সোমবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০১২

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

নতুন বছরে শুনতে চাই শুভবার্তা



কালের আবর্তে হারিয়ে গেল ২০১২ সাল। নতুন সূর্যোদয় আমাদের উপহার দিল নতুন বছর ২০১৩। বাস্তব কারণেই মানুষ বিদায় জানায় বিগত বছরকে এবং স্বাগত জানায় নতুন সময়কে।  মানুষ নতুন বছরকে  স্বাগত জানায় নতুন স্বপ্নে, আর পুরাতন বছরের দিকে তাকায় জিজ্ঞাসার দৃষ্টিতে। এর যৌক্তিক কারণও রয়েছে। স্বপ্নকে সফল করতে হলে বিগত বছরের ঘটনা প্রবাহকে বিশ্লেষণ করতে হয়। যথার্থ বিশ্লেষণ ভুল-ত্রুটি  সংশোধন করে সঙ্গত পদক্ষেপ গ্রহণে আমাদের সহযোগিতা করতে পারে। বিগত বছরে আমরা একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হওয়ার পাশাপাশি ছিলাম আন্তর্জাতিক বিশ্বেরও নাগরিক। স্বদেশের ঘটনা প্রবাহের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ঘটনা প্রবাহও আমাদের জীবনে প্রভাব ফেলে থাকে। তাই সচেতন মানুষ মাত্রই তাদের অভিযাত্রায় শুধু দেশের নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনের ঘটনা প্রবাহের দিকেও রাখে সতর্ক দৃষ্টি। এটাই স্বাভাবিক এবং সঙ্গতও বটে।
বিগত বছরে জাপান, মিসর, যুক্তরাষ্ট্রসহ আরো কিছু দেশে জাতীয় নির্বাচন হয়েছে। এসব নির্বাচনকে ঘিরে অনেক আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে, স্বপ্নের কথাও বলা হয়েছে। তবে বর্তমান আন্তর্জাতিক বিশ্বে রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে যে পরাশক্তি তাদের নীতিতে কিংবা আচরণে তেমন কোন পরিবর্তন সূচিত হয়নি। আর এই বিষয়টিও উপলব্ধি করা গেছে যে, পরাশক্তির ভাষাগত পরিবর্তনে বাস্তবে তেমন কোন পরিবর্তন সূচিত হয় না। ফলে বর্তমান বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় মধ্যপ্রাচ্য সংকটের সমাধান অনিবার্য বিষয় হিসেবে স্বীকৃতি পেলেও সেখানে ফলদায়ক তেমন কিছু ঘটেনি। ফিলিস্তিনিরা আজও তাদের অধিকার ফিরে পায়নি। উড়ে এসে জুড়ে বসে ইহুদিরা ইসরাইল রাষ্ট্র গঠন করে আগ্রাসনের উত্তাপ ছড়াতে থাকলেও ভূমিপুত্র ফিলিস্তিনিরা এখনও স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি পেল না। এমন পরিস্থিতিতে জাতিসংঘে ফিলিস্তিন পর্যবেক্ষক রাষ্ট্রের মর্যাদা পেলে গোস্যা বেড়ে যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। ফলে তারা বলে ওঠে, জাতিসংঘ কি বললো সেটা বড় কথা নয়, ইসরাইল কি বললো সেটাই আসল কথা। এমন প্রশ্রয় পেয়েই ইসরাইল বলতে পারলো, জাতিসংঘের বক্তব্যকে আমরা তোয়াক্কা করি না। এই যদি হয় বিশ্ব পরিস্থিতি এবং বিশ্ব নেতাদের আচরণ তাহলে বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থার ব্যাপারে মানুষ আশান্বিত হবে কেমন করে? সভ্যতার অন্যায় দৃষ্টিভঙ্গি এবং অমানবিক আচরণের কারণে এখনও বিপর্যয়ের মধ্যে রয়েছে ফিলিস্তিন, ইরাক, আফগানিস্তান, কাশ্মির এবং মিয়ানমারের জনগণ। জানি না নির্যাতিত-নিপীড়িত এই সব মানুষ কখন মানবাধিকার ফিরে পাবে, কখন নিজেদের বিশ্বের নাগরিক হিসেবে ভাবতে পারবে? গত বছরের প্রহসনের বিশ্ব ব্যবস্থার বদলে নতুন বছর মুক্তির বার্তা বয়ে আনবে এটাই এখন মানবজাতির স্বপ্ন। তবে গত বছরের ‘আরব বসন্ত' মানব জাতির সামনে যেন এক নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে। পাশ্চাত্যের সাহায্য-সহযোগিতায় মধ্যপ্রাচ্যের বহু দেশে স্বৈরশাসকরা চেপে বসেছিল। ‘আরব বসন্ত' স্বৈরাচারী শাসকদের মসনদ টলিয়ে দিয়েছে। জনগণ তাদের স্বাধীকার চেতনায় নতুন করে দেশকে গঠন করতে চেয়েছে। এর উজ্জ্বল উদাহরণ মিসর। মিসরের স্বৈরশাসকরা যে ‘ব্রাদারহুডের' নেতা-কর্মীদের মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িকসহ না মন্দ ভাষায় চিহ্নিত করতে চেয়েছে তাদের হাতেই জনগণ তুলে দিয়েছে মিসরের শাসন ক্ষমতা। মিসরের মুরসি সরকার জনগণের আশা-আকাঙক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়ে রচিত সংবিধানকে জনগণের রেফারেন্ডার্মের মুখোমুখি করেছে। সে রেফারেন্ডামে জনগণের ভোটে পাস হয়েছে প্রস্তাবিত সংবিধান। এভাবে জনগণের মতামতের ভিত্তিতে দেশ শাসন করার যে উদাহরণ সৃষ্টি করেছে মিসরের মুরসি সরকার তা গত বছরের আন্তর্জাতিক অঙ্গনের একটি বড় ঘটনা। এ ঘটনা বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থাকে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণে সাহায্য করতে পারে। তবে এই বার্তাটি আন্তর্জাতিক বিশ্ব গ্রহণ করে কি না সেটাই ২০১৩  সালে লক্ষ্য করার মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হবে।
আন্তর্জাতিক বিশ্বের ঘটনাপ্রবাহের চাইতেও স্বদেশের ঘটনাপ্রবাহ আমাদের কাছে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়। কিন্তু গত বছর বাংলাদেশে যেসব ঘটনা ঘটেছে তার বর্ণনা দিতে গেলে যে কোনো সচেতন নাগরিকেরই মন ব্যথায় ভারী হয়ে আসতে পারে। স্বদেশে ব্যর্থতা ও গ্লানির কথা বর্ণনা করতে কারই বা ভালো লাগে। এ কারণেই হয়তো কবি বলে গেছেন, ‘কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জানাতে ভালবাসে'। গত বছরের ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে পত্রিকার পাতায় শিরোনাম হয়েছে ‘খুন-গুম-কেলেঙ্কারির বছর'। কোনো পত্রিকায় শিরোনাম হয়েছে, ‘দেশের মর্যাদাহানির বছর'। বছরজুড়ে দেশে আলোচিত বিষয় ছিল খুন-গুম ও নানা কেলেঙ্কারির ঘটনা। পদ্মা সেতু, নিম্নমুখী শেয়ার বাজার, হলমার্ক, ডেসটিনি ও রেল কেলেঙ্কারির ঘটনা সরকারের জন্য ছিল খুবই বিব্রতকর বিষয়। এছাড়া বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী, গার্মেন্টস শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলামসহ বেশ কয়েকটি গুম ও খুনের ঘটনায় দেশ-বিদেশে সমালোচনার ঝড় ওঠে। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকান্ডের কোনো কূল কিনারা না হওয়ায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ভূমিকা ও জনগণের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। বিরোধী দলের অবরোধ কর্মসূচিতে পুরান ঢাকার পথচারী বিশ্বজিৎ দাসকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যার মধ্য দিয়ে সরকারের মুখে আরো কালিমা লেপন করে ছাত্রলীগ। আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের একজন বিচারপতির স্কাইপে কথোপকথন ব্যাপকভাবে জনমনে আলোড়নের সৃষ্টি করে। ফলে যুদ্ধাপরাধ বিচারের স্বচ্ছতা নিয়ে দেশে-বিদেশে আলোচনার মাত্রাও বেড়ে যায়। এছাড়া গত বছর কক্সবাজারের রামুতে বৌদ্ধ পল্লী ও মন্দিরে অগ্নিসংযোগ, সিলেট এমসি কলেজের ঐতিহাসিক ছাত্রাসাবে অগ্নিসংযোগের ঘটনা, আশুলিয়ার তাজরিন গার্মেন্টে অগ্নিদগ্ধ হয়ে ১২৪ জন গার্মেন্ট শ্রমিকরে মৃত্যু এবং চট্টগ্রামে ফ্লাই ওভার দুর্ঘটনায় প্রাণহানির ঘটনা দেশবাসীর কাছে দুঃখজনক স্মৃতি হয়ে রয়েছে। অনাকাঙ্ক্ষিত এসব ঘটনাপ্রবাহের মধ্যেও গত বছর কিছু পুরস্কার বিষয়ও আমরা লক্ষ্য করেছি। কৃষিতে আমরা ভাল করেছি, ক্রিকেটেও আমরা ভাল করেছি। শুধু পুরুষই নয় বাংলাদেশের নারীরাও এখন এভারেস্ট জয় করছে। গত বছরের মে মাসে নিশাত মজুমদার ও ওয়াসফিয়া নাজরিন এভারেস্ট চূঁড়া জয় করেন। বিজ্ঞানী মাকসুদ আলমের নেতৃত্বে দেশের বিজ্ঞানীরা ছত্রাকের জীবন রহস্য উম্মোচন করেন। এসব ঘটনা আমাদের উপলব্ধি দেয় যে, আমরাও পারি। কিন্তু গত বছর যে গরুত্বপূর্ণ বিষয়টি আমরা করতে পারিনি তা হলো, সামনের জাতীয় নির্বাচনটি কোন পদ্ধতিতে কিভাবে হবে তা নির্ণয় করতে। গত বছর এই ব্যর্থতাটি নতুন বছরের জন্য একটি অশনি সংকেত হয়ে রয়েছে। আমাদের রাজনীতিবিদরা যদি একটি অবাদ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন পদ্ধতি গ্রহণে সামর্থন না হয় তাহলে আমাদের আশা-আকাঙ্কা ও স্বপ্ন ভেঙ্গে খানখান হয়ে যেতে পারে। আমরা আশা করবো, গত বছরের মত নতুন বছরে আমাদের সরকার ও রাজনীতিবিদরা সঙ্গত সিদ্ধান্ত গ্রহণে ব্যর্থ হবে না। তবে এ ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকাটাই আসল। পরিশেষে নতুন আশায় সবাইকে জানাই শুভ নববর্ষ।
0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

বিগত বছরের সব গ্লানি মুছে যাক

নতুন বছরের শুভেচ্ছা

আমাদের সামগ্রিক জীবন থেকে আরো একটি বছর বিদায় নিলো। শুরু  হলো নতুন সৌরবর্ষ দুই হাজার তেরো সাল। বিগত বছরটা ছিল খুন, গুম, হামলা, মামলা ও কেলেঙ্কারির বছর। সেই সাথে বাড়তি বিড়ম্বনা ছিল আইনের শাসনের বিপর্যয়। দুর্নীতির প্রসার ঘটেছে রন্ধ্রে রন্ধ্রে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রেও দুই হাজার বারো সাল ছিল আলোচিত বছর। রাজনৈতিক নিপীড়নের মাত্রা ছিল সীমাহীন। প্রশাসন দলীয়করণের নেতিবাচক প্রভাবে ছিল আড়ষ্ট। শিক্ষাঙ্গনে অস্থিরতা ছিল সীমাহীন। নিত্যপণ্যের দাম বাড়া ও জ্বালানির বারবার বাড়তি মূল্য নির্ধারণের বিষয়টি ছিল অসহনীয়। ব্যাংক খাত মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। উৎপাদনের চাকা ছিল স্থবির। তার ওপর সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো জনগণের প্রত্যাশা পূরণে শুধু ব্যর্থই হয়নি, সরকারি চাপে ছিল নতজানু। বিচার বিভাগ যতটা না ইতিবাচক আলোচনার বিষয় ছিল, তার চেয়ে হাজার গুণ ছিল বিভিন্ন ধরনের গ্লানিতে ভরা। আস্থা ও বিশ্বাসের জায়গায় শুধু চিড় ধরেনিÑ বিচারক নিয়োগ, পদোন্নতি ও বিচারিক কাজ নিয়ে সমালোচনা ছিল অধিকতর আলোচ্য বিষয়।

অসংখ্য ব্যর্থতার গ্লানি ও হতাশার মাঝে হারিয়ে গেছে সামান্য কিছু সাফল্য ও অগ্রগতি। অর্থনৈতিক বিবেচনায় বিগত বছরটি ছিল আশাহত হওয়ার মতো। শেয়ারবাজার ঘুরে দাঁড়ায়নি, ব্যাংক কেলেঙ্কারির প্রসার ঘটেছে, রাজনৈতিকভাবে দেশ আবার শঙ্কা ও হতাশার গহ্বরে পড়েছে। গণতন্ত্র চর্চায় সরকার সামান্যতম সহিষ্ণুতাও প্রদর্শন করেনি। অর্থনৈতিক শোষণের সাথে রাজনৈতিক নিপীড়ন যোগ হয়ে দেশে একধরনের ছদ্মবেশী স্বৈরাচারের আলামত স্পষ্ট করেছে। সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে আধিপত্যবাদী ধারাকে সরকারই পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে। সামাজিক মূল্যবোধগুলো যেন ধসিয়ে দেয়া হয়েছে। নৈতিক মানদণ্ডের বিবেচনায় অবক্ষয় ঠেকানো এবং জাতীয় চেতনাকে তুলে ধরার ক্ষেত্রে সরকার কোনো ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেনি। প্রতিবেশী দেশের সাথে সম্পর্কোন্নয়নের কথা বলা হলেও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কোন্নয়নের ক্ষেত্রে ভারতীয় স্বার্থ প্রাধান্য পেয়েছে। অপর দিকে কূটনৈতিক ব্যর্থতায় পররাষ্ট্রনীতি হয়ে পড়েছে একঘরে। দূরত্ব বেড়েছে দাতা সংস্থা, বিশ্বব্যাংক, মুসলিম বিশ্ব, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে। আমাদের জাতীয় জীবনের মতোই আন্তর্জাতিক বিশ্ব ছিল অনেক আলোচনায় মুখর। তবে বিদায়ী বছরে বিশ্বজুড়ে কিছু নেতিবাচক দুঃসংবাদের পাশাপাশি বেশ কিছু ইতিবাচক ঘটনাও ঘটেছে। মিসর ও ফিলিস্তিনের অগ্রগতি সন্তোষজনক হলেও সিরিয়ায় রক্তক্ষরণ ছিল অনেক ব্যথাতুর।
এত সব নেতিবাচক সমস্যা, সঙ্কট ও শঙ্কা নিয়েও আমরা নতুন বছরকে আশাবাদের স্বপ্নে রাঙাতে চাই। আশা করতে চাই, জনগণের বিজয়ের পথে অনেক অগ্রগতিই প্রত্যক্ষ করা যাবে। রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিকাশ ঘটবে। অর্থনীতি বাঁক ঘুরে দাঁড়াবে। সাংস্কৃতিক দেউলিয়াত্ব ঘুচে যাবে। হতাশার কালো চাদর ভেদ করেই আশার আলো জ্বলে উঠবে। আশা করা যায়, সরকার জনগণের হৃৎস্পন্দন বুঝতে সক্ষম হবে। জনগণের প্রত্যাশা পূরণে একটি শুভ দিনের আশায় সবাই প্রহর গুনতে চান। এ ক্ষেত্রে দায়িত্বশীলতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে সর্বত্র। তবেই একটি নববর্ষকে স্বাগত জানানোর রেওয়াজ সার্থকতা পাবে। তাই জোর দিয়ে বলবÑ গণতন্ত্র সত্যিকার অর্থে মুক্তি পাক, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হোক। ন্যায়, ইনসাফ ও স্বচ্ছতা সব গ্লানি মুছে দিক। সবাইকে নতুন বছরের শুভেচ্ছা।
0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

বছরজুড়ে ছিল ছাত্রলীগের তাণ্ডব : নতুন বছরে সুমতি হবে কি?


শেষ হয়ে গেল ২০১২ সাল। এ বছরের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সমান তালে তাণ্ডব দেখিয়েছে ছাত্রলীগ। শতাধিক সংঘর্ষে তারা অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল প্রতিপক্ষের ওপর। কখনও বিরোধী সংগঠনের নেতাকর্মী, কখনওবা নিজ দলীয়রাই ছিল প্রতিপক্ষ। নিরীহ পথচারীরাও রেহাই পায়নি ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীদের হাত থেকে। একে একে ৯ জনকে হত্যা করেছে তারা। আহত করেছে ১১শ’র মতো। তাদের তাণ্ডবের মুখে বন্ধ করতে হয়েছে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, যার মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১০টি। তাদের সৃষ্ট মারামারিতে অবাধে ভাংচুর হয়েছে। কত শিক্ষার্থী যে তাদের বইপত্র-আসবাবপত্র হারিয়েছে তার হিসাব নেই। কত টেন্ডার ছিনতাই হয়েছে, অগ্নিসংযোগ বা যানবাহন ভাংচুর হয়েছে তারও হিসাব রাখেনি কেউ। তবে একটা কথা মানুষের মনে গেঁথে গেছে, ছাত্রলীগ হলো এমনই সংগঠন যা ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের সেই দানবের মতো, যে নিজের স্রষ্টাকেই ধ্বংস করে।
ছাত্রদের হাতে বই-খাতা-কলমই স্বাভাবিক হলেও ছাত্রলীগারদের হাতে লাঠি, লোহার রড, চাপাতি, হাসুয়া বা রিভলভার-পিস্তলই স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। ২০১২ সালের শুরুতেই ২ জানুয়ারি ঢাবিসহ দেশের চারটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের তাণ্ডবে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ বেধে যায়। আহত হয় কমপক্ষে ৬০ জন। ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই তাণ্ডবের পরদিনই তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনরত সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর। সেখানে ৫ ছাত্রীসহ ২০ শিক্ষার্থী আহত হয়। ৮ জানুয়ারি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অভ্যন্তরীণ কোন্দলের শিকার হয়ে মারা যান জুবায়ের নামের এক ছাত্রলীগ কর্মী। এভাবেই সহিংসতা আর রক্তপাতের মধ্য দিয়ে শুরু হওয়া বছরের পুরোটা জুড়েই ছাত্রলীগের এই ভূমিকার কমতি দেখা যায়নি। এমন দিন কমই ছিল যেদিন দেশের কোনো না কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সংঘর্ষে জড়ায়নি ছাত্রলীগ ক্যাডাররা। তাদের উন্মত্ততা থেকে ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক, পথচারী, পুলিশ কেউই রেহাই পায়নি। তারা ছাত্রীদের শ্লীলতাহানি করেছে। ধর্ষণ করেছে শিশুকেও। আধিপত্য বিস্তারের জের ধরে তারা সিলেটের ১২০ বছরের এতিহ্যবাহী এমসি কলেজ ছাত্রাবাসটি জ্বালিয়ে দিতেও দ্বিধা করেনি। এতকিছুর পরও তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক আইনি ব্যবস্থার দেখা মেলেনি। প্রধানমন্ত্রী চক্ষুলজ্জার খাতিরে এক সময় সাংগঠনিক সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করার ঘোষণা দিতে বাধ্য হলেও ঠিকই শাসক দল ও মন্ত্রী-এমপিদের আশপাশ আলো করে ছিল ছাত্রলীগের সোনার ছেলেরা। তারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিরোধীদের কঠোরভাবে দমন করেই ক্ষ্যান্ত হয়নি, রাজপথেও আন্দোলনকারীদের ওপর চড়াও হয়েছে প্রকাশ্যেই পুলিশের সহযোগী হিসেবে। নিরস্ত করা দূরে থাক, সরকারের শীর্ষ মহল থেকে তাদের উত্সাহিত করা হয়েছে। খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে বিরোধীদের মোকাবিলা করতে আহ্বান জানিয়েছেন তাদের প্রতি। এর ফল পেতে দেরি হয়নি। ৯ ডিসেম্বর বিরোধী জোটের অবরোধ চলাকালে রাজপথে পুলিশের সামনেই নিরীহ পথচারী বিশ্বজিেক নির্মমভাবে কুপিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেছে ছাত্রলীগের চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা। দেশে-বিদেশে চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী এমন অপরাধের পরও প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাদের বাঁচানোর অবিশ্বাস্য অপচেষ্টা করায় প্রমাণিত হয়েছে—যাই করুক না কেন, ছাত্রলীগ ছাড়া হাসিনা সরকার চলতে পারে না।
সর্বগ্রাসী দুর্নীতি-দুঃশাসনের কারণে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন এ সরকার আইন রক্ষা বাহিনীর ওপর যে পুরোপুরি আস্থা রাখতে পারছে না, সেটাও প্রমাণিত হয় এতকিছুর পরও ছাত্রলীগের তোষণ অব্যাহত রাখার ঘটনা থেকে। বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী ও সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কার্যকর কিছুই করা হয়নি গত চার বছরে। লোক দেখানো পদক্ষেপ যে ফল দেয় না, সেটা বারবারই দেখা গেছে। শেষ বছরে এসে সরকারের সুমতি ফিরবে কি? যদি না ফেরে তবে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের সঙ্গেই সরকারের পরিণতিও দেখতে হবে সবাইকে।

রবিবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০১২

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

বিজয়ের মাসে পরাধীনতার কালো আইন : ৫৪ ধারার অপপ্রয়োগ


এডভোকেট সাবিকুন্নাহার মুন্নি :
 বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। লক্ষ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। এদেশের মানুষ জানমাল, ইজ্জত-আব্রু, সম্মান, মর্যাদা ও জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য ও সকল প্রকার অপশাসন, শোষণ এবং বঞ্চনার বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো। নারী, শিশু, যুবক, বৃদ্ধ তথা সর্বস্তরের মানুষ তার অধিকার নিশ্চিন্তে দ্বিধাহীনভাবে ভোগ করতে পারবে এটাই ছিল প্রতিটি নাগরিকের প্রত্যাশা। স্বাধীনতার ৪১ বছর পর আজ আমরা দেখতে পাচ্ছি, মৌলিক মানবাধিকার আজ চরমভাবে ভূলুণ্ঠিত। বিশেষ করে নারীর অধিকার নিয়ে কয়েক দশক যাবৎ যে আন্দোলন চলছে সেই নারীরা আজও নির্যাতিত, অবহেলিত, শোষিত, বঞ্চিত ও নিগৃহীত। নারীরা আজ রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার। যে ব্রিটিশ শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে এ দেশের মানুষ আন্দোলন করেছে, জেল, জুলুম নির্যাতনের শিকার হয়েছে এবং অনেককে নির্বাসিত জীবন যাপন করতে হয়েছে সেই ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া কালো আইনের অপপ্রয়োগ হচ্ছে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে।
বহু রক্ত ও ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে নারীর সম্মান, মর্যাদা, ইজ্জত আজ ভূলুণ্ঠিত। যে দেশে আইনের অপপ্রয়োগ করে নারীকে অপমানিত, লাঞ্ছিত করা হয়, সে দেশের মর্যাদা বিশ্ব দরবারে কিভাবে সমুন্নত হবে?
বর্তমান সরকার ১৮৯৮ সালে ব্রিটিশ প্রবর্তিত ৫৪ ধারা আইনটির অপপ্রয়োগ করেছেন ২০ জন পর্দানশীন মেধাবী ছাত্রীর উপর। ঘটনাটি ঘটেছে ঢাকার মগবাজারস্থ ইসলামী ছাত্রী সংস্থার কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে।
সরকারের অগণতান্ত্রিক ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ধারাবাহিকতায় গত ১৭ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় ৪৯৩, বড় মগবাজারস্থ সংগঠনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে তল্লাশির নামে অফিস তছনছ ও ভাংচুর করে আতঙ্ক সৃষ্টি করে ২০ জন পর্দানশীন মেধাবী ছাত্রীসহ মিসেস সানোয়ারা জাহানকে গ্রেফতার করে।
কোন সুনির্দিষ্ট কারণ ছাড়াই তাদের গ্রেফতার করে রমনা থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর কোন ধরনের অভিযোগ দাঁড় করাতে না পেরে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার দেখিয়ে তাদেরকে আদালতে সোপর্দ করা হয়। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে একজন অন্তঃসত্ত্বা মহিলাও রয়েছে। অথচ তাকে অত্যন্ত অমানবিকভাবে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়েছে। যে কোন অভিযুক্ত ব্যক্তির মানবাধিকারের প্রতি খেয়াল রাখা একটি স্বাভাবিক আইনী বাধ্যবাধকতা। অথচ একজন অন্তঃসত্ত্বা মহিলাকে কোন সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ব্যতিরেকে শুধুমাত্র সন্দেহের বশবর্তী হয়ে গ্রেফতার ও কারাগারে প্রেরণ মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন বলে প্রশ্ন উঠেছে।
২০ জন মেধাবী ছাত্রীকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার দেখিয়ে রিমান্ডে নেয়া বাংলাদেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন ঘটনা। কোন সভ্য সমাজে এটা হতে পারে না। যে দেশের প্রধানমন্ত্রী একজন নারী, বিরোধী দলীয় নেত্রীও নারী সে দেশে শুধুমাত্র রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে এহেন আচরণ গোটা নারী সমাজের জন্য অপমানজনক, দেশের জন্য কলঙ্কজনক। একটি স্বাধীন দেশে এ ধরনের ঘটনা অপ্রত্যাশিত।
যেভাবে তাদেরকে গ্রেফতার করা হয় এবং গ্রেফতারের পর তাদের সাথে যে সব আচরণ করা হয় তা সুস্পষ্ট আইনের লঙ্ঘন। গ্রেফতার ও আটক সম্পর্কে বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৩নং ধারায় স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে ঃ
০ গ্রেফতারকৃত কোন ব্যক্তিকে যথাসম্ভব শীঘ্র গ্রেফতারের কারণ জ্ঞাপন না করিয়া প্রহরায় আটক রাখা যাইবে না এবং উক্ত ব্যক্তিকে তাঁহার মনোনীত আইনজীবীর সহিত পরামর্শের ও তাহার দ্বারা আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার হইতে বঞ্চিত করা যাইবে না।
০ গ্রেফতারকৃত ও প্রহরায় আটক প্রত্যেক ব্যক্তিকে নিকটতম ম্যাজিস্ট্রেটের সম্মুখে গ্রেফতারের চবিবশ ঘণ্টার মধ্যে (গ্রেফতারের স্থান হইতে ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে আনয়নের জন্য প্রয়োজনীয় সময় ব্যতিরেকে) হাজির করা হইবে এবং ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ ব্যতীত তাঁহাকে তদতিরিক্তকাল প্রহরায় আটক রাখা যাইবে না।
সংবিধানের এ ধারার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন করেছে পুলিশ। গ্রেফতারকৃতদের চবিবশ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে হাজির করা হয়নি। তাদেরকে ২ দিন রমনা থানায় আটক রাখা হয়। একজন অন্তঃসত্তবা নারীকে ২ দিন থানায় আটকিয়ে রাখার এখতিয়ার পুলিশ কোথায় পেল? এরপর তাদেরকে আদালতে সোপর্দ করে ২ দিন রিমান্ডে নেয়া হলো। ভাবতেও অবাক লাগে যে মাসটির সাথে নারীমুক্তি আন্দোলনের পথিকৃৎ বেগম রোকেয়ার স্মৃতি জড়িত রয়েছে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এই মাসে রাজনৈতিক কর্মসূচি দেয়ার কারণে বিরোধীদলের কঠোর সমালোচনা করলেন সেই মাসে একজন অন্তঃসত্ত্বা নারীর সাথে রাষ্ট্র যে ব্যবহার করলো সে ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী একজন নারী হয়েও নীরব ভূমিকা পালন করলেন।
বর্তমান সরকার নিজেদেরকে গণতান্ত্রিক সরকার বলে দাবি করে। কিন্তু বাস্তবতা হল এ সরকার গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহকে ধ্বংস করে দিয়েছে। পেশাদারিত্বের পরিবর্তে রাজনৈতিক পরিচয়ের ভিত্তিতে প্রশাসনসহ সর্বত্র নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। দেশের বিচার বিভাগ নামেমাত্র স্বাধীন। পেশাদারিত্বের ভিত্তিতে বিচার বিভাগে কার্যক্রম হচ্ছে বলে মনে করার কোন সুযোগ নেই। পুলিশ বাহিনীতে পেশাদারিত্বের কোন বালাই নেই। কোন পেশাদার পুলিশ অবলা নারীর উপর এমন আচরণ করতে পারে না।
সরকার যদি গণতান্ত্রিকই হবে তবে ব্রিটিশ নিবর্তনমূলক আইনটির কোন অপপ্রয়োগ করছে? ব্রিটিশবিরোধী গণ-আন্দোলন থামাতে ১৮৯৮ সালে ইংরেজরা সর্বপ্রথম নিবর্তনমূলক আইন তৈরি করে। তারা ওই আইনের ৫৪ ধারায় লাখ লাখ মানুষকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার করে। উপনিবেশবিরোধী আন্দোলন দমাতে তারা এ ধারাটি ব্যবহার করেছিল। পাকিস্তান আমলেও নিপীড়ন চালানোর হাতিয়ার ছিল ৫৪ ধারা। স্বাধীনতার পর এ ধারাটির বিরুদ্ধে যারা সোচ্চার ছিলেন এমনকি তারাও নিজেরা ক্ষমতায় গিয়ে এ ধারাটি নিজেদের প্রয়োজনে কাজে লাগিয়েছেন। নিবর্তনমূলক এ আইনটি এখন ব্যবহৃত হচ্ছে দমন পীড়নের হাতিয়ার হিসেবে।
ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় বলা আছে, ‘যেকোনো পুলিশ কর্মকর্তা ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ অথবা পরোয়ানা ছাড়াই, যেকোনো ব্যক্তিকে গ্রেফতার করতে পারেন। কোনো আমলযোগ্য অপরাধের সাথে জড়িত ব্যক্তি অথবা এ ধরনের কাজে জড়িত বলে যার বিরুদ্ধে যুক্তিসঙ্গত অভিযোগ করা হয়েছে অথবা বিশ্বাসযোগ্য খবর পাওয়া গেছে বা যুক্তিসঙ্গত সন্দেহ রয়েছে। অপরাধী বলে ঘোষিত ব্যক্তি, চুরি যাওয়া জিনিস থাকতে পারে এমন কোনো ব্যক্তি, পুলিশ কর্মকর্তাকে কাজে বাধাদানকারী, প্রতিরক্ষা বাহিনী হতে পালানো ব্যক্তি, বিদেশে অপরাধ করে দেশে ফেরত ব্যক্তি, মুক্তিপ্রাপ্ত আসামি মুক্তির নিয়ম লঙ্ঘন করলে এবং অন্য কোনো পুলিশ কর্মকর্তার কাছ থেকে গ্রেফতারের অনুরোধকৃত ব্যক্তিদের এ আইনে গ্রেফতার করা যায়।'
ব্রিটিশদের প্রণীত ওই ফৌজদারি আইনের নিবর্তনমূলক ৫৪ ধারা স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক। এ ধারা ব্রিটিশদের প্রণীত ওই ফৌজদারি আইনের নিবর্তনমূলক ৫৪ ধারা স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক। এ ধারা বাংলাদেশ সংবিধানের মৌলিক অধিকার সম্পর্কিত ৩১, ৩৩(ক), ৩৩(খ) ও ৩৫(৫) ধারার পরিপন্থী। ধারাগুলোতে নির্যাতন নিষিদ্ধ ও ব্যক্তি স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ রাখার কথা বলা হলেও ৫৪ ধারার অপপ্রয়োগের কারণে এ দেশে মানবাধিকার খর্ব হচ্ছে। সংবিধানের ৩১ ধারায় উল্লেখ রযেছে, ‘আইনের আশ্রয়লাভ এবং আইনানুযায়ী ও কেবল আইনানুযায়ী ব্যবহার লাভ যেকোনো স্থানে অবস্থানরত প্রত্যেক নাগরিকের এবং সাময়িকভাবে বাংলাদেশে অবস্থানরত অপরাপর ব্যক্তির অবিচ্ছেদ্য অধিকার এবং বিশেষত আইনানুযায়ী ব্যতীত এমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাইবে না, যাহাতে কোনো ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি না ঘটে।'
পুলিশ ২০ জন ছাত্রীকে গ্রেফতার করে তাদের জীবন, স্বাধীনতা, সুনাম ও ছাত্রী জীবনের কৃতিত্বপূর্ণ অগ্রযাত্রার ব্যাঘাত ঘটিয়েছে। যারা মেডিকেল এবং বুয়েটের ছাত্রী তাদের সবচাইতে বড় সম্পত্তি হচ্ছে তাদের শিক্ষাগত জীবনের ক্যারিয়ার। এই ক্যারিয়ারের ক্ষতি করা হয়েছে গ্রেফতারের মাধ্যমে যা সংবিধানের ৩১ ধারার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
একটি মামলার পরিপ্রেক্ষিতে ৫৪ ধারা সংশোধনের বিষয়ে ২০১০ সালে হাইকোর্টের দেয়া রায়ে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার ও রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের প্রচলিত বিধান সংশোধন করতে নির্দেশ দেয়া হয়।এ জন্য বেঁধে দেয়া হয় ছয় মাসের সময়সীমা। ধারাটি সংশোধনের আগে এক্ষেত্রে কয়েকদফা নির্দেশনা অনুসরণ করতে সরকারকে বলা হয়। এর বিরুদ্ধে হাইকোর্টের রায়ে স্থগিতাদেশ চেয়ে আপীল বিভাগে আবেদন করে বিগত চারদলীয় জোট সরকার। ২০০৩ সালের ২ আগস্ট আপিল বিভাগ লিভ মঞ্জুর করলেও হাইকোর্টের ওই নির্দেশনাগুলো স্থগিত করেনি।
হাইকোর্টের ওই নির্দেশনার মধ্যে রয়েছে- ডিটেনশন (আটকাদেশ) দেয়ার জন্য পুলিশ কাউকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করতে পারবে না। কাউকে গ্রেফতার করার সময় পুলিশ তার পরিচয়পত্র দেখাতে বাধ্য থাকবে। গ্রেফতারের তিন ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতার ব্যক্তিকে এর কারণ জানাতে হবে। বাসা বা ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য স্থান থেকে গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তির নিকটাত্মীয়কে এক ঘণ্টার মধ্যে টেলিফোন বা বিশেষ বার্তাবাহক মারফত বিষয়টি জানাতে হবে। গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিকে তার পছন্দসই আইনজীবী ও নিকটাত্মীয়ের সাথে পরামর্শ করতে দিতে হবে। ওই ব্যক্তিকে আবার জিজ্ঞাসাবাদের (রিমান্ড) প্রয়োজন হলে ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশক্রমে কারাগারের অভ্যন্তরে কাচঘেরা বিশেষ কক্ষে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। কক্ষের বাইরে তার আইনজীবী ও নিকটাত্মীয় থাকতে পারবেন। কিন্তু সরকার এই নির্দেশনার কোনটিই অনুসরণ করেনি। গ্রেফতারের পর তাদের রমনা থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। তার আত্মীয়-স্বজন দেখা করতে গেলে তাদেরকে দেখা করার সুযোগ দেয়া হয়নি। রিমান্ডের ব্যাপারে মহামান্য হাইকোর্টের যে নির্দেশনা তার কোন কিছুই অনুসরণ করেনি সরকার। পুলিশ ছাত্রী সংস্থার ২০ জন ছাত্রীকে গ্রেফতারের পর বলেছিল তারা রাষ্ট্রবিরোধী কাজে জড়িত। গ্রেফতার অভিযানের সময় পুলিশ আলামত হিসেবে কুরআন শরীফ এবং সাহাবীদের জীবনী ও কয়েকটি কম্পিউটার জব্দ করে। একটি বৈধ সংগঠনের অফিসে কুরআন শরীফ রাখা, সাহাবীদের জীবনী রাখা কি কোন অপরাধ না রাষ্ট্রদোহিতা?
পত্র-পত্রিকা ও বিভিন্ন চ্যানেলের মাধ্যমে গোটা জাতি জানতে পেরেছে তাদেরকে ইসলামী ছাত্রী সংস্থার কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ইসলামী ছাত্রী সংস্থা কোন নিষিদ্ধ সংগঠন নয়। এটি একটি বৈধ সংগঠন। সুতরাং কোন বৈধ সংগঠনের কার্যালয় থেকে কাউকে গ্রেফতার করা সংবিধানে বর্ণিত মৌলিক অধিকারের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। সংবিধানে মৌলিক অধিকার সম্পর্কে যে সব বিষয়ের নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে তা হলো ঃ
ক) চলাফেরা করার অধিকার
খ) মত প্রকাশের অধিকার
গ) সংগঠন বা দল করার অধিকার
ঘ) সভা-সমাবেশ করার অধিকার
এগুলো সংবিধান স্বীকৃত মৌলিক অধিকার। পুলিশ এগুলোতে বাধা প্রদান করেই বরং রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধ করেছে। পাশাপাশি সরকার নারী অধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন করেছে। নারীর সবচেয়ে বড় অধিকার তার ইজ্জত, আব্রু, সম্মান ও নিরাপত্তার গ্যারান্টি। আমরা টিভিতে ও পত্রিকার ছবিতে দেখেছি গ্রেফতার করেছে পুরুষ পুলিশ। পরে নারী পুলিশ তাদেরকে গাড়িতে উঠিয়েছে। যা একজন নারীর প্রতি অবমাননা ছাড়া আর কিছু নয়। নারীদেরকে নারী পুলিশের মাধ্যমেই গ্রেফতার করতে হবে।
সাধারণত সুনির্দিষ্ট মামলায় সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে মামলার অধিকতর তদন্তের জন্য অভিযুক্ত ব্যক্তিকে রিমান্ডে নেয়া হয়। কিন্তু এই ২০ জন ছাত্রীকে রিমান্ডে নেয়ার ক্ষেত্রেও সরকারের ভূমিকা আইনসম্মত হয়নি। সাধারণত ৫৪ ধারায় কাউকে রিমান্ডে নেয়ার কোন সুযোগ নেই। সুনির্দিষ্ট অভিযোগে যদি মামলা হয় তাহলে কতগুলো শর্তের ভিত্তিতে রিমান্ড চাওয়া যায়। রিমান্ড চাইলেই রিমান্ড দেয়া যায় না। কতগুলো যুক্তিসঙ্গত কারণ থাকতে হবে।
যেমন ঃ
 কোর্টের সামনে সুনির্দিষ্ট মামলা ও সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকতে হবে। যেসব ছাত্রীদের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোন মামলা ছিল না সুনির্দিষ্ট অভিযোগও ছিল না। সুতরাং তাদের রিমান্ডে নেয়ার যুক্তিসংগত কোন কারণও নেই।
 মহিলাদের রিমান্ডে নিলে মহিলা পুলিশ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হতে হবে। এক্ষেত্রেও বিধি অনুসরণ করা হয়নি।
রিমান্ড চলাকালে মহামান্য হাইকোর্টের ২০১০ সালের নির্দেশিকা পূর্ণভাবে অনুসরণ করা হয়নি। যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে তারা সবাই উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রী, সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান। কোন সন্দেহভাজন ছাত্রী নয়। সরকারের এ ভূমিকার মাধ্যমে স্পষ্ট হয়েছে মানবতা ও মানবাধিকার পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে! সরকার শুধু অমানবিক আচরণই করেনি নারী অধিকার ও মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন করেছে। দেশের সচেতন নাগরিক, সুশীল সমাজ, বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থাসহ মুক্তিকামী মানুষকে এসব জুলুম অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। মানবাধিকার যেখানে লঙ্ঘিত হয় সেখানে দল, গ্রুপ বা রাজনৈতিক পরিচয় বিবেচ্য বিষয় নয়। বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে মানুষ হিসেবে মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকার নিশ্চিত করা। আজ নারীর সম্মান, মর্যাদা ও অধিকারের উপর যে আঘাত এসেছে সর্বোপরি মানবাধিকারের ওপর যে আক্রমণ হয়েছে তার বিরুদ্ধে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে এবং আইনের শাসন নিশ্চিত করতে হবে। তাই বলতে চাই-
‘এসো সত্য সাহসের সাথে লড়ি
এসো মিথ্যা ভেঙ্গে ইতিহাস গড়ি
এসো নব তরঙ্গ তারুণ্য, এসো প্রদীপ্ত প্রভাত
এসো দলি কঠিন প্রস্তর, এসো আগ্নেয় প্রপাত।’’
0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

পুলিশি গ্রেফতার, আতঙ্কিত জনগণ


নীতিগতভাবে রাষ্ট্রের জনগণের জানমাল রা ও রাজনৈতিক অধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্ব প্রধানত সরকারের। এ দায়িত্ব পালনের সময় জনস্বার্থের বদলে দলীয় এজেন্ডাকে প্রাধান্য দেয়া কাম্য নয়। এ ছাড়া বিরোধী দলের দাবি ও অধিকারের প্রতিও ল রাখা বাঞ্ছনীয়। রাষ্ট্রের অধীনে সবাই যেন ন্যায়বিচার ও মানবাধিকার পায়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। আইনের নির্দলীয় প্রয়োগ সুশাসনের শর্ত। এসব গণতান্ত্রিক অধিকারের বিলুপ্তি ঘটলে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং সমাজে হিংসা-সঙ্ঘাত সৃষ্টি হয়। ফলে জনজীবনে শান্তিশৃঙ্খলার ব্যাপক তির আশঙ্কা দেখা দেয় এবং দেশ অতল গহ্বরে পতিত হয়।

দেশে কখনো কোনো সঙ্কট, সমস্যা ও অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হলে তা বন্ধ করতে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, সমঝোতা ও ঐকমত্যের প্রয়োজন। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশে এহেন ঐকমত্য ও সদিচ্ছার বড়ই অভাব পরিলতি হচ্ছে। সরকার যে, আজ ইমেজ সঙ্কটে ভুগছে তার দায় তো সরকারেরই। তারা একের পর এক সঙ্কীর্ণ, দলীয় ও হীন উদ্দেশ্যে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়ে অপ্রয়োজনীয় কাজ করায় নানা দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়ে কার্যত জাতীয় জীবনকে ঠেলে দিয়েছে অনিশ্চয়তা ও বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে। সরকার তাদের জনপ্রিয়তার  পতন ঘটছে দেখে আজ দিশাহারা হয়ে গেছে। তাদের বিভিন্ন পদক্ষেপের পরিণাম তারা বুঝতে পারছে না। মতার রশি আঁকড়ে ধরতে রাষ্ট্রীয় শক্তি পুলিশ প্রশাসনকে যথেচ্ছ ব্যবহার করছে। ফলে পুলিশ মামলা, হামলায় লিপ্ত হয়ে প্রতিবাদী ও সত্যান্বেষীদের স্তব্ধ করে রাখার চেষ্টা করছে।
বর্তমান সরকারের আমলে মানুষকে গুম করে ফেলার মতো অপরাধ অনেক ঘটছে, যা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন হিসেবে বিবেচিত। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কর্মীরাও গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে নিখোঁজ ব্যক্তিদের উদ্ধার করে পরিবারের কাছে ফেরত দিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। ফলাফল কিছুই হয়নি। নাগরিকদের রা করার কথা রাষ্ট্রের, কিন্তু রাষ্ট্রই আজ অভিযুক্ত। যে গুম হয়ে যাচ্ছে তাকে আর ফিরে পাওয়া যাচ্ছে না, কিংবা কিছু দিন পর তার লাশ আবিষ্কৃত হচ্ছে। এর বিরুদ্ধে আন্দোলন করে আরো কয়েকজন লাশ হয়েছেন। যেখানে নির্যাতিত মানুষ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে নিরাপত্তা চায়, সেখানে এসব বাহিনীর নামে গুম, হত্যা চলছে। সাধারণ মানুষ নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে খুবই আতঙ্কিত।
পুলিশ স্বেচ্ছাচারিতায় লিপ্ত হয়েছে। যাকে ইচ্ছা তাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে এবং রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতনের পথ সুগম করা হচ্ছে। আগে পুলিশ এক-দুই দিনের রিমান্ডের আবেদন করত আদালতের কাছে। এখন সাত দিনের নিচে তারা রিমান্ডের আবেদন জানাতে যেন ভুলে গেছে। আর আদালত রিমান্ড মঞ্জুরে কার্পণ্য করেন না।
রিমান্ডের আসল উদ্দেশ্য অভিযুক্তকে জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে সত্য উদঘাটন। কিন্তু বর্তমানে রিমান্ডের অর্থ হচ্ছে, সব ধরনের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের মাধ্যমে অভিযুক্তের কাছ থেকে বলপূর্বক স্বীকারোক্তি আদায় করা। দেশের মানুষের কাছে এখন খুন ও গুমের মতো রিমান্ডও একটি ভয়ঙ্কর শব্দ।
রিমান্ডে নিয়ে অমানবিক নির্যাতন-নিপীড়নের মাধ্যমে স্বীকারোক্তি আদায় করা কতটুকু ন্যায়সঙ্গত এবং এর আইনগত ভিত্তিই বা কতটুকু, তা সর্বোচ্চ আদালতের বিবেচ্য বিষয়। এ দিকে পুলিশ বা র‌্যাব হেফাজতে মৃত্যু উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রায়ই পত্রিকা ও টিভি রিপোর্টে দেখা যায়, পুলিশের ঘুষ-দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, গণগ্রেফতার বাণিজ্য, ছিনতাইকারী, সন্ত্রাসী, মাদক সন্ত্রাসী ও তাদের গডফাদার-অপরাধীদের সাথে সহাবস্থান, বিপদে পড়লে নিরীহ-নিরপরাধ লোকজন পুলিশের সাহায্য না পাওয়া ইত্যাদি অভিযোগ প্রকাশিত হচ্ছে। কিন্তু পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপ অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিচ্ছে না। বর্তমান সরকারের আমলে পুলিশবাহিনীর কর্মকর্তা ও সদস্যরা আওয়ামী নেতাকর্মী, ক্যাডার নামধারী চাঁদাবাজ, ছিনতাইকারী, সন্ত্রাসীদের দমনে তেমন সক্রিয় নয়। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়নে জনগণের সেবা প্রদানে বা জননিরাপত্তাদানে গুরুত্ব দেয়ার পরিবর্তে টাকার পেছনে বেশি ছুটছে অনেক পুলিশ। এর হাতিয়ার হিসেবে গণগ্রেফতারের পথ বেছে নিয়েছে। তারা দাগি আসামি ধরার চেয়ে সাধারণ মানুষকে ধরতে বেশি উৎসাহী। রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগে গভীর রজনীতে বিভিন্ন বাসাবাড়িতে হানা দিয়ে সাধারণ মানুষকে আটক বা হয়রানি করছে বলে পত্রিকার রিপোর্টে জানা যায়। সন্ত্রাস দমনের নামে ইসলামি ব্যক্তিত্ব ও প্রতিষ্ঠান এবং দাড়ি-টুপি পরা ব্যক্তিদের হয়রানি করছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। সাধারণ মানুষকে গ্রেফতার করে অন্যায়ভাবে ভুয়া মামলায় জড়িয়ে দিচ্ছে। এর দরুন সাধারণ রিকশাওয়ালা থেকে শুরু করে সরকারি-বেসরকারি কর্মচারী পর্যন্ত আতঙ্কে দিনাতিপাত করছেন। এহেন রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস কারো জন্য কাম্য হতে পারে না। সময় এসেছে পুলিশের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের। তাদের উচিত ভক না হয়ে জনগণের রকের দায়িত্ব নেয়া। নতুবা এ সাধের ‘সোনার বাংলা’ ছারখার হয়ে যাবে।
0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

সুশাসনের সংজ্ঞা কী?


গোলাপ মুনীর

মাছের পচন শুরু হয় মাথা থেকে। তেমনি একটি দেশের ধ্বংসের সূচনা হয় তখন, যখন নিচ থেকে ওপর পর্যন্ত সর্বস্তরে দুর্নীতি ছেয়ে যায়। আমাদের দেশের দুর্নীতির সর্বব্যাপিতা বোধ হয় আজ সেই পর্যায়েই পৌঁছে গেছে। যে দিকেই তাকাই, সেখানেই দুর্নীতির সদর্প পদচারণা। দুর্নীতি যেন সবখানে অবাধ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যে ধরনের দুর্নীতি নামের কেলেঙ্কারির অভূতপূর্ব আকার-প্রকারের ঘটনা একের পর এক দেখতে পাচ্ছি, তা তো দেশবাসীর মধ্যে সে ধারণারই জন্ম দেয়। এ ধারণা আরো গাঢ় হয়, সদ্য প্রকাশিত টিআইবির খানা জরিপ প্রতিবেদনটি দেখলে।
বাংলাদেশের জাতীয় খানা জরিপ ২০১২ সালের ফলাফল বিশ্লেষণ করে দুর্নীতিবিষয়ক নজরদারি প্রতিষ্ঠান বলেছে, দেশের ৬৩ দশমিক ৭ শতাংশ সেবাগ্রহীতা কোনো না কোনোভাবে দুর্নীতির শিকার হচ্ছে। দেশের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত খাত হলো শ্রম অভিবাসন। সব গুরুত্বপূর্ণ খাতে দুর্নীতির ব্যাপকতা উদ্বেগজনক। আর ঘুষ আদায়ের হার আগের চেয়ে বেড়েছে। ঘুষের মাত্রা উদ্বেগজনক। উল্লেখ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্থানীয় সরকারপ্রতিষ্ঠান, ভূমি প্রশাসন, কৃষি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, বিচারিক সেবা, বিদ্যুৎ, ব্যাংক ব্যবসায়, বীমা, কর ও শুল্ক, শ্রম অভিবাসন, এনজিও, নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি, বিআরটিএ, ওয়াসা, পাসপোর্ট, বিটিসিএল প্রভৃতি খাত জরিপের অন্তর্ভুক্ত ছিল।
গত শুক্রবার প্রকাশিত টিআইবির এই খানা জরিপ মতে, শ্রম অভিবাসন খাতে দুর্নীতির হার ৭৭ শতাংশ। দ্বিতীয় বৃহত্তম দুর্নীতির খাত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা ৭৫.৮ শতাংশ। এরপর যথাক্রমে ভূমি প্রশাসন ৫৯ শতাংশ, বিচারিক সেবা ৫৭.১ শতাংশ, স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি ৩৩.২ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪০.২ শতাংশে এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে একই সময়ের তুলনায় ৩৪.১ শতাংশ থেকে বেড়ে উঠেছে ৫৪.৯ শতাংশে। টিআইবি বলেছে, গত ২০১১-১২ অর্থবছরের সেবা খাতে ঘুষ লেনদেন হয়েছে, যা ওই অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের ১৬.৬ শতাংশ এবং জিডিপির ২.৪ শতাংশ। জাতীয় জীবনে দুর্নীতিচিত্র যদি এতটা পরিব্যাপক হয়, তবে বিশ্ববাসীর কাছে আমাদের পরিচয় ‘দুর্নীতিবাজ এক জাতি’ ছাড়া কোনো কিছু হওয়ার কি কোনো অবকাশ আছে। সবচেয়ে বড় কথা, যারা দুর্নীতি প্রতিরোধ করার দায়িত্বে নিয়োজিত, তারাই দুর্নীতির সাথে গভীরভাবে সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়ছে বেশি থেকে বেশি হারে। সরকারি আমলা থেকে শুরু করে শীর্ষ সারির রাজনীতিবিদদের বড় বড় দুর্নীতি কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়ার বিষয়টি আজ ওপেন সিক্রেট। সরকারের ও রাজনৈতিক দলের ক্ষমতাসীন অংশের শীর্ষে যারা অবস্থান করছেন, তাদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সংশ্লিষ্টতা ছাড়া এসব বড় বড় দুর্নীতি সংঘটিত হতে পারে না। এর জায়মান প্রমাণ উদাহরণ তো আমাদের হাতের কাছেই মজুদ রয়েছে। শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, পদ্মা সেতু কেলেঙ্কারি, রেলওয়ে নিয়োগবাণিজ্য কেলেঙ্কারি, ভিওআইপি কেলেঙ্কারি, হলমার্ক কেলেঙ্কারি ইত্যাদি ধরনের মহাকেলেঙ্কারির সাথে কারা জড়িত তা আজ কারো অজানা নয়। ছেলে-বুড়ো বোধ-নির্বোধ সবাই জানে এসব কেলেঙ্কারির পেছনে কাদের হাত। কিন্তু দুঃখজনক সত্যিটা হলো, সরকারের শীর্ষপর্যায় থেকে এসব কেলেঙ্কারির নায়কদের বাঁচানোর মরিয়া প্রয়াস চলে। ফলে দুর্নীতি নামের বৃক্ষটির ডালপালা ক্রমেই বৃহত্তর পরিসরে ছড়িয়ে পড়ছে। জাতির কপালে লেপন করছে নতুন নতুন কলঙ্কতিলক।
আজ আমরা শুধু হলমার্ক কেলেঙ্কারি নামের বহুল আলোচিত ব্যাংক ঋণ কেলেঙ্কারির কথাই বারবার শুনছি। কিন্তু সোনালী ব্যাংকের এই ঋণ কেলেঙ্কারি শুধু হলমার্ক কেলেঙ্কারির মধ্যেই সীমিত নয়। এখন আমরা নতুন করে শুনছি সরকারি সোনালি ব্যাংকে আরো হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণ কেলেঙ্কারির কথা। অভিনব উপায়ে এসব কেলেঙ্কারির মাধ্যমে এ ব্যাংক থেকে অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন কয়েকজন ব্যবসায়ী। আবার নথিতে নাম পরিবর্তন করে অন্য নাম বসিয়ে ব্যাংকে কর্মকর্তারা বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করেছেন।
এর আগে হলমার্ক কেলেঙ্কারির মাধ্যমে সোনালী ব্যাংকের শত শত কোটি টাকা আত্মসাতের কথা শুনেছি। এখন শুনছি এর বাইরে আরো ৫৮টি প্রতিষ্ঠানকে নানামাত্রিক ঋণ কেলেঙ্কারির মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা দিয়েছে এই ব্যাংকটি। এর মধ্যে ৪০টি প্রতিষ্ঠানের কোনো অস্তিত্ব এখন খুঁজে পাচ্ছে না সোনালী ব্যাংক ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এই ৪০ প্রতিষ্ঠানের নামে দেয়া হয়েছে এক হাজার কোটি টাকা। বাকি ১৮টি কোম্পানির সাইনবোর্ড থাকলেও উৎপাদন বন্ধ বা অন্য ধরনের পণ্য তৈরি করে। প্রতিষ্ঠানগুলো অখ্যাত। এগুলোর মধ্যে কিছু প্রতিষ্ঠানের সাথে আবার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে হলমার্কের। দুর্নীতির এসব কেলেঙ্কারির পদ্ধতি প্রক্রিয়া অভিনব। এর সাথে অন্যান্য ব্যাংকের কর্মকর্তারাও জড়িত। অন্য ব্যাংকে স্থানীয় ঋণপত্র খোলা হয়েছে, আর সেইসব ঋণপত্রের বিল গ্রহণ করেছে সোনালী ব্যাংক। অর্থও পরিশোধ করা হয়েছে। অথচ এখন দেখা যাচ্ছে, ঋণপত্র জাল, কোম্পানিও ভুয়া। অতএব সহজেই অনুমেয় এসব অর্থ আদায়ের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞজনেরা বলছেন, এগুলো ঋণ না, সুস্পষ্ট জালিয়াতি। দুর্নীতি দমন কমিশন বলছে, হলমার্ক গ্রুপ ও অন্য পাঁচটি ব্যবসায়-প্রতিষ্ঠান সোনালী ব্যাংকের তিন হাজার ৫৪৭ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা শাখা থেকে। চলতি বছরের মে থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সময়ে জাল দলিলপত্র দেখিয়ে এই অর্থ আত্মসাৎ করা হয়। এর মধ্যে টি অ্যান্ড ব্রাদার্স ৩১৭ কোটি ৫২ লাখ টাকা, প্যারাগন নিট কম্পোজিট লিমিটেড ও এর সহযোগী প্রতিষ্ঠান ১৩ কোটি ৫৮ লাখ টাকা, ডিএন স্পোর্টস ও এর সহযোগী প্রতিষ্ঠান দুই কোটি ৮১ লাখ টাকা, নকশি নিট অ্যান্ড কম্পোজিট লিমিটেড ও এর সহযোগী প্রতিষ্ঠান ১০ কোটি ৮১ লাখ টাকা এবং খানজাহান আলী সোয়েটার লিমিটেড এক কোটি ১৪ লাখ টাকা নিয়েছে। শুনছি দুদক এসব দুর্নীতির সাথে জড়িত থাকার দায়ে ২৬ জন সোনালী ব্যাংক কর্মকর্তা ও পাঁচটি ব্যবসায়-প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করবে। মামলা করে এই অর্থ আদায় কতটুকু সম্ভব হবে, সে ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশের সমূহ অবকাশ রয়েছে। হলমার্কের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে সত্য, তবে শোনা যাচ্ছে সেখানে জালিয়াতি করে অর্থ আত্মসাৎ এমনভাবে করা হয়েছে, যাতে পুরো অর্থ আদায়ের সম্ভাবনা কম। অবাক করা ব্যাপার, দুর্নীতিবাজ ব্যাংক কর্মকর্তারা অবৈধ অর্থ আদায়ের মৌরুসি পাট্টা খুলে বসেছে। সোনালী ব্যাংক কর্মকর্তারা নাকি তথ্য ধামাচাপা দেয়ার জন্য হলমার্ক গ্রুপ থেকে নিয়মিত মাসোয়ারা নিতেন। এবার বুঝুন জালিয়াতির তীব্রতা কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে। সোনালী ব্যাংকের একাধিক পরিচালক পর্ষদকে ম্যানেজ করার জন্য হলমার্ক থেকে নিয়মিত ঘুষ নিতেন। তানভীর আহমদ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়ে এ কথা বলেছেন। বলেছেন তিনি নিজ হাতে এ ঘুষ দিতেন।
দুর্নীতি আর অনিয়মের আভাস পাওয়া যাচ্ছে এবার বেসিক ব্যাংকেও। এই ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী প্রধান কার্যালয়ের অনুমোদন ছাড়া কোনো চলতি হিসাবের বিপরীতে কোনো শাখা ব্যবস্থাপকের ক্ষমতা নেই টিওডি তথা টেম্পরারি ওভারড্রাফট সৃষ্টির। কিন্তু এর গুলশান শাখার শাখা ম্যানেজার সে নিয়ম লঙ্ঘন করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এ ছাড়া এই ব্যাংকে অন্য ধরনের অনিয়মের কথাও উঠেছে। এসব ঘটনা বলে দিচ্ছে, ব্যাংকগুলোতে দুর্নীতির যে উৎসব হচ্ছে, তা কার্যত ব্যাংক প্রতিষ্ঠানগুলোকে এক ধরনের সঙ্কটের দিকে ঠেলে দেবে। কারণ, একপর্যায়ে গ্রাহকেরা ব্যাংকগুলোর প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলবেন। ব্যাংক ব্যবসায়ে গ্রাহকদের আস্থাই হচ্ছে একটি ব্যাংকের গুরুত্বপূর্ণ পুঁজি।
যেখানেই হাত দেবেন, সেখানেই দেখবেন দুর্নীতি, অনিয়ম আর নৈরাজ্য। টেলিযোগাযোগ খাতের কথা যদি ধরি, তবে দেখা যাবে অনিয়ম আর নৈরাজ্যে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে এ খাত। দলীয় লোকদের শুধু টেন্ডারই নয়, স্থায়ীভাবে আর্থিক সুবিধা দিতে গণহারে টেলিযোগাযোগের বিভিন্ন সেবার লাইসেন্স দেয়া হয় সরকারি দলের লোকদের। এসব লাইসেন্স দেয়া নিয়ে সরকারের ভেতরেই বিরোধ দেখা দেয়। তবুও রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কারণে তা থেকে সরে আসতে পারেনি বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন তথা বিটিআরসি। দুর্নীতির মাধ্যমে বেড়েছে অবৈধ ভিওআইপি কল। একই সাথে ডুবে গেছে সরকারের দোয়েল ল্যাপটপের স্বপ্ন। অবৈধ ভিওআইপি কল অব্যাহত থাকার কারণে সরকার প্রতি বছর বঞ্চিত হচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকার রাজস্ব থেকে। আসুন রাজউকে, সেখানেও দুর্নীতির পাহাড়। রাজধানীতে ৪০ বছরে রাজউকের পাঁচ হাজার কোটি টাকার শতাধিক বাড়ি ও প্লট বেহাত হয়ে গেছে। ‘জালিয়াতির মাধ্যমে রাজউকের আরো ৩৮টি বাড়ি আত্মসাতের চেষ্টা করছে সঙ্ঘবদ্ধ সরকারি ভূমি দখলকারী সিন্ডিকেট। খবরে প্রকাশ, চক্রটি সম্প্রতি শত কোটি টাকা মূল্যের ধানমন্ডি ১ নম্বর সড়কের একটি সরকারি বাড়ি হাতিয়ে নিয়েছে। রাজউক এবং গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এসব বাড়ি রক্ষায় তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি বলে অভিযোগ। রাজউক ও মন্ত্রণালয়ের এক শ্রেণীর দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা বরং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সরকারি বাড়ি দখলকারীদের নানাভাবে সহায়তা করছেন।
এ দিকে অনেক বড় মাপের কেলেঙ্কারির ঘটনা নিয়ে যখন তুমুল হইচই, তখন অনেকটাই আমরা ভুলতে বসেছি ইউনিপেটুইউ, ডেসটিনি ও যুবক ইত্যাদির বহুল আলোচিত প্রতারণার বিষয়। এসব প্রতিষ্ঠানের প্রতারণার জালের ফাঁদে আটকা পড়ে ৭০ লাখ গ্রাহক আর্থিকভাবে কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এসব এমএলএম কোম্পানির চটকদার আকর্ষণীয় সব অফার পেয়ে বিনিয়োগ করে সর্বস্বান্তÍ হয়েছেন লাখ লাখ মানুষ। সরকারি হিসাব মতে, এমএলএম ব্যবসায়ের নামে ১১টি প্রতিষ্ঠান তাদের গ্রাহকদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে ১২ হাজার কোটি টাকা। তবে গ্রাহকদের অভিযোগ, শুধু ইউনিপেটুইউ, ডেসটিনি ও যুবকÑ এ তিনটি প্রতিষ্ঠানেই ২০ হাজার কোটি টাকারও বেশি বিনিয়োগ করেছেন গ্রাহকেরা। গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের অভিযোগ, প্রায় এক কোটি গ্রাহক এসব এমএলএম কোম্পানির ফাঁদে পা দিয়েছেন। বিনিয়োগকারীদের বেশির ভাগই স্বল্প ও মধ্য আয়ের পরিবারের লোক। গ্রাহকদের অভিযোগ, এমএলএম ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করা টাকার ৮০ শতাংশই বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্তরা নিয়মিত তাদের বিনিয়োগ করা টাকা উদ্ধারের তাগিদ দিচ্ছেন। কিন্তু হাতিয়ে নেয়া এই হাজার হাজার কোটি টাকা উদ্ধারের কোনো  উদ্যোগ নেই। বড় বড় ঘটনার আড়ালে চলে যাচ্ছে ডেসটিনির দুর্নীতি। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থা এখন এ ব্যাপারে নীরব।
সবচেয়ে বড় কথা, টিআইবির গত ১৪ অক্টোবরের একটি রিপোর্ট যখন বলেÑ বর্তমান জাতীয় সংসদের অর্ধেকেরও বেশি এমপি অপরাধকর্মে জড়িত। এ রিপোর্টে বলা হয়, বর্তমান জাতীয় সংসদের অর্ধেকেরও বেশি সংসদ সদস্য হত্যা, দখল, চাঁদাবাজি, কমিশনবাজি, সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ, অবৈধ প্রভাব বিস্তার, মিথ্যা তথ্যে প্লট বরাদ্দ, নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনসহ নানা অপরাধের সাথে জড়িত। তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলাসহ ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে। প্রতিবেদন মতে, সংসদের ৯৭ শতাংশ এমপি কোনো-না-কোনো নেতিবাচক কাজের সাথে জড়িত। তাদের মধ্যে অর্ধেকেরই বেশি অর্থাৎ ৫৩.৫ শতাংশ সরাসরি অপরাধ কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত। ২০.১ শতাংশ এমপির বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা রয়েছে। তবে তাদের মধ্যে ৫৩.৭ শতাংশ কোনো না কোনো ইতিবাচক কার্যক্রমের সাথে জড়িত। এই হিসাব মতে, বাকি ৪৬.৩ শতাংশের কোনো ইতিবাচক কাজ নেই। নেতিবাচক কাজগুলোর মধ্যে আছেÑ প্রশাসনিক কাজে প্রভাব বিস্তার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ, কমিশন আদায়, উন্নয়ন বরাদ্দের অপব্যবহার, হত্যা, দখলবাণিজ্য, অপরাধকর্মে জড়িত হওয়া বা সমর্থন দেয়া, সরকারি ক্রয় সিদ্ধান্তে প্রভাব বিস্তার, নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন, মিথ্যা তথ্য দিয়ে প্লট বরাদ্দ নেয়া।

এই যদি হয় অবস্থা। আর এসব এমপি যখন বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে গলাবাজি এই আদর্শ ওই আদর্শ বাস্তবায়নের কথা বলেন, দুর্নীতিমুক্ত দেশ গড়ার কথা বলেন আর অন্যদের দুর্নীতিবাজ আখ্যায়িত করে নিজেদের সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার কথা বলেন; তখন আমরা বুঝি না সুশাসনের সংজ্ঞা কী? তাই বিবেকবান মানুষের তাগিদ, এবার থামুন। অনেক হয়েছে। এবার থামলে সবার কল্যাণ। ক্ষতি কারো নয়।

শনিবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০১২

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

বিজয়ের মাসে রুদ্ধ বাংলাদেশ!


বিজয় শব্দটি শুনতে কার না ভালো লাগে? আর সেটি যদি হয় দেশ জয়ের, তাহলে তো কথাই নেই। ইতিহাস বারবার ফিরে আসে কিন্তু ইতিহাস থেকে কেউ শিা নেয় না। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ছিল বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় বিজয়। আর তারই ধারাবাহিকতায় প্রতি বছর আমরা বিজয় দিবস পালন করে আসছি।

এ মাসের বিজয়ের আনন্দ সাধারণ মানুষ মনেপ্রাণে উপভোগ করতে পারছে বলে মনে হয় না। বিজয়ের মাসে আমরা কী দেখছি? দেখার কথা ছিল সুখীসমৃদ্ধ বাংলাদেশ। সেখানে দেখলাম, বিশ্বজিতের রক্তে রাঙানো বাংলাদেশ। এই সরকার মতায় আসার পরপরই সরকারের ‘সোনার ছেলে’রা এতই বেপরোয়া হয়ে যায়, যার ফলে প্রধানমন্ত্রী ছাত্রলীগের অভিভাবকত্ব থেকে অব্যাহতি নিলেন। ছাত্রলীগকে আর সামলাতে পারলেন না। টেন্ডারবাজি থেকে শুরু করে এমন কোনো অপকর্ম নেই, যা তারা করেনি। চার বছরের শাসনামলের দিকে আমরা যদি তাকাই, তাহলে কী দেখতে পাই? হত্যা, খুন, ধর্ষণ, আর গুমের মতো জঘন্যতম ঘটনা।
মন্ত্রীরা সফলতার ঢোল বাজিয়ে সরকারকে যতই সাধুবাদ দিয়ে যাক না কেন, তা শুধু মিডিয়ায় শোভা পায়। কিন্তু দেশের সাধারণ মানুষের ভাগ্যোউন্নয়নের সূচক হতে পারে না। সরকার গণতন্ত্রের কথা বলে যেভাবে বিরোধী দলকে মামলা আর হামলা দিয়ে দমন করছে তার খেসারত একদিন দিতে হতে পারে।
অতীত কাউকে মা করে না। একটা গল্প ছিল এ রকমÑ হিন্দুদের এক রাজা ছিলেন। তিনি খুবই দয়ালু, ধর্মপরায়ণ ছিলেন। তার সাতটি সন্তান ছিল। একদিন ঈশ্বর তার সাতটি
সন্তানকে মেরে ফেললেন। তিনি ঈশ্বরকে প্রশ্ন করলেন, আমি তো কোনো দিন কোনো অন্যায় করিনি, তুমি কেন আমাকে এ রকম শাস্তি দিলে। ঈশ্বর বললেন, দেখো, তুমি যখন ছোট ছিলে তখন একদিন আমার সাতটি প্রজাপতিকে তুমি হত্যা করেছিলে। হিন্দু রাজা উত্তর দিলেন, ঈশ্বর আমি তো এটা খেলার ছলে করে ফেলছিলাম। তিনিও বললেন, আমিও তাই করেছি। যে কেউ অপরাধ করবে তার যেমন শাস্তি আছে আর ভালো কাজ করলে তার একটা পুরস্কারও আছে।
গত ২০ ডিসেম্বর লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবালের একটি লেখা পড়লাম। তিনি বিশ্বজিতের লাল শার্ট নামে যে লেখাটি লিখেছেন তার অংশবিশেষ তুলে ধরা হলো :
‘আমি কাপুরুষের মতো টেলিভিশন থেকে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পেরেছিলাম, কিন্তু খবরের কাগজ থেকে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারিনি। খবরের কাগজের ছবিগুলো না দেখে দ্রুত পৃষ্ঠাগুলো উল্টে ফেলার চেষ্টা করলেও ছবিগুলো আমার মাথায় গেঁথে গেছে, চার পাশ ঘিরে যখন ছাত্রলীগের কর্মীরা তাকে হত্যা করছে, সেই মুহূর্তেও বিশ্বজিতের চোখের দৃষ্টি আমাদের সবাইকে বাকি জীবন তাড়া করে বেড়াবে, সেই দৃষ্টিতে আতঙ্ক বা যন্ত্রণা ছিল না, এক ধরনের অসহায় ব্যাকুলতা ছিল, চার পাশে অসংখ্য মানুষ দৃশ্যটি দেখছে, কেউ তাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসছে না, সেটি নিয়ে হয়তো জগৎ সংসারের প্রতি একটা তীব্র অভিমান ছিল।
কোনো কোনো ছবিতে বিশ্বজিতের শার্টটি ছিল হালকা সাদা রঙের, আবার কোনো কোনো ছবিতে সেটি ছিল উজ্জ্বল লাল রঙের, সেটি নিয়েও আমার মনে একটা প্রশ্ন ছিল। ঘটনার সপ্তাহখানেক পর একটু সাহস সঞ্চয় করে আমি যখন খবরের কাগজগুলো পড়েছি, ছবিগুলো নতুন করে দেখেছি, তখন আমি বুঝতে পেরেছি বিশ্বজিৎ লাল শার্ট পরেনি, রক্তে ভিজে তার শার্ট লাল হয়েছিল। দেশের সব মানুষের মতো আমার মনেও অনেক প্রশ্ন জন্ম নিয়েছে, খবরের কাগজ, টেলিভিশনের ক্যামেরাম্যান আর সাংবাদিকেরা শুধু ছবি তুলেই তাদের দায়িত্ব পালন না করে বিশ্বজিৎকে বাঁচানোর চেষ্টা করেনি কেন? এত কাছে পুলিশ থাকার পরও তারা এগিয়ে গেল না কেন? যখন তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো তখন হিপোক্রেটিক শপথ নেয়া চিকিৎসকেরা তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করল না কেন? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর আমার জানা নেই।
আবার কিছু কিছু ভয়ঙ্কর প্রশ্নের উত্তর আমি অনুমান করতে পারি। যেমন ছাত্রলীগের যে কর্মীরা বিশ্বজিৎকে কুপিয়ে হত্যা করেছিল, তারা দেখেছে চার পাশ থেকে ক্যামেরায় তাদের ছবি তোলা হচ্ছে, তার পরও তারা কেন ক্যামেরার সামনে এই পৈশাচিক উন্মত্ততায় বিশ্বজিৎকে হত্যা করেছে? কিংবা প্রশ্নটি আরো ভয়ঙ্করভাবে করা যায়, চার পাশে ক্যামেরা ছিল বলেই কি তারা এত উন্মত্ত হয়েছিল, যেন সবাইকে দেখানো যায় তাদের সর্বগ্রাসী মতা, কত ভয়ঙ্কর?
সরকার বিশ্বজিৎকে নিয়ে যে নাটক করছে, তা আমরা সাধারণ মানুষ প্রত্যাশা করিনি। নাটকের শেষে সন্ত্রাসীদেরকে ধরতে হলো। জানি না তারা আবার কবে শীর্ষ সন্ত্রাসী বিকাশের মতো ছাড়া পেয়ে যায়। দুনিয়ার আদালতে বিশ্বজিতের খুনিরা পার পেলেও পরকালের আদালতে পার পাবে না।
হরতাল একটি গণতান্ত্রিক অধিকার। সরকার অতীতকে ভুলে গিয়েছে বিধায় বিরোধী দলের যেকোনো রাজনৈতিক কর্মসূচিতে বাধা দিচ্ছে। আজ যারা মতায় আছেন,  যখন তারা বিরোধী দলে ছিলেন, ১৭৩ দিন হরতাল দিয়েছিলেন। আজ যারা বিরোধী দলে তারা যদি আবার মতায় এসে হরতালের বিরুদ্ধে লাঠিপেঠা করেন, মিটিং-মিছিল করতে না দেন, তখন বর্তমান সরকার প্রধান কী বলবেন? বিজয়ের মাসে যে কয়টি হরতাল হয়েছে তার মধ্যে ‘ইতিহাস’ হয়ে থাকবে বামপন্থীদের হরতালটি। ভাবতে অবাক লাগে, সরকার কী করে গণবিচ্ছিন্নদের হরতালকে সমর্থন দিলো। আইনে একটি কথা চালু আছে, আইন সবার ক্ষেত্রে সমান। কিন্তু সরকারের দ্বিমুখী আচরণ দেখে মনে হলো, তা নয়।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিরোধী দলকে বললেন বামপন্থীদের হরতাল থেকে শিা নেয়ার জন্য। আমরা মন্ত্রীকে বলতে চাই, আপনার দল যখন বিরোধী দলে, তখন শাহবাগে গাড়িতে আগুন লাগিয়ে পাঁচজনকে হত্যা করা হলো। আমরা অন্যকে শিা নিতে বলতে খুবই ওস্তাদ কিন্তু নিজে শিা নিই না। বামপন্থীদের হরতালের দিন মিডিয়ার বদৌলতে গোটা জাতি দেখেছে যে, পুলিশ কিভাবে রাজপথের রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছিল, সরকার বিআরটিসি গাড়িগুলো বন্ধ করে দিয়েছিল। বিরোধী দলের হরতালের দিন ঝুঁকি নিয়ে হলেও গাড়িগুলো চলত, সেদিনের হরতালে সে গাড়িগুলো রাস্তায় নামতেই দেয়া হয়নি। এ থেকেই কি প্রতীয়মান হয় না যে, সরকার হরতাল শত ভাগ সমর্থন করে চরম নীতিহীনতার পরিচয় দিয়েছে?
যে পুলিশের হরতালের নাম শুনলেই গায়ে ‘আগুন লেগে যায়’, তাদের সামনে শাহবাগের মোড়ে বামপন্থীরা গান গেয়ে হরতাল পালন করল, গাড়ি ভাঙচুর করল অথচ তারা নীরব দর্শক ছিল। এটি জাতির জন্য এক অশনি সঙ্কেত। দুই দিন পরে ইসলামি সমমনা ১২ দল যখন হরতাল দিলো তখন পুলিশ তাদের করল লাঠিপেঠা। সে দৃশ্য বিবেকবান মানুষের হৃদয়কে সত্যিই ভাবিয়ে তুলবে।
যুদ্ধাপরাধের বিচারের নামে সরকার যা করছে স্কাইপ কেলেঙ্কারির মাধ্যমে অবশেষে তা জাতির সামনে ফাঁস হয়ে গেল। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী স্কাইপ কেলেঙ্কারির সংলাপ আমার দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার পর একটি অনুষ্ঠানে বলেছেন, নোবেল পুরস্কার যদি দেয়া যেত তাহলে আমার দেশের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে দেয়া উচিত। কারণ সাংবাদিকতায় তিনি খুব সাহসী ভূমিকা পালন করেছেন।
বিচারপতির স্কাইপ সংলাপ আমার দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই  সরকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতারের চেষ্টা করছে। তিনি পত্রিকা কার্যালয়ে বন্দীর মতোই অবরুদ্ধ হয়ে আছেন। এ থেকে কি বলা যায় না যে, সরকার সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকেও খর্ব করার চেষ্টা করছে। গত ২০ ডিসেম্বর আমার দেশ পত্রিকায় মন্তব্য প্রতিবেদনে মাহমুদুর রহমান এক অবরুদ্ধ চান্স সম্পাদকের জবানবন্দীতে মিডিয়াতে টকশোর সম্পর্কে যে তথ্য দিয়েছেন তা প্রণিধানযোগ্য। সরকারের লেজুড় টকশো হোস্ট এবং ‘দলবাজ’ বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক অবলীলাক্রমে দাবি করছেন, ইকোনমিস্টে স্কাইপ সংলাপবিষয়ক সংবাদ নাকি ছাপাই হয়নি। কেবল আমার দেশ সংলাপ প্রকাশ করে মহাঅপরাধ করে ফেলেছে। মিথ্যাচারেরও সীমা থাকা দরকার। ইকোনমিস্টে কেবল সংবাদই ছাপা হয়নি, সে সংখ্যাটি ঢাকা বিমানবন্দরে পৌঁছানো মাত্র সরকারের এজেন্সি তার সব কপি বাজেয়াপ্ত করেছে।
সেসব মহাপণ্ডিত অভিমত দিচ্ছেন যে, আমার দেশ কথোপকথন ছাপলেও সংশ্লিষ্ট বিচারপতির মতামত নিয়ে ছাপা উচিত ছিল। ইকোনমিস্ট সেই কাজটি করতে চাওয়াতেই তো বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম রুল দিয়ে এর কণ্ঠরোধের ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলেন। আমার দেশ তাকে জিজ্ঞেস করতে গেলে কি আর রে ছিল?
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে ময়লার গাড়ি পোড়ানোর ভুয়া মামলায় গ্রেফতার করা হলো। অন্য দিকে কারাবন্দী নন, কিন্তু অন্যদের মতো মুক্ত স্বাধীনও নন জাতীয়তাবাদী দলের দফতর সম্পাদক অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী। অবরুদ্ধ হয়ে আছেন দলের প্রধান কার্যালয়ে। গত ৯ ডিসেম্বর ১৮ দলীয় জোটের অবরোধের দিন থেকেই আটকা পড়ে আছেন তিনি। ১৩টি দিন পার হয়ে গেছে রিজভীর অবরুদ্ধ দিনযাপনের। অর্ধাহারে বা রুটি-বিস্কুট খেয়ে দিন কাটছে তার। নেই ঘুমোনো বা গোসলের ব্যবস্থা। এভাবেই মানবেতর জীবন যাপন করছেন বরেণ্য এই সাবেক ছাত্রনেতা।
আমরা সরকারকে বলব, বিরোধী দলের সব রাজবন্দীকে মুক্তি আর নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন দিয়ে আগামী দিনে জাতিকে সুন্দর নির্বাচন উপহার দিন। দেশকে রা করুন সঙ্ঘাতের হাত থেকে।
0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষের বিতর্ক



ডা. ও য়া জে দ এ খা ন

সুদীর্ঘ চার দশক পর এখন বাহাস-বিতর্ক চলছে দেশের স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি নিয়ে। রাষ্ট্র ও সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তি, একশ্রেণীর রাজনীতিক এমনকি কথিত বুদ্ধিজীবীরাও প্রতিনিয়ত সভা-সেমিনার, টিভি টক শো ও পত্রপত্রিকার লেখনীতে স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ শক্তির প্রসঙ্গ টেনে জাতিকে বিভক্তির দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। জাতীয় ঐক্য বিনষ্টের চেষ্টা করছেন নিতান্ত রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের উদ্দেশ্যে। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালীন হাতেগোনা কিছু ব্যক্তি ছাড়া ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে গোটা জাতি ছিল ঐক্যবদ্ধ। অর্থনৈতিক সমতা, আইনের শাসন, গণতন্ত্র, সামাজিক ন্যায়বিচার, ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখে তারা কেন্দ্রীভূত হয়েছিল একটি বিন্দুতে। পুরো জাতি একক শক্তিতে বলীয়ান হয়ে প্রাণপণ যুদ্ধ করে চিরতরে বিতাড়িত করেছে পাক হানাদার বাহিনীকে। অর্জন করেছে স্বাধীনতা। আর যারা একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতা করেছিল স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে সময়ের ব্যবধানে তারাও মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে মূল স্রোতধারায়। যেমনটি ঘটেছে বিশ্বের স্বাধীনতা অর্জনকারী প্রতিটি দেশ ও জাতিগোষ্ঠীতে। স্বাধীনতার একচল্লিশ বছর পর ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, স্বার্থের সংঘাত, ধর্মীয় মূল্যবোধ, রাজনৈতিক আদর্শ ও মতপার্থক্যের কারণে অসংখ্য শ্রেণীগোষ্ঠীর আবির্ভাব ঘটেছে। গড়ে উঠেছে অসংখ্য রাজনৈতিক দল ও মোর্চা। গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্রে এটাই স্বাভাবিক। এতে দোষের কিছু নেই। ক্ষমতার রাজনীতিতে এসব রাজনৈতিক দলের মধ্যে এখন প্রতিদ্বন্দ্বিতা, প্রতিযোগিতা ও বিরোধিতা প্রকটভাবে বিদ্যমান। কিন্তু কোনো রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠী বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে অসম্মান বা অস্বীকার করে পুনরায় পাকিস্তান বানাতে চাচ্ছে এমন কোনো ধৃষ্টতার নজির নেই। নেই বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন। স্বাধীনতাবিরোধী প্রকাশ্য বা গোপন কোনো তত্পরতাও চলছে না দেশে। তাহলে এখানে স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ শক্তির প্রসঙ্গ আসে কীভাবে? যারা নিজেদের স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি বলে দাবি করে রাজনীতির ময়দান গরম করতে চেষ্টারত তারা কি একবারও ভেবে দেখেছেন, তাদের দাবির পক্ষ-বিপক্ষের মধ্যে পাল্লা কোনদিকে বেশি ভারী? ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ মনে করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে যতটুকু অবদান তার পুরোটাই তাদের। এদেশের মালিকানা এবং কর্তৃত্ব একমাত্র আওয়ামী লীগের। দেশ শাসন, শোষণ ও ভোগ-দখল করার একমাত্র এখতিয়ার আওয়ামী লীগের। এখানে অন্য কোনো রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠীর কোনো অধিকার নেই। আওয়ামী লীগ এবং তাদের সমর্থক একটি শ্রেণী হচ্ছে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি। আর গোটা দেশের মানুষ তাদের চোখে স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তি। রাজাকার আলবদর। আর তাই যদি সত্যি হয় তাহলে বলতে হবে দেশের দুই-তৃতীয়াংশেরও অধিক মানুষ আজ স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তিতে পরিণত হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর ভোট-ব্যাংকের দিকে তাকালেই বিষয়টি অনেকটা স্পষ্ট হয়ে যাবে। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দুই-তৃতীয়াংশেরও অধিক আসনে বিজয়ী হয়েছে আওয়ামী লীগ। এর আগের নির্বাচনে বিএনপিও দুই-তৃতীয়াংশের অধিক আসনে জয়লাভ করে। দেশের মোট জনসংখ্যার ৭০ শতাংশের সমর্থন রয়েছে এই দল দুটির ওপর। বিগত নির্বাচনগুলোতে জনরায়ের পরিসংখ্যান অনুযায়ী আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ভোট-ব্যাংক প্রায় সমান সমান। মোট কথা, দুটি দলেরই স্থিত জনসমর্থন বরাবর ৪০ শতাংশের নিচে।
দেশের রাজনীতি ডান ও বাম ধারায় বিভক্ত। ডান রাজনীতির ধারায় রয়েছে বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াতসহ ইসলামী ও মধ্যপন্থী দলগুলো। পক্ষান্তরে আওয়ামী লীগ, জাসদ ও কম্যুনিস্ট পার্টিসহ ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সাইনবোর্ডসর্বস্ব কিছু দল বাম রাজনীতির ধারক-বাহক। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ্য যে আওয়ামী লীগের বড় একটি অংশ দলীয় নীতি-আদর্শে বিশ্বাসী হলেও তারা নিজেদের বামপন্থী মনে করেন না। সে হিসাবে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশই বলতে হবে ডানপন্থী। বাংলাদেশের একচল্লিশ বছরের ইতিহাসে সিংহভাগ সময় ডানপন্থীদের শাসন এমনটিই প্রমাণ করে। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি ছিল প্রায়ই শতভাগ। আজকের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এবং জাতীয় পার্টির আত্মপ্রকাশই তখন ঘটেনি। চার দশক পরে তারা কী করে স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি হয়? আর আজকে যাদের স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি বলে চিহ্নিত করার চেষ্টা চলছে তাদের একটি বড় অংশের জন্ম স্বাধীন বাংলাদেশে। সবকিছু মিলে বিষয়টি এমন দাঁড়ায় যে বিগত ৪১ বছরে স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি পক্ষের শক্তির চেয়ে অনেক বেশি বড়। তাহলে কি আমরা ধরে নেব দিন যত অতিক্রান্ত হবে স্বাধীনতার বিপক্ষ ততই শক্তিশালী হতে থাকবে। কিন্তু প্রকৃত অবস্থা তো তা নয়। বাংলাদেশের কোনো নাগরিকই এখন স্বাধীনতার বিপক্ষে নয়। তাছাড়া বিপক্ষে গিয়ে তো কোনো লাভ নেই। বাংলাদেশকে আর কখনোই যে পাকিস্তান বানানো যাবে না তা সবারই জানা।
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালীন যারা পাকবাহিনীর পক্ষাবলম্বন করে মানবতাবিরোধী অপরাধে লিপ্ত হয়েছিল তাদের কথা ভিন্ন। এছাড়া রাজনৈতিক কারণে তারা তখন স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছে এই ভেবে যে পাকিস্তান ভেঙে গেলে তা ভারতের অধীনে চলে যাবে। মুসলমানরা পুনরায় পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হবে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাদের সে ধারণা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। পরবর্তী সময়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশকে তারা যেমন মেনে নিয়েছে তেমনি তারা ভোগ করেছে সব নাগরিক অধিকার। পরাধীনতার নাগপাশ ছিন্নকারী বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্রেই মুক্তি সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধকালীন এক্টি শ্রেণী স্বাধীনতাবিরোধী শিবিরে সমবেত হয়। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের সময় কংগ্রেসের অনেক নেতাকর্মী-সমর্থক ভারতের স্বাধীনতা চাননি। মুসলিম লীগের অনেক নেতাকর্মী চাননি পাকিস্তান হোক। কিন্তু ভারত ও পাকিস্তান স্বাধীন দুটি রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হলে স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান নেয়ার কারণে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের সেসব নেতাকর্মীকে ভারত কিংবা পাকিস্তানে কখনোই স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি বলে চিহ্নিত করা হয়নি।
জর্জ ওয়াশিংটনের নেতৃত্বে ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে আমেরিকায় মুক্তিযুদ্ধ চলে ১৭৭৫ থেকে ১৭৮৩ সাল পর্যন্ত। টানা ৮ বছরের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্নভাবে প্রাণ হারায় ২৫ হাজার আমেরিকান। ইউরোপের বৃহত্ শক্তিগুলো এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। আমেরিকার মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় সমর্থন ছিল মাত্র ৪০ শতাংশ মানুষের। এই যুদ্ধে ২০ শতাংশ আমেরিকান শত্রুপক্ষ ব্রিটিশদের পক্ষাবলম্বন করে। আর নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করে ৪০ শতাংশ মানুষ। কিন্তু আমেরিকা স্বাধীনতা লাভের পর বিরোধিতাকারী হাতেগোনা কিছু মানুষ কানাডায় পালিয়ে যায়। বাকি সবাই পক্ষ-বিপক্ষ ভুলে অভিন্ন আমেরিকান জাতি হিসেবে দেশ গড়ায় আত্মনিয়োগ করে। শুধু কি তাই, ১৮৬১ সাল থেকে ১৮৬৫ সাল পর্যন্ত আমেরিকার গৃহযুদ্ধে প্রায় ৭ লাখ মানুষ প্রাণ হারায়। গৃহযুদ্ধের বর্ণবৈষম্য, বিদ্বেষ ও ভয়াবহতা ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। ভেঙে পড়ে গোটা দেশের আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো। গৃহযুদ্ধের অবসান শেষে গোটা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেন আমেরিকার অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন। সব বিভেদ বিভ্রান্তি ভুলে গিয়ে সবাইকে ক্ষমা করেন তিনি। নবউদ্যমে শুরু হয় আমেরিকার অগ্রযাত্রা যা এখনও অব্যাহত রয়েছে। ভিয়েতনামে ১৯৬৫ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত এক দশকের যুদ্ধে আমেরিকার ৬০ সহস্রাধিক সৈন্য প্রাণ হারিয়েছে। আহত হয়েছে ৩ লক্ষাধিক। তারপরও যুদ্ধের ২৫ বছর পর আমেরিকান প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ভিয়েতনাম সফরে গিয়ে ২০০০ সালের ১৭ নভেম্বর হ্যানয় ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে দেশটির অবিসংবাদিত নেতা হোচিমিনের প্রতিকৃতির পাদদেশে দাঁড়িয়ে অতীতের দুঃখ-বেদনা, বিরোধ এবং তিক্ততা ভুলে গিয়ে একটি উন্নত, সুন্দর, শান্তিপূর্ণ ও সম্ভাবনাময় ভবিষ্যত্ গড়ার আহ্বান জানান। আমেরিকান প্রেসিডেন্টরা বরাবরই জাতীয় ঐক্যের প্রতিভূ হিসেবে কাজ করেন। একারণেই আমেরিকা আজ বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত ও শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পর জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে দেশ গড়ার লক্ষ্যে মূল শত্রু হানাদার পাক বাহিনীকে ক্ষমা করে দেন তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের প্রাক্কালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘আমরা প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধ গ্রহণের নীতিতে বিশ্বাসী নই। তাই মুক্তিযুদ্ধের শত্রুতা করে যারা দালাল আইনে অভিযুক্ত ও দণ্ডিত হয়েছিলেন তাদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়েছে।’ ১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে আয়োজিত সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের এক জনসভায় প্রধানমন্ত্রী বললেন, ‘ভায়েরা, বোনেরা আমার, আমরা চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু একটা ওয়াদা আমি রাখতে পারি নাই। জীবনে যে ওয়াদা আমি করেছি জীবন দিয়েও সে ওয়াদা আমি পালন করেছি। আমি ওয়াদা করেছিলাম তাদের বিচার করব। এই ওয়াদা আপনাদের পক্ষ থেকে খেলাপ করেছি। আমি তাদের বিচার করিনি। আমি তাদের ছেড়ে দিয়েছি এ জন্য যে এশিয়ায়, দুনিয়ায় আমি বন্ধুত্ব চেয়েছিলাম।’ মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে সরাসরি পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বনকারী আমেরিকা, চীন ও মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপন করে তত্কালীন ক্ষমতাসীনরা ধন্য হলেও নিজ দেশ ও জাতি-গোষ্ঠীর মানুষকে অকারণে স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি বলে গালমন্দ করছে তাদের উত্তরসূরিরা। এতে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে বিভেদ, বিদ্বেষ, প্রতিহিংসাপরায়ণতা যেমন বাড়ছে তেমনি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে দেশের স্বাভাবিক উন্নয়নের ধারা। স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ শক্তির ধুয়ো তুলে দেশ ও জাতিকে দ্বিধাবিভক্ত করে আর যাই হোক, স্বাধীনতার সুফল সাধারণ মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছানো যাবে না।
নির্বাচনে ভোট-ব্যাংকের হিসাব-নিকাশ এবং বিজয়ী হয়ে পুনরায় ক্ষমতাসীন হওয়ার অপকৌশল হিসেবে আওয়ামী লীগ বিএনপি-জামায়াত জোট ভেঙে দিতে স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ বিতর্ক ইস্যুকে সামনে নিয়ে আসে। বিগত ৪ বছরের অপশাসন, দুর্নীতি, অনিয়ম এবং ক্রমাবনতিশীল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে ধামাচাপা দিতেই সরকারদলীয় নেতাকর্মী এবং মন্ত্রীরা এসব ইস্যুতে এতটা সোচ্চার হয়ে উঠেছেন। স্বাধীন বাংলাদেশে যাদের জন্ম, এমনকি তাদের সন্তানরা আজ যারা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে বিশ্বাস করে না তাদের স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি বলে আখ্যায়িত করে দেশছাড়া করার হুমকি দিচ্ছেন সরকারের মন্ত্রী বাহাদুররা। ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল আয়তনের বাংলাদেশে কোটি কোটি মানুষ কোনো না কোনোভাবে আত্মীয়তার সম্পর্কে সম্পর্কিত। একাত্তরে একই পরিবারে রাজনৈতিক মতাদর্শের ভিন্নতা দেখা গেছে। পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বনকারী শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন এমন পিতা তার পুত্রকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে বাধা সৃষ্টি করতে পারেনি। স্বাধীন বাংলাদেশে অনেক আওয়ামী লীগারের ছেলেমেয়ে এখন শিবিরের সক্রিয় কর্মী। আবার অনেক জামায়াত নেতার সন্তান ছাত্রলীগের কর্মী হয়ে উঠেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মেয়ের শ্বশুরের পরিবার বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোর বিরোধিতা করেছে একাত্তরে একথা সর্বজনবিদিত। শেখ হাসিনা এক মন্তব্যে বলেছেন, তার মেয়ের শ্বশুরবাড়ির সদস্যরা রাজাকার ছিলেন। কিন্তু যুদ্ধাপরাধী নন। অথচ এই পরিবারের সদস্য, তার মেয়ের শ্বশুর বর্তমান মন্ত্রিপরিষদের সদস্য। স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তির তালিকা থেকে তাদের নাম মুছে গেছে। আর যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি তাদের এই তালিকাভুক্ত করে দেশান্তরী করার হুঙ্কার দেয়া হচ্ছে। আজ এটাই বাস্তবতা।
স্বাধীন বাংলাদেশের সিংহভাগ মানুষ একই নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠীভুক্ত। তাদের ভাষা এক। সিংহভাগ মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাসও অভিন্ন। দেশটির দুটি বিশাল সমুদ্রবন্দরসহ রয়েছে বিপুল জনশক্তি। তারপরও দেশটি কাঙ্ক্ষিত সাফল্য লাভের দোরগোড়ায় পৌঁছতে পারছে না একমাত্র রাজনৈতিক বিভক্তি, দেশপ্রেম ও দুরদর্শী ত্যাগী জাতীয় নেতৃত্বের অভাবে। অথচ আমাদের কাছাকাছি দেশ মালয়েশিয়া ভিন্নধর্মী, ভাষাভাষী ও জাতিগোষ্ঠীর মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে তরতর করে পৌঁছে গেছে উন্নয়নের শিখরে। সময়ের বিবর্তনে বার্লিন প্রাচীর গুঁড়িয়ে দিয়ে জার্মানসহ বিভিন্ন জাতি যখন একীভূত হচ্ছে, ঐক্যবদ্ধ করছে বিভক্ত জাতিকে, বাংলাদেশে তখন ঐক্যবদ্ধ জাতির মাঝে বিভক্তির প্রাচীর তুলে চলছে জাতীয় ঐক্য বিনষ্টের অশুভ খেলা। আত্মঘাতী এই খেলা দেশ ও জাতিকে ভয়াবহ সংঘাত ও বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। প্রতিহিংসার রাজনীতি যেভাবে ক্রমান্বয়ে প্রকট হয়ে উঠেছে এ ধারা অব্যাহত থাকলে অদূর ভবিষ্যতে জাতিকে চরম মূল্য দিতে হবে। কোনো রাজনৈতিক দল বা সরকারের কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করা মানে স্বাধীনতার বিরোধিতা করা বা রাষ্ট্রদ্রোহিতা নয়। দেশে সরকার আছে, বিরোধী রাজনৈতিক দল ও প্রতিপক্ষ আছে। স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তি বলে কিছু নেই এখন।
লেখক : নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক বাংলাদেশ-এর সম্পাদক
0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

অনিশ্চয়তার পথে রাজনীতি ও নির্বাচন



মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন

অর্থনীতি, ব্যবসানীতি, সমাজনীতিসহ সব নীতির নিয়ামক শক্তি হলো রাজনীতি। রাজনীতি অনিশ্চিত তো সবকিছুই অনিশ্চিত। সুস্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, এক ভয়ানক অনিশ্চয়তার পথে ধাবিত হচ্ছে দেশের চলমান রাজনীতি।
প্রকাশ্যে হাজার হাজার মানুষ ও র্যাব-পুলিশের সামনে বিশ্বজিত্ দাসকে চাপাতি দিয়ে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে তাত্ক্ষণিক গ্রেফতার, নির্ভীক সাংবাদিক মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দেয়া, খালেদা জিয়াকে একের পর এক গ্রেফতারের হুমকি প্রদান—নিঃসন্দেহে রাজনীতিতে তাত্পর্যপূর্ণ ঘটনা। এতে সহজেই প্রতীয়মান হয়, সরকারের পরবর্তী পদক্ষেপটা কী হবে এবং দেশের রাজনীতি কোন দিকে ধাবিত হবে। সরকারের রাজনৈতিক পদক্ষেপ গভীর পর্যবেক্ষণে রেখেই তৈরি করতে হবে বিরোধী দলের আগামী দিনের ‘রাজনৈতিক স্ট্র্যাটেজি’।
নির্দলীয় সরকার ইস্যুতে বিরোধী জোটের সঙ্গে শাসক দলের দূরত্ব এখন চরমে। এই ইস্যুতে সরকারের পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট ঘোষণা না আসা পর্যন্ত বিরোধী জোট তার অবস্থান থেকে এক চুলও সরবে না। সরকারও তার সিদ্ধান্তে অটল। এই পরস্পর বিপরীতমুখী অবস্থায় কার্যত রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে সুষ্ঠু নির্বাচনের কোনো পথ বেরিয়ে আসছে না।
আগামী নির্বাচনে পরাজয়ের ব্যাপারটি শাসক দলের মনে হয় নিশ্চিত হয়ে গেছে। তাই ‘রাজনৈতিক স্ট্র্যাটেজি’ নির্ধারণ তাদের জন্য সহজ হচ্ছে। হয় দলীয় সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচন, না হয় অন্য বিকল্প কিছু—এ চিন্তা মাথায় নিয়ে তারা অগ্রসর হচ্ছে বলে প্রতীয়মান হয়। তারা বিরোধী দলের রাজনীতি স্তব্ধ করে দিতে চায়, কণ্ঠরোধ করতে চায় গণমাধ্যমের; দেশকে নিয়ে যেতে চায় সেই সত্তরের দশকের অন্ধকার রাজনীতির যুগে।
দেশে কোনো নির্বাচনের পরিবেশ তৈরির আলামত পরিলক্ষিত হচ্ছে না। বরং দেশকে উল্টো সুকৌশলে নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলার দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে, একটা ঘোলাটে পরিস্থিতি সৃষ্টি করে জরুরি অবস্থা জারির প্রেক্ষাপট তৈরি করা হচ্ছে বলে প্রতীয়মান হয়।
দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিরোধী নেতাকর্মীদের ওপর হামলা হচ্ছে, রক্ত ঝরছে; মানুষ আহত-নিহত হচ্ছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলের কার্যালয় পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে, পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষালয়ও। আগামী নির্বাচন প্রশ্নে দেশে এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে, রাজনীতির আকাশে শুধুই অশনিসঙ্কেত; সবকিছু নিক্ষিপ্ত হচ্ছে এক সর্বগ্রাসী সঙ্কটের আবর্তে। মানুষের মনে আতঙ্ক, অনিশ্চয়তা, অবিশ্বাস ও উদ্বেগ-উত্কণ্ঠা—কোন দিকে যাচ্ছে দেশ, কী হতে যাচ্ছে দেশে। দেশ কি গৃহযুদ্ধের মুখোমুখি অবস্থায় এসে উপনীত হয়েছে? প্রথিতযশা সাংবাদিক ও বিজ্ঞ রাজনীতিবিদরা তো এমনই আশঙ্কা করছেন। আগামী নির্বাচন প্রশ্নে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা না হলে গৃহযুদ্ধের পথেই দেশ ধাবিত হওয়ার আশঙ্কা প্রবল।
চার বছরের মাথায় এসে হাজারো প্রশ্ন ও সমালোচনার মুখোমুখি সরকার। মানুষের স্বপ্ন এখন দুঃখ ও বেদনায় পরিণত হয়েছে। তাই অবস্থা বুঝে সরকার বেপরোয়া হয়ে অবর্ণনীয় দমন-পীড়ন চালাচ্ছে এবং এটাকেই তারা ক্ষমতায় টিকে থাকা ও আবার ক্ষমতায় যাওয়ার প্রধান মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছে। দেশের কোথাও কিছু ঘটলে সরকার বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের অকারণে হয়রানি, মামলা ও গ্রেফতার করে চরম হেনস্থা করছে। সরকারের দমননীতির মুখে বেপরোয়া পুলিশের হাতে রাস্তায় বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা মার খাচ্ছেন, নাজেহাল হচ্ছেন এবং রিমান্ডে যাচ্ছেন। যত নাজেহাল এবং নির্যাতন করুক, এতে শেষ রক্ষা হবে না; রাজনীতিবিদরা রুখে দাঁড়ালে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা সরকারকে করতেই হবে। নয়তো বাধাগ্রস্ত হতে পারে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক ধারা। মানুষ হারাতে পারে তাদের ভোটের অধিকার, দেশ হতে পারে ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন।
দেশকে অপূরণীয় ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করতে গঠনমূলক, সহনশীল ও পরিপকস্ফ রাজনীতির কোনো বিকল্প নেই। আপনি কত বড় রাজনীতিবিদ সেটি বড় কথা নয়, আপনার কর্মকাণ্ড দেশের জন্য কতটা ইতিবাচক ও মঙ্গলজনক—জাতির কাছে সেটিই বড় বলে বিবেচিত। জাতির কাছে একটি সত্য দিবালোকের মতো উদ্ভাসিত হয়ে উঠছে, বর্তমান সরকার ইচ্ছা করলে দেশকে যে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটাতে পারে।
সাংঘর্ষিক ও প্রতিশোধমূলক রাজনীতি পরিহারের জন্য স্থিতিশীল আবহ সৃষ্টি করা প্রয়োজন। কিন্তু জাতি শাসক দলের কাছ থেকে তেমন দায়িত্বশীল আচরণ প্রত্যক্ষ করছে না, বরং কঠিন মারপ্যাঁচের জালে রাজনীতিকে আটকে ফেলার দুরভিসন্ধি নিয়ে শাসক দল অগ্রসর হচ্ছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের রাজনীতিতে যা কিছু ঘটে চলেছে, তা এক পরিকল্পিত দুরভিসন্ধিরই বাস্তবায়ন বলা ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই।
কথিত যুদ্ধাপরাধের বিচার শাসক দলের ক্ষমতায় টিকে থাকার একমাত্র যোগ্যতা, এ ইস্যুর সুস্পষ্ট বেনিফিশিয়ারি বর্তমান শাসক দল; এর মাধ্যমে তারা বিরোধী রাজনীতিকে কোণঠাসা করে রাখার প্রাণান্তকর ও ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এর মাধ্যমে মানুষের দৃষ্টি সরকারের সীমাহীন দুর্নীতি ও নজিরবিহীন ব্যর্থতা থেকে ভিন্ন দিকে ঘুরিয়ে দিতে চাইছে তারা।
বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা অব্যাহত রাখার বিষয়টি এখন সর্বতোভাবে শেখ হাসিনার ওপরই নির্ভর করছে। নির্দলীয় সরকারের অধীনে পক্ষপাতহীন নির্বাচনের ব্যবস্থা করলে জনগণের ভোটের অধিকার রক্ষার পাশাপাশি দেশও এক অনিবার্য বিপর্যয় থেকে রক্ষা পাবে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন যথাসময়ে অনুষ্ঠিত হওয়া নিয়ে সব মহলেই উদ্বেগ-উত্কণ্ঠা বৃদ্ধি পাচ্ছে, কেননা এ নির্বাচনের ওপর দেশ ও জাতির ভাগ্য নির্ভর করছে।
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদসহ রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা বিভিন্ন সভা-সেমিনারে আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছেন। দেশে অরাজকতা সৃষ্টি ও গণতান্ত্রিক ধারা ব্যাহত করে নির্বাচন বানচালের মাধ্যমে বর্তমান শাসক দলের একাধিক স্বার্থ হাসিল হতে পারে। যেমন বিএনপির ক্ষমতায় যাওয়া রুখে দেয়া, দেশে সর্বগ্রাসী সঙ্কট, শেয়ার মার্কেট কেলেঙ্কারি, রেল মন্ত্রণালয়ের কেলেঙ্কারি, পদ্মা সেতু কেলেঙ্কারি, হলমার্ক কেলেঙ্কারি, ডেসটিনি কেলেঙ্কারিসহ আরও অসংখ্য কেলেঙ্কারি ও সীমাহীন দুর্নীতি এবং নজিরবিহীন ব্যর্থতার মাধ্যমে শাসক দলের গায়ে যে দুর্নীতির কালিমা লেগেছে তা ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করার সুযোগ পাওয়া, জামায়াত-শিবিরকে দমনের নামে জাতিকে স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ দুই শিবিরে বিভক্ত করা, নিস্ক্রিয় নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত করার মাধ্যমে রাজনীতির মাঠ দখলে নেয়া ইত্যাদি। প্রশ্ন হলো, অরাজকতার মাধ্যমে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি সৃষ্টি করে কি জনমত পক্ষে আনা যায়? নাকি মানুষের দুর্ভোগ আরও বৃদ্ধি পায়? শেষ পর্যন্ত এ দুর্ভোগের দায়ও শাসক দলকেই নিতে হয়, যেমন অতীতে অন্য দল নিয়েছে।
জনসভা, গণমিছিল ও গণসংযোগ এবং মানববন্ধনসহ বিভিন্ন শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে অবধারিতভাবে প্রমাণ হয়েছে জনগণ বিএনপির পক্ষে আছে। এখন এই জনগণের শক্তিকে বিএনপি কীভাবে এবং কোন কাজে ব্যবহার করবে—এই কৌশল বিএনপিকে ঠাণ্ডা মাথায় প্রণয়ন করতে হবে।
দেশি-বিদেশি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম থেকে বিএনপির ক্ষমতায় যাওয়ার আভাস-ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।
কোন কাজটি এখন, এই মুহূর্তে করতে হবে এবং কোনটির জন্য করতে হবে অপেক্ষা, রাজনীতিতে এটি নির্ধারণ করা জরুরি। চলমান রাজনীতিকে এলোমেলো করে দেয়ার একটা প্রক্রিয়া চলমান। এসব ব্যাপার বিএনপির রাজনৈতিক ভাবনায় থাকতে হবে।
রাজনীতিতে একটা কথা বিবেচনায় রাখা অনস্বীকার্য যে, কোনো একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে কাউকে অসম্ভব রকম শক্তিশালী মানুষ মনে হতে পারে, আবার আরেকটি বিশেষ পরিস্থিতিতে তিনিই হয়ে যেতে পারেন পৃথিবীর দুর্বলতম মানুষ। প্রধানমন্ত্রীর ‘খেলা শুরু হয়েছে’ বক্তব্যের সূত্র ধরে বলতে চাই, রাজনীতিতে যে যত খেলাই খেলুন, শেষ পর্যন্ত নির্বাচনের পথেই ফিরে আসতে হয়; নির্বাচন ছাড়া রাজনৈতিক দলের সামনে বিকল্প কোনো পথ নেই। নির্বাচন অনিশ্চিত তো রাজনীতিকদের জীবনও অনিশ্চিত।
ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয় এটা অবধারিত সত্য। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, ঠিক একই ধরনের বা মাত্রায় হয় না। এবার ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটলে তা হবে আরও ভয়াবহ ও নিষ্ঠুর। কাজেই সময় থাকতে পরস্পর ভেদাভেদ ভুলে, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্র তৈরি করার দিকে সবাইকে মনোনিবেশ করতে হবে। যাতে সংঘাত-সংঘর্ষের পথ এড়ানো সম্ভব হয়। যাতে সুস্থ রাজনীতির ধারা দেশে ফিরে আসে। যাতে সামনে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব হয়।
লেখক : কলামিস্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
belayet_1@yahoo.com
0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

শেখ মুজিব থেকে খালেদা জিয়া : ‘মহাবীর’ ইনুর মহান মাইনাস থিওরি



আবদুল হাই শিকদার

সেই কোন শৈশবে ছড়ায় পড়েছিলাম—‘রাম ছাগলে/গামছা গলে/ঘাস দখলে যায়/মরি হায়রে হায়।’ সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর করুণাধন্য, একদার ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের’ সশস্ত্র ‘কমরেড’ তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর মহা মহা বীরত্বপূর্ণ কাণ্ডকারখানা দেখে বহুদিন পর সেই পুরনো কথাগুলো মনে এলো।
আভিধানিক অর্থে রামছাগল চতুষ্পদবিশিষ্ট প্রাণী। তৃণভোজী। একথা সবাই জানি। কিন্তু অতীতের মাংসাশী কমরেডদের অনেকে যে জনগণ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত, ধিকৃত ও পরিত্যক্ত হয়ে, রাজনৈতিক বর্জ্য থেকে ধীরে ধীরে দ্বিপদবিশিষ্ট মনুষ্যরূপী রামছাগলে পরিণত হয়ে, এর-ওর নৌকায় চেপে ‘খুঁটির জোরে পাঁঠা কুঁদে’ পাড়া মাথায় নিয়ে, বেহায়ার মতো নিজেদের বীর হিসেবে জাহির করে, বত্রিশ পাটি দন্ত বিকশিত করে আত্মতৃপ্তি লাভ করে, তার নজির আমাদের দেশে ভূরি ভূরি। চামচাগিরি আর দালালি করে, মোসাহেবি আর ষড়যন্ত্র করে যাদের জীবন কাটে, সেসব লোকজন উপস্থাপিত হন ‘স্বঘোষিত বীর’ হিসেবে। এরা এতটাই নির্লজ্জ যে এদের এই ভণ্ডামি, ডিগবাজি যে জনগণ বোঝে—এরা তাও বোঝে না। অথবা বুঝেও ভাঙা রেকর্ডের মতো কর্তার ইচ্ছায় কীর্তন গাইতেই থাকেন।
ওইজাতীয় ‘স্বঘোষিত বীর’দের নামে ডাকে গগন ফাটে। অথচ এদের হাঁড়ির ভাত চাটে সারমেয়কুল। এসব ‘মহাবীর দুর্বল সিং’দের অন্যতম হাসানুল হক ইনু। বিরাট বিপ্লবী, বিরাট কমরেড—ছাল নেই কুকুরের বাঘা নাম। ইনুর লমম্ফঝমেম্ফ ইদানীং জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। লোকে বলে, ‘ভাইরে আওয়ামী লীগের নেতারা যখন লম্বা লম্বা বাণী দেন, তখন ভালো না লাগলেও সেটা সহ্য হয়। আফটার অল আওয়ামী লীগ একটা বড় দল। তাদের নেতাদের কথাবার্তা একটু চাওড়া হতেই পারে। কিন্তু ইনুর কথাবার্তা শুনে প্রাণ ত্যক্ত, বিরক্ত। সিংহের গর্জনের একটা মর্যাদা আছে, কিন্তু বাঁদরের ভেংচি কার সহ্য হয় বলুন?’
ইনু সাহেবের কীর্তির অন্ত নেই। সর্বশেষ বাংলাদেশের প্রকৌশলীদের জাতীয় সংগঠন ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউশন অব বাংলাদেশের (আইইবি) কার্যকরী পরিষদ নির্বাচনে গোহারা হেরে তিনি এক অনন্য কীর্তি স্থাপন করেছেন। ইনু সাহেবরা তো আগারটাও খান, গোড়ারটাও খান। খাওয়া কোন কোন পদের কোন পর্যায়ের সে হুঁশ তো তার নেই। খাওয়া হলেই হলো, থালি হাতে নিয়ে বসে পড়লেন।
আক্কেল যার নেই, কোন কাজটি করা উচিত আর কোনটি করা উচিত নয়, এই বোধ যাদের নেই তাদের গু লাগে নাকি তিন স্থানে। পায়ে, হাতে তারপর নাকে। ইনু সাহেবের হলো সেই কেস। মন্ত্রী মানুষ, ভোট না দিয়ে ইঞ্জিনিয়াররা যাবে কোথায়? হয়তো ভেবেছিলেন, এখানেও হয়তো একজন মাহবুবউল আলম হানিফ আছেন। তিনি তরী পার করে দেবেন। অতএব ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ বলে (বঙ্গবন্ধুর নাম আওয়ামী লীগারদের চাইতেও ইনু সাহেব বেশি নেন। কারণ নও মুসলিম নাকি গরু খাওয়ার যম) দাঁড়িয়ে গেলেন ভোটে। ব্যানার যথারীতি বঙ্গবন্ধু প্রকৌশলী পরিষদ।
তো ২৬টি সদস্যপদের মধ্যে তিনি পাননি একটিও। তিনি নাকি শতাধিক প্রার্থীর মধ্যে পেয়েছেন সর্বনিম্ন ভোট। ফলে এই ২৬ জনের মধ্যে তিনি রাখতে পারেননি নিজের অবস্থান। প্রকৌশলীরা ছেঁড়া কাগজের মতো এই অন্তঃসারশূন্য আস্ফাালনকারীকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে গ্লানির মধ্যে।

দুই.
শেখ মুজিবের চামড়া দিয়ে দিনে তিনবার যারা ডুগডুগি বাজানোর স্বপ্ন দেখতেন, ইনু সাহেব তাদের একজন। শেখ মুজিবের শাসন তখন তার ও তার দলের কাছে ছিল চরম ফ্যাসিবাদী শাসন। হিটলার-চেঙ্গিস খানের চাইতেও এরা বেশি ঘৃণা করতেন শেখ মুজিবকে। শেখ মুজিব অগণতান্ত্রিক, শেখ মুজিব প্রতিক্রিয়াশীল, শেখ মুজিব গণশত্রু—এই ধরনের শব্দ তখন ইনু সাহেবের দল থেকে অহরহ উচ্চারিত হতো।
সেই জন্যই তারা ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের’ সস্তা চকটদার স্লোগান নিয়ে স্বৈরাচারী শেখ মুজিব সরকারকে ক্ষমতা থেকে উত্খাতের জন্য প্রয়োগ করেন সর্বশক্তি। যে কোনো পথে শেখ মুজিবকে ‘মাইনাস’ করার জন্য ইনু সাহেবরা তখন মরিয়া। বিপ্লব আসন্ন বলে গঠন করেন গণবাহিনী। তারপর এই সশস্ত্র বাহিনী নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর। প্রচুর আওয়ামী লীগার সে সময় ইনু সাহেবদের গণবাহিনীর হাতে নিহত হয়।
শেখ মুজিবও এই জাসদ ও গণবাহিনীর মোকাবিলায় লেলিয়ে দেন রক্ষীবাহিনী ও পুলিশ। হাজার হাজার তরুণ, যারা ইনু সাহেবদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে, উদ্বুদ্ধ হয়ে সমাজতন্ত্র কায়েমের জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম করছিলেন, তারা নির্মমভাবে নিহত হন। এই সংখ্যা আনুমানিক ২৭ হাজার। এই যুবকরা ভেবেছিল ইনু সাহেবরা সত্যি সত্যি ‘বীর’। সত্যি তারা শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চান। ফলে তারা জীবনকে তুচ্ছ করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মরণপণ সংগ্রামে।
রক্ষীবাহিনীর অমানুষিক নির্যাতনে আরও কত তরুণ-যুবক যে পঙ্গু হয়ে গেছে, গুম হয়ে গেছে, সর্বহারা হয়ে গেছে, তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেয়ারও গরজ বোধ করেনি কেউ। ইনু সাহেবরা তো করেনইনি।
আজ ক্ষমতার লোভে, গদির মোহে, প্রতিপত্তির লালসায়, হিতাহিত বোধবর্জিত অন্ধের মতো, গোঁয়ারের মতো ইনু সাহেবরা সেই সব শহীদের রক্তের সঙ্গে বেঈমানি করে, বিশ্বাসঘাতকতা করে আওয়ামী লীগের নৌকায় চেপে অষ্টপ্রহর জপছেন ‘বঙ্গবন্ধু’ নামের তসবিহ।
কার্ল মার্কসের বাণীকে নিজ স্বার্থে ব্যবহার করে ইনু সাহেবরা তখন শেখ মুজিবের পার্লামেন্টকে বলতেন ‘শুয়োরের খোঁয়াড়’। ভাগ্যের পরিহাস, এখন শিং, নখ ভেঙে সেই খোঁয়াড়ে ঢুকে মুজিবের অধস্তনদের পাদুকা চুম্বন করে ঠেকা দিচ্ছেন নিজেদের মাইনাস হওয়ার আতঙ্ক। বাঁচাচ্ছেন পিঠের চামড়া আর রাতারাতি হয়ে উঠছেন ধনবান। আর ঢেঁকুর তুলছেন আত্মপ্রসাদের।
ইনু সাহেব যখন ‘বঙ্গবন্ধু’ নাম জপেন, তখন ওইসব শহীদের আত্মাগুলো তাকে ‘গাদ্দার’, ‘বিশ্বাসঘাতক’ ও ‘বেঈমান’ বলে অভিশাপ দেয়। তিনি আজ প্রতিপত্তি ও ক্ষমতা-বধির বলে শুনতে পান না তাদের রোদন। কিন্তু রাজা ডানকানের রক্তের মতোই ওই শহীদদের রক্তও তাকে ছাড় দেবে না। তাকে আজীবন, এমন কি মৃত্যুর পরও তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াবে প্রেতের মতো। মীরজাফর কিংবা কুইসলিঙের মতোই ঘৃণার স্থান তার জন্য নির্ধারণ করবে ইতিহাস।

তিন.
আওয়ামী লীগের খোঁয়াড়ে পর্যাপ্ত ঘাস, বিচালি পেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতায় অধীর হয়ে পড়েছেন ইনু সাহেব। চেহারাও মাশাল্লাহ নাদুস-নুদুস হয়ে পড়েছে। তো তার এখন প্রধান কাজ হলো শেখ হাসিনার মনোরঞ্জন করা। তাকে খুশি রাখা। এটা অবশ্য গদির মহিমা। এই খুশি রাখার কৌশল হিসেবে বেছে নিয়েছেন বিএনপি প্রধান বেগম খালেদা জিয়াকে গালাগাল করার কাজটি। ইনু তার মুরোদ সম্পর্কে জানেন না তা নয়। এও জানেন, খোঁয়ারে থাকা-খাওয়ার সব দায়িত্ব যেমন নিয়েছে আওয়ামী লীগ, তেমনি তার নিরাপত্তার দেখভালও তারাই করবে। অতএব চোয়ালকে দিয়েছেন অর্গলমুক্ত করে।
এই গ্যারান্টি থেকে ইনু মাঝে মধ্যেই হুঙ্কার ছাড়ছেন, বেগম খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে বিতাড়িত করা হবে। তাকে রাজনীতি থেকে মাইনাস করা হবে। শেখ মুজিবের পর এই ইনু চক্র এখন অস্থির খালেদা জিয়াকে মাইনাস করার জন্য।
যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা যখন কেউ বলে তখন লোকে তাকে বলে বেআক্কেল। বলে বেয়াদব। গাড়ির ইঞ্জিন হলো ভাঙা বেবি ট্যাক্সির, সেই গাড়ি যখন বেড ফোর্ড গাড়ির মতো আওয়াজ করে তখন লোকে কৌতুক অনুভব করে। প্রশ্ন তোলে কাণ্ডজ্ঞান নিয়ে। ছাগলের তিন বাচ্চার কারবার দেখে শিশুরাও অনুভব করে অপার আনন্দ।
বেগম খালেদা জিয়ার দলের যে কোনো একটা থানা কমিটিতে যত লোক আছে, ইনু সাহেবের পুরো দলেও তো অতজন লোক নেই। সেই কথাটা যদি এই রাজনীতিবিদের মনে থাকতো, তাহলে হয়তো তিনি গলা নামিয়ে সমীহ করে কথা বলতেন।
বিএনপির কর্মী ভেড়ামারার নেতা শহীদুল ইসলামের কাছে সারা জীবন পরাজিত হয়ে যিনি রেকর্ড স্থাপন করেছেন, সেই ইনু খালেদা জিয়াকে ধমক দিয়ে কথা বলেন। আওয়ামী লীগের নেতা হানিফ সাহেবের দয়ায় এমপি হয়ে ইনু সাহেব ধরে নিয়েছেন ‘মুই কি হনুরে’।
শেখ মুজিব ইনুর মাইনাস থিওরির হাড়-হাড্ডি ভেঙে দিয়েছিলেন পিটিয়ে; জান কবচ করেছিলেন এদের গালভরা তত্ত্বের; ফলে ভিটেছাড়া ইনুরা পরিণত হয়েছিল রাজনৈতিক এতিমে।
এবার খালেদা মাইনাস তত্ত্ব জাহির করতে গিয়ে তাদের কোন শিক্ষা হয়, সেটা দেখার জন্য বসে আছি।
নাকি আপন স্বভাব অনুযায়ী ‘মাইনাস-ফাইনাস’ শিকায় তুলে, মওকা বুঝে খালেদা জিয়ার পায়ের নিচে জায়গা নেয়ার জন্য ছুটবেন? দেখা যাক।
আওয়ামী নৌকায় চেপেছে আরেক সর্বহারা দিলীপ বড়ুয়া। সারা জীবনে যিনি সব মিলিয়ে ভোট পেয়েছেন ১২০০। সেই লোক বাংলাদেশের গর্ব প্রফেসর ইউনূসকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে মারে। বলে, আমার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ভোটে দাঁড়িয়ে জনপ্রিয়তা যাচাই করুন!—বুঝুন ঠেলা।

চার.
এক ব্যবসায়ী বিয়ে করবেন আরেকটি। কোর্টে গিয়ে বললেন, আমার প্রথম স্ত্রীর অনুমতি নিয়ে দিন। কোর্ট বললো, কেন বিয়ে করবেন আরেকটা? লোকটি বললো, হুজুর, আমার বিরাট ব্যবসা। কিন্তু আমার প্রথম স্ত্রী আমাকে এক এক করে ৪টি মেয়ে উপহার দিয়েছে। আরেকটি আসছে। আমি সিওর এটিও মেয়েই হবে। তো আমার ব্যবসা দেখাশোনা করার জন্য একটা ছেলে চাই। সেজন্যই দ্বিতীয় বিয়ে করবো।
কোর্ট ডাকলো তার প্রথম স্ত্রীকে। প্রথম স্ত্রী সব শুনে হো হো করে হাসলো। বললো, জজ সাহেব, আপনে আমারে হাসাইলেন। ওর পোলার বাপ হইবার খায়েশ হইছে? আরে ওর মুরোদ আমার জানা আছে। জানা আছে। ও হইবো পোলার বাপ! আরে ওর আশায় বইসা থাকলে আমার মেয়ে ৪টাও তো হইতো না!

পাঁচ.
জেল থেকে বের হয়ে এরশাদ সাহেব বলেছিলেন, ইনু-মেননরা আমার বিরুদ্ধে আন্দোলন করে কেন? অবাক ব্যাপার! আরে ওদের তো আমি নিয়মিত মাসোহারা দিতাম।
রেগেমেগে এরশাদের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকলেন ইনু সাহেবরা। এরশাদ বিশ্ব বেহায়া; এরশাদ স্বৈরাচারী। এরশাদ নূর হোসেনের হত্যাকারী। এরশাদ রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করেছে। ইত্যাদি আরও কত কী!
এখন সেই এরশাদকে বুকে নিয়ে, তাকে বাহুলগ্ন করে, আরামছে মহাজোট করছেন ইনুরা।

ছয়.
আমি অতি বিনয়ের সঙ্গে জানাচ্ছি, হাসানুল হক ইনু সাহেব যে লেখাপড়া জানেন, এটা আমি ভুলে গিয়েছিলাম। এই ভোলার জন্যও অবশ্য তিনিই দায়ী। কারণ, তিনি অহরহ যেসব বক্তব্য দেন, যেসব ভাষা তিনি ব্যবহার করেন, যেরকম আচরণ তাকে করতে দেখি—তাতে আমি কেন, যে কারোরই মনে হতে পারে তিনি একটা অকাট মূর্খ। রাজনৈতিক শিষ্টাচার, শালীনতা, ভদ্রতা, সভ্যতা, পরিমিতিবোধ, কাণ্ডজ্ঞান-এর অভাবই তাকে বাজে মানুষ হিসেবে তুলে ধরেছে। এখানে আমার দোষ কোথায়?
কিন্তু এবারের ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশের নির্বাচনের মাধ্যমে আবার নতুন করে মনে হলো, আরে ইনু সাহেব তো ইঞ্জিনিয়ার! তাও আবার কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, যে বিভাগ থেকে আমার দেশ-এর সত্যনিষ্ঠ সাহসী সম্পাদক মাহমুদুর রহমান সাহেবের মতো মানুষ সাফল্যের সঙ্গে বেরিয়ে এসেছেন। তো মাহমুদুর রহমানের বিভাগ থেকে তাহলে ইনু সাহেবের মতো ‘জিনিস’ বেরিয়েছে! বিষয়টা আমাকে বেশ অবাক করেছে।
তাছাড়া মূল নামের সঙ্গে যারা ‘ঘরের ডাকনাম’ লাগিয়ে কৃতিত্ব জাহির করেন, তাদেরকে আমার সবসময়ই ‘অর্বাচীন’ মনে হয়। কারণ, আমার ধারণা, যাদের মানসিক বয়স বাড়ে না, বিচক্ষণতা থাকে না, তারাই নামের শেষে ডাকনাম ঝুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর ডাকনাম হাসু। বেগম খালেদা জিয়ার ডাকনাম পুতুল। রবীন্দ্রনাথের রবি, নজরুলের দুখু মিয়া। মওলানা ভাসানীর ডাকনাম চ্যাকা মিয়া। কই তারা তো ডাকনামের লেজ মূল নামের সঙ্গে কখনোই লাগাননি। কিন্তু আমাদের হাসানুল হক সাহেব দিব্যি ‘ইনু’ লেজ ঝুলিয়ে মাঠ দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। এটা কি বালসুলভ চপলতা নয়? গভীরতাহীনতার লক্ষণ নয়?

সাত.
জামায়াত নেতা মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর সঙ্গে করমর্দনরত ইনুর একটা ছবি গত ২৬ ডিসেম্বর যাত্রাবাড়ীর পথসভায় জনসমক্ষে তুলে ধরে বেগম খালেদা জিয়া বলেন, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু করজোড়ে মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর সঙ্গে হ্যান্ডশেক করছেন। এই ইনু ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশের সদস্যপদে দাঁড়িয়ে হেরে গেছেন।’
বেগম জিয়া যে ছবিটি দেখান তাতে দেখা যায়, মাওলানা নিজামী সোফায় বসে আছেন। আর ইনু সাহেব অনেকটা ঝুঁকে পড়ে তার সঙ্গে করমর্দন করছেন।
বেগম খালেদা জিয়ার বক্তব্যে নিজেদের থলে থেকে ভণ্ডামী আর মুনাফেকির বিড়াল বেরিয়ে গেলে বেসামাল হয়ে পড়েন হাসানুল হক ইনু। তিনি এর জবাবে বলেন, ‘নিজামী আমার পা ধরতে চেয়েছিল। তবে আমি তাকে আমার পা ধরতে দিইনি। পরে হাত ধরে মাফ চেয়েছিল। আমি মাফ করিনি।’
সহযোগী পত্রিকা যুগান্তর লিখেছে, তথ্যমন্ত্রীর এই ব্যাখ্যায় কেউ সন্তুষ্ট হতে পারছেন না। কেউ ইনু সাহেবকে বিশ্বাসও করছেন না। তাদের কাছে ব্যাখ্যাটি নিতান্তই বালখিল্যতাপূর্ণ ও অসৌজন্যমূলক মনে হয়েছে। এ ব্যাপারে বিএনপি নেতা তরিকুল ইসলাম বলেছেন, ইনু তখন (ছবি তোলার সময়) কোন অবস্থানে ছিলেন যে উনি নিজামীকে মাফ করে দিলে মাফ পেয়ে যাবেন? ইনু তো জীবনে এই প্রথম মন্ত্রী হলেন। সেই সময় তার কাছে নিজামী মাফ চাইতে যাবেন কেন? তাছাড়া ছবিতে দেখা যাচ্ছে নিজামী সোফায় বসে আছেন। আর ইনু কুর্নিশ করার মতো ঝুঁকে পড়ে তার সঙ্গে করমর্দন করছেন। পায়ে হাত দিয়ে মাফ চাইতে হলে তো নিজামীকেই উঠে দাঁড়াতে হতো। আসলে দুর্বৃত্তের ছলনার অভাব হয় না।
অর্থাত্ একথা দিবালোকের মতো পরিষ্কার, ইনু মিথ্যা কথা বলছেন। এই মিথ্যা কথার ভেতর দিয়ে তিনি নিজেদের দেউলিয়াত্ব আবারও প্রকাশ করে মন্ত্রিত্ব করার যোগ্যতা হারিয়েছেন। অবশ্য কান যাদের দুটোই কাটা, তাদের হিতোপদেশ দিয়ে লাভ নেই। এদের ভদ্রতা সভ্যতার কথা শোনানোও অর্থহীন।

আট.
ভাতিজা কাজ করে রেলের গুমটি ঘরে। গেটম্যানের কাজ। দেশ থেকে চাচা এসেছেন বেড়াতে। রাতে ভাতিজা চাচাকে বললো, জান চাচা, আমার না অনেক পাওয়ার। চাচা বললো, দেখা। ভাতিজা বললো সকালে দেখাব।
সকালে আসছে মেইল ট্রেন। ভাতিজা ট্রেনকে লাল পতাকা দেখালো। ট্রেন থেমে গেল। গার্ড দ্রুত নেমে এলেন। কী ব্যাপার। কোনো দুর্ঘটনা? ভাতিজা বললো, না স্যার, আমার চাচা আমার পাওয়ার দেখতে চেয়েছিল। তাই দেখালাম। শুনে গার্ড কষে এক চড় কষলো গেটম্যানকে। হুশিয়ার করলো আর কখনও এরকম না করতে।
ট্রেন চলে গেল। হতভম্ব চাচা বললো, ভাতিজা, এটা কী হলো, চড় মারলো তোকে?
ভাতিজা নির্বিকারভাবে বললো, বুঝলে চাচা, এটা হলো পাওয়ারের ব্যাপার। যার যার পাওয়ার তার তার। আমি আমার পাওয়ার দেখিয়েছি। গার্ড সাহেব তার পাওয়ার দেখিয়েছেন। এ আর এমন কী!
ইনু সাহেবরা বাংলাদেশের মানুষকে পাওয়ার দেখাচ্ছে। কিন্তু প্রত্যেক ক্রিয়ারই একটা সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে। বাংলাদেশের মানুষও অচিরেই তাকে নিজেদের পাওয়ার দেখাবে। তখন যেমন পালিয়েও যেতে পারবেন না, তেমনি কেঁদেও কূল পাবেন না।
a_hyesikder@yahoo.com

শুক্রবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০১২

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার অপরিহার্য



 প্রত্যেক গণতান্ত্রিক দেশে জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমেই সরকার গঠিত হয়ে থাকে। দেশে একাধিক রাজনৈতিক দল থাকে। জনগণ স্বাধীনভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করে তাদের পছন্দের ব্যক্তিকে সংসদে পাঠায়। এভাবে যে দলের বেশি সীট লাভ হয় সেই দলই সরকার গঠন করে এবং দেশ চালায়। আর এটাই গণতন্ত্রের দাবি। নির্বাচন যদি অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু না হয় তবে জনগণ যথাযথভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে না এবং তাদের বাঞ্ছিত ব্যক্তিদের সংসদে পাঠানো সম্ভব হয় না। ফলে দেশবাসীর আকাঙ্ক্ষিত সরকারও গঠন হয় না। এতে গণতন্ত্রের মাথায় যেমন কুঠারাঘাত করা হয় তেমনি দেশ চালাবার মতো সৎ ও দক্ষ ব্যক্তির অভাব ঘটে সরকারে।
সুষ্ঠুভাবে দেশ চালানো, জনগণের কল্যাণ, দেশের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি দূরে থাক, জনগণের জীবন ধারণই কঠিন হয়ে পড়ে। দেশে আইনের শাসন থাকে না। সরকারে যারা থাকেন তাদের মুখের কথাই আইনে পরিণত হয়। জনগণ সরকারের নিকট জিম্মি হয়ে পড়ে। তাদের জানমাল ও ইজ্জতের নিরাপত্তা বলতে কিছুই থাকে না। এমনকি দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বও হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়ে। বাংলাদেশে যতবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে জনগণকে ততবারই সে দুরবস্থার মোকাবিলা করতে হয়েছে।
বাংলাদেশের দু'একটি রাজনৈতিক দল ছাড়া অধিকাংশ দলই রাজনীতিকে অপবিত্র ও ধোঁকা-ফাঁকির নীতি মনে করে। তাদের বিশ্বাস ধোঁকা-ফাঁকি আর জবর-দখলের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করাই হলো রাজনীতির মূল লক্ষ্য। তাই নির্বাচনে জেতার জন্য এমন কোন অপকর্ম নেই যা তারা করেন না।
ফল্স ভোট দেয়া, ব্যালট বাক্স ছিনতাই, ভোটকেন্দ্র দখল এমনকি মারামারি, খুনাখুনি পর্যন্ত করে থাকেন। এসব সন্ত্রাসী কর্মকান্ডকে তারা নির্বাচনের কৌশল হিসেবে গ্রহণ করেন।
আসলে রাজনীতি অত্যন্ত পবিত্র বিষয়। মানব সভ্যতায় যার গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ রাজনীতির মাধ্যমেই দেশের সরকার গঠন হয়। অপবিত্র নীতির মাধ্যমে যে সরকার গঠিত হয় সে সরকার জনগণ ও দেশের কোন কল্যাণ করতে পারে না। জনগণের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা এবং দেশের ধন-সম্পদ লুটপাট করা, জোর করে ক্ষমতায় থাকার অপচেষ্টা করা ছাড়া তাদের আর কোন কাজ থাকে না। আর যারা রাজনীতিকে পবিত্র মনে করেন তারা ক্ষমতায় এলে জনগণের হক্ব আদায় করেন, দেশের সম্পদ লুটপাট না করে জনগণের কল্যাণ, দেশের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির জন্য কাজ করেন। রাজনীতিকে যারা অপবিত্র মনে করেন তারা গণতন্ত্রের কথা দিনে হাজার বার মুখে বললেও ছলে বলে কলে-কৌশলে একবার ক্ষমতায় যেতে পারলে সিন্দাবাদের ভূতের চেয়েও কঠিন অবস্থায় জাতির ঘাড়ে চেপে বসেন। গণোত্থান ছাড়া তাদের নামানোই অসম্ভব হয়ে পড়ে। তারা নিজেদের গণতান্ত্রিক দল হিসেবে বিশ্বকে দেখানোর জন্য ক্ষমতায় থেকেই প্রহসনের নির্বাচন করান। রাষ্ট্রীয় সকল শক্তি প্রয়োগ করে হাজারো রকমের দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে বিপুল ভোটে বিজয় দেখিয়ে তারাই পুনরায় ক্ষমতায় জেঁকে বসেন। তাদের নির্বাচনী যত খরচ তা রাষ্ট্রের টাকা দিয়েই প্রায় মিটিয়ে থাকেন।
জনগণের ভোট ছাড়াই অপকৌশলে যারা ক্ষমতায় আসতে পারে, জনগণের তোয়াক্কা করার তাদের কোন প্রয়োজন হয় না। এ কারণে জনগণের ভোটাধিকারের কোন মূল্যই থাকে না। এ ধরনের সরকার স্বৈরাচারী রূপ ধারণ করে। তাদের দুঃশাসনে জনগণ অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। এহেন দুর্গতি থেকে মুক্তি লাভ, জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিতকরণ এবং দেশবাসীর কাঙ্ক্ষিত সরকার নির্বাচিত হবার লক্ষ্যে বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, ভাষা সৈনিক অধ্যাপক গোলাম আযম কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতির উদ্ভাবন করেন।
সরকারের মেয়াদ শেষ হলে পরবর্তী নির্বাচনের পূর্বে সংসদ ভেঙে দিতে হবে। পরবর্তী সরকার নির্বাচিত হবার আগ পর্যন্ত দৈনন্দিন সরকারি কাজ চালানো এবং নির্বাচন পরিচালনার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারই হলো কেয়ারটেকার সরকার। এই সরকারের কার্যকাল ৯০ দিন। ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত করে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে কেয়ারটেকার সরকার পদত্যাগ করবে।
গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচনের সময় এক ধরনের কেয়ারটেকার সরকার থাকে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী এ সরকারের প্রধান হলে নির্বাচনের ওপর দলীয় প্রভাব ফেলার ব্যাপক সুযোগ থাকে। নির্বাচনকে প্রভাব মুক্ত করার জন্যই প্রয়োজন অরাজনৈতিক ও নির্দলীয় ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত এই কেয়ারটেকার সরকার। সুপ্রিমকোর্টের কর্মরত প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে সম্পূর্ণরূপে অরাজনৈতিক ও নির্দলীয় কেয়ারটেকার সরকার গঠন হবে। এ সরকারে মন্ত্রীর পদমর্যাদায় (উপদেষ্টা) যাদের নিয়োগ দেয়া হবে তারা হবেন এমন যে তারা কোন রাজনৈতিক ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত নন এবং কোন রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্তও নন। এ সরকারের প্রধান প্রধান উপদেষ্টা। তার নেতৃত্বে অপর অনধিক ১০ জন উপদেষ্টার সমন্বয়ে এ সরকার গঠিত হবে। উপদেষ্টাগণ রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হবেন। কেয়ারটেকার সরকারই নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের নিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন করবেন। তবে নির্বাচন কমিশন থাকবে প্রভাবমুক্ত।
পাকিস্তান থেকে শুরু করে বাংলাদেশ তক এ পর্যন্ত যত জাতীয় নির্বাচন হয়েছে ১৯৯১, ১৯৯৬ এবং ২০০১ সালের নির্বাচন তন্মধ্যে অধিক সুষ্ঠু ও সুন্দর হয়েছে। নির্বাচনগুলো এত সুষ্ঠু ও সুন্দর হবার কারণ ছিল নির্দলীয় নিরপেক্ষ কেয়ারটেকার সরকার। বিদেশি পর্যবেক্ষকগণ পর্যন্ত এই নির্বাচনকে উচ্ছবসিত প্রশংসা করেছিলেন। কেউ কেউ এ কথা বলেছেন যে, এই সুন্দর নির্বাচন পদ্ধতি আমাদের দেশেও চালু করতে চেষ্টা করব। কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতির অধীনে নির্বাচন হওয়ার কারণে ওই তিনটি নির্বাচনে কোন দলই নির্বাচন কমিশনের ওপর প্রভাব ফেলতে পারেনি। সে কারণে অপকৌশলে জিতারও কোন সুযোগ কেউ লাভ করতে পারেনি।
আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী তিনি এবং তার দলের লোক ছাড়া অন্য কেউ কিছু করে কৃতিত্ব লাভ করুক এটা মোটেই বরদাস্ত করতে পারেন না। যেমন ড. ইউনূসের নোবেল পুরস্কার পাওয়াটা তার মোটেই পছন্দ না। এরপর সচেতন মহলে কেনা জানে যে, কেয়ারটেকার সরকারের উদ্ভাবক অধ্যাপক গোলাম আযম কিন্তু ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা কেয়ারটেকার সরকারের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে যখন দেখলেন যে, কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতি দেশে বিদেশে ব্যাপক প্রশংসা লাভ করেছে, এ কৃতিত্ব কিভাবে হাইজ্যাক করা যায়, সেই চেষ্টায় লেগে গেলেন। তিনি কেয়ারটেকার সরকারের বাংলা অনুবাদ করলেন ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার'। আগে দেয়ালে দেয়ালে লেখা দেখা যেত-
‘কেয়ারটেকার সরকার
গোলাম আযম রূপকার'
এবার তার কর্মীরা দেয়ালের সে লেখা মুছে দিয়ে সেখানে লিখে দিল-
‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার
শেখ হাসিনা রূপকার'
২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনের দিন রাত ৯টা পর্যন্ত তিনি মনেপ্রাণে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপকার ছিলেন। কিন্তু রাত ৯টার পরে যখন বিভিন্ন ভোটকেন্দ্র থেকে নৌকার ভরাডুবির খবর আসতে লাগল তখন থেকেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওপর তিনি ভীষণভাবে চটে যান। এই কারণে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হওয়ার জন্যে তার দল অপকৌশলের সুযোগ পায়নি তাই তাদের এই ভরাডুবি। তিনি ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত এই পাঁচ বছর দেশ ও জনগণের কল্যাণের জন্য কোন কাজই করেননি। বরং আগামী নির্বাচনে জিতার জন্য পাঁচ বছর ভরে দেশের প্রশাসনকে এমনভাবে ঢেলে সাজিয়েছিলেন যে, নির্বাচনে তার দল ছাড়া আর কোন দলই জিততে পারবে না। কিন্তু সমগ্র জাতি তাদের দুঃশাসনে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। তাই তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং নির্বাচন কমিশন কেউই তাদের পুনরায় ক্ষমতায় আসার ব্যাপারে সাহায্য করেনি। সে কারণে তার কর্মীরা ভোট কারচুপি করার সুযোগ পায়নি।
শেখ হাসিনা নির্বাচনের দিন রাত ৯টার আগ পর্যন্ত বলেছিলেন যে, নির্বাচন অত্যন্ত অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু হচ্ছে কিন্তু হারার খবর শুনে ক্ষেপে গেলেন এবং বললেন যে, নির্বাচনে সূক্ষ্ম কারচুপি হয়েছে। যখন সারাদেশের দুর্দশার কথা জানতে পারলেন তখন বললেন, স্থূল কারচুপি হয়েছে। এ নির্বাচন মানি না। কিন্তু তাদের অন্যায় আব্দার দেশে-বিদেশে কোথাও গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। চারদলীয় জোট সরকার গঠন করলে তিনি বলবেন, চারদলীয় জোট ভোট ডাকাতি করে ক্ষমতায় গেছে। সরকার গঠন করেছে করুক, একদিনও তাদের শান্তিতে দেশ চালাতে দেব না। তার সে ওয়াদা তিনি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলেন। সরকারে থাকতে তিনি বলতেন বিরোধী দলে গেলে আমরা হরতাল দেব না। কিন্তু বিরোধী দলে গিয়েই তিনি ঘনঘন হরতাল, অবরোধ, জ্বালাও-পোড়াও ইত্যাদি শুরু করে দেন। শুধু তাই নয় ১৯৯৮ সালে জেএমবি সৃষ্টি করে ভারতে তাদের ট্রেনিং দিয়ে রেখেছিলেন। ইসলাম কায়েমের নামে দেশব্যাপী বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে মানুষ মেরে দেশের মধ্যে সন্ত্রাস সৃষ্টি করার জন্য, যাতে জেএমবির সন্ত্রাস দিয়ে জামায়াত-শিবিরকে দেশে-বিদেশে সন্ত্রাসী ও জঙ্গী হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। তারা হরতালের আগের দিন দোতলা বাসে আগুন ধরিয়ে ১২/১৪ জন জীবন্ত মানুষকে পুড়িয়ে মেরেছিল। হরতালের দিন সচিব পর্যায়ের ব্যক্তিদের মত সম্মানিত লোকদের দিগম্বর করে রাস্তায় ছেড়ে দিয়েছিল। তারা কয়েকজন পুলিশ সদস্যকেও হত্যা করেছিল। জেএমবি দিয়ে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে বরিশালে দু'জন জজকে হত্যা করেছিল। একদিনে একযোগে চৌষট্টিটি জেলায় বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে সারাদেশে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল। এভাবে নানাবিধ নাশকতামূলক সন্ত্রাসী কর্মকান্ড চালিয়ে দেশকে অচল করে দেবার ষড়যন্ত্র চালিয়েছিল। চারদলীয় জোট সরকার অত্যন্ত সহনশীলতার পরিচয় দিয়েছিল। বিরোধীদল যখন সন্ত্রাসের সীমা ছেড়ে যাচ্ছিল তখন সরকার র‌্যাব গঠন করে সন্ত্রাস দমন করে। এতে ১৪ দল র‌্যাবের বিরুদ্ধে কোর্টে মামলা দায়ের করেছিল। আওয়ামী লীগ আগাগোড়াই জানে জনগণের মন জয় করে ভোট পেয়ে ক্ষমতায় যাওয়া তাদের পক্ষে কম্মিনকালেও সম্ভব হবে না। ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিংই তাদের ভোটে নির্বাচনে জেতার একমাত্র উপায়। কিন্তু জামায়াত-বিএনপি যদি ঐক্যবদ্ধ থাকে আর কেয়ারটেকার বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হয় তাহলে কোন অপকৌশলের সুযোগ পাওয়া যাবে না। নির্বাচনে জেতা তো দূরের কথা অধিকাংশের জামানত রক্ষা করাই সম্ভব হবে না। সে কারণে তারা জামায়াত ও বিএনপির মধ্যে ফাটল ধরাবার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালাতে লাগল এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে অকেজো করার জন্য সংলাপের নামে নানারকম অসংগত প্রস্তাব দিতে লাগল। তাদের ওই প্রস্তাব মেনে নিলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকবে কেবলমাত্র নামকাওয়াস্তে। নির্বাচনে তাদের অপকৌশলে বাধা দেবার কোন শক্তি থাকবে না। সরকার তাদের ষড়যন্ত্র বুঝতে পেরে তাদের ওই সকল প্রস্তাব মেনে নেয়নি। তখন তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার বানচালের চেষ্টা চালাতে লাগল। কিন্তু তাতেও সফল হলো না। তারা সিদ্ধান্ত নিল যতক্ষণ পর্যন্ত নির্বাচনের ফল তাদের পক্ষে ঘুরিয়ে দেবার মত লোক তত্ত্বাবধায়ক সরকারে না দিতে পারবো ততক্ষণ পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমরা মেনে নেব না। তাদের অনেকবার ভেটো দেয়ার পর অবশেষে ফখরুদ্দীন ও মইনুদ্দীনকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারে আনা হলো। তারা ১৪ দলকে জিতাবার লক্ষ্যে নানা তালবাহানা করে ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন না করে নির্বাচন অনুষ্ঠিত করালো ২ বছর পর। তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং নির্বাচন কমিশনের ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের কারণে ১৪ দলের যেখানে ৩০টি আসন পাবার সম্ভাবনা ছিল না সেখানে দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি আসন দখল করলো। নির্বাচন যে কত সুষ্ঠু হয়েছিল এক কথায় তার নমুনা হলো এ নির্বাচনে অনেক কেন্দ্রে ১০৫% পর্যন্ত ভোট কাস্ট হয়েছিল।
দেশের আপামর জনগণ বলেছিল ২০০৮ সালের নির্বাচন ডিজিটাল ভোট ডাকাতির নির্বাচন। এ ধরনের ভোট ডাকাতি আর কখনো দেখা যায়নি। অথচ শেখ হাসিনা বলেছেন, এই নির্বাচন নাকি সব নির্বাচনের থেকে সুষ্ঠু ও সুন্দর নির্বাচন। ১৪ দল ক্ষমতায় এসেই যারা তাদের দেশ ধ্বংসের উদ্দেশ্য-লক্ষ্য বাস্তবায়নে কঠিন বাধা হয়ে দাঁড়াবে সেই সেনাবাহিনীর (ডানপন্থী) ৫৭ চৌকষ কর্মকর্তাকে পিলখানায় ডেকে এনে কিছু বিডিআরকে উস্কিয়ে দিয়ে হত্যা করালো। এরপর এ সকল বিডিআরকে বিদ্রোহী নাম দিয়ে কৌশলে নিঃশেষ করছে। কারণ তাদের অধিকাংশ দেশদরদী ও ইসলামপন্থী।
সংবিধানের পবিত্রতা রক্ষা করার কথা জোর গলায় বললেও তাদের থেকে সংবিধানের অবমাননা আর কেউ বেশি করেনি। সংবিধান সংশোধনের নামে অন্তত ৫০ জায়গায় কেটেছিঁড়ে নিজেদের আশা-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের দলিল বানিয়ে নিয়েছে। যেন তাদের ইচ্ছের বাইরে সংবিধানে কিছু থাকতে পারবে না।
তারপর বিরোধীদল থেকে কোন বাধা এসে তাদের গতিপথকে যাতে বিপর্যস্ত করে তুলতে না পারে সেজন্য বিরোধীদলের নেতা-কর্মীদের মিথ্যে মামলায় জড়িয়ে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করছে। এক একজনের বিরুদ্ধে ১০/১৫টি মামলা দিয়ে বছরের পর বছর জেলে আটকিয়ে রাখছে। কাউকে কাউকে দুনিয়া থেকে একেবারে মিটিয়ে ফেলারও চেষ্টা চালাচ্ছে।
নানা ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নিয়ে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান তুলে দিয়েছে। কোন আইনি বিধান মেনে নয় গায়ের জোরে। বলছে, যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসলে নেতাদের জেল খাটতে হয় সে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আর আনা হবে না। ফখরুদ্দীন ও মই উদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারকেতো ১৪ দলই নিয়োগ দিয়েছিল। শেখ হাসিনা গর্বের সাথেই বলেছিলেন এ সরকার আমাদের আন্দোলনের ফসল। আসলে ফখরুদ্দীন-মইন উদ্দিন সাহেবদের সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল না। কারণ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদকাল ৯০ দিন। কিন্তু তাদের সরকার দু' বছর সময় নিয়েছিল। তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কর্মক্ষমতার বাইরে গিয়ে দেশের সকল কিছু নিয়ন্ত্রণ করেছে। বর্তমান আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল যেমন আওয়ামী সরকারের ডমেস্টিক ট্রাইব্যুনাল তেমন ফখরুদ্দীন-মইন উদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারও ছিল তাদের ডমেস্টিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এ সরকার বলছে তত্ত্বাবধাযক সরকার অনির্বাচিত সরকার। এ সরকারের অধীন নির্বাচন করানো গণতন্ত্র বিরোধী। এখানে বলার বিষয় হলো মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টারাও অনির্বাচিত, তাদের পরামর্শে দেশ চালানোও তাহলে গণতন্ত্র বিরোধী হয়ে যায়। নির্বাচন কমিশনও অনির্বাচিত। তাদের দিয়ে নির্বাচন পরিচালনাও গণতন্ত্র বিরোধী হবে। প্রিজাইডিং অফিসার, সহ-প্রিজাইডিং অফিসার, পোলিং অফিসার সকলেই অনির্বাচিত। তাদের দিয়ে নির্বাচনের কাজ করানোও অগণতান্ত্রিক।
সরকার বিরোধী দলের দাবির মোকাবিলায় বলে থাকে আমাদের আদালতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে। আদালত সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার তুলে দিয়েছে। সুতরাং আর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন নির্বাচন করা যাবে না। কিন্তু মুখে আদালতের মর্যাদা রক্ষার কথা বললেও তারাই অহরহ আদালতকে অবমাননা করছে। আদালতকে যদি তারা এতই সম্মান করতো তাহলে আদালত আগামী দু'টার্ম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন নির্বাচন হওয়ার সুযোগ রেখেছিল। কিন্তু আদালতের সে রায় তারা মানেননি। বরং উক্ত রায়ের গলায় স্বৈরাচারী ছুরি চালিয়েছেন।
দেশের সকল বিরোধীদল, জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিবর্গ, আইনবিদ, শিক্ষাবিদ, কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক রাজনীতি-বিশ্লেষকগণ এমনকি আওয়ামী লীগের তৃণমূলের কর্মীরা যারা ময়দানের দাবি বুঝতে পারছেন তারাও দাবি করছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার। বিদেশ থেকেও পরামর্শ আসছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের। তারা বলছেন বাংলাদেশে নিরপেক্ষ এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিকল্প নেই। এটা স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে যে, নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে না হলে চরম সংঘাত বেধে যাবে। গৃহযুদ্ধ শুরু হবে। হাজার হাজার জীবন ধ্বংস হবে। কিন্তু তারা সে ব্যাপারে মোটেই কান দিচ্ছেন না। বিরোধীদল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন নির্বাচনের দাবি করেই বসে নেই। দাবি আদায়ের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগের জযবা নিয়েই সংগ্রামে নেমেছে। সামনে দেশের ভয়াবহতা অাঁচ করতে পেরে ডঃ কামাল হোসেন, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী, আ স ম আবদুর রব, ডঃ এমাজ উদ্দীন আহমদ প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিগণ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রেখেছেন।
শরীক দলের অধিকাংশ দলই মহাজোট থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। তারাও দাবি করছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন করানোর জন্য। গোঁ না ধরে দেশের শান্তি-শৃক্মখলা রক্ষার্থে সরকারের উচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির অধীনে আগামী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার ঘোষণা দেয়া। সরকার যদি নিজেরা জিততে পারবে না এই ভয়ে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করাতে চায় তাহলে বিরোধীদল এবং জনগণ তা প্রতিহত করার জন্য সাধ্যমতো বাধা দেবে। এতে দু' পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বেধে যাবে এবং চরম হানাহানিতে সারা দেশে রক্তের প্লাবন বয়ে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে বলে অভিজ্ঞ মহলের ধারণা।
আওয়ামী বলয়ের লোকেরা বলে থাকেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়াও যে নির্বাচন সুষ্ঠু হতে পারে তার অনেক প্রমাণ আমাদের সামনে রয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীকে পরাজিত করে জামায়াত এবং বিএনপি'র প্রার্থী চেয়ারম্যান হয়েছে।
নারায়ণগঞ্জে সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী শামীম ওসমানকে পরাজিত করে ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী জিতেছেন। টাঙ্গাইলে উপ-নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী না জিতে জিতেছেন বিদ্রোহী স্বতন্ত্র প্রার্থী আমানুর রহমান রানা।
রাজনৈতিক সচেতন মহলের বক্তব্য হলো, এসব আওয়ামী সরকারের চালবাজি। জনগণকে এভাবে ধোঁকা দেয়া হচ্ছে যে, দেখো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন না হয়েও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থেকেও চেয়ারম্যান নির্বাচনে তাদের প্রার্থী জামায়াত-বিএনপির কাছে চরমভাবে পরাজিত হয়েছে। অতএব, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলেও নির্বাচন সুষ্ঠু হবে এবং অন্য দলের যোগ্য প্রার্থীরাও নির্বাচিত হতে পারবেন। আসলে চেয়ারম্যান নির্বাচন আর জাতীয় পরিষদ নির্বাচন এক জিনিস নয়, একথা জনগণ ভালোভাবেই বুঝে। আওয়ামী লীগের একজন ব্যক্তিও যদি চেয়ারম্যান নির্বাচিত না হয় তাতে তাদের কিছুই আসে-যায় না। বরং জাতীয় নির্বাচনে সরকার গঠনের মতো আসন দখল করতে পারলেই হলো। সে কারণেই তাদের এই পাতানো খেলা। তাদের নিয়ত যে মোটেই সহীহ না, তার প্রমাণ হলো একটি উপ-নির্বাচনেও বিরোধীদলের কাউকে সংসদে আসার সুযোগ দেয়া হয়নি। ভোলার উপ-নির্বাচনে মেজর হাফিজের মতো যোগ্য ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিকে জবর দখল করে জিততে না দিয়ে শাওনের মতো অযোগ্য লোককে জিতানো হলো। হাফিজের মতো লোকদের এমনভাবে মারধর করা হয়েছিল যে, এখনও কেউ কেউ পুরোপুরি সুস্থ হতে পারেননি।
নারায়ণগঞ্জে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে শামীম ওসমানকে মনোনীত প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা দিলেও ডা. আইভীকে মেয়র বানাবার সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের আগেই ঘোষণা দিয়েছিলেন। আর শামীম ওসমানকে আগামী জাতীয় নির্বাচনে এমপি বানিয়ে সংসদে নেয়ার পরিকল্পনা তাদের রয়েছে। এতে মেয়র এবং এমপি'র দু'টো পদই তাদের দখলে থাকবে।
টাঙ্গাইলে উপ-নির্বাচনে যাকে জেতানো হবে না তাকে দিল মনোনয়ন আর যাকে জেতানো হবে তাকে বিদ্রোহী সাজিয়ে দল থেকে বহিষ্কার করে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জিতিয়ে নিয়েছে। যাতে লোকে ভাবে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও দল থেকে বহিষ্কৃত ব্যক্তি জিতে গেছে। তাহলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচন হতে বাধা কিসের? কিন্তু নির্বাচনে জিতেই ভোটারদের চরমভাবে আশাহত করে আমানুর রহমান রানা ঘোষণা দিলেন যে, আমি আমার দলেই ফিরে যাব। এতেই জনগণের বুঝতে বাকী রইল না যে, এটা আওয়ামী লীগের নির্বাচনী অপকৌশল। কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন এদেরকে উস্তাদ না মেনে স্বয়ং ইবলীসেরও চলার উপায় নেই।
আসলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে ২০০৮ সালের মতো ফলাফল হবে। কারণ আওয়ামী লীগের টার্গেট হলো আপাতত ২০২১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার। নির্বাচনে অন্যদল জিতে সরকার গঠন করলে তাদের সে বাসনা পূর্ণ হবে কেমন করে? তাই ছলেবলে কলেকৌশলে যে করেই হোক তাদের ক্ষমতায় আসতেই হবে। অন্যদল ছাড়াই সংসদে সবরকম বিল পাস করিয়ে নিতে পারে এত পরিমাণ আসন নিজেদের দখলে রেখে বাকিগুলো বিরোধীদলের জন্য ছেড়ে দিতে পারে। ২০০৮ সালে যা হয়েছে। পক্ষান্তরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে ২০০১ সালে যে কয় আসন পেয়েছিল ২০১৩ সালের নির্বাচনে তার অর্ধেক আসন পেতে পারে বলে অভিজ্ঞমহলের ধারণা।
আওয়ামী লীগের নেতারা বলে থাকেন নির্বাচন কমিশনকে যদি স্ট্রং করা যায় তাহলে নির্বাচন নিরপেক্ষ এবং সুষ্ঠু হবে। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন কমিশন যত শক্তিশালীই হোক না কেন সরকারের নির্দেশের বাইরে তার কিছু করার থাকবে না। এখন যেমন দুদক, হাইকোর্ট-সুপ্রিমকোর্ট সরকারের মর্জির বাইরে একপাও নড়তে পারছে না।
আওয়ামী লীগ যদি ক্ষমতায় থেকে নির্বাচনে বিরোধীদলকে জিততেই দেবে তাহলে বিরোধীদলের সকল মানবিক, সাংবিধানিক, গণতান্ত্রিক, রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকার পদদলিত করত না। নিজেদের দাবি-দাওয়া আদায়, সরকারের অন্যায়ের প্রতিবাদে জনসভা, মিছিল-মিটিং করা এবং হরতাল ডাকা এসবই গণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক অধিকার। অথচ সরকার বিরোধীদলকে একেবারেই ময়দানে নামতে দিচ্ছে না। এমনকি মানববন্ধনের মতো নিরীহ ও দুর্বল প্রতিবাদও করতে পারছে না। কোথাও মানববন্ধনের ব্যবস্থা করলে পুলিশ, র‌্যাব জলকামান, কাঁদুনে গ্যাস, লাঠি ইত্যাদি নিয়ে আক্রমণ করছে। মিছিলকারীদের বেধড়ক পিটাচ্ছে, ধরে নিয়ে মিথ্যা মামলায় রিমান্ডে দিচ্ছে। পুলিশের সাথে দলের ক্যাডার বাহিনী হাসুয়া, রামদা, পিস্তল ইত্যাদি নিয়ে মিছিলকারীদের ওপর চড়াও হচ্ছে। কখনো পুলিশ এবং ক্যাডাররা মিলে গুলী করে বিরোধীদলের কর্মীদের হত্যা করছে। দীর্ঘদিন যাবত বিরোধীদলকে তাদের অফিসে বসতে দিচ্ছে না। অনেক স্থানে বিরোধীদলের অফিসে ভাংচুর, লুট ও অগ্নিসংযোগ করা হচ্ছে।
পুলিশ বাহিনী বিরোধীদলীয় জাতীয় নেতাদের ওপর নির্বিচারে লাঠিচার্জ করছে। বিরোধীদলের সম্মানিত চীফহুইপ জয়নুল আবদিন ফারুককে পিটিয়ে হাসপাতালে পাঠিয়েছিল। আরেক পুলিশ কর্মকর্তাকে দেখা গেল, মিছিলে যোগদানকারী এক ব্যক্তিকে পিটিয়ে মাটিতে ফেলে তার বুকের ওপর বুট পায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে। বাসায় বাসায় ঢুকে বিরোধীদলের পুরুষ এবং মহিলা কর্মীদের বিনা অপরাধে ধরে নিয়ে রিমান্ডে দিচ্ছে, জেলখানায় পাঠাচ্ছে।
ইউনিভার্সিটি এবং মেডিকেল কলেজের নির্বাচনে যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা অন্যমতের লোকদের পিটিয়ে ভোটকেন্দ্র থেকে বের করে দিয়েছিল। তাদের আক্রমণে আক্রান্ত হয়ে অনেক সম্মানিত শিক্ষকদের মাসের পর মাস হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। আওয়ামী ক্যাডাররা বিরোধীমতের ভোটারদের জোরপূর্বক বের করে দিয়ে ব্যালট পেপার ছিঁড়ে নিজেদের প্রার্থীর বাক্স ভরে দিয়ে বিপুলভোটে বিজয়ী করে দিয়েছে। এটাই কি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের নমুনা?
আসলে রাজনীতিকে মিথ্যা ও ধোঁকা-ফাঁকির বিষয় মনে করেন তারা। তাদের জীবনটাকেই মিথ্যা উৎপাদনের কারখানায় পরিণত করে নিয়েছেন। তাই তারা রাতদিন মিথ্যা বলেন এবং মিথ্যার ওপরেই চলেন। যারা বেশি বেশি মিথ্যা বলেন, আল্লাহর দফতরে তাদের নাম মিথ্যাবাদীদের তালিকায় লিপিবদ্ধ হয়ে যায়। তখন তাদের মুখ দিয়ে সত্য বের হয় না। তারা কোন সত্যকে প্রকাশ করতে চাইলেও মিথ্যার আবরণে প্রকাশ করে থাকেন। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায়- রামুতে যে সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটল, কারা ঘটিয়েছে, কিভাবে ঘটিয়েছে তা টিভি ফুটেজে এবং ভিডিওতে স্পষ্টভাবে ধরা পড়েছে। স্থানীয় জনগণ, ভুক্তভোগী হিন্দু ও বৌদ্ধগণ তা চাক্ষুষভাবে দেখেছেন এবং সাংবাদিকদের নিকট তা খোলাখুলিভাবে বলেও দিয়েছেন যে, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের নেতৃত্বেই এই জঘন্য ঘটনা ঘটেছে। তা সত্ত্বেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সত্য জেনেও তা প্রকাশ করলেন জঘন্য মিথ্যার আবরণে। তারা বললেন, জামায়াত-শিবির ও বিএনপির লোকেরাই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ধ্বংস ও অশান্তি সৃষ্টির জন্যই এ কাজ করেছে। গার্মেন্টসে আগুন ধরে ১২৬ জন মানুষ জীবন্ত পুড়ে মরল, যারা বেঁচে আছে তারা বলছে কর্তৃপক্ষের খামখেয়ালী ও দুরভিসন্ধির কারণেই এতগুলো জীবন শেষ হলো এবং গার্মেন্টসের সম্পদ নষ্ট হলো। অনেকের ধারণা, এ সরকার গার্মেন্টসের উন্নয়ন সহ্য করতে পারে না তাই এ ঘটনায় সরকারেরও ইন্ধন থাকা অস্বাভাবিক নয়। অথচ সরকার চোখ-মুখ বন্ধ করে বলে ফেলল এখানে জামায়াত-শিবিরের সম্পৃক্ততা আছে।
মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নির্দেশের অংশ হিসেবে রাজপথে বিশ্বজিৎকে কুপিয়ে হত্যা করল ছাত্রলীগের হিরের টুকরো ছেলেরা, অথচ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব বললেন, জামায়াত-শিবিরই বিশ্বজিৎকে হত্যা করেছে। কিন্তু টিভি ফুটেজে ভিডিওতে হত্যাকারীদের ছবি ধরা পড়েছে। পত্র-পত্রিকায় তার সচিত্র ছবি ছাপা হয়েছে। ফলে সরকার পক্ষ মুখ বন্ধ রাখলেও খুনীদের বাঁচাবার কোশেশ চালিয়েই যাচ্ছে। আমাদের মনে রাখতে হবে সত্যের জয় অবশ্যম্ভাবী। একদিন সত্যের জয় হবেই।
আইনের শাসন কায়েম জনগণের জানমাল ও ইজ্জতের নিরাপত্তা বিধান, দেশের শান্তি-শৃক্মখলা রক্ষা করার দায়িত্ব সরকারের। তাই সরকারের এমন কোন হঠকারী সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে নামা উচিত নয় যা দেশবাসীর জান-মাল-ইজ্জতকে বিপন্ন করে, মানবতা মনুষত্ব নিগৃহীত হয়।
শান্তি রক্ষায় দরকার
তত্ত্বাবধায়ক সরকার

Ads