শনিবার, ৫ অক্টোবর, ২০১৩

ভারত এ লজ্জা রাখবে কোথায়?

ভারতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাঅর্থাৎ সংখ্যালঘুদের প্রাণ-সম্পদ-সম্ভ্রমের ওপর হামলা যেন অনেকটা নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। সেখানে ১৯৪৭ সালের পর সংঘটিত অসংখ্য দাঙ্গার শিকার প্রধানত মুসলিম জনগোষ্ঠী। ধর্মীয় সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের উগ্রপন্থীদের সৃষ্ট এই ভয়াবহ সহিংসতা বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের দাবিদার ভারতের সমাজকে পরিচিত করেছে চরম অসহিষ্ণু হিসেবে। এ জন্য সাম্প্রদায়িক দলগুলোর বিদ্বেষপূর্ণ রাজনীতির পাশাপাশি সেকুলার শক্তির সুবিধাবাদও দায়ী। সংখ্যালঘু মুসলমানেরা যেন সমানাধিকারের দাবিদার নাগরিক নয়, নিছক ক্ষমতার রাজনীতির দাবা খেলার অসহায় ঘুঁটি। মুজাফফরনগর এলাকাটি ভারতের রাজধানী দিল্লি থেকে ৭৫ মাইল দূরে। রাজনৈতিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ উত্তর প্রদেশের একেবারে উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে মুজাফফরনগর। জনসংখ্যা, পার্লামেন্টের আসন সংখ্যা এবং দিল্লির সংলগ্নতা ছাড়াও উত্তর প্রদেশ বিশেষ গুরুত্বের অধিকারী নেহরু পরিবারের আবাস ও রাজনীতির পাদপীঠ হিসেবে। আবার এটাও ঠিক, এই রাজ্যে হিন্দুদের মাঝে জাতপাতের বৈষম্যের মতো মুসলিমবিরোধী দাঙ্গাপ্রবণতাও কম নয়। এবার মুজাফফরনগরে সেপ্টেম্বরের প্রথমার্ধের দাঙ্গায় অর্ধশতাধিক মানুষ নিহত এবং ৪০ হাজার গৃহহারা হয়েছেন। সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি বিপুল। উত্তর প্রদেশে ২১ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো সেনা মোতায়েন করতে হয়েছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে। আমাদের এই উপমহাদেশে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িকতা বিশেষ করে ইংরেজ আমল থেকে পরিলক্ষিত হয়েছে। প্রধান দুটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বিভেদ ও বৈরিতার চূড়ান্ত পরিণামে ভারত ও পাকিস্তান দুটি রাষ্ট্রের জন্মের মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান হয়েছিল। তবে ভারত-পাক শত্রুতার যেমন অবসান হয়নি, তেমনি অব্যাহত আছে হিন্দু-মুসলিম বিরোধের বিষয়টিও। উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের শেষ পর্বে দেখা যায়, আমাদের এই বাংলাদেশ অঞ্চলে দলিত বা তফসিলি হিন্দুরা বিপুল সংখ্যায় পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সপক্ষে সমর্থন দিয়েছেন। এর মাধ্যমে তারা বর্ণবাদী হিন্দু প্রভাবিত কংগ্রেসের অখণ্ড ভারত দাবির জবাব দিতে চেয়েছেন। কারণ ব্রাহ্মণ্যবাদী মহলসহ উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের হাতে নিম্নবর্ণের মানুষেরা হতেন নির্যাতিত নিগৃহীত। তবে ৪৭-এর স্বাধীনতার পর ভারতের নানা অঞ্চলে দলিত বা নিম্নবর্ণের হিন্দুদেরও বিভিন্নভাবে উসকানি দিয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে অপব্যবহার করা হয়েছে। মুজাফফরনগরের সর্বশেষ ঘটনায়ও মহলবিশেষের এমন চক্রান্ত দৃষ্টিগোচর হয়েছে এবার। শুধু এটাই নয়, এবারে সেখানে যে দাঙ্গায় অর্ধশত মুসলিম নিহত হলো আর ধ্বংসতাণ্ডবে হাজার হাজার সংখ্যালঘু হলো গৃহহারা, এতে সংশ্লিষ্ট হিন্দু ও মুসলিম, উভয়ই নৃতাত্ত্বিকভাবে জাঠ। বর্তমান উত্তর প্রদেশের পশ্চিমাঞ্চলের জাঠদের একাংশ ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে ইসলাম গ্রহণ করেন। ধর্মান্তরিত হওয়ার এই ঐতিহাসিক ঘটনার পেছনে ছিল প্রখ্যাত সুফিসাধক শায়খ ফরিদুদ্দীন গন্দ্বশকর ও বাহাউল হক জাকারিয়ার প্রভাব। মুসলিম জাঠরাও হিন্দু ও শিখ জাঠদের মতো কৃষিজীবী ছিলেন। অমুসলিম ও মুসলিম জাঠদের গোত্রের নামও অভিন্ন। যেমন আহীর, ভুল্লার, চীমা, দেও, ধিলন, গিল, গ্রেওয়াল, গুজজার, জাখার, খার, মালিক, রানধাওয়া, নন্দ, সান্ধু, সিধু, মান প্রভৃতি। সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও সব জাঠের মাঝে কতগুলো মিল দেখা যেত। কিন্তু এই পরিবেশ বদলে দেয় বাবরি মসজিদ ইস্যু। উগ্র হিন্দুত্ববাদের প্রতিক্রিয়ায় সর্বভারতীয় মুসলিম ঐক্যের চেতনা তীব্র হতে থাকে। ১৯৯২ সালে সঙ্ঘপরিবারবাবরি মসজিদ ধ্বংস করার জের ধরে উত্তর প্রদেশের মুসলমানেরা মুলায়ম সিং যাদব ও কাঁশিরামের তফসিলি দলিত সংখ্যালঘু মোর্চায় শামিল হয়ে যায়। এর আগে দীর্ঘকাল তারা ছিল কংগ্রেসের সমর্থক। কিন্তু হিন্দুত্ববাদীদের সহিংসতারোধে ব্যর্থতা ও নিষ্ক্রিয়তা এবং পরোক্ষে সাম্প্রদায়িকতায় মদদদানের ফলে কংগ্রেসের ওপর মুসলিম জনগোষ্ঠী আর আস্থা রাখতে পারছিল না। যা হোক, উত্তর প্রদেশের পশ্চিম অংশের মুজাফফরনগর, ভাগপাত ও শামলিÑ এই তিন জেলার মুসলমানেরা স্থানীয় হিন্দুদের মতো অজিত সিংয়ের রাষ্ট্রীয় লোকদলের (আরএলডি) পেছনে জোরালো সমর্থন দিয়ে আসছিল। ওই জেলাগুলোতে এ পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় ছিল পুরোপুরি। এবারে আগস্টের শেষ দিকে একটি মুসলিম বালককে কয়েকজন অমুসলিম টিনএজারপিটিয়ে মেরে ফেলে। অভিযোগ, ছেলেটি নাকি একটি মেয়েকে উত্ত্যক্ত করেছিল। এর পর প্রতিশোধ হিসেবে পাল্টা হত্যাকাণ্ডও ঘটে যায়। প্রশাসন যদি সত্যিকারভাবে নিরপেক্ষ ও দায়িত্বসচেতন হতো, তা হলে পরিস্থিতির আর অবনতি ঘটত না। সাম্প্রদায়িক ইস্যুর স্পর্শকাতরতা সত্ত্বেও প্রশাসন যথাযথ পদক্ষেপ না নিয়ে বাস্তবে সংখ্যালঘুদের নিধনের সুযোগ করে দেয়। উগ্রপন্থী হিন্দুরা ছিল সুযোগের অপেক্ষায়। সাম্প্রদায়িক রাজনীতিবিদেরা মাঠে নেমে পড়েন দেরি না করে। শুরু করা হয় মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষ ছড়ানোর প্রচারাভিযান (hate-speech)একটি ভুয়া ভিডিও পোস্ট করে ঘৃণার আগুনে ঘি ঢালা হলো। বিজেপির এক নেতা এই অপকর্মের হোতা। এখন পুলিশ স্বীকার করছে, ভিডিওটি দুই বছর আগের এবং এর সাথে ভারতীয় মুসলমানদের সম্পর্ক নেই। এতে দেখানো হয়েছে দলিত সম্প্রদায়ের এক ব্যক্তিকে হত্যার চিত্র। অপর দিকে মুসলিম সম্প্রদায়ের দরদী সেজে কোনো কোনো দলের নেতারা রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির প্রয়াস পান। ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার মাঝে সহিংসতার শঙ্কা বৃদ্ধি পায়। তবু ৭ সেপ্টেম্বর অমুসলিম জাঠদের বিশাল সমাবেশ করার অনুমতি দেয়া হয় সরকারি নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করে। সম্ভাব্য হামলা ও দাঙ্গা রোধ করার জন্য এর আগেই মুজাফফরনগর জেলায় সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। সমাবেশ করার সুযোগ পেয়ে দিল্লি, হরিয়ানা ও উত্তরাখণ্ড থেকেও লোক আনা হয়। দেড় লাখ উগ্র হিন্দুর এই সমাবেশে নেতারা মুসলিমবিরোধী সন্ত্রাস উসকিয়ে দিতে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেন। এসব সাম্প্রদায়িক নেতার মধ্যে ছিলেন বিজেপির হুকুম সিং, সঙ্গত সিং সোম, সুরেশ রানা ও কুনওয়ার ভারতেন্দু, কংগ্রেসের সাবেক এমপি হরেন্দ্র মালিক প্রমুখ। এই প্রেক্ষাপটে দাঙ্গার সূচনা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মুসলমানেরাও উসকানির ফাঁদে পা দেয়। হিন্দু জাঠরা দাঙ্গায় জড়িয়ে পড়ার একটা বড় কারণ আর্থসামাজিক। তারা পরিবর্তিত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে নিজেদের বঞ্চিত ভাবছে। সেই ক্ষোভ ঝেড়েছে সংখ্যালঘুদের ওপর। দাঙ্গায় মুসলমানেরাই যে অনেক বেশি ক্ষতির শিকার হয়, তা বলা বাহুল্য। ভারতের অন্যান্য দাঙ্গার মতো এ ক্ষেত্রেও কর্তৃপক্ষ ও বেশির ভাগ মিডিয়া দাঙ্গায় হামলাকারী বা ক্ষতিগ্রস্ত সম্প্রদায়ের নাম এড়িয়ে গেছে। তবুও বুঝতে অসুবিধা হয় নাÑ হত্যা, জখম, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ, গুম ইত্যাদির বলি প্রধানত কোন সম্প্রদায়ের লোকজন। অনেকটা একতরফা হামলার ঘটনা হলেও সেটাকে দুই সম্প্রদায়ের দাঙ্গা হিসেবে দেখানো হয়। যা হোক, মুজাফফরনগরে হত্যা, বিতাড়ন ও হামলার পাশাপাশি নারী নির্যাতনের বর্বরতাও ঘটিয়েছে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী। এমনিতেই ধর্ষণের মহামারী ভারতের গর্ব খর্ব করে দিয়েছে। তার ওপর মুসলিম মেয়েদের অবমাননা সে লজ্জা দিয়েছে আরো বাড়িয়ে। আর স্বাধীনতার ৬৬ বছর পরও গান্ধীজীর ভারতে সাম্প্রদায়িকতার তাণ্ডব পুরো রাষ্ট্র ও জাতির জন্য নিদারুণ লজ্জার। মুজাফফরনগরের দাঙ্গার পর ভারতের বামপন্থী রাজনৈতিক দল সিপিআই (এম) সেখানে ডেলিগেশন পাঠায় তথ্যানুসন্ধানে। এতে ছিলেন লোকসভা সদস্য সাঈদুল হক, কেন্দ্রীয় কমিটি সদস্য সুভাষিণী আলী, উত্তর প্রদেশ সম্পাদকমণ্ডলী সদস্য ডি পি সিং। তারা স্থানীয় নেতাদের নিয়ে হতাহত ও ক্ষতিগ্রস্তদের সরেজমিন খোঁজখবর নেন। স্বজনহারা যে মানুষেরা উদ্বাস্তু শিবিরে, তাদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। পরিদর্শন করেছেন হাসপাতাল। প্রতিনিধিদলের রিপোর্টে কিছু দাবি ও সুপারিশ রয়েছে। এতে উল্লেখ করা হয়Ñ (ক) এলাকায় ব্যাপক যৌন হয়রানির কারণে মেয়েদের লেখাপড়ার ক্ষতি হচ্ছে। দুঃখজনকভাবে হিন্দুত্ববাদী শক্তি ইস্যুটিকে ব্যবহার করে সংখ্যালঘুদের ঘাড়ে সব দোষ চাপিয়ে তাদের দানব হিসেবে উপস্থাপন করছে। তারা অসত্য প্রচারণার মাধ্যমে এভাবে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ ঘটাতে চাচ্ছে। (খ) বলা হচ্ছে, ২৭ আগস্ট একটি মেয়েকে উত্ত্যক্ত করার জের ধরে দাঙ্গার সূত্রপাত। এ অভিযোগ সঠিক নয়। এ ধরনের ঘটনা শুধু এই এলাকায় নয়, উত্তর প্রদেশে ব্যাপক। (গ) এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা যে, এবার ৯ আগস্ট ঈদুল ফিতরের দিনে ঈদের জামাত শুরু হওয়ার আগ মুহূর্তে ঈদগাহের গেটে ইদরিস নামে একজন মুসলমানকে গুলি করে হত্যা করা হয়। তার ঘাতকদের নাম প্রদীপ, রামনিবাস (আইনজীবী) ও কিশোর। প্রদীপ প্রায়ই ইদরিসের মেয়েকে উত্ত্যক্ত করত। এ জন্য একবার ইদরিস চড় মেরেছিলেন প্রদীপকে। এর প্রতিশোধনেয়া হলো তাকে ঈদের দিন নামাজের প্রাক্কালে ঈদগাহের প্রবেশপথে সবার সামনে হত্যা করে। এমন একটি অভাবনীয় নৃশংস ঘটনায় মুসলমানদের আর ঈদ করা হয়নি। উদ্বাস্তু শিবিরে আশ্রিত লোকজন বারবার বলেছেন, প্রশাসন তৎপর থাকলে ২৭ আগস্ট এবং এর পরের বীভৎস ঘটনাগুলো ঘটত না। (ঘ) সিপিআই (এম) প্রতিনিধিদল নিশ্চিত যে, ক্ষতি উভয় সম্প্রদায়ের হলেও সংখ্যালঘুরা প্রাণহানি, ঘরবাড়িসহ সম্পদহানি এবং গবাদিপশুর ক্ষতির দিক দিয়ে অপরিমেয় দুর্ভোগের সম্মুখীন। হাসপাতাল পরিদর্শন এবং উদ্বাস্তুদের সাক্ষাৎকার থেকে নিশ্চিত হওয়া গেছে নৃশংস হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে। কচি শিশুদের ওপর নির্মম অত্যাচার করা হয়েছে এবং তাদের গায়ে আগুন দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে। একজন নারীর দেহকে করা হয়েছে খণ্ড-বিখণ্ড। (ঙ) এটা প্রমাণিত যে, সরকার ও প্রশাসনের ব্যর্থতা এ ঘটনায় জীবন ও সম্পত্তির ভয়াবহ ক্ষতির জন্য দায়ী। এটা অবোধগম্য যে, ২৭ আগস্ট তিনটি মৃত্যুর ঘটনার পরও প্রশাসন কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। সেদিন থেকে ৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রতিদিন সংঘর্ষ, ইট-পাথর নিক্ষেপ, উসকানিমূলক বক্তৃতা এবং লোকজন জড়ো করার ঘটনা ঘটেছে। তবুও ১৪৪ ধারা কার্যকর করাসহ কড়া ব্যবস্থা নেয়ার মতো কিছুই করা হয়নি। সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে উন্মাদনা সৃষ্টির জন্য ভিডিও প্রচার এবং এতে বিজেপির বিধানসভা সদস্য সঙ্গত সোম জড়িত থাকার কথা জেনেও তেমন কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। ৭ সেপ্টেম্বরে জাঠদের মহাসমাবেশ নিষিদ্ধঘোষণা করেও তা বন্ধ করার উদ্যোগ নেয়া হয়নি। চ) এটা অনস্বীকার্য, আরএসএসসহ হিন্দুত্ববাদীরা ওই এলাকায় সুপরিকল্পিতভাবে তৎপর থেকে বিভেদমূলক কিছু ইস্যু তুলছিল। এটা জেনেও সরকার ওদের পরিস্থিতির সুযোগ নেয়ার পথ করে দিয়েছে, যার পরিণতি হয়েছে মারাত্মক। পূর্বোক্ত মহাসমাবেশে বৌ বানাওস্লোগান দেয়া হয় (বিশেষ সম্প্রদায়কে টার্গেট করে)। প্রকাশ্যে অস্ত্রবাজি চলেছে। পুলিশসহ প্রশাসন এসব কিছুর নীরব দর্শক ছিল। থানার সামনেই ইসরারকে হত্যা করা হয়। সিপিআই (এম) তদন্ত রিপোর্টে অবিলম্বে তাদের সবাইকে গ্রেফতার করার দাবি জানানো হয়েছে, যাদের দেখা গেছে সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় উসকানি দিতে। নিহতদের পরিজন ও আহতদের বৈষম্যহীনভাবে শিগগিরই ক্ষতিপূরণ প্রদান এবং ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে যথাযথ ত্রাণ কার্যক্রমের ওপরও জোর দেয়া হয়েছে। আরো বলা হয়েছে, শান্তি-শৃঙ্খলা পুনর্বহাল করা এবং বজায় রাখার পাশাপাশি যারা ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে, ফিরিয়ে এনে তাদের নিরাপত্তা করতে হবে সুনিশ্চিত। সিপিআই (এম) প্রতিনিধিদল মুসলিম অধ্যুষিত শহর তানওয়ালির উদ্বাস্তু শিবিরে গিয়ে দেখে, সেখানে ৫০০ মুসলমান আশ্রয় নিয়েছেন। আশপাশের গ্রামের এসব মানুষের মধ্যে নারী-পুরুষও রয়েছে। তারা বাড়িঘর, গবাদিপশুসহ সহায়-সম্পত্তি হারিয়েছে। খারাদ গ্রামে সগিরকে হত্যা করে তার পুরো পরিবারকে আগুনে পুড়ে মারার চেষ্টা করা হয়েছে। আহতাবস্থায় তাদের উদ্ধার করা হয়েছে। কিনাউনি গ্রামে মুসলিম নারী-শিশুরা ৭ সেপ্টেম্বর রাতে গ্রামপ্রধান দেবেন্দ্রর বাড়িতে আশ্রয় পেয়েছিলেন। পরদিন তারা উদ্বাস্তু শিবিরে চলে যান। তারা জানেন না, বাড়িঘর, সহায়-সম্বল ও গবাদিপশুর এখন কী অবস্থা। পাশের হাদাউলি গ্রামে অন্তত ছয়জন নিহত হয়েছে। কয়েকজনকে তাদের বাড়িতে পুড়িয়ে মারা হয়। কোনো কোনো শিবিরে প্রশাসন প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও খাদ্যসামগ্রী পাঠায়নি উদ্বাস্তুদের জন্য। মুজাফফরনগর জেলা হাসপাতালের সুপার জানান, মারাত্মক যাদের অবস্থা, তাদের মিরাট হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। জেলা হাসপাতালে ২৭ আগস্টের পর ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট ৫৩ জনের পোস্টমর্টেম হয়েছে, যাদের মধ্যে একজন নারী ও দুটি শিশু রয়েছে। মৃতদের বেশির ভাগই সংখ্যালঘু। একজন সরকারি ডাক্তার জানান, কোনো কোনো লাশে এমন নৃশংসতার চিহ্ন ছিল যে, তিনি ২৪ ঘণ্টা কিছু খেতে পারেননি। প্রকাশিত খবর মোতাবেক, শিশুদের দেহ এমনভাবে জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে যে, তারা ছেলে না মেয়ে, তা পর্যন্ত নির্ধারণ করা যায়নি। দাঙ্গায় প্রাণ দিয়েছেন খুবই জনপ্রিয় সাংবাদিক রাজেশ বর্মা। আইবিএন ৭-এর এই সাংবাদিকের ছিল সুদৃঢ় সামাজিক অঙ্গীকার। অসাম্প্রদায়িক এই ব্যক্তিত্ব ইসরার হত্যাকাণ্ডে মর্মাহত হয়েছিলেন এবং ফরিদ ও তার স্ত্রীকে সাহায্য করেছেন বলে রাজেশের পরিবার জানান। তিনি মুজাফফরনগরে দাঙ্গার খবর পেয়েই ছুটে যান। এর শুধু ছবিই তোলেননি, দাঙ্গা থামাতেও চেষ্টা করেছেন। তখন তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। সিপিআই(এম) নেতারা শাহপুর উদ্বাস্তু শিবিরও পরিদর্শন করেছেন। একটি বড় মাদ্রাসায় অবস্থিত এই শিবিরে চার হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। অনেকে আশপাশের বাড়িগুলোতে ঠাঁই পেয়েছেন। ওই সব নেতা সফর করার তিন দিন আগে থেকে ত্রাণসামগ্রী দেয়া হলেও তা অপর্যাপ্ত। এ দিকে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ব্যস্ত ছিলেন উদ্বাস্তু শিবিরে প্যান্ডেল তৈরির কাজে। কারণ, পরদিনই মুখ্যমন্ত্রীর আগমন ঘটবে। তিনি জানান, তখনো ভীতসন্ত্রস্ত মানুষ গ্রাম ছেড়ে চলে যাচ্ছিল। ফলে প্রতিদিনই আশ্রয় শিবিরের সংখ্যা বাড়ছে। কোথাও কোথাও সশস্ত্র জনতা লুটপাট চালিয়ে বাড়িঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়। মসজিদে হামলার ঘটনাও ঘটেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাজ্য পুলিশ এবং কেন্দ্রীয় দাঙ্গা পুলিশ সংখ্যালঘুদের সাহায্য করেছে আশ্রয় শিবিরে পৌঁছতে। কেবল একটি গ্রামেরই দুই হাজারের বেশি মানুষ বাড়ি ছেড়ে উদ্বাস্তু শিবিরে উঠেছে। উত্তর প্রদেশে এখন ক্ষমতাসীন সমাজবাদী দলের (এসপি) সরকার, আর প্রথমবারের মতো মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে আছেন মুলায়মপুত্র অখিলেশ সিং যাদব। আগে ক্ষমতায় ছিল দলিতকন্যা মায়াবতীর বহুজন সমাজ পার্টি (বিএসপি)। এখন ভারতের রাজনৈতিক অঙ্গনে সবকিছুই আবর্তিত হচ্ছে আসন্ন লোকসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। এ নির্বাচনে কেন্দ্রে বিজয় নিয়ে যেমন ক্ষমতাসীন কংগ্রেস চিন্তিত, তেমনি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য, উত্তর প্রদেশে ক্ষমতাসীন সমাজবাদী পার্টি দুশ্চিন্তায় রয়েছে। অপর দিকে বিজেপি মোদিকে নিয়ে যতই খোশখোয়াব দেখুক, তারাও উত্তর প্রদেশে নিজেদের বিজয় নিয়ে সন্দিহান। অথচ বিজেপি গুজরাটের নরেন্দ্র মোদিকে উত্তর প্রদেশের লèৌ থেকে প্রার্থী করতে পারে। তার ঘনিষ্ঠজন অমিত শাহকে করা হয়েছে সে রাজ্যে দলীয় প্রচারণা টিমের প্রধান। এই প্রেক্ষাপটে বিজেপির উদ্যোগে সাম্প্রদায়িক বিভাজন ও মেরুকরণের প্রয়াস, মুসলিমবিরোধী দাঙ্গায় উসকানি প্রভৃতি বিষয় বিচার্য। ভারতের রাজধানীর কিছু দূরে এবার এমন ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক তাণ্ডব চালানো হলো যে, পুলিশ সিংবা সিআরপিএফ তা থামাতে ব্যর্থ বলে সেনাবাহিনী নামতে হলো কারফিউ দিয়ে। কিন্তু এই দাঙ্গার খবর বাংলাদেশের মিডিয়ায় তেমন গুরুত্ব পায়নি। ভারতে সংখ্যালঘুদের ওপর সাম্প্রদায়িক হামলা ও নিপীড়নের ঘটনা এত বেশি ঘটে যে, সেটাকে স্বঘোষিত সেকুলার ভারতের মতো রাষ্ট্রে স্বাভাবিক মনে করা হয়। তা ছাড়া আমাদের মিডিয়ার একটা বড় অংশ মনে করে, ভারতের সাম্প্রদায়িক ঘটনা তুলে ধরলে ধর্মনিরপেক্ষতা ুণœ হবে এবং পরীক্ষিতবন্ধু দেশের সাথে বন্ধুত্ব বজায় রাখার পরীক্ষায় আমরা হেরে যাব। অথচ বাংলাদেশের তিলকে তাল বানাতে ভারতীয় মিডিয়ার জুড়ি নেই।


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads