জাতীয় একটি দৈনিকে প্রকাশিত খবরে জানানো হয়েছে, রাজনৈতিক বিবেচনায় নতুন পর্যায়ে আরও কয়েকশ’ মামলা প্রত্যাহার করার প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। বলা বাহুল্য, এই প্রস্তুতি নিচ্ছেন ক্ষমতাসীনরা। মেয়াদের একেবারে শেষপ্রান্তে এসে সরকার রাজনৈতিক বিবেচনায় দলীয় লোকজনের বিরুদ্ধে আদালতে পড়ে থাকা বাকি সব মামলা প্রত্যাহার করে নেয়ার জন্য তোড়জোড় শুরু করেছে। এসব মামলার মধ্যে হত্যা-সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি থেকে দুদকের দায়ের করা অসংখ্য মামলাও রয়েছে। মামলাগুলোর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য চলতি মাসের শেষ কিংবা আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে জাতীয় কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হবে। মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ নিয়ে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও এমপি থেকে আওয়ামী লীগের জেলা পর্যায়ের নেতারা পর্যন্ত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তদবির করে বেড়াচ্ছেন। স্বরাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকেও এসব মামলার চার্জশিট ও সর্বশেষ অবস্থাসহ তথ্য-উপাত্ত চেয়ে সংশ্লিষ্ট জেলার ডিসিদের কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছে। এসব জেলার সংখ্যা ৪০। ধারণা করা হচ্ছে, ডিসিদের কাছ থেকে জবাব ও তথ্য-উপাত্ত পাওয়ার পরই মামলা প্রত্যাহার সংক্রান্ত জাতীয় কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হবে। ধরে নেয়া যায়, ক্ষমতাসীন দলের আরও কয়েকশ’ অপরাধী পার পেয়ে যাবে।
খবর হিসেবে এটা অবশ্য নতুন কিছু নয়। কারণ, রাজনৈতিক বিবেচনায় কেবলই নিজেদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহারের ব্যাপারে প্রথম পর্যায় থেকেই বর্তমান সরকার আইনসম্মত অবস্থানের অনেক বাইরে চলে গেছে। বলা চলে, অন্য কিছু বিষয়ের সঙ্গে এ ব্যাপারেও রেকর্ড তৈরি করেছেন ক্ষমতাসীনরা। ক্ষমতায় আসার পরপর কিছুদিনের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি ও দুর্নীতিসহ বিভিন্ন অভিযোগে দায়ের করা ডজন দেড়েক মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছিল। আওয়ামী লীগের অন্য নেতাদের মামলাও প্রত্যাহার করেছে রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহার সংক্রান্ত জাতীয় কমিটি। উলে¬খযোগ্য বিষয় হলো, শত শত নামের দীর্ঘ তালিকায় কখনো বিরোধী দলীয় নেতাদের নাম পাওয়া যায়নি। এ ব্যাপারে চমৎকার কিছু কথা শুনিয়ে রেখেছেন আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম। তিনি বলেছেন, রাজনৈতিক বিবেচনায় মামলা প্রত্যাহারে ‘ভুল’ হতেই পারে। তবে সরকার ‘যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন’ করে তালিকা তৈরি করছে এবং মামলা প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। মানতেই হবে, আসলেও ‘যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন’ করেই তালিকাগুলো তৈরি করা হয়েছে! এখনও একই সতর্কতা বজায় রাখছেন ক্ষমতাসীনরা। এই প্রক্রিয়ায় পার পেয়ে গেছে এমনকি প্রমাণিত ও দন্ডিত খুনি-ঘাতকরাও। আমরা মনে করি, যথেষ্ট ‘সতর্কতার সঙ্গে’ সরকার যেভাবে খুনি-ঘাতক থেকে সন্ত্রাসী-চাঁদাবাজ পর্যন্ত অপরাধীদের দন্ড মওকুফ করার পাশাপাশি বাকিদের মামলা প্রত্যাহার করে নিচ্ছে তার ফলে অপরাধীরাই উল্টো প্রশ্রয় পাবে। বাস্তবে প্রশ্রয় পেয়েছে বলেই দেশে এখনও অপরাধ শুধু বেড়েই চলেছে। বলা দরকার, ক্ষমতাসীন দল করে বলে পুলিশ কর্মকর্তাকে হত্যার অভিযোগ থেকেও নেতা-কর্মীরা বিনাবিচারে পার পেয়ে গেছে। আইনজীবী ও আইন বিশেষজ্ঞদের অভিমতসহ বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত অনুসন্ধানী রিপোর্টে জানানো হয়েছে, খুনিদের দ- মওকুফের কোনো কোনো ক্ষেত্রে জেল কোড মানা হয়নি, নেয়া হয়নি আইন মন্ত্রণালয়ের অভিমতও। প্রসঙ্গক্রমে সংসদে আওয়ামী লীগের উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর ছেলের ক্ষেত্রে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের ক্ষমার কথা স্মরণ করা যায়। ২০০৮ সালে দুদকের দায়ের করা কয়েকটি মামলায় সাজেদা চৌধুরীর ছেলে শাহদাব আকবর চৌধুরীকে ১৮ বছরের কারাদ- দেয়া এবং এক কোটি ৬০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছিল। তিনি পলাতক থাকা অবস্থায় রাষ্ট্রপতির কাছে দন্ড মওকুফের আবেদন পেশ করেছিলেন। সে সময় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছিল, সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদে দেয়া ক্ষমতাবলে রাষ্ট্রপতি ‘আইনসম্মতভাবেই’ সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর ছেলের দ- মওকুফ করেছেন। এই ব্যাখ্যা মানুষের ক্ষোভ দূর করতে পারেনি। কারণ, আইনের বিধান হলো, দন্ডিত ব্যক্তিকে প্রথমে আদালতের কাছে আত্মসমর্পণ করতে হবে। আদালত তাকে কারাগারে পাঠাবে বা জামিন দেবে। দ- মওকুফ করার আবেদন তাকে কারা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে পাঠাতে হবে। কিন্তু সাজেদা চৌধুরীর পুত্রের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, রাষ্ট্রপতি একজন পলাতক ও দন্ডিত অপরাধীর বেআইনী পন্থায় পাঠানো আবেদনের ভিত্তিতে দ- মওকুফ করেছিলেন। এটা ২০১১ সালের জুলাই মাসের ঘটনা। লক্ষ্মীপুরের বিএনপি নেতা অ্যাডভোকেট নূরুল ইসলাম হত্যার দায়ে মৃত্যুদ-প্রাপ্তদেরও একই রাজনৈতিক বিবেচনায় ক্ষমা করেছিলেন রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান। স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতার পুত্রের নেতৃত্বে ২০০০ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর বিএনপি নেতা নূরুল ইসলামকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। ২০০৩ সালে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল পাঁচ আসামীকে মৃত্যুদ- দিয়েছিল। হাই কোর্ট সে মৃত্যুদ- বহাল রেখেছিল। দ-িতদের আবেদন আপিল বিভাগে নিষ্পত্তি হওয়ার আগেই রাষ্ট্রপতি দ- মওকুফ করে দিয়েছিলেন। বলা হয়েছে, পিতা যেহেতু আওয়ামী লীগের নেতা সেহেতু রাষ্ট্রপতি মহানুভবতা দেখিয়েছিলেন। এভাবেই চলছে রাজনৈতিক বিবেচনায় দ- মওকুফ করার এবং মামলা প্রত্যাহার করিয়ে নেয়ার কর্মকান্ড। মানুষের মনে উচ্চ আদালতের প্রতি অনাস্থার সৃষ্টি হলেও বেছে বেছে শুধু আওয়ামী লীগের লোকজনকেই ক্ষমা করা হচ্ছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এ ধরনের কর্মকা- কোনো মূল্যায়নেই সমর্থনযোগ্য নয়। অন্য একটি বিষয়ও বিবেচনায় রাখা দরকার। সেটা হলো, দ-িত আসামীরা মুক্তি পাওয়ার পর আবারও অপরাধে জড়িয়ে পড়তে পারে, তারা এমনকি প্রতিশোধ নেয়ার জন্যও উন্মত্ত হয়ে উঠতে পারে। এর ফলে নতুন করে বিপদে পড়বেন নিহতের স্বজনরা। এর অনেক প্রমাণও পাওয়া গেছে, এখনো পাওয়া যাচ্ছে। এটা একটি দিক। অন্য দিকটি হলো, মৃত্যুদ- পাওয়ার পরও যেখানে কেবলই রাজনৈতিক কারণে রেহাই পাওয়া যায় সেখানে সব ধরনের অপরাধীরাই এরপর বেপরোয়া হয়ে উঠবে। বাস্তবে বেপরোয়া হয়ে উঠেছেও। সেজন্যই দেশে অপরাধ কমছে না বরং বাড়ছেই। এভাবে চলতে থাকলে দেশে আইনশৃংখলা বলে যে কিছুই আর অবশিষ্ট থাকবে না সেকথা নিশ্চয়ই বলাই বাহুল্য। আইনের দিক থেকে এ শুধু আপত্তিকর নয়, ভয়ের কথাও বটে! আমরা তাই দলীয় বিবেচনায় মামলা প্রত্যাহারের বিরোধিতা করি। আইন এবং আইনের প্রয়োগ সকলের ক্ষেত্রেই সমান হওয়া উচিত বলেও আমরা মনে করি।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন