মঙ্গলবার, ২৭ আগস্ট, ২০১৩

ঐশীর বদলে যাওয়া প্রসঙ্গে-


পরিবর্তনের এমন ঘটনা ঐশীর জীবনে আগে ঘটলে আমাদের হয়তো মাতা-পিতাকে হত্যার মতো এমন নৃশংস ঘটনা দেখতে হতো না। দৈনিক ইত্তেফাকের ২৭ আগস্ট সংখ্যার এক রিপোর্টে বলা হয়, ডান্স পার্টি, ডিজে পার্টি আর রঙিন দুনিয়ার বন্ধুদের নিয়ে দিন-রাত আড্ডা দেয়া ঐশী রহমান এখন নামায পড়তে শুরু করেছে। মদ, গাঁজা, ইয়াবা সেবনে অভ্যস্ত ঐশী এখন বদলে গেছে। মাদকের কথা সে শুনতেই পারছে না। এই মাদকই তার বাবা-মাকে খুন করেছে। তাই মাদক থেকে দূরে থাকতে চায় ঐশী। জীবনে আর কখনও মাদকের কাছে যাবে না বলে শপথ করেছে। গত ২৬ আগস্ট সোমবার কাউকে কিছু না জানিয়ে ফজরের নামায পড়তে শুরু করে ঐশী। শুধু তার রুমে থাকা বন্ধুরাই নয়, গাজীপুরস্থ কোনাবাড়ীর কিশোরী উন্নয়ন কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়করাও ঐশীর এই পরিবর্তনে বিস্মিত হন। সোমবার ৫ ওয়াক্ত নামায আদায় করে ঐশী।
ঐশীর জীবনে এখন যে পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে সেটাই সবার কাম্য। গাজীপুর জেলার সমাজসেবা কার্যালয়ের উপপরিচালক বেগম লুৎফুননেসা ইত্তেফাককে বলেন, কেমন যেন বদলে গেছে ঐশী। সোমবার সঠিক সময়ে ৫ ওয়াক্ত নামায আদায় করেছে সে। সবার সঙ্গে স্বাভাবিক আচরণ করছে। নিজের অপরাধবোধ আর এতিম হওয়ার বেদনা সে হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করছে। তার রুমে থাকা অন্য মেয়েদের সে বলেছে, জীবনে আর কোন দিন মাদকের কাছে যাবে না। সুযোগ পেলে ছোট ভাইকে মানুষের মতো মানুষ করার চেষ্টা করবে সে। ছোট ভাইটির জন্য তার মন কাঁদে। ঐশী এখন এমব্রয়ডারির কাজ শিখছে। কাজে সে খুবই মনোযোগী, তাই সহজেই কাজ শিখতে পারছে। তার মধ্যে অনুশোচনা বোধও কাজ করছে।
ইত্তেফাকের রিপোর্ট এবং সমাজসেবা কার্যালয়ের উপ-পরিচালকের বক্তব্যে যেই বিষয়টি উঠে এসেছে তা হলো, অনুতপ্ত ঐশী এখন তার অতীত জীবন যাপন ও কর্মকা- বিশ্লেষণ করতে সক্ষম হচ্ছে। প্রশ্ন জাগে, এই কাজটি সে আগে করতে সক্ষম হলো না কেন? আগে নিজের কর্মকা-ের বিশ্লেষণে সক্ষম হলে তো তার পিতা-মাতাকে নিহত হতে হতো না এবং তার জীবনে এমন বিপর্যয় নেমে আসতো না। কিন্তু কোন্্ জিনিস তাকে এমন অন্ধকারের পথে ঠেলে দিয়েছিল? সে তো আলো ঝলমলে এই রাজধানীতে শিক্ষিত পরিবারে ও একটি ইংলিশ স্কুলের পরিবেশে বেড়ে উঠেছিল। প্রশ্ন জাগে, ‘ও লেভেল’ পর্যন্ত পড়ার এই দীর্ঘ সময়ে যে পরিবেশ ও প্রতিবেশে সে বেড়ে উঠছিল সেখানে কি কোন ভুল ছিল? যে কোন ঘটনায় আমরা দোষী ব্যক্তির দোষ খুঁজে বেড়াই কিন্তু মানুষ কিভাবে কোন্্ পথে দোষী হয়ে যায় তার বিশ্লেষণে আমরা তেমন যাই না। ঐশীর বাবা-মাও হয়তো মনে করেছিলেন, ঐশীকে ভাল স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছি, সে মানুষ হয়েই গড়ে উঠবে। বস্তুবাদী এই সমাজে আজকাল অভিভাবকরা জীবন যাপনের উপকরণ সংগ্রহে এতটাই ব্যস্ত থাকেন যে, সন্তানের দিকে আর তেমন নজর দিতে পারেন না। সন্তানরা কাদের সাথে মিশছে, জীবন কিভাবে যাপন করছে, সে খবর রাখতে পারেন না। ফলে ভ্রান্ত পথে চলার এক পর্যায়ে যখন সন্তানকে বিপর্যয়ের মধ্যে দেখতে পায়, তখন অনেক অভিভাবকই ক্ষুব্ধ হয়ে সন্তানদের সাথে নিষ্ঠুর ও প্রতিক্রিয়াশীল আচরণ করেন। এতে সন্তানও শুদ্ধির পথে না এসে বরং পা বাড়ায় প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের পথে। এমন অবস্থা আমাদের সমাজের জন্য এক দুশ্চিন্তার বিষয় হয়ে ওঠেছে। ঐশী তো অনুতপ্ত হয়ে আত্মসমালোচনার ধারায় এখন নিজের কর্তব্যকে নির্দিষ্ট করতে পেরেছে, কিন্তু আমরা যারা পরিবার, স্কুল, সমাজ, রাজনীতি ও রাষ্ট্রের অভিভাবক তারা কি আত্মসমালোচনার আলোকে নিজেদের কর্তব্য স্থির করতে পেরেছি? বক্তৃতা-বিবৃতি কিংবা ঘরোয়া আলোচনায় আমরা প্রায়ই শিশু-কিশোরদের প্রকৃত মানুষ হওয়ার উপদেশ দিয়ে থাকি। কিন্তু আমরা তাদের সামনে প্রকৃত মানুষ হওয়ার উদাহরণ কতটা পেশ করতে পেরেছি কিংবা তাদেরকে প্রকৃত মানুষ করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে কাঙ্খিত পরিবেশ কতটা উপহার দিতে পেরেছি? আর শিশু-কিশোরদের সামনে শিক্ষার প্রকৃত লক্ষ্যটাও কি আমরা স্থির করতে পেরেছি? বস্তুবাদী এই সমাজে ভোগবাদী জীবন-যাপন ও অর্থ-সম্পদ উপার্জনের লালসা এতটাই উৎকট রূপ ধারণ করেছে যে, নীতি-নৈতিকতা সমৃদ্ধ মহত্ত্বর জীবনের চেতনাই যেন সমাজ থেকে লোপ পেতে বসেছে। ফলে বর্তমানে ছাত্র-ছাত্রীরা মনে করে, লেখাপড়ার উদ্দেশ্য হলোÑ ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, ব্যারিস্টার, আমলা বা অন্য কিছু হওয়া। কিন্তু শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য যে মানুষ হওয়া, সে কথা আজ আমরা ভুলতে বসেছি। এ কথাটি আমরা ভুলতে বসেছি যে, পশু-পাখি সহজেই পশু-পাখি কিন্তু মানুষ সহজে মানুষ নয়। জ্ঞান সাধনা ও ত্যাগ-তিতিক্ষার মাধ্যমে মনুষ্যত্ব অর্জন করতে হয়। মনীষীরা বলে গেছেন, শুধু পরীক্ষায় পাস নয়, শিক্ষার লক্ষ্য হবে শরীর-মন ও আত্মার সুসমঞ্জস বিকাশ। শারীরিক ও মানসিক বিকাশের কথা তো অনেকেই বলে থাকেন কিন্তু আত্মিক শুদ্ধির কথা খুব কমই শোনা যায়। আমাদের শিক্ষা কারিকুলামেও বিষয়টিকে অনেকটাই এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে। ঐশী সৃষ্টি হওয়ার এটা অন্যতম কারণ। বিষয়টি সংশ্লিষ্টরা উপলব্ধি করলেই মঙ্গল।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads