেছে। যেমন বাংলাদেশে বসিয়েছিল মার্কিন নাগরিক ফখরুদ্দীন আহমদ নামে এক ব্যক্তিকে। আর একইভাবে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী প্রধান মার্কিন নাগরিক মইন ইউ আহমেদকে। তারা একটি নির্দিষ্ট এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশের নাগরিকের ভান ধরে এমন এক গজবএখানে তৈরি করে গেছেন যে, ভবিষ্যতে তাদের অভিসম্পাত করলেও এর কোনো মীমাংসা হবে না। এদের ভাগ্য তবু ভালো। ভারী যতœ-আত্তি করে যুক্তরাষ্ট্র ফখরুদ্দীন-মইনউদ্দিনকে কোলে করে রেখেছে। ফখরুদ্দীন নামে নষ্ট লোকটি বোধ হয় এখন পর্যন্ত সুস্থ আছে। কিন্তু মইনউদ্দিনের অবস্থা খুবই খারাপ। তার মেরুদণ্ডের রজ্জু পরিবর্তন করার দরকার পড়েছে। ফলে তার ব্লাড গ্রুপের অন্য কারো মেরুদণ্ডের রজ্জুর অপেক্ষায় আছেন। এখন হুইল চেয়ারেই প্রাকৃতিক কার্য সমাধা করেন। পৃথিবীর ইতিহাস এ রকম নিষ্ঠুর যে, বিশ্বাসঘাতকদের এমনই পরিণতি ভোগ করতে হয়। বাংলাদেশ প্রসঙ্গে পরে আসছি। কিন্তু মিসরে কী হলো? মিসরে বেশির ভাগ মানুষ মুসলিম ব্রাদারহুডের সমর্থক। তারাই ড. মোহাম্মদ মুরসিকে ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতায় বসিয়েছিলেন। গণতন্ত্রের স্বাভাবিক নিয়মেই সেখানে বিরোধী দলও আছে এবং থাকবে। এই বিরোধী দল সংখ্যায় খুব বড় নয়। কিন্তু একেবারে নিঃশক্তিও নয়। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি শুরু থেকেই ব্রাদারহুডের প্রতিনিধি ড. মোহাম্মদ মুরসিকে পছন্দ করেনি। তারা ওই ুদ্র বিরোধী দলকেই রাস্তায় নামিয়ে দিলো। লক্ষ্য মুরসি সরকারের পতন ঘটানো। তাদের দাবিদাওয়ার ভেতরে কোনো যৌক্তিকতা ছিল নাÑ এমন বিশ্লেষণ করব না। কিন্তু তারা সে দাবি আদায়ের জন্য তাহরির স্কয়ারের মতো ছোটখাটো সমাবেশ করতে থাকল। ফলে মিসরে নতুন সঙ্কটের জন্ম হলো। সে ক্ষেত্রে সেনাবাহিনী হঠাৎ করেই অবাধ্যতার ঘোষণা দিয়ে বসল। তারা ড. মুরসিকে ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়ে বলল, এর মধ্যেই তাকে রাজনৈতিক সঙ্কটের সমাধান করতে হবে। আসলে হুকুম দেয়ার মালিক ছিলেন মুরসি। কিন্তু হুকুম দিয়ে বসলেন সেনাপ্রধান। যারা মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করতে চেয়েছিল অসঙ্গত দাবিতে, তাদের মধ্যে কিছু সাধারণ মানুষ ছিলেন, যারা গোটা ষড়যন্ত্র সম্পর্কে হয়তো কোনোভাবেই অবহিত ছিলেন না। মুরসিবিরোধী আন্দোলনকারীরা জানতেন, এ আন্দোলনের ফলে গণতন্ত্র ধ্বংস হবে এবং ক্ষমতা গ্রহণ করবে সেনাবাহিনী। আর সেনাবাহিনী ক্ষমতা গ্রহণের অর্থ, আবারো দীর্ঘ কালের জন্য মিসর থেকে গণতন্ত্রের প্রস্থান। যারা এ কাজ করলেন তারা ভেবে দেখলেন না যে, এর ফলে নিজেরাই নিজেদের পায়ে কুড়াল মেরে বসেছেন। আরও একটি বিষয় তারা ভাবেননি যে, সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করে ট্যাংক, কামান, বন্দুক নিয়ে মাঠে নামলেই লাখ লাখ ব্রাদারহুড সমর্থককে রাতারাতি দমিয়ে ফেলা সম্ভব হবে না। সেটি এখন মিসরে সত্য প্রমাণিত হয়েছে। কায়রো, আলেকজান্দ্রিয়াসহ মিসরের শহরগুলোতে লাখ লাখ মানুষ মুরসির পক্ষে সমবেত হয়ে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠেছেন। এ প্রতিবাদধ্বনি স্তব্ধ করে দেয়ার জন্য সেনাবাহিনী লাখ লাখ মানুষের ওপর স্থল ও আকাশপথে গোলাবর্ষণ করে কয়েক হাজার মানুষকে খুন করেছে। তারপরও গত শুক্রবার যখন মসজিদগুলো থেকে মিছিল নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ার ডাক দেয় মুসলিম ব্রাদারহুড, তখন সেখানে আবার লাখ মানুষ সমবেত হয়েছেন। মিসরে ব্রাদারহুড নিষিদ্ধ ছিল হোসনি মোবারকের আমল থেকেইÑ প্রায় ৩০ বছর ধরে। কিন্তু দলটি তাতে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি। মোবারকের পতনের পর যখন নির্বাচনের সুযোগ এলো, তখন দেখা গেল মিসরীয় জনসাধারণের বৃহত্তম অংশ ব্রাদারহুডের পক্ষেই রয়েছে। তাই ড. মুরসি ব্রাদারহুডের প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হয়ে রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্ব লাভ করেন। কিছু ভুল যে মুরসি করেননি, এমন নয়। তার প্রথম ভুল ছিলÑপ্রেসিডেন্টের ক্ষমতা অধিক করে তোলা, যাকে স্বৈরতান্ত্রিক বললে হয়তো ভুল হবে না। ড. মুরসি ব্যাপক জনসমর্থন লাভের পর সম্ভবত ভুলেই গিয়েছিলেন যে, সাম্রাজ্যবাদী শক্তি বাগে পেলে কখনোই তাকে ছাড় দেবে না। হয়তো ড. মুরসি সে পরিস্থিতি নিজেই তৈরি করলেন। এর কিছুটা সংশোধন যে তিনি করেননি, এমন নয়। কিন্তু তাকে সে সুযোগ সাম্রাজ্যবাদীরা দেবে কেন? মিসরে তাদের দরকার ইসরাইলের বন্ধুভাবাপন্ন বা অনুগত একটি সরকার। সেই ভারসাম্যমুরসি রক্ষা করতে পারেননি কিংবা তাকে রক্ষা করতে দেয়া হয়নি। গত কয়েক দিনে বিশ্বব্যাপী গণমাধ্যম ও সংবাদপত্রগুলোর প্রধান শিরোনাম, মিসর। লাখ লাখ মানুষের সমাবেশে সেনাবাহিনীর গুলি প্রধান আলোচ্য বিষয়। মধ্যপ্রাচ্যে যারা ব্রাদারহুডকে সমর্থন করেন না, তারা এ গণহত্যার এভাবে মূল্যায়ন করছেন যে, সেনাবাহিনী মিসরে সন্ত্রাসবাদ দমন করছে। যারা খুন হচ্ছে কিংবা মিছিল বা সমাবেশ করছেন তারা সবাই সন্ত্রাসী। চূড়ান্ত বিচারে কী হবে, বলতে পারি না। কিন্তু এখনকার মতো মিসরে জয়ীহয়েছে ইসরাইলপন্থী সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও তার দোসররা। বন্দুকের নলের মাধ্যমে কিংবা একশ্রেণীর দালাল সৃষ্টি করে মিসরে দীর্ঘ কাল ধরে গৃহযুদ্ধ বাধিয়ে রাখা সম্ভব হবে। তাতে আরও বহু মানুষের প্রাণ যাবে। আরও বহু মা হবেন সন্তানহারা। বোন হবেন স্বামীহারা। বহু শিশু হারাবে মা-বাবাকে। মিসরে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির দম্ভ চলতে থাকবে। একসময় মিসরের গণ-অভ্যুত্থানকে আরব বসন্তবলে এই সাম্রাজ্যবাদীরাই খুব তারিফ করেছিল। কারণ তা রোধ করার সাধ্য তাদের ছিল না। কিন্তু মুরসির এক বছরের শাসনকালের মধ্যে সাম্রাজ্যবাদীরা তা গুছিয়ে নিয়েছে। এখন সম্ভব হলো। মিসরে ব্রাদারহুডের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ন্যাশনাল স্যালভেশন ফ্রন্ট। যদিও তারা সংখ্যালঘু। সেনাবাহিনীর বর্তমান অভিযানে যদি ব্রাদারহুড চরম পন্থা অবলম্বন করে, তা হলে তাদের সন্ত্রাসী বলে অভিহিত করা সম্ভব হবে। আর ব্রাদারহুড যদি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়, তা হলে তাদের সহজে আলকায়েদা বলে নির্মূল অভিযান অব্যাহত রাখা হবে। মিসরের হোসনি মোবারকবিরোধী গণ-অভ্যুত্থানে মারা গিয়েছিলেন ৯০০ মানুষ। কিন্তু বর্তমান সেনাশাসকেরা এক দিনেই হত্যা করেছে কয়েক হাজার লোক। আলজেরিয়ায় সাম্রাজ্যবাদী বাহিনীর দশকব্যাপী অভিযানে প্রাণ হারিয়েছিলেন ১০ লাখ মানুষ। মিসরের সেনাবাহিনী যে পথে অগ্রসর হয়েছে, সে পথ ধরে যদি এগোতে থাকে, তা হলে হয়তো সেখানে এর চেয়েও বেশি মানুষকে প্রাণ দিতে হবে। ইসরাইল অন্তত তাই চায়। সে বিবেচনায় মিসরে যে সঙ্ঘাত শুরু হলো, তা সম্ভবত দীর্ঘস্থায়ী হবে। আর তাতে ব্রাদারহুড আর স্যালভেশন ফ্রন্ট নিজেদের মধ্যেও শক্তি ক্ষয় করে ইসরাইল তথা সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে আরও অধিক নিরাপত্তা দিতে পারে। মিসরের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে ক্ষমতাসীনদের খুশি হওয়ার যথেষ্ট কারণ ঘটেছে। তারা বলতে পারবেন, শাপলা চত্বরে সমবেত লাখ লাখ নিরীহ মানুষের ওপর তারা একইভাবে গণহত্যাযজ্ঞ পরিচালনা করেছেন। অতএব সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের সমর্থন দেবে না কেন? খেলা তো সেখানেই। ভারত তুষ্ট আছে, সাম্রাজ্যবাদীরা মানবাধিকার-টানবাধিকারের কথা বললেও তারাও এতে তুষ্ট। অতএব সরকার যাই করুক না কেন, তাকে রোখে কে?


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads