মঙ্গলবার, ৬ আগস্ট, ২০১৩

রানা প্লাজার কান্না


বিশাল এ বিশ্বে প্রতিদিন নানা ঘটনা-দুর্ঘটনা ঘটে। বাংলাদেশেও ঘটে। দূরের ঘটনা মানুষকে যতটা প্রভাবিত না করে, কাছের ঘটনা তার চেয়ে অনেক বেশি প্রভাবিত করে। বাংলাদেশে সম্প্রতি যেসব ঘটনা ঘটেছে, তার মধ্যে সাভারের রানা প্লাজার দুর্ঘটনা সর্বাধিক মর্মান্তিক, যা বাংলাদেশকে যেমন গভীর দুঃখ-বেদনা, ােভ ও হতাশায় মুহ্যমান করেছে, তেমনি সারা বিশ্বের মানুষকেও খানিকটা বেদনার্ত করেছে। এই দুঃখ-বেদনা, ক্ষোভ আরো ঘনীভূত সর্বসাম্প্রতিক আরো একটি ঘটনায়। গত ৪ আগস্ট বেতন-বোনাস ও ক্ষতিপূরণের দাবিতে রাস্তায় নেমে আসা রানা প্লাজার বিভিন্ন পোশাক কারখানা ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের শ্রমিক ও তাদের স্বজনদের যখন পুলিশের হাতে বেধড়ক পিটুনি খেতে হলো। পুলিশের নির্মম পিটুনিতে কয়েকজনকে রাস্তায় অজ্ঞান হয়ে পড়তেও দেখা গেছে। দীর্ঘ তিন সপ্তাহ পর্যন্ত রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপের মর্মান্তিক দৃশ্য ও ধ্বংসস্তূপে আটকেপড়া অসহায় মানুষের আর্তচিৎকার আর বেঁচে থাকার নিষ্ফল ক্রন্দন প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে টেলিভিশনে প্রচারিত হওয়ার ফলে রানা প্লাজার কান্না শুধু বাংলাদেশকেই কাঁদায়নি, বিশ্বের সর্বত্র সংবেদনশীল প্রতিটি মানুষকেই স্তম্ভিত, বিস্মিত ও মর্মাহত করেছে। সাথে সাথে মানবসৃষ্ট এ ধ্বংসযজ্ঞ ও আধুনিক উন্নত প্রযুক্তির যুগেও দুর্ঘটনাকবলিত একটি অট্টালিকার ধ্বংসস্তূপ থেকে আটকেপড়া অসহায় মানুষকে উদ্ধারকাজে কেন এত দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হলো সে ব্যাপারে বিবেকবান মানুষের মনে নানা প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছে। অবশ্য নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বে¡ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, ফায়ার ব্রিগেড ও অসংখ্য স্বেচ্ছাসেবক স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে যেভাবে উদ্ধারকাজে এগিয়ে এসেছে এবং এনাম মেডিক্যাল হাসপাতাল, ইবনে সিনা ট্রাস্ট আহতদের সেবায় আত্মনিয়োগ করেছে, বিশ্বের অগণিত মানুষ সবিস্ময় ও সপ্রশংস দৃষ্টিতে তা অবলোকন করেছে। ওই সময় আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ক্যানসাস নগরীতে আমার কনিষ্ঠ ছেলে আবিদুর রহমানের বাসায় অবস্থান করছিলাম। সে আইটি কোম্পানিতে সিনিয়র ডাইরেক্টর হিসেবে কর্মরত। আমি জানুয়ারিতে সস্ত্রীক ছেলের বাসায় বেড়াতে এসেছি। বিদেশে অবকাশকালে ইন্টারনেটে বাংলাদেশের পত্রপত্রিকা পড়ে এবং টিভি দেখে প্রতিনিয়ত দেশের খবরাখবর রাখছিলাম। রানা প্লাজার দুর্ঘটনা ও দুর্ঘটনাকবলিত অসহায় মানুষের করুণ পরিণতি, এ সম্পর্কিত প্রতিদিনের ঘটনাপ্রবাহ দেখে গভীর মর্মপীড়া বোধ করেছি। যেখানে গিয়েছি, যার সঙ্গে কথা হয়েছে, রানা প্লাজার দুর্ঘটনার কথা সর্বত্রই আলোচনায় এসেছে। দুর্ঘটনায় নিহত আহত শ্রমিক ও তাদের স্বজনদের প্রতি সহানুভূতি হৃদয় থেকে স্বতঃউৎসারিত হয়েছে। আমার মনে হয়, রানা প্লাজার ধসে যাওয়া এবং সেই সাথে হাজার হাজার গরিব খেটে খাওয়া অসহায় শ্রমিকের (যাদের বেশির ভাগই নারী) নিহত-আহত হওয়ার মর্মান্তিক দৃশ্য দেখে বিশ্বের অগণিত মানুষের হৃদয় গভীরভাবে মথিত, আন্দোলিত, আপ্লুত ও বেদনার্ত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে ক্যানসাসে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বিদেশে রানা প্লাজার এ দুর্ঘটনার প্রতিক্রিয়ার প্রয়াস পাবো। ঘটনাটি আমার ছেলে আবিদের অফিসেই ঘটেছে। ওর মুখেই ঘটনার বিবরণ শুনেছি। ক্যানসাসের একটি নামকরা আইটি কোম্পানি। পাঁচ শতাধিক কর্মচারী কর্মরত। তাদের একজনের পরিবারে এক শিশুর জন্ম হয়েছে। নবজাত শিশু ও তার বাবা-মাকে শুভেচ্ছা জানাতে অফিসের সহকর্মীরা অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। দুপুরে লাঞ্চব্রেকের সময় কেক কেটে চা-নাশতা পরিবেশনের সাথে সহকর্মীদের প থেকে নবজাতকের জন্য যৌথভাবে বিপুল উপঢৌকন আনা হয়েছে। শিশু খাবার, ডাইপার, খেলনা ও জামাকাপড়সহ অনেক কিছু। উপস্থিত সবার আনন্দ-কোলাহলে অফিস ঘরে উৎসবমুখর পরিবেশ। উপঢৌকনের প্যাকেটগুলো সামনে আনা হলো। সেখান থেকে একটি প্যাকেট খুলে নবজাতকের গায়ে নতুন পোশাক পরিয়ে দেয়ার জন্য একটি সুন্দর জামা বের করা হলো। জামার ভাঁজ খুলতে খুলতে কৌতূহলী চোখ গিয়ে পড়ল ছোট্ট একটি ল্যাবেলে। অতি ুদ্র অরে লেখা রয়েছেÑ Made in Bangladesh. লেখাটি উচ্চারিত হওয়ার সাথে সাথে ঝড়ের রাতে অকস্মাৎ প্রদীপ নিভে গেলে যেমন ঘুটঘুটে অন্ধকারে চার দিক আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে, তেমনি মুহূর্তের মধ্যে তড়িতাহতের মতো উৎসবমুখর পরিবেশে থমথমে বিষণœতার অন্ধকার নেমে এসেছিল। রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপের মর্মান্তিক দূশ্য সবার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। অনেকেই বলতে থাকেনÑ এ সুন্দর পোশাকটি যে নিপুণ হাতে তৈরি হয়েছে, সে হতভাগ্য নারী শ্রমিক হয়তো ওই রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়ে করুণ মৃত্যুবরণ করেছে। উপস্থিত সবাই সে দুর্ভাগা রমণীর জন্য অনুশোচনা করতে করতে বিমর্ষ হয়ে পড়ল। উৎসবের আমেজ উবে গেল। রানা প্লাজার দুর্ঘটনার খবর নিয়ে সবাই আলোচনায় মগ্ন হলো। ইতোমধ্যে ভাঁজখোলা সুন্দর জামাটিতে আবার ভাঁজ পড়ল। প্যাকেটে ভরা হলো। কল্পনার সে নারীশ্রমিকের বিদেহী আত্মার সম্মানে ওই জামাটি নবজাতকের গায়ে আর শোভা পেল না। হতভাগা শ্রকিকের অজানা মর্মান্তিক পরিণতির কথা স্মরণ করে জামাটি আবার প্যাকেটে ভরা হলো। আনন্দঘন পরিবেশে যেন এক কালো মেঘের ঘনঘটা। সবার চোখে-মুখে বিষণœতার ছায়া। রানা প্লাজার বোবা কান্নাার ঢেউ মুহূর্তের মধ্যে সব এলোমেলো করে দিয়ে গেল। সাভারের রানা প্লাজায় পাঁচটি গার্মেন্ট কোম্পানি ছিল। তাতে মোট প্রায় ১০-১২ হাজার শ্রমিক কাজ করত। বাংলাদেশে এ রকম হাজার হাজার পোশাক কারখানা রয়েছে, তাতে প্রায় ৩৫ লাখ শ্রমিক কাজ করে। অতএব, উল্লিখিত সুন্দর জামাটি ঠিক কোন কারখানায়, কোন শ্রমিকের নিপুণ হাতে তৈরি হয়েছিল এবং সে শ্রমিক এখন জীবিত না মৃত, তা কেউ জানে না; কিন্তু রানা প্লাজার দুর্ঘটনার সাথে বাংলাদেশের পোশাকশিল্প ও ৩৫ লাখ হতভাগ্য শ্রমিকের ভাগ্য প্রতীকীভাবে আজ এক ও অভিন্ন হয়ে গেছে। বাংলাদেশের পোশাকশিল্প বলতেই যেন কারখানায় আগুন লেগে, অট্টালিকা ধসে অসহায় শ্রমিকের করুণ মৃত্যুর ভয়াবহ দূশ্য অনেকের চোখেই ভেসে ওঠে। মানবিক ট্র্যাজেডির এ নেতিবাচক রূপকল্প বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে বহুলাংশে ম্লান করে দিয়েছে। দ্রুত এ অবস্থার অবসান হওয়া প্রয়োজন। অবিচল দেশপ্রেম, সততা, কর্মনিষ্ঠা ও সুদৃঢ় সঙ্কল্পই পারে এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে সীমাহীন আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের ষোল কোটি মানুষকে আজ এ চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে হবে আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন জাতি হিসেবে বেঁচে থাকার অপরিহার্য তাগিদে।


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads