সিরাজুর রহমান
নয় বছর স্থায়ী সামরিক
স্বৈরতন্ত্রের পর বাংলাদেশে প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচন হয়েছিল ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি।
এর দু’দিন আগে ২৫ ফেব্রুয়ারি রাতে শেখ হাসিনা টেলিভিশনে ৪৫
মিনিট ধরে স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান, তার স্ত্রী ও পরিবারের কুৎসা রটনা করেছেন। তার ভাষণের বেশির
ভাগজুড়ে ছিল অশ্লীল ভাষায় তাদের গালিগালাজ। সে সন্ধ্যায় বাংলাদেশের একজন শীর্ষ
আমলার বাড়িতে আমার নৈশভোজের নিমন্ত্রণ ছিল। আরো প্রায় ১০ জন বিশিষ্ট অতিথি ছিলেন
সে নৈশভোজে। শেখ হাসিনার টেলিবক্তৃতা শুনে সবাই থ’
হয়ে গিয়েছিলেন। ধাতস্থ হওয়ার পর প্রত্যকেই অত্যন্ত বিরূপ মন্তব্য
করছিলেন শেখ হাসিনা সম্বন্ধে। একজন বললেন, এই দীর্ঘ সময়
নষ্ট করে উন্মাদের প্রলাপোক্তি শুনলাম। আরেকজন বলেছিলেন, মহিলার বাপ-মা তাকে ভদ্র ভাষা শেখাতে ভুলে গিয়েছিলেন। ভোজসভার পর আমার আরেকটি নিমন্ত্রণ ছিল পররাষ্ট্র সচিবের বাড়িতে, তাদের বিয়েবার্ষিকী উপলক্ষে। কূটনীতিক, রাজনীতিক, পত্রিকা সম্পাদক অর্থাৎ ঢাকার
সমাজের ‘মাথা’ বিশিষ্টজনেরা উপস্থিত ছিলেন। পৌঁছেছিলাম একটু বেশি রাত করে।
পৌঁছে শুনি, গোটা মজলিসে আলোচনার
বিষয়বস্তু শেখ হাসিনার ভাষণ। খুবই হতাশা দেখালেন কয়েকজন। ছি ছি করলেন কেউ কেউ। শেখ
মুজিব সরকারের অ্যাডভোকেট জেনারেল ব্যারিস্টার সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদকে এক পাশে ডেকে
জিজ্ঞেস করলাম, কাকে ভোট দেবেন তিনি। খুবই
হতাশার সুরে তিনি বললেন, সারা জীবন আওয়ামী লীগের
রাজনীতি করেছি। এখন অন্য কোনো দলকে ভোট দেয়ার প্রশ্ন ওঠে না; কিন্তু এই ভাষণের পর আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়ার প্রবৃত্তি হবে না। যাদের স্মৃতি এখনো ঝাপসা হয়ে যায়নি,
সে ভাষণ প্রসঙ্গে তাদের সবাই এখনো ছি ছি করেন। দেশের ও জাতির রায়
যে শেখ হাসিনা জানতেন না, সেটা ভাবতে পারি না; কিন্তু কোনো শিক্ষা নিতে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। সুযোগ পেলেই তিনি
শহীদ জিয়াউর রহমানের পরিবার, বিশেষ করে
বাংলাদেশের তিনবারের প্রধানমন্ত্রী (হাসিনা এ যাবৎ প্রধানমন্ত্রিত্ব করেছেন দু’বার) বেগম খালেদা জিয়া সম্বন্ধে কটূক্তি করতে তিনি ছাড়েননি। এমনকি
বর্তমান সংসদের অধিবেশনেও ১৯৯১ সালের কদর্য ভাষণের উক্তিগুলোর পুনরাবৃত্তি করেছেন। সরকারের মেয়াদ সমাপ্তির মুখে আরেকটি টেলিভাষণ দিয়েছেন শেখ হাসিনা।
এটাকে বলা হয়েছে ‘জাতির উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রীর
ভাষণ’। সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রসূতি স্থান বলে বর্ণিত
ব্রিটেনে বাস করছি ৫৩ বছর ধরে। এ দেশেও বিশেষ জাতীয় পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রীর
ভাষণের রীতি আছে। যুদ্ধবিগ্রহ, আপৎকালীন
পরিস্থিতি ইতাদি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ভাষণ দেন। কিছু দৃষ্টান্তÑ ১৯৩৯ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী নেভিল চেম্বারলেন
জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। সে উপলক্ষে তিনি জাতির উদ্দেশে একটি
রেডিও ভাষণ দিয়েছিলেন। ২০০৩ সালের মার্চ মাসে ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্র ইরাক আক্রমণ
করেছিল। প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার তার আগে আগে একটা ভাষণ দিয়েছিলেন। কিন্তু বিশেষ শর্ত এই যে, তেমন ভাষণে
প্রধানমন্ত্রী দলীয় রাজনীতির প্রসঙ্গ তুলতে পারবেন না। তিনি যদি তেমনি কোনো
প্রসঙ্গ তোলেন তা হলে বিবিসিসহ ব্রডকাস্টিং প্রতিষ্ঠানগুলো অনুরূপ সময়ে এবং সমান
সময়জুড়ে বিরোধী দলের নেতাকেও ভাষণদানের সুযোগ দিতে হয়। সেটা বিবিসির চার্টারে
অন্তর্ভুক্ত আছে। কারো কারো মনে থাকার কথা। ১৯৫৬ সালের অক্টোবরে ব্রিটিশ
প্রধানমন্ত্রী স্যার অ্যান্টনি ইডেন সুয়েজ খাল আক্রমণ করেন। সে উপলক্ষে তিনি একটি
বেতার ভাষণ দাবি করেন। বিবিসি তার লিখিত ভাষণ গ্রহণযোগ্য মনে করেনি, কেননা ব্রিটেনের বেশির ভাগ মানুষ সে আক্রমণের বিরোধী ছিল; কিন্তু ইডেন তার প্রধানমন্ত্রীর ভাষণদানের অধিকার ছাড়তে রাজি ছিলেন
না। সে সময় বিবিসি যা করেছিল, সেটা ইতিহাস হয়ে আছে। বিবিসি কর্তৃপক্ষ বিরোধী লেবার পার্টির নেতা
হিউ গেটসস্কেলকে এনে অন্য একটি স্টুডিওতে বসিয়ে রাখে। অ্যান্টনি ইডেনের ভাষণের পর
পরই গেটসস্কেল সুয়েজ আক্রমণের বিরোধিতা করে সমান দৈর্ঘ্যরে একটি ভাষণ প্রচার করেন।
বাহ্যত ও স্পষ্টতই ব্রিটিশ জাতির বিপুল গরিষ্ঠ অংশ ইরাক আক্রমণের বিরোধী ছিল।
বেতার-টেলিভিশন সম্প্রচারকেরা ব্লেয়ারের ‘প্রধানমন্ত্রীর
ভাষণ’ প্রচার করলেও যুদ্ধের বিরোধীদের বক্তব্য সম্ভবত বেশি
গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করেছিলেন।এখন স্পষ্ট যে, বাংলাদেশের ৯০ শতাংশ
মানুষ ‘তত্ত্বাবধায়ক’ অথবা যেকোনো নামেই হোক একটা নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন চায়।
সরকারসমর্থক কোনো কোনো পত্রিকায় প্রকাশিত সমীক্ষায়ও এর সপক্ষে ৮১ শতাংশ মানুষের
কথা বলা হয়েছে; কিন্তু শেখ হাসিনা আলোচ্য
বক্তব্যে জনমতের বিরুদ্ধে তার একগুঁয়েমির পক্ষে বক্তব্য রেখেছেন। বক্তৃতার বেশির
ভাগজুড়ে তিনি আওয়ামী লীগের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণাই চালিয়েছেন। সুতরাং এটাকে
প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ বলা ভুল হবে। শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের নেত্রী হিসেবেই ১৮ অক্টোবর
শুক্রবারের টেলিভাষণটি দিয়েছেন।অর্থাৎ গণতন্ত্রের আদর্শ অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর
বক্তব্যের জবাব দেয়ার অধিকার বিরোধী দলের নেতার আছে। যেসব চ্যানেল শেখ হাসিনার
ভাষণটি প্রচার করেছে, তাদের নৈতিক কর্তব্য হচ্ছে
মোটামুটি দিনের একই সময়ে (এ ক্ষেত্রে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা) বেগম খালেদা জিয়াকে
জবাবদানের সুযোগ দেয়া। তারা নিজেরা সে দায়িত্ব পালন না করলে তথ্যমন্ত্রীর কর্তব্য
হবে, বিরোধী দলের নেতার বক্তব্য সম্প্রচার করতে
চ্যানেলগুলোকে বাধ্য করা। সেটা যদি তিনি না করেন তা হলে হাসানুল হক ইনু যেকোনো
জাতীয় দায়িত্বপূর্ণ পদের অযোগ্য বলে বিবেচিত হবেন। আওয়ামী লীগ
ছাড়া অন্য সব দলের নেতারা এবং দেশের চিন্তানায়কেরা বলেছেন, নির্বাচন সম্বন্ধে শেখ হাসিনার বক্তব্য সুস্পষ্ট নয়। তিনি যা
বলেছেন তার চেয়ে অনেক বেশি অনুক্ত রয়ে গেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান কে হবেন
খুলে বলেননি প্রধানমন্ত্রী।
বর্তমান সংসদ বজায় রেখে নির্বাচন হবে কি না, সে বিতর্কিত
প্রশ্নের ওপর কোনো আলোকপাত হয়নি। নির্বাচন কবে হবে,
সেটাও বলেননি প্রধানমন্ত্রী। নির্দলীয় সরকারে বিরোধী দলকে সমান
প্রতিনিধিত্ব দেয়ার প্রতিশ্রুতি তিনি দেননি। কেউ কেউ এ কথাও বলেছেন যে, ভাষণে শেখ হাসিনা সংবিধানের ভুল ব্যাখ্যা দিয়েছেন। আলোচ্য ভাষণে তিনি ভাষার কদর্যতা খুব বেশি দেখাননি, কিন্তু বিরোধী দলের বিরুদ্ধে অনেক অসত্য অপবাদ দিয়েছেন। তার ভাষণে
শেখ হাসিনা ওয়ান-ইলেভেন সরকারের জন্য খালেদা জিয়ার ওপর দোষারোপ করেছেন এবং সে
সরকারের দৃষ্টান্ত দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতির অগ্রহণযোগ্যতা প্রমাণের চেষ্টা
করেছেন। এর চেয়ে সত্যের বড় অপলাপ আর হতে পারে না। প্রথমত, ওয়ান-ইলেভেন কোনো তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল না। সেটা ছিল একটি
বর্ণচোরা সামরিক সরকার এবং সেটা ঘটিয়েছিল আওয়ামী লীগ। শেখ হাসিনা নিজেই সে কথা
স্বীকার করেছেন। এক-এগারোর বোঝা অন্যের ঘাড়ে
চাপানোর চেষ্টা বিএনপি সরকার ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর
তাদের মেয়াদ শেষে সংবিধান অনুযায়ী একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা
হস্তান্তর করে বিদায় নেয়। মনে রাখতে হবে, ১৯৯৫-৯৬ সালে
শেখ হাসিনা জামায়াতে ইসলামীকে দলে টেনে তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতির দাবিতে দেশজুড়ে
আন্দোলন করেছিলেন। দেশকে অচল করে দেয়া হয় এবং আন্দোলনকারীদের সহিংসতায় বেশ কয়েকজন
মারা যান। হানাহানি বন্ধ করার লক্ষ্যে খালেদা জিয়ার সরকার সংবিধানের ১৩তম সংশোধনী
পাস করে তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতির বিধান করে। ২০০৬ সালে শেখ হাসিনা ‘থুড়ি’ খেলেন। সংবিধান তখন আর তার
ভালো লাগল না। সেই সাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতির বিরুদ্ধে তিনি যুদ্ধ ঘোষণা
করলেন, লগি-লাঠি-বৈঠার আন্দোলন শুরু করেন। সে আন্দোলনের ভয়াবহতার কথা ভুলে গেলে বাংলাদেশের মানুষ ভুল করবে।
লাঠিপেটা করে প্রকাশ্য দিবালোকে এবং রাজধানীর কেন্দ্রে বেশ কয়েকজন মানুষ হত্যা করা
হয়। বন্দর ও সড়ক অবরোধ করে অর্থনীতিকে অচল করে দেয়া হয়। রেলওয়ের স্লিপার তুলে তাতে
আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়। এমনকি বঙ্গভবন অবরোধ এবং বঙ্গভবনের বিদ্যুৎ, টেলিফোন সংযোগ ইত্যাদি কাটার হুমকি দিয়ে রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক
ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদকে বলা যায়, এক ধরনের
গৃহবন্দী করে রাখা হয়। সেসব কিছুকে তখন শেখ হাসিনার সন্ত্রাস বলে মনে হয়নি। ওয়ান-ইলেভেনের সরকার আসে শেখ হাসিনার গোপন ষড়যন্ত্রের ফলে। ২০০৭ সালের
১৫ এপ্রিল বিদেশ ভ্রমণে যাওয়ার আগে বিমানবন্দরে শেখ হাসিনা সাংবাদিকদের বলেছিলেন, সে সরকার তারই আন্দোলনের ফসল এবং ক্ষমতা পেলে তিনি তাদের সব কাজ
বৈধ করে দেবেন। শেখ হাসিনাকে চিকিৎসার নামে বিদেশ ভ্রমণের (যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য ও ফিনল্যান্ড) অনুমতি
দেয়া হয়। অথচ বেগম খালেদা জিয়াকে প্রথমে সৌদি আরবে নির্বাসনে পাঠানোর চেষ্টা করে
বর্ণচোরা সরকার। বিএনপি নেত্রী সাহসিকতার সাথে সে অপচেষ্টা ব্যর্থ করে দেন; কিন্তু তাকে কয়েদ করে রাখা হয়। প্রথমে ডিজিএফআইকে দিয়ে বিএনপিকে
ভেঙে দেয়ার চেষ্টা হলো। তাতে ব্যর্থ হয়ে ওয়ান-ইলেভেন সরকার বিএনপিকে বাদ দিয়ে
নির্বাচন করারও চেষ্টা করেছিল। হাসিনা নিজে ওয়ান-ইলেভেন ডেকে আনলেন। অথচ এখন তিনি
প্রকারান্তরে সে জন্য বিএনপিকে দায়ী করার চেষ্টা করছেন, সে দৃষ্টান্ত দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতির ব্যর্থতা প্রমাণ করার
চেষ্টা করছেন। আরেকটা কথা, শেখ হাসিনা বিএনপিকে কতটা ভয়
করেন, এই হচ্ছে তার মাত্র একটি প্রমাণ। অন্যের কীর্তি চুরি করে এই দল শেখ হাসিনা
প্রায়ই বলে থাকেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে কিছু
গঠনমূলক কাজ হয়। বিএনপি এলে হয় ভাঙচুর ও দুর্নীতি। মনে করা যেত, শেখ হাসিনা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন। প্রকৃত পরিস্থিতি ভিন্ন
রকম। প্রধানমন্ত্রী মাত্র সাধারণ মানুষের হ্রস্ব রাজনৈতিক স্মৃতিকে ‘এক্সপ্লয়েট’ (অপসুযোগ গ্রহণ) করছেন। খালেদা
জিয়ার প্রথম সরকার সুবৃহৎ যমুনা সেতুটি তৈরি করেছিল। ১৯৯৬ সালে গদি পেয়েই শেখ
হাসিনা সে সেতুর কপালে তার বাপের নাম এঁকে দিলেন। বর্তমানেও তিনি শুধুই পাইকারি
হারে ‘ভিত্তিস্থাপন’ করছেন। অথচ
কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। এই সরকার পদ্মা
সেতুটিও ‘গিলে খেয়েছে’। সরকারের দুর্নীতির কারণে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর অর্থায়ন
প্রত্যাহার করে নেয়। ব্যাংক দুর্নীতিবাজদের তালিকা সরকারের হাতে দিয়ে তাদের বিচার
চেয়েছিল। বলেছিল, তা হলেই আবার তারা সেতু
নির্মাণে অর্থায়ন করবে; কিন্তু শীর্ষ ব্যক্তিদের
প্রক্সি হয়ে যারা দুর্নীতি করেছেন সরকারের হুকুম তামিলের দুর্নীতি দমন কমিশন তাদের
বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সাহস পায়নি। এই সরকার কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের নামে ২০
হাজার কোটি টাকা চুরি করেছে। ডেসটিনি এবং হলমার্কসহ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর
হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়ে এই ব্যাংকগুলোকে ফতুর করে দিয়েছে। ২০০৯ সালে গদি পেয়ে
প্রথমেই তাদের আপনজনেরা শেয়ারবাজার থেকে ৩৫ লাখ পরিবারের লগ্নি লুট করেছে। এবিএম মূসা বাংলাদেশের প্রবীণতম সাংবাদিকদের একজন। কম বয়সে আমরা
একসাথে বিভিন্ন পত্রিকায় কাজ করেছি। তারপর তিনি বিবিসির সংবাদদাতা নিযুক্ত হন।
প্রায়ই টেলিফোনে কর্থাবার্তা হতো তার সাথে। গোটা কর্মজীবন তিনি আওয়ামী লীগের
সমর্থক ছিলেন। সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে তিনি বিবিসির চাকরি ছেড়ে
দেন। তিনি ১৯৭৩ থেকে ’৭৫ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ
দলীয় এমপি ছিলেন। শেখ মুজিব তাকে বিটিভির মহাপরিচালক নিয়োগ করেছিলেন। শেখ মুজিব
যতবারই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে লন্ডনে এসেছেন, ততবারই এবিএম
মূসা তার সফরসঙ্গী ছিলেন। শুনেছি, অন্যান্য সফরেও
তিনি তার সাথে থাকতেন। সেই এবিএম মূসাই সম্প্রতি এক টেলিভেশন টক শোতে বলেছেন, দেশবাসীর উচিত যখনই কোনো আওয়ামী লীগ নেতাকে দেখবেন, তখনই চোর, চোর বলে ধ্বনি তোলা। শেখ হাসিনার মুখে বিএনপির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ হাস্যোদ্রেক
করে মাত্র। আসলে বিএনপির দুর্নীতির অভিযোগ তুলে তিনি নিজের সরকার ও নিজের দলের
দুর্নীতি থেকে দেশবাসীর মনোযোগ ভিন্নমুখী করার চেষ্টা করেছেন। তিনি দেশের মানুষকে জুজুর ভয় দেখাচ্ছেন শেখ হাসিনা দেশের মানুষকে জুজুর ভয় দেখাতে চান বলেই মনে হয়। তিনি
বলে থাকেন, বিএনপি ক্ষমতায় এলে দেশে
সন্ত্রাস হয় এবং হবে। বিগত প্রায় পাঁচ বছরে বাংলাদেশে যা ঘটেছে সেটা যদি সন্ত্রাস
না হয় তা হলে সন্ত্রাস কাকে বলব? এমন দিন যায় না
যখন দেশের কোথাও না কোথাও দু’চারটি খুনের
খবর পাওয়া যায় না। এগুলোর বেশির ভাগের জন্যই দায়ী আওয়ামী লীগের ক্যাডার।
ক্যাডারেরা রাজনৈতিক হত্যা করেছে কয়েক হাজার। সরকার নিজেই সন্ত্রাসী ভূমিকা
নিয়েছে। ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধের ভুয়া নামে প্রায় আড়াই শ’ রাজনৈতিক কর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। গুম-খুন হয়েছে প্রায় দেড় শ’। গত বছরের এপ্রিল মাসে একটি বাহিনীর হাতে ছিনতাই হওয়া বিএনপির
সাংগঠনিক সম্পাদক এবং সিলেট বিএনপির নেতা ইলিয়াস আলী ও তার গাড়িচালককে সরকার এখনো
হাজির করতে পারেনি। বিএনপি কোনো মিছিল মিটিং
ডাকলে তাতে সন্ত্রাস হয়; কিন্তু সে সন্ত্রাস কে করে? সর্বত্রই পুলিশ-র্যাবের মদদে ছাত্রলীগ-যুবলীগের সশস্ত্র ক্যাডারেরা
সেসব শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে বলেই সন্ত্রাসের ঘটনাগুলো ঘটে। পুলিশ আর
আওয়ামী ক্যাডারদের সংযত করা গেলে সভা-সমাবেশ ও মিছিলে সন্ত্রাস মোটেই হবে না। গত ৬
মে ভোরে শাপলা চত্বরে যা ঘটেছে সেসবের জন্য কি বিএনপি দায়ী ছিল? সে রাতে হেফাজতে ইসলামের লাখ লাখ কর্মী শাপলা চত্বরে ঘুমিয়ে ছিলেন।
রাস্তার আলো ও মাইক্রোফোন বন্ধ করে দিয়ে সম্পূর্ণ দলীয়কৃত র্যাব-পুলিশ-বিজিবি (এবং
কিছু রহস্যজনক সশস্ত্র ব্যক্তি) ঘুমন্ত কর্মীদের ওপর পাইকারি গুলি চালায়। দাবি করা
হয়েছে যে, হাজার-দুই কর্মী সেই কালরাতে
মারা গেছেন। ঘটনা চাপা দেয়ার সব চেষ্টা করেছে সরকার। পরিচয়সহ ৬৫ জনের নামের তালিকা
হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে দেয়ায় মানবাধিকার সংস্থা অধিকার-এর মহাসচিব আদিলুর রহমানকে
গ্রেফতার করে বেশ কিছু দিন কয়েদ করে রেখেছিল সরকার। এসব খুন-খারাবি
ও অপকর্মের জন্য প্রধানমন্ত্রী পুলিশ, র্যাব ও
বিজিবিকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন তার ভাষণে। এই ব্যক্তিরা বাংলাদেশের লোক। দেশে তাদের
আত্মীয়-বন্ধু ও পরিচিত অনেক আছেন। তারা এই তিন বাহিনীর বাড়াবাড়ি সমর্থন করছেন বলে
কি আপনাদের মনে হয়? দেশে সরকার পরিবর্তন হবেই।
তখন বাড়াবাড়ির সাথে জড়িতদের কী পরিণতি হবে ভাবতেও আমি শিউরে উঠছি। রাজনীতিতে সন্ত্রাস চালু করেছে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে রাজনৈতিক সন্ত্রাসের ‘ফাদার-মাদার’ হচ্ছে আওয়ামী লীগ। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালের মধ্যে (শেখ মুজিবের
শাসনকাল) রক্ষীবাহিনী অন্তত ৩০ হাজার রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে হত্যা করেছে। শেখ
হাসিনা ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর আওয়ামী লীগের সশস্ত্র ক্যাডার বাহিনীকে
তৎপর দেখা যায়। সে সময় এক কলামে আমি তাকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলাম, চোর-চোট্টা-দাগাবাজ আর ধর্ষণকারীরা ক্যাডারের ছাতার নিচে এসে
দুষ্কর্ম চালাবে। কিছু দিনের মধ্যেই সে আশঙ্কা সত্য হয়ে গেল। ‘গডফাদারের’ নির্দেশে আওয়ামী লীগের
ক্যাডারেরা খুন-খারাবি ও ত্রাসের রাজত্ব চালিয়ে যায়। প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং
চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতাদের ‘একটির বদলে
দশটি’ লাশ ফেলার নির্দেশ দিয়েছিলেন। গডফাদারদের সমালোচনা
করায় সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের তিনি তিরস্কার করেন। হাসিনার বর্তমান সরকারের
আমলে কী ঘটেছে, সেটা তো জাতির মনে তাজা আছে। হামলা হলে গৃহস্থালির দা-কুড়াল নিয়ে কর্মীদের প্রস্তুত থাকতে
বলেছেন সাদেক হোসেন খোকা। তাকে গ্রেফতারের জন্য হন্যে হয়ে খুঁজছে পুলিশ। তার
বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় তুলেছেন আওয়ামী লীগ নেতারা;
কিন্তু কর্মীদের এ ধরনের নির্দেশদানের কথা কেন মনে হয়েছিল? তিনি শুধু নজির অনুসরণ করেছেন। আওয়ামী লীগ নেতারা মনে করছেন, দেশের সব মানুষ ইতিহাস ভুলে গেছে। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের বক্তৃতায় ‘যার যা অস্ত্র আছে’ তাই নিয়ে
পাকিস্তানিদের প্রতিরোধ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। শেখ হাসিনা ২০০৬ সালে লগি-লাঠি-বৈঠা
দিয়ে ঢাকায় আসার নির্দেশ দিয়েছিলেন। একটি এনজিওর ভাড়া করা লোকেরাসহ লক্ষাধিক
লাঠিয়াল তখন ঢাকায় এসেছিল। সাদেক হোসেন খোকা হয়তো এদের দৃষ্টান্তে অনুপ্রাণিত হয়েই
কথাগুলো বলেছিলেন। আওয়ামী লীগের একটা চারিত্রিক দোষ এই যে, তারা দুই মানদণ্ডে পৃথিবীকে বিচার করে। তারা যা করে সেটা ‘হালাল’। আর তাদের বিরোধীরা যদি একই
কাজ করে তা হলে তাদের দেশদ্রোহী বলে অপবাদ দেয়া হয়। আজকাল আওয়ামী
লীগ প্রায়ই দাবি করে, তার দল গদি পেলে ইসলাম নিরাপদ
থাকবে, আর বিএনপি ক্ষমতা পেলে ইসলাম বিপন্ন হবে।
প্রধানমন্ত্রী কি একবারো ভেবে দেখছেন, বিভিন্ন
বানোয়াট অভিযোগে হাজার হাজার টুপি-দাড়ি অলা মুসলমানকে গ্রেফতার কে করেছে? ফসল ভালো হওয়ায় মা-দুর্গাকে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলেন কে? শাপলা চত্বরের লাখ লাখ মুসলমানের ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়েছিল কে? প্রধানমন্ত্রী কি শোনেননি যে, তার ছেলে জয়
বলেছেন মুসল্লিদের ওপর নজরদারি করার জন্য মসজিদে আওয়ামী ক্যাডারদের পাঠানো হবে? জয় সম্প্রতি বলেছেন মাদরাসাগুলোতে ভর্তি হ্রাস করার ব্যবস্থা নেয়া
হয়েছে। অনেকেই সন্দেহ করেন, চট্টগ্রামে একটি মাদরাসায়
বোমা বিস্ফোরণ বিশেষ মহলের চরেরাই করেছে পরিকল্পনা অনুযায়ী। এসব দৃষ্টান্তকে
ইসলামের সংরক্ষণ বলে বিশ্বাস করবেন কেউ? গণতন্ত্র সম্বন্ধে হাসিনার সংজ্ঞা শেখ হাসিনা তার
ভাষণে বলেছেন, ‘গণতন্ত্র তখনই শক্তিশালী হবে, যখন তা সাংবিধানিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হবে। জনগণের ভোটে
নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিরা রাষ্ট্র পরিচালনা করবেন।’
এ প্রশ্ন অবশ্যই উঠবে, ২০০৬ সালে লগি-লাঠি-বৈঠার
আন্দোলনে যখন এত মানুষ খুন করা হলো, দেশ অচল করে
দেয়া হলো, তখন কি দেশে কোনো সংবিধান ছিল
না? একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির অত্যন্ত বিতর্কিত একটা
রায়ের অর্ধেকের দোহাই দিয়ে বিরোধী দলবর্জিত সংসদে শেখ হাসিনা সংবিধানের ১৫তম
সংশোধনী পাস করে তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি বাতিল করেছিলেন। তার পর থেকে হঠাৎ তার
সংবিধানপ্রীতি অতিরিক্ত বেড়ে গেছে মনে হয়। ক্ষমতায় আসার
সময় থেকেই বিরোধী দলের সভা-সমাবেশ করার ওপর বহু অন্যায় বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে।
বিভিন্ন ভুয়া অজুহাতে বিরোধী দলের নেতাদের গ্রেফতার করে রিম্যান্ডের নামে নির্যাতন
করা হচ্ছে। বহু নেতা এখনো কারাবন্দী। শোনা যাচ্ছে,
বাইরে যারা আছেন তাদেরও শিগগিরই বিভিন্ন অজুহাতে গ্রেফতার করা হবে।
বিএনপির নেতাদের নয়া পল্টনে তাদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না।
কার্যালয়ের বাইরে পুলিশ দিয়ে প্রাচীর তৈরি করা হয়েছে। মিডিয়াকে গণতন্ত্রের ‘চতুর্থ স্তম্ভ’ বলা হয়। এ সরকার দেশে বাক ও সাংবাদিকতার ঢল নেমেছে বলে টাইমস
পত্রিকায় লাখ পাউন্ড ব্যয় করে বিজ্ঞাপন দিয়েছে। অথচ মিডিয়ার ওপর এমন অত্যাচার-নির্যাতন
আইয়ুব খানের সামরিক স্বৈরতন্ত্রে কিংবা ব্রিটিশ আমলেও দেখা যায়নি। এ সরকারের আমলে
অন্তত ২৩ জন সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে। আহত হয়েছেন আরো অনেকে। মেহেরুন রুনি ও
তার স্বামী সাগরের মর্মান্তিক হত্যার তদন্তে অগ্রগতি করতে পুলিশ ব্যর্থ হয়েছে।
দিগন্ত ও ইসলামিক টেলিভিশন এখনো বন্ধ। আমার দেশ পত্রিকার মুদ্রণের ওপর নিষেধাজ্ঞা
প্রত্যাহার করা হয়নি। পত্রিকাটির সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে অন্যায়ভাবে প্রায় ছয়
মাস জেলে পুরে রাখা হয়েছে। এসবকে শেখ হাসিনা গণতন্ত্র বলতে পারেন; কিন্তু কোনো সুস্থ বুদ্ধির মানুষ বলবেন না।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন