তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০১৩-কে আইনে রূপ দিয়ে
গত ৬ অক্টোবর জাতীয় সংসদে পাস হলো তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (সংশোধন) আইন ২০১৩।
দেশী-বিদেশী নানা মহলের প্রবল সমালোচনা উপেক্ষা করে সরকার নিজের মতো করে পাস করল
তথ্যপ্রযুক্তি আইনের এ সংশোধনী। সংশোধিত আইনে সুনির্দিষ্ট চারটি অপরাধের ক্ষেত্রে
গ্রেফতারি পরোয়ানা ছাড়াই অভিযুক্তকে গ্রেফতার করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে পুলিশকে। এসব
অপরাধ জামিনের অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে এ আইনে। বলাবাহুল্য এ ক্ষেত্রে চরম বাস্তবতা
হচ্ছেÑ কার্যত সরকারের অলিখিত ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপরই নির্ভর
করবে এ আইনের অধীনে কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোন অপরাধটি পুলিশ আমলে নিয়ে কখন মামলা
করবে, আর কখন করবে না। আর এর সবচেয়ে বড় শিকার হবে
ভিন্নমতের রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী, সক্রিয়বাদী ও
মানবাধিকার সংগঠনের লোকজন।
সংশোধিত এ আইনে শাস্তির মেয়াদ বাড়িয়ে সর্বনি¤œ সাত বছর ও সর্বোচ্চ ১৪ বছর কারাদণ্ডের বিধান করা হয়েছে। ২০০৬ সালে প্রণীত তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনে সর্বোচ্চ শাস্তির মেয়াদ ছিল ১০ বছরের কারাদণ্ড। আগের আইনে মামলা করতে হলে মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিতে হতো। কিন্তু সদ্য সংশোধিত আইনে পুলিশ চাইলেই অপরাধ আমলে নিয়ে মামলা করতে পারবে। এখানে সবিশেষ উল্লেখ্য, গত ১৯ আগস্ট মন্ত্রিসভা এ আইনের খসড়া সংশোধনী মন্ত্রিসভায় অনুমোদন নেয়। এরপর অনেকটা তাড়াহুড়ো করে জারি করা হয় তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (সংশোধনী) অধ্যাদেশ ২০১৩। বলা হয়, সরকার এই আইন সংশোধনীর উদ্যোগ নিয়েছে। কারণ দেশে তথ্যপ্রযুক্তিগত বা সাইবার অপরাধ ক্রমেই বেড়ে তা সামাজিক ব্যাধি হিসেবে ছড়িয়ে পড়েছে। বিশেষ করে রাজনৈতিক স্বার্থে এর ব্যবহার ব্যাপক হুমকির সৃষ্টি করছে। এ প্রেক্ষাপটে সরকার ২০০৬ সালের তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইন সংশোনের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু অবাক হওয়ার মতো ব্যাপার, যেখানে এ অধ্যাদেশ জারির মাত্র কয়েক দিন পর ১২ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদ বসার দিনতারিখ নির্ধারিত ছিল, তখন কেন তাড়াহুড়ো করে এই সংশোধনীর জন্য অধ্যাদেশ জারি এতটা প্রয়োজন হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত তো আবার সে অধ্যাদেশ সংসদে তুলে তা পাস করিয়ে নিয়ে আইনে রূপ দিতে হলোই। সমালোচকদের অভিমত, আসলে সরকার এতটা তাড়াহুড়ো করে অধ্যাদেশ জারি করে এ সংশোধনী পাস করার পেছনে একটি মাত্র কারণ হলো বিরোধী দল-মত দমনে আরো একটি শক্ত হাতিয়ার হাতের কাছে পাওয়া। অথচ এই আইন সংশোধনীর উদ্যোগ জনগণের কাছে কিছুটা যুক্তিযুক্ত হতো যদি তা স্বাভাবিক বিল আকারে সংসদে উত্থাপন করে সংসদ সদস্যদের আলোচনার পর তা পাস হতো। তা না করে সংসদ বসার মাত্র ক’দিন আগে এ জন্য অধ্যাদেশ জারি কোনো মতেই যুক্তিগ্রাহ্য হতে পারে না। বরং এর ফলে এই সংশোধনী নিয়ে জনমনে সরকারের উদ্দেশ্যই কার্যত প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। এমনিতেই সমালোচনা আছে ২০০৬ সালে যখন এ আইনটি করা হয়, তখনো আইন প্রণয়নে স্বচ্ছ ধারা অনুসরণ করা হয়নি। তা ছাড়া তখনো অভিযোগ ওঠেÑ আইনটিতে নাগরিক অধিকারের স্বার্থবিরোধী কালাকানুন যুক্ত করা হয়েছে। দৃষ্টান্ত হিসেবে ৫৭ নম্বর ধারার ১ নম্বর উপধারাটির কথা উল্লেখ করা হয়। বলা হয়, এ ধারাটি ত্রুটিপূর্ণ ও সংবিধানে দেয়া মৌলিক অধিকারের প্রতি হুমকি। সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞজনদের অভিমত, এ ধারাটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে আইনে সংযোজন করা হয়। সরকার রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য এ ধারাটি ব্যবহার করতে পারে বলে সুশীলসমাজসহ সচেতন নাগরিক সমাজ তখনই উদ্বেগ প্রকাশ করে। তাদের এ যুক্তির পেছনে এখন একটি জায়মান উদাহরণ হিসেবে বলা হচ্ছে, সাংবাদিক মাহমুদুর রহমান ও মানবাধিকারকর্মী আদিলুর রহমান খানের বিরুদ্ধে এ ধারাটির অপপ্রয়োগ করছে বর্তমান সরকার। অতএব এ ধারাটি ন্যায়বিচার বিঘিœত করছে এবং আগামী দিনেও করবে বলে তাদের প্রবল বিশ্বাস। তাদের অভিমত, এ ধারার অপপ্রয়োগ হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল; অতএব এ ধারাটি বাতিলযোগ্য।
সংশোধিত আলোচ্য আইনে সমালোচনা আছে এর ৫৪, ৫৬, ৫৭ ও ৬১ ধারা নিয়ে। এসব ধারায় উল্লিখিত অপরাধকে জামিন-অযোগ্য অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এ চার ধারার অপরাধগুলোর মধ্যে আছে কম্পিউটার ব্যবহার করে নানা অপরাধ, সিস্টেম হ্যাকিং, সংরক্ষিত সিস্টেমে প্রবেশ ও ইলেকট্রনিক আকারে মিথ্যা, অশ্লীল ও মানহানিকর তথ্য প্রকাশ করা। তবে বিভিন্ন মহলের সবচেয়ে বেশি উদ্বেগ ৫৭ ধারাটি নিয়ে। এ ধারায় বলা আছে, ইলেকট্রনিক মাধ্যমে মিথ্যা, অশ্লীল ও মানহানিকর তথ্য প্রকাশ এ ধারার অপরাধ বলে গণ্য হবে। ইচ্ছে করে ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে মিথ্যা ও অশ্লীল কিছু প্রকাশ করলে এবং এর কারণে মানহানি, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, ব্যক্তি ভাবমূর্তি ক্ষুণœ বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগলে অথবা কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উসকানি দেয়া হলে তা অপরাধ বলে গণ্য হবে। এখানে বর্ণিত অপরাধে অভিযোগ এনে পুলিশ সরকারের অঙ্গুলিহেলনে যেকোনো সময় ভিন্নমতের রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার করে নির্যাতনের শিকারে পরিণত করতে পারবে। এ ধারার অপরাধ জামিনের অযোগ্য হওয়ায় প্রহসনের বিচারের নামে তাকে আটকে রাখতে পারবে মামলা চলা অবস্থায়। এ ধরনের আইন যে মানুষের মৌল অধিকারের পরিপন্থী, তা বুঝতে কারো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
যেকোনো বিবেকবান মানুষই স্বীকার করবেন, এ আইনের ব্যাপারে আমাদেরকে নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে ভেবে দেখা দরকার। বিভিন্ন মহল ২০০৬ সাল থেকেই এ আইনের ব্যাপারে আপত্তি জানিয়ে আসছে। সম্প্রতি আইনটির সংশোধন একে আরো খারাপপর্যায়ে নিয়ে নামানো হলো। কেউ কেউ বলছেন, আজকে এ আইনকে যে পর্যায়ে নামিয়ে আনা হয়েছে, তা সরকারে প্রতিশ্রুত ডিজিটাল বাংলাদেশ বানানো নীতির সম্পূর্ণ বিপরীত। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় কোনো অপরাধেরই সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞায়ন নেই এ আইনে। অতএব, যেকোনো ব্যক্তি যেকোনো সময় কোনো কিছু না জেনেই এ আইনে বর্ণিত কোনো অপরাধে অপরাধী সাব্যস্ত হতো।
গত আগস্টে যখন সরকার তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (সংশোধন) আইন অধ্যাদেশের মাধ্যমে সংশোধনের উদ্যোগ নেয়, তখনই ওএমসিটি (ওয়ার্ল্ড অর্গানাইজেশন অ্যাগেইনস্ট টর্চার) এবং এফআইডিএইচ (ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব হিউম্যান রাইটস) মানবাধিকার সংরক্ষণের পর্যবেক্ষক হিসেবে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্টের কাছে এ অধ্যাদেশ জারি না করার আহ্বান জানান, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (সংশোধন) আইন ২০১৩ অধ্যাদেশ জারি থেকে বিরত থাকতে। এই দুই পর্যবেক্ষক দু’টি উদ্বেগ প্রকাশ করে বলে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা বলে মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার’-এর সেক্রেটারি আদিলুর রহমান খানকে ‘মিথ্যা তথ্য ও ছবি প্রকাশ’ এবং ‘দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর প্রচেষ্টার’ অভিযোগে গত ১০ আগস্ট গ্রেফতার করা হয়। এখন আইসিটি আইন সংশোধন করে যেভাবে বিনা পরোয়ানায় উল্লিখিত অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতারের সুযোগ করে দেয়া হলো, তাতে পুলিশ যখন-তখন যাকে-তাকে গ্রেফতার করে হয়রানি করার ব্যাপারেও প্ররোচিত হবে। এ ছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক হয়রানির সমূহ সম্ভাবনা তো আছেই।
ওএমসিটি সেক্রেটারি জেনারেল জেরাল্ড স্টেবেরক বলেন, নতুন আইন সংশোধন মনে হয় বিশেষত মানবাধিকার কর্মী অধিকার সম্পাদক ও অন্যান্য সদস্যকে টার্গেট করেই করা হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, ‘একটি ডিফ্যাক্টো ইমারজেন্সি’ প্রক্রিয়ায় ইতোমধ্যেই ডাউটফুল ল হিসেবে বিবেচিত এ আইনে নতুন ‘এক্স পেস্ট ফ্যাক্টো প্রভিশন’ যোগ করে জামিনের পথ রোধ করে সংশোধনের কোনো যৌক্তিকতা নেই। এ আইন সংশোধনের অধ্যাদেশ জারির আগে এফআইডিএইচ প্রেসিডেন্ট করিম লাহিকি বাংলাদেশের প্রেসিডেন্টের কাছে আহ্বান জানিয়ে বলেন : mkcÖæblu@gmail.com
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, এ আইনের মাধ্যমে গণমাধ্যম, সংবাদমাধ্যম, মানবাধিকারকর্মী, তথ্যপ্রযুক্তিকর্মীÑ এরা সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। একটি গণতান্ত্রিক দেশে গতান্ত্রিক সরকারের কাছে এ ধরনের আইন কাম্য হতে পারে না। যে কারো মত প্রকাশের বিরুদ্ধে এ আইন প্রয়োগের চেয়ে অপপ্রয়োগের সুযোগ থাকছে বেশি।
আইন ও সালিস কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল বলেছেন, একজন ব্যক্তি দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত তাকে দোষী বলা যাবে না। তাই কোনো অপরাধকে অজামিনযোগ্য করা গ্রহণযোগ্য নয়। অপরাধ অজামিনযোগ্য করলে হিতে বিপরীত হয়। আইনের অপব্যবহার হতে পারে। তাই জামিন আদালতের সন্তুষ্টির ওপর ছেড়ে দেয়া উচিত। তিনি আরো বলেন, আইনের জামিনযোগ্য ধারাগুলো অজামিনযোগ্য করে দিলে মানুষ ভীত হবে। তা ছাড়া এটি ন্যায়বিচারের পরিপন্থী। এর ফলে মত প্রকাশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে।
এ আইন সংশোধন ও এটি সংশোধন করতে গিয়ে প্রথমে তাড়াহুড়ো করে প্রথমে রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ জারি ও এর মাত্র কয়েক দিন পর সংসদে এ অধ্যাদেশ পাস করে তাকে আইনে পরিণত করার এ প্রক্রিয়া করাসহ সংযোজিত নতুন বিধান নিয়ে এখন চার দিকে চলছে নানা বিতর্ক। বিভিন্ন অনলাইন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও কমিউনিটি ব্লগেও চলছে এর আলোচনা-সমালোচনা। এতে একটি বিষয় জোর দিয়ে বলা হচ্ছে, পরোয়ানা ছাড়া পুলিশকে গ্রেফতারের ক্ষমতা দেয়ার আইন কোনো সভ্য দেশে চলতে পারে না।
বিশিষ্ট আইনজীবী ড. কামাল হোসেন এ সম্পর্কে বলেছেন, যে আইনে বাকস্বাধীনতা কিংবা মৌলিক অধিকার খর্বের প্রশ্ন ওঠে, তা অবশ্যই অধ্যাদেশ জারি করে কার্যকর করা উচিত নয়। তিনি বলেন, আইনটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে জারির আগে সংসদে তোলা উচিত ছিল। আইনটি সংশোধনের আগে সংসদীয় স্থায়ী কমিটি যাচাই-বাছাই করে, এর পর সংসদে আরো আলোচনা করে, প্রয়োজনে জনমত যাচাই করে সংশোধন করা উচিত ছিল। তা না করায় এখন আইনের সংশোধন ও অধ্যাদেশ জারির বিষয় নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠছে।
এ আইনে নতুন ধারা সংযোজনের সমালোচনা করে বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেন, আইনে তথ্যের সংজ্ঞায় মিথ্যা, অশ্লীল ও উসকানিমূলক ইত্যাদি বিষয়গুলো সুস্পষ্ট করা হয়নি। আমরা প্রতিনিয়ত ইন্টারনেট ব্যবহার করি। ইন্টারনেটে সত্য ভেবে কোনো তথ্য বিনিময় করা হলে, সে ক্ষেত্রে পুলিশ পরোয়ানা ছাড়াই গ্রেফতার করতে পারবে। এর ফলে ভয়ভীতির কারণে মত প্রকাশের স্বাধীনতা স্বাভাবিকভাবেই সঙ্কুচিত হবে।
তথ্যপ্রযুক্তি আইন সংশোধনের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা হাফিজ উদ্দিন খান বলেন, সংসদ অধিবেশন বসার মাত্র ক’দিন আগে তাড়াহুড়ো করে অধ্যাদেশ জারি করে এ আইন সংশোধনের পেছনে সরকারের কোনো উদ্দেশ্য কাজ করছে, এমন সন্দেহের অবকাশ আছে। আইনটিকে ‘কালাকানুন’ হিসেবে অভিহিত করে তিনি বলেন, পরোয়ানা ছাড়া পুলিশকে গ্রেফতারের ক্ষমতা দেয়া সভ্য দেশে বেমানান। এ ধরনের সংশোধনী কার্যকর হলে সংবিধানে ঘোষিত জনগণের মত প্রকাশের স্বাধীনতা বাধাগ্রস্ত হবে।
দেশের মানুষ আশা করছে, সরকার বাস্তবতা অনুধাবন করে মানবাধিকার বিধ্বংসী কালাকানুনটি নতুন করে পর্যলোচনায় নামবে। সেই সাথে জনগণের চাওয়া-পাওয়ার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে এ আইনের অগ্রহণযোগ্য ধারাগুলোর প্রয়োজনীয় সংশোধন কিংবা বাতিল করার আশু পদক্ষেপ নেবে।
সংশোধিত এ আইনে শাস্তির মেয়াদ বাড়িয়ে সর্বনি¤œ সাত বছর ও সর্বোচ্চ ১৪ বছর কারাদণ্ডের বিধান করা হয়েছে। ২০০৬ সালে প্রণীত তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনে সর্বোচ্চ শাস্তির মেয়াদ ছিল ১০ বছরের কারাদণ্ড। আগের আইনে মামলা করতে হলে মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিতে হতো। কিন্তু সদ্য সংশোধিত আইনে পুলিশ চাইলেই অপরাধ আমলে নিয়ে মামলা করতে পারবে। এখানে সবিশেষ উল্লেখ্য, গত ১৯ আগস্ট মন্ত্রিসভা এ আইনের খসড়া সংশোধনী মন্ত্রিসভায় অনুমোদন নেয়। এরপর অনেকটা তাড়াহুড়ো করে জারি করা হয় তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (সংশোধনী) অধ্যাদেশ ২০১৩। বলা হয়, সরকার এই আইন সংশোধনীর উদ্যোগ নিয়েছে। কারণ দেশে তথ্যপ্রযুক্তিগত বা সাইবার অপরাধ ক্রমেই বেড়ে তা সামাজিক ব্যাধি হিসেবে ছড়িয়ে পড়েছে। বিশেষ করে রাজনৈতিক স্বার্থে এর ব্যবহার ব্যাপক হুমকির সৃষ্টি করছে। এ প্রেক্ষাপটে সরকার ২০০৬ সালের তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইন সংশোনের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু অবাক হওয়ার মতো ব্যাপার, যেখানে এ অধ্যাদেশ জারির মাত্র কয়েক দিন পর ১২ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদ বসার দিনতারিখ নির্ধারিত ছিল, তখন কেন তাড়াহুড়ো করে এই সংশোধনীর জন্য অধ্যাদেশ জারি এতটা প্রয়োজন হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত তো আবার সে অধ্যাদেশ সংসদে তুলে তা পাস করিয়ে নিয়ে আইনে রূপ দিতে হলোই। সমালোচকদের অভিমত, আসলে সরকার এতটা তাড়াহুড়ো করে অধ্যাদেশ জারি করে এ সংশোধনী পাস করার পেছনে একটি মাত্র কারণ হলো বিরোধী দল-মত দমনে আরো একটি শক্ত হাতিয়ার হাতের কাছে পাওয়া। অথচ এই আইন সংশোধনীর উদ্যোগ জনগণের কাছে কিছুটা যুক্তিযুক্ত হতো যদি তা স্বাভাবিক বিল আকারে সংসদে উত্থাপন করে সংসদ সদস্যদের আলোচনার পর তা পাস হতো। তা না করে সংসদ বসার মাত্র ক’দিন আগে এ জন্য অধ্যাদেশ জারি কোনো মতেই যুক্তিগ্রাহ্য হতে পারে না। বরং এর ফলে এই সংশোধনী নিয়ে জনমনে সরকারের উদ্দেশ্যই কার্যত প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। এমনিতেই সমালোচনা আছে ২০০৬ সালে যখন এ আইনটি করা হয়, তখনো আইন প্রণয়নে স্বচ্ছ ধারা অনুসরণ করা হয়নি। তা ছাড়া তখনো অভিযোগ ওঠেÑ আইনটিতে নাগরিক অধিকারের স্বার্থবিরোধী কালাকানুন যুক্ত করা হয়েছে। দৃষ্টান্ত হিসেবে ৫৭ নম্বর ধারার ১ নম্বর উপধারাটির কথা উল্লেখ করা হয়। বলা হয়, এ ধারাটি ত্রুটিপূর্ণ ও সংবিধানে দেয়া মৌলিক অধিকারের প্রতি হুমকি। সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞজনদের অভিমত, এ ধারাটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে আইনে সংযোজন করা হয়। সরকার রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য এ ধারাটি ব্যবহার করতে পারে বলে সুশীলসমাজসহ সচেতন নাগরিক সমাজ তখনই উদ্বেগ প্রকাশ করে। তাদের এ যুক্তির পেছনে এখন একটি জায়মান উদাহরণ হিসেবে বলা হচ্ছে, সাংবাদিক মাহমুদুর রহমান ও মানবাধিকারকর্মী আদিলুর রহমান খানের বিরুদ্ধে এ ধারাটির অপপ্রয়োগ করছে বর্তমান সরকার। অতএব এ ধারাটি ন্যায়বিচার বিঘিœত করছে এবং আগামী দিনেও করবে বলে তাদের প্রবল বিশ্বাস। তাদের অভিমত, এ ধারার অপপ্রয়োগ হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল; অতএব এ ধারাটি বাতিলযোগ্য।
সংশোধিত আলোচ্য আইনে সমালোচনা আছে এর ৫৪, ৫৬, ৫৭ ও ৬১ ধারা নিয়ে। এসব ধারায় উল্লিখিত অপরাধকে জামিন-অযোগ্য অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এ চার ধারার অপরাধগুলোর মধ্যে আছে কম্পিউটার ব্যবহার করে নানা অপরাধ, সিস্টেম হ্যাকিং, সংরক্ষিত সিস্টেমে প্রবেশ ও ইলেকট্রনিক আকারে মিথ্যা, অশ্লীল ও মানহানিকর তথ্য প্রকাশ করা। তবে বিভিন্ন মহলের সবচেয়ে বেশি উদ্বেগ ৫৭ ধারাটি নিয়ে। এ ধারায় বলা আছে, ইলেকট্রনিক মাধ্যমে মিথ্যা, অশ্লীল ও মানহানিকর তথ্য প্রকাশ এ ধারার অপরাধ বলে গণ্য হবে। ইচ্ছে করে ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে মিথ্যা ও অশ্লীল কিছু প্রকাশ করলে এবং এর কারণে মানহানি, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, ব্যক্তি ভাবমূর্তি ক্ষুণœ বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগলে অথবা কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উসকানি দেয়া হলে তা অপরাধ বলে গণ্য হবে। এখানে বর্ণিত অপরাধে অভিযোগ এনে পুলিশ সরকারের অঙ্গুলিহেলনে যেকোনো সময় ভিন্নমতের রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার করে নির্যাতনের শিকারে পরিণত করতে পারবে। এ ধারার অপরাধ জামিনের অযোগ্য হওয়ায় প্রহসনের বিচারের নামে তাকে আটকে রাখতে পারবে মামলা চলা অবস্থায়। এ ধরনের আইন যে মানুষের মৌল অধিকারের পরিপন্থী, তা বুঝতে কারো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
যেকোনো বিবেকবান মানুষই স্বীকার করবেন, এ আইনের ব্যাপারে আমাদেরকে নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে ভেবে দেখা দরকার। বিভিন্ন মহল ২০০৬ সাল থেকেই এ আইনের ব্যাপারে আপত্তি জানিয়ে আসছে। সম্প্রতি আইনটির সংশোধন একে আরো খারাপপর্যায়ে নিয়ে নামানো হলো। কেউ কেউ বলছেন, আজকে এ আইনকে যে পর্যায়ে নামিয়ে আনা হয়েছে, তা সরকারে প্রতিশ্রুত ডিজিটাল বাংলাদেশ বানানো নীতির সম্পূর্ণ বিপরীত। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় কোনো অপরাধেরই সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞায়ন নেই এ আইনে। অতএব, যেকোনো ব্যক্তি যেকোনো সময় কোনো কিছু না জেনেই এ আইনে বর্ণিত কোনো অপরাধে অপরাধী সাব্যস্ত হতো।
গত আগস্টে যখন সরকার তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (সংশোধন) আইন অধ্যাদেশের মাধ্যমে সংশোধনের উদ্যোগ নেয়, তখনই ওএমসিটি (ওয়ার্ল্ড অর্গানাইজেশন অ্যাগেইনস্ট টর্চার) এবং এফআইডিএইচ (ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব হিউম্যান রাইটস) মানবাধিকার সংরক্ষণের পর্যবেক্ষক হিসেবে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্টের কাছে এ অধ্যাদেশ জারি না করার আহ্বান জানান, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (সংশোধন) আইন ২০১৩ অধ্যাদেশ জারি থেকে বিরত থাকতে। এই দুই পর্যবেক্ষক দু’টি উদ্বেগ প্রকাশ করে বলে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা বলে মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার’-এর সেক্রেটারি আদিলুর রহমান খানকে ‘মিথ্যা তথ্য ও ছবি প্রকাশ’ এবং ‘দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর প্রচেষ্টার’ অভিযোগে গত ১০ আগস্ট গ্রেফতার করা হয়। এখন আইসিটি আইন সংশোধন করে যেভাবে বিনা পরোয়ানায় উল্লিখিত অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতারের সুযোগ করে দেয়া হলো, তাতে পুলিশ যখন-তখন যাকে-তাকে গ্রেফতার করে হয়রানি করার ব্যাপারেও প্ররোচিত হবে। এ ছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক হয়রানির সমূহ সম্ভাবনা তো আছেই।
ওএমসিটি সেক্রেটারি জেনারেল জেরাল্ড স্টেবেরক বলেন, নতুন আইন সংশোধন মনে হয় বিশেষত মানবাধিকার কর্মী অধিকার সম্পাদক ও অন্যান্য সদস্যকে টার্গেট করেই করা হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, ‘একটি ডিফ্যাক্টো ইমারজেন্সি’ প্রক্রিয়ায় ইতোমধ্যেই ডাউটফুল ল হিসেবে বিবেচিত এ আইনে নতুন ‘এক্স পেস্ট ফ্যাক্টো প্রভিশন’ যোগ করে জামিনের পথ রোধ করে সংশোধনের কোনো যৌক্তিকতা নেই। এ আইন সংশোধনের অধ্যাদেশ জারির আগে এফআইডিএইচ প্রেসিডেন্ট করিম লাহিকি বাংলাদেশের প্রেসিডেন্টের কাছে আহ্বান জানিয়ে বলেন : mkcÖæblu@gmail.com
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, এ আইনের মাধ্যমে গণমাধ্যম, সংবাদমাধ্যম, মানবাধিকারকর্মী, তথ্যপ্রযুক্তিকর্মীÑ এরা সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। একটি গণতান্ত্রিক দেশে গতান্ত্রিক সরকারের কাছে এ ধরনের আইন কাম্য হতে পারে না। যে কারো মত প্রকাশের বিরুদ্ধে এ আইন প্রয়োগের চেয়ে অপপ্রয়োগের সুযোগ থাকছে বেশি।
আইন ও সালিস কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল বলেছেন, একজন ব্যক্তি দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত তাকে দোষী বলা যাবে না। তাই কোনো অপরাধকে অজামিনযোগ্য করা গ্রহণযোগ্য নয়। অপরাধ অজামিনযোগ্য করলে হিতে বিপরীত হয়। আইনের অপব্যবহার হতে পারে। তাই জামিন আদালতের সন্তুষ্টির ওপর ছেড়ে দেয়া উচিত। তিনি আরো বলেন, আইনের জামিনযোগ্য ধারাগুলো অজামিনযোগ্য করে দিলে মানুষ ভীত হবে। তা ছাড়া এটি ন্যায়বিচারের পরিপন্থী। এর ফলে মত প্রকাশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে।
এ আইন সংশোধন ও এটি সংশোধন করতে গিয়ে প্রথমে তাড়াহুড়ো করে প্রথমে রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ জারি ও এর মাত্র কয়েক দিন পর সংসদে এ অধ্যাদেশ পাস করে তাকে আইনে পরিণত করার এ প্রক্রিয়া করাসহ সংযোজিত নতুন বিধান নিয়ে এখন চার দিকে চলছে নানা বিতর্ক। বিভিন্ন অনলাইন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও কমিউনিটি ব্লগেও চলছে এর আলোচনা-সমালোচনা। এতে একটি বিষয় জোর দিয়ে বলা হচ্ছে, পরোয়ানা ছাড়া পুলিশকে গ্রেফতারের ক্ষমতা দেয়ার আইন কোনো সভ্য দেশে চলতে পারে না।
বিশিষ্ট আইনজীবী ড. কামাল হোসেন এ সম্পর্কে বলেছেন, যে আইনে বাকস্বাধীনতা কিংবা মৌলিক অধিকার খর্বের প্রশ্ন ওঠে, তা অবশ্যই অধ্যাদেশ জারি করে কার্যকর করা উচিত নয়। তিনি বলেন, আইনটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে জারির আগে সংসদে তোলা উচিত ছিল। আইনটি সংশোধনের আগে সংসদীয় স্থায়ী কমিটি যাচাই-বাছাই করে, এর পর সংসদে আরো আলোচনা করে, প্রয়োজনে জনমত যাচাই করে সংশোধন করা উচিত ছিল। তা না করায় এখন আইনের সংশোধন ও অধ্যাদেশ জারির বিষয় নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠছে।
এ আইনে নতুন ধারা সংযোজনের সমালোচনা করে বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেন, আইনে তথ্যের সংজ্ঞায় মিথ্যা, অশ্লীল ও উসকানিমূলক ইত্যাদি বিষয়গুলো সুস্পষ্ট করা হয়নি। আমরা প্রতিনিয়ত ইন্টারনেট ব্যবহার করি। ইন্টারনেটে সত্য ভেবে কোনো তথ্য বিনিময় করা হলে, সে ক্ষেত্রে পুলিশ পরোয়ানা ছাড়াই গ্রেফতার করতে পারবে। এর ফলে ভয়ভীতির কারণে মত প্রকাশের স্বাধীনতা স্বাভাবিকভাবেই সঙ্কুচিত হবে।
তথ্যপ্রযুক্তি আইন সংশোধনের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা হাফিজ উদ্দিন খান বলেন, সংসদ অধিবেশন বসার মাত্র ক’দিন আগে তাড়াহুড়ো করে অধ্যাদেশ জারি করে এ আইন সংশোধনের পেছনে সরকারের কোনো উদ্দেশ্য কাজ করছে, এমন সন্দেহের অবকাশ আছে। আইনটিকে ‘কালাকানুন’ হিসেবে অভিহিত করে তিনি বলেন, পরোয়ানা ছাড়া পুলিশকে গ্রেফতারের ক্ষমতা দেয়া সভ্য দেশে বেমানান। এ ধরনের সংশোধনী কার্যকর হলে সংবিধানে ঘোষিত জনগণের মত প্রকাশের স্বাধীনতা বাধাগ্রস্ত হবে।
দেশের মানুষ আশা করছে, সরকার বাস্তবতা অনুধাবন করে মানবাধিকার বিধ্বংসী কালাকানুনটি নতুন করে পর্যলোচনায় নামবে। সেই সাথে জনগণের চাওয়া-পাওয়ার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে এ আইনের অগ্রহণযোগ্য ধারাগুলোর প্রয়োজনীয় সংশোধন কিংবা বাতিল করার আশু পদক্ষেপ নেবে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন