সম্প্রতি অনুষ্ঠিত পাঁচটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে সরকারদলীয় প্রার্থী পরাজিত হয়েছেন এবং বিজয়ী হয়েছেন বিরোধীদলীয় প্রার্থী। ক্ষমতাসীন পক্ষের পরাজয়ের কারণে সরকার ও একদল প-িত ব্যক্তি এই নির্বাচনগুলোকে ঢালাওভাবে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ বলছে। তাদের এই দাবির পক্ষে যুক্তি একটাই তা হলো- নির্বাচন নিরপেক্ষ না হলে বিরোধীদল জয়ী হতো না। অর্থাৎ সরকারি দল “হারিয়া প্রমাণ করিল নির্বাচন নিরপেক্ষ হইয়াছে” রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্পে কাদম্বিনীকে মরে তার জীবনের প্রমাণ দিতে হয়েছিল। সে ছিল রবীন্দ্রযুগের কথা। একশ’ বছর আগের কথা। কিন্তু আজকে তথ্যপ্রযুক্তির এই স্বর্ণযুগেও যদি কাদম্বিনীদেরকে মরিয়া জীবনের প্রমাণ দিতে হয় তবে জ্ঞান-বিজ্ঞানের এর চেয়ে বড় অপমান আর কি হতে পারে? সরকারপক্ষ ও কতিপয় প-িত এটুকু বলেই ক্ষান্ত হয়নি। তারা আরও দাবি করেছে যে, যেহেতু সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনগুলো নিরপেক্ষ হয়েছে। তাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আর কোন প্রয়োজন নেই বরং এই সরকারের অধীনে অথবা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনেই অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব। তাদের দাবি আমার আজকের আলোচনার মূল প্রতিপাদ্য। তাদের দাবি মূলত দুটি
১. বিগত পাঁচটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে।
২. সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন নিরপেক্ষ হওয়ায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আর কোন প্রয়োজন নেই।
আমি তাদের এ দুটি দাবির অসারতা প্রমাণের চেষ্টা করব।
১.
সরকারদলীয় প্রার্থীর পরাজয় নির্বাচনকে নিরপেক্ষ প্রমাণের জন্য যথেষ্ট নয়। কারণ একজন অপরাধী অপরাধ সংঘটনে ব্যর্থ হলেই তাকে নিরপরাধ বলা যায় না। সে অপরাধমূলক কাজের চেষ্টা করেছে কিনা সেটাও বিবেচ্য বিষয়। কানাডার আদালতে বিচারাধীন পদ্মা সেতু দুর্নীতি মামলা এ ব্যাপারে দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখযোগ্য। নির্বাচনগুলোর ক্ষেত্রে লক্ষণীয় হলো সরকার তাদের দলীয় প্রার্থীর পক্ষে সরকারি প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করেছেন কি না? এমন কোন চেষ্টা করা হলে অবশ্যই নির্বাচনগুলোকে নিরপেক্ষ বলা যাবে না। নির্বাচনী প্রচারণাসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে সরকারের প্রভাব বিস্তার ও নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের কয়েক ডজন প্রমাণ আমার হাতে আছে। আমি নিচে কয়েকটি উল্লেখ করলাম-
১. অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত সিলেটে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিয়েছেন যা নির্বাচনী আচরণবিধির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
২. নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন করে গাজীপুরে প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদাসম্পন্ন একাধিক ব্যক্তি নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিয়েছেন।
৩. রাজশাহীতে সরকারদলীয় প্রার্থীর ভোট বাড়ানোর লক্ষ্যে নির্বাচনের কয়েকদিন আগে গ্যাসের সংযোগ দেয়া হয়েছে। যা সরকারদলীয় প্রার্থীর বিগত দিনের নির্বাচনী ওয়াদা ছিল।
৪. নির্বাচনের আগমুহূর্তে বিরোধীদল সমর্থিত প্রার্থী গাজীপুরের অধ্যাপক এম এ মান্নানকে এনবিআর-এর মাধ্যমে হয়রানির চেষ্টা করা হয়েছে।
৫. গাজীপুরে সরকার সমর্থিত প্রার্থীর বিজয় নিশ্চিত করতে অপর প্রার্থী মো. জাহাঙ্গীর আলমকে নির্বাচনী প্রচারণা থেকে সরিয়ে যেতে বাধ্য করা হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী নগ্নভাবে তার নির্বাহী ক্ষমতার ব্যবহার করেছেন।
৬. প্রধানমন্ত্রীর অফিসকে নির্বাচনের কাজে ব্যবহার করা হয়েছে।
৭. গাজীপুরে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মাঠপর্যায়ের জনবলকে নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যবহার করা হয়েছে।
৮. নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে ছাত্রলীগের গাড়ি জব্দ করার অপরাধে গাজীপুর সদর উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা আয়েশা আক্তারকে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়।
এছাড়াও প্রার্থী ও তাদের সমর্থক কর্তৃক নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গের ভুড়ি ভুড়ি ঘটনা দেখা গেছে। নির্বাচনী আচরণবিধিতে মিছিল করার অনুমতি না থাকলেও গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ৫৩নং ওয়ার্ডে সকল কাউন্সিলর প্রার্থীকেই প্রচার প্রচারণার শেষদিনে ও শেষ মুহূর্তে মিছিল করতে আমি স্বচক্ষে দেখেছি। উপরোক্ত ঘটনাগুলোতে সরকারের নিরপেক্ষতার কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না বরং সরকার নগ্নভাবে দলীয় প্রার্থীর পক্ষ অবলম্বন করেছে। এসব ঘটনায় নির্বাচন কমিশন সঠিক ও আইনানুগ ব্যবস্থা নিলে তারা অন্তত নিজেদেরকে নিরপেক্ষ দাবি করতে পারত। কিন্তু তারা সে সুযোগ কাজে লাগায়নি। বরং নিজেদেরকে সরকারের আজ্ঞাবহ হিসেবে প্রমাণ করেছে। নির্বাচন যে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়নি তা আগেই প্রমাণ করা হয়েছে। তারপরও যদি যুক্তির খাতিরে ধরে নেয়া হয় যে, নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে, তাহলেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি ভুল প্রমাণিত হয় না। কারণ
১. কেউ কখনো স্থানীয় নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি করেনি বরং এ দাবিটি করা হয়েছে শুধুমাত্র জাতীয় নির্বাচনের জন্য।
২. সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে কোন মেয়র প্রার্থীই মেয়র পদ বা অন্য কোন লাভজনক সরকারি পদে বহাল থেকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি। বরং রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল ও সিলেটের মেয়ররা নিজ পদ থেকে এবং গাজীপুরের মো: জাহাঙ্গীর আলম উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যানের পদ থেকে পদত্যাগ করে নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করেছেন। কিন্তু বর্তমান প্রধানমন্ত্রী স্বপদে বহাল থেকে নির্বাচন করতে চাচ্ছেন।
৩. সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে কোন প্রার্থী কোন নির্বাহী ক্ষমতার অধিকারী ছিল না। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচন হলে একটি দলের অনেক এমপি প্রার্থী নির্বাহী ক্ষমতার অধিকারী থাকবেন।
৪. সিটি নির্বাচনে নির্বাচনকে প্রভাবিত করার মত কোন ক্ষমতা প্রার্থীদের ছিল না কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচন হলে নির্বাচনে প্রভাব বিস্তারের সব ক্ষমতা একটি দলের প্রার্থীদের হাতে থাকবে।
৫. সর্বোপরি ক্ষমতা ও মর্যাদার দিক দিয়ে সিটি কর্পোরেশন ও জাতীয় সংসদ সমান নয় বরং এ দুয়ের ব্যবধান আকাশ-পাতাল। তাই সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিরোধীদলের প্রার্থীদের জয়ের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি ভুল প্রমাণ হয়নি বরং এ দাবি আরো যুক্তিগ্রাহ্য হয়ে উঠেছে। কারণ, বর্তমান বিএনপি নেতৃত্বাধীন আঠার দল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে এমন পর্যায়ে নিয়ে গেছেন যে, আঠার দল ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার আন্দোলন এখন একাকার হয়ে গেছে। আঠার দল ও তাদের প্রার্থীকে সমর্থন করার অর্থই হলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিকে সমর্থন করা। তাই বিগত নির্বাচনগুলোর মাধ্যমে জনগণের ম্যান্ডেট এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার দাবির পক্ষে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন