১.
পরিস্থিতি ঘুমন্ত অগ্নিগিরিসম। সর্বত্র টান টান উত্তেজনা। শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা। একদিকে দুই রাজনৈতিক শিবিরের পৃথক দুই প্রস্তাব আর অন্যদিকে গণতান্ত্রিক তৎপরতার বিরুদ্ধে সরকারের জরুরি অবস্থার মতো শক্তি প্রয়োগ ও কঠোর সতর্কতা। সবাই উদ্বিগ্ন হয়ে ভাবছে, ২৫ অক্টোবরের পর কি হবে? সমাধান কি আলোচনার বদলে আন্দোলনের পথেই নির্ধারিত হবে? রাজনীতির ফাইনাল খেলা কি শুরু হয়ে গেছে?
বর্তমান সরকারের মেয়াদান্তে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং প্রধান বিরোধী দলের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া রাজনৈতিক সমস্যা ও সঙ্কট সমাধানে পৃথক দুটি প্রস্তাব পেশ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সর্বদলীয় সরকার গঠন করে সকলের অংশ গ্রহণে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি পুনর্ব্যক্ত করে ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালে নির্দলীয় সরকারের উপদেষ্টাদের মধ্য থেকে সরকার ও বিরোধী পক্ষে ৫ জন করে উপদেষ্টার মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করে নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রস্তাব দিয়েছেন। উভয় বক্তব্য রাজনৈতিক মহলে সাড়া জাগিয়েছে। তবে প্রতিক্রিয়া অভিন্ন হয় নি। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণকে সরকার সমর্থকরা বলেছেন, সমঝোতার প্রতিচ্ছবি। বিরোধীরা বলেছেন, অস্পষ্ট। প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে হাল আমলে কোনও ব্যাপারেই একমত বা ঐকমত্য সৃষ্টির নজির না থাকার প্রেক্ষাপটে ভাষণ দুটিকে কেন্দ্র করে সরকার ও বিরোধী মহলে একতার সৃষ্টি হতে পারেনি। বাস্তবতা হলো, প্রধান বিরোধী দল ভাষণকে প্রত্যাখ্যান করেছে। প্রধানমন্ত্রী ভাষণ বিরোধী শিবিরে বিশ্বাস ও আস্থা সৃষ্টি করতে পারেনি। বরং বেগম খালেদা জিয়া এখন ‘হটাও আওয়ামী লীগ, বাঁচাও দেশ’ স্লোগানে সবাইকে একত্র হতে আহ্বান জানিয়েছেন।
কোনও সমস্যার সমাধান ও সমঝোতায় আস্থা ও বিশ্বাস গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। বাংলাদেশে এখন এই দুটি বিষয়েরই তীব্র অভাব। প্রধানত শাসক দল সম্পর্কে জনমনে আস্থা ও বিশ্বাসের অভাব সীমাহীন। আস্থা ও বিশ্বাসের সঙ্কটের সঙ্গে সঙ্গে সরকার ভীতির জন্ম দিয়েছে। এমন অবস্থায় আলোচনা ও সংলাপের মাধ্যমে সঙ্কটের সমাধান সুদূরপরাহত। যদিও বিরোধী দলের পক্ষ থেকে পাল্টা প্রস্তাব এসেছে তথাপি সরকারের শক্তি প্রয়োগ নীতি পরিস্থিতিকে জটিল করেছে। সঙ্কট এখনও ঘনীভূত হয়ে রয়েছে। যদিও প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে সাড়া দিয়ে এরশাদের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টির ১৪ সদস্য গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা ও নৈশভোজ করেছে, তথাপি এতে কোনও কোনও দল নির্বাচনে যেতে পারে, এমন ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু প্রধান বিরোধী দল ও জোটের অংশগ্রহণ ছাড়া খোদ নির্বাচনই এখনও অনিশ্চিত। তদুপরি বর্তমান সরকারের মেয়াদান্তে ২৫ অক্টোবর সমাবেশ-পাল্টা সমাবেশের উত্তেজনায় দেশময় টানটান পরিস্থিতি বিরাজমান। বাস্তবের ময়দান ভাষণে শান্ত হয়েছে বলা যাচ্ছে না। বরং অশান্তি সুপ্ত হয়ে রয়েছে। এমন উদ্বেগজনক পরিস্থিতিতে একটি সামান্য স্ফূলিঙ্গই ভয়াবহ দাবানলের সৃষ্টি করতে পারে। বাংলাদেশকে বর্তমানে ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরির সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে। যে কোনও সময় বিস্ফোরণের আশঙ্কা করা হচ্ছে। গণতান্ত্রিক ধারা ও সাধারণ জন-জীবনের জন্য এমন পরিস্থিতি কাম্য নয়; বিপদের কারণ। এমন বিপদ বাংলাদেশের রাজনীতিতে বার বার এসেছে। বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হয় তখনও অনেকে চিন্তিত ছিলেন। তবে সে সময়ে চিন্তার কারণ ছিল ভিন্ন। স্বাধীনতার প্রাথমিক পর্বে তৎকালীন নতুন দেশ অরাজকতায় অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত ছিল। স্বাধীনতার ৪২ বছরের ব্যবধানে দারিদ্র্যপীড়িত, সঙ্কটাপন্ন ভঙ্গুর অর্থনীতির কিছুটা অগ্রগতি দৃশ্যমান হয়েছে। কিন্তু নানা কারণে, গুয়ার্তুমিতে, চক্রান্তে ও হটকারিতায় রাজনীতি রয়ে গেছে তুলনামূলক অনগ্রসর। বিষয়টি আরও মূর্ত হয়ে উঠেছে এই জন্য যে, তিন-তিনবারÑ১৯৯০, ১৯৯৬, ২০০৮Ñরাজনীতি বাধাহত হয়েছে। যদিও শেষ পর্যন্ত দেশ ও জাতি গণতন্ত্রের দিকেই চলেছে। কিন্তু বর্তমানে রাজনীতি গভীরতর সঙ্কটের সম্মুখীন হয়ে জন্ম দিয়েছে প্রবল অনিশ্চয়তার। ২৫ অক্টোবরের পর সেই শঙ্কার বিস্ফোরণ কিভাবে হয়, সেটা ভেবে দেশ-বিদেশের অনেকেই মহা-উদ্বিগ্ন। পুরো দেশ, বিশেষত গণতন্ত্র যেন একটি ঘুমন্ত অগ্নিগিরিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে। এমন আগুনের আশঙ্কাময় শঙ্কার মধ্যে বাংলাদেশ আগে কখনও নিপতিত হয়নি। রাজনৈতিক শক্তি চূড়ান্তভাবে বিভাজিত হয়ে গেছে। বাংলাদেশের বর্তমান চরম সঙ্কুল রাজনৈতিক পরিস্থিতি দেশ ও জনগণের মতো রাজনীতিবিদগণকেও চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করেছে। তারা পরিশেষে সঙ্কটের সমাধান করে দেশবাসীকে শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি থেকে মুক্ত করে গণতান্ত্রিক প্রবাহকে অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে কাজ করবেন বলেই সকলে আশা করেন। প্রসঙ্গত স্মরণ করা যায় বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জে. এফ, ক্লার্কের একটি ঐতিহাসিক উক্তি: “অ্যা পলিটিশিয়ান থিঙ্কস অব দ্য নেক্সট ইলেকশন, অ্যা স্টেটসম্যান থিঙ্কস অব দ্য নেক্সট জেনারেশন। অ্যা পলিটিশিয়ান ওয়ার্কস ফর পার্টি, অ্যা স্টেটসম্যান ওয়ার্কস ফর কান্ট্রি। দ্য স্টেটসম্যান ইউশেস টু স্টিয়ার, হোয়াইল দ্য পলিটিশিয়ান ইজ স্যাটিসফায়েড টু ড্রফট।” [একজন রাজনীতিবিদ নিছক পরবর্তী নির্বাচনের চিন্তায় ব্যস্ত, একজন রাষ্ট্রনেতা চিন্তা করেন পরবর্তী প্রজন্মের কথা। একজন রাজনীতিবিদ তার দলের জন্য কাজ করেন, একজন রাষ্ট্রনেতা কাজ কেেরন পুরো দেশের কল্যাণের জন্য। রাষ্ট্রনেতা জাতিকে পরিচালিত করেন আর রাজনীতিবিদ স্রোতের টানে সুবিধামতো গা ভাসিয়ে চলেন।] অতীত নেতৃত্ব যেমন, শেরে বাংলা, সোহরাওয়ার্দী, ভাসানী, মুজিব, জিয়া কেবল রাজনীতিবিদ নন, রাষ্ট্রনেতা; জাতির সঙ্কট সমাধানে, ঐক্যের বিস্তারে, গণতন্ত্রের বিকাশে, সরকার পরিচালনায় দেশ-জাতি-মানুষের কথাই ভেবেছেন। তাদের কারও কারও রক্ত ও বংশ ঐতিহ্য বা দলের অস্তিত্ব না থাকলেও ইতিহাসে মর্যাদা আছে। বর্তমান চরম সঙ্কট ও অনিশ্চয়তায় শান্তি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে প্রকৃত গণতন্ত্রের ধারা বজায়ে বর্তমানেও শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়ার মতো জাতীয় নেতৃত্বের ভূমিকা ও অবদান সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবের সঙ্গে বিরোধী দলের প্রস্তাব সমন্বয় করে এখন বাংলাদেশে গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার এবং মানুষের ভোটের অধিকারকে বিজয়ী করার কাজটিই করতে হবে। সর্ব শক্তি নিয়োগ করে একদলীয় বা স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের পুনরাবৃত্তি প্রতিরোধ করতে হবে। কিন্তু সরকারের চরম নীতি কি সংলাপ বা সমঝোতায় বিরোধী পক্ষকে টানতে পারবে? আস্থা ও বিশ্বাস কি এভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে? নাকি দমন-নির্যাতনের বিরুদ্ধে গণরোষ জেগে উঠবে? ২৫ অক্টোবরকে ঘিরে এখন এমনই সব জল্পনা-কল্পনায় বাতাস ভারি হয়ে আছে।
২.
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ২৫ অক্টোবর একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ দিন হিসাবে সমগ্র জাতি এবং বিশ্ববাসীর সামনে উপস্থিত হয়েছে। এদিন শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকার তার শাসন মেয়াদ শেষ করছে বটে; কিন্তু রেখে যাচ্ছে চরম অনিশ্চয়তা। যে সঙ্কট মহাজোটের নামে আওয়ামী শাসনে রোপিত হয়েছিল, সেটা এখন বিষবৃক্ষে পরিণত হয়েছে। পুরো শাসনামলে গণতন্ত্র, আইনের শাসন, মানবাধিকার, শিষ্টতাকে পদদলিত করার পর এখন নিয়মতান্ত্রিক-সাংবিধানিক পন্থায় শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতার পালাবদলকে সংঘাতময় করে ফেলা হয়েছে। বিরোধী দলের ভাষায়, সুষ্ঠু জনমতের প্রতিফলনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের প্রতিষ্ঠিত বিধানকে তুলে দিয়ে তারা এখন মেয়াদান্তেও ক্ষমতায় থাকতে চাচ্ছে। যে কারণে শাসনের বৈধতার তীব্রতম সঙ্কটও সৃষ্টি হয়েছে। ফলে সরকারের বাইরের বৃহত্তর জনতাকে এ কারণেই গণতন্ত্রের পথে অভিযাত্রার সূচনা করতে হচ্ছে। চলমান আন্দোলনকে দিতে হচ্ছে নতুন গতিবেগ। যার ফলশ্রুতিতেই উত্থাপিত হয়েছে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিরোধী জোটের বিকল্প প্রস্তাব ও আন্দোলন কর্মসূচি।
সরকার যদি আরও আগে বিরোধী দলের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ নির্বাচন প্রসঙ্গে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা, সংলাপ ও সমঝোতার চেষ্টা করত, তাহলে জনদুশ্চিন্তার কারণ ঘটতো না। ২৫ অক্টোবরের পর থেকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে প্রায়-সকলকেই গভীরভাবে চিন্তিত হতে হতো না। এই জন-দুশ্চিন্তা একদিনে তৈরি হয়নি। বিগত শাসনের স্বৈর-একদলীয়-প্রতিপক্ষ নির্মূলকামী চরিত্রের কারণেই তৈরি হয়েছে। সংলাপ-সমঝোতা-আলোচনার প্রতিটি দরজা-জানালা বন্ধ করে দিয়ে প্রতিপক্ষকে আইন ও শাসনের আওতায় নির্মূল করে দেবার প্রবণতার সঙ্গে যখন স্বৈর সাংবিধানিকতা যুক্ত করা হয়, তখন গণআন্দোলন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সঙ্গে সঙ্গে স্বৈর শাসনেরও তীব্র বিরোধিতা করতে থাকে। এই অবস্থায় শান্তিকামী গণতান্ত্রিক জনতা গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা ক্ষুণœ হওয়াসহ সুশাসনের প্রচ- অভাবজনিত পরিস্থিতিতে প্রায়-একদলীয় শাসনের কঠোর নিষ্পেষণের শেষে এর বর্তমান কুপ্রভাবের কারণে আকণ্ঠ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। এই পরিস্থিতিতেই স্বৈর শাসন, সাংবিধানিক বিকৃতি, আইনের শাসনের নামে প্রতিপক্ষ নিধনমূলক অপপ্রয়োগ, ভোটের অধিকারকে ছিনিয়ে নেওয়ার বিরুদ্ধে গণআন্দোলনের নবজন্মের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশে আইনের শাসন, গণতান্ত্রিক ধারা, বিশুদ্ধ সাংবিধানিক রীতি ও অবাধ ভোটাধিকারে প্রশ্নে ২৫ অক্টোবর গণতন্ত্রের পথে গণআন্দোলন নবতর মাত্রা লাভ করেছে এবং একে ফাইনাল রাউন্ড বলে উল্লেখ করেছে মিডিয়া ও বিশ্লেষকগণ।
বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হয় তখনও অনেকে চিন্তিত ছিলেন। তবে সে সময়ে চিন্তার কারণ ছিল ভিন্ন। স্বাধীনতার প্রাথমিক পর্বে তৎকালীন আওয়ামী লীগের নানা কুশাসন, ক্ষমতাসীন দল ও ভারতীয় বাহিনীর লুট-তরাজ ও দুনীতির জন্য মানুষের দুশ্চিন্তা ছিল মূলত ব্যক্তি নিরাপত্তা, মৌলিক অধিকার, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎকে ঘিরে। কিন্তু শেখ মুজিব তখন নানা সীমাবদ্ধতা নিয়েও রাষ্ট্রের সকল নাগরিকদের এক কাতারে শামিল করে অর্থনৈতিকভাবে ডুবতে বসা দেশটিকে বাঁচানোর শেষ চেষ্টা করেছিলেন। বাস্তবতাকে প্রাধান্য দিয়ে তিনি দেশি ও বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীদের প্ররোচনায় স্বাধীনতার পক্ষ ও বিপক্ষ বলে কোনও হিংসাত্মক বিভাজন তৈরি করেননি। তিনি সমগ্র জাতির নেতা হতে চেয়েছিলেন এবং একদলীয় আওয়ামী-বাকশালী শাসনের অন্ধকার যুগকে বাদ দিলে নানা সাফল্য ও ব্যর্থতার মধ্যেও তিনি সব সময় জাতির নেতার মতোই কাজ করতে চেষ্টা করে গেছেন। বর্তমান আওয়ামী লীগ নিকৃষ্ট পন্থায় শেখ মুজিবের ঠিক উল্টো পথে হেঁঁটে পুরো জাতিকে এবং গণতান্ত্রিক-সাংবিধানিক-আইনগত কাঠামোকে তছনছ করে দিয়েছে। ফলে আজকের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তা স্বাধীনতা-পরবর্তীকালের চিন্তার চেয়ে মারাত্মক, সুগভীর ও সুদূরপ্রসারী।
স্বাধীনতার পরবর্তীতে আওয়ামী শাসনের দুঃখজনক বিদায়ান্তে স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ প্রেসিডেন্ট এবং মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেনানায়ক জিয়াউর রহমান মুক্তিকামী-দেশপ্রেমিক সমগ্র জনগোষ্ঠীকে একতাবদ্ধ করে পুরো দেশকে অভিন্ন জাতিসত্ত্বার ইসলামী মূল্যবোধ ও বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের চেতনা-বন্ধনে দৃঢ়তর করেছিলেন। ফলে স্বাধীনতার ৪২ বছরের ব্যবধানে দারিদ্র্যপীড়িত, সঙ্কটাপন্ন ভঙ্গুর অর্থনীতির কিছুটা অগ্রগতি দৃশ্যমান হয়েছে। কিন্তু নানা অদূরদর্শিতায় রাজনীতি রয়ে গেছে একদলীয় ও অনগ্রসর। কিন্তু জনতার তীব্র দাবিতে দেশ গণতন্ত্রের দিকেই শেষতক চলেছে। তবে বর্তমানে রাজনীতি গভীরতর সঙ্কটের সম্মুখীন হয়ে জন্ম দিয়েছে প্রবল অনিশ্চয়তার। একদলীয় ও স্বৈরতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতায় থাকার নেশায় ভেসে যাচ্ছে জনইচ্ছা। ২৫ অক্টোবরের পর জনক্ষোভের বিস্ফোরণ অবশ্যম্ভাবী বলেছেন পর্যবেক্ষকগণ।
৩.
ইতিহাস থেকে সকলেই জানেন যে, আইয়ুব খান অখ- পাকিস্তানে সামরিক শাসন ও স্বৈরতন্ত্র কায়েমের জন্য ঐতিহাসিকভাবে নিন্দিত একজন শাসক। কিন্তু তিনিও সাথে একটি সংবিধান ও লেজুড় দল রেখেছিলেন। সেটা ছিল প্রেসিডেন্টের চরম ক্ষমতার দলিল। সংবিধান ছিল বলেই আইয়ুব গণতান্ত্রিক হয়ে যায়নি। হিটলার বিপুল ভোটে সংবিধান সম্মতভাবে বিজয়ী একজন নেতা ছিলেন। জার্মান জাতির মেধা ও মনন দিয়ে তৈরি একটি চমৎকার সংবিধান তার ক্ষমতার পেছনে ছিল। কিন্তু তাকে কেউ সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেয় না। এদেশে নয় বছরের স্বৈরশাসক এরশাদের সময়েও সংবিধান ছিল। কিন্তু সেটা তাকে গণতান্ত্রিক চরিত্রের শাসকের মর্যাদা দিতে পারেনি। ঐতিহাসিকভাবেই এরশাদ একজন স্বৈর শাসক এবং শিল্পী কামরুল হাসানের দেওয়া উপাধি ‘বিশ্ব বেহায়া’ রূপে নিন্দিত। অর্থাৎ সংবিধান হাতে থাকলেই কেউ স্বৈর শাসক থেকে গণতান্ত্রিক হয়ে যায় না। সংবিধানকে স্বৈর চরিত্র দেয়া হলে এবং দলকে চরম শক্তিধর করা হলে বরং গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত শাসকও স্বৈর শাসকে রূপান্তরিত হয়।
বর্তমান সরকার হাতে একটি সংবিধান নিয়ে ২৫ অক্টোবরের পরেও ক্ষমতায় থাকতে চাচ্ছে। প্রধান বিরোধী দল অংশ নেয়নি, এমন পরিস্থিতিতে তারা সেই সংবিধানকে নিজেদের শাসনের উপযুক্ত করে পরিবর্তিত করেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করেছে, তাদের দলীয় নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বে নির্বাচনের ব্যবস্থা রেখেছে এবং মেয়াদ শেষেও তারা ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকতে চাচ্ছে।। এমন কয়েকটি মৌলিক পরিবর্তন করা হয়েছে স্বৈরাচারী কায়দায় একতরফাভাবে এবং তড়িঘড়ি করে। বিরোধী তো বটেই, জনগণের কোন মতামত বা ম্যান্ডেট এই বিরাট পরিবর্তনের সময় নেয়া হয়নি। সংবিধানকে বার বার নিজেদের মতো পরিবর্তন ও অপব্যবহার করার ইতিহাসের সূচনাকারী আওয়ামী লীগ যেভাবে গণতন্ত্রকে হত্যা করে কয়েক মিনিটে বাকশাল কায়েম করেছিল; তেমনি কয়েক মিনিটে জনগণের ভোটের নিরপেক্ষ প্রয়োগের অধিকারকে বানচাল করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বদলে অত্যন্ত আপত্তিকর ও অনিয়মতান্ত্রিকভাবে দলীয় সরকারের নির্বাচনকালীন কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। এই পরিবর্তন দেশের প্রধান বিরোধী দল এবং অধিকাংশ মানুষ মেনে না নেওয়ায় এর বৈধতার প্রশ্নটি সামনে চলে এসেছে। গণতন্ত্র ও আইন-সংবিধানসম্মত শাসনের দাবিতে আন্দোলনকারীরা এই প্রক্রিয়াকে অবৈধ বলে চিহ্নিত করে গণআন্দোলন আরও তীব্রভাবে শুরু করেছে। ফলে ২৫ অক্টোবরের পর আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় থাকাটা একটি প্রশ্নবিদ্ধ বিষয়। বৈধতা ও নৈতিকতার প্রশ্নে আপত্তিকর এবং আইনের চোখে সর্বাংশে সিদ্ধ নয়, এমন একটি দলীয় স্বার্থবাদী কাজ। বিশিষ্টজনদের অভিমতে এমন মনোভাবই ফুটে উঠেছে।
৪.
এমন সঙ্কুল পরিস্থিতিতেও কেউ কেউ আস্ফালন করছেন। কিন্তু গণতন্ত্রের পথে জনতার অভিযাত্রার সামনে সেগুলো অক্ষমের অভিলাষ ছাড়া আর কিছুই নয়। ‘‘রোজ কেয়ামত হলেও নির্বাচন হবে’’ বলে আওয়ামী লীগের সভাপতি-ম-লীর সদস্য মোহাম্মদ নাসিমের বক্তব্যের সঙ্গে আক্ষরিকভাবে তাই একমত হওয়ার অবকাশ কারও নেই। তবে তাঁর এ বক্তব্যের মর্মবস্তু বুঝতে কারও অসুবিধা হয় না; সরকারি দল বিরোধী দলের সঙ্গে কোনো রকম আপসের কথা বিবেচনা করবে না, যেভাবেই হোক নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে সরকারি দলের নেতারা, বিশেষত প্রধানমন্ত্রী সংকল্পবদ্ধ। অন্যদিকে বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়া বলেছেন যে তাঁরা নির্বাচন প্রতিহত করবেন। এসব বক্তব্যের পাশাপাশি রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি, ২৫ অক্টোবরের পর সরকারের কাজ দৈনন্দিন দায়িত্বের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। এই প্রেক্ষাপটে অনেকের মনেই প্রশ্ন, ২৫ অক্টোবরের পর পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে?’’ বিরোধী দলও ২৫ অক্টোবরের পর তাদের শক্তির প্রমাণ দেবে মর্মে হুঙ্কার দিচ্ছে।
এদিকে, বৃটেনের ফিনান্সিয়াল টাইমস এ প্রকাশিত ‘ফ্ল্যাউড ওয়ার ক্রাইমস ট্রায়াল পুশ বাংলাদেশ টু দ্যা এ্যাজ’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে: ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশের পরিচিত ছিল ক্ষুধা, দারিদ্র্য এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের জন্য। কিন্তু শেষ দুই দশকে সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করে। এইসময়ে অপুষ্টি, শিশু মৃত্যুর হার এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমেছে, বেড়েছে সাক্ষরতা এবং জীবনযাত্রার মান। এইসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশ তার বৃহৎ প্রতিবেশি ভারতকে ছাড়িয়ে গেছে। এতে বলা হয়েছে, ১৫ কোটি জনসংখ্যার মুসলিম দেশ বাংলাদেশ- চীন এবং ইতালির সঙ্গে বিশ্বের বৃহৎ গার্মেন্ট পন্য রফতানিকারক দেশ। যদিও গার্মেন্ট কারখানায় আগুন এবং ভবন ধসের ঘটনায় এক্ষেত্রে বাংলাদেশের খ্যাতি নষ্ট হয়েছে। ভবন ধসের ঘটনায় এক হাজারেরও বেশি শ্রমিক মারা যায়। যদিও রাজনীতির কারণে বাংলাদেশের অর্জন আজ হুমকির মুখে। বিশেষত বিরোধীদের দমনে, তাদের ফাঁসি দিতে শেখ হাসিনা এবং তার দল আওয়ামী লীগের সংকল্পের কারণে বাংলাদেশে অর্জন হুমকির মুখে পড়েছে। ট্রাইব্যুনাল তার বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। সন্দেহ নেই, সর্বত্র প্রশ্ন আর সংশয়। বাংলাদেশে চলমান সব কিছু দেখে-শুনে কি কেউ বলতে পারবে পুরো পরিস্থিতি ও বিচিত্র ঘটনা প্রবাহ কিসের ইঙ্গিত দিচ্ছে? মানুষ ও সমাজকে আসলে কোন দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে? আসলে কি হবে ২৫ অক্টোবরের পর? অর্থাৎ সংঘাত, সমঝোতার কথা বলতে বলতে সকলেই মুখে ফেনা তুলে ফেললেও সেটা হয়নি। এমন কি, সঙ্কট সম্পর্কে দায়িত্বপূর্ণ কথা-বার্তা বা সংলাপ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হতে পারেনি ব্যক্তি বিশেষের একগুঁয়েমির কারণে। পরিণামে আমরা সর্বনাশের দ্বারপ্রান্তে এসে উপস্থিত হয়েছি। এখন ২৫ অক্টোবরকে দিন ধার্য্য করে ক্ষমতার দড়ি টানাটানির অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির সামনে সমগ্র জাতিকে টেনে এনে ফেলে দেওয়া হয়েছে। সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা, শান্তিপূর্ণ ক্ষমতার পালাবদল, সুশীল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার নিয়মতান্ত্রিক পথচলা সর্বনাশা ক্ষমতার লোভ ও মোহের কারণে কোথায় গিয়ে পৌঁছায়, ক্ষমতাসীনরা ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে আর কি কি করে, সেটা ২৫ অক্টোবরের পরেই স্পষ্টভাবে দেখা যাবে এবং জানা যাবে। সেই জানাটা গণতন্ত্রমনা জনতার জন্য সুখকর না দুঃখজনক হবে, সেটা নিয়েও ভরপুর আশঙ্কা বিদ্যমান। প্রসঙ্গত সর্বনাশ নিয়ে একটি আপ্ত বাক্য স্মরণ করা যেতে পারে। সুপ্রাচীন প-িত বিষ্ণুশর্মা বলেছিলেন, ‘সর্বনাশ সমুৎপন্ন হলে অর্ধেক ত্যাগ করে বাকি অর্ধেক রক্ষা করতে হয়।’ সিংহের সেজোমামার আধখানা কুমিরে খেয়ে ফেললে বাকি আধখানা মরে যায়। অর্থাৎ কথা, কর্ম, নীতি, পদ্ধতি এবং আচরণ যথাযথ হওয়াই গণতন্ত্রে সমান আবশ্যক। সিংহের মামা সেজে গণতন্ত্র চালানো যায় না। এ কথা সকলেই সমানভাবে অনুধাবণ করেন না। যেমন, সপ্তদশ শতকে ফরাসি স¤্রাট চতুর্দশ লুই বলেছিলেন ‘আমিই রাষ্ট্র’। বাংলাদেশের ক্ষমতায় উপবিষ্ট রাজনীতিবিদগণের বোঝা দরকার, লুইয়ের কথার পর চারশ’ বছর অতিক্রান্ত হয়ে এখন একবিংশ শতাব্দী। বিলবোর্ডে বিজ্ঞাপন দিয়ে নেতারা গণতান্ত্রিক মানসিকতা জাহির করেছেন। এবার সর্বনাশ ঠেকিয়ে গণতান্ত্রিকতার প্রমাণ দিলেই মানুষ খুশি হবে; জাতিও উদ্ধার পাবে।
৫.
ক্ষমতার বৃত্তে আবদ্ধ এবং দম্ভে অন্ধ হয়ে ন্যায়ানুগ সুশাসন ও গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে, মানুষের আইন সঙ্গত অধিকার ও বাক-ব্যক্তি-সংবাদপত্রের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে, ন্যায়সঙ্গত সুবিচারের বিরুদ্ধে, প্রতিপক্ষ দল ও নেত্রীবৃন্দের বিরুদ্ধে, পবিত্র ইসলাম ধর্ম এবং মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিরুদ্ধে, ইসলামপন্থী ও আলেম সমাজের বিরুদ্ধে এবং সর্বপরি দেশপ্রেমিক-গণতান্ত্রিক জনতার বিরুদ্ধে গিয়ে একটি বিশেষ দেশ ও গোষ্ঠীর কাছে জাতীয় সম্পদ ও স্বার্থ বিলিয়ে দিলে দেশ ও জাতির অপরিসীম ক্ষতি করা হয়, দেশ ও মানুষের স্বার্থ উদ্ধার করা হয় না। এবং ক্ষমতার দাপট ও রক্তচক্ষু নয়, জনগণের স্বার্থ রক্ষা ও ইচ্ছাই গণতন্ত্রে শেষ কথা। ইতিহাস কান পেতে আছে জন-কণ্ঠস্বরের গণতান্ত্রিক বজ্র-নিনাদে উচ্চকিত ঐতিহাসিক রায় শোনার জন্য।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন