শনিবার, ২৬ অক্টোবর, ২০১৩

সংলাপের সমস্ত পথ রুদ্ধ : সংঘাতের মুখে বাংলাদেশ


বাংলাদেশের রাজনৈতিক সঙ্কট এখন কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে? ইংরেজী ভাষায় পরিস্থিতির গাম্ভীর্যকে বিভিন্নভাবে বর্ণনা করা যায়। সাধারণত বলা হচ্ছে যে, বড় দু’টি দল তথা বড় দু’টি রাজনৈতিক জোট‘ চড়রহঃ ড়ভ হড় ৎবঃঁৎহ এ পৌঁছেছে। অর্থাৎ এমন একটি জায়গায় পৌঁছেছে যেখান থেকে ফেরার আর কোন পথ নাই। ইংরেজী ভাষায় আরও বলা যায় যে, ঞযব ফরব রং ধষৎবধফু পধংঃ অর্থাৎ সীসা গলিয়ে এমন ছাঁচে ঢালা হয়েছে যে, এখন আর তার আকৃতি বা প্রকৃতি পরিবর্তনের কোন সুযোগ নাই। পাকিস্তানের সাবেক ক্রিকেটার বিশ্ববিখ্যাত অল রাউন্ডার ইমরান খান একটি ওফরড়স ব্যবহার করেন। সেটি হলো ঞযব পযরঢ়ং ধৎব ফড়হি অর্থাৎ মহাসঙ্কট উপস্থিত। তবে আমি এসব ইডিয়ম ব্যবহার করার সাথে সাথে আরেকটি চযৎধংব বা ওফরড়স ব্যবহার করবো। সেটি হলো ঞযব নধঃঃষব ষরহব রং ফৎধহি । গত শুক্রবার ২৫শে অক্টোবর সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানের বিশাল জনসভায় বেগম খালেদা জিয়া সরকারকে ২ দিনের সময় দিয়েছেন। নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার গঠনের উদ্দেশ্যে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বিরোধী দলের সাথে ডায়ালগ বা সংলাপে বসতে হবে। যদি এর মধ্যে তিনি সংলাপে না বসেন তাহলে আজ রোববার সকাল ৬টা থেকে মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৬টা- এই ৬০ ঘণ্টা সারা বাংলায় বিরতিহীনভাবে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হবে। এই ৬০ ঘণ্টার হরতালকে ১৮ দলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন প্রাথমিক কর্মসূচী। আগামী ২৯ তারিখ মঙ্গলবার সন্ধ্যার মধ্যেও যদি বিরোধী দলের সাথে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় সরকার বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বৈঠক বা সংলাপে না বসেন তাহলে পরবর্তীতে আরও কঠোর কর্মসূচী দেয়া হবে।
বেগম জিয়ার ভাষণ এবার মোটামুটি পরিষ্কার ছিল। এর মধ্যে তেমন কোন অস্পষ্টতা ছিল না। কাজেই ধারণা করা হচ্ছে যে, মঙ্গলবারের মধ্যে যদি নির্দলীয় সরকার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে বিরোধী দলের সাথে আওয়ামী সরকার আলোচনায় না বসে তাহলে পরবর্তীতে যে আরও কঠোর কর্মসূচী আসছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে অবরোধ, ঘেরাও, ঢাকা মহানগরীকে দেশের অবশিষ্ট অঞ্চল থেকে বিচ্ছিন্ন করা প্রভৃতি। এখন দেশের শিক্ষিত সচেতন মানুষের মনকে যে বিষয়টি বেশি নাড়া দিচ্ছে সেটি হলো, রাজনীতির এই চূড়ান্ত লড়াইয়ে কোন পক্ষের হার হবে, আর কোন পক্ষের জিত হবে। আমরা সাধারণ মানুষ কিন্তু এই হার জিতের লড়াই দেখতে চাই না। আমরা দেখতে চাই একটি ডরহ ডরহ ঝরঃঁঃধরড়হ অর্থাৎ এই রাজনৈতিক সঙ্কটের এমন একটি সমাধান হবে যেখানে কেউ জিতবে না আবার কেউ হারবেও না। কিন্তু সেটি কি হওয়া সম্ভব ?
বর্তমানে বিদ্যমান পরিস্থিতি বলছে যে, সঙ্কটের সমাধান নির্ভর করছে প্রধানত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর। আমার বিশ্বাস, সেই ত্রয়োদশ সংশোধনীর মডেলের কেয়ার টেকার সরকারের ওপর এখন বেগম জিয়া আর শতকরা ১০০ ভাগ নির্ভর করছেন না। ইতোমধ্যেই তিনি সেখান থেকে সরে এসেছেন এবং কেয়ার টেকারের পরিবর্তে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের কথা বলছেন। তার বা তার দলের চিন্তা ধারার প্রতিফলন ঘটিয়ে সেদিন তিনি এক প্রেস কনফারেন্সে যে ফর্মুলা দিয়েছেন সেটি বাস্তবায়ন করতে খুব বড় একটি বাধা দেখা যাচ্ছে না। শুধু একটি মাত্র জায়গায় গিট্টু লেগে আছে বলে মনে হচ্ছে। গিট্টুটি ছোট। কিন্তু সেটি জিলাপির প্যাঁচের মতো জটিল। সেখান থেকে ছুটে আসাকে আওয়ামী লীগ খুব কঠিন মনে করছে। ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের মতো একজন অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্ত্ব বিষয়টিকে যতই হালকা করার চেষ্টা করেন না কেন, তিনি হয় পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারেননি, না হয় তিনি রাজনীতিতে সম্পূর্ণ বেমানান।
॥দুই॥
সেই গিট্টুটি হলো, নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান কে হবেন সেই প্রশ্ন। আওয়ামী লীগ তো সাফ বলেই দিয়েছে যে, সেই নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান হবেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর বেগম জিয়া বলেছেন যে, সেই নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান হবেন একজন সম্মানিত নাগরিক। সরকার এবং বিরোধী দল উভয় পক্ষ কোন এক সম্মানিত নাগরিকের ব্যাপারে একমত হলে তাকেই প্রধান উপদেষ্টা করা হবে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এত দূরও বললেন যে, তিনি এখনি প্রধানমন্ত্রীর সাথে একই হেলিকপ্টারে দিনাজপুরে যাচ্ছেন। যাত্রাকালীন সময়ে তিনি মির্জা ফখরুলের চিঠি প্রধানমন্ত্রীকে দেখাবেন এবং পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। আওয়ামী লীগের তরফ থেকে আরও বলা হয় যে, পরের দিন একটি সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে বেগম খালেদা জিয়ার ফর্মুলা এবং আলোচনায় বসা সম্পর্কে মির্জা ফখরুলের চিঠির জবাব আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হবে। ঐ দিকে তথ্য মন্ত্রী হাসানুল হক ইনু জানান যে, শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অতি শীঘ্রই বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়ার কাছে ফোন করবেন। বিএনপি’র তরফ থেকে বলা হয়েছে যে, ফোনের পাশে বেগম খালেদা জিয়া সার্বক্ষণিকভাবে একজন লোক বসিয়ে রেখেছেন। এ কারণে বসিয়ে রেখেছেন যে, প্রধানমন্ত্রীর ফোনটি এলেই সে ধরবে এবং বেগম খালেদা জিয়াকে খবর দেবে। তারপর বেগম জিয়া এসে ফোনটি ধরবেন এবং প্রধানমন্ত্রীর সাথে কথা বলবেন। এই কথার পরেও ৩/৪ দিন পার হয়ে গেছে। শনিবার সকালে এই কলাম লেখার সময় পর্যন্ত শেখ হাসিনা বেগম জিয়াকে ফোন করেছেন বলে কোন সংবাদ পাওয়া যায়নি।
শেখ হাসিনার ফোনের আশায় বিএনপি চাতক পাখির মতো চেয়ে আছে। আপনারা কি চাতক পাখির চেয়ে থাকার গল্পটি জানেন? নিদাঘ তপ্ত দিনে চাতক পাখি ঠোঁট ফাঁক করে ঊর্ধ্বাকাশে চেয়ে থাকে, কখন বৃষ্টি হবে। সে পিপাসার্ত। বৃষ্টি হলে ঐ বৃষ্টির ফোঁটা তার ফাঁক করা ঠোঁটের মধ্যে ঢুকবে এবং সেই পানি দিয়ে তার তৃষ্ণা নিবারণ হবে। সে জন্যই সে ঠোঁট ফাঁক করে আকাশের দিকে চেয়ে থাকে এক ফোঁটা পানির আশায়। কিন্তু হায়, বৃষ্টি আর আসে না। বিএনপিও তেমনি টেলিফোনের পাশে কয়েকদিন ধরে বসে আছে। কিন্তু শেখ হাসিনার টেলিফোন আর আসে না।
আদতেই সেটি কি আসবে? আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা তোফায়েল আহমেদ বলেছেন যে, খালেদা জিয়াকে শেখ হাসিনার আর টেলিফোন করা উচিত নয়। গতকাল শনিবার দৈনিক ইত্তেফাকের প্রথম পৃষ্ঠায় এই সংবাদটি প্রকাশিত হয়েছে। সংবাদটির শিরোনাম, “প্রধানমন্ত্রীর আর খালেদা জিয়াকে ফোন করা উচিত হবে না / তোফায়েল আহমেদ।” খবরে বলা হয়, “ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টাম-লীর সদস্য তোফায়েল আহমেদ এমপি বলেছেন, খালেদা জিয়ার এ আল্টিমেটামের পর আমি মনে করি প্রধানমন্ত্রীর আর তাকে ফোন করা উচিত হবে না। গতকাল একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলকে দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তোফায়েল আহমেদ এ কথাগুলো বলেন। তিনি বলেন, তথ্যমন্ত্রী দেশের মানুষকে জানিয়েছিলেন, যে কোন মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলীয় নেতাকে ফোন করবেন। কিন্তু তাকে সময় না দিয়ে বিরোধীদলীয় নেতা যেভাবে আল্টিমেটাম দিয়েছেন তারপর আর তাকে ফোন করা যায় না। আওয়ামী লীগ সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠ রাজনৈতিক দল। খালেদা জিয়ার কথায় অসাংবিধানিক দাবি আওয়ামী লীগ মানতে পারে না।”
॥তিন॥
কঠিন বাস্তব হলো এই যে, দেশে যখন কোন রাজনৈতিক সঙ্কট সৃষ্টি হয় তখন সরকারি দলই বিরোধী দলকে আলোচনা বৈঠকে বসার আহ্বান জানায়। বিরোধী দল অনেক ধানাই পানাই করার পর কোন কোন সময় আলোচনার আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে অথবা কোন কোন সময় শর্ত সাপেক্ষে যায়। আইয়ুব খানের গোল টেবিল বৈঠকে যোগদানের আহ্বান সেই সময় পশ্চিম পাকিস্তানের বিরোধীদলীয় নেতা জুলফিকার আলী ভূট্টো এবং পূর্ব পাকিস্তানের বিরোধীদলীয় নেতা মওলানা ভাসানী প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। পক্ষান্তরে আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান বৈঠকে যোগদান করে ছিলেন। কিন্তু বিরোধী দল আলোচনা বা সংলাপের জন্য সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে, তেমন নজির অন্তত এই উপমহাদেশে নাই। বেগম খালেদা জিয়া এখানে এক অনন্য সাধারণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। গত ২ বছর ধরে সরকারকে অনুরোধ করার পরেও যখন শেখ হাসিনার তরফ থেকে বরফ গলেনি তখন বিএনপি সরাসরি উদ্যোগ গ্রহণ করে। এতদিন পর্যন্ত আওয়ামী লীগ বলছিল যে, বিএনপি নির্দলীয় সরকারের কথা বলে। কিন্তু তার কোন রূপরেখা দেয় না। সেখানে গত সপ্তাহে বেগম জিয়া সেই রূপরেখাটিও দিয়েছেন। আওয়ামী লীগ সেই রূপরেখা সম্পর্কে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া দেবে, এই কথা বলে তারা একটা সংবাদ সম্মেলনের ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু কোনরূপ কারণ উল্লেখ ছাড়াই সেই সম্মেলন বাতিল করা হয়েছে। সংসদে রূপরেখা উত্থাপন করা হয়েছে। সেই রূপরেখার ওপর কোন আলোচনার ব্যবস্থা না করে পদ্ধতিগত ক্রটির মতো ঠুনকো অজুহাত দিয়ে সেটি আমলে নেয়া হয় নাই। অন্যদিকে আলোচনার আহ্বান জানিয়ে বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে একটি চিঠি দিয়েছেন। সেই চিঠিরও কোন উত্তর দেয়নি আওয়ামী লীগ। গত সোমবার আওয়ামী লীগের একজন মুখপাত্র বলেছেন যে, সংলাপের আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে কোনদিন বেগম জিয়াকে টেলিফোন করবেন। এই লেখাটি লিখছি শনিবার। সোমবারের পর ৫ দিন অতিক্রান্ত হয়েছে। একটি টেলিফোন আসতে কি ৫ দিন লাগে? অথচ এই ৫ দিনেও প্রধানমন্ত্রী বেগম জিয়াকে কোন ফোন করেননি।
এমতাবস্থায় দাবি আদায়ের জন্য হরতাল আহ্বান করা ছাড়া বিরোধী দল তথা বেগম জিয়ার কাছে আর কোন বিকল্প ছিল না। হরতাল আহ্বান করার পরেও বেগম জিয়া আলোচনার জন্য স্পেস রেখেছেন। তিনি সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় বলেছেন যে, যদি সরকার আলোচনায় রাজি হয় তাহলে আলোচনা এবং আন্দোলন পাশাপাশি চলবে।
আজ শনিবার দুপুর পর্যন্ত সরকারি দলের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ নেতারা যে সব উক্তি করেছেন সেগুলো থেকে মনে হচ্ছে যে, আওয়ামী লীগ কোন সংলাপে যাবে না। আর যদি দেশী বিদেশী চাপে যায়ও তাহলে তারাই সেই সংলাপ সফল হতে দেবে না। তেমন একটি অবস্থায় দাবি দাওয়ার ফয়সালা হবে রাজপথে। এটি বাঞ্ছিত নয়। কিন্তু সরকার তো আর কোন দরজা খোলা রাখেনি। আর যদি রাজপথেই দাবি-দাওয়ার ফয়সালা হয় তাহলে সেটি যে অহিংস থাকবে সেই গ্যারান্টি কেউ দিতে পারবে না। সে জন্যই এই কলামের শুরুতে কয়েকটি ইংরেজী বাগধারা দিয়েছে। বলেছি, মহাসঙ্কটে নিক্ষিপ্ত হওয়া ছাড়া সেখান থেকে আমাদের ফেরার আর কোন পথ নাই।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads