আজ থেকে আর ১২ দিন পর ১২ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদের অধিবেশন বসছে। সম্ভবত এটিই হতে যাচ্ছে জাতীয় সংসদের শেষ অধিবেশন। এই অধিবেশনে যদি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের বিল পাস না হয় তাহলে বিরোধী দলের দাবি মানার আর কোন সুযোগ থাকবে না। কারণ সম্ভবত এটিই চলতি জাতীয় সংসদের শেষ অধিবেশন। এই অধিবেশন কতদিন চলবে সেটি এখনও কেউ জানে না। দিন তারিখ হিসাব করে বলা হচ্ছে যে, এই সংবিধানের মেয়াদ শেষ হবে ২৭শে জানুয়ারি ২০১৪। যদি অন্য কিছু না ঘটে তাহলে ঐ দিন পর্যন্ত সরকার ক্ষমতায় থাকতে পারবে। তবে সংবিধান মোতাবেক সরকারকে ২৭শে জানুয়ারির পূর্ববর্তী ৩ মাস বা ৯০ দিনের মধ্যে সংসদ নির্বাচন বা জাতীয় নির্বাচন করতে হবে। সেই হিসাবে ২৭শে জানুয়ারির পূর্ববর্তী ৯০ দিন শুরু হয় ৩০ অক্টোবর থেকে। নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে গেলে তফসিল ঘোষণা করতে হয়। নির্বাচন অনুষ্ঠানের কতোদিন আগে তফসিল ঘোষণা করা হবে তার কোন ধরা-বাধা নিয়ম নেই। তবে প্র্যাকটিস বা রীতি অনুযায়ী নির্বাচন অনুষ্ঠানের দেড় মাস আগে তফসিল ঘোষণা করা হয়। নমিনেশন পত্র জমা দেয়া, সেগুলো যাচাই-বাছাই করা, প্রত্যাহার করা এবং কোন কোন নমিনেশন পেপার যাচাই-বাছাইয়ে টিকে গেল এগুলো করতে যদি ১৫ দিন সময়ও দেয়া হয় তাহলে নির্বাচনী প্রচারণার জন্য দেয়া হয় ১ মাস। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, ২৬শে জানুয়ারী নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে হলেও ১২ই ডিসেম্বরের মধ্যে তফসিল ঘোষণা করতে হবে। সুতরাং এটি এখন স্পষ্ট হয়ে যায় যে ১২ই ডিসেম্বর থেকে বর্তমান জাতীয় সংসদের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হওয়ার আর কোন সুযোগ নাই। জাতীয় সংসদের আসন্ন অধিবেশন যদি ১ মাসও চলে তাহলেও পরবর্তী ১ মাসের মধ্যে আরেকটি অধিবেশন ডাকা এবং গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পাদন করার সময়-সুযোগ কমই দেখা যায়। সেজন্যই বলছিলাম যে, আগামী ১২ই সেপ্টেম্বর থেকে জাতীয় সংসদের যে অধিবেশন বসছে সেটি সম্ভবত এই জাতীয় সংসদের শেষ অধিবেশন। অবশ্য জরুরি কার্য সম্পাদনের জন্য সরকার ইচ্ছা করলে তফসিল ঘোষণার ২-১ সপ্তাহ আগেও কয়েকদিনের জন্য অধিবেশন ডাকতে পারে। কিন্তু সে রকম কোন ইচ্ছা সরকারের আছে বলে মনে হচ্ছে না।
এতোক্ষণ ধরে ওপরে যে আলোচনা হলো সেটি করা হলো নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের বিল পাস করাকে পটভূমিতে রেখে। কারণ এই সংসদে যদি নির্দলীয় সরকারের বিল পাস না হয় তাহলে তো আর সেটি পাস হওয়ার সময় থাকছে না। এর অর্থ হলো এই যে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী অনুযায়ী হবে। পঞ্চদশ সংশোধনীতে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করা হয়েছে। নতুন ব্যবস্থা অনুযায়ী আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে এবং সেই সরকারের প্রধান থাকবেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। এখন প্রশ্ন হলো, বিরোধী দল কি সেই নির্বাচনে যাবে? তারাও তো দাবি করে আসছেন যে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে যদি নির্বাচন না হয়, যদি আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনেই নির্বাচন হয়, তাহলে সে নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে না এবং এই নির্বাচন প্রতিহত করবে তারা। ওপরে যে আলোচনা করলাম সে আলোচনা থেকে দেখা যায় যে, পঞ্চদশ সংশোধনীকে বহাল রেখে যে নির্বাচন হবে সেই নির্বাচন শুধু বিএনপিই যে বয়কট করবে তাই নয়, তার সাথে বয়কট করবে তার ১৮ দলীয় জোট। এখন এরশাদও বলছেন যে, যদি নিরপেক্ষ সরকার দেয়া না হয় এবং যদি বিএনপিও ইলেকশনে না যায় তাহলে তার জাতীয় পার্টিও এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না। এরশাদও যদি ইলেকশন বয়কট করেন (অবশ্য হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের কোন কথা বিশ্বাস করা যায় না। তিনি আজ যেটা বলেন আগামীকাল সে বক্তব্য থেকে সরে যান) তারপরেও, পরিস্থিতি যেরূপ নিচ্ছে তার ফলে সেটি হবে একটি বিরাট ঘটনা। ইতোমধ্যে দেখা যাচ্ছে যে গণ ফোরামের ড. কামাল হোসেন, জাসদের আ স ম আব্দুর রব, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের কাদের সিদ্দিকী এবং নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না সরকারের তীব্র সমালোচনা করছেন। সোজা কথা, রাশেদ খান মেনন এবং হাসানুল হক ইনু ছাড়া এই সরকারের সাথে আর কেউ নাই। ড. বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বিকল্প ধারাও ১৮ দলীয় জোটের সাথে হাত মিলিয়েছে। এরা সকলেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার চান। এদের সকলের দাবি অস্বীকার করে কি শেখ হাসিনা নির্বাচন করবেন? যদি করেন তাহলে সেটি হবে গায়ের জোরে নির্বাচন। আর গায়ের জোরে নির্বাচন করলে সেটি কতোদিন টেকসই হবে সেটিও চিন্তার বিষয়।
॥দুই॥
দেশে এমন একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক যেখানে ছোট-বড় নির্বিশেষে সকল দল অংশগ্রহণ করতে পারে। দাবি আকারে সরকারের কাছে উপস্থাপন না করলেও এটি যে তাদের ডিজায়ার, অর্থাৎ তারা যেটা চান, সেই ইচ্ছা সরকারকে জানিয়ে দিয়েছে সবগুলো বিদেশী রাষ্ট্র। ইতোমধ্যেই মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনা, চীনা রাষ্ট্রদূত লী জোন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সমস্ত রাষ্ট্রদূত এবং জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন অনুরূপ ইচ্ছা পোষণ করেছেন। দেশের ৯০ শতাংশ মানুষ নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন চাচ্ছে। বিএনপি এবং ১৮ দলীয় জোটকে বাদ দিয়ে নির্বাচন হোক সেটিও জনগণ চায় না। বিশ্ব জনমতও সেই একই কথার প্রতিধ্বনি করছে পরোক্ষভাবে। এদের সকলকে অস্বীকার করে কি শেখ হাসিনা একতরফা নির্বাচনে এগিয়ে যাবেন? কয়েক দিন আগে অনুষ্ঠিত একটি জরুরী সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা করেছেন যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে তিনি সংবিধান থেকে এক চুলও নড়বেন না। তার মন্ত্রী সান্ত্রী সকলেই সংবিধানের দোহাই দিচ্ছেন। ২০০৬ সালে বিএনপি’র নেতৃত্বাধীন ৪ দলীয় জোট যখন ক্ষমতায় ছিলো তখন ঐ সরকারও বলতো যে সংবিধান মোতাবেক নির্বাচন হবে। তখন কিন্তু সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ছিলো না। সংবিধানে এটাও ছিলো যে, সবচেয়ে পরে সুপ্রীম কোর্টের যে প্রধান বিচারপতি অবসরে গেছেন তিনিই হবেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা। কিন্তু আওয়ামী লীগ এবং শেখ হাসিনা সদ্য অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি কে এম হাসানের অধীনে নির্বাচন করবেন না বলে দাবি তোলেন। তখন বিএনপি এবং ৪ দলীয় জোট বলে যে, সংবিধান মোতাবেক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আর সংবিধান মোতাবেক নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে হলে বিচারপতি কে এম হাসানকেই প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দিতে হবে। তখন বিএনপি সংবিধানের কথা বললে আওয়ামী লীগ এবং আওয়ামী ঘরানার বুদ্ধিজীবী, উকিল, মোক্তার, ব্যারিস্টার, অধ্যাপক, শিল্পী-সাহিত্যিকসহ সকলেই সমস্বরে বলে ওঠেন যে, সংবিধান মানুষের জন্য, সংবিধানের জন্য মানুষ নয়। তাদের মতে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যখন কে এম হাসানকে চাচ্ছে না তখন সংবিধান পরিবর্তন করতে আপত্তি কেন? তারা এটাও বলতেন যে সংবিধান কোন বেদ বাক্য নয় বা কোন ধর্মগ্রন্থও নয়। যেহেতু মানুষের প্রয়োজনে সংবিধান তাই মানুষের প্রয়োজনেই সেটিকে সংশোধন করতে হবে।
সেদিন যে কথা বিএনপি তথা ৪ দলীয় জোটের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিলো, আজ সেই একই কথা আওয়ামী সরকারের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না কেন? মাত্র একজন মানুষের জন্য যদি সংবিধান পরিবর্তন করা যায় তাহলে দেশের ৯০ শতাংশ মানুষের জন্য সংবিধান পরিবর্তন করা যাবে না কেন? খুব বেশি দিন আগের কথা নয়। সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতি সাহাবুদ্দীনকে অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য তৎকালীন বিরোধীদল সমূহ অনুরোধ করে। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য সম্পূর্ণ অনিচ্ছুক ছিলেন। তিনি প্রধান বিচারপতিই থাকতে চান। তখন তাকে আশ্বাস দেয়া হয় যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পর তাকে প্রধান বিচারপতির পদে ফেরত আনা হবে। সংবিধানে ফেরত আনার মতো কোন অনুচ্ছেদ ছিলো না। বিচারপতি সাহাবুদ্দীনকে অস্থায়ী প্রেসিডেন্টের পদ থেকে প্রধান বিচারপতির পদে ফেরত আনার জন্য সংবিধান সংশোধন করা হয়। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে মাত্র এক ব্যক্তির ইচ্ছা পূরণের জন্য সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে। তাহলে দেশের ৯০ শতাংশ মানুষের ইচ্ছা পূরণের জন্য সংবিধান সংশোধন করা হবে না কেন?
॥তিন॥
প্রধানমন্ত্রী মুখে যতোই বলুন না কেন যে সংবিধান থেকে এক চুলও নড়বেন না, এবং তার অধীনে আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, বা¯বে ক্ষেত্রে কিন্তু এই সরকার অনেক নার্ভাস হয়ে পড়েছে এবং গোপনে বিকল্প খুঁজছে। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবর মোতাবেক, একটি বিকল্প ব্যবস্থা বের করার জন্য আওয়ামী ঘরানার কয়েকটি মাথাকে একত্রিত করা হয়। এরা সম্প্রতি এক বৈঠকে মিলিত হন। আইন মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত ঐ বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ, আইন কমিশনের নবনিযুক্ত প্রধান সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক, এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম এবং প্রধানমন্ত্রীর প্রভাবশালী দুইজন উপদেষ্টা। বৈঠকে সংবিধানের বিভিন্ন অনুচ্ছেদ পর্যালোচনার পর এটি বেরিয়ে আসে যে, সংবিধান সংশোধন না করে সংসদ ভেঙে দিয়েও সদ্য বাতিল কৃত সংসদ সদস্যদেরকে নিয়ে একটি সরকার গঠন করা যায় এবং নির্বাচনের মাধ্যমে পরবর্তী সরকার গঠিত না হওয়া পর্যন্ত ঐ সরকার ক্ষমতায় থাকতে পারে। এই ব্যবস্থা রয়েছে সংবিধানের ৫৬ অনুচ্ছেদের ৪ উপ-অনুচ্ছেদে। এই উপ-অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “সংসদ ভাঙ্গিয়া যাওয়া এবং সংসদ-সদস্যদের অব্যবহিত পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্যবর্তীকালে এই অনুচ্ছেদের (২) বা (৩) দফার অধীন নিয়োগ দানের প্রয়োজন দেখা দিলে সংসদ ভাঙ্গিয়া যাইবার অব্যবহিত পূর্বে যাঁহারা সংসদ-সদস্য ছিলেন, এই দফার উদ্দেশ্য সাধন কল্পে তাঁহারা সদস্য রূপে বহাল রহিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবেন।”
এই ধারা প্রয়োগ করে সংবিধানে কোন সংশোধনী না এনেও আওয়ামী লীগ একটি নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করতে পারে। কিন্তু সেখানে রয়েছে অনেকগুলো প্রশ্ন। আর সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, সেই সরকারের প্রধানমন্ত্রী কে থাকবেন? যদি শেখ হাসিনাকে পুনরায় ঐ সরকারের প্রধানমন্ত্রী করা হয় তাহলে বিরোধীদল সমূহ সেই নির্বাচনে যাবে না। বিএনপি’র তরফ থেকে এ কথা বলা হয়েছে যে প্রেসিডেন্ট বা স্পীকারের নেতৃত্বেও কোন সরকার গঠিত হলে সেই সরকারের অধীনে বিরোধী দল সমূহ নির্বাচনে যাবে না। কারণ স্পীকার বা প্রেসিডেন্টও নিরপেক্ষ নন। তারাও আওয়ামী লীগের হার্ড কোর সদস্য।
এগুলো সব হলো আওয়ামী লীগের চালাকি। তারা মনে করে যে তাদের চালাকি বিরোধী দল ধরতে পারবে না। বিরোধী দল এত বেকুব নয় যে, তারা আওয়ামী লীগের চালাকির ফাঁদে ধরা দেবে। এসব কারণেই নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া বিরোধী দল নির্বাচনে যেতে পারে না। সেই সরকার গঠন করতে হলে জাতীয় সংসদের আসন্ন অধিবেশনেই বিল আনতে হবে। অন্যথায় এক ভয়াবহ সংঘর্ষে নিক্ষিপ্ত হবে আমাদের এই প্রিয় মাতৃভূমি।