গত কালের পর - ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার রাম কিশোর জমিদার বাড়ী, কিশোরগঞ্জ জেলার পাকুন্দিয়া উপজেলা জাঙ্গালীয়ার কৃষ্ট বাবুর বাড়ী, কিশোরগঞ্জ সদরের ব্রাহ্মণকচুরীর শ্যাম রায়ের জমিদার বাড়ী, নবাবগঞ্জের জমিদার বাড়ী এবং কিশোরগঞ্জ শহরের বত্রিশ পরামানিক জমিদারের অত্যাচারের কাহিনী শুনলে আজও গা শিউরে ওঠে।
জানা যায়, সময় মতো খাজনা পরিশোধ করতে না পারলে অসহায় প্রজাদেরকে ধরে এনে জমিদার পরামানিকের বাড়ীর টর্চারশেলে মন কাঁটার বেড়াজালে হাঁটানো হত। শিং মাছের গর্তে ছেড়ে দেয়া হলো, বিষ পিঁপড়ার বাক্সে ছেড়ে দেয়াসহ অমানুষিক অত্যাচারসহ প্রজাদের সুন্দরী স্ত্রী ও যুবতী মেয়েদের ধরে এনে পরামানিক আনন্দ উল্লাসে মেতে যেত। এমন কি গর্ভবতী মহিলাদের পেট কেটে বাচ্চা দেখে নাকি মজাবোধ করত। ১৯৪৭ সনের ১৪ আগস্ট তদানীন্তন পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের অব্যবহিত আগে ও পরে এদেশের অত্যাচারী জমিদাররা তাদের ভয়াবহ পরিণতির কথা চিন্তা করে রাতারাতি তদানীন্তন পূর্ব বাংলা ও পরে পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করে ভারতে পাড়ি জমায়।
পাকিস্তানের শোষণ নির্যাতন থেকে মুক্তি পেয়ে ’৭১ সনের ১৬ ডিসেম্বর বিশ্বের মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হলেও আজও জমিদার তন্ত্রের ন্যায় স্বাধীন দেশের প্রশাসনের খপ্পর হতে এদেশের মানুষ সম্যক মুক্তি লাভ করতে পারে নি। তজ্জন্য বিশেষ সময়ের কোন সরকার বা বিশেষ সময়ের প্রশাসনকে দায়ী দোষী না করলেও এর সামগ্রীক দায় দায়িত্ব এ পর্যন্ত আসা যাওয়া সকল সরকারের উপরই নিপতিত হচ্ছে। এ অপবাদ থেকে একে অপরকে দোষারোপ করার সুযোগ অনুপস্থিত।
জেলা উপজেলা পর্যায়ের অনেক অফিসে নামী দামী কর্মকর্তাদের প্রায় সময় পাওয়া গেলেও সচিবালয় থেকে আরম্ভ করে রাজধানী এবং বিভাগীয় শহরের কর্মকর্তাদের সাক্ষাৎ একেবারে আলাদিনের আশ্চর্য্য প্রদীপের সাথে তুলনা করলেও অত্যুক্তি হবে না। এ সমস্ত অফিসগুলোতে প্রায় সময় দেখা যায় সরকারি জরুরী কাজের অজুহাত দেখিয়ে বিরতিহীনভাবে লাল বাতি সংকেত এবং অফিসের দরজায় পিয়ন চাপরাশীর সার্বক্ষণিক পাহারা বসিয়ে তল্পিবাহক হিসেবে চিহ্নিত কিছু মোসাহেবদের নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা খোশগল্পের মজমা, হাসি তামাশা, কে সাহেবের বিরুদ্ধে কে সাহেবের পক্ষে ঢালাও ভাবে ভাল-মন্দের সার্টিফিকেট, প্রভুতোষণ, মোসাহেবী, জি স্যার, ইয়েস স্যার, ওকে স্যার, আপনি মহামানব স্যার, বাসার ম্যাডাম খুব ভাল স্যার ইত্যাদি তোষামোদ মার্কা গোলাম আলীর জি হুজুর নাটক, চা চক্র এবং প্রায় সময় নামীদামী হোটেলের লাঞ্চ প্যাকেটের মধ্য দিয়ে বিরতিহীন লাল বাতির জরুরী সরকারি কাজ সমাপ্তি হয়। তবে অনেক সময়ে দর্শনার্থী মহিলা সাক্ষাতে আসলে লালবাতি সংকেত থেকেই যায়।
নিরপেক্ষ বিচার বিশ্লেষণ যাচাই বাছাই ও তুলনা করলে দেখা যায় ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজদের চেয়ে কোন ভাবে লাল বাতি নাটকের কর্মকর্তা এবং মোসাহেবরা কম দোষে দোষী নহে। প্রকারান্তরালে তাহারাই ঘুষখোর দুর্নীতিবাজদের ধারক, বাহক-সহায়ক, প্রশ্রয়দাতা ও নেপথ্য নায়ক। তদুপরি তারাই আবার পর্দার অন্তরালে বিশেষ কোন রাজনৈতিক দলের নাটের গুরু, লজিষ্টিক সাপোর্টার ও রূপকার। অপরদিকে ন্যায় নিষ্ঠাবান, সৎ, কর্মঠ, নির্লোভ, আদর্শবান অগণিত কর্মকর্তা, কর্মচারী বড় সাহেব ও মোসাহেব নামীয় সিন্ডিকেটের রোষানলে পড়ে বছরের পর বছর পদোন্নতি বঞ্চিত হয়ে নির্বাক অসহায় ও প্রতিবন্ধীর ন্যায় অসহ্য জ্বালা-যন্ত্রনা নিয়ে টিকে আছে। তাদের অবস্থা দেখে মনে হয়, কেটে গেছে রক্ত বেরুচ্ছে না। অসহ্য ব্যথায় ভুগছে তবে চিৎকার করতে পারছে না।
সম্প্রতি একজন অভিজ্ঞজনের মন্তব্য থেকে জানা যায়, চাকরিজীবীদের পদোন্নতির ব্যাপারে সকল সময়ের সরকার উদার মনমানসিকতার অধিকারী হলেও চাকরিজীবীদের মধ্যে প্রভাবশালী কিছু কর্মকর্তার কারণে অনেক সময় পদোন্নতির প্রেক্ষাপট নাকি এলোমেলো হয়ে যায়।
তথ্য সূত্রে দেখা যায়, অনেক সিনিয়রকে ডিঙিয়ে অধঃস্তন, যুগ্ম সচিবের মর্যাদায় পদোন্নতি লাভ করলেও সিনিয়র ব্যাচের অনেকেই বছরের পর বছর উপসচিবই রয়ে গেছেন। ১৮ জুলাই ১৩ ইং ৩৪৫ জন কর্মকর্তার পদোন্নতি দেয়া হয়। এ সময় পদোন্নতির বাইরে থেকে যায় ৮২ বিশেষ ব্যাচের ২২ জন, ৮৪ ব্যাচের ১০১ জন, ৮৫ ব্যাচের ১৭৬ জন, ৮৬ ব্যাচের ২০ জন। ১০ সেপ্টেম্বর ১৩ ইং ৭২ জনকে পদোন্নতি দেয়া হলেও প্রশাসন ক্যাডারের ৮২ ব্যাচের ৩ জন, ৮৪ ব্যাচের ১৫ জন, ৮৫ ব্যাচের ২৫ জন ও ৮৬ ব্যাচের ২০ জন। পদোন্নতির বাইরে থেকে গেছে ৮২ ব্যাচের ১৯ জন, ৮৪ ব্যাচের ৮৭ জন, ৮৫ ব্যাচের ১৫২ জন ও ৮৬ ব্যাচের ৭৩ জন সহ মোট ৩৩১ জন। এ প্রসঙ্গে আরও একজন অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা বলেছেন, আমাদের প্রশাসনিক ব্যবস্থা অনেকটাই আত্মবন্দী (স্ট্রাকচারাল ইন্টার লকিং)। এ আত্ম নাকি বন্দীত্বের অভিশাপ থেকে মুক্ত হওয়া খুব একটা সহজ কাজ নয়। এর জন্য প্রয়োজন নিজেদের মধ্যে সমন্বয় ও আত্মশুদ্ধি। এটাও ডিফিকাল্ট। স্বাধীনতার এত বছর পরও গণমুখী প্রশাসন গড়ে তুলতে সার্ভিস এ্যাক্ট প্রণয়ন করার কথা থাকলেও প্রশাসনে রাজনৈতিক অভিলাষে এ পর্যন্ত এ প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়ে আসছে। এ পর্যন্ত প্রশাসন চলছে বিধি দিয়ে অথচ সিভিল সার্ভিস এ্যাক্ট রচিত হলে আইনগত বিধি বিধান মতেই প্রশাসন পরিচালিত হতো। তখন হয়তো অনেক সমস্যার সমাধান এমনিতেই হয়ে যেত।
যাক, স্বাধীনতার এত বছর গত হলেও এখনো যাদের শুভবুদ্ধির উদয় হয়নি, কবে হবে তা অনিশ্চিত না ভেবে এতটুকুই বলব, বৃটিশের শোষণ, পাকিস্তানিদের শোষণ এবং জমিদার তন্ত্রের কালো ছায়ায় ব্র্যাকেটে বন্দি করে যেভাবে প্রশাসন চলছে, তা কোনমতেই একটি স্বাধীন সার্বভৌম ও গণতান্ত্রিক দেশের জন্য খুবই অসুন্দর, অশুভ ও অনাকাক্সিক্ষত। হাবভাব দেখে মনে হয় আজও দেশের কর্মকর্তাদের আমলাতান্ত্রিক মনোভাব পরিবর্তন হয়নি। এর জন্য শুধু তাদের প্রশাসনিক একাডেমিক শিক্ষার চেয়ে প্রয়োজন মনমানসিকতার পরিবর্তন, জাতীয়তাবোধ, দেশ প্রেম ও রাজনৈতিক বিমুখ মনমানসিকতা।
যতদিন প্রশাসনে আমলাতান্ত্রিক মনমানসিকতার পরিবর্তন না আসবে, ততদিন দেশের জনগণ এমনিভাবেই জমিদার তন্ত্রের কালো ছায়ার মতো প্রশাসনের লাল বাতি সংকেতের মধ্যেই ঘুরপাক খেতেই হবে। যদি আত্মোপলব্ধি থেকে কোন দিন এত সব কিছুর উত্তরণ ঘটিয়ে যদি কেহ বলে উঠে, প্রভু মোরে ক্ষমা কর, দেখিয়া, জানিয়া, শুনিয়াও করিতে পারি নাই প্রতিকার। এতেই আত্মস্থ, তাতেই স্বার্থকতা।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন