শনিবার, ৩১ আগস্ট, ২০১৩

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

সংসদের এই অধিবেশনেই নির্দলীয় সরকার বিল পাস করতে হবেঃ অন্যথায় ঘন অন্ধকার


আজ থেকে আর ১২ দিন পর ১২ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদের অধিবেশন বসছে। সম্ভবত এটিই হতে যাচ্ছে জাতীয় সংসদের শেষ অধিবেশন। এই অধিবেশনে যদি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের বিল পাস না হয় তাহলে বিরোধী দলের দাবি মানার আর কোন সুযোগ থাকবে না। কারণ সম্ভবত এটিই চলতি জাতীয় সংসদের শেষ অধিবেশন। এই অধিবেশন কতদিন চলবে সেটি এখনও কেউ জানে না। দিন তারিখ হিসাব করে বলা হচ্ছে যে, এই সংবিধানের মেয়াদ শেষ হবে ২৭শে জানুয়ারি ২০১৪। যদি অন্য কিছু না ঘটে তাহলে ঐ দিন পর্যন্ত সরকার ক্ষমতায় থাকতে পারবে। তবে সংবিধান মোতাবেক সরকারকে ২৭শে জানুয়ারির পূর্ববর্তী ৩ মাস বা ৯০ দিনের মধ্যে সংসদ নির্বাচন বা জাতীয় নির্বাচন করতে হবে। সেই হিসাবে ২৭শে জানুয়ারির পূর্ববর্তী ৯০ দিন শুরু হয় ৩০ অক্টোবর থেকে। নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে গেলে তফসিল ঘোষণা করতে হয়। নির্বাচন অনুষ্ঠানের কতোদিন আগে তফসিল ঘোষণা করা হবে তার কোন ধরা-বাধা নিয়ম নেই। তবে প্র্যাকটিস বা রীতি অনুযায়ী নির্বাচন অনুষ্ঠানের দেড় মাস আগে তফসিল ঘোষণা করা হয়। নমিনেশন পত্র জমা দেয়া, সেগুলো যাচাই-বাছাই করা, প্রত্যাহার করা এবং কোন কোন নমিনেশন পেপার যাচাই-বাছাইয়ে টিকে গেল এগুলো করতে যদি ১৫ দিন সময়ও দেয়া হয় তাহলে নির্বাচনী প্রচারণার জন্য দেয়া হয় ১ মাস। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, ২৬শে জানুয়ারী নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে হলেও ১২ই ডিসেম্বরের মধ্যে তফসিল ঘোষণা করতে হবে। সুতরাং এটি এখন স্পষ্ট হয়ে যায় যে ১২ই ডিসেম্বর থেকে বর্তমান জাতীয় সংসদের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হওয়ার আর কোন সুযোগ নাই। জাতীয় সংসদের আসন্ন অধিবেশন যদি ১ মাসও চলে তাহলেও পরবর্তী ১ মাসের মধ্যে আরেকটি অধিবেশন ডাকা এবং গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পাদন করার সময়-সুযোগ কমই দেখা যায়। সেজন্যই বলছিলাম যে, আগামী ১২ই সেপ্টেম্বর থেকে জাতীয় সংসদের যে অধিবেশন বসছে সেটি সম্ভবত এই জাতীয় সংসদের শেষ অধিবেশন। অবশ্য জরুরি কার্য সম্পাদনের জন্য সরকার ইচ্ছা করলে তফসিল ঘোষণার ২-১ সপ্তাহ আগেও কয়েকদিনের জন্য অধিবেশন ডাকতে পারে। কিন্তু সে রকম কোন ইচ্ছা সরকারের আছে বলে মনে হচ্ছে না।
এতোক্ষণ ধরে ওপরে যে আলোচনা হলো সেটি করা হলো নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের বিল পাস করাকে পটভূমিতে রেখে। কারণ এই সংসদে যদি নির্দলীয় সরকারের বিল পাস না হয় তাহলে তো আর সেটি পাস হওয়ার সময় থাকছে না। এর অর্থ হলো এই যে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী অনুযায়ী হবে। পঞ্চদশ সংশোধনীতে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করা হয়েছে। নতুন ব্যবস্থা অনুযায়ী আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে এবং সেই সরকারের প্রধান থাকবেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। এখন প্রশ্ন হলো, বিরোধী দল কি সেই নির্বাচনে যাবে? তারাও তো দাবি করে আসছেন যে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে যদি নির্বাচন না হয়, যদি আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনেই নির্বাচন হয়, তাহলে সে নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে না এবং এই নির্বাচন প্রতিহত করবে তারা। ওপরে যে আলোচনা করলাম সে আলোচনা থেকে দেখা যায় যে, পঞ্চদশ সংশোধনীকে বহাল রেখে যে নির্বাচন হবে সেই নির্বাচন শুধু বিএনপিই যে বয়কট করবে তাই নয়, তার সাথে বয়কট করবে তার ১৮ দলীয় জোট। এখন এরশাদও বলছেন যে, যদি নিরপেক্ষ সরকার দেয়া না হয় এবং যদি বিএনপিও ইলেকশনে না যায় তাহলে তার জাতীয় পার্টিও এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না। এরশাদও যদি ইলেকশন বয়কট করেন (অবশ্য হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের কোন কথা বিশ্বাস করা যায় না। তিনি আজ যেটা বলেন আগামীকাল সে বক্তব্য থেকে সরে যান) তারপরেও, পরিস্থিতি যেরূপ নিচ্ছে তার ফলে সেটি হবে একটি বিরাট ঘটনা। ইতোমধ্যে দেখা যাচ্ছে যে গণ ফোরামের ড. কামাল হোসেন, জাসদের আ স ম আব্দুর রব, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের কাদের সিদ্দিকী এবং নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না সরকারের তীব্র সমালোচনা করছেন। সোজা কথা, রাশেদ খান মেনন এবং হাসানুল হক ইনু ছাড়া এই সরকারের সাথে আর কেউ নাই। ড. বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বিকল্প ধারাও ১৮ দলীয় জোটের সাথে হাত মিলিয়েছে। এরা সকলেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার চান। এদের সকলের দাবি অস্বীকার করে কি শেখ হাসিনা নির্বাচন করবেন? যদি করেন তাহলে সেটি হবে গায়ের জোরে নির্বাচন। আর গায়ের জোরে নির্বাচন করলে সেটি কতোদিন টেকসই হবে সেটিও চিন্তার বিষয়।
॥দুই॥
দেশে এমন একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক যেখানে ছোট-বড় নির্বিশেষে সকল দল অংশগ্রহণ করতে পারে। দাবি আকারে সরকারের কাছে উপস্থাপন না করলেও এটি যে তাদের ডিজায়ার, অর্থাৎ তারা যেটা চান, সেই ইচ্ছা সরকারকে জানিয়ে দিয়েছে সবগুলো বিদেশী রাষ্ট্র। ইতোমধ্যেই মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনা, চীনা রাষ্ট্রদূত লী জোন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সমস্ত রাষ্ট্রদূত এবং জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন অনুরূপ ইচ্ছা পোষণ করেছেন। দেশের ৯০ শতাংশ মানুষ নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন চাচ্ছে। বিএনপি এবং ১৮ দলীয় জোটকে বাদ দিয়ে নির্বাচন হোক সেটিও জনগণ চায় না। বিশ্ব জনমতও সেই একই কথার প্রতিধ্বনি করছে পরোক্ষভাবে। এদের সকলকে অস্বীকার করে কি শেখ হাসিনা একতরফা নির্বাচনে এগিয়ে যাবেন? কয়েক দিন আগে অনুষ্ঠিত একটি জরুরী সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা করেছেন যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে তিনি সংবিধান থেকে এক চুলও নড়বেন না। তার মন্ত্রী সান্ত্রী সকলেই সংবিধানের দোহাই দিচ্ছেন। ২০০৬ সালে বিএনপি’র নেতৃত্বাধীন ৪ দলীয় জোট যখন ক্ষমতায় ছিলো তখন ঐ সরকারও বলতো যে সংবিধান মোতাবেক নির্বাচন হবে। তখন কিন্তু সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ছিলো না। সংবিধানে এটাও ছিলো যে, সবচেয়ে পরে সুপ্রীম কোর্টের যে প্রধান বিচারপতি অবসরে গেছেন তিনিই হবেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা। কিন্তু আওয়ামী লীগ এবং শেখ হাসিনা সদ্য অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি কে এম হাসানের অধীনে নির্বাচন করবেন না বলে দাবি তোলেন। তখন বিএনপি এবং ৪ দলীয় জোট বলে যে, সংবিধান মোতাবেক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আর সংবিধান মোতাবেক নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে হলে বিচারপতি কে এম হাসানকেই প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দিতে হবে। তখন বিএনপি সংবিধানের কথা বললে আওয়ামী লীগ এবং আওয়ামী ঘরানার বুদ্ধিজীবী, উকিল, মোক্তার, ব্যারিস্টার, অধ্যাপক, শিল্পী-সাহিত্যিকসহ সকলেই সমস্বরে বলে ওঠেন যে, সংবিধান মানুষের জন্য, সংবিধানের জন্য মানুষ নয়। তাদের মতে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যখন কে এম হাসানকে চাচ্ছে না তখন সংবিধান পরিবর্তন করতে আপত্তি কেন? তারা এটাও বলতেন যে সংবিধান কোন বেদ বাক্য নয় বা কোন ধর্মগ্রন্থও নয়। যেহেতু মানুষের প্রয়োজনে সংবিধান তাই মানুষের প্রয়োজনেই সেটিকে সংশোধন করতে হবে।
সেদিন যে কথা বিএনপি তথা ৪ দলীয় জোটের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিলো, আজ সেই একই কথা আওয়ামী সরকারের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না কেন? মাত্র একজন মানুষের জন্য যদি সংবিধান পরিবর্তন করা যায় তাহলে দেশের ৯০ শতাংশ মানুষের জন্য সংবিধান পরিবর্তন করা যাবে না কেন? খুব বেশি দিন আগের কথা নয়। সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতি সাহাবুদ্দীনকে অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য তৎকালীন বিরোধীদল সমূহ অনুরোধ করে। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য সম্পূর্ণ অনিচ্ছুক ছিলেন। তিনি প্রধান বিচারপতিই থাকতে চান। তখন তাকে আশ্বাস দেয়া হয় যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পর তাকে প্রধান বিচারপতির পদে ফেরত আনা হবে। সংবিধানে ফেরত আনার মতো কোন অনুচ্ছেদ ছিলো না। বিচারপতি সাহাবুদ্দীনকে অস্থায়ী প্রেসিডেন্টের পদ থেকে প্রধান বিচারপতির পদে ফেরত আনার জন্য সংবিধান সংশোধন করা হয়। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে মাত্র এক ব্যক্তির ইচ্ছা পূরণের জন্য সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে। তাহলে দেশের ৯০ শতাংশ মানুষের ইচ্ছা পূরণের জন্য সংবিধান সংশোধন করা হবে না কেন?
॥তিন॥
প্রধানমন্ত্রী মুখে যতোই বলুন না কেন যে সংবিধান থেকে এক চুলও নড়বেন না, এবং তার অধীনে আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, বা¯বে ক্ষেত্রে কিন্তু এই সরকার অনেক নার্ভাস হয়ে পড়েছে এবং গোপনে বিকল্প খুঁজছে। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবর মোতাবেক, একটি বিকল্প ব্যবস্থা বের করার জন্য আওয়ামী ঘরানার কয়েকটি মাথাকে একত্রিত করা হয়। এরা সম্প্রতি এক বৈঠকে মিলিত হন। আইন মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত ঐ বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ, আইন কমিশনের নবনিযুক্ত প্রধান সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক, এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম এবং প্রধানমন্ত্রীর প্রভাবশালী দুইজন উপদেষ্টা। বৈঠকে সংবিধানের বিভিন্ন অনুচ্ছেদ পর্যালোচনার পর এটি বেরিয়ে আসে যে, সংবিধান সংশোধন না করে সংসদ ভেঙে দিয়েও সদ্য বাতিল কৃত সংসদ সদস্যদেরকে নিয়ে একটি সরকার গঠন করা যায় এবং নির্বাচনের মাধ্যমে পরবর্তী সরকার গঠিত না হওয়া পর্যন্ত ঐ সরকার ক্ষমতায় থাকতে পারে। এই ব্যবস্থা রয়েছে সংবিধানের ৫৬ অনুচ্ছেদের ৪ উপ-অনুচ্ছেদে। এই উপ-অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “সংসদ ভাঙ্গিয়া যাওয়া এবং সংসদ-সদস্যদের অব্যবহিত পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্যবর্তীকালে এই অনুচ্ছেদের (২) বা (৩) দফার অধীন নিয়োগ দানের প্রয়োজন দেখা দিলে সংসদ ভাঙ্গিয়া যাইবার অব্যবহিত পূর্বে যাঁহারা সংসদ-সদস্য ছিলেন, এই দফার উদ্দেশ্য সাধন কল্পে তাঁহারা সদস্য রূপে বহাল রহিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবেন।”
এই ধারা প্রয়োগ করে সংবিধানে কোন সংশোধনী না এনেও আওয়ামী লীগ একটি নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করতে পারে। কিন্তু সেখানে রয়েছে অনেকগুলো প্রশ্ন। আর সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, সেই সরকারের প্রধানমন্ত্রী কে থাকবেন? যদি শেখ হাসিনাকে পুনরায় ঐ সরকারের প্রধানমন্ত্রী করা হয় তাহলে বিরোধীদল সমূহ সেই নির্বাচনে যাবে না। বিএনপি’র তরফ থেকে এ কথা বলা হয়েছে যে প্রেসিডেন্ট বা স্পীকারের নেতৃত্বেও কোন সরকার গঠিত হলে সেই সরকারের অধীনে বিরোধী দল সমূহ নির্বাচনে যাবে না। কারণ স্পীকার বা প্রেসিডেন্টও নিরপেক্ষ নন। তারাও আওয়ামী লীগের হার্ড কোর সদস্য।
এগুলো সব হলো আওয়ামী লীগের চালাকি। তারা মনে করে যে তাদের চালাকি বিরোধী দল ধরতে পারবে না। বিরোধী দল এত বেকুব নয় যে, তারা আওয়ামী লীগের চালাকির ফাঁদে ধরা দেবে। এসব কারণেই নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া বিরোধী দল নির্বাচনে যেতে পারে না। সেই সরকার গঠন করতে হলে জাতীয় সংসদের আসন্ন অধিবেশনেই বিল আনতে হবে। অন্যথায় এক ভয়াবহ সংঘর্ষে নিক্ষিপ্ত হবে আমাদের এই প্রিয় মাতৃভূমি।
0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

ব্যতিক্রমী রাজনীতি, নেতৃত্ব এবং জনসম্পৃক্ততা

 বাংলাদেশের রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় সংসদীয় গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থা চালুর মাধ্যমে। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ইতিহাস দীর্ঘ দিনের। কিন্তু এটি সঠিক পথে দেশ পরিচালনা করতে সক্ষম হয়নি। বাস্তবে দলটির কার্যকলাপ নেতানেত্রীরা শুধু মুখে বলেই থাকেন। যেসব গুণ একটি দলের জনপ্রিয়তা বাড়াতে পারে সেগুলোর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উপাদান হলো গণতন্ত্র। কিন্তু দলটি ১৯৭৫ সালে গণতন্ত্রের গলা টিপে হত্যা করে প্রতিষ্ঠা করে বাকশাল। নেতাকর্মীরা লোভ-লালসা পরিহার করে ব্যক্তিস্বার্থ, দলীয় স্বার্থ ও পারিবারিক স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠতে পারেননি। দলটি ১৯৭৪ সালে জনপ্রিয়তা হারায়। এমনকি এক বিভীষিকা, অরাজকতা ও বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি হয় দেশজুড়ে। দক্ষ প্রশাসনের অভাবে শিল্পকারখানাগুলো প্রচুর লোকসানের সম্মুখীন হয়। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর এর প্রভাব পড়ে। অর্থনৈতিক স্থবিরতা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি এবং সর্বোপরি ক্ষমতাসীন দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসে সংবিধান পরিবর্তন করে সংসদীয় গণতন্ত্র পরিত্যাগ করে একদলীয় রাষ্ট্রপতি শাসনব্যবস্থা কায়েম করা হয়। ফলে দলটি প্রায় বন্ধুহীন হয়ে পড়ে। এমনই একটি শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে ১৯৭৫ সালের নভেম্বর মাসে দেশপ্রেমিক সিপাহি জনতা তৎকালীন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে জাতীয় বৃহত্তর স্বার্থে ক্ষমতায় নিয়ে আসে। সেদিন তিনি যদি সিপাহি জনতার ডাকে সাড়া না দিতেন তাহলে দেশ গৃহযুদ্ধের দিকে ধাবিত হতো। ক্ষমতা গ্রহণের পর তিনি ঘোষণা করেন, জনগণের ক্ষমতা জনগণকে ফিরিয়ে দেয়া হবে। জিয়াউর রহমান জানতেন, সামরিক শাসন কোনো স্থায়ী ব্যবস্থা নয়। জনগণ এ ব্যবস্থা দীর্ঘ দিন মেনে নেবে না। তিনি এক ঐতিহাসিক ঘোষণার মাধ্যমে একদলীয় বাকশাল পদ্ধতি বাতিল করে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। প্রশাসন বেসামরিকীকরণ করার প্রক্রিয়ার একপর্যায়ে জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) প্রতিষ্ঠা করেন। তারই সুদৃঢ় নেতৃত্বে ১৯ দফা কর্মসূচি নিয়ে দল যাত্রা শুরু করে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন, যুদ্ধ করেছেন। তিনি স্বাধীনতার মহান ঘোষক। তিনি গ্রামগঞ্জে, দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় ভ্রমণ করেছেন। খাল কেটেছেন, জনগণের সাথে একাত্ম হয়ে তাদের সুখ-দুঃখের সাথে মিশে গেছেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, এ দেশের সাধারণ মানুষ চায় সহজ সরল, সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব একমাত্র বেঁচে থাকার তাগিদে। দেশকে উপনিবেশবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, সম্প্রসারণবাদ ও আধিপত্যবাদ থেকে রক্ষায় তিনি ছিলেন সচেষ্টÑ শহীদ জিয়ার নেতৃত্বে ও ব্যক্তিত্বে ছিল সততা ও সত্যবাদিতা। ক্ষমাশীলতা ও সমঝোতার রাজনীতিই ছিল জিয়ার রাজনৈতিক দর্শন। উৎপাদন ও উন্নয়নই তার রাজনৈতিক লক্ষ্য। ১৯৭৫ সালে আওয়ামী আমলে বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ির খেতাব দেয়া হয়। রাষ্ট্রপতি জিয়া সেই বদনাম ঘুচাতে সক্ষম হয়েছিলেন। দেশে প্রতিষ্ঠিত হয় অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার। বিএনপির সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্মসূচি সমাজের রাজনৈতিক সচেতন লোকদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া জাগায়। ব্যক্তিগত বিনিয়োগ উৎসাহিত করার কারণে জিয়াউর রহমান শিল্পোদ্যোক্তাদের মধ্যে সমাদৃত হন। কৃষি উপকরণ সরবরাহের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির নীতি গ্রহণ করার কারণে কৃষকেরা বিএনপির প্রতি ব্যাপক সাড়া দেন। জিয়াউর রহমানের খাল কাটা কর্মসূচি পল্লী উন্নয়ন পরিকল্পনা, তার পল্লী এলাকায় প্রতিনিয়ত ভ্রমণের কারণে পল্লীর জনগণের মধ্যে এ ধারণা হয় যে, বিএনপি সরকার অবহেলিত পল্লী এলাকার উন্নয়নের জন্য সত্যিই আগ্রহী। এরই ফলে কৃষি ও শিল্প উৎপাদন ছিল আশাব্যঞ্জক। জাতীয় ঐক্যের ক্ষেত্রে জিয়াউর রহমানের অবদান অবিস্মরণীয়। তিনি জাতীয় ঐক্যের খাতিরে সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দিয়ে এর স্থলে সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর বিশ্বাস স্থাপন করেন। জনগণের মধ্যে ব্যাপক সমর্থন থাকা সত্ত্বেও জিয়াউর রহমান মৃত্যুর পর তৎকালীন সেনাবাহিনী প্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে ১৯৮২ সালের মার্চ মাসে ক্ষমতা দখল করেন। বিএনপির এ দুর্দিনে বেগম খালেদা জিয়া এর নেতৃত্ব গ্রহণ করেন এবং অবৈধ এরশাদ সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করার জন্য আন্দোলন গড়ে তোলেন। আওয়ামী লীগের অসহযোগিতা সত্ত্বেও বেগম খালেদা জিয়ার আপসহীন সুদৃঢ় নেতৃত্বে এরশাদ সরকারের পতন হয়। এর জন্য যে সংগঠনের ভূমিকা স্মরণ করতে হয় তা হলো রাষ্ট্রপতি জিয়ার সৃষ্টি ছাত্রদল। স্বাধীনতাকামী জনগণ জাতীয়তাবাদ ও ইসলামি মূল্যবোধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ১৯৭৫-৮১ পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি জিয়ার এবং পরবর্তী সময়ে বেগম খালেদা জিয়ার জাতীয়তাবাদ শক্তির পতাকাতলে সমবেত হয়ে স্লোগান তুলেছিল জাতীয়তাবাদী শক্তির পক্ষে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে জিয়াউর রহমান এক ব্যতিক্রমধর্মী জননন্দিত পুরুষ। বাংলা সাহিত্যে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের অভ্যুদয়কে রবীন্দ্রনাথসহ অনেকেই ধূমকেতুর সাথে তুলনা করেছেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে জিয়াউর রহমানের সাড়া জাগানো আগমনের সাথে সাহিত্যে নজরুলের উপস্থিতির আশ্চর্য মিল খুঁজে পাওয়া যায়। জীবনের গতিপথ ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হলেও তারা দুজনই ছিলেন সৈনিক। নজরুল ইসলাম ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক বাহিনীর বাঙালা পল্টনের একজন নন-কমিশন অফিসার হিসেবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। জিয়াউর রহমানও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বেঙ্গল রেজিমেন্টের একজন কোম্পানি কমান্ডার হিসেবে ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তখন বীরত্ব ও রণনৈপুণ্যের সাথে জিয়াউর রহমানের ব্যক্তিত্বের বিকাশ ও তার প্রতিভার বিচ্ছুরণ ঘটতে থাকে। তখন থেকেই রণক্ষেত্রে ও জাতীয় দুর্যোগে জিয়াউর রহমানের অবদান অনস্বীকার্য। তিনি হচ্ছেন সঙ্কট ও সন্ধিক্ষণের নেতা। রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার পর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্মসূচি বাস্তবায়নের সাথে গোটা দেশকে তিনি কর্মযোগ আন্দোলনে নামিয়েছিলেন, তার দৃষ্টান্ত সারা বিশ্বে বিরল। ক্ষমতায় থেকে এত জনপ্রিয়তা বিশ্বে খুব কম নেতাই পেয়েছেন। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে তার সাফল্য ছিল অতুলনীয়। জোট নিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলো, কমনওয়েলথ ও মুসলিম বিশ্বসহ সারা বিশ্বে অপরিসীম শ্রদ্ধা তিনি অর্জন করেছিলেন। জনগণের কাছে তার প্রভাব ছিল কিংবদন্তির মতো। দেশের জনসাধারণ তার মৃত্যুতে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন। বেগম খালেদা জিয়া তার যোগ্য উত্তরসূরি। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর দৃঢ়তার সাথে তিনি বিএনপির হাল ধরেন। তিনি তার স্বামী হত্যার প্রতিশোধ নিতে চাননি। অত্যন্ত ধৈর্যসহকারে তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদ এবং বহুদলীয় গণতন্ত্রের সহাবস্থানের মূল দর্শন প্রচারণায় নেমেছিলেন। তিনি ইতিবাচক প্রচারণাকে বিবেচনায় রেখে ৯০-এর গণ-অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে ডালভাতের আশ্বাস দেন। তিনিও সমগ্র দেশের মানুষের মণিকোঠায় বিএনপির কর্মসূচি সফলভাবে উপস্থাপন করেন এবং ৯১-এর নির্বাচনে বেগম খালেদা জিয়া ও জাতীয়তাবাদী দল বিজয়ী হয়। জাতীয়তাবাদী দলের সহনশীলতা, ধৈর্য, ভদ্রতা, মার্জিত আচরণ এ দলের জনপ্রিয়তার কারণ। চারদলীয় জোটের প্রচেষ্টায়, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে ২০০১ সালে জোটের বিপুল বিজয়ে প্রমাণিত হলো দেশের জনসাধারণ শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের দর্শন জাতীয়তাবাদী ও ইসলামি মূল্যবোধের পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ। ১৮ দলীয় জোট সেই রাজনীতিকে এগিয়ে নিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।


0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

সাংবিধানিক সরকার বনাম তত্ত্বাবধায়ক সরকার


বর্তমান সরকারের আমলে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে সাধারণ নির্বাচন বা জাতীয় সংসদের নির্বাচন আদৌ হবে কি না এ ব্যাপারে বাংলাদেশের বেশির ভাগ বুদ্ধিজীবী, লেখক, রাজনীতিবিদ ও প্রবন্ধকার কম-বেশি সংশয় প্রকাশ করেছেন। কেননা বাংলাদেশের রাজনীতির গতি-প্রকৃতি ও বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী এবং প্রধান বিরোধীদলীয় নেত্রীর ইদানীংকার কর্থাবার্তা, বক্তৃতা, বিবৃতি এই আশঙ্কাকে আরো ত্বরান্বিত করেছে। এক দিকে বিরোধী দলের নেতা তথা ১৮ দলীয় জোট তত্ত্বাবধায়ক বা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বা যে নামেই হোক একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন হতে হবে মর্মে দাবি জানাচ্ছে। অপর দিকে যারা বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার এবং দুই-তৃতীয়াংশ সংসদ সদস্যের মালিক, সেই দল যারা পঞ্চদশ সংবিধান সংশোধন করে সরকারের যে রূপরেখা তৈরি করেছেন তার ভিত্তিতে তারা আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন করতে চান। অর্থাৎ উভয় জোট বা মহাজোট যদি তাদের স্ব স্ব অবস্থানে অনড় থাকে তাহলে এ দেশের সাধারণ মানুষ যাবে কোথায়? আমাদের দেশের নামীদামি লেখক, রাজনীতিবিদ ও কলাম লিখিয়েরা তাদের লেখনীর মাধ্যমে, টকশোর মাধ্যমে সরকার ও বিরোধী দলকে বোঝাতে চেষ্টা করছেন এই দেশটা আমাদের, আমরা এই দেশের জনগণ আর জনগণের ভালো-মন্দ দেখার দায়িত্ব রাষ্ট্রের অর্থাৎ সরকারের। যদি সত্যিকার অর্থে আমরা জনগণকে ভালোবেসে থাকি, জনগণের কল্যাণে রাজনীতি হয় তাহলে কখনোই কোনো দেশপ্রেমিক সরকার বা বিরোধী দল কেউই অনড় মনোভাব পোষণ করে যার যার অবস্থানে নিশ্চুপ থাকতে পারে না। আশা করব, এ দেশের জনগণের কথা ভেবে অবশ্যই উভয় দল বা জোট একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হবে। আজকে সাংবিধানিক সরকার বনাম তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে যে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে তা অবশ্য এক দিনে তৈরি হয়নি। বর্তমান সরকারি দল ও বিরোধী দলের মধ্যে দীর্ঘ দিনের পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাসের অভাবে আজ এই অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। প্রথমেই অনুরোধ করব সরকারি দলের নেতা যিনি আজকের প্রধানমন্ত্রী, তার মনের মধ্যে যদি কোনো ইগো কাজ করে, তাহলে দেশের স্বার্থে, দেশের মানুষের স্বার্থে তিনি সেটা মন থেকে মুছে ফেলবেন। অপর দিকে বিরোধী দলের নেত্রীকেও অনুরোধ করব যদি আপনার মনের মধ্যেও কোনো ইগো কাজ করে আপনি সেটা দেশের স্বার্থে, জনগণের স্বার্থে মন থেকে মুছে ফেলবেন। উভয়ে জনগণের কল্যাণের কথা চিন্তা করে, দেশের মানুষের কথা চিন্তা করে ও রাষ্ট্রীয় স্বার্থের কথা বিবেচনা করে একে অপরকে সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে কাজ করুন, দেখুন আর কোনো সমস্যা সৃষ্টি হবে বলে মনে হয় না। বর্তমান সরকারি দল ও বিরোধী দলের সাথে কিছু মৌলিক বিষয়ে মতভেদ আছে, যা দল দুটোকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। এই মতভেদগুলো স্থায়ীভাবে সমাধান হওয়া প্রয়োজন। তাহলে দল দুটির যে মতভেদ বা বৈরিতা তা অনেকাংশে দূর হবে বলে মনে করি। তবে এই মুহূর্তে সেটা দূর করা সম্ভব নয়। কারণ দেশ একটি উত্তপ্ত কড়াইয়ের ওপর বসে আছে। সে বিষয়টি নিয়েই আগে আমাদের ভাবতে হবে। আমাদেরকে সব ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে সাংবিধানিক সরকার ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার সম্পর্কে বিতর্কে না গিয়ে কিভাবে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেয়া যায়, সে বিষয়ে চিন্তা করার জন্য মহাজোট সরকারপ্রধান ও ১৮ দলীয় জোট নেত্রীকে অনুরোধ করব। প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা সম্পর্কে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশের নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা সম্পর্কে উদাহরণ টেনেছেন। আমি এখানে সব রাষ্ট্রের নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করব না, শুধু আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের নির্বাচনকালীন অবস্থার বিষয়টি তুলে ধরার চেষ্টা করব। ভারত সর্ববৃহৎ একটি গণতান্ত্রিক দেশ। তাদের কৃষ্টি, কালচার, গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি দীর্ঘ পথপরিক্রমায় পরীক্ষিত। কিন্তু আমাদের দেশ সেই চর্চা করার সুযোগ পায়নি। কেন পায়নি সেই বিতর্কে যাবো না। তবে এটুকু বলতে পারি, গণতন্ত্রকে অর্থবহ করতে গেলে নিয়মতান্ত্রিকতা ও পরমতসহিষ্ণুতা দরকার সেটা আমাদের মধ্যে বড়ই অভাব। ভারতের সংবিধান অনুযায়ী সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র পেশ করেন। প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করার সাথে সাথে মন্ত্রিসভা ও পার্লামেন্ট ভেঙে দেয়া হয় এবং রাষ্ট্রপতির অনুরোধক্রমে নিয়মতান্ত্রিক সরকারপ্রধান হিসেবে বা রাষ্ট্রীয় রুটিনওয়ার্কগুলো সম্পন্ন করার জন্য এবং নির্বাচন সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তখন নির্বাচন কমিশন নির্বাচনসংক্রান্ত যাবতীয় দায়িত্ব পালন করেন। ভারতের নির্বাচন কমিশন অত্যন্ত শক্তিশালী। এখানে উল্লেখ্য, ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইন্দিরা গান্ধী যখন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় তখন নির্বাচন কমিশনের প্রধান ছিলেন টি এম সেশন। তার আমলে ইন্দিরা গান্ধীর দল কংগ্রেসের ভরাডুবি হয়েছিল। নির্বাচনে জিতে মোরারজি দেশাইয়ের নেতৃত্বে জনতার মোর্চা সরকার গঠন করেছিল। কাজেই আমাদের দেশেও সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করার লক্ষ্যে একটি স্বাধীন ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠন করা যায় (আলোচনার মাধ্যমে) তাহলে বাংলাদেশেও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব। তবে পঞ্চদশ সংবিধান সংশোধন করে নির্বাচন করার যে রূপরেখা প্রণয়ন করা হয়েছে তা বহাল রেখে শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠন বা নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। তাই একটি স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সদিচ্ছা বর্তমান সরকারকেই দেখাতে হবে এবং বর্তমান পঞ্চদশ সংবিধান সংশোধন করে একটি শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠন ও একটি নির্বাচনকালীন নিয়মতান্ত্রিক সরকারের রূপরেখা রেখে সংবিধান সংশোধন অবশ্যই প্রয়োজন। প্রধানমন্ত্রী যদি দেশে সঙ্ঘাত-সংঘর্ষ এড়াতে চান তাহলে তিনি যে অপশক্তির কথা বলছেন তা পরিহার করার জন্য হলেও দেশে একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে, সেই ব্যাপারে তিনি দ্রুত ব্যবস্থা নেবেন, এটাই দেশবাসীর প্রত্যাশা। সময় খুব তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাচ্ছে। যা করার চলতি অধিবেশনেই পদক্ষেপ নিতে হবে সংসদের। তা না হলে আশঙ্কা যদি সত্যে পরিণত হয় তাহলে কেউ রক্ষা পাবে না। 


0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

স্বাধীনতার ভাবনা, একটি সাক্ষাৎকার ও কিছু কথা


বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য যৌবনে বছরের পর বছর নানাভাবে কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করেছেন। তিনি কেন শেষ পর্যন্ত সেই পাকিস্তান রাষ্ট্রকাঠামোর প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ালেন, এর দীর্ঘ পটভূমি সম্পর্কে অনেক আলোচনা হয়েছে। তবে ঠিক, কখন থেকে তার মনে আলাদা দেশ গঠনের আকাক্সা ও প্রচেষ্টা প্রকাশ্য রূপ নিয়েছিল, সে বিষয়ে একেবারে সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না। ওয়াকিবহাল ব্যক্তিদের অভিমত, ১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুব খানের সামরিক শাসন শুরু হওয়ার পর মুজিবের এই বিশ্বাস দৃঢ় হতে থাকে যে, পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসকগোষ্ঠীর আধিপত্য মেনে আর একত্রে থাকা সম্ভব নয়। একপর্যায়ে তিনি সশস্ত্র আন্দোলন, এমনকি ভারতের সাহায্য কামনার কথাও ভাবতে থাকেন। এ প্রসঙ্গে, ১৯৬২ সালের দিকে শেখ মুজিব গোপনে ত্রিপুরার আগরতলায় গিয়ে বরং আটক হয়েছিলেন বলেও কেউ কেউ দাবি করেছেন। ভারত তখনো তাকে বিশ্বাস করতে না পারাই নাকি এর কারণ। সেখানে তিক্ত অভিজ্ঞতা অর্জন করে মুজিব ফিরে এসে প্রকাশ্য ও নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনকে প্রাধান্য দিয়ে সংগ্রাম চালিয়ে যান। তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার হলো, প্রায় একই সময়ে (৬২ সালে) স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে একটি নিউকিয়াসগঠিত হয় এবং তখন থেকে পরিকল্পিতভাবে এর কাজ আগাতে থাকে। এ বিষয়ে একটি তথ্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা যায়। তা জানিয়েছেন সম্প্রতি পরলোকগত, প্রখ্যাত আইনজ্ঞ ড. এম জহির। মৃত্যুর পরপরই গত ১২ জুলাই ইত্তেফাকে তার স্মৃতিকথা প্রকাশিত হয়েছে। শিরোনামÑ ‘যদি ফাগুন আসে গো ফিরে। ড. জহির সাবেক পূর্বপাকিস্তান হাইকোর্টের বিচারপতি এম আছিরের ছেলে। তার পৈতৃক বাড়ি ছিল পুরনো ঢাকায়। শেখ মুজিবের রাজনৈতিক গুরু সোহরাওয়ার্দীর সাথে তার বাবার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। ড. জহির লিখেছেনÑ “সোহরাওয়ার্দীর কথা কিছুটা মনে আছে। ১৯৬১ সালের দিকে বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের মেয়ের বিয়েতে এসে তিনি আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন। তখন তিনি আব্বাকে বলেছিলেন, ‘আইয়ুব ডাজ নট রিয়েলাইজ, আনলেস দেয়ার ইজ ডেমোক্রেসি পাকিস্তান উইল ব্রেক। মুজিব অ্যান্ড আদার্স ওয়ার্ক টু ব্রেক পাকিস্তান। আই অ্যাম হোল্ডিং ইট। আই ক্যান নট। ইফ দেয়ার ইজ নো ডেমোক্রেসি, পাকিস্তান উইল ব্রেক।এত দূরদর্শী ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী।এই বক্তব্য থেকে স্পষ্ট, সোহরাওয়ার্দী তখনো জানতেনÑ তার দল আওয়ামী লীগে তার স্নেহধন্য শেখ মুজিবসহ অনেকে পাকিস্তান থেকে আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছেন। গণতন্ত্র না থাকলে যে দেশটা টিকবে না, তার এই ভবিষ্যদ্বাণী মাত্র এক দশকের মধ্যেই সত্যে পরিণত হয়েছিল। মুজিবতনয়া ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছোট বোন শেখ রেহানার একটি সাক্ষাৎকার বিদেশের একটি বাংলা পত্রিকাসূত্রে ঢাকার একাধিক দৈনিক পত্রিকা এবার ছাপিয়েছে। এতে রেহানা বলেছেন, ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট তিনি ব্রাসেলসে বড় বোনের পরিবারের সাথে ছিলেন। তখন ভগ্নিপতি ড. ওয়াজেদ মিয়ার কর্মস্থল ছিল জার্মানি। সেখান থেকে তারা বেড়াতে যান বেলজিয়াম। ১৪ আগস্ট তারা ওঠেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত (কবি) সানাউল হকের বাসায়। শেখ রেহানার ভাষায়Ñ ‘আমরা প্রেসিডেন্টের মেয়ে, খাতির যতেœর কী বাহার। পরদিন পৃথিবীতে আমাদের কেউ নেই। নিঃস্ব অসহায় আমরা দুবোন তখন সানাউল হক সাহেবের কাছে বোঝা হিসেবে পরিগণিত হলাম। আমাদের সরিয়ে দিতে তিনি অস্থির হয়ে উঠলেন।... পরে শুনেছি (জার্মানিতে রাষ্ট্রদূত) হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীকেও টেলিফোন করে সানাউল হক বলেছেন, এসব ঝামেলা (অর্থাৎ হাসিনা-রেহানা) আপনি আমার ওপর চাপিয়ে দিয়েছেন, তাড়াতাড়ি এই ঝামেলা সরান।সানাউল হক (১৯২৪-৯৩) বঙ্গবন্ধু পরিষদের অন্যতম কর্মকর্তা ছিলেন পরবর্তী জীবনে। ১৯৪৫ সালে মাস্টার্স করে কিছু দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন অর্থনীতি বিভাগে। এরপর সিএসপি হয়ে ক্রমান্বয়ে সচিব পদে প্রমোশন পেয়েছিলেন। অবসর নিয়ে আইন ব্যবসায় শুরু করেন সুপ্রিম কোর্টে। ১৯৬৪ সালে বাংলা একাডেমী পুরস্কার অর্জন করেন। একই বছর পাকিস্তানের আইয়ুব খান সরকার তাকে সিতারা-ই-কায়েদে আজম খেতাবে ভূষিত করেছিল। বাংলা একাডেমীর চরিতাভিধানগ্রন্থটির পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করেছিলেন কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন। বর্তমান মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খানের সামগ্রিক তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত এই সঙ্কলন গ্রন্থে আলোচ্য সানাউল হক সম্পর্কে বলা হয়েছেÑ ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনা, অসাম্প্রদায়িক জীবনবোধ ও মুক্তবুদ্ধির ধ্যানধারণা বিকাশের ক্ষেত্রে তার অবদান উল্লেখযোগ্য।উল্লিখিত সাক্ষাৎকারে শেখ রেহানা জানানÑ পরিবারের কেউ যে বেঁচে নেই, তা জানতে পারেন তিন-চার মাস পরে। রেহানা বলেছেন, ১৫ আগস্টের অল্প পরেই মুজিব সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন জার্মানি যান। রেহানা কামাল চাচাকে অনুরোধ করেন, সংবাদ সম্মেলন করে ঢাকার ঘটনা তুলে ধরতে। কামাল অনুরোধ রাখেননি। ২৪ কী ২৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ও রেহানা ভারতে চলে আসেন। হাসিনা ১৯৮১ সালের ১৭ মে ঢাকায় ফেরা পর্যন্ত দিল্লিতেই ছিলেন। খন্দকার মোশতাক সম্পর্কে রেহানা একটি নতুন কথা বলেছেন। তা হলো, শুনেছি ১৫ আগস্টের আগের রাতে ১২টা পর্যন্ত মোশতাক ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতেই ছিলেন। শেখ রেহানার বিশ্বাস, ‘তাদের পরিকল্পিত অভিযান সম্পর্কে কেউ কিছু আঁচ করতে পারছে কি না, তা অবজার্ভ করতে তিনি ওইখানে ছিলেন।রেহানা আরো বলেন, ‘আমার দাদীর মৃত্যুর পর মোশতাকের সেই অস্বাভাবিক কান্না এখনো আমার চোখে ভাসে।... একমাত্র তিনিই তখন মাটিতে গড়াগড়ি করে কান্নাকাটি করেছেন।ভারত সরকারের বিশেষ আতিথ্যে থাকার সময় শেখ রেহানা প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে পড়ালেখা করার ইচ্ছার কথা জানিয়েছিলেন। এরপর তার ভর্তির ব্যবস্থা করে দেয়া হয় দিল্লি নেহরু ভার্সিটি, সিমলায় ও পশ্চিমবঙ্গের শান্তি নিকেতনে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ সরকার জানায়, তারা নিরাপত্তা দিতে পারবে না। ফলে রেহানা লন্ডনে আত্মীয়ের কাছে চলে যান। সেখানে মুজিব হত্যার বিচার দাবি করার প্রতিক্রিয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘কতজন যে কত বিদ্রƒপ করল।১৫ আগস্টের ট্র্যাজেডির রাজনৈতিক খলনায়ক হিসেবে খন্দকার মোশতাক আহমদকে অভিযুক্ত করে থাকে আওয়ামী লীগ। তার সাথে দলের প্রধান নেতা মুজিবের সম্পর্ক কেমন ছিল? তা এক বিচিত্র ও কৌতূহলোদ্দীপক ব্যাপার। পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি আওয়ামী লীগ থেকে একটি গ্রুপ বেরিয়ে গিয়ে বছর দুয়েক আলাদা ছিল। এতে ছিলেন খন্দকার মোশতাক, সালাম খান, হাশিমুদ্দিন প্রমুখ। অপর দিকে, তখন মূল দলের নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান। ষাটের দশকের শেষ দিকে মুজিবের নেতৃত্বে আওয়াম লীগ দৃশ্যত দেশীয় সমাজতন্ত্রর দিকে ঝুঁকে পড়ে। মুক্তিযুদ্ধের সুবাদে সত্তরের দশকে দলটি কমিউনিস্ট সোভিয়েত ইউনিয়নের খুব ঘনিষ্ঠ ছিল। তখনো মোশতাক পরিচিত ছিলেন মার্কিনঘেঁষা বা দক্ষিণপন্থী হিসেবে। মুজিবনগরে তাজউদ্দীন বনাম মোশতাক দ্বন্দ্ব সর্বজনবিদিত। যা হোক, মুজিব স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসার পর এই দুনেতাই তার ঘনিষ্ঠতা ও আস্থা অর্জনে প্রয়াসী ছিলেন স্বাভাবিকভাবেই। আওয়ামী মহলের অনেকে বলে থকেন, মোশতাক তাজউদ্দীনের বিরুদ্ধে কান ভারীকরেছিলেন নেতার। তবে শেখ মুজিব তাজউদ্দীন ও মোশতাক উভয়কেই তখনকার জাতীয় প্রয়োজনে কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন। বাংলাদেশকে তখন ইন্দো-সোভিয়েত অক্ষের ওপর অত্যধিক নির্ভরশীল থাকতে হয়েছে। এ দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন তাজউদ্দীন। অপর দিকে শেখ মুজিব প্রয়োজন বোধ করছিলেন ক্রমান্বয়ে পাশ্চাত্যের ঘনিষ্ঠ হওয়া, এমনকি চীনের সাথে যোগাযোগের। তাই মোশতাককে দূরে সরানো সম্ভব ছিল না। স্মর্তব্য, ষাটের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত বামপন্থীরা মুজিবকে মার্কিনপন্থী বলে সমালোচনা করতেন। এ দিকে চীনপন্থীরা মুজিবের রাজনীতিতে প্রতিপক্ষ হলেও চীনের প্রতি তার দুর্বলতা ও সশ্রদ্ধ মনোভাব অনেক পুরনো। ১৯৫৩ সালের বেইজিং শান্তি সম্মেলনে যোগ দিতে গিয়ে তার যে ইতিবাচক অভিজ্ঞতা হয়েছিল, এর বয়ান দিয়েছেন অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে। যা হোক, মোশতাক যখন মুজিব সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রী, তখন সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের আগ্রহেই গোপনে চীনের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। শেখ মুজিবের আত্মজীবনীতে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত ঘটনাবলির উল্লেখ রয়েছে। বইটিতে বহুলালোচিত খন্দকার মোশতাক প্রসঙ্গ এসেছে বারবার। প্রথমেই ৩২ পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু মুজিব তার উল্লেখ করেছেন শহীদ নজীর আহমদের পর ঢাকার অন্যতম ছাত্রনেতা হিসেবে। ৪৬ পৃষ্ঠায় শেখ মুজিব জানিয়েছেন, ১৯৪৬ সালে পাকিস্তান ইস্যু সামনে রেখে যে ঐতিহাসিক নির্বাচন হয়েছিল, তখন দলের নির্বাচনী অফিস ও কর্মীশিবির খোলার জন্য বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার দায়িত্বে ছিলেন মুজিব নিজে; তেমনি বৃহত্তর কুমিল্লার ভার দেয়া হয় মোশতাককে। স্মৃতিচারণে শেখ মুজিব জানিয়েছেন, ১৯৪৭ সালের মুসলিম লীগের দিল্লি কনভেনশনে তরুণ নেতা হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন তিনি এবং অন্যদের মধ্যে জহিরুদ্দিন, (টাঙ্গাইলের) শামসুল হক, খন্দকার মোশতাক, কিউ জে আজমিরী প্রমুখ। এই কনভেনশনেই মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ সোহরাওয়ার্দীকে দিয়ে লাহোর প্রস্তাবের সংশোধনী উত্থাপন করিয়েছিলেন। ফলে মুসলিম অধ্যুষিত একাধিক রাষ্ট্রের বদলে একটিমাত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে বলে স্থির হয়। শেখ মুজিবের ভাষ্যমতে, আবুল হাশিম আর সামান্য কয়েকজনছাড়া কেউ এই মৌলিক পরিবর্তনের প্রতিবাদ জানাননি। ১৯৪৯ সালে আওয়ামী (মুসলিম) লীগ প্রতিষ্ঠাকালে মুজিব ও মোশতাক উভয়েই জয়েন্ট সেক্রেটারি নিযুক্ত হন। হয়তো বয়সে সিনিয়র হওয়ার কারণে প্রথমে মোশতাকের নাম এসেছিল। মুজিব তখন কারাগারে। এটা অনস্বীকার্য যে, সংগঠক হিসেবে শেখ মুজিব খন্দকার মোশতাকের চেয়ে অনেক বেশি দক্ষ ছিলেন। অবশ্য আওয়ামী রাজনীতির একজন নেতা হিসেবে মোশতাকও কয়েকবার জেল খেটেছিলেন। মুজিব আত্মজীবনীতে বিভিন্ন ঘটনার বর্ণনায় তার দলের নেতা ও সহকর্মীদের নাম উল্লেখ করতে কার্পণ্য করেননি। তাদের অনেকের অবদানের সাথে দোষত্রুটিও তুলে ধরেছেন। ভাষা আন্দোলনে মোশতাকসহ নেতারা গ্রেফতার হওয়া এবং বৃহত্তর কুমিল্লায় মোশতাকের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সংগঠন গড়ার কথাও জানা যায় এই বই থেকে। আবার এটাও মুজিব জানিয়েছেন যে, ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে তিনি নিজে ছিলেন আওয়ামী লীগের এককভাবে নির্বাচনে অংশ নেয়ার প্রবক্তা। অপর দিকে, মোশতাকসহ দলের অনেকেই শেরে বাংলার দলসহ যুক্তফ্রন্ট করার পক্ষে ছিলেন। আলোচিত আত্মজীবনীর একটি উল্লেখযোগ্য উদ্ধৃতি হলো, ‘খন্দকার মোশতাক আহমদের মতো জেলখাটা কর্মীকেও নমিনেশন দেওয়া হয় নাই’ (পৃষ্ঠা ২৫৩)। সেখানে মুজিব দুঃখের সাথে উল্লেখ করেন, ‘যুক্তফ্রন্টের খেসারত হিসেবে ৫৪-এর ঐতিহাসিক নির্বাচনে অনেক প্রার্থীÑ যারা জেল খেটেছে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে, তাদের নমিনেশন দেওয়া যায় নাই।এ প্রসঙ্গে তিনি এম এ আজিজ (চট্টগ্রাম), খন্দকার মোশতাক (কুমিল্লা), আবদুল জব্বার খদ্দর (নোয়াখালী)Ñ এই তিনজনের নাম বলেছেন। খন্দকার মোশতাক ৬৯-৭০ সালে ছিলেন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। তার মাথায় বিশেষ ধরনের টুপি তাকে দলের নেতাদের মধ্যে এক ধরনের স্বাতন্ত্র্য দিয়েছিল। আমার মনে আছে, ১৯৭০ সালের নির্বাচনের সময় ইসলামপন্থীরাসহ আওয়ামী লীগ বিরোধী অনেকে মোশতাকের টুপিকে গান্ধী টুপির নতুন সংস্করণ বলে ব্যঙ্গ করতেন। পরে জানা যায়, মোশতাক একজন পীরজাদা। স্বাধীনতা পর মন্ত্রী থাকাকালে ফারাক্কা ও রক্ষীবাহিনীসহ কোনো কোনো ইস্যুতে মোশতাকের অসন্তোষের কথা কারো কারো লেখায় এসেছে। তবে লক্ষণীয়, ’৭৩ সালে দেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দলের যে কজন শীর্ষ নেতাকে যেকোনোভাবে বিজয়ীকরতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল, মোশতাক সেই ভাগ্যবানদের একজন। শেখ রেহানা এবারে প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে মোশতাক পরিবারের সাথে মুজিব পরিবারের অতীত ঘনিষ্ঠতা তুলে ধরেছেন। রেহানার ভাষায়Ñ ‘স্বাধীনতার আগে এই মোশতাক যখন জেলে, তখন তার অসুস্থ স্ত্রীর সব দায়দায়িত্ব নিয়েছিলেন আমার মা। তাকে সুস্থ করে তুলতে মা বিরামহীন চেষ্টা করেছেন।শেখ রেহানা এক আত্মীয়ের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, মোশতাককে বঙ্গবন্ধু ঠিকই চিনতেন। অনেক আগে একটি লেখায় পড়েছিলাম, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ শেখ মুজিব গ্রেফতার হওয়ার সময় মোশতাক চিকিৎসাধীন ছিলেন ধানমন্ডির একটি হাসপাতালে। দুই-তিন দিন পর কোনো মতে বেরিয়ে ভারতে চলে যান এবং ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে প্রবাসী সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিযুক্ত হলেন। আওয়ামী লীগের মতো একটি বিশাল সংগঠন ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের কোনো প্রতিবাদ করেনি সে সময়। দেশের কোথাও একটি মিছিল বা সমাবেশ পর্যন্ত করতে দেখা যায়নি তাদের। দলটি অভাবনীয় এ ঘটনায় দিশেহারা ও ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েছিল। এর মূলে ছিল নৈতিক দুর্বলতা। ফলে হাজার হাজার নেতাকর্মীর সংগঠনটি সাহস ও মনোবল হারিয়ে ফেলেছিল। ৭২ থেকে ৭৫ পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকাকালে এক দিকে দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও ক্ষমতার অপব্যবহার দলটির নৈতিক শক্তি শেষ করে দিয়েছিল। অপর দিকে, বিশেষ করে অগণতান্ত্রিক একদলীয় ব্যবস্থায় হয়ে পড়েছিল জনবিচ্ছিন্ন। আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকেরা বিভ্রান্ত ও হতাশ হয়ে পড়ছিলেন। কারণ একদলীয় শাসন এবং প্রায় সংবাদপত্রবিহীন দেশের সাথে তাদের পরিচয় ছিল না। বাকশালব্যবস্থার পরিণতি কী, বঙ্গবন্ধু কী পদক্ষেপ নেবেন ভবিষ্যতে এবং আবার কখন ফিরবে পরিচিত বহুদলীয় সংসদীয় সিস্টেমÑ এসব কিছু দেশবাসীর মতো আওয়ামী লীগের কর্মীদের কাছেও স্পষ্ট ছিল না। অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক সম্প্রতি এক নিবন্ধে বলেছেন, ‘দলের ভেতরে গণতান্ত্রিক শৃঙ্খলা ও রীতিনীতি এবং আত্মসমালোচনা বলে কিছুই বিকশিত হয়নি। ফলে স্বাধীন বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের রাজনীতি অতি দ্রুত ভেতর থেকে দুর্বল হয়ে পড়ল।


শুক্রবার, ৩০ আগস্ট, ২০১৩

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতিই জাতীয় ঐক্যের পথে প্রধান বাধা


যখনই জাতীয় ঐক্যের কথা ভাবি তখনই মনে পড়ে বিশ্বের প্রথম গণমানুষের রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা হজরত মুহাম্মদ সা: ও কালো আফ্রিকার নির্যাতিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার কথা। এমন একটি ব্যক্তিত্ব সমকালীন বিশ্বে জন্ম নেন। জাতীয় ঐক্যের এমন উদাহরণ সমকালে কোথাও নেই। সাদাদের কারাগারে ২৬ বছর বন্দী থেকে মুক্তি লাভের পর প্রথমে বলেছিলেন, সাদা ও কালোরা দণি আফ্রিকারই সন্তান। আজ থেকে কোনো ভেদাভেদ নেই। সবাই এক মায়ের সন্তান। যারা তার ওপর অত্যাচার করেছে তাদের নিয়েই সরকার গঠন করলেন। অপর দিকে দেড় হাজার বছর আগে এ বিশ্বজগতে প্রথম গণমানুষের রাষ্ট্র ও সরকার গঠন করেছিলেন নিপীড়িত নির্যাতিত মানুষের নেতা ও রাসূল সা: মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ। তিনিও উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন কালো-ধলো, ধনী-গরিব, আরব-আজমি, আশরাফ-আতরাফ, কৌলিন্য সব কিছুই রহিত করা হলো। সবাই এক আদমের সন্তান। একই রক্ত বইছে বনি আদমের শরীরে। সত্য একটাই মানুষ জগতে কোনো শক্তির কাছে মাথা নোয়াবে না। মানুষের একমাত্র মালিক তার স্রষ্টা। হে মানবজাতির জন্য মনোনীত একমাত্র নবী ও রাসূল সা: আপনার জন্য কোটি কোটি সালাম ও দরুদ। হজরত বেলালের বংশধর হাবশি নেতা ম্যান্ডেলা তোমাকেও হাজার সালাম। খোদার কাছে আকুল আবেদন, আমাদের প্রিয় দেশ বাংলাদেশের জন্য এমন একজন নেতা ও পিতা পাঠিয়ে দাও যে নেতা ও পিতা এ দেশটাকে সোনার দেশে পরিণত করবে। আমাদের দেশটি হচ্ছে বিপুল সম্ভাবনার দেশ। এখানকার মানুষগুলোও খুবই ভালো। বেশ কয়েক বছর আগে সিঙ্গাপুরের একটি সংস্থা জরিপ চালিয়ে বলেছে, বাংলাদেশের মানুষ সুখী। সাধারণ মানুষের তেমন কোনো বড় চাহিদা নেই। এরা কাজ চায়, আর দুই বেলা খেতে চায়। দেশের মানুষগুলো ভালো করে জানে না রাষ্ট্র কী জিনিস এবং মানুষ বা নাগরিক হিসেবে তাদের কী অধিকার। ভোট এলে দল বেঁধে ভোট দিতে যায় এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তি বা মাস্তানদের চাপে পড়ে। আর অবুঝ নিরর উম্মি মানুষগুলোই নাকি দেশের মালিক। এত বড় প্রতারণা একমাত্র তথাকথিত গণতন্ত্রেই সম্ভব। ’৪৭ সাল থেকে হিসাব করলে ৬৫ বছর পার হতে চলল এ দেশের মানুষ তাদের মৌলিক অধিকারগুলো প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। কারণ এরা জানে না তাদের অধিকার কী। অনেকেই দুই চার পাঁচ শ’ হাজার টাকায় ভোট বিক্রি করে দেয়। ওরা বলে আমরা গরিব নিরর মানুষ, নির্বাচনের পরে তো আর মতাবান, শক্তিবান নেতাদের পাবো না। তাই নগদ যা পাই সেটাই ভালো। যারা ভোট কিনে বা ভোট চুরি বা জালিয়াতি করে সংসদ সদস্য হন তারাই জনগণের কল্যাণের জন্য আইন বানান। দেশের সার্বভৌম মতার মালিক এই জনগণকেই সুযোগ পেলে সবাই পাছায় লাথি মারে। সম্প্রতি টিভিতে এক আলোচনায় সরকারদলীয় এমপি মইনউদ্দিন খান বাদল বলেছেন, ঠিক করার সময় এসে গেছে রাষ্ট্র কিভাবে চলবে। এই চলাটা ঠিক হতে পারে নির্বাচন বা সঙ্ঘাতের মাধ্যমে। তিনি জাসদ নেতা। যখন ডানপন্থী মৌলবাদী বলে কথিত বা পরিচিত দলগুলো নিষিদ্ধ ছিল তখন নবগঠিত জাসদ বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করেছে। এখন জাসদ বহু গ্রুপ বা দলে বিভক্ত। হাসানুল হক ইনু মন্ত্রী হয়েছেন। তিনি এবং তার সতীর্থরা এক সময় গণবাহিনী গঠন করে সেনাবাহিনীতে সৈনিকদের মাঝে নিজেদের আদর্শ বিতরণ করেছিলেন। এখন তিনি সংসদীয় গণতন্ত্রে ফিরে এসেছেন। সে সময়ে রী বাহিনীর হাতে বহু জাসদ কর্মী নিহত হয়েছেন। ইনু ও তার সতীর্থরাও ভারতীয় দূতাবাস আক্রমণ করেছিলেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ি আক্রমণ করতে গিয়ে তাদের অনেক কর্মী নিহত হয়েছেন। সে সময়ে যারা বঙ্গবন্ধুর সরকারের বিরোধিতা করেছিলেন, তারা প্রায় সবাই অদৃশ্য শক্তির ইঙ্গিতে এখন আওয়ামী লীগের ছায়াতলে আশ্রয় নিয়েছেন। এখন নাকি তাদের সবার রাজনীতি ও আদর্শ এক হয়ে গেছে। বরিশালের মহিউদ্দিন আওয়ামী লীগে যোগদান করেও সারা জীবন ন্যাপের মহিউদ্দিন হিসেবে পরিচিত ছিলেন। আরো অতীতে তিনি মুসলিম লীগ ছিলেন। বঙ্গবন্ধু, শাহ আজিজ, আতাউর রহমানও মুসলিম লীগার ছিলেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করেছেন, হিন্দুদের লাঠিপেটা করেছেন। এরা সবাই তখন মুসলিম জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করতেন। পরে বাঙালি জাতীয়তাবাদে দীা নিয়েছেন। মইন উদ্দিন খান বাদলসহ বেশির ভাগ গণতন্ত্রমনা সেকুলার (ধর্মহীন) মানুষগুলো চান দেশের ৯০ ভাগ মানুষ মানে মুসলমান নিজেদের ধর্মীয় অধিকার ত্যাগ করে ১০ ভাগ সংখ্যালঘুর সমান হয়ে যাক। এমনকি দামি দামি সম্পাদক, সাহিত্যিক, শিক, কবি, বুদ্ধিজীবীরাও চান বাংলাদেশ একটি ধর্মমুক্ত রাষ্ট্রে পরিণত হোক। আমি এর আগে বহুবার লিখেছি, বর্তমান আওয়ামী লীগের কাঁধে সিন্দাবাদের দৈত্যের মতো তথকথিত বামেরা চেপে বসেছে। এরা ’৭২ থেকে ’৭৫ পর্যন্ত বলেছিলেন বঙ্গবন্ধুর চামড়া দিয়ে ডুগডুগি বাজাবেন। তারাই জনগণের দেয়া বঙ্গবন্ধু টাইটেলটি ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। এরা বঙ্গবন্ধুর মাথায় একদলীয় শাসনব্যবস্থার ভূত ঢুকিয়েছিলেন। বাদল, মেনন আর ইনু-এরা এখন শেখ হাসিনার কাঁধে উঠে বসেছেন। আওয়ামী লীগ এবং শেখ হাসিনার রাজনীতিকে শেষ না করে কাঁধ থেকে নামবেন না। আর এই তথাকথিত বামদের উৎসাহ জোগাচ্ছে ভারত ও আমেরিকা। আমেরিকার কথা বললাম এ কারণে যে, বামেরা ইসলামের বিরোধিতা করে। আমেরিকাও এখন ইসলামের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। এই আমেরিকাই এক সময় বিশ্বব্যাপী বামদের শেষ করার জন্য ইসলামিস্টদের ব্যবহার করেছে। আজ আবার দিক পরিবর্তন করে ইসলামের বিরুদ্ধে বামদের ব্যবহার করছে। ভারতের কাছে আদর্শ কোনো বিষয় নয়। ভারত চায় বাংলাদেশে এমন একটি সরকার মতায় থাকুক যা দিল্লির অনুগত থাকবে এবং ইসলামকে রাষ্ট্রীয় জীবন থেকে বিদায় করে দেবে। আওয়ামী লীগ ও তার বন্ধুরা চায় ধর্মমুক্ত শিা, সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা। তারা জানেন, ধর্মের গুরুত্ব্ বাড়লে আওয়ামী লীগ বা ভারতপন্থী বা সেকুলাররা (ধর্মহীনেরা) কখনোই মতায় আসতে পারবে না। এই তো ক’দিন আগে প্রধানমন্ত্রী দেশবাসীর কাছে আবেদন জানিয়েছেন বিএনপি-জামায়াত, হেফাজত থেকে হুঁশিয়ার থাকার জন্য। এসব সংগঠন নাকি জঙ্গিবাদে বিশ্বাস করে। এসব কথা বলে তিনি ভারত, আমেরিকা ও তার দোসরদের সন্তুষ্ট করতে চান। বাদল সাহেবেরা মনে করেন, আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য কেউ মতায় থাকলে বা নির্বাচিত হলে বাংলাদেশ একটি ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্রে পরিণত হবে। এর ফলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভূলুণ্ঠিত হবে। আওয়ামী লীগ ও ওই ঘরানার সবাই মনে করেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মানে ধর্মকে ষোলআনা বাদ দিয়ে যেটুকু থাকে সেটুকু। আর এ চেতনাই হচ্ছে আমাদের দেশ, সমাজ, রাজনীতি, শিা, সংস্কৃতি ও ইতিহাসকে ইসলাম বা মুসলমান মুক্ত করা। ধর্মে বিশ্বাস না করা বা ধর্মহীন (সেকুলার) থাকা যেকোনো নাগরিকের ব্যক্তিগত অধিকার। আমাদের সংবিধান বলেনি যে, কেউ ধর্মে বিশ্বাস না করলে নাগরিক হতে পারবে না বা ভোট দিতে পারবে না। এমনকি ধর্ম না জানলে বা বিশ্বাস না করলে সচিব, বিচারপতি, সেনাপতি, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী হতে কোনো বাধা নেই। আমাদের দেশের বড় বড় নামী-দামি নাগরিকদের অনেকেই ধর্মচর্চা করেন না। রাষ্ট্রীয় ইসলাম করা হয়েছে রাজনৈতিক কারণে। সেটা এখনো বহাল আছে রাজনৈতিক কারণে। অপর দিকে সংবিধানে বিসমিল্লাহ থাকতে পারবে না। আল্লাহ পাকের সার্বভৌমত্ব স্বীকার করা হয় না। এসব হচ্ছে গোঁজামিল বা রাজনৈতিক শয়তানি। অবাক ও বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, যারা ধর্ম মানেন না বা ধর্মচর্চা করেন না তারা সে কথা রাজনীতির কারণেই বলতে চান না। কারণ ভোটারদের ৯০ শতাংশই মুসলমান এবং ধর্মচর্চা করেন। এক সময় একশ্রেণীর মুসলিম লীগার ছিলেন, যারা জনসভার সময় বলতেন, ‘মিটিংকা কাপড়া লে আও’। আর এখন একশ্রেণীর নেতা আছেন যারা নামাজের সময় হলে বলেন, আজান দেন, নামাজের সময় হয়ে গেছে। কিন্তু নিজেরা অনেক সময় নামাজ পড়তেন না। আমাদের রাজনীতিতে ডাবল স্ট্যান্ডার্ড বা এক ধরনের মোনাফেকি বহুকাল ধরে চলে আসছে। অপর দিকে যারা ধর্মহীন তারাও সময় সুযোগে কুরআন কিতাব, হাদিস ফিকাহ নিয়ে কথা বলেন। মানে অপব্যাখ্যা করেন। নামী-দামি বহু মুসলমান আছেন যারা সব যুগেই কুরআন ও ইসলামকে নিজেদের সুবিধামতো ব্যাখ্যা করেছেন। আওয়ামী লীগে বহু ধার্মিক মানুষ আছেন, যারা নিয়মিত ধর্মচর্চা করেন। তারা কিন্তু দলের ভেতর মাইনরিটি। দলের একমাত্র নীতিনির্ধারক হলেন শেখ হাসিনা। তিনি নাকি ব্যক্তিগত জীবনে খুবই ধার্মিক এবং নিয়মিত ধর্মচর্চা করেন। মাঝে মাঝে পোশাকে আশাকেও জানান দেন যে, তিনি ধার্মিক। তার দলের লোকেরাও মাঝে মাঝে জানান দেন যে, তারা নিয়মিত ধর্মচর্চা করেন। কিন্তু তারা সবাই ধর্মকে ব্যক্তিগত গোপনীয় বিষয় মনে করেন। ভারত, আমেরিকা ও তার বন্ধুরাও মনে করেন ধর্ম ব্যক্তিগত বিষয়। ঘরে বসে এর চর্চা করতে হবে। এমনকি মসজিদ-মাদরাসা, মক্তবেরও প্রয়োজন নেই। তাই আজান দেয়ার প্রয়োজন নেই। কারণ ধর্ম দেখানোর বিষয় নয়। সম্প্রতি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ম খা আলমগীর বলেছেন, ধর্ম নিয়ে ব্যবসায় করতে দেয়া হবে না এবং প্রতিহত করা হবে। ম খা সাহেব একজন সাবেক আমলা। জিয়ার আমলে তার বিশ্বাসভাজন হয়ে ভাগ্যের চাকার গতি বাড়িয়েছেন। তারপর জাতীয়তাবাদী সরকারের পতনের জন্য জনতার মঞ্চ করে শেখ হাসিনার মতায় আসার পথ সুগম করেন। সাথে সাথে নিজেও মতার অন্দর মহলে প্রবেশ করেন। ভদ্রলোক ধর্ম ব্যবসায় বলতে কী বোঝান তা দেশবাসী ভালো করে জানেন না। ম খা আলমগীর ধর্মের বিরোধিতা করলে সেটা ধর্ম ব্যবসায় হয় না, শুধু ধর্মের পে বললেই ব্যবসায় হয়ে যায়। আসলে সব দলই প্রত্য বা পরোভাবে রাজনীতিতে ধর্মকে ব্যবহার করে। রাজনীতির ময়দানে ধর্মের বিরোধিতাও ধর্ম ব্যবসায়। মিসরে সেনাবাহিনীর মতা দখল নিয়ে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মাহবুব হাসান ক’দিন আগে মিসর পরিস্থিতি নিয়ে নিজের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছেন, মিসরের সেনাবাহিনী খুবই আধুনিক ও সেকুলার (ধর্মহীন)। ওই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় সেনাবাহিনী। এদের যুদ্ধাস্ত্রও খুবই আধুনিক। তিনি নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মুরসিকে উৎখাত করাকে সমর্থন করেছেন। নির্বাচিত হলেও মুরসি নাকি অতিমাত্রায় ইসলামিস্ট হয়ে গিয়েছিলেন। পরোভাবে তিনি ব্রাদারহুড নিষিদ্ধকরণকেও সমর্থন করেন। আমাদের দেশের আমলাদের মনোভাব বোঝার জন্যই মাহবুব হাসানের কথা উল্লেখ করলাম। আমাদের রাজনীতি ও প্রশাসনে এমন বহু মানুষ আছেন, যারা মুসলমানও থাকবেন, আবার ইসলামেরও বিরোধিতা করবেন। দেশের বড় বড় সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে হেরেও শেখ হাসিনার হুঁশ হয়নি। নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার কারণগুলো জেনেও শেখ হাসিনা দল এবং নিজেকে শোধরানোর কোনো উদ্যোগ নেন। তিনি ৯০ শতাংশ মুসলমানের দেশে একটি ধর্মহীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চান। সারা পৃথিবীতে এখন মতাবানেরা মুসলমান দেশগুলোর বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লেগেছে। মুসলমানদের বিরুদ্ধে হাজারো অভিযোগ। মুসলমানেরা নাকি জঙ্গি, সন্ত্রাসী, অগণতান্ত্রিক। বড় দুঃখ ও বেদনার বিষয় হলো বহু মুসলমান নেতা ও শাসক পশ্চিমাদের সাথে হাত মিলিয়ে ইসলামের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। এদের মধ্যে সৌদি আরবের বাদশাহ এক নম্বর। তিনি গণতন্ত্র বা ইসলাম কোনোটাতেই বিশ্বাস করেন না। ক’দিন আগে জনপ্রিয় রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী মিতা হক বলেছেন, যারা মাথায় ঘোমটা দেন তারা বাঙালি নন। আমি ধরে নিয়েছি তিনি আবেগের কারণে ওরকম একটি কথা বলেছেন। আইয়ুব খানও বলেছিলেন, বাঙালি মেয়েরা পেটিকোট বা ছায়া সেমিজ পরে না। এমনকি তারা কাঁচুলি বা ববন্ধনী পরেন না। জেনারেল আইয়ুবের কথাটি আংশিক সত্য ছিল। বাংলাদেশের গরিব কিষানীরা ছায়া বা সেমিজ পরতেন না। মিতা হক বা তার মতো আরো যারা আছেন তারা হয়তো জানেন না ঘোমটা হিন্দু মুসলমান বাঙালি নারীদের সংস্কৃতি বা ঐতিহ্য। বিবাহিত হিন্দু নারীরা সিঁথিতে সিঁদুর দেয়। সিঁথি দেখে বোঝা যায় তিনি বিবাহিত নারী। এ ছিল এক যুগের কথা। এখন বাঙালি/বাংলাদেশী/ভারতীয় ও পাকিস্তানি নারীরা সালোয়ার কামিজ ওড়না পরেন। বেশ কিছু কম বয়সী বা তরুণীরা জিন্সের প্যান্ট, টি-শার্ট পরে। এর সংখ্যা খুবই কম। তথাকথিত কিছু সাংস্কৃতিক কর্মী বা নেতা মাঝে মধ্যে এসব আজেবাজে কথা বলে থাকেন। এখন জাতির সম্মুখে একটি মাত্র প্রশ্ন। আর তা হলো বাংলাদেশে ৯০ ভাগ মুসলমানের জীবনে ইসলাম থাকবে কি থাকবে না। আওয়ামী লীগ মনে করে বাংলাদেশকে রাষ্ট্রীয়ভাবে একটি ধর্মমুক্ত রাষ্ট্রে পরিণত করা। আর তাদের এই বিশ্বাসই নাকি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর প্রগতিশীলতা। তাদের স্লোগান হলো ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার। এর মানে ধর্ম ব্যক্তিগত বা পারিবারিক ব্যাপার। তাহলে আওয়ামী লীগ বা ওই ঘরানার লোকেরা কিভাবে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলবেন। আওয়ামী লীগ রাজনীতির কারণে ইসলাম ও মুসলমানদের বিরোধিতা করছে। অপর দিকে বিএনপিসহ জাতীয়তাবাদী ইসলামি দলগুলো চায় বাংলাদেশ একটি আধুনিক উদার মুসলিম রাষ্ট্রে পরিণত হোক। মইনউদ্দিন খান সাহেব তার আলোচনায় ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, বিএনপি এবং তার সহযোগী দলগুলো মতায় থাকলে বাংলাদেশের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। ধর্ম বা ইসলামই নাকি আমাদের জাতীয় ঐক্যের পথে প্রধানতম বাধা। ইসলাম নাকি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী। যারা একটু চিন্তা করেন তাদের বুঝতে একেবারেই অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। তাহলো বাংলাদেশকে ধর্মহীন তথাকথিত নামধারী মুসলমানদের দেশে পরিণত করা। যারা মুসলমান থাকবে কিন্তু ইসলামচর্চাকে জীবন থেকে বিদায় দেবে। তাদের রাজনীতির প্রধানতম ল্য হচ্ছে কালক্রমে ইসলামকে রাষ্ট্র, সমাজ ও জীবন থেকে বিতাড়িত করা। বাদল সাহেবেরা তাদের ল্য অর্জনের জন্য প্রয়োজনে সেনাবাহিনীকেও ব্যবহার করতে পারেন, যেমন মিসরের সেকুলারিস্টরা (ধর্মহীনরা) আমেরিকা, ইসরাইল ও পশ্চিমা শক্তির তাঁবেদার সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করেছে এবং সে দেশের ধর্মপ্রিয় মানুষের রক্ত নিয়ে হোলি খেলছে।
0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

শেষ সময়ের ‘হরিলুট’


মেয়াদের শেষ সময়ে এসে ক্ষমতাসীনরা নিজেদের ভালো-মন্দ বোঝার মতো বুদ্ধি ও কা-জ্ঞানও হারিয়ে ফেলেছেন কি না সে প্রশ্ন আজকাল সাধারণ মানুষের মুখেও উচ্চারিত হচ্ছে। এর কারণও ক্ষমতাসীনরাই তৈরি করে চলেছেন। অন্তরালে গভীর কোনো ষড়যন্ত্র বা অন্য যে কোনো অশুভ কৌশল ও উদ্দেশ্যই থেকে থাকুক না কেন, প্রধানমন্ত্রীর সুপুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় সম্প্রতি এক ‘তথ্য-তত্ত্ব’ হাজির করে বলেছেন, তার মায়ের দলই আবার ক্ষমতায় আসবে। তত্ত্বটি নিয়ে নিন্দা ও বিতর্কের ঝড় উঠতে না উঠতেই দৃশ্যপটে এসে গেছেন সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। স্থানীয় সরকারমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তিনি ঘোষণা করেছেন, তার কাছে জয়ের মতো কোনো তথ্য না থাকলেও তিনিও একই ‘গন্ধ’ পাচ্ছেন। ওদিকে ব্যঙ্গাত্মক কথায় ও ঘোষণায় যথারীতি এগিয়ে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিরোধী দলের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে তো বটেই, তার ছেলের বয়সী তারেক রহমানের বিরুদ্ধেও তিনি তীরের পর তীর ছুঁড়ছেন। কথিত ঘুষ আর দুর্নীতির ব্যাপারে কথার খৈ ফুটিয়ে চলেছেন তিনি। অন্য কিছু কথার মাধ্যমেও ঝড় তুলেছেন প্রধানমন্ত্রী। এসবের মধ্যে সংবিধান থেকে  ‘এক চুল’ও নড়বেন না ঘোষণাটি তো এরই মধ্যে ‘ঐতিহাসিক’ ঘোষণা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে! একযোগে ভাষণে-বিবৃতিতে তিনি চরম মিথ্যাচারই শুধু করে বেড়াচ্ছেন না, জনগণকে ভয়-ভীতিও দেখাচ্ছেন। নিজেদের সাধু-সন্ন্যাসীর পর্যায়ে উন্নীত করার হাস্যকর প্রচেষ্টা চালানোর পাশাপাশি বিএনপিসহ বিরোধী দলকে তারা দুর্নীতিবাজ ও জঙ্গি-সন্ত্রাসী বানিয়ে ছাড়ছেন। বোঝাতে চাচ্ছেন, বিএনপি এবং ১৮ দলীয় জোটকে ভোট দিলে বাংলাদেশ নাকি তালেবান রাষ্ট্র হয়ে যাবে! ঘটনাপ্রবাহে নির্বাচনী প্রচারণার ব্যাপারেই ক্ষমতাসীনদের সবচেয়ে বেশি তৎপর দেখা যাচ্ছে। আইনত নিষিদ্ধ হলেও সরকারি খরচে আয়োজিত বিভিন্ন সরকারি অনুষ্ঠানে তারা দিব্যি নিজেদের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। গতকাল ৩০ আগস্টও তিনি রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নির্বাচনী জনসভা করেছেন।
আজকের নিবন্ধে আমরা অবশ্য অন্য দু-একটি দিকের উল্লেখ করবো। জনগণের অর্থের ‘হরিলুট’ এরকম একটি বিষয়। প্রকাশিত বিভিন্ন খবরে বার্ষিক উন্নয়ন প্রকল্প বা এডিপি বাস্তবায়নের নামে সরকারের বিরুদ্ধে আবারও হরিলুটের গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। অর্থবছরের শেষপ্রান্তে এসে রাতারাতি প্রকল্প বাস্তবায়ন করার এবং বিপুল অর্থের ব্যয় দেখানোর ব্যাপারে অতীতেও অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু এবার স্থাপিত হয়েছে হরিলুটের নতুন রেকর্ড। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ আইএমইডির এক রিপোর্টের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রকাশিত খবরে জানানো হয়েছে, ২০১২-১৩ অর্থবছরের শেষ মাস জুনে এসে এডিপি বাস্তবায়ন খাতে অস্বাভাবিক পরিমাণ ব্যয় দেখানো হয়েছে। বিস্ময়কর তথ্য হলো, সংশোধিত এডিপির ২৭ শতাংশই ব্যয় হয়েছে জুন মাসে। ৫২ হাজার ৩৬৬ কোটি টাকার মধ্যে মে মাস পর্যন্ত যেখানে ব্যয় হয়েছিল ৩৬ হাজার কোটি টাকা সেখানে একমাত্র জুন মাসেই হয়েছে ১৬ হাজার কোটি টাকা। মোট ব্যয়ের দিক থেকেও এবার চমক সৃষ্টি করা হয়েছে। মোট বরাদ্দের ৯৫ দশমিক ৫৩ শতাংশ অর্থই নাকি ব্যয় হয়ে গেছে! অথচ আইএমইডি জানিয়েছে, স্বাধীনতার পর আগে কখনো এত ব্যাপক হারে এডিপির বাস্তবায়ন হতে দেখা যায়নি। ফলে অর্থনীতিবিদসহ বিশেষজ্ঞদের মধ্যেও সন্দেহ-সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। তারা মনে করেন, কাজ না করেই অনেক প্রকল্পের টাকা উঠিয়ে নেয়া হয়েছে। দলীয় বিবেচনার মতো বিশেষ কারণে সরকার ঠিকাদারদের আগাম চেক দিয়েছে। কিছু কাজ হলেও সেগুলোর মান নিশ্চিত করা হয়নি। ফলে লোপাট হয়ে গেছে রাষ্ট্রের বিপুল পরিমাণ অর্থ। কোনো অর্থনীতিবিদ ব্যঙ্গ করে বলেছেন, মনে হচ্ছে সরকার হাতে আলাদিনের চেরাগ পেয়েছে। না হলে এত অল্প সময়ে এত বেশি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভবই নয়। দেখা গেছে, পূর্ববর্তী অর্থবছরের তুলনায় ৯০ থেকে ৯৯ শতাংশ পর্যন্ত প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে ১৫টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ। শুধু তা-ই নয়, ১১টি বিভাগ ও মন্ত্রণালয় আবার নির্ধারিত বরাদ্দের চেয়ে অনেক বেশি অর্থও ব্যয় করেছেÑ যার পরিমাণ এমনকি ১৭ থেকে ২৪ শতাংশ পর্যন্ত বেশি। সরকারও তাদের এই অতিরিক্ত অর্থ দিয়েছে। তথ্যাভিজ্ঞরা জানিয়েছেন, নির্বাচন এগিয়ে আসায় প্রতিশ্রুতি পূরণের উদ্দেশ্যে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়ে থাকতে পারে। একই কারণে প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও রেকর্ড করেছে সরকার। টাকার সঙ্গে বিপুল পরিমাণ খয়রাতি চাল, গম প্রভৃতিও লোপাট হয়ে গেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন এবং এটাই সত্য যে, প্রকল্প বাস্তবায়নের চাইতে টাকা আদায় করার ব্যাপারেই আসলে বেশি লক্ষ্য রাখা হয়েছে। সরকারও ‘চাহিবা মাত্র’ টাকা দেয়ায়, এমনকি অনেক ক্ষেত্রে বরাদ্দের চাইতে অনেক বেশি টাকা দেয়ায় এ অভিযোগই অনস্বীকার্য হয়ে উঠেছে যে, প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে বাস্তবে চলছে হরিলুটের পালা। আইএমইডির পর্যালোচনায়ও পরিষ্কার হয়েছে, সারা বছর বসে থাকার পর অর্থবছর শেষ হওয়ার ঠিক প্রাক্কালে এসে ঠিকাদারসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী, এমপি ও কর্মকর্তারা হঠাৎ তৎপর হয়ে উঠেছেন। প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে দেখিয়ে জুন মাসেই তারা বরাদ্দকৃত অর্থ তুলে নিয়েছেন। অথচ বাস্তবে তখন পর্যন্ত অনেক প্রকল্পেরই অর্ধেকের বেশি কাজ অসম্পূর্ণ ছিল। অনেক প্রকল্পের বাস্তবায়নও সন্তোষজনক ছিল না। কিন্তু জুন মাসে এসে রাতারাতি পাল্টে গেছে সবকিছু। এমনভাবেই ৯০/৯৫ শতাংশ পর্যন্ত বাস্তবায়নের রিপোর্ট হাজির করা হয়েছে যেন কর্তাব্যক্তিরা হাতে আলাদীনের চেরাগ পেয়ে গেছেন! না হলে মাত্র এক মাসেই সম্পূর্ণ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলো কীভাবে? আসল রহস্য অবশ্য আড়াল করা যায়নি। অবস্থায় পরিবর্তন ঘটেছে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে। টাকা ফেরত চলে গেলে ক্ষমতাসীন দলের লোকজন চলবেন কীভাবে? তাছাড়া সামনেই আবার জাতীয় নির্বাচন। দলের কর্মী-ক্যাডাররা অস্ত্রে শান দিয়ে বসে আছে। তাদেরকেও তো হাতে রাখতে হবে! এজন্যই কাগজপত্রে প্রকল্পের বাস্তবায়ন ৯৫ থেকে ৯৯ শতাংশ পর্যন্ত সম্পন্ন দেখিয়ে হরিলুটের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এই লুটের অর্থ শুধু ঠিকাদারদের পকেটে যায়নি, ‘ভাগ’ পেয়েছেন মন্ত্রী-এমপি থেকে সরকারের কর্তাব্যক্তিরাও। না হলে তারাই বা সব জেনেশুনে চাল, গম এবং নগদ অর্থ ছাড় করবেন কেন?
উন্নয়নের ফিরিস্তি দিয়ে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে বিলবোর্ডে দেশ ছেয়ে ফেলা হলেও বাস্তবে ঠিক কোন ধরনের কাজকারবার চলছে তারই কিছু চিত্র পাওয়া গেছে আলোচ্য রিপোর্টটিতে। প্রকল্পের ব্যয় নিয়ে এমন অবস্থারই যে সৃষ্টি হবে সে সম্পর্কে অবশ্য কিছুদিন আগে থেকেই জানা যাচ্ছিল। যেমন এপ্রিলে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছিল, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে অধিকাংশ মন্ত্রণালয় ব্যর্থ হয়েছে। ধরে নেয়া যায়, তখনই সম্ভবত হুকুম এসেছিল ‘ওপর’ থেকে। সে হুকুমই তামিল করা হয়েছে মাত্র। অন্যদিকে কাজের কাজ যে কিছুই হয়নি তার প্রমাণ তো বিভিন্ন বিভাগ ও  মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প বাস্তবায়ন চিত্র থেকেই পরিষ্কার হয়েছে।  কথা শুধু এটুকুই নয়। কাজ যা হয়েছে সেগুলোরও ঠিকাদারি পেয়েছে ক্ষমতাসীন দলের লোকজন। তাদের কাজ পাইয়ে দেয়ার জন্য বর্তমান সরকার এমনকি টেন্ডারের আইনেও পরিবর্তন করেছে। আগে দু’লাখ টাকা পর্যন্ত কাজের জন্য টেন্ডার লাগতো না। এখন আট কোটি টাকার কাজও বিনা টেন্ডারেই পাওয়া যাচ্ছে। পাচ্ছেও ক্ষমতাসীন দলের লোকজনই। মূলত এজন্যই সময় মতো উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন না করা হলেও ‘শ্রাদ্ধ’ করা হচ্ছে বিপুল পরিমাণ অর্থ ও খাদ্যের। এভাবে চলতে দেয়া হলে সব উন্নয়ন কর্মসূচিই যে হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে সে কথা নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না। বলা দরকার, বিষয়টির সঙ্গে জাতীয় উন্নতি ও সমৃদ্ধির প্রশ্ন জড়িত রয়েছে বলেই প্রতিটি বিষয়ে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা দরকার। বিভাগ ও মন্ত্রণালয়গুলো কেন নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারেনি এবং অর্থবছরের শেষ মাসে এসে কীভাবে বরাদ্দের সমুদয় অর্থ তুলে নিতে পেরেছে তারও কৈফিয়ৎ আদায় করতে হবে। তদন্ত সাপেক্ষে মন্ত্রী, এমপি, ঠিকাদার ও কর্মকর্তাসহ প্রত্যেকের বিরুদ্ধেই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া দরকার। না হলে দুর্নীতি ও অর্থের হরিলুট সীমা ছাড়িয়ে যাবে এবং উন্নয়ন কর্মকা- পিছিয়েই পড়তে থাকবে।
হরিলুটের সর্বশেষ অন্য একটি খাত হিসেবে এসেছে ‘খাম্বা’ বাণিজ্য। জাতীয় দৈনিকের এক পিলে চমকানো রিপোর্টে জানানো হয়েছে, নিয়মনীতি না মেনে হাজার হাজার কোটি টাকার কেনাকাটা ও টেন্ডার বাণিজ্য তো চলছেই, একযোগে শুরু হয়েছে বিদ্যুতের জন্য ‘খাম্বা’ কেনার জোর তৎপরতাও। বিদ্যুৎ খাতে বড় কোনো প্রকল্প বাস্তবায়িত না হলেও এরই মধ্যে প্রায় ১২ লাখ ‘খাম্বা’ কিনেছে সরকার। সম্প্রতি আবার নতুন করে আরও ৬০ হাজার ৬২৫টি ‘খাম্বা’ কেনার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বলেছে, ১৮ লাখ পল্লী গ্রাহকের কাছে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেয়ার জন্য নাকি এই খাম্বাগুলো দরকার। লাখ লাখ কিলোমিটার তার কেনার জন্যও অর্থ বরাদ্দ দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। খাম্বা ও তার ছাড়া সরাসরি কমিশন এবং মুনাফা পাওয়া যায় এমন অন্য কিছু খাতেও অর্থ বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে কোনো রকম যাচাই-বাছাই ছাড়াই। যেমন ২৯ জুলাই অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে জ্বালানি তেল আমদানির জন্য ১২ হাজার কোটি টাকার বেশি বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এর দু’ সপ্তাহের ব্যবধানে প্রস্তাব উঠেছে আরও ১০টি প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ দেয়ার। অথচ বাস্তবে এসব প্রকল্পের কোনো অস্তিত্ব নেই। সবই রয়েছে কেবল কাগজপত্রে। এজন্যই প্রকল্পগুলোকে সরকারের স্বপ্নবিলাস হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। বড়কথা, সরকারি-বেসরকারি অংশিদারিত্বের আড়াল নিয়ে এসবের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন ক্ষমতাসীন দলের রুই-কাতলারা। মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের নাম তো বটেই, উচ্চারিত হচ্ছে বিদেশে বসবাসরত বিশিষ্টজনদের নামও।
রিপোর্টে আরও কিছু তথ্য-পরিসংখ্যান রয়েছে, যেগুলোর ভিত্তিতে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, বিভিন্ন বাহারী নামের প্রকল্পের আড়ালে আসলে শুরু হয়েছে ‘হরিলুট’। বলা দরকার, হরিলুট চলছে রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই। এ প্রসঙ্গে বার্ষিক উন্নয়ন প্রকল্প বা এডিপি বাস্তবায়নের বিষয়টি লক্ষ্য করা যেতে পারে। বস্তুত নির্বাচন এগিয়ে আসায় প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ‘রেকর্ড’ করে চলেছে সরকার। বলার অপেক্ষা রাখে না, প্রতিটি বিষয়ে হুকুম এসেছে ‘ওপর’ থেকে। সে হুকুমই তামিল করা হয়েছে, এখনও হচ্ছে। অন্যদিকে কাজের কাজ কিছুই যে হয়নি এবং হচ্ছে না তার প্রমাণ তো বিভিন্ন বিভাগ ও  মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প বাস্তবায়ন চিত্র থেকেই পরিষ্কার হয়েছে। কথা শুধু এটুকুই নয়। কাজ যা হয়েছে সেগুলোরও ঠিকাদারি পেয়েছে ক্ষমতাসীন দলের লোকজন। মূলত এজন্যই সময় মতো উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন না করা হলেও ‘শ্রাদ্ধ’ করা হচ্ছে বিপুল পরিমাণ অর্থ ও খাদ্যের। এভাবে চলতে থাকলে সব উন্নয়ন কর্মসূচিই যে ‘স্বপ্ন’ থেকে যাবে সে কথা নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না। এসবের সঙ্গে জাতীয় উন্নতি ও সমৃদ্ধির প্রশ্ন জড়িত রয়েছে বলেই প্রতিটি বিষয়ে আমরা জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার দাবি জানাই। ‘হরিলুট’ অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। কারণ, টাকাটা গরীব জনগণের।

Ads