মঙ্গলবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৩
শেখ হাসিনা দারুণ! তাঁর
দলের সন্ত্রাসীরা পুলিশের সহায়তায় যখন লাঠি হাতে প্রেস ক্লাবে সাংবাদিকদের ওপর
চড়াও কিম্বা সুপ্রিম কোর্টের ভেতরে পুলিশের প্রশ্রয়ে গেট ভেঙে ঢুকে আইনজীবীদের
নির্দয় ভাবে লাঠি দিয়ে পেটাচ্ছে, আর পেটাচ্ছে নারী
আইনজীবীদের- শেখ হাসিনা তখন বলছেন, ‘এক-এগারোর
কুশীলবরা আবার সক্রিয়। এক শ্রেণির বুদ্ধিজীবী অসাংবিধানিক সরকারকে মতায় আনতে চান’। তখন তাঁকে বেশ গুরুগম্ভীর বুদ্ধিজীবীর
মতোই মনে হচ্ছিল।
দারুণ যে খালেদা
জিয়াকে কোন কর্মসূচিই পালন করতে হয় নি। তিনি ‘সার্বভৌমত্ব
ও গণতন্ত্র’ রক্ষার জন্য অভিযাত্রার ডাক
দিয়ে যে রাজনৈতিক ফল পাবার আশা করেছিলেন, তার
চেয়ে দশ গুণ বেশি ফল পেয়ে গিয়েছেন মতাসীনদের কারণে। তিনি আন্দোলনের ধরন বদলাতে
চেয়েছেন, কারণ ধর্মঘট ও অবরোধ
কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে যে অনিবার্য সহিংস পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছিল বারবার, সেই অবস্থা থেকে তিনি বেরিয়ে আসতে চেয়েছেন।
খালেদা জিয়া যেখানে হরতাল বা অবরোধ-ধরনের কর্মসূচি থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছেন, সেখানে শেখ হাসিনা বিরোধী দলের চেয়েও আরো
কড়া অবরোধ আরোপ করলেন। খালেদা জিয়ার কর্মসূচিতে কিছু কিছু গণপরিবহন নামত, রিকশা টেম্পো চলত, মানুষ হাঁটত। এবার হাঁটতেও বাধা দিয়েছে
পুলিশ। দুর্দান্ত অবরোধ কর্মসূচি পালন করলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
খালেদা জিয়া তাঁর গণতন্ত্রের অভিযাত্রা চালিয়ে যাবেন, শেখ হাসিনার অবরোধও চলবে। শেখ হাসিনার
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসী ক্যাডাররা খুবই সফল। এতটাই সফল যে
বেগম খালেদা জিয়া তাঁর বাসা থেকে বেরোতেই পারেন নি। তাঁকে পুলিশ গেটের বাইরে এক
কদমও অগ্রসর হতে দেয় নি। শেখ হাসিনা যে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন, তুলনায় বাকশালী শেখ মুজিবুর রহমান শুকনা
আমসত্ত্বের মতো প্রাচীন হয়ে গিয়েছেন।
ফলে সৈয়দ আশরাফুল
ইসলাম বিরোধী দলের কর্মসূচি ‘ব্যর্থ’ বললেও তাতে বিশেষ কিছুই আসে-যায় না।
ব্যাপারটা কর্মসূচির সফলতা-ব্যর্থতার মামলা নয়। কর্মসূচি দেওয়া সুনির্দিষ্ট
রাজনৈতিক ফল লাভের জন্য। সেই দিক থেকে খালেদা জিয়ার জয়ই হয়েছে। যদি খালেদা জিয়ার
জয় হয়েছে সেই কূটতর্কে যেতে না চাই তাহলে এটা অনায়াসেই মেনে নেওয়া যায় যে, ২৯ তারিখের গণতন্ত্রের অভিযাত্রায়
মতাসীনদের নির্লজ্জ পরাজয় হয়েছে। আজ একই কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে। থাকুক। এই ফাঁকে
আমরা এক-এগারোর কুশীলবদের কথা বলি।
শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘এক-এগারোর কুশীলবরা আবার সক্রিয়। এক
শ্রেণির বুদ্ধিজীবী অসাংবিধানিক সরকারকে মতায় আনতে চান’। কারেক্ট। কিন্তু তারা শুধু এখন সক্রিয়
হয়ে উঠেছে তা নয়, তারা বরাবরই সক্রিয় ছিল।
আমাদের মনে আছে এক-এগারোর সময় মতাসীন বিএনপির বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার সক্রিয়তার
পাশাপাশি এখনকার কুশীলবরাই সক্রিয় ছিলেন। শেখ হাসিনাও এক-এগারোর সরকারকে স্বাগত
জানিয়েছিলেন, এটা ভুলে গেলে চলবে না। এক-এগারোর
কুশীলবরা দাবি করেছিলেন তাঁদের কারণেই সেনাসমর্থিত সরকার মতায় এসেছে। এই সফলতায়
তাঁরা গর্ব প্রকাশ করেছিলেন। সন্দেহ নাই সেই কুশীলবরা বাংলাদেশে বহাল তবিয়তেই
আছেন। তাঁরা তাঁদের সক্রিয়তা মোটেও কমান নি। এটাও শেখ হাসিনাকে ভুলে গেলে চলবে না
যে এক-এগারোর কুশীলবদের সক্রিয়তার সাড়ে ষোল আনা সুফল ভোগ করেছেন তিনি নিজে। নবম জাতীয়
সংসদ নির্বাচনে তাঁর জয় এক-এগারোর কুশীলবদের ভূমিকা ছাড়া কখনই সম্ভব হোত না।
এক-এগারো সম্পর্কে
সাধারণ অনুমান হচ্ছে, এটা একটা ষড়যন্ত্র।
রাজনীতিতে সবসময় ষড়যন্ত্র থাকে, এই অর্থে যে কাউকে-না-কাউকে
কিছু ঘটনা ঘটাতে হয়। কিন্তু ষড়যন্ত্র দিয়ে রাজনীতি বোঝা অসম্ভব। আসলে যখন রাজনীতির
গতিপ্রক্রিয়া কেউ আর ব্যাখ্যা করতে পারে না তখন সেই রহস্যময় জায়গাটাকেই ষড়যন্ত্র
তত্ত্ব দিয়ে বুঝ দেবার শর্টকাট পথ গ্রহণ করা হয়। এক-এগারোকে বুঝতে হলে ষড়যন্ত্র
তত্ত্ব দিয়ে নয়, বুঝতে হবে বাস্তব অবস্থার
বাস্তব বিশ্লেষণ দিয়েই।
বাংলাদেশের রাজনীতির
একটা সংস্কার দরকার- এর পক্ষে একটা জনমত আছে। সেই সংস্কার শুধু রাজনৈতিক দল বা
রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের সংস্কার নয়, জনগণের
দিক থেকে তাগিদটা খোদ রাষ্ট্রের সংস্কার, এমনকি
সম্ভব হলে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তর। এক-এগারোর কুশীলবদের বুঝতে হলে বুঝতে
হবে তারা আসলে ঠিক রাষ্ট্রব্যবস্থার গণতান্ত্রিক রূপান্তরে আগ্রহী নয়, এমনকি সংস্কারেও নয়। সংস্কার করতে হলেও
বাংলাদেশের বাস্তবতায় নিদেনপে এমন এক গণক্ষমতা তৈয়ার করা দরকার, যা সংস্কার করতে সক্ষম। এটাও কম কঠিন বা র্যাডিক্যাল
নয়। কিন্তু সে গণক্ষমতা তৈরিতে তারা রাজি নয়। ফলাফলে দাঁড়ায় আসলে তারা কোন
রূপান্তর দূরে থাকুক সংস্কারেই আগ্রহী নয়।
বরং তাদের মূল ল্য
রাজনৈতিক দল। রাজনৈতিক দলগুলোর সমালোচনা এবং তাদের দুর্নীতি ও কুকীর্তির বিরুদ্ধে
জনগণকে সচেতন করা দরকারি কাজ। ফলে যারা এ কাজ করেন তারা জনগণের পক্ষেই কাজ করেন।
এক-এগারোর কুশীলবরাও এ কাজ করেন। কিন্তু একই কাজ করার পরেও এক-এগারোর কুশীলবদের
আমরা চিনতে পারি যখন সুযোগ পেলেই তারা খোদ রাজনীতিরই নিরাকরণ ঘটাতে চায়। একে
সাধারণত বিরাজনীতিকরণ বলা হয়। রাজনৈতিক দলগুলোর কুকীর্তিতে বীতশ্রদ্ধ জনগণ
রাজনৈতিক দল বাদ দিয়ে বা রাজনীতি বাদ দিয়ে যদি শান্তিতে থাকতে পারে, সে আশায় বিরাজনীতিকরণে আগ্রহী হয়ে ওঠে। এক-এগারোর
কুশীলবদের রাজনীতিতে ভূমিকা পালনের শর্ত এভাবেই তৈরি হয়। এর জন্য রাজনৈতিক দলগুলোই
প্রধানত দায়ী।
এই দিক থেকে এক-এগারোর
কুশীলবরা বাংলাদেশের একটি বিশেষ রাজনৈতিক চিন্তার প্রতিনিধি বটে। যারা এই চিন্তা
ধারণ করেন তারা দলীয় রাজনীতিতে বিতৃষ্ণ, প্রধান
দুই রাজনৈতিক জোটের অত্যাচার থেকে নিষ্কৃতি পাবার জন্য তারা প্রায়ই দিবাস্বপ্ন
দেখেন। এই দিবাস্বপ্নের নাম তৃতীয় শক্তি। তাদের মনের গোপন বাসনা এই যে তাঁরাই হবেন
সেই তৃতীয় শক্তি। কিন্তু বিদ্যমান দলগুলোর বাইরে তাদের নিজেদের কিছু করবার মতা
নাই। মতার লড়াই কখনই খুব আরামের কাজ নয়, বাংলাদেশের
মতো দেশে সেটা সহিংস রূপ নেয় বাস্তবতার কারণেই। কিন্তু যারা রাজনৈতিক সংস্কার চান
তারা চান সেটা শান্তিপূর্ণ ও অহিংস হোক। দুই দলের মতার বাইরে জনগণের মতা বিকাশের
পথ কঠিন ও বন্ধুর। এক-এগারোর কুশীলবরা কণ্টকাকীর্ণ ও কঠিন পথে যেতে নারাজ। ফলে
তারা ঢোঁক গিলে বাস্তবিক কারণেই মেনে নেন যে তৃতীয় শক্তি আসলে ‘সেনাবাহিনী’। কারণ সশস্ত্র ও সহিংস রাজনৈতিক দলগুলোর বাইরে সশস্ত্র মতা
হিসেবে একমাত্র সেনাবাহিনীকেই তারা বাস্তবে দেখতে পায়। আর আসলে এটাই বাস্তব
পরিস্থিতি। তৃতীয় শক্তি হিসেবে এক-এগারোর কুশীলবরা মতাধর হয়ে সমাজে হাজির হবার
একমাত্র সম্ভাবনা সেনাসমর্থন; এ ছাড়া তাদের বাসনা
চরিতার্থ করা কঠিন। কিন্তু সেনাবাহিনীকে রাজনীতিতে যুক্ত করতে হলে আন্তর্জাতিক
পরাশক্তির সমর্থন ছাড়া সম্ভব নয়। কাজেই এর ফলে সমাজের বিশেষ একটি শ্রেণি, সেনাবাহিনী ও পরাশক্তির একটা ত্রিভুজ
সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আগেই বলেছি ওর পেছনে থাকে বিদ্যমান রাজনীতির সংস্কারের আকাক্সা।
এতটুকুই মাত্র এর ইতিবাচক দিক। সেই আকাক্সার আর্থ-সামাজিক কারণ হিসেবে হাজির থাকে
কিছু কিছু ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতির গতিশীল বিকাশের সম্ভাবনা।
বিদ্যমান রাজনীতি ও রাজনৈতিক দলগুলোর কুকীর্তির কারণে যে সম্ভাবনা নষ্ট হবার বিপদ
তৈরি হয়। যেমন, বলা হয়, বাংলাদেশ মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হবার
সম্ভাবনায় টইটম্বুর। কিন্তু সে সম্ভাবনা বানচাল হতে বসেছে রাজনৈতিক দলগুলোর
কুশাসনের জন্য। কথাটা উড়িয়ে দেবার মতো নয়। সে কারণেই কুশাসনের জায়গায় আমরা প্রায়ই
সুশাসনের কথা শুনি।
এই বিপদের আরেকটি
গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে ‘দুর্নীতি’। রাজনৈতিক দলগুলোর বিরুদ্ধে এক-এগারোর
কুশীলবদের রাজনৈতিক প্রপাগান্ডায় সবচেয়ে প্রধান অস্ত্র ছিল দুর্নীতি। একে আমি
উদ্ধৃতি চিহ্ন দিয়েছি। এ কারণে যে অর্থশাস্ত্র দুর্নীতি মাত্রই মন্দ- এই নীতিবাদী
বাচালতার কারবার করে না। দুর্নীতি ছাড়া পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্কের বিকাশ ও বিস্তার
চিন্তাই করা যায় না। পুঁজিতন্ত্র চাই, কিন্তু
দুর্নীতি চাই না, এটা তো হতে পারে না। প্রশ্ন
হচ্ছে দুর্নীতির দ্বারা উপার্জিত অর্থ বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে যাচ্ছে, নাকি পাচার হয়ে যাচ্ছে দেশের বাইরে। নাকি
সেই দুর্নীতি নির্লজ্জ ভাবে সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছে। শেখ হাসিনার সরকার যেমন।
বাংলাদেশের দুর্নীতিকে বুঝতে
হলে এখানে পুঁজি গঠন এবং পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্ক গড়ে ওঠার বিশেষ ধরন বিচার করা
দরকার। সেটা করতে হলে বহুপীয় ও দ্বিপীয় দাতা সংস্থাগুলোর ভূমিকা, কাঠামোগত সংস্কার, অবাধ বিনিয়োগ ও অবাধ বাজারব্যবস্থা, রফতানিমুখী উন্নয়ননীতিসহ আরো নানান দিক
পর্যালোচনার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। বিচ্ছিন্ন বা বিক্ষিপ্ত ভাবে নীতিবাদী কায়দায় ‘দুর্নীতি’র মূল্যায়ন বালখিল্যতা ছাড়া কিছুই নয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের হাড়
মাংস মজ্জা পানি করা যে পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্ক আমাদের চোখের সামনে গড়ে উঠেছে ও
বিস্তার ঘটছে, সেই অসহনীয় ব্যবস্থার
সুনির্দিষ্ট চরিত্র বোঝার দিকে মনোযোগ নিবিষ্ট করাই এ ক্ষেত্রে আসল কাজ। অর্থাৎ
দুর্নীতি থেকে মুক্তি পেতে হলে সংস্কার করতে হবে আসল জায়গায়। এর সাথে সংশ্লিষ্ট
রয়েছে গণমতা তৈরির কাজ। সেটা না করে এক-এগারোর কুশীলবরা দুর্নীতির চরিত্র বিচার
করে শুধু জনগণের ‘উপলব্ধি’র মাত্রা দিয়ে। পুলিশ, প্রশাসন, বিচারব্যবস্থা, স্বাস্থ্যব্যবস্থাসহ
রাষ্ট্রের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে জনগণের উপলব্ধি
দিয়ে দুর্নীতি পরিমাপ করা হয়। এখন রাজনৈতিক দলগুলোর দুর্নীতির তথ্য প্রকাশিত হয়ে
পড়ায় সেটা মুখ্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে। সেটা ভালো। এক-এগারোর কুশীলবদের রাজনীতি বুঝতে
হলে বুঝতে হবে তারা রাজনীতি বা রাষ্ট্রব্যবস্থার মৌলিক সংস্কারে কিম্বা
পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার পর্যালোচনাতে মোটেও আগ্রহী নয়। তারা বরং বিদ্যমান
ব্যবস্থায় জনগণের ক্ষোভে আশ্রয় করে তাকে ততটুকুই প্রশমন করতে রাজি যতটুকু বিদ্যমান
ব্যবস্থাকে সহনীয় করে তুলতে কাজে লাগে।
রাজনীতিতে এক-এগারোর
কুশীলবরা রাজনৈতিক দল ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার অনিশ্চিত ও সংঘাতপূর্ণ প্রক্রিয়া
এড়িয়ে বাংলাদেশে ‘সুশাসন’ কায়েম করতে চায়। এই অর্থে যে গণতান্ত্রিক
রাষ্ট্র কায়েমের চেয়ে আন্তর্জাতিক পুঁজি এবং বহুজাতিক করপোরেশানের জন্য একটি
স্থিতিশীল ও ঝামেলামুক্ত রাজনৈতিক পরিবেশ নিশ্চিত করাই তাদের প্রধান লক্ষ্য। এ
কারণেই ‘বিরাজনীতিকরণ’ (depoliticisation) কথাটা চালু হয়েছে। এর
সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছে তথাকথিত ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলা। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে তাদের
বিরোধের জায়গাটা হচ্ছে স্থিতিশীলতা বহাল রাখার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর
ব্যর্থতা। সেনাবাহিনীর ভূমিকার কথাটা এই স্থিতিশীলতা রার প্রয়োজনেই ওঠে। সেটা
জনগণের স্বার্থ পাহারা দেবার জন্য নয়, আন্তর্জাতিক
পুঁজি ও বহুজাতিক কম্পানিগুলোর বিনিয়োগ ও মুনাফা নিশ্চিত করবার জন্যই। অতএব
বিরাজনীতিকরণ কথাটা বুঝতে হবে আক্ষরিক অর্থে নয়, বরং সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক অর্থে। বিরাজনীতিকরণেরও রাজনীতি আছে।
বুঝতে হবে লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জনগণের গণতান্ত্রিক শক্তি অর্জনের বিপরীতে
বিদ্যমান ব্যবস্থার টিকিয়ে রাখবার রাজনীতি হিসেবে।
এ কারণে ‘সুশাসন’ বলাবাহুল্য
গণতন্ত্র নয়, করপোরেট শাসন। গুড
গভর্নেন্স। প্রথমেই এটা পরিষ্কার বুঝতে হবে। ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি পলাশীর যুদ্ধের
পর ধীরে ধীরে এ দেশের ‘শাসনভার’ তাদের নিজেদের হাতে তুলে নেয়। সেটা ছিল
ঔপনিবেশিক শাসন। সেটাও ছিল ইংরেজদের দিক থেকে সুশাসন। কিন্তু ঔপনিবেশিক শাসন আজ আর
নাই, বা নৈতিক ভাবে বহাল রাখা
অসম্ভব। সেই জায়গায় বহুজাতিক কোম্পানির স্বার্থে সুশাসন কায়েম জরুরি হয়ে পড়েছে।
দ্বিতীয়ত ঔপনিবেশিকতা
পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থা গড়ে উঠবার উঠতি সময়। এখন দুনিয়াজোড়া বিশ্ব
পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম রয়েছে। আমরা সেই ব্যবস্থার প্রান্তে আছি, কেন্দ্রে নয়; আন্তর্জাতিক শ্রমবিভাগের যে অবস্থানে রয়েছি সেখানে আমাদের বেঁচে
থাকবার একমাত্র পথ হচ্ছে সস্তা শ্রম বেচা- দেশের ভেতরে বা বাইরে। এমন এক শ্রম যার
জীবসত্তার কোন মূল্য নাই। একে পুড়িয়ে মারা যায়, বিল্ডিং
ভেঙে চাপা দিয়ে জ্যান্ত কবর দেওয়া যায়, মধ্যপ্রাচ্যের
মরুভূমিতে সূর্যের দহনে দগ্ধ করা যায়, কিম্বা
মালয়েশিয়ার রাবার বাগানে সাপের কামড়ে মরতে পাঠানো যায়, ইত্যাদি।
নিরন্তর পুঁজির
পুঞ্জীভবন ও আত্মস্ফীতি ঘটছে, সেটা একটি বৈশ্বিক
প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়াকে অবাধ রাখতে বাজারব্যবস্থার ওপর রাষ্ট্রের কোন প্রকার
হস্তপে বরদাশত করা হয় না। রাষ্ট্রকে এ কাজ করতে না দেওয়াও ‘সুশাসন’-এর
অন্তর্গত। বিনিয়োগ ও উন্নয়নের একমাত্র এজেন্ট বা চালিকাশক্তি হচ্ছে বহুজাতিক
করপোরেশান বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা। এই প্রক্রিয়ায় রাজনীতির মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে
পুঁজির দৃশ্যমান আন্তর্জাতিক ধরন, যাকে আমরা সাধারণত
বহুজাতিক করপোরেশান বলি। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর কাজ হচ্ছে পুঁজিতান্ত্রিক
ব্যবস্থায় নিরন্তর তৈরি হওয়া অর্থনৈতিক অসাম্য, দারিদ্র্য
ও সামাজিক অসন্তোষ সামাল দেওয়া। বাংলাদেশে সেনাসমর্থিত সরকার কায়েম করাই এক-এগারোর
কুশীলবদের প্রধান কাজ ছিল না। তাদের কাজ ছিল পুঁজির অবাধ বিনিয়োগ ও মুনাফা কামাবার
জন্য প্রয়োজনীয় ‘রাজনৈতিক’ স্থিতিশীলতা ও শান্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা।
রাজনৈতিক দলগুলো ব্যর্থ হলে, বলা বাহুল্য, সবসময়ই স্থিতিশীলতার জন্য সুশীলসমাজ, সেনাবাহিনী ও পরাশাক্তির আঁতাত অনিবার্য
ভাবেই গড়ে ওঠে। এখানে কোন ষড়যন্ত্রের দরকার পড়ে না।
বাংলাদেশে আবার সেই
পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। আর এবার এই অবস্থা তৈরিতে প্রধান ভূমিকা নিয়েছেন শেখ
হাসিনা। এটা পরিষ্কার। অবস্থাদৃষ্টে দেখা যাচ্ছে, এক-এগারোর কুশীলবরা সংবিধানের মধ্যে থেকে কিভাবে শেখ হাসিনাকে
মোকাবিলা করা যায় তার ফর্মুলা বের করবার জন্য প্রাণান্ত হয়ে যাচ্ছেন। সে সম্ভাবনা
খুবই ক্ষীণ। ফলে এক-এগারোর পরিস্থিতি তৈরি হলে অবাক হবার কিছু নাই। শেখ হাসিনার
নাসিকা প্রখর। তিনি ধরে ফেলেছেন কিছু একটা পরিকল্পনা চলছে।
এবার এক-এগারোর ঘটনা
ঘটলে জনগণের দিক থেকে হয়তো এই মুহূর্তে কোন ইতরবিশেষ বা তিবৃদ্ধি নাই। দেখা যাক কী
হয়!!
ড.রেজোয়ান সিদ্দিকী
দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত শেখ হাসিনার সরকার ভয়ে আতঙ্কে একেবারে বিবর্ণ হয়ে গেছে। আর দুর্নীতি যেমন তেমন নয়। এই পাঁচ বছরে কিংবা বছর দেড়েকের মধ্যে তারা এক একজন দুর্নীতির বিশ্বরেকর্ড গড়ে তুলেছেন। পৃথিবীর কোনো দেশের মানুষও বোধ করি দুর্নীতির এই বিশাল মাত্রা কল্পনাও করতে পারে না। প্রধানমন্ত্রীসহ প্রত্যেক মন্ত্রী, এমপি, দলীয় কর্মী, মনোনয়ন প্রত্যাশী এই সময়ে তাদের সম্পদের পরিমাণ বাড়িয়েছেন ৪০ থেকে সাড়ে চার হাজার গুণ পর্যন্ত। নির্বাচন কমিশনে তারা তাদের সম্পত্তির হিসাব জমা দিয়েছেন। সে হিসাবও বলিহারি। কী করে একেকজন এই বিপুল সম্পত্তির মালিক হলেন সেটি কেউ প্রকাশ করেনি। এখানে আছে শেয়ার বাজারের ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে লুণ্ঠন করা ৪০ হাজার কোটি টাকা। আছে কুইক রেন্টালে জনগণের পকেট কেটে নেয়া ২৫/৩০ হাজার কোটি টাকা। আছে হলমার্ক, ডেসটিনির আরও ১৫/২০ হাজার কোটি টাকা। তার ওপর টেন্ডারবাজির আছে কোটি কোটি টাকা। শেখ মুজিবের শাসনকালে যে বিপুল দুর্নীতি হয়েছিলো তাকে প্রবীণ রাজনীতিবিদ আতাউর রহমান বলেছিলেন, ‘এরা আঙুল ফুলে কলাগাছ নয়, বটগাছ হয়ে গেছে।” এবার বোধ হয় আর কোনো উদাহরণ দেয়া চলে না। শুধু বলা চলে, এদের আঙুল ফুলে হিমালয় পর্বতমালা হয়ে গেছে। নির্বাচন কমিশনে তারা নিজেরাই এ হিসাব জমা দিয়েছিলেন। নির্বাচন কমিশন যথারীতি তাদের ওয়েবসাইটে এ তথ্য সংযোজিত করেছিলো। কিন্তু এতে প্রধানমন্ত্রীসহ তার দলের লোকেরা বড়বেশি শরমিন্দা হয়ে পড়েন। তারা নির্বাচন কমিশনে একটি প্রতিনিধিদল পাঠায়। যারা গিয়ে দাবি করে, এটি ওয়েবসাইট থেকে মুছে দেন। আর পৃথিবীর ইতিহাসে নিকৃষ্টতম প্রধান নির্বাচন কমিশনার সঙ্গে সঙ্গে তা মুছে দেবার ব্যবস্থা করেন। কিন্তু যা হবার তাতো হয়েই গেছে। সকলেরই হাতে হাতে মুখে মুখে এ হিসাব চলে গেছে।
প্রবীণ সাংবাদিক এ বি এম মূসা একসময় টিভি টকশোতে বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ নেতাদের দেখলে যেনো সবাই ‘চোর চোর’ বলে ধ্বনি দেয়। কিন্তু শুধু চোর বললে কি যথেষ্ট বলা হবে? আর কী বললে যথেষ্ট বলা হয় সেটি আমাদের জানা নেই। তবে প্রমাণিত হয়ে গেছে আওয়ামী লীগের সকল নেতা, মন্ত্রী, এমপি ‘চোর’। এর আগে বিএনপি নেতা তারেক রহমানকে লক্ষ্য করে ‘দুর্নীতিবাজ দুর্নীতিবাজ’ বলে আওয়ামী লীগের সর্বস্তরের নেতাকর্মী মুখে ফেনা তুলে ফেলেছিলেন। তার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি মামলাও দায়ের করা হয়। কিন্তু বিগত সাত বছরে কোনো একটি মামলায় প্রমাণিত হয়নি যে, তারেক রহমান ন্যূনতম কোনো দুর্নীতি করেছেন। বরং মানি ল-ারিং মামলা থেকে আদালতে তিনি বেকসুর খালাস পেয়েছেন। সেনাশাসিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি দুর্নীতির মামলা হয়েছিলো। ‘আঁতাতের’ নির্বাচনে জয়ী হয়ে তিনি তার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলো প্রত্যাহার করে নিয়েছেন, মোকাবিলা করেননি। এতে ধরে নেয়া যায় যে, ঘুষ-দুর্নীতির কীর্তি তিনি করেছিলেন। এছাড়া বিগত পাঁচ বছরে আওয়ামী দুঃশাসন, হত্যা, লুণ্ঠন, গুম, খুন, অত্যাচার-নির্যাতন এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে, জনগণ একেবারে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েন। এরকম পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের বহু মন্ত্রী, এমপি ভোটারদের ভয়ে নির্বাচনী এলাকা পর্যন্ত যেতে সাহস পায়নি। অনেকেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পুলিশ প্রটেকশনের জন্য আবেদন করেছেন। গফরগাঁওয়ের এমপি নিজে পিস্তল বের করে তার এলাকার ভোটারদের ওপর গুলী চালিয়েছে। ডাকাতের হাতেও বন্দুক থাকে। কিন্তু সে ডাকাতকেও জনগণ ঘেরাও করে পিটিয়ে মারে। জনগণের সংঘশক্তি এমনই প্রবল তা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন শেখ হাসিনা।
বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার দাবিতে বিগত আড়াই বছর ধরে আন্দোলন করে আসছেন। যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য শেখ হাসিনা ১৭৩ দিন হরতাল করেছিলেন সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় তিনি অনুদানখোর বিচারপতি খায়রুল হকের এক বিতর্কিত রায়ের মাধ্যমে বাতিল করে দেন। এটাও অবাক করার বিষয় ছিলো। ১৯৯১ সালে অনানুষ্ঠানিকভাবে এবং ১৯৯৬ সালে সংবিধান সংশোধন করে এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে যে তিনটি নির্বাচন বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হয়েছে তা সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য বলে দেশের মানুষ ও সারা বিশ্ব রায় দিয়েছিলো। সে ব্যবস্থা বাতিল করে শেখ হাসিনা কিম্ভূত নির্বাচন ব্যবস্থার আয়োজন করেছিলেন। তাতে সংসদ বহাল থাকবে, প্রধানমন্ত্রী নিজেও স্বপদে বহাল থাকবেন, তার মধ্যেই নির্বাচন হবে। তার পরেও যাতে কোনো ফাঁকফোঁকর না বের হয়, আর বের হলেও তা যেনো মেটানো যায় সে জন্য তিনি বিচার বিভাগ দলীয়করণ করেছেন। আর পদলেহী একদল নতজানু লোককে দিয়ে নির্বাচন কমিশন সাজিয়েছেন। তাদের আচার-আচরণ কখনও কখনও একেবারে দাসানুদাসের মতো।
১৮ দল যতোই বলে এই নির্বাচনে তারা যোগ দেবেন না ততোই যেনো শেখ হাসিনা খুশিতে ডগোমগো হয়ে ওঠেন। কিন্তু শুধুমাত্র ১৮ দল নয় বি. চৌধুরীর বিকল্পধারা, কাদের সিদ্দিকীর কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, আ স ম আব্দুর রবের জেএসডি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিও এ নির্বাচনে অংশ নেবে না। তাতেও খুশি শেখ হাসিনা। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যে একেবারেই বিপর্যয়কর পরাজয় বরণ করবে যুগান্তর, প্রথম আলো, ডেইলি স্টার-এশিয়া ফাউন্ডেশন প্রভৃতি সংস্থার জরিপে সেটি উঠে এসেছে। ফলে নির্বাচনে বিরোধী দল যাতে না আসে সে আয়োজনই করতে থাকে শেখ হাসিনা। এমনকি তার প্রধান শরীক জাতীয় পার্টির এরশাদও ঘোষণা দেন যে, সবাই অংশ না নিলে তার দলও নির্বাচনে অংশ নেবে না। তারপর এরশাদকে সরকার র্যাব দিয়ে তুলে নিয়ে সিএমএইচ-এ আটক করে রেখেছে। নির্বাচনে অংশ না নেয়ার ব্যাপারে তিনি অনড়, এমন কথাই এখন পর্যন্ত বলে যাচ্ছেন। যদিও জাতীয় পার্টির কিছু নেতা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। চেয়ারম্যান এরশাদ নির্বাচন কমিশনকে লিখিতভাবে জানান যে, তার দলের প্রতীক লাঙল যেনো কাউকে বরাদ্দ দেয়া না হয়। কিন্তু জাতীয় পার্টির ভোটপ্রার্থীদের নামে নির্বাচন কমিশন সে প্রতীক বরাদ্দ দিয়েছে। এরশাদ তিনটি আসনে প্রার্থী হয়েছিলেন। তিনটি আসন থেকেই তিনি প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেন। তা সত্ত্বেও নির্বাচন কমিশন একটি আসনে তাকে প্রার্থী রাখে এবং বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ঘোষণা করে। ভাবটা যেনো এমন যে, নির্বাচন করবি না, তোর ঘাড়ে করবে।
এসব কিছুই করা হচ্ছে ভয়, আতঙ্ক ও ভারতীয় তাঁবেদারির জন্য। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং বাংলাদেশে এসেছিলেন। যেখানে যুক্তরাষ্ট্র, ই ইউ, যুক্তরাজ্যসহ সারা পৃথিবী বলছে বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য এবং সকল দলের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখতে চায় তারা। সেখানে সুজাতা সিং এসে বলে গেলেন, সব দলের অংশগ্রহণ করতে হবে এমন কোনো কথা নেই। নির্বাচনে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক দল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেই নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয়। এই উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কথাটাকে ভিত্তি ধরেই এরশাদকে জোর-জবরদস্তিমূলকভাবে নির্বাচনে রাখাই সরকারের উদ্দেশ্য। এরশাদ না থাকলে একেবারে কিছুই থাকে না। এই প্রহসনের নির্বাচনে বিরোধী দল নেই বলে ১৫৪টি আসন আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়ে গেছে। ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে প্রায় ৫৩ শতাংশ ভোটার। আর যে ১৪৬টি আসনে নির্বাচন বাকি সেগুলোতে বস্তুতপক্ষে ভোট হবে এমন মনে করার কারণ নেই। সরকার আর নির্বাচন কমিশন মিলে এমন একটা পরিবেশের সৃষ্টি হবে যাতে শুধু নাম ঘোষণা করে দিলেই হয়। অর্থাৎ এই নির্বাচন ভোটারবিহীন। ভোটের অধিকার কেড়ে নেয়ার নির্বাচন। সর্বশেষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অধীনে নির্বাচনের দাবিতে ১৮ দলীয় জোট যখন হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি দিতে শুরু করলো তখন সরকার একেবারেই বেহাল দশায় পড়ে যায়। এই অবরোধ কর্মসূচিতে সারা দেশের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নেমে আসে। এবং রাজধানীকে গোটা দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। সরকার র্যাব, পুলিশ, বিজিবি ও ছাত্রলীগ দিয়ে কয়েকশ’ মানুষ হত্যা করে। তাতেও সে আন্দোলন, সে অবরোধ বিন্দুমাত্রও শিথিল হয়নি। বরং তা আরও প্রবল রূপ ধারণ করে।
প্রায় মাসখানেক ধরে অবরোধ কর্মসূচি পালিত হওয়ার পর ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ নামক যে কর্মসূচি ঘোষণা করে তাতে যোগদানের জন্য ২৯ ডিসেম্বর সকল নেতা কর্মীকে ঢাকায় আসার আহ্বান জানান বেগম খালেদা জিয়া। এতে একেবারেই বেসামাল হয়ে পড়ে সরকার। তখন অবরোধের ডাক দেয় সরকার নিজেই। তারা ঢাকামুখী বাস, ট্রেন, লঞ্চসহ সকল প্রকার যান চলাচল বন্ধ করে দেয়। ঢাকার ভেতরেও যান চলাচল ছিলো অতি সামান্য। সরকার পথে পথে চেকপোস্ট বসিয়ে র্যাব, পুলিশ, বিজিবি আর তাদের সঙ্গে ছাত্রলীগ, যুবলীগ, যুব মহিলা লীগ, আওয়ামী লীগ, প্রজন্মলীগ দিয়ে মানুষকে বেপরোয়াভাবে নাজেহাল করতে শুরু করে। এম্বুলেন্সে মারা যায় রোগী। শুরু হয় ব্যাপক ধরপাকড় আর গ্রেফতার বাণিজ্য। এমনকি কর্মজীবী মানুষকে ঢাকায় আসতে বাধা দেয়া হয়। ১৮ দলের ডাকা অবরোধের সময় তবু রাজধানীতে কিছু যানবাহন চলতো কিন্তু সরকারের অবরোধে রাস্তাঘাট জনমানবশূন্য হয়ে পড়ে। সরকার সৃষ্টি করে একটি ত্রাসের রাজত্ব। আর বেগম খালেদা জিয়ার ঐ ঘোষণার পর থেকেই তাকে তার নিজ বাসভবনে গৃহবন্দী করে রাখা হয়। এই লেখা হওয়া পর্যন্ত তিনি গৃহবন্দী আছেন। যতদূর ধারণা করা যায়, ৫ জানুয়ারি নির্বাচন পর্যন্ত তিনি গৃহবন্দী থাকবেন।
সাদা চোখে একে আতঙ্ক ছাড়া আর কি বলা যায়? সরকারের জনগণকে ভয়। নির্বাচনকে ভয়। খালেদা জিয়াকে ভয়। এতো ভীতির মধ্যে এই সরকার কীভাবে আশা করে যে, তবু তারা নির্বাচনের নামে প্রহসন করে অনন্তকাল ক্ষমতায় থাকবে। সে আশা যে ইতোমধ্যেই দুরাশাই পরিণত হয়েছে সেটি সাধারণ মানুষের বুঝতে আর বাকি নেই। এরকম একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি করে শেষ পর্যন্ত যে ক্ষমতায় টিকে থাকা যাবে না এটি বোঝার ক্ষমতা সরকার হারিয়ে ফেলেছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে গ্রেফতার থাকলেও জিতেছেন বেগম খালেদা জিয়া ও এদেশের জনগণ। আর হেরেছেন শেখ হাসিনা ও তার পেটোয়া বাহিনী। বিরোধীদলীয় নেতাকে বন্দী রেখে জনগণের ওপর এই নির্যাতনের প্রতিবাদ মানুষ করবেই। সে প্রতিবাদের কিছু নমুনা অবরোধকালে আওয়ামী লীগ দেখেছে। সামনে তাদের আরও দেখার খানিকটা বাকি অছে।
ড. আব্দুল হাই তালুকদার
ব্রিটিশ পত্রিকা দ্য
ইকোনমিস্ট লিখেছে, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে
আওয়ামী লীগ বিজয়ী হলেও বাংলাদেশ হারবে। মন্তব্যটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও
তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলাদেশের গণতন্ত্রের বয়স দুই দশকের বেশি। এর মধ্যে রাজনীতিকদের
চাতুর্য ও কৌশলের কাছে বারবার গণতন্ত্র বিপদগ্রস্ত হচ্ছে। রাজনীতিবিদেরা
গণতন্ত্রকে বিকশিত করতে কার্যকর ও ফলপ্রসূ কোনো উদ্যোগ না নেয়ায় গণতান্ত্রিক
প্রতিষ্ঠানগুলো সবল ও বিকাশলাভ করতে পারেনি। যেসব প্রতিষ্ঠান গণতন্ত্র বিকাশে
কার্যকর ও ফলপ্রসূ অবদান রাখার কথা সেগুলো নামসর্বস্ব^, প্যাডসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।
রাজনৈতিক দলগুলো প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বাধীন ও সার্বভৌম প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে উঠতে
না দিয়ে ঠুঁটো জগন্নাথে পরিণত করেছে। সে কারণে নির্বাচন কমিশনকে নিজ অধিকার ও মতা
বিলিয়ে দিতে দেখে দেশের মানুষ একযোগে প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠেন। অবশ্য সঠিক জায়গায়
সঠিক ব্যক্তি জায়গা না পাওয়াও একটি কারণ। যতটুকু স্বাধীনতা ও মতা আছে মেরুদণ্ডহীন
দুর্বল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন আমলাদের নিয়োগে তা-ও অনুশীলন করতে পারেন না। সবল
ব্যক্তিত্বের অধিকারী ব্যক্তিরা অর্পিত স্বাধীনতা ও মতার সর্বোচ্চ ব্যবহার করেন
এবং প্রাপ্য ন্যায্য অধিকার ও মতা আদায় করে নিতে সচেষ্ট থাকেন। অযোগ্য লোকজনকে
দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে নির্বাচন করে দায়িত্ব দেয়ায় তারা কর্তার ইচ্ছায় কর্ম করতে
সদা সচেষ্ট থাকেন। গত পাঁচ বছরে দলীয়করণের সব রেকর্ড ভঙ্গ করে নিয়োগ দেয়ায় জনগণ
তাদের কাছ থেকে প্রত্যাশিত আচরণ ও সেবাবঞ্চিত হচ্ছে। সে কারণে প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন
নির্লজ্জ সিলেকশনে সরকার গঠনের মতো ১৫৪ জন এমপি নির্বাচিত হলেও নির্বাচন
কমিশনারেরা কোনো রকম বিব্রত না হয়ে স্বপদে অধিষ্ঠিত থাকেন।
নির্বাচন
কমিশন আরিক অর্থে স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হলেও কাজকর্মে স্বাধীন প্রতিষ্ঠানের
সামান্যতম নিদর্শন দেখা যাচ্ছে না। নির্বাচন কমিশনারেরা যেন পুতুল। সরকারের ইচ্ছা-অনিচ্ছায়
পুতুলের মতো নাচছে। এবারের মতো বাংলাদেশের ইতিহাসে সরকারের আজ্ঞাবহ ও দাশানুদাশ
মনোবৃত্তির অধিকারী কোনো কমিশন দেখা যায়নি। কমিশনের যতটুকু অধিকার আছে তা-ও বিলিয়ে
দিয়ে কত অধিক পরিমাণ সরকারে আজ্ঞাবহ হওয়া যায় তার প্রতিযোগিতা চলছে। তফসিল ঘোষণার
আগে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বললেন, কয়েক
দিন দেরি করা হবে। সংলাপ হচ্ছে, দেখা যাক দুই দলের
মধ্যে কোনো সমঝোতা হয় কি না। তারানকোর দূতিয়ালি চলছিল। মানুষ অনেকটা আশান্বিত হয়ে
অধীর আগ্রহে সমঝোতার জন্য উদগ্রীব হয়েছিল। প্রধান নির্বাচন কমিশনার অপোর কথা বলে
হঠাৎ করে কার ইশারায় পর দিন তফসিল ঘোষণা করলেন। সমঝোতা ছাড়া তফসিল ঘোষণা করায়
মানুষ হতাশ ও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। শুধু উদ্বিগ্ন নন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, সরকারি নেতারা ও নির্বাচন কমিশন। তারা
দেশের ভয়াবহ ও সঙ্কটজনক পরিস্থিতি বিবেচনায় না নিয়ে শক্তি প্রয়োগ করে নির্বাচন
অনুষ্ঠানে অগ্রসরমান। শক্তি প্রয়োগ করে মানুষের আকাক্সা ও প্রয়োজনকে দমন করা যায়
না এ কথাটি কর্তাব্যক্তিরা
অস্বীকার করছেন।
তফসিল
ঘোষণার পর বিএনপি তথা আঠারোদলীয় জোট ও দেশের অন্যান্য রাজনৈতিক দল পূর্ব ঘোষণা
অনুযায়ী মনোনয়নপত্র জমা দেয়নি। দু-চারটি নামসর্বস্ব ও প্যাডসর্বস্ব দলকে নিয়ে
আওয়ামী লীগ মনোনয়নপত্র জমা দেয়। জাতীয় পার্টি মনোনয়পত্র জমা দিয়ে পরিস্থিতি
বিবেচনায় নিয়ে যথাসময়ে প্রেসিডেন্ট এরশাদ নিজে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করার আবেদন
করেন ও দলীয় নেতাকর্মীদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের নির্দেশ দেন। তার নির্দেশ মেনে
অনেকে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেন। মেরুদণ্ডহীন নির্বাচন কমিশন এরশাদের আবেদন
গ্রহণ করেননি। তিনি দলীয় চেয়ারম্যান হিসেবে লাঙ্গল প্রতীক কাউকে বরাদ্দ না দেয়ার
অনুরোধ করে কমিশনকে পত্র দেন। তার আবেদন অগ্রাহ্য করে লাঙ্গল প্রতীক বরাদ্দ দেয়া হয়।
প্রত্যাহারের তারিখ অতিক্রান্ত হওয়ার পরেও সমঝোতা করে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের
সুযোগ দেয়া হলেও জাতীয় পার্টির আবেদন নিবেদন সত্ত্বেও প্রার্থিতা প্রত্যাহারের
আবেদন মঞ্জুর করা হয়নি। নির্বাচন কমিশন চোখ বন্ধ করে সরকারের হুকুম তামিলে ব্যস্ত।
১৫৪ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হলেও কমিশনকে পুলকিত মনে হয়। যে ১৪৬ আসনে
প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে তার বেশির ভাগ আওয়ামী লীগের বিদ্্েরাহী প্রার্থী; অর্থাৎ আওয়ামী লীগ বনাম আওয়ামী লীগের
নির্বাচন অনুষ্ঠান হতে যাচ্ছে ৫ জানুয়ারি। বেগম জিয়া একে নির্বাচন কমিশনের দ্বারা
আওয়ামী লীগের জন্য আওয়ামী লীগের নির্বাচন বলে অভিহিত করেছেন। এরশাদকে জোর করে
নির্বাচনের আনার জন্য অনেক নাটক দেশবাসী প্রত্য করছেন। নির্লজ্জ নাটকের মহড়া দেখে
দেশবাসীর সাথে বিশ্ববাসীও হাসাহাসি করছেন।
ফাঁকা
মাঠে গোল দেয়া খেলার নিয়মে পড়ে না। প্রতিদ্বন্দ্বী অনুপস্থিত হলে খেলা বন্ধ করা হয়
অথবা ওয়াক ওভার দেয়া হয়। আওয়ামী লীগ ফাঁকা মাঠ পেয়ে গোল দিয়ে আনন্দ করছে ও সেসব
বক্তৃতা বিবৃতি দিয়ে গর্বভরে প্রকাশ করছে। এভাবে গণতন্ত্র বিধ্বংসী কর্মকাণ্ডের
বিষময় ফল আঁচ অনুমান করতে না পেরে সরকার বাহাদুরি করছে। ইইউ, কমনওয়েলথ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অর্ধেকের
বেশি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়া দেখে নির্বাচনে পর্যবেক পাঠাবে না বলে
জানিয়ে দিয়েছে। সবজান্তা প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলছেন, পর্যবেক না পাঠালেও নির্বাচন গ্রহণযোগ্য
হবে। দেশীয় পর্যবেকেরাও পর্যবেণে অনীহা প্রকাশ করছে। সরকার এসবকে মোটেই গুরুত্ব না
দিয়ে নানারকম কূটযুক্তি উপস্থাপন করছে। বিরোধী দলহীন নির্বাচনকে সবাই একবাক্যে
তামাশার নির্বাচন বলছেন ও অনেক একে কোনো নির্বাচনই বলতে চাচ্ছেন না। সরকারের
লোকেরা একে নিয়ম রার নির্বাচন বলছেন ও বৈধতা দাবি করছেন। অংশগ্রহণমূলক
প্রতিযোগিতাপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠান হলো গণতন্ত্রের চালিকাশক্তি। একদলীয়
নির্বাচনকে কোনো দেশে কোনোকালে নির্বাচন হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয় না। বিনা
প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ১৫৪ জন নির্বাচিত হওয়ায় গণতন্ত্রের মৃত্যু ঘটেছে। এরূপ নির্বাচন
দেশ-বিদেশে কোথাও গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। সরকারের কর্মকাণ্ড পরিচালনার নৈতিক অধিকার
থাকবে না। পাঁচ কোটি ভোটারকে অধিকারবঞ্চিত করে সরকার আনন্দ-উল্লাসে থাকলেও ওই
ভোটারেরা কিন্তু খুবই দুঃখ প্রকাশ করবে।
সরকার
সংলাপ বিষয়ে কোনো সময় আন্তরিকতার পরিচয় দেয়নি। গত ২৪ নভেম্বরের সংবাদ সম্মেলনে
বেগম জিয়া সঠিক বলেছেন, বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায়
নির্বাচিতরা অবৈধ। সংলাপের নামে সরকার জনগণের সাথে প্রতারণা করেছে। সংলাপ, সংলাপ খেলার পর সরকার আজ্ঞাবহ নির্বাচন
কমিশনকে দিয়ে একটি নির্বাচনী নাটক মঞ্চস্থ করতে চলেছে। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ আবার সরকার গঠন করবে
ও বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ওপর অত্যাচার নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে মতায় টিকে
থাকার চেষ্টা করবে। সরকারের এসব তামাশাপূর্ণ কর্মকাণ্ড দেখে বিদেশীরা ইতোমধ্যে মুখ
ফিরিয়ে নিয়েছে। অবৈধ সরকারের সাথে তারা কতটা সম্পর্ক রাখে সেটি এখন দেখার বিষয়। এক
স্বনামধন্য ব্যারিস্টার বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ মতায় এলে এ
রকম হয়। তার কথাটি সম্পূর্ণ সত্য। সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনে আজীবন মতায় থাকার নেশায়
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তত্ত্বাবধায়কপদ্ধতি তুলে দিয়ে সঙ্কট ডেকে এনেছেন। ব্যবস্থাটি
পুনঃপ্রবর্তনের দাবিতে বিরোধী দল সংগ্রাম করে চলেছে। আন্দোলন সংগ্রামে মানুষের
জীবন ও সম্পদের অপূরণীয় তি হচ্ছে। সরকার মোটেই বিচলিত নয়। তোরা যে যা বলিস ভাই, আমার সোনার হরিণ চাই। অনেকে বলেছেন বেগম
জিয়া যেহেতু তিনবারের প্রধানমন্ত্রী, মাননীয়
প্রধানমন্ত্রীও তিনবারের প্রধানমন্ত্রী হতে চান। কেউ বলছেন, অবৈধ পথে শত শত কোটি টাকার সম্পদকে বৈধ
করতে আর একবার মতায় যাওয়া চাই। আহত, নিহত, আহাজারি শুনার অবকাশ কোথায়? ইচ্ছাকৃতভাবে যুদ্ধাপরাধীদের রায়কে
নির্বাচনের সময় দিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনকে উত্তপ্ত করে তুলেছে। জঙ্গি দমনের নামে পাখির
মতো গুলি করে নিরীহ মানুষ খুন করা হচ্ছে। গুলি থেকে নারী, পুরুষ বাদ যাচ্ছে না, এমনকি শিশু ও স্কুলের ছাত্র পর্যন্ত রা পাচ্ছে
না। আগুনে দগ্ধ হয়ে কত মানুষ হাসপাতালে কাতরাচ্ছে। সরকার ঘাতক শনাক্ত করতে ব্যর্থ।
নিরপে তদন্তে অপরাধী শনাক্ত করার বদলে বিরোধী দলের ওপর দোষ চাপিয়ে সরকার দায়িত্ব
এড়াতে চাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতিতে মানুষের জীবন-জীবিকা ঝুঁকিপূর্ণ। মানুষের
জীবনের স্বস্তি দিতে সরকার শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ।
অনেকে
বলছেন, বেগম জিয়া নির্বাচনে অংশ
নিলে জনগণ তাকে মতায় বসাতেন। কথাটি যুক্তিযুক্ত মনে হয় না। তিনি আন্তরিকতার সাথে
সমঝোতায় আগ্রহ প্রকাশ করে ব্যর্থ হয়েছেন। এক ইঞ্চিও ছাড় দিতে রাজি না হওয়ায়
সরকারের দুরভিসন্ধি ধরা পড়েছে। নির্বাচনে কারচুপির রেকর্ড আওয়ামী লীগের ভালো না। ’৭৩ সালে বেশির ভাগ আসনে বিজয়ী হয়েও অন্তত পাঁচটি আসন জোর
করে ছিনিয়ে নেয়া হয়। সখীপুর উপনির্বাচনের কারচুপি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর কথায়
মাগুরা উপনির্বাচনের ১০ গুণ হয়েছিল। আরো অনেক উদাহরণ দেয়া যায়। প্রয়োজনে তারা ছলে
বলে কৌশলে বিজয় ছিনিয়ে নিতে পারে। পাঁচ বছরে সম্পদের পাহাড় গড়াকে অর্থমন্ত্রী
বলছেন মতায় থাকলে সম্পদ বাড়বেই। নির্বাচনে কারচুপির পর তারা বলতে পারতেন মতায়
থাকলে একটু-আধটু কারচুপি হতেই পারে। তবে এটি উপো করা উচিত। দলীয়কৃত পুলিশ ও সাজানো
প্রশাসনে পরিচালিত নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে বেগম জিয়া অত্যন্ত বিজ্ঞতা ও
দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। জনগণের ভোটাধিকার আদায়ের সংগ্রাম বৃথা যাবে না। বিজয়
হবেই।
এক
জায়গায় সরকার অবশ্য খুবই দতার পরিচয় দিয়েছে। বিরোধী দল দমনে সরকার যথেষ্ট
পারদর্শিতা প্রদর্শন করেছে। ৬০-৭০ হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করে জেলখানা ভরাট
করা হয়েছে। জামায়াতের দোষ দেয়া হলেও গাড়ি পোড়ানো, আগুন দেয়া প্রভৃতি বানোয়াট মামলায় বিএনপির শীর্ষস্থানীয়
নেতাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। নেতাকর্মীদের রিমান্ডে নিয়ে অত্যাচার-নির্যাতনের সব
রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। বেশুমার মামলা ও আসামির তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর করা হচ্ছে।
দমনপীড়ন চালিয়ে সরকার মতায় ফেরা ও টিকে থাকার ফন্দিফিকির অব্যাহত রেখেছে। এভাবেই ১৯৭৫
সালে সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে ও চারটি পত্রিকা বাদে সব পত্রিকা বন্ধ করে দিয়ে
বাকশাল কায়েম করে আজীবন মতায় টিকে থাকার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। সেই সময় বিরোধী দল
ছিল না। আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে জাসদ গঠন করা হয়েছিল। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে জাসদের
শাজাহান সিরাজ, মেজর জলিল, রাশেদ খান মেনন ও ন্যাপের আলীম আলরাজীসহ
অন্তত নির্বাচিত পাঁচজনকে জোর করে পরাজিত করানো হয়। রীবাহিনী দিয়ে জাসদের হাজার
হাজার কর্মীকে খুন করা হয়। তবে জনগণের প্রতিরোধের কাছে মতা চিরস্থায়ী করা যায়নি। ১৯৭৫-এর
দুঃখজনক ঘটনার পর আওয়ামী লীগ প্রায় নিস্তেজ নিঃশেষ হতে চলেছিল। ২২ বছর মতার বাইরে
থেকে জামায়াতের সহযোগিতায় তত্ত্বাবধায়কপদ্ধতি প্রবর্তন করে নিয়ে ১৯৯৬ সালের
নির্বাচনে মতা পায়। এবার মতায় এসে আওয়ামী লীগ বীরবিক্রমে বিরোধী দল নিধনে
সর্বশক্তি নিয়োগ করে। তত্ত্বাবধায়কপদ্ধতি তুলে নিজ অধীনে নিজে নির্বাচত হয়ে
প্রধানমন্ত্রী আবার মতায় ফিরে আসতে চান। এ কাজে হয়তো তিনি সফল হবেন। তবে একটা কথা
মনে রাখতে হবে মতা কারো চিরস্থায়ী নয়। একবার মতা চলে গেলে মতায় ফিরে আসতে আওয়ামী
লীগের জন্য কঠিন হবে। জনগণ লেন্দুপ দর্জির মতো সেবাদাস সরকার চায় না। তাই বলছি, আওয়ামী লীগ স্বল্পমেয়াদে জিতবে, তিগ্রস্ত হবে দীর্ঘ মেয়াদে। আওয়ামী লীগ
একটি গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল। দীর্ঘ ৬৩ বছর ধরে যে দল গণতন্ত্রের জন্য
লড়াই সংগ্রাম করে আসার দাবি করে আসছে এবার তারা ফাঁকা মাঠে গোল দিতে গিয়ে এবারো
বাকশাল গঠনের মতো কলঙ্কের তিলক নিতে চলেছে। আওয়ামী লীগের যে কলঙ্কতিলক পরবে তা
মুছতে বহু সময় লাগবে। আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক ও নৈতিক উভয় দিক দিয়ে হারবে। ১৫৪ জনের
বিজয় আওয়ামী লীগের নিঃসঙ্গ নির্দেশক। তাই এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, আওয়ামী লীগের বিজয়ে দেশ হারবে না, জিতেও হারবে আওয়ামী লীগ।
সোমবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৩
গত রোববার ও সোমবার মার্চ ফর ডেমোক্রেসিকে কেন্দ্র করে পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দল এবং সরকার রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, প্রতিহিংসা, একনায়কতন্ত্র, গু-ামী ও মিথ্যাচার এবং হীনমন্যতার যে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন সভ্য সমাজের ইতিহাসে এর দৃষ্টান্ত বিরল। বিরোধী দলের ঘোষিত কর্মসূচী অনুযায়ী ঢাকামুখী অভিযাত্রার গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে মানুষকে বঞ্চিত করার জন্য তারা নৌ ও সড়ক পথের সকল প্রকার যানবাহন বন্ধ করে দিয়ে সারাদেশের মানুষের জন্য এক ভয়াবহ সঙ্কট সৃষ্টি করেছেন। ঢাকার আবাসিক হোটেলসমূহ, রেস্টহাউজ ও বাসাবাড়িতে গ্রেফতার ও তল্লাশির নামে পুলিশ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং আওয়ামী সন্ত্রাসীরা যে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছেন তা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। পুলিশ পাহারায় মারমুখী সরকারি দল জাতীয় প্রেসক্লাবে সাংবাদিকদের শান্তিপূর্ণ সমাবেশে দফায় দফায় হামলা করেছে। সুপ্রীম কোর্টের মূল ফটক ভেঙ্গে ভিতরে ঢুকে আইনজীবীদের ওপর নজিরবিহীন হামলা চালিয়েছে। হামলাকালে তাদের হাতে লাঠি, উইকেট স্ট্যাম্প, লগি-বৈঠা ও আগ্নেয়াস্ত্র ছিল। তাদের হামলায় এবং বেধড়ক মারধরে প্রায় বিশজন আইনজীবী মারাত্মকভাবে আহত হয়েছেন। এর মধ্যে রেহানা পারভীন ও সিনথিয়া নামক দুইজন মহিলা আইনজীবীও রয়েছেন। এডভোকেট সিনথিয়া আওয়ামী লীগ কর্মীদের লাঠির আঘাতে রাস্তায় লুটিয়ে পড়েন এবং সাহায্যের জন্য আর্তনাদ করতে থাকেন। তাকে বিবস্ত্র করারও অভিযোগ পাওয়া গেছে। পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত ও টিভি চ্যানেলসমূহে সম্প্রচারিত ছবিতে তার স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে এই যে, এই মহিলা আইনজীবীর চিৎকারে র্যাব, পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোন সদস্য এগিয়ে আসেননি। গত মে মাসে হেফাজতের কর্মসূচি চলাকালে দিগন্ত ভবনের নীচে একজন মহিলা সাংবাদিককে কে বা কারা ধাওয়া করেছিল। দিগন্ত টিভির সাংবাদিক, শিবির ও হেফাজত কর্মীরা তাকে উদ্ধার করেছিলেন। এনিয়ে হেফাজত ও ধর্মভিত্তিক দলগুলোর বিরুদ্ধে আমাদের নারী সংগঠন এবং মানবাধিকার কর্মীরা বিক্ষোভ ও আন্দোলনের ঝড় তুলেছিল। আমি বিস্মিত হই ক্ষমতাসীন দলের কর্মীরা এই মহিলা আইনজীবীদের যখন লাঠিপেটা করে রাস্তায় ফেলে দিলেন এবং তাদের বিবস্ত্র করলেন তখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিস্ক্রিয় থাকার কারণ কি ছিল? আমাদের নারী আন্দোলনের নেতা-নেত্রী এবং মানবাধিকার কর্মীরা এর বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটিও করলেন না কেন? গতকাল সোমবার প্রকাশিত দেশের দৈনিক পত্রিকাগুলোর কোথাও এর বিরুদ্ধে একটি বিবৃতি পর্যন্ত প্রকাশিত হতে দেখা যায়নি। এর কারণ জানার আবেদন রেখে আজকের লেখাটি আমি শুরু করছি।
সরকারের পেটোয়া বাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের উপরেও হামলা করেছে এবং এই হামলায় সাতজন শিক্ষক এবং দুইজন শিক্ষিকা আহত ও লাঞ্ছিত হয়েছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম জিয়াকে তার বাসা থেকে বের হতে দেননি। তারা নানারকম প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে তার পল্টন যাওয়া থামিয়ে দিয়েছেন এবং এ জন্যে তার বাড়ির সামনে ১৩ প্লাটুন পুলিশসহ র্যাব ও বিজিবির শত শত সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। তাদের যত প্রতিবন্ধকতা, গ্রেফতার, নির্যাতন, অবরোধ, জলে, স্থলে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয়ার একটি কারণ তারা প্রদর্শন করেছেন এবং তা হচ্ছে তারা বিরোধী দলের ঢাকামুখী অভিযাত্রার পেছনে নাশকতা সৃষ্টির তথ্য পেয়েছিলেন এবং এই গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতেই তারা জনগণের নিরাপত্তার জন্য যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। অভিজ্ঞজনদের প্রশ্ন, বাংলাদেশের গোয়েন্দারা শুধু বিরোধী দল দমনের জন্যই কি সরকারকে তথ্য প্রদানে পারঙ্গম? ২০০৯ সালে বিডিআর হত্যাযজ্ঞে যখন ৫৭ জন চৌকস সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করে তাদের লাশ অবমাননা করা হলো, ড্রেনে ফেলে দেয়া হলো এবং তাদের পরিবার-পরিজনের উপর অমানুষিক নির্যাতন করা হলো তখন এই গোয়েন্দারা কোথায় ছিলেন? সামরিক, বেসামরিক গোয়েন্দারা কেন সরকারকে কোন তথ্য দিতে পারেননি কিংবা তথ্য দিলেও সরকার কেন কোন ব্যবস্থা নেয়নি? আমাদের সীমান্তরক্ষী বাহিনী ও সেনাবাহিনীকে ধ্বংস করার জন্যই কি সরকার গোয়েন্দা তথ্য আমলে নেননি? আর যদি গোয়েন্দারা কোন তথ্য না দিয়েই থাকেন তাহলে তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি কেন? এই প্রশ্নের জবাব এখনও পাওয়া যায়নি। সরকারের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এখন নিরাপত্তার দোহাই দিচ্ছেন এবং নিরাপত্তার খাতিরে ঢাকায় সমাবেশ করতে দিচ্ছেন না। অথচ দেখা যাচ্ছে পুলিশ ও সরকারদলীয় ক্যাডাররা লাঠি ও অস্ত্র নিয়ে প্রেসক্লাব, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সুপ্রিম কোর্ট এলাকায় হামলা করছেন। এতে নিরাপত্তার কোন সমস্যা হচ্ছে না। তাদের হামলা ও তা-ব, গাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও দেশের সর্বোচ্চ আদালতের অবমাননা এবং জনদুর্ভোগ সৃষ্টি এগুলো কি নাশকতার আওতায় পড়ে না? এতে কি জননিরাপত্তা বিঘিœত হচ্ছে না?
আমাদের দেশের ভোটাররা অত্যন্ত সাধারণ মানুষ। তাদের প্রত্যাশা সামান্য। তাদের বাড়িগাড়ি, প্লট-ফ্ল্যাট, লাইসেন্স, ঘুষ-রিসওয়াতের সুযোগ-সুবিধার প্রয়োজন নেই। প্রতি ৫ বছর অন্তর অন্তর তারা তাদের পছন্দের সরকার গঠনের আকাঙ্খা পূরণের জন্য একটি ভোট দিতে চান। ভোট দেয়া তাদের অধিকার। মত প্রকাশের স্বাধীনতা, দল করার, প্রতিবাদ করার, সভা-সমাবেশ করার অধিকার হচ্ছে তাদের সংবিধান প্রদত্ত অলঙ্ঘনীয় অধিকার। এই অধিকার থেকে সরকার তাদের বঞ্চিত করছেন এবং প্রহসনের নির্বাচন করে তাদের উপর দুর্নীতিপরায়ণ ও ক্ষমতালিপ্সু স্বৈরতান্ত্রিক একটি সরকার চাপিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছেন। তাদের উপর ফ্যাসিবাদ চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। তারা যখন প্রতিবাদ করছেন, তখন তাদের প্রতিবাদের ভাষা এবং বাহন দুটিই কেড়ে নেয়া হচ্ছে। সরকার তাদের বিক্ষোভ প্রতিবাদকে দেশে-বিদেশে সন্ত্রাসী কর্মকা- হিসেবে অভিহিত করে অপপ্রচার চালাচ্ছে। নির্বাচনের যে প্রহসন তারা বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছেন তা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে খ্যাতনামা বৃটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট বলেছে যে, এতে আওয়ামী লীগ জিতবে কিন্তু বাংলাদেশ হারবে। বাংলাদেশ হারার অর্থ ১৬ কোটি মানুষের পরাজয়। একটি স্বাধীন দেশের ষোল কোটি মানুষকে ক্ষমতালিপ্সু একটি দলের গোলাম বানানো যায় না এবং এই জন্যেই বিরোধী দল-মানুষের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পুনঃস্থাপন এবং স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের ভিত্তি মজবুত করার জন্যে আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন। এখানে নাশকতার কোন প্রশ্ন ছিল না। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে, সরকার বিরোধী দলের কল্পিত নাশকতা ঠেকানোর নামে নিজেরাই নাশকতা সৃষ্টি করে জনজীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছেন। এর বিরুদ্ধে দেশবাসীর রুখে দাঁড়ানো প্রয়োজন। প্রধানমন্ত্রী মানুষকে ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেয়ার কথা বলেন। কিন্তু তার এই একদলীয় নির্বাচনে দেশের ১৫৪টি আসনের ১০০ শতাংশ ভোটারের ভোটাধিকার তিনি হরণ করেছেন এবং বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এসব আসনে তার দলীয় ¯েœহভাজনরা নির্বাচিত হয়ে গেছেন। এখন ১৪৬টি আসন বাকি। এই আসনগুলো পূর্ব নির্ধারিত আঁতাতের ভিত্তিতে ভাগ-বাটোয়ারার পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয়েছে। নির্বাচন এখন প্রহসন মাত্র। দেশের আশি থেকে নব্বই শতাংশ লোক এখন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে চলে গেছে। দশ ভাগ ডাইহার্ড নেতাকর্মী ছাড়া কেউ আওয়ামী লীগকে আর পছন্দ করেন না। আবার এই দশভাগের মধ্যে রয়েছেন অবৈধ পন্থায় গত পাঁচ বছরে কোটি কোটি টাকার বিত্তবৈভবের মালিক হওয়া মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী, উপদেষ্টা, এমপি এবং দল ও তার অঙ্গ সংগঠনের নেতা-কর্মী।
ভারত ছাড়া আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এখন বাংলাদেশের আর কোন বন্ধু নেই। সমস্ত পৃথিবীর মতামতকে উপেক্ষা করে তারা এককভাবে হাসিনার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। তাদের উৎসাহ-উদ্দীপনায় হাসিনা জামায়াত-বিএনপিসহ দেশের সকল বিরোধী রাজনৈতিক দল ও সংগঠনগুলোকে নির্মূল করার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছেন। কিন্তু কেন? ভারতের এতে স্বার্থ কি?
এ প্রসঙ্গে ১৯৭২ সালের মার্চ মাসে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে লেখা সিরাজ শিকদারের একটি খোলা চিঠির কিছু অংশ এখানে উদ্ধৃত করছি। চিঠিতে তিনি ইন্দিরা গান্ধীকে বলেছেন,
“১. আপনার সেনাবাহিনী মিত্র বাহিনী। পাক বাহিনীর কয়েক শত কোটি টাকার যুদ্ধাস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম ভারতে নিয়ে গেল। (বর্তমান বাজার দর অনুযায়ী লক্ষ কোটি হবে)। কলকারখানা, তার যন্ত্রাংশ, গাড়ি, উৎপাদিত পণ্য, পাট, চা, চামড়া, স্বর্ণ-রৌপ্য, ভারতে পাচার করল। আপনি কিছুই বললেন না।
২. আপনি নিজেকে মুক্তি সংগ্রামী বলে জাহির করেন। নাগামিজো, কাশ্মীরী ও শিখদের মুক্তি সংগ্রামকে কেন আপনি ফ্যাসিবাদী উপায়ে দমন করছেন। ইহা কি প্রমাণ করে না যে বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে আপনি পূর্ব বাংলার মুক্তি সংগ্রামে সহায়তার বেশ ধরেছেন? আপনার উদ্দেশ্য উপনিবেশ স্থাপন, হারানো পশ্চাৎভূমি পুনরুদ্ধার, পূর্ব বাংলাকে শোষণ লুণ্ঠন করে আপনার আর্থিক ও রাজনৈতিক সংকট নিরসন এবং চীনকে প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে ঘাঁটি স্থাপন।
৩. পূর্ব বাংলায় আপনি ঔপনিবেশ কায়েম করেছেন, যারা আপনার ঔপনিবেশবাদে রাজী নন তাদের আপনি হত্যা করছেন। তাদের সন্ত্রাসী নকশাল নামে অভিহিত করছেন।
৪. আপনার তাঁবেদারদের শোষণ লুণ্ঠনের ফলে পূর্ব বাংলা এখন অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া হয়ে পড়ছে......।”
পাঠকরা সিরাজ শিকদারের এই চিঠিটির বিষয়বস্তুর সাথে পূর্ব বাংলা তথা বাংলাদেশের বর্তমান চিত্রটি একবার মিলিয়ে দেখতে পারেন। ভারতীয় তাঁবেদারদের অত্যাচার, নিপীড়ন, দুঃশাসন, লুটপাট ও দুর্নীতিতে বাংলাদেশ আজ পর্যুদস্ত হয়ে পড়েছে। যে গণতান্ত্রিক ও মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য এদেশের মানুষ পিন্ডির আধিপত্য থেকে দেশকে মুক্ত করে স্বাধীন বাংলাদেশের সৃষ্টি করেছিল, দিল্লীর আধিপত্যের জাঁতাকলে তারা এখন পিষ্ট ও নিপীড়িত। গণতন্ত্র এখন স্বৈরতন্ত্র ও ফ্যাসিবাদের বগলদাবা হয়ে প্রাণ রক্ষার জন্য আর্তনাদ করছে।
আমি এর আগেও একাধিকার বলেছি যে, আমাদের দেশে আওয়ামী লীগ নামক দলটির ঐতিহ্য ফ্যাসিবাদ। গণতন্ত্রের সাথে এই দলের কোন সম্পর্ক নেই। সন্ত্রাস এবং ফ্যাসিবাদকে লালন করেই তাদের উৎপত্তি এবং বিকাশ।
পাঠকদের অনেকেই জানেন ভারতে একটি সম্প্রদায় আছে যাদের পরিবারে স্ত্রীরা পালঙ্কে শোয়, স্বামীরা শোয় নীচে। এই অদ্ভূত প্রথার পিছনে একটি ঐতিহাসিক কারণ রয়েছে। এই সম্প্রদায়টি নাকি রাজপুতদের বংশধর। বাদশাহ আওরঙ্গজেবের সাথে প্রায় তিন দশক যুদ্ধ করে এদের পুরুষদের প্রায় সবাই প্রাণ হারিয়েছিল। মেয়েদের জন্য বর পাওয়া যাচ্ছিল না। কিন্তু যৌবন আর বয়স তো বসে থাকে না। শেষ পর্যন্ত রাজপুত মেয়েরা বাড়ির চাকর-বাকরদের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। কিন্তু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও প্রভু-ভৃত্যের পুরনো সম্পর্ক অনুযায়ী বৌদের সামনে নব্য স্বামীরা চেয়ার-টেবিলে বসত না, একই খাটে শোয়াও তারা দারুণ বেয়াদবি মনে করত। এরই ধারাবাহিকতায় তারা বৌ’দের সাথে খাটে না শুয়ে নীচে শুয়ে ঘুমাতো। এই প্রথাটি এখনো প্রচলিত আছে। গণতন্ত্রের সাথে আওয়ামী লীগের সম্পর্ক প্রায় একই ধরনের। তারা অবশ্য আরো এক ধাপ এগিয়ে গেছেন এবং গণতন্ত্রের সাথে এর ফলে তাদের সহঅবস্থান কঠিন হয়ে পড়েছে। এই অবস্থায় যারা আওয়ামী লীগের কাছ থেকে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রত্যাশা করেন তারা বোকার স্বর্গে বসবাস করেন বলে আমার বিশ্বাস। কেন না আওয়ামী লীগের ইতিহাস গণন্ত্র প্রতিষ্ঠার নয়, গণতন্ত্র ধ্বংসের ইতিহাস।
যারা জনতার প্রতিনিধি তারা তো গণআকাক্সক্ষা পূরণের অঙ্গীকার করেই জনগণের কাছে ভোট প্রার্থনা করে থাকেন। কিন্তু জনগণের ভোটে নির্বাচিত হওয়ার পর জনপ্রতিনিধিরা যদি অঙ্গীকার ভঙ্গ করেন এবং ঘোষিত ইশতেহার পাশ কাটিয়ে নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত থাকেন, তাহলে তারা কি জনগণের সাথে ওয়াদা ভঙ্গ করেন না? ওয়াদা ভঙ্গকারী এমন রাজনৈতিক নেতাদের কী বিশেষণে অভিহিত করা যায়? এদেরকে কি আবারও ভোট দিয়ে নির্বাচিত করা যায়? এসব প্রশ্ন এখন জনমনে ব্যাপকভাবে জেগে উঠছে। বিশেষ করে মহাজোট সরকারের মন্ত্রী-এমপিদের হলফনামায় সম্পদের যে বিবরণী প্রকাশ করা হয়েছে তাতে দেশের জনগণ বিস্মিত। একজন জনপ্রতিনিধির সম্পদ বিগত ৫ বছরে কি করে শত গুণ বৃদ্ধি হয়ে যায়? এ তো হলো সম্পদের ঘোষিত বিবরণী, যা ঘোষণা না করলেই নয়। কিন্তু এর বাইরেও যে তারা কত সম্পদ অর্জন করেছেন, সেই বিবরণী হয়তো কোনো এক সময়ে জানা যেতে পারে। হলফনামায় সম্পদের বিবরণী প্রকাশের পর নির্বাচন কমিশনের আচরণ জনমনে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। আওয়ামী লীগের নেতারা এসে চাপ দিলেন, আর নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইট থেকে উধাও হয়ে গেল মন্ত্রী-এমপিদের সম্পদের বিবরণ। এতে বিরোধী দলের অভিযোগই সত্য বলে প্রতীয়মান হয় যে, সরকার ও নির্বাচন কমিশন দোসরের মত কাজ করছে। আসলে সাম্প্রতিক সময়ে সরকার ও নির্বাচন কমিশনের আচরণ থেকে পর্যবেক্ষক মহল একথা বিশ্বাস করতে পারছেন না যে, এই সরকার ও কমিশনের অধীনে কোনো অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে মন্ত্রী-এমপিরা শুধু যে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন তা নয়, বিশালকায় বাড়ি নির্মাণের প্রতিযোগিতায়ও যেন তারা নেমে পড়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে সরকারি দলের এমপি শাহরিয়ার আলমের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। রাজশাহী-৬ আসনের এই এমপি বাঘার আড়ানী পৌর এলাকায় আলিশান বাড়ি নির্মাণ করে রীতিমত হৈ চৈ ফেলে দিয়েছেন। শুধু বাড়ি নির্মাণ করেই তিনি ক্ষান্ত থাকেননি, সেই বাড়ি দেখানোর জন্য রাজশাহীর সর্বত্র উন্মুক্ত আমন্ত্রণও জানান। আয়োজন করেন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের। গত বছরের ৩ ফেব্রুয়ারি শাহরিয়ার আলমের বাড়ি দেখার অনুষ্ঠানে ভিড়ের মধ্যে হুড়োহুড়িতে পদদলিত হয়ে মোসলেম উদ্দিন (৬২) নামে এক মুক্তিযোদ্ধার করুণ মৃত্যু ঘটে। সেখানে আহত হন আরও ১৫ দর্শনার্থী। অনুষ্ঠান থেকে ফেরার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় শোয়েব আলী (৫৫) নামে আরও একজন মারা যান বলে পত্রিকান্তরে প্রকাশিত রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়। অনুষ্ঠানে মানুষ মৃত্যুর পর থেকেই স্থানীয়রা অনেকেই মানুষখেকো বাড়ি বলে আখ্যা দিলেও শাহরিয়ার আলমের বাড়ির জৌলুস কমেনি। বরং দিন দিনই বাড়ির সৌন্দর্য বাড়ানো হয়েছে। পৌর এলাকায় বাঁশ-ছনের বেড়া ও ভাঙাচোরা টিন-চালার অসংখ্য বাড়ি-ঘর বিদ্যমান। চিনি কলের আখ ক্রয়কেন্দ্র, রেলস্টেশন, পোস্ট অফিসসহ হাতেগোনা পাকা ইমারতের আড়ানীতে আধুনিক ভবন বলতে কেবলই এমপি শাহরিয়ারের বাসভবনটি সবার দৃষ্টি কাড়ে। এই ভবনটি বিদেশি জিনিসপত্রে সাজানো। কার্পেট ইরানের, মালয়েশিয়ার ঝাড়বাতি, পানির ট্যাপকল সিঙ্গাপুরের, দরজা-জানালার লক ইতালির, গার্ডেন ও প্রাচীরের লাইট ফিটিংস জাপানের। আলিশান এই বাড়ি দেখে জনমনে প্রশ্ন- কত কোটি টাকা খরচ হয়েছে এর নির্মাণে? জনতা যেখানে থাকে বাঁশ-ছন আর ভাঙা টিনের ঘরে, সেখানে জননেতা থাকেন এমন আলিশান ভবনে, যে ভবন আবার মানুষও খায়! এত ব্যবধান দেখে প্রশ্ন জাগে, এমপি কিংবা মন্ত্রী হলেই কি আর টাকা-পয়সার অভাব থাকে না? কিন্তু এতো তারা কোথায় পায়? কথা ছিল মন্ত্রী-এমপিরা প্রতি বছর তাদের অর্থ-সম্পদের হিসাব দেবেন। কিন্তু তা তারা দেননি। ফলে উপলব্ধি করা যায় যে, স্বাভাবিক পথে এত অর্থ-সম্পদ উপার্জন সম্ভব নয়। তাই অর্থ-সম্পদের অস্বাভাবিক উৎসগুলো সম্পর্কে জনগণ জানতে চায়, কিন্তু জনপ্রতিনিধিরা তা জানাতে চান না। আসলে জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার সাথে জনপ্রতিনিধিদের আচরণ মিলছে না। সেবার বদলে শোষণেই এখন তারা ব্যস্ত। তারপরও তারা জনপ্রতিনিধি! শোষণের মেয়াদ শেষে আবারও তারা জনপ্রতিনিধি হতে চান। কিন্তু জনগণ তো এমন প্রতিনিধি চায় না। তাই কি এতো ছলাকলা, চাতুর্য ও নির্বাচনী প্রহসন! এমন প্রহসন তো জনগণ কখনো মেনে নেবে না। বিষয়টি শাসকগোষ্ঠী উপলব্ধি করলেই মঙ্গল।
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী
আমরা এমনিতেই
তামাশাপ্রিয় জাতি। কোথায়ও বাঁদরের খেলা হচ্ছে সেটা দেখার জন্য আমরা গোল হয়ে
দাঁড়িয়ে ভিড় করি। বাঁদরের খেলার নানা তামাশা দেখি। সাপের খেলায়ও তাই। অনেক সময় দুই
ব্যক্তি মারামারি করে, মারামারি না থামিয়ে
আমরা একইভাবে গোল হয়ে তামাশা দেখি। দেখি না, কে
জেতে। ২০১৪ সালে আমরা তেমনি এক নির্বাচনী তামাশার ভেতর পড়েছি। এই তামাশার প্লেয়ার
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আর প্রধান নির্বাচন কমিশনার রকিবউদ্দীন আহমদ। এই দু’জনের সম্মিলিত খেলা আমাদের এক দারুণ মজার
তামাশা দেখাচ্ছে।
বাংলাদেশে
আগামী ৫ জানুয়ারি এক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। বিরোধী দল দাবি করে আসছিল যে, সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল করে
নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দেওয়া হোক। তা না দিলে সে নির্বাচনে
প্রধান বিরোধী দলগুলোর জোট অংশ নেবে না। এই পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে দেয়া হয়। ১৯৯১ সাল থেকেই নির্বাচনকালীন
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে আসছিল। ’৯১ সালে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের
তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংবিধান অনুযায়ী গঠিত হয়নি। কিন্তু সব দল মিলে এই মর্মে একমত
হয়েছিল যে, প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে
তারা নির্বাচনে যেতে রাজি। সে ক্ষেত্রে বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের শর্ত ছিল, তিনি নির্বাচন সম্পন্ন এবং নির্বাচিতদের
হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে প্রধান বিচারপতি পদে ফেরত যাবেন। রাজনৈতিক দলগুলো তার
এই শর্ত মেনে নেয়। সেভাবেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমেদও
স্বপদে ফিরে যান। সংবিধান সংশোধন করে আনুষ্ঠানিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা
প্রবর্তিত হয় ১৯৯৬ সালে। ১৯৯০ সালে স্বৈরাচারী সেনাপ্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে
গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করে বিরোধী দলগুলো। তাতে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে
আওয়ামী লীগ এবং বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে গঠিত জোট সমানভাবে অংশগ্রহণ করেছিল।
অবশ্য ১৯৮৬ সালেই স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারকে বৈধতা দেয়ার জন্য শেখ হাসিনা হঠাৎ
এরশাদের পাতানো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তার এক দিন আগে তিনি ঘোষণা করেছিলেন, এরশাদের পাতানো নির্বাচনে যে অংশগ্রহণ করবে
সে হবে জাতীয় বেঈমান। মাত্র এক দিন পরেই তিনি নির্বাচনে যোগ দেয়ার ঘোষণা প্রদান
করেন। তখন আমরা ভেবে পাচ্ছিলাম না যে, হাসব
না কাঁদব। এতে আওয়ামী লীগে অবশ্য কিছুই যায় আসেনি। তখন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নাম
ছিল বিশ্ববেহায়া। পটুয়াশিল্পী কামরুল হাসান এই কার্টুন একে দারুণ সুনাম অর্জন
করেছিলেন।
এখন
বাংলাদেশে নির্বাচনী চিত্র তার চেয়ে খুব বেশি ভিন্ন নয়। বাংলাদেশে শেখ হাসিনা এমন
এক নির্বাচন করতে যাচ্ছেন, যে নির্বাচনে বিরোধী দল
নেই। ফলে ইতোমধ্যেই ১৫৪টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়লাভ করেছেন আওয়ামী লীগের
প্রার্থীরা। এর মধ্যে রয়েছেন হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বাধীন বহুধা বিভক্ত জাসদের
একাংশ। আর রয়েছেন একাধিক খণ্ডে বিভক্ত ওয়ার্কার্স পার্টির একাংশের নেতা রাশেদ খান
মেনন। তবে এই দু’জনকে হয়তো বিশ্বাস করা
যায়নি। আর তাই তারা নিজস্ব প্রতীকে নির্বাচনে যাওয়ার অনুমতি পাননি। ফলে গতবারের
মতো এবারো এদের নৌকা মার্কা নিয়ে নির্বাচনে যেতে হয়েছে। এদের আত্মমার্যাদাবোধ ও
লজ্জা আছে কি না, জনমনে প্রশ্ন। আর শেখ হাসিনা
বোধহয় অনুমান করেছেন, যেকোনো সময় এরা মোচড়
দিতে পারেন। মোচড় দিলে সংসদ সদস্য পদ বাতিল।
শেখ
হাসিনা খুব দৃঢ়কণ্ঠে বলেছেন, পৃথিবীর কাউকে দিয়ে
ফোন করিয়েও কোনো ফল হবে না এবং পৃথিবীর কোনো শক্তি ৫ জানুয়ারির নির্বাচন
বাধাগ্রস্ত করতে পারবে না। তার আত্মবিশ্বাসের প্রশংসা করতে হয়। এ রকম গর্ব তার
বাবা শেখ মুজিবুর রহমানও করেছিলেন। তাতে শেষপর্যন্ত কোনো ফল লাভ হয়নি। তিনি
গণতন্ত্র হত্যা করে দেশে একদলীয় শাসন কায়েম করেছিলেন। সে শাসনও মাত্র কয়েক মাস
স্থায়ী হয়েছিল। তবে সে শাসন কায়েম করা ছিল
ভিন্ন রকম। তিনি পার্লামেন্টে সংবিধান সংশোধন করে চতুর্থ সংশোধনী পাস করেছিলেন। তাতে
তিনি নিজ দল আওয়ামী লীগসহ দেশের সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। সংসদীয়
সরকারপদ্ধতির বদলে কায়েম করেছিলেন রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারব্যবস্থা। আর সেই
রাষ্ট্রপতি পদে নিজেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য অধিষ্ঠিত করেছিলেন। সে সংশোধনীতে বলা
হয়েছিল, যেন তিনি নির্বাচিত হয়েছেন।
বর্তমান
সরকার হুবহু সে কাজটি করেনি। শেখ হাসিনা নির্বাচন
দিয়েছেন। মন্ত্রীদের সব ক্ষমতা তিনি নিজ হাতে নিয়ে নিয়েছেন। মন্ত্রীরা এখন কার্যত
তার কৃপাধীন। কারণ কোনো মন্ত্রী নিজ মন্ত্রণালয়ের কোনো পিয়নকেও এখন বদলি করার
ক্ষমতা রাখেন না। বিরোধী দল যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতি ফিরিয়ে আনার দাবিতে
আন্দোলন শুরু করল, তখন সরকার তাদের
তুচ্ছতাচ্ছিল্য কম করেনি। এখন ১৫৪ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে
বললেন, মাঠে খেলোয়াড় নেই। তাই গোল
তো হবেই। আর যে ১৪৬ আসনে নির্বাচন বাকি রয়েছে তার কোনোটিতে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে
প্রতিদ্বন্দ্বিতা হওয়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ। দিনাজপুরের কথাই ধরা যাক, সেখানে ছয়টি আসনের একটি বিনা
প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছে। আর পাঁচটি আসনে আওয়ামী প্রার্থীর বিরুদ্ধে
প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে ওয়ার্কার্স পার্টি। তারা আগের তিনটি নির্বাচনে ১০ লাখ
ভোটারের মধ্যে এক হাজার ৫০০ ভোট পেয়েছিল।
এই
নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ১৫৪টি আসনে জয়লাভ করে কার্যত জনগণের ভোটের
অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে। বাকি ১৪৬টি
আসনের পরিস্থিতিও তাই দাঁড়াবে। ফলে এই নির্বাচন হবে ভোটারবিহীন। কার্যত এই
নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন করে দেশে পুনরায় একদলীয় শাসন কায়েম করার আকাক্সাই
বাড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। বহুবার জনগণের ভোটের অধিকারের কথা বলেছেন। কিন্তু এই নির্বাচনে
সে অধিকার কেড়ে নিয়েছে এ সরকার। অবাধ, নিরপেক্ষ
ও গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন ছাড়া গণতন্ত্র অচল। এ ধরনের নির্বাচন ছাড়া যে সংসদ
গঠিত হয়ে থাকে, তা-ও জনপ্রতিনিধিত্বশীল নয়।
নির্দলীয়
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট প্রায় এক
মাস ধরে সারা দেশে বাস-লঞ্চ-ট্রেন অবরোধ কর্মসূচি পালন করে এবং এই কর্মসূচিতে
সর্বস্তরের মানুষ সর্বাত্মকভাবে অংশগ্রহণ করেছে। এরপর ২৯ ডিসেম্বর বেগম জিয়া ‘মার্চ ফর ডেমোক্র্যাসি’ কর্মসূচি হিসেবে ঢাকায় মহাসমাবেশের ডাক
দেন। অবরোধ চলাকালে বিজিবি-র্যাব-পুলিশ-ছাত্রলীগ-যুবলীগ মিলে দেশের বিভিন্ন
স্থানে বহু মানুষ হত্যা করে। গ্রামে ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। যৌথবাহিনী বুলডোজার দিয়ে
গুঁড়িয়ে দেয় অনেক বাড়ি। সে অভিযান এখনো চলছে। চলছে পাইকারি হারে গ্রেফতার ও গুম।
এর
মধ্যে ঘটেছে আরেক কাণ্ড। সরকারের আজ্ঞাবহ মেরুদণ্ডহীন
নির্বাচন কমিশন সরকারের নির্দেশনার বাইরে কিছুই করতে পারছে না। আওয়ামী লীগের
মন্ত্রী-এমপি-নেতাদের যারা নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন, তারা নিজেরাই তাদের সম্পত্তির হিসাব নির্বাচন কমিশনে জমা
দিয়েছেন। সে এক ‘আলী বাবা ও চল্লিশ চোরের’ কাহিনী। পাঁচ বছর আগে এরা তাদের সম্পত্তির
যে হিসাব দিয়েছিলেন, এখন সে সম্পদ বেড়ে শত-সহস্র
গুণ হয়েছে। এমনকি পাঁচ হাজার গুণ পর্যন্ত সম্পদ বেড়েছে। অর্থাৎ যার সম্পদ ছিল এক
কোটি টাকা, তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে পাঁচ
হাজার কোটি টাকা। এর বেশির ভাগই জনগণের অর্থ লুণ্ঠন করে। শেয়ার মার্কেট থেকে যারা
হাজার হাজার কোটি টাকা লুণ্ঠন করেছে, যারা
বিভিন্ন ব্যাংক ফতুর করেছে, যারা কুইক রেন্টালের
মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে, তারা
প্রার্থী। তার ওপর তো টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, দখলবাজি ছিলই। পত্র-পত্রিকায় যখন আওয়ামী
মন্ত্রী-এমপি-নেতাদের সম্পদ বৃদ্ধির হিসাব প্রকাশিত হতে শুরু করল, তখন শেখ হাসিনা নির্বাচন কমিশনে এক
প্রতিনিধিদল পাঠালেন। তারা কমিশনকে জানালেন, যে
বিপুল সম্পদের হিসাব তারা দিয়েছেন, তা
কমিশনের ওয়েবসাইট থেকে সরিয়ে ফেলা হোক। কী আশ্চর্য! নির্বাচন কমিশন সেই বিবরণ
সরিয়ে ফেলল। এ রকম একটি নতজানু ও মেরুদণ্ডহীন নির্বাচন কমিশনের অধীনে কোন বিবেকবান
নির্বাচনে যাবে! আর তাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন এবং এই নির্বাচন
কমিশনের বিদায়ে মাধ্যমে সমস্যার সুরাহা হওয়া সম্ভব।
এ
দিকে ঢাকায় ‘মার্চ ফর ডেমোক্র্যাসি’ কর্মসূচিতে যাতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে
লোক আসতে না পারে তার জন্য সরকারই দূরপাল্লার লঞ্চ, বাস, ট্রেন বন্ধ করে
দিয়েছে। ঢাকার ভেতরও টাউন সার্ভিস বাস চলাচল করতে দিচ্ছে না। এখন ব্যবসায়ী সমাজ
কোথায়? তারা বিরোধী দলের বিরুদ্ধে
সাদা পতাকা মিছিল করলেন। মানববন্ধন করলেন। এখন আসুন সরকারের বিরুদ্ধেও সাদা পতাকা
মিছিল, মানববন্ধন করুন। সেটি তাদের
কাছ থেকে আশা করা যায় কি? ঢাকায় সমবেত হতে মানুষ এসেছে বন্যার
স্রোতের মতো। যখন জোয়ার আসে, তখন বাঁধ দিয়ে তার
কতটুকুইবা রক্ষা করা যায়!
সরকারও
এই জনস্রোতকে রোধ করার জন্য পথে পথে ব্যাপক তল্লাশি চালিয়েছে। এমনকি বস্তা সাজিয়ে
বাঙ্কার তৈরী করে বন্দুক তাক করে রেখেছে। জনগণের বিরুদ্ধে সরকারের যুদ্ধ।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আমাদের নিকটজন কেউ ছিল না। কিন্তু বর্তমান হামলা যারা
করছে তারা আমাদের পাড়া-প্রতিবেশী। নয়া পল্টনে বেগম খালেদা জিয়া যে সমাবেশের ডাক
দিয়েছিলেন, সেটা অনুষ্ঠিত হলে সরকার
বোধকরি ধসেই পড়ত। সরকারের প্রতি পদক্ষেপে সে কথাই আমাদের মনে হয়েছে।
২৯
ডিসেম্বরের দুই-তিন দিন আগ থেকে সংবাদপত্রে খবর বেরিয়েছে যে, ১৮ দলীয় জোটনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া কার্যত
গৃহবন্দী। সেটি ২৮ তারিখ রাত থেকে আরো স্পষ্ট হয়ে উঠল। নেতৃত্বের অভাব ছিল এ কথা
সত্য। বিএনপি, জামায়াতসহ ১৮ দলীয় জোটের
যাকে যেখানে পাওয়া গেছে তাকে সাথে সাথে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এরপর চালানো হয়েছে
যৌথবাহিনীর নামে নির্যাতন।
২৮
তারিখ রাত থেকেই বেগম খালেদা জিয়ার বাড়ির দুই দিকের প্রবেশপথই বালুভর্তি ট্রাক
দিয়ে আটকে দেয়া হয়। র্যাব, পুলিশ, বিজিবি গিজগিজ করতে থাকে। সেখানে সবার
প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়। মিডিয়া কর্মীরাও পরিস্থিতির সংবাদ প্রচার করতে পারছিলেন
না। ২৯ তারিখ সে চিত্র আরো ভয়াবহ রূপ নেয়। পথের বাধা তো আমরা দেখেছি। আর এ কথা
সত্য যে, খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে
নয়া পল্টনে গিয়ে দাঁড়ানোর সে রকম কোনো শক্তিশালী নেতা ছিলেন না। থাকলে সম্ভবত
মুহূর্তে লাখো মানুষের সমাগম থাকত সেখানে।
আর
সে কারণেই সরকার খালেদা জিয়াকে গৃহবন্দী করে ফেলে। ২৯ তারিখের এক দিকে সকাল থেকে
বেগম খালেদা জিয়া নয়া পল্টনে আসার চেষ্টা করছিলেন; কিন্তু তাকে আসতে দেয়া হচ্ছিল না। তেমনি চিত্র দেখা গেল জাতীয়
প্রেস কাব, সুপ্রিম কোর্ট অঙ্গন ও কদম
ফোয়ারা এলকায়। প্রেস কাবে চলছিল সাংবাদিকদের সমাবেশ। সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে
আইনজীবীরা বেরিয়ে এসে যোগ দিতে চেয়েছিলেন নয়া পল্টনের সমাবেশে। আর মিছিল নিয়ে ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা আসছিলেন কার্জন হল থেকে। এই তিন স্থানে র্যাব, পুলিশ ও আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ একযোগে হামলা চালায়। আশ্চর্য ঘটনা
এই যে, আইনজীবীরা যখন বেরিয়ে আসার
চেষ্টা করছিলেন, তখন তাদের পুলিশের জলকামান
হামলা করেছিল। গেটে তালা দেয়া ছিল। আইনজীবীরা বের হতে পারছিলেন না। কিন্তু এই তালা
ভেঙে লাঠিসোটা নিয়ে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগের ক্যাডাররা
ভেতরে ঢুকল। তখন পুলিশ কোথায় যে মিলিয়ে গেল বোঝা গেল না। তারা গিয়ে ভাঙচুর করল।
আগুন জ্বালাল। মহিলা আইনজীবীকে মাটিতে ফেলে পেটালো। সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে
ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করল। কেউ কাছ থেকে, কেউ
টেলিভিশনের পর্দায় আমরা সে বীভৎস দৃশ্য দেখলাম।
আর
দেখলাম বেগম খালেদা জিয়ার বাসভবনে পুলিশের বাহাদুরি। তাকে নয়া পল্টনে আসতে না
দেয়ায় তিনি বাসার ভেতরেই ‘গণতন্ত্রের অভিযাত্রা’ অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেন এবং পরদিন অর্থাৎ ৩০
ডিসেম্বর একইভাবে ১৮ দলীয় জোটের নেতাকর্মীদের নয়া পল্টনে হাজির হওয়ার আহ্বান
জানান। আর ঘোষণা দেন, তিনি সেখানে উপস্থিত
থাকবেন।
আবারো সরকার জিতল না, হেরে গেল গণতন্ত্র। বেগম জিয়া আবারো প্রমাণ
করলেন তিনি আপসহীন। গণতন্ত্রের প্রশ্নে তার অবস্থান দৃঢ়। মার্চ ফর ডেমোক্র্যাসি
একসাথে কয়েকটি সত্য তুলে ধরল।
ক.
সরকার গণতন্ত্রচর্চা করবে না। খ. সরকার-বিরোধী দল, জোট ও ভিন্নমত সহ্য করবে না। গ. একতরফা নির্বাচনের যে
পরিকল্পনা সেখান থেকেও সরে আসবে না। ঘ. ক্ষমতার জন্য সরকার যত অনৈতিক কাজই হোক, তা করতে কার্পণ্য করবে না। ঙ. পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি সরকারের পেটোয়া হিসেবে নির্লজ্জভাবে
আরো কিছু দিন ব্যবহার হতে থাকবে। চ. প্রেস কাব ও হাইকোর্টের মতো স্পর্শকাতর স্থানও
সরকারি টার্গেটের বাইরে থাকবে না।
সাংবাদিক
ও আইনজীবীরা আক্রান্ত হয়ে চলমান আন্দোলনকে অর্থবহ করলেন। শিক্ষকদের লাঞ্ছিত করার
এই দৃষ্টান্তও সরকারের কপাল পুড়ল। এত দিন খোলসের ভেতর থাকা আজদাহাতুল্য সরকার
স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করল। এটিই আজদাহাকে মৃত্যুতুল্য বিষপান করাবেই। কয়েক দফা টানা
অবরোধের পর বিরতি দিয়ে সহিংসতামুক্ত, নাশকতা
এড়িয়ে শান্তিপূর্ণ একটি কর্মসূচি ঘোষণার দায় ছিল বিরোধী দলের। যেভাবে সব নাশকতা ও
সহিংসতার জন্য জামায়াত-শিবির, হেফাজত ও বিরোধী দলকে
অভিযুক্ত করা হচ্ছিল, তার মোকাবেলায় বিরোধী
দলের গণতান্ত্রিক শিষ্টাচার মেনে কর্মসূচি পালনের তাগিদ ছিল।
বিরোধী
জোট প্রমাণ করতে পেরেছে এরা প্রতিবাদী ও সংুব্ধ, কিন্তু হঠকারী নয়। অপর দিকে আওয়ামী লীগ ও সরকার প্রমাণ করেছে, এরা হঠকারি ও চরমমাত্রার ফ্যাসিবাদী।
কর্মসূচি ছিল বিরোধী দলের অথচ প্রথম দিনের মতো দ্বিতীয় দিনও অস্ত্র ও লাঠি হাতে
রাজপথে মহড়া দিয়েছে সরকারি দল। প্রেস কাবের ঘটনা, হাইকোর্টে পুলিশকে সাক্ষীগোপাল সাজিয়ে বর্বর কর্মীদের ভেতরে
ঢোকানোর দৃশ্য, গুলশানে খালেদা জিয়ার পথ ও
গতিরোধের জন্য বালুর ট্রাক, নজিরবিহীন পুলিশি
বাড়াবাড়ি, সরকার ঘোষিত সর্বাত্মক হরতাল-অবরোধ
পালন, ঢাকাকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া, লঞ্চ-ট্রেন-বাস সরকারি নির্দেশে বন্ধ রাখা, দেশজুড়ে গণগ্রেফতার ও তল্লাশি, রাজধানীজুড়ে অঘোষিত ১৪৪ ধারা জারি, সারা দেশ থেকে ঢাকাগামী মানুষের জনস্রোত জোর
করে আটকে দেয়ার ঘটনায় সাধারণ মানুষ আরো বিগড়ে গেছে। কারবালায় হুসাইন খুন হলেও মরে
যায় এজিদ। বাংলাদেশেও শেখ হাসিনা সরকার গঠন করবে পাতানো ও প্রহসনের নির্বাচনে, রাষ্ট্রশক্তির আনুকূল্যের কারণে সরকারি দল
চূড়ান্ত বাড়াবাড়ি করলেও হেরে যাবে বাংলাদেশের প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতি, মৃত্যু ঘটবে গণতন্ত্রের।
এখনো
আমরা রাষ্ট্র ও সরকারের পার্থক্য বুঝতে চাই না। রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে
কোনো দিন কোনো দল জিততে পারে না; জনগণ ও আন্দোলন কার্যত
জিতে যায় ব্যর্থ, দুর্বিনীত, দুর্নীতিবাজ ও স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের
বিরুদ্ধে লড়াই করে কিংবা গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নয়। রাষ্ট্র
সব নাগরিকের। সরকার আওয়ামী-বিএনপির কিংবা অন্য কোনো দলেরই হয়ে থাকে। বর্তমান
সরকারের বিরুদ্ধে জনগণের পক্ষে বিরোধী দলের আন্দোলন নতুন মাত্রা পেয়েছে।
রাষ্ট্রশক্তির এ অপব্যবহার অচিরেই রাষ্ট্রশক্তি ও সরকারের মধ্যে ফারাকটা আরো
স্পষ্ট করে দেবে। তখন জনগণ ও বিরোধী দলের জয় অবশ্যম্ভাবী। নির্বিচারে
রাষ্ট্রশক্তির অপব্যবহার আর কত দিন! রাষ্ট্রের অস্তিত্বের প্রয়োজনেই রাষ্ট্রশক্তির
বোধোদয় ঘটতেই হবে।
রাষ্ট্রশক্তির
সঠিক ব্যবহার হলে হাইকোর্টে তালা খুলে পুলিশ দলীয় ক্যাডার ও গুণ্ডা ঢুকতে দিত না।
আইনজীবীরা বিক্ষোভ করতেন ভেতরে। আওয়ামী লীগ ক্যাডার মিছিল করত রাজপথে। প্রেস কাবে
হামলাও হতো না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ওপর সরকারদলীয় ক্যাডারদের হামলে
পড়ার দৃশ্য দেখতে হতো না। খালেদা জিয়াকেও পুলিশের বাড়াবাড়ির মুখোমুখি দাঁড়াতে হতো
না। বিরোধী দলের কর্মসূচি ভণ্ডুল করতে বিরানি-খিচুড়ি খাইয়ে দলীয় ক্যাডার নামানোর
প্রয়োজন হতো না। সরকার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়ে পুলিশকে দেয়া নির্দেশনাই যথেষ্ট হতো।
পুলিশ সিদ্ধান্ত নিতে পারত তার কতটুকু যাওয়া দরকার, কতটুকু নয়।
এখন
বিরোধী দলের কর্মসূচি পালন করে দিচ্ছে সরকার এবং পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি। অবরুদ্ধ থেকেও বিরোধীদলীয়
নেতা তার ঝাঁঝালো ভাষায় বিুব্ধ মনের কথাগুলো বলে জাতিকে আলোড়িত করছেন। অবরুদ্ধ
খালেদা জিয়া যেন আরো বেশি শক্তিমান, আরো
বেশি প্রতিবাদী ও সোচ্চার। শত সমাবেশ করে যে কথাগুলো তিনি বলতে চাইলেও বলতে পারতেন
নাÑ সংুব্ধ মনে নির্ভয়ে সে
কথাগুলো তিনি বলেছেন। দেশবাসী তার বক্তব্যে উজ্জীবিত-অনুপ্রাণিত। তিনি চাওয়ার
চেয়েও বেশি অর্জন করেছেন, অপর দিকে
প্রধানমন্ত্রী নিজেকে আরো বেশি বিতর্কিত করলেন। বিরোধী দল, জোট, সুশীলসমাজ
ও পেশাজীবীদের পক্ষ থেকে পাতানো ও একতরফা নির্বাচন বাতিলের দাবি আরো যুক্তিগ্রাহ্য
প্রমাণিত হলো। সরকারের ফ্যাসিবাদী চরিত্র আর লুকানো সম্ভব হলো না।
বাংলাদেশের
রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে চটজলদি মন্তব্য করা কঠিন। তার পরও বিগত ক’টা দিনের ঘটনাপ্রবাহ এমন কিছু বিষয়ের দিকে
ইঙ্গিত করে, যা সুখকর মন্তব্যের জন্য জুৎসই
নয়। সরকার এখন দিশেহারা। রাষ্ট্রশক্তি ব্যবহার করেও স্বস্তি পাচ্ছে না। দলীয়
ক্যাডার বাহিনীকে লাঠি হাতে নামিয়েও ভরসা পাচ্ছে না। বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের
দৌড়ের ওপর রাখা ছাড়াও গণগ্রেফতার করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। বিরোধী
দলের প্রায় সব নেতা হাজার হাজার মামলা মাথায় নিয়ে হয় জেলে রয়েছেন, নয়তো স্বেচ্ছানির্বাসনে থাকতে বাধ্য
হচ্ছেন। সরকারের ভাষা হচ্ছে, দেখামাত্র গুলি, নজরে আসামাত্রই গ্রেফতার। জেলখানাগুলো ঠাঁই
নেই অবস্থায় রয়েছে। দেশের মানুষের কোনো নিরাপত্তা নেই। স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা
পাওয়াও কঠিন। তার ওপর দেশজুড়ে স্থবিরতা নেমে এসেছে। ভয়ভীতি আর নিরাপত্তাহীনতা
গ্রাস করে আছে সমগ্র জাতিকে। যৌথবাহিনীর অস্বচ্ছ কর্মকাণ্ডে জনজীবনে যে বিভীষিকা
নেমে এসেছে, তা রীতিমতো ভয়াবহ এক অবস্থার
সৃষ্টি করেছে। জনগণ যেন এখন কোনো এক ত্রাণকর্তার জন্য অপেক্ষমাণ। একটা জাতির জন্য এমন
গুমোট ও অস্বস্তিকর পরিস্থিতি কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না।
দীপুমণির
বক্তব্য শুনে মনে হয়েছে, তিনি খালেদা জিয়াকে
পাকিস্তানি বানিয়ে সব সমস্যার সমাধান করতে চান। অথচ সবার দৃষ্টি এখন গুলশানের
কূটনৈতিক পাড়ার একটি বাড়ির দিকে। বিশ্ববাসীর নজরও রয়েছে বেগম জিয়ার সেই বাড়িকে
ঘিরে। এক দিকে সরকারের সীমাহীন বাড়াবাড়ি, অন্য দিকে খালেদা জিয়ার নির্দেশনা। সারা দেশ
থেকে রাজধানী ঢাকা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। জনবিচ্ছিন্ন সরকার পরিচালিত হচ্ছে
রাষ্ট্রশক্তির জোরে। প্রতিবাদী জনতা অনুসরণ করছে বিরোধীদলীয় নেতার আদেশ-নির্দেশ।
একটি দেশের একজন নেতা বা নেত্রী যখন সবার মনোযোগ আকর্ষণ করেন, দল-মত নির্বিশেষে সবাই যখন তার জন্য প্রহর
গোনেন, তখন দেশ-জাতি একটা
পরিবর্তনের মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়। তখন রাষ্ট্রশক্তি এবং সরকার আলাদা হয়ে যেতে বাধ্য
হয়। জনগণের বিজয় তখন শুধুই অপেক্ষার বিষয়।
এতে সদস্যতা:
পোস্টগুলি (Atom)