সোমবার, ২৮ অক্টোবর, ২০১৩

সুশীল রাজনীতি, সংলাপ ও সহিংসতা


এক. দুই নেত্রী সংলাপ করলে ও আগামি নির্বাচন অনুষ্ঠান প্রসঙ্গে একটি আপোষরফা হয়ে গেলেই বাংলাদেশের সঙ্ঘাতসঙ্কুল রাজনীতি শান্ত হয়ে যাবেÑ এই অনুমান নিয়ে পত্রপত্রিকা ও গণমাধ্যমে অনেকের নিরর্থক কথাবার্তা এখন বিরক্তিকর কোলাহলে পরিণত হয়েছে। পত্রপত্রিকা, টেলিভিশান ও ওয়েব পোর্টাল এমন সব অন্তঃসারশূন্য তর্ক করছে, যার সঙ্গে বাস্তবতার কোনো সম্পর্ক নাই। সুশীলকথাটা বাংলাদেশের রাজনীতিতে নিন্দার্থে ব্যবহার শুরু হয়েছে এক-এগারোর পর থেকে। কিন্তু আমরা প্রশ্ন করতে পারি বাংলাদেশে সুশীল রাজনীতির কি কোনোই ইতিবাচক ভূমিকা নাই? সুশীল রাজনীতি বলতে আমি সেই রাজনীতির কথাই বলছি যা সাধারণত লিবারেলবলে পরিচিত। আমি মনে করি আছে। তাদের ভূমিকা কি রাজনৈতিক দলগুলোর নিন্দা করা এবং রাজনীতি দিয়ে কিছু হবে না, এই মহৎ শিা নসিহত করে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলার অবনতি রোধ ও উন্নয়নের পথে কদম কদম অগ্রসরের জন্য সেনাবাহিনীকে মতায় বসিয়ে দেওয়া? আমি মনে করি, অবশ্যই না। অনেকেই তৃতীয় শক্তিকে মতায় এনে রাজনৈতিক দলগুলোকে শায়েস্তা করতে চান। সেটা হবে চরম আহাম্মকি। কয়েক দিন ধরে দেখছি গণমাধ্যমগুলো সহিংসতার খবর একপীয়ভাবে ছাপছে, তারা কী চাইছে সেটা বুঝতে খুব কষ্ট হবার কথা নয়। তারা এমন পরিস্থিতি চাইছে যাতে পরাশক্তির সমর্থনে তাদের প্রাণপ্রিয় তৃতীয় শক্তিবাংলাদেশের রাজনীতিতে হস্তপে করতে পারে। এটা ঠিক নয়। গণমাধ্যমের দিক থেকে বিচার করলে দেখি, বিরোধী দলের কথা বলে এমন কোনো গণমাধ্যম নাই। এ এক আশ্চর্য অসাম্য। অন্য দিকে কয়েকটি টেলিভিশান চ্যানেল ক্রমগাত মিথ্যাচার করে যাচ্ছে। যার টার্গেট সবসময়ই বিরোধী দলসমূহ বা মতাসীনদের প্রতিপ। সরকার অবৈধভাবে বল প্রয়োগের মাধ্যমে বিরোধী কণ্ঠস্বরগুলো বা বিরোধী দলগুলোর পে কথা বলতে পারে এমন সব মিডিয়া বন্ধ করে দিয়েছে। এ ব্যাপারে সুশীলদের কোনো মাথাব্যথা নাই। যদি সত্য সত্যই সুশীলসমাজ রাজনৈতিক সংলাপ চাইত তাহলে তাদের প্রথম কাজ ছিল সংলাপের পরিবেশ তৈরির জন্য দাবি তোলা। সমাজে রাজনৈতিক ও মতাদর্শিক বিতর্কে বিভিন্ন প যেন অংশগ্রহণ করতে পারে তার জন্য নীতিগত অবস্থান গ্রহণ করা। যেমন, অবিলম্বে আমার দেশ, দিগন্ত টিভি, ইসলামিক টিভি, চ্যানেল ওয়ানের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার। আমার দেশ সম্পাদক, মাহমুদুর রহমানের মুক্তি। কিম্বা মুক্তি চাইতে অসুবিধা বোধ করলে জামিন। নাগরিক হিসাবে জামিন পাবার অধিকার তাঁর আছে। যদি তা-ও কেউ না চান তাহলে নিদেনপে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার স্বার্থে বেআইনিভাবে তালা দিয়ে আটকে রাখা দৈনিক আমার দেশ-এর ছাপাখানা অবিলম্বে খুলে দেয়া। এগুলো অবশ্যই লিবারেল রাজনীতির অংশ। কিন্তু সুশীলরা মুখে বাক-ব্যক্তি-মত-চিন্তা ইত্যাদির স্বাধীনতার কথা বলে, কিন্তু আসলে তলে তলে বেশির ভাগই বিরোধী মতকে দমন-পীড়ন-নির্যাতনেই খুশি হয়। অনেকে ওর মধ্যে পৈশাচিক আনন্দ লাভ করে। রাজনৈতিক সহিংসতা ও বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য তারাই আবার খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাকে দায়ী করে। অথচ মত প্রকাশের স্বাধীনতা দমন প্রথম ভায়োলেন্স বা রাষ্ট্রীয় সহিংসতাÑ যা আজ হোক কাল হোক রাজপথে সহিংস রূপ নিয়ে ফিরে আসে। যে কণ্ঠস্বর সুশীলেরা মতাসীনদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে নিঃশব্দ করে দিয়েছে, সেটাই রাজপথের শক্তি হয়ে তাদের বিরুদ্ধে এখন রুখে দাঁড়াতে চাইছে। যাদের তারা কথা বলতে দিতে চায় না, তারা যে ভাষা জানে সেই ভাষাতেই রাজপথে কথা বলছে। এখন কিছু বিপদ টের পেয়ে অনেকে সহিংসতার বিরুদ্ধে চিৎকার জুড়ে দিয়েছে। সহিংসতার কারণ যে তারাই, সেটা তারা জানে না। কথা বলতে না দেওয়ার সহিংসতাই রাস্তায় গণবিদ্রোহ ও গণপ্রতিরোধ হয়ে প্রত্যাবর্তন করে। এটাই ইতিহাসের নিয়ম। ইন্টারনেটে ছেলেমেয়েরা কিছু কথা বলতে পারত। অথচ আইসিটি (তথ্যপ্রযুক্তি আইন ২০১৩) আইনে বাক, ব্যক্তি, মতপ্রকাশের স্বাধীনতাবিরোধী কালো ধারা যুক্ত করা হয়েছে। এই ধারা বলেই অধিকার সম্পাদক অ্যাডভোকেট আদিলুর রহমান খান, নাসিরুদ্দিন এলানের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করা হয়েছে। আজ ভারতীয় সীমান্তরী সীমান্তে প্রতিদিন কতজন বাংলাদেশীকে গুলি করে হত্যা করছে, কতজনকে ধরে নিয়ে গিয়েছে, কতজন মহিলাকে ধর্ষণ করেছে তার কোনো নিয়মিত তথ্য আমরা জানতে পারছি না। মানবাধিকার সংগঠনগুলোকে নির্ভয়ে কাজ করতে দেওয়া হচ্ছে না। হয়রানি চলছে। রাষ্ট্রীয় সহিংসতা ও সন্ত্রাসের কারণে কতজন মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, তার নির্ভরযোগ্য কোনো তথ্য পাবার উপায় সীমিত হয়ে গিয়েছে। সুশীলদের কর্তব্য ছিল জনগণের মত প্রকাশের অধিকার ও তথ্য জানার অধিকারের পে দাঁড়ানো। সংলাপ দরকার ছিল সমাজে, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে শুধু নয়। যদি সামাজিক েেত্র সংলাপে আমরা সফল হতে পারতাম, রাজনৈতিক েেত্র সফল হবার সম্ভাবনা বাড়ত। কিন্তু বিরোধী মত ও চিন্তাকে রুদ্ধ করে দিয়ে কিছু সুশীল এখন চাইছে হাসিনা আর খালেদা টেলিফোন করে আর ডিনার খেয়ে দেশের সমস্যা সমাধান করুক। এটা হাস্যকর। বিরোধী দলের বিরুদ্ধে দমন-নিপীড়নের উদ্দেশ্যে তাদের নেতাকর্মীদের আটক করে রাখা, দেশব্যাপী দায়েরকৃত লাধিক মানুষের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে দায়ের করা মিথ্যা মামলার বিরুদ্ধে সুশীলসমাজ অবশ্যই দাঁড়াতে পারত। কিন্তু তাদের কর্তব্য তারা পালন করে নি। লিবারেল মতাদর্শ বা রাজনীতির পে তারা দাঁড়ায় নি, মুখে খই ফুটিয়েছে। শাপলা চত্বরে গত ৫ মে অনুষ্ঠিত হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে সংঘটিত গণহত্যার সঠিক তথ্য ও আহত ও নিহতদের অনুসন্ধানের জন্য নিরপে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন। নিহত ও আহতদের যথাযোগ্য তিপূরণ প্রদান ও আলেম-ওলামাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা সব মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারে তারা সমাজের সেই অংশের কাছে প্রমাণ করতে পারত তারা উদার রাজনৈতিক নীতিতে আসলেই বিশ্বাসী। তারা রাজনৈতিক প্রতিপরে নাগরিক ও মানবিক অধিকার রা করা কর্তব্য অস্বীকার করে না। সমাজে ভায়োলেন্স ও নিরুপায় সহিংসতা এতে অবশ্যই কমত। পুরাপুরি কমত না। যে দ্বন্দ্ব কাঠামোগত সেই দ্বন্দ্ব টিকিয়ে রাখলে সহিংসতার সম্ভাবনা কখনোই উবে যেত না, কিন্তু কমত, এতে সন্দেহ নাই। দুই. বাংলাদেশে প্রতি পাঁচ বছর পরপর কিভাবে নির্বাচন হবে শুধু সেই সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে রক্তপাত কম হয় নি। এরপর তো নির্বাচনকালীন সময়ের রক্তপাত ও সহিংসতা আছেই। কিন্তু এখনকার সঙ্কট নিছকই নির্বাচনীব্যবস্থা সম্পর্কে মষৈতক্য প্রতিষ্ঠার সমস্যাও নয়। স্বৈরশাসক এরশাদের পতনের মধ্য দিয়ে তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। তার বিস্তর সমালোচনা করা যায়, হয়েছেও। কিন্তু তার পেছনে রাজনৈতিক ও সামাজিক সমঝোতা ছিল। এর বৈধতা জনগণের সম্মতির মধ্যে, যার ভিত্তিতে বেশ কয়েকটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এখন পঞ্চদশ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে তাকে নস্যাৎ করে দেওয়ার কারণে একটা ভয়াবহ রাজনৈতিক শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে। আদালতের পরামর্শে জাতীয় সংসদে আইন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নাকচ করে দেওয়ার ফল অতএব ভালো হয় নি। আইনিসিদ্ধান্তে ত্রয়োদশ সংশোধনীকে জাতীয় সংসদ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ও আইনি এখতিয়ারের জোরে বাতিল করতে পারে, কিন্তু সমাজে রাজনৈতিক লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত বৈধতাতাতে নাকচ হয়ে যায় না। আইনি (legality) সিদ্ধান্ত মানেই বৈধ (legitimate) সিদ্ধান্ত নয়। বৈধতার শূন্যতা আইন পূরণ করতে পারে না। নৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক বৈধতাকে আইন দিয়ে মোকাবিলা করা যায় না। এগুলো রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও আইনশাস্ত্রের পুরানা কথা। বিদ্যমান নৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক বৈধতাকে নতুন নৈতিকতা, সামাজিকতা ও বৈধতা তৈরির রাজনীতি দিয়েই মোকাবিলা করতে হয়। অন্য বহু কারণ বাদ দিলেও নির্বাচনকেন্দ্রিক বর্তমান সঙ্কটের কারণ কিভাবে নির্বাচন হবে সে সম্পর্কে সমাজে গড়ে ওঠা অভিপ্রায়কে মতাসীনদের অস্বীকার। যাঁরা সুশীল ও উদারনৈতিক রাজনীতির পাবলম্বনকারী, তাদের প্রথম কাজ হচ্ছে এই শূন্যতা তৈরির জন্য যারা দায়ী তাদের সমালোচনা করা। কিন্তু দুই-একজন ব্যতিক্রম ছাড়া সুশীলরা মতাসীনদের নয়, দায়ী করছে বিরোধীদলীয় জোটকে। মতাসীনেরা যেহেতু ক্রমাগত সংবিধানের দোহাই দিচ্ছে তাই আজ (২৭ অক্টোবর ২০১৩) দেখছি বদিউল আলম মজুমদার দৈনিক প্রথম আলোয় প্রশ্ন তুলেছেন কোন সংবিধান, কার সংবিধান?’। ঠিকই। সুশীল রাজনীতি যদি তাদের উদার রাজনৈতিক মতাদর্শের জায়গা থেকে বর্তমান সঙ্কটে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে চায়, তাহলে তাঁদের অবস্থান স্পষ্ট ও শক্ত করতে হবে। মজুমদার পঞ্চদশ সংশোধনীর ইতিহাস ব্যাখ্যা করে লিখেছেন, ‘এ ইতিহাস থেকে পাঠকেরা নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী কি বাংলাদেশের ১৬ কোটি জনগণের অভিপ্রায়ের, না প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছার প্রতিফলন! বলাবাহুল্য যে, এ সিদ্ধান্তের কারণেই আমাদের বর্তমান রাজনৈতিক সংকট, হানাহানি ও নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা। তিনি অবশ্যই ঠিক বলেছেন। শেখ হাসিনা তাঁর ইচ্ছা দেশের জনগণের চাপিয়ে দিয়ে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে, সুশীলসমাজকে অবশ্যই সেটা বদিউল আলম মজুমদারের স্পষ্টভাবেই বলতে হবে। বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতির কাঠামোগত সমস্যা অনেক গভীর। সমাজে বিভিন্ন শ্রেণি ও শক্তির স্বার্থের দ্বন্দ্ব এত বিকট ও ভয়াবহ যে তার মীমাংসা দুই পরে পরস্পরের বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগ ছাড়া অন্য কোনোভাবে সমাধান অসম্ভব। তার পরও বহু সুশীলের হুঁশ হয় না যে এটা লাল ফোন কিম্বা মোবাইল টেলিফোনের বাতচিতের ব্যাপার নয়, কিম্বা ভাত খাওয়ার দাওয়াত গ্রহণ করে দুই নেতার পটোল ভাজি বা বেগুন ভর্তা খেতে খেতে সমাধানের বিষয়ও নয়। সমাধান দুই নেত্রীর হাতেও কি আছে? ড্যান মজিনা একবার দিল্লি যান, এখন হয়তো ওয়াশিংটন না গিয়ে বেইজিং যাবেন। এই পরিস্থিতি এক দিনে তৈরি হয় নি। কোনো দৈব হুকুমে নির্বাচন হলেও এই পরিস্থিতির মীমাংসা সহজে হবে না। বাংলাদেশ সঙ্ঘাতের রাজনীতিতে ঢুকেছে বহু আগে। তার পরও তর্কের খাতিরে মেনে নেওয়া যাক সমাজ ও রাজনীতির কাঠামোগত রূপান্তরের সমস্যা বা গোড়ার গোলমালের সমাধান সহসা সম্ভব নয়, কিন্তু বিপদ তো এখন মাথার ওপর এসে পড়েছে। বদলে দাও বদলে যাওবলে কাজ হচ্ছে না। যেখানে আছে দিন বদল সেখানেই আছে...বললেও সামনে ডোরাকাটা হলুদ শেয়ালের মুখব্যাদান ভেসে ওঠে, সবুজ বাংলাদেশ তবিত হয়ে যাচ্ছে চোখের সামনে। সমাধান বিপ্লবে না সংস্কারে, সেই তর্ক থেকেও আমরা বহু দূর পিছিয়ে এসেছি। এই পরিপ্রেেিতই, আমি মনে করি, সুশীল রাজনীতির একটা ভূমিকা আছে। আসলেই। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র দূরে থাক এই সব দেশে ন্যূনতম লিবারেল বা উদারনৈতিক নাগরিক ও মানবিক অধিকারসম্পন্ন সমাজ, রাজনীতি ও রাষ্ট্র কায়েম করতে হলেও বিপ্লব ও রক্তপাত ছাড়া কোনো শান্তিপূর্ণ পথ খুঁজে পাওয়া রীতিমতো অসম্ভব। এই দিকটির উপলব্ধি জরুরি। কিন্তু সুশীলদের মধ্যে বেশির ভাগের মধ্যে এই উপলব্ধি নাই। বাংলাদেশের বাস্তবতা বুঝেও প্রায় প্রত্যেকেই শান্তিপ্রিয় ভদ্রলোক সাজতে চান। তারা সঙ্ঘাত চান না, শান্তি চান, সেটা ভালো। অশান্তি কেউ শখ করে চায় না। শান্তিপূর্ণভাবে কোনো সঙ্কটের মীমাংসা হলে সহিংসতা ও রক্তপাত কেউই চায় না। কিন্তু বাস্তব রাজনীতির আলোচনা পাতিবুর্জোয়া নৈতিকতা প্রদর্শন করে নিজেকে শান্তিপ্রিয় সুশীলহিসাবে হাজির করবার চেয়ে বিরক্তিকর কিছুই হতে পারে না। সেই েেত্র টেলিফোন, আলাপ সংলাপ, ডিনার ভাত খাওয়াখাওয়ি নিয়ে কোনো কিছু লিখতে বা বলতে হলে কিছু কাণ্ডজ্ঞান খরচ করা দরকার। স্রেফ কাণ্ডজ্ঞান দিয়েই বিবদমান দুই পকে বোঝার চেষ্টা করা উচিত। পার্লামেন্টের শেষ অধিবেশন বসবে নভেম্বরের ৭ তারিখে। হাতে সময় আছে এক সপ্তাহেরও কম। শেখ হাসিনা যদি কোনো সিদ্ধান্ত নিতে চান তাহলে তাঁকে জাতীয় সংসদেই নিতে হবে, সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন হতে পারে। খালেদা জিয়া একটি প্রস্তাব দিয়েছেন, আমি যার কঠোর সমালোচনা করেছি (দেখুন www.chintaa.com)তবু ছহিহ সুশীল রাজনীতির বরাতে মেনে নিচ্ছি হাজার হোক একটা প্রস্তাব তো বিরোধী দলের তরফে এসেছে এবং জাতীয় সংসদে সেটা পেশ করা হয়েছে। শেখ হাসিনার সর্বদলীয় সরকারের প্রস্তাব তো আছেই। কোনো সমাধান এই দুই প্রস্তাবের মধ্য থেকে বের করতে হবে, অথবা নতুন প্রস্তাব পেশ করতে হবে। এই পরিস্থিতিতে বিরোধী দল হরতাল প্রত্যাহার করে লাশের ওপর হেঁটে ডিনার খেতে যেতে চায় না। এতে আন্দোলনে ছেদ পড়বে, যারা রাস্তায় আন্দোলন করতে গিয়ে নির্যাতিত হয়েছেন তাদের ব্যাপারে কিছু না করে শেখ হাসিনার ওপর ন্যায়সঙ্গত দাবির চাপ কমিয়ে দিলে তারা আম ও ছালা দুটাই হারাবেন। বদিউল আলম মজুমদারের বিশ্লেষণের সঙ্গে যদি আমরা একমত হই তাহলে এটা পরিষ্কার, বেগম খালেদা জিয়া ইতোমধ্যেই অতিরিক্ত ছাড় দিয়ে ফেলেছেন। আরো ছাড় আত্মঘাতী হবে, এতে রাস্তার আন্দোলনে ছেদ পড়লে আন্দোলনমুখী জনগণের আস্থাও বিএনপি হারাবে। অথচ এই সময় এরাই খালেদা জিয়ার প্রধান রাজনৈতিক ভিত্তি ও সমর্থক। সুশীলরা নয়। জনগণ মাঠে নেমে পড়েছে, কিন্তু পুরাপুরি নেমে গিয়েছে বলা যাবে না। এর কারণ আন্দোলনে শরিক হতে চাইলেও বিএনপির শ্রেণিচরিত্র ও দোদুল্যমানতার জন্য বিএনপি কী করতে চায় সে বিষয়ে অনেকে এখনো সন্দিহান। বেগম জিয়া হরতাল প্রত্যাহার করে ডিনার খেতে গেলে সাধারণ মানুষের বিশাল একটি অংশ নির্বাচনে তাঁকে ভোট দিতেও ইতস্তত করবে। ফলে হরতাল প্রত্যাহার ও ডিনার খাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়ার বিষয় খালেদা জিয়ার একার নয়। তাঁকে তাঁর নিজের রাজনৈতিক স্বার্থ অবশ্যই বিবেচনায় নিতে হবে। এই মুহূর্তে ন্যূনতম আপোষের জায়গা হচ্ছে শেখ হাসিনা মতা ছাড়ুক, তাঁর অধীনে নির্বাচন হবে না। তাঁর দলেরই কেউ নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান হোক। শেখ হাসিনার পে কি আসলেই এই ন্যূনতম জায়গাটুকুও মেনে নেওয়া সম্ভব? মেনে নিলে সেটা হবে নৈতিক পরাজয়। এই নৈতিক পরাজয় মেনে নেওয়া এবং তার পরিণতিতে রাজনৈতিকভাবে নিজের পতনের আরম্ভের আবাহন শেখ হাসিনার পে কিভাবে সম্ভব? ‘শেখ হাসিনার অধীনেই নির্বাচন হবে’Ñ আওয়ামী লীগের নেতাদের দাম্ভিক ও রুচিহীন কথাবার্তা বাদ দিয়ে যদি বিবেচনা করি তো দেখি, শেখ হাসিনার অবস্থানও নাকচ করা কঠিন। দুই পরে অবস্থান যেখানে সেখানে আপোষ বা সমঝোতা কিভাবে হবে? এ কারণেই আমি এর আগের লেখায় বলেছি, যদি কোনো সমাধান হয় তো দুই পরে বল প্রয়োগের মধ্য দিয়েই হবে। এ নিয়ে হাহুতাশ করে কিছু লাভ হবে বলে আমি মনে করি না। সুশীলদেরও বলি, হা-হুতাশ না করে আসুন, বরং কারো মত বা চিন্তা যত খারাপ হোক তাকে তার কথা বলার অধিকারের পে দাঁড়াই। সহিংসতাকে যদি সংলাপে পরিণত করতে চাই, তাহলে এটা হচ্ছে প্রাথমিক পদপে। অন্যায়ভাবে বন্ধ করে দেওয়া পত্রিকা-টিভি খুলে দেবার দাবি জানাই। সমাজে সব পরে কথা আমরা শুনতে চাই, সে দাবি তুলি। সুশীলসমাজ ইতিবাচক ভূমিকা চাইলেই পালন করতে পারে। অবশ্যই। যদি তাঁরা যে নীতির কথা বলেন, সেই নীতিতে বিশ্বাস করেন। 


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads