শনিবার, ২৬ অক্টোবর, ২০১৩

টেলিফোনের রাজনীতি বনাম আন্দোলন


বেগম জিয়া ২৫ অক্টোবরের মহাসমাবেশে ঘোষণা করেছেন, আন্দোলন এবং সংলাপ দুই পথ ধরেই তিনি অগ্রসর হবেন। রাজনৈতিক কৌশল হিসাবে এটা সঠিক অবস্থান। কিন্তু তিনি কী অর্জন করতে চাইছেন সেটা এখনো সাধারণ জনগণের কাছে অস্পষ্ট। তাঁর রাজনীতির এই দিকটি সবচেয়ে দুর্বল। যখন লিখছি তখন শোনা যাচ্ছিল তাঁকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফোন করবেন। শেষমেশ ফোন করেছেন হরতাল প্রত্যাহার করবার জন্য, আন্দোলন থেকে তাঁকে সরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন মতাসীনেরা। তাঁকে গণভবনে নৈশভোজেও দাওয়াত দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। আরেকটি দারুণ খবর তাঁর লাল ফোন নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, প্রধানমন্ত্রী তা ঠিক করে দেবেন বলেছেন। খুব সুন্দর! সংলাপ শুরু হয়েছে!! শেখ হাসিনা যদি আদৌ ফোন করেন তো করেছেন আন্তর্জাতিক চাপে, বেগম জিয়াকেও কথা বলতে হবে আন্তর্জাতিক চাপেই। প্রধানত দিল্লি ও ওয়াশিংটনের খবরদারি মেনে। এর ফল কী হবে আমরা জানি না। বেগম জিয়া কী উত্তর দিয়েছেন এই লেখার সময় জানতে পারি নি। আমরা জানি, বাংলাদেশের মার্কিন রাষ্ট্রদূত দিল্লি গেছেন। তিনি দিল্লিকে যতই বোঝাক যে বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হোক, এবং দিল্লি তাতে সহযোগিতা করুক, দিল্লি শেখ হাসিনাকে ছাড়া অন্য কারো মতায় আসা ভাবতে পারে না, ভাববেও না। নিরাপত্তা, আঞ্চলিক বাণিজ্য ও আন্তর্জাতিক েেত্র দণি এশিয়ায় ভারতের আধিপত্য বজায় রাখার জন্য দিল্লি খালেদা জিয়াকে বিপজ্জনক মনে করে। মহাজোট কী করবে সেটা তারা জানে, বেগম জিয়া যাদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে থাকেন, তারা যেকোনো মূল্যে তাঁকে নির্বাচনে নিতে আগ্রহী। যেন তাঁকে ওয়াশিংটন-দিল্লির পায়ে কোরবানি দেওয়া যায়। দরকার হলে হাসিনার অধীনে নির্বাচন হলেও এদের অসুবিধা নাই। তাদের স্বার্থের জন্য বেগম জিয়াকে বলি দিতে এদের অনেকের খুব একটা অসুবিধা হবার কথা নয়। এই পরিস্থিতিতে বেগম জিয়া বাংলাদেশে জনগণের সঙ্গে থাকবেন, নাকি দিল্লি-ওয়াশিংটনের পথে গিয়ে আম ও ছালা দুটোই হারাবেন, সেটা তিনিই জানেন। আমরা বড়জোর তাঁর সুমতির জন্য হাত তুলে মুনাজাত করতে পারি। কেন তিনি হারাবেন? এটা যেকেউ কাণ্ডজ্ঞানেই বোঝে যে যদি শেখ হাসিনা কোনো মীমাংসা চান তাহলে তাঁকে তো কোনো টেলিফোন করবার দরকার নাই। টেলিফোনের রাজনীতি আমদানি হয়েছে বেগম জিয়ার আন্দোলনের কর্মসূচি পণ্ড করার জন্য। যে পদ্ধতিতে শেখ হাসিনা সংবিধান বদলিয়েছেন, সেই পদ্ধতিতেই সংবিধান বদলাবেন তিনি। কিম্বা তাঁকে মতায় রেখে নির্বাচন করবার অবস্থান থেকে তিনি সরে এসেছেন সেই সিদ্ধান্ত আগে জানাবেন। যদি তা-ও না চান, শুধু আলোচনা শুরু করতে চান, তাহলেও তো টেলিফোন লাগে না। দুই দলের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা বসে পড়লেই হয়। কিন্তু কিছু গণমাধ্যম, সুশীলসমাজ, ও অর্বাচীন লোকজন টেলিফোন করাকে বিরাট কিছুতে পরিণত করতে চাইছে। এখানে ফোন করার কিছু নাই। শেখ হাসিনা তাঁর প্রস্তাব তো নাকচ করেই দিয়েছেন। মহাজোটের লোকজন এখনো অঙ্গভঙ্গি ও অকথ্য ভাষাসহকারে তাঁকে সমালোচনা করছে। টেলিফোন করার পর তারা বলবে আমরা সমস্যা সমাধান করতে চেয়েছি, কিন্তু খালেদা জিয়ার জন্য সমাধান হয় নি। দিল্লি-ওয়াশিংটন প্রচার করে বেড়াবে, হাসিনা মহৎ, তিনি ফোন করেছেন, নৈশভোজে আমন্ত্রণ জানিয়েছেনও, লাল ফোন ঠিক করে দেবেন প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, কিন্তু খালেদা কোনো ইতিবাচক সিদ্ধান্ত দিতে পারে নি। মতাসীনদের তার বিরুদ্ধে প্রচারণার সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছেন তিনি।এই সরকারকে খালেদা জিয়া অবৈধ সরকার বলেছেন। অবশ্যই তিনি ঠিক বলেছেন। তাঁর এই ঘোষণার পর জনগণ রাস্তায় নেমে এসেছে। আন্দোলনের স্বতঃস্ফূর্ত বেগ দানা বাঁধছে। বেগম জিয়ার উচিত যারা তার আন্দোলনের শক্তি তাদের সঙ্গে সংযোগ বাড়ানো। এই অবৈধ সরকারকে হটিয়ে কিভাবে তিনি নির্বাচন করবেন তার রূপরেখা অবিলম্বে জনগণের সামনে হাজির করা। আন্তর্জাতিকভাবে কিভাবে তিনি বাংলাদেশে গণতন্ত্র কায়েম করবেন এবং শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনবেন তার পরিষ্কার পথরেখা দাখিল করা। টেলিফোনের সময় শেষ হয়ে গিয়েছে। তিনি আলটিমেটাম দিয়েছেন। প্রতিশ্রুতি মোতাবেক মতাসীনদের উত্তরের জন্য অপো করা ছাড়া তার আর কোনো কর্তব্য নাই। কিন্তু তিনি টেলিফোনের ফাঁদে পা দিয়ে উষ্টা খেয়ে পড়বার ব্যবস্থা করছেন। যে সকল গণমাধ্যম ও সুশীল লোকজন টেলিফোন করাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন, তাদের ধারণা, বাংলাদেশের মানুষ শিশু, তাদের হাতে তারা লজেন্স বা ললিপপ ধরিয়ে দিতে চাইছে! এত দিন খালেদা জিয়া বলেছেন, তিনি নির্দলীয় নিরপে তত্ত্বাবধায়ক সরকার চান। তারপর বলা শুরু করেছেন, তত্ত্বাবধায়ক নয়, নির্দলীয় নিরপে নির্বাচনকালীন সরকারে তাঁর অমত নাই, এখন বলেছেন বা তাঁর দলের তরফে এই ধারণা দেওয়া হয়েছে যে নির্বাচনকালীন সরকার হলেই হবে, তবে শেখ হাসিনার অধীনে কোনো নির্বাচনে যাবেন না। পাল্টা মতাসীনেরা বলেছেন, তারা সংবিধানের বাইরে কিছুই করবেন না। শেখ হাসিনাই নির্বাচনের সময় মতায় থাকবেন। একুশে অক্টোবর তাঁর সংবাদ সম্মেলনে তিনি বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারে ছিলেন এমন ব্যক্তিদের নিয়ে একটি সরকারের কথা বলেছেন। যেহেতু শেখ হাসিনা সংবিধানের বাইরে যাবেন না, অতএব তাদের সাংবিধানিকন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করতে প্রস্তাবিত ব্যক্তিদের নির্বাচনে পাস করিয়ে আনার কথা বলেছেন। কারা করবে সেটা? শেখ হাসিনা ও তার সংসদ? এগুলো অবাস্তব প্রস্তাব। দূতাবাসে তৈরি হওয়া প্রতিভাদীপ্ত রম্যরচনা। এতে খালেদা জিয়া জনগণের কাছে খেলো হয়েছেন এবং তাঁর ওপর জনগণের বিশ্বাস দুর্বল করে তুলছেন। যদি আন্দোলনের ওপর দাঁড়িয়ে মতাসীনদের তাঁর কথা শুনতে বাধ্য করতে চান, তাহলে তাঁকে আন্দোলনই করতে হবে। তা করতে হলে যারা তাঁর মাঠের মিত্র, যাদের সমর্থনে পাঁচটি সিটি করপোরেশান নির্বাচনে তিনি জিতেছেন তাদের আস্থায় রাখতে হবে। তাঁকে আঠারো দলীয় জোটকে শক্তিশালী করতে হবে। তাদের ব্যবহার নয়, জোটের শরিক হিসাবে পূর্ণমর্যাদায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় সঙ্গে রাখতে হবে। কিন্তু সবার আগে তাঁকে বলতে হবে তিনি মতায় গিয়ে কী অর্জন করতে চান। গত নির্বাচনে তড়িঘড়ি করে তাঁর দল যেভাবে থার্ড কাস নির্বাচনী ইশতেহার বের করেছিলÑ কোনো চিন্তা নাই, পরিকল্পনা নাই, প্রচারের কোনো কৌশল নাইÑ রাজনৈতিক আদর্শবিবর্জিত সে রকম কর্মসূচি দিয়ে আবারো যদি তিনি অল্প সময়ের ব্যবধানে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন, তিনি নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারবেন। তিনি কী ভাবছেন বা তার লোকজন কী ভাবছেন সেটা ২১ অক্টোবর সংবাদ সম্মেলনের বক্তব্যে আমরা দেখেছি। এই গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক মুহূর্তে বেগম জিয়ার বক্তব্য স্পষ্ট ও নির্দেশমূলক হওয়ার দরকার ছিল, কিন্তু তা হয় নি। বাংলাদেশের রাজনীতি কোন দিকে যেতে চাইছে তা আন্দাজ করার জন্য পাণ্ডিত্যের প্রয়োজন হয় না। দুই পরে মধ্যে তথাকথিত সমঝোতাবা আপোষহয় নি অতএব রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের মীমাংসা বল প্রয়োগের মধ্য দিয়েই নিষ্পন্ন হবে। এ নিয়ে হাহুতাশ করার কিছুই নাই। এর দায়দায়িত্ব পুরাটাই মতাসীনদের। মতাসীনেরা আইন-আদালত, পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবিসহ রাষ্ট্রের সকল শক্তি প্রয়োগের প্রতিষ্ঠানকে বিরোধী পরে বিরুদ্ধে ব্যবহার শুরু করে দিয়েছে। এর বিরুদ্ধে বিরোধী দলগুলোর রাজনৈতিক কৌশল ও প্রতিরোধের প্রস্তুতি কেমন সেটাই জনগণ দেখবার জন্য আগ্রহী। টেলিফোন-সংলাপ মার্কা ফালতু নাটক নয়। বলাবাহুল্য এই ধরনের পরিস্থিতিতে বলপ্রয়োগের মতাই রাজনীতিতে নির্ধারক ভূমিকা পালন করে। তবে এর পরিণতি নির্ভর করবে সমাজে রাজনৈতিক চিন্তাচেতনার মাত্রার ওপর। এই মুহূর্তে খালেদা জিয়া সামগ্রিক রাজনীতিকে কিভাবে মূল্যায়ন করছেন সেটা গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর মূল্যায়নের মতার ওপর নির্ভর করবে কী ধরনের নীতি ও কৌশল এই প্রতিরোধ-পর্বে তিনি গ্রহণ করবেন। এখানে ভুল করলে বিশাল খাদে তিনি পড়ে যেতে পারেন। সেখান থেকে তাঁর পে উঠে আসা খুবই কঠিন হবে। এটা ২০০৭ সাল নয়, ২০১৩ সাল। এক-এগারোর নায়কেরা একটি সঙ্ঘবদ্ধ রাজনৈতিক দল ছিল না। তারা সুশীলদের সুবিধাবাদী রাজনীতির ধারক হলেও আওয়ামী লীগ বা মহাজোটের মতো কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শে ঐক্যবদ্ধ ছিল না। মতাসীন মহাজোটের রাজনৈতিক মতাদর্শ হচ্ছে ইসলামবিদ্বেষ, ফ্যাসিবাদ ও বাংলাদেশকে দিল্লির অধীনস্থ করা। জনগণের সঙ্গে তাদের বিরোধের মূল জায়গাগুলো এখানে। একে জনগণ সমাজের নানান স্তর থেকে মোকাবিলা করছে। কেউ ঈমান-আকিদার জায়গা থেকে, কেউ জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের লড়াই হিসাবে, আবার কেউ বাংলাদেশের জনগণের ইতিহাস ও সংস্কৃতি হিসাবে। একটি বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক দল হিসাবে ইসলাম প্রশ্নে বিএনপির দৃষ্টিভঙ্গি আসলে কী সেটা এখনো স্পষ্ট নয়। তাদের মধ্যে কেউ শাহবাগের সমর্থক, আবার কেউ শাপলা চত্বরের। অনেকে মাঝখানে পেন্ডুলামের মতো একবার বাম দিকে একবার ডান দিকে হেলছে। এই ধরনের দল নিয়ে বড় কোনো নীতিগত আন্দোলন করা যায় না। রাজনৈতিক উদারবাদও না। কিন্তু নানান কারণে বাংলাদেশের জনগণের বিশাল একটি অংশ খালেদা জিয়ার ওপর নতুন করে ভরসা করছে। এই ভরসা কতোটুকু বাহ্যিক নাকি সারবস্তুসম্পন্ন সেটা আমরা এখন দেখতে থাকব। আসলে নির্বাচনে বিএনপিকে ভোট দেওয়া আর আন্দোলনে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বের ওপর ভরসা করার মধ্যে পার্থক্য আছে। আওয়ামী লীগ বিএনপির শত্রু, ইসলামপন্থীদেরও বটে। কিন্তু শত্রুর শত্রু আমার মিত্র এই কৌশল যথেষ্ট নয়। সুনির্দিষ্ট নীতি ও সঙ্গতিপূর্ণ কৌশল দরকার। দ্বিতীয়ত গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বিদ্যমান ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার রূপান্তর ছাড়া বাংলাদেশে ন্যূনতম লিবারেল বা উদার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তনও এখন অসম্ভবÑ সেটা শুধু বিএনপি ও তার জোটের শরিকদের নয়, ফ্যাসিবাদবিরোধী সব নাগরিককেই বুঝতে হবে। আর খালেদা জিয়াকে বুঝতে হবে, আন্দোলনের যেকোনো পর্যায়ে আপোষ করে তিনি নির্বাচনে জয়ী হয়ে আসতে পারবেন, কিন্তু ফ্যাসিবাদের মতাদর্শিক, রাষ্ট্রীয় ও প্রাতিষ্ঠানিক খুঁটি উপড়ে ফেলতে না পারলে তিনি মতা ধরে রাখতে পারবেন না। মিসরের ঘটনাবলি থেকে তিনি কিছুটা শিা নিতে পারেন। তৃতীয়ত রয়েছে দিল্লিকে মোকাবিলার প্রশ্ন। সেটা নিছকই দিল্লির সঙ্গে সুসম্পর্ক নয়Ñ নতুনভাবে একটি জাতীয় প্রতিরাব্যবস্থা গড়ে তোলা। মহাজোট সরকার গত পাঁচ বছরে সেটা ধ্বংস করে দিয়েছে। তার জোটের শরিকদের মধ্যে এই ধরনের উপলব্ধি যেন না হয় যে তিনি তার রাজনৈতিক স্বার্থে জোটের শরিকদের ব্যবহার করছেন, কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতি, রাষ্ট্রব্যবস্থা ও প্রতিরার প্রশ্নে সকলের সঙ্গে সুনির্দিষ্ট নীতি ও কৌশল তাঁকে গড়ে তোলা অনেক আগেই জরুরি ছিল। শুধু বক্তৃতা যথেষ্ট নয়। লড়াই সুস্পষ্ট ভাবে ফ্যাসিবাদ ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে জনগণের সংগ্রাম হিসাবে হাজির হতে থাকবে। জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত হবার রাজনীতি তিনি কিভাবে হাজির করেন তার ওপর তার নেতৃত্বের নিশ্চয়তা নির্ভর করছে। ২১ অক্টোবর সংবাদ সম্মেলনে তার বক্তব্যের যে দিকটা বিশেষ ভাবে লণীয় সেটা হচ্ছে সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদ সম্পর্কে যতটুকু বলা দরকার অতি উৎসাহী হয়ে তিনি তার চেয়েও অনেক বেশি বলেছেন। তিনি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্তযুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের স্থানীয় বরকন্দাজ হতে চান, যে যুদ্ধ মূলত পরিচালিত হচ্ছে ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে, তিনি সেই যুদ্ধে পাশ্চাত্য শক্তির অংশীদার হতে চান, তাদের হাত মজবুত করতে চান। পাশ্চাত্যের হয়ে তিনি এ দেশের জনগণের বিরুদ্ধে লড়তে চান। যে র‌্যাবকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো ঘাতক বাহিনীআখ্যা দিয়েছে, তিনি তার জন্য গর্বিত। এর আগেও তিনি এই ধরনের ভুল গর্বে গর্বিত হয়েছেন। নাগরিক ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায় তাঁর ওপর কালো ছায়ার মতো ঝুলছে। আজ যখন জনগণ মানবিক ও নাগরিক অধিকার অর্জনের জন্য লড়ছে, তখন তার চরম মানবাধিকারবিরোধী অবস্থান নেওয়া ঠিক হয় নি। এই অবস্থান তাঁর রাজনৈতিক শক্তি ও সমর্থনের ভিত্তিকে দুর্বল করবে। তাছাড়া বেগম জিয়া ভুলে যাচ্ছেন তিনি যতই চেষ্টা করেন না কেন, বাংলাদেশে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্তযুদ্ধের সেনাপতি শেখ হাসিনা। তিনি শত চেষ্টা করেও শেখ হাসিনার চেয়ে বেশি ফ্যাসিস্ট হতে পারবেন না। এবং ফ্যাসিস্টরাই পরাশক্তির পছন্দ। শেখ হাসিনার সঙ্গে প্রতিযোগিতার ত্রে এটা নয়। বরং ফ্যাসিবাদ ও ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াইটাই তাঁর জায়গা। সেই জায়গা তিনি অলঙ্কৃত করতে না চাইলে তা খালি থাকবে না। আমি বারবারই বলে আসছি, তাঁকে ঘিরে আছে এমন কিছু শক্তি যারা তাঁকে পরাশক্তির ইচ্ছামতো পরিচালিত করতে চান। এতে তাঁদের নিজেদেরও লাভ আছে। তারা তাঁকে সারাণই বিভ্রান্ত করছে ও ভুল পথে নিয়ে যাচ্ছে। তাঁকে বাংলাদেশের জনগণের বিপরীতে দাঁড় করাচ্ছে। কিন্তু তিনি যদি সত্যিই দেশনেত্রী হতে চান তাহলে তাঁকে এদের জাল ছিন্ন করে জনগণের পাশে দাঁড়াতে হবে। তিনি শেখ হাসিনাকে টালবাহানা বন্ধ করার কথা বলেছেন, এ েেত্র তাঁকেও টালবাহানা বন্ধ করতে হবে। বিএনপি কোনো বিপ্লবী দল নয়, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিভাষায় এ ধরনের দল উদার রাজনৈতিক (liberal) দল বলে পরিচিত। তারপরও সীমিত রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে এই দলটি অনেক কিছুই করতে পারে। করার আছে। যেমন নাগরিক ও মানবিক অধিকার নিশ্চিত করা, বাক, ব্যক্তি ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা, শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করবার অধিকার স্বীকার করা এবং কারখানায় তাদের প্রাণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, সীমান্তে হত্যা বন্ধ করা, প্রাণ ও পরিবেশের তি না করা, দুর্নীতি না করা, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তপনা বন্ধ করা, দিল্লির আগ্রাসন থেকে রা, অবাধ বাজারের নামে সাম্রাজ্যবাদী লুণ্ঠন বন্ধ করা, ইত্যাদি। বিএনপি এই ন্যূনতম কাজগুলো করবে জনগণ সেই প্রতিশ্রুতি তাঁর কাছ থেকে চায়। এখন আওয়ামী লীগ যদি হঠাৎ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করে বসে তাহলে নির্বাচনে যাবার পরিস্থতি সৃষ্টি হলেও বিএনপিএই প্রতিশ্রুতি দেবার সময় পাবে না। কিন্তু তিনি এখনো সুনির্দিষ্ট কোনো প্রতিশ্রুতি দেন নি। মনে রাখা দরকার আমরা অবাস্তব নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ও প্রপাগান্ডামূলক কর্মসূচির কথা বলছি না। বলছি এমন কিছু নীতিগত সংস্কারের কথা যা জনগণকে আশার বাণী শোনায়, এবং যার বাস্তবায়ন তাঁর দল বা আঠারো দলীয় জোটের পে বাস্তবায়ন করা সম্ভব। যেমন পঞ্চদশ সংশোধনীর পর যে অগণতান্ত্রিক, নাগরিক ও মানবাধিকারবিরোধী সংবিধান আমাদের ঘাড়ের ওপর বাঘের হিংস্র নখের মতো বসে রয়েছে আর আমাদের ক্রমাগত রক্তরণ ঘটাচ্ছে, তিনি কিভাবে তার সংস্কার করবেন। কিম্বা আদৌ করবেন কি না আমরা এখনো জানি না। গণমাধ্যমের ওপর যে নিপীড়ন চলছে সেই নিপীড়নের বিবিধ কালো আইন তিনি বাতিল করবেন কি না। তিনি মাহমুদুর রহমান, আদিলুর রহমান খানের ওপর দমন-নিপীড়নের কথা বলেছেন, অবশ্যই। কিন্তু এই নিপীড়ন বন্ধ করতে হলে তাঁকে তো বিচারব্যবস্থার সংস্কার করতে হবে, দুষ্ট বিচারকদের হাত থেকে নাগরিকদের মুক্তি দিতে হবে, পুলিশ ও প্রশাসনের ট্রিগার হ্যাপি সন্ত্রাসীদের শাস্তি দিতে হবে। ইত্যাদি। তিনি এই সকল সুনির্দিষ্ট বিষয় সম্পর্কে কিছুই বলেন নি। তিনি প্রতিহিংসার রাজনীতি করবেন না বলেছেন, সেটা খুবই ভালো নীতি। এ কথা তাঁর বারবার বলা দরকার। কিন্তু যারা গণহত্যা করেছে, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করেছে, মানুষ গুম করেছে, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে, আলেম-ওলামাদের আলো নিভিয়ে নির্বিচারে হত্যা করেছে, নিজেরা কোরআন শরিফ পুড়িয়ে আলেম-ওলামাদের ওপর দোষ চাপিয়ে দিয়েছেÑ তাদের মা করে দেবার অধিকার তো জনগণ তাঁকে দেয় নি। প্রতিহিংসা অবশ্যই নয়, কিন্তু ন্যায়সঙ্গত বিচার থেকে কাউকে রেহাই দেবার অধিকার তাঁর নাই। কারোরই নাই। এই প্রত্যাশাগুলোকেই তিনি লম্বা দাবিনামা বা অনর্থক বিশাল তালিকা না বানিয়ে সহজে বলতে পারেন যে একাত্তরে স্বাধীনতার ঘোষণা ছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ইনসাফের ভিত্তিতে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন করা। তিনি মতায় এসে মুক্তিযুদ্ধের সেই ঘোষণাই বাস্তবায়িত করবেন। আসলেই আমরা মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় স্তরে প্রবেশ করতে চাইছি। জয় শাহবাগ! এটা সত্য যে তিনি নতুন ধারার রাজনীতির কথা বলেছেন এবং বিমূর্ত হলেও তার কিছু রূপরেখা দেবার চেষ্টা করেছেন। ওর মধ্যে আবেগ ও আশা আছে, কিন্তু নতুন ভবিষ্যৎ তৈরির কোনো সুচিন্তিত সূত্র নাই। তবু তিনি যখন নিজের ভুলত্রুটি অকপটে স্বীকার করেন, তখন তাঁকে প্রশংসা না করে পারা যায় না। তিনি বলেছেন, “প্রিয় সাংবাদিকবৃন্দ, মানুষ ভুলত্রুটির ঊর্ধ্বে নয়। এবং এ কথা স্বীকার করতে আমার কোনো দ্বিধা নেই যে, অতীতে আমাদেরও ভুলভ্রান্তি হয়েছে। তবে একই সঙ্গে আমি বলতে চাই যে, আমরা ওই সব ভুল থেকে শিা নিয়েছি। আগামীতে একটি উজ্জ্বল, অধিক স্থিতিশীল ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের পথে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে আমরা ভালোভাবে প্রস্তুতি নিয়েছি। আমি সেই প্রবচনের সঙ্গে একমত যে, ইতিহাস থেকে শিা না নিলে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে। তাই আমরা অতীতের ভুলগুলোর পুনরাবৃত্তি করবো না।এই কথাগুলো আমাদের সোনার অরে খোদাই করে রাখা দরকার। কারণ এই কথার ওপর দাঁড়িয়েই আগামি দিনে জনগণ তাঁকে মূল্যায়ন করবে। কিন্তু চিন্তার বিষয় হচ্ছে বিদেশীদের সন্তুষ্ট রাখবার ভুল ও হীনম্মন্য নীতি তিনি এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেন নি। স্বীকার করি, পরাশক্তির সঙ্গে সম্পর্কের েেত্র তাঁকে কৌশলী হতে হবে। কিন্তু সেটা দেশের ও জনগণের স্বার্থের বিনিময়ে নয়। তিনি এত দিন শুধু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন চেয়ে আসছেন। আমি অনেকবারই তার সমালোচনা করেছি। তিনি মতার রাজনীতি করেন, মতায় যেতে চান, এতে কোনো অসুবিধা নাই। সেটা অন্যায়ও নয়। আমরা অনেকেই বারবার তাঁকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছি, বিএনপি কোনো বিপ্লবী দল নয়, ফলে এতটুকুই বিএনপির কাছে আশা করা ন্যায্য যে তাঁরা অতীতের দুর্নীতিপরায়ণ চরিত্র ও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তপনা থেকে যথাসম্ভব নিজেদের সংশোধন করে একটা উদার কিন্তু গণতান্ত্রিক নীতির চর্চা করবেন। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে সেটাও কঠিন কাজ। এর অর্থ হচ্ছে পঞ্চদশ সংশোধনীর পর সংবিধানের যে দুর্দশা ঘটেছে, সেই সংবিধান বহাল রেখে গণতন্ত্র কায়েম ও চর্চা রীতিমতো অসম্ভব। এই সত্য মাথায় রেখেই তাঁকে আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হবে। গণ-অভ্যুত্থান ছাড়া বাংলাদেশের জনগণের সামনে আর কোনো পথ মতাসীনেরা রাখে নি। তিনি চান বা না চান বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সেই দিকে যাবারই সমূহ সম্ভাবনা। বুর্জোয়া দল হিসাবে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের বাধ্যবাধকতার মধ্যে থাকলেও এই বাস্তবতাকে অস্বীকার করলে তিনি নিজেকে গৌণ শক্তিতে পরিণত করবেন। ষাট ও সত্তর দশকে শেখ মুজিবুর রহমান আইনি পরিমণ্ডলে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিই করেছিলেন। কিন্তু তা আইন ও নিয়মতান্ত্রিকতার সীমা অতিক্রম করে গণভ্যুত্থান ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে রূপ নেয়। কিলিয়ে কাঁঠাল পাকানো যায় না, ঠিক, কিন্তু ফল পেকে গেলে সেটা পাড়তে না পারলে সেই ফল বাদুড়ের খাদ্য হয়।বাংলাদেশের মানুষ বিদ্যমান রাজনৈতিক বাস্তবতার কারণে এখন বেগম জিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। তিনি কী বলবেন না বলবেন সেটা তাঁকে অনেক সাবধানে ও বহু কিছু বিবেচনা করে বলতে হবে। পরাশক্তি তাঁকে মতায় আনবে না, জনগণই আনবে। যদি তারা চায়। পরাশক্তি যদি কাউকে আনে তবে তারা হচ্ছে তথাকথিত তৃতীয় শক্তি। তিনি নন। যারা এলে এবার দুই বছর নয়, আরো দীর্ঘকাল থাকবে। আন্দোলনের প্রতিটি পর্যায়ে তথাকথিত তৃতীয় শক্তির হস্তেেপর সম্ভাবনা সবসময়ই থাকবে। অতএব ঢাকার কূটনৈতিক মহলের সঙ্গে সৌহার্দ্য থাকুক, কিন্তু তাদের হাত ধরে চলার নীতি বেগম জিয়াকে ত্যাগ করতে হবে। বিশেষত তিনি যদি বলেন যে দিল্লি ও ওয়াশিংটনের তথাকথিত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অন্যায়, সহিংস ও মানবতাবিরোধী যুদ্ধে তিনি বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে লড়বেন, তাহলে ইসলামধর্মাবলম্বী সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশের জনগণ তাঁর পেছনে দাঁড়াবে কেন? শেখ হাসিনা এই নীতি নিয়েছেন বলেই জনগণ তাকে প্রত্যাখ্যান করছে। আর যারা এই নীতির সমর্থক তারাই বাংলাদেশে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার ভিত্তি। এই সরল কাণ্ডজ্ঞান আমরা যেন না হারাই। 


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads