গত মে মাসে সরকার ও বিরোধী দলের সমঝোতার মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উদ্যোগে একটি সুষ্ঠু ও চমৎকার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল পাকিস্তানে। নির্বাচন সম্পর্কে কারো কোনো অভিযোগ নেই। সকল দল সামাজিক সংগঠন, সুশীল সমাজ এবং সাধারণ মানুষও খুশী। এক্ষেত্রে বাংলাদেশই পাকিস্তানের মডেল।
পাকিস্তানের দেখাদেখি এখন দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশই তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি চালু করতে যাচ্ছে। তার মধ্যে শ্রীলঙ্কা ও নেপাল অন্যতম। তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা এখন আর দক্ষিণ এশিয়ায় সীমাবদ্ধ নেই। ইউরোপের গ্রীসেও তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। কাজেই শুধু দক্ষিণ এশিয়ায় নয় সারা পৃথিবী বাংলাদেশের উদ্ভাবিত তত্ত্বাবধায়ক মডেল অনুসরণ করতে যাচ্ছে। অথচ দুঃখের বিষয় আমরা এই পদ্ধতির উদ্ভাবক হয়েও এই পদ্ধতি নিয়ে নিজেদের মধ্যে যুদ্ধে লিপ্ত আছি।
বর্তমান সরকার নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে নিঃসন্দেহে একটি আত্মঘাতী কাজ করেছে। রাজনৈতিকভাবে স্থিতিশীল বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছে। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, যার দ্বারা প্রথমে যেটি তৈরি হয়, পরে তার দ্বারাই এর বিপরীতটা হয়। আওয়ামী লীগই এদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার এনেছে। আবার আওয়ামী লীগই আদালতের অজুহাত দেখিয়ে তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা বাতিল করেছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার পটভূমি : এরশাদবিরোধী আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে সকলের মতামতের ভিত্তিতে বিচারপতি শাহাবুদ্দিন তত্ত্বাবধায়ক তথা ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি বিচারপতি শাহাবুদ্দিনের তত্ত্বাবধানে ’৯১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি একটি অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে বিএনপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও সরকার গঠনের মতো মেজরিটি পায়নি। পরে জামায়াতে ইসলামীর সহায়তায় খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি সরকার গঠন করে। একপর্যায়ে জামায়াতে ইসলামীর আমীর অধ্যাপক গোলাম আযম পরবর্তী নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠানের প্রস্তাব করেন। ২৫ জন সদস্য এই প্রস্তাবকে সমর্থন না করার কারণে ঐ প্রস্তাবটি সংসদে পেশ করা সম্ভব হয়নি। ফলে প্রস্তাবটি হালে পানি পায়নি। পরবর্তী পর্যায়ে অধ্যাপক গোলাম আযমের এই প্রস্তাব শেখ হাসিনা লুফে নেন। জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় পার্টিকে সঙ্গে নিয়ে পরবর্তী নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠানের দাবিতে তুমুল আন্দোলন গড়ে তোলে।
অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান স্বৈরাচার, রাজাকার, হাইজ্যাকার বলে আন্দোলনকারী তিন দলকে গালি দেন। এই তিন দলের উদ্যোগে রাস্তায় চলাচলকারী লোকদের দিগম্বরসহ ১৭৩ দিন হরতাল পালন করে। গানপাউডার দিয়ে বিআরটিসি বাস পুড়িয়ে ৯ জন যাত্রীকে হত্যা করে। অবশেষে ১৫ ফেব্রুয়ারি ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত পার্লামেন্টে তত্ত্বাবধায়ক বিল পাস করা হয়। ঐ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করে ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে।
বিগত ২০১২ সালের ৩০ জুলাই লন্ডনে বিবিসিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি নির্বাচনকালে বিরোধী দলের সমন্বয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের প্রস্তাব দেন। সেই সরকারের মন্ত্রিসভায় বিরোধী দল চাইলে অংশ নিতে পারে। এর কয়েক সপ্তাহ পর ১৯ সেপ্টেম্বর সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রস্তাব থেকে সরে আসেন। প্রধানমন্ত্রী পদে তিনি বহাল থাকা অবস্থায় দলীয় সরকারের অধীনেই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলেন। তিনি আরও বলেন, সংসদ ভেঙে দিয়ে আগামী সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া সরকারকে পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহাল নিয়ে সরকারের সঙ্গে যেকোনো স্থানে আলোচনা হতে পারে, অন্য কোনো বিষয়ে আলোচনা করে সময় নষ্ট করার মতো সময় তাদের হাতে নেই। তিনি আরও বলেন, বিএনপিকে বাইরে রেখে দলীয় সরকারের অধীনে যেকোনো নির্বাচন প্রতিহত করা হবে। এর প্রস্তুতি নেয়ার জন্য তিনি তার জোটের সর্বস্তরের নেতাকর্মীকে নির্দেশ দেন। তিনি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংবিধানে দ্রুত সংযোজনেরও দাবি জানান।
কার্যত: নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকার এখন বাংলাদেশের রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের সব রাজনৈতিক দল এমনকি সরকারি জোট মহাজোটেরও অনেক দল একবাক্যে এই দাবির প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করেছে। কেননা, একটি সুষ্ঠু পক্ষপাতহীন ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কেবল নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনেই অনুষ্ঠিত করা সম্ভব; কোন দলীয় সরকারের অধীনে এটি আশা করা অবান্তর অবাস্তব।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের ইতিহাসের দিকে নজর দিলে দেখা যায়, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য বিরোধী দলের আন্দোলনের মাধ্যমে জনতার রায়ে এদেশে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা হয়। সেই আওয়ামী লীগ আদালতের একটি বিভক্ত রায়কে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সর্বজন গ্রহণযোগ্য নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে নিজেরাও অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে এবং দেশকেও ভয়াবহ এক রাজনৈতিক সংকটের দিকে ঠেলে দিচ্ছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
বলাবাহুল্য, নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে পর পর দুটি নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবে অনেক শক্তিশালী হয়েছিল। আওয়ামী লীগের একটি ভালো ইমেজ দেশে বিদেশে তৈরি হয়েছিল। তার চেয়ে বড় কথা, শেখ হাসিনার রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতাও তৈরি হয়েছিল নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। এর জন্য তিনি ব্যাপক আন্দোলন করেছেন, প্রায় ১৭৩ দিন হরতাল পালন করেছেন, তার দলের অসংখ্য নেতাকর্মীর রক্ত ঝরেছে, অনেকে প্রাণ দিয়েছে এবং অনেকে গুরুতর আহত ও পঙ্গুত্ববরণ করেছে। দেশেরও সীমাহীন ক্ষতি হয়েছে। এসবই এখন ইতিহাস।
রাজনৈতিক নেতৃত্বের অপরিসীম ত্যাগ এবং দেশের সীমাহীন ক্ষতির পর একটি দিকনির্দেশনামূলক টেকসই রাজনৈতিক ব্যবস্থা যে নেতৃত্বের মাধ্যমে দেশে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং দেশে বিদেশে প্রশংসিত ও সার্বজনীনতা পায়, সে নেতৃত্বের দ্বারা কীভাবে এটি বিলুপ্ত হয় তা জাতির কাছে বোধগম্য নয়, রাজনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কোন সংজ্ঞায় এটিকে স্থান দেয়া যায় না। এটা একটা আত্মঘাতী কাজ ছাড়া আর কিছুই নয়।
আওয়ামী লীগের অধীনে কোন দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে বলে মনে হয় না। কারণ তাদের অতীত ইতিহাস সম্পর্কে সবাই জ্ঞাত। সম্ভাব্য পরিণতি সম্পর্কেও সবাই ওয়াকিবহাল। মানুষ একতরফা কোন নির্বাচন মেনে নেবে না। একতরফা নির্বাচনের দিন এখন আর নেই। একতরফা নির্বাচনে যাওয়া মানে দেশের অবধারিত সর্বনাশ ডেকে আনা। আওয়ামী লীগ যদি একতরফা কোন নির্বাচনের দিকে যায়, তাহলে তাদের সর্বনাশ তারা নিজেরাই ডেকে আনবে, ইতিহাসে একটা একতরফা নির্বাচনের কলংকের তিলক আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে সংযোজিত হবে।
লক্ষণীয় ব্যাপার হলো তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠায় সীমাহীন ত্যাগ আওয়ামী লীগ ভুলে গেলেও দেশের জনগণ ভুলে যায়নি, তাই এ পদ্ধতি বাতিলের পর থেকেই দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি দ্রুত পরিবর্তন হতে থাকে, মানুষের ভোটাধিকার নিয়ে তৈরি হয় সন্দেহ-সংশয়। এতে প্রতীয়মান হয়, এদেশের মানুষের মাঝে তত্ত্বাবধায়ক সরকার খুব ভালোভাবেই স্থান করে নিয়েছে। এটির প্রয়োজনীয়তা এখনো ফুরিয়ে যায়নি।
তারপরও দেশটি দুই যুগ গণতন্ত্রের অনুশীলন করেছে। এটি বিশ্ববাসীর দৃষ্টিতে এক অনন্য দৃষ্টান্ত, বিরল উদাহরণ। এ দেশটি একটি ‘মডারেট’ গণতান্ত্রিক মুসলিম রাষ্ট্রেরও খ্যাতি অর্জন করেছিল। এর সবই সম্ভব হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার কারণে। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে এটি কোনভাবেই সম্ভব হতো না, রাজনৈতিক, অস্থিতিশীলতা ও সংঘাত-সংঘর্ষ দেশকে আষ্ট্রেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলতো। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সুষ্ঠু, পক্ষপাতহীন গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমেই বাংলাদেশ এশিয়ার অন্যতম শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে যাচ্ছে, এটি এ দেশের শীর্ষ নেতৃত্বকে অধিক মাত্রায় স্মরণে রাখতে হবে।
আইনের চোখে ও গণতান্ত্রিক নির্বাচনী ব্যবস্থায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার বলতে কোন সরকারের বৈধতা না থাকলেও এটি একটি সামাজিক বাস্তবতা ও রাজনৈতিক সমঝোতার ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। তাই এ ব্যাপারটিকে আদালতের মুখোমুখি নিয়ে যাওয়ার পর আদালত একটি ভারসাম্যপূণ্য অবস্থান গ্রহণ করেছে। আদালত আরও দুই মেয়াদের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু রাখার পক্ষে মত দিয়েছে। কিন্তু সরকার আদালতের ওপর দায় চাপিয়ে একরতরফা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করেছে।
আওয়ামী লীগের মতো একটি প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল কিভাবে আদালতের রায়ের ওপর নির্ভর করে রাজনৈতিক কৌশল তৈরি করে, তা ভাবতে অবাক লাগে। প্রশ্ন আসে ১৯৯৬ সালে কি আদালতের কোন রায়ে এদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল? নাকি জনতার রায়ে? আজ ক্ষমতার মোহে জনতার রায়কে আসম্মান করা হচ্ছে।
শুধু শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন দিয়ে পক্ষপাতহীন, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আশা করাও অকল্পনীয় ও অবাস্তব। ইচ্ছা থাকলেও নির্বাচন কমিশনের পক্ষে সেটি কোনভাবেই সম্ভব নয়। কেননা সারদেশে প্রায় ৬০ হাজার ভোটকেন্দ্রের প্রায় ৯ কোটি ভোটারের ভোট নিশ্চিত করার ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের নেই। সিভিল প্রশাসন ও পুলিশ বাহিনীর ওপর নির্ভর করে তাদের নির্বাচনের আয়োজন করতে হয় আর দলীয় সরকারের অধীনে এসব প্রশাসন যন্ত্র কোনভাবেই নিরপেক্ষ থাকতে পারে না। তাছাড়া প্রশাসনের তৃণমূল থেকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে ইতিমধ্যে দলীয়করণ করা হয়ে গেছে। সুতরাং কোন দলীয় সরকার ও তার আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশনের কাছে নিরপেক্ষ গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আশা করা যায় না।
বিশ্বে বাংলাদেশের তৈরী উজ্জ্বল ভাবমর্যাদা সমুন্নত রাখতে এবং গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোন বিকল্প নেই। এই নির্মোহ সত্যাটি শাসক দল যত তাড়াতাড়ি উপলব্ধি করবে ততই মঙ্গল।
সংবিধান প্রণেতা ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. কামাল হোসেন আদালতের রায়কে উল্লেখ করে বলেছেন আদালতের রায়ে আরও দুই মেয়াদ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে নির্বাচন করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। পঞ্চদশ সংশোধনীর কথা আদালত বলেনি। পঞ্চদশ সংশোধনী আদালতের রায়ের বরখেলাপ।
তাছাড়া তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতিতো আদালতের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এটি আন্দোলনের মাধ্যমে জনতার অর্জন। যেমনটি ৭১-এর স্বাধীনতা আদালত নয়, যুদ্ধের মাধ্যমে আমাদের অর্জন। এখানে আদালতের কোন ভূমিকা নেই। রক্তপাতের মাধ্যমে জনতার এই অর্জনকে আদালতের দোহাই দিয়ে যারা ভূলুণ্ঠিত করতে চায় ইতিহাস তাদের ক্ষমা করবে না।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন