সোমবার, ৭ অক্টোবর, ২০১৩

দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক


সম্প্রতি একই দিনে অনুষ্ঠিত চারটি সিটি করপোরেশনের (রাজশাহী, খুলনা, সিলেট ও বরিশাল) মেয়র নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়র প্রার্থীরা বিরোধী ১৮ দলীয় জোটের প্রার্থীদের কাছে বিপুল ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হলে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা সংসদে তার প্রদত্ত বক্তব্যে নির্বাচিত সরকারের অধীনে নির্বাচনের প্রস্তুতি নেয়ার জন্য বিরোধী দলের প্রতি আহ্বান জানান। প্রধানমন্ত্রীর এ আহ্বানে বিরোধী দলের নেতারা ইতিবাচক সাড়া না দিয়ে পাল্টা দাবি উত্থাপন করে অবিলম্বে তত্ত্বাবধায়কের বিল এনে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করতে বলেন। সংবিধানের বর্তমান বিধান অনুযায়ী মেয়াদ অবসানের কারণে সংসদ ভেঙে যাওয়ার ক্ষেত্রে ভেঙে যাওয়ার পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে এবং মেয়াদ অবসান ব্যতীত অন্য কোনো কারণে সংসদ ভেঙে যাওয়ার ক্ষেত্রে ভেঙে যাওয়ার পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে সংসদ সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করতে হবে। সংসদ সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন-পরবর্তী একটি সংসদের মেয়াদ পাঁচ বছর এবং সংসদের প্রথম বৈঠকের তারিখ থেকে এ পাঁচ বছর সময়কাল গণনা করা হয়। নবম সংসদের প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২৫ জানুয়ারি, ২০০৯ এবং সে হিসাব অনুযায়ী পাঁচ বছর মেয়াদ অন্তে ২৪ জানুয়ারি, ২০১৪ সংসদ ভেঙে যাওয়ার পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে হবে অর্থাৎ ২৪ অক্টোবর, ২০১৩ থেকে ২৪ জানুয়ারি, ২০১৪ এর মধ্যবর্তী ৯০ দিন সময়ের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করতে হবে। সংবিধানের বর্তমান বিধান অনুযায়ী সংসদ ভেঙে যাওয়ার পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হলে সংসদ বহাল রেখে নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে। পৃথিবীর অপর কোনো গণতান্ত্রিক দেশে সংসদ বহাল থাকাবস্থায় সংসদ সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় না এবং এ অবস্থায় নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হলে নির্বাচনের নিরপেক্ষতা যে প্রশ্নবিদ্ধ হবে এমন ধারণা পোষণ অমূলক নয়। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দাবি তাদের অধীনে স্থানীয় সরকারের প্রায় দুই হাজার ৫০০ ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভা এবং ৯টি সিটি করপোরেশনের নির্বাচন স্বচ্ছ হয়েছে। তাই আগামী সংসদ সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন তাদের দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হলে নির্বাচনের স্বচ্ছতা কোনোভাবেই ক্ষুণœ হবে না। আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হওয়ার পরবর্তী ৯টি সিটি করপোরেশন নির্বাচন পর্যালোচনায় দেখা যায়, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার দ্বারা গঠিত নির্বাচন কমিশনের তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। অপর ছয়টি সিটি করপোরেশন নির্বাচন যথাÑ রংপুর, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেট ও গাজীপুরের নির্বাচন বর্তমান সরকার দ্বারা গঠিত নির্বাচন কমিশনের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়েছে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে সেনা মোতায়েনের জন্য বলা হলেও সরকার তাতে সাড়া দেয়নি। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপি ও তাদের সমর্থিত প্রার্থীদের পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশনের কাছে সেনা মোতায়েনের দাবি করা হলে তা সরাসরি অগ্রাহ্য করা হয়। স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয় ভিত্তিতে না হওয়ার কথা থাকলেও অতীতে যেমন বিষয়টি উপেক্ষিত হয়েছে, বর্তমানেও উপেক্ষিত হয়ে আসছে। তা ছাড়া দেখা গেছে, দলীয় ভিত্তিতে হওয়ার কারণে জাতীয় ইস্যু সরাসরি নির্বাচনকে প্রভাবিত করছে যার ফলে স্থানীয় উন্নয়ন বিজয়ের ক্ষেত্রে আশানুরূপ অবদান রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে। তবে এ কথাটিও ঠিক যে, স্থানীয় সরকারের অধীন বাস্তবায়নাধীন বিভিন্ন উন্নয়ন কাজের মান নিয়ে জনগণের অসন্তোষ রয়েছে। স্থানীয় বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী উন্নয়ন কাজের প্রকারভেদে বরাদ্দের ২০-৫০ ভাগ মেয়র, চেয়ারম্যান, কমিশনার ও দলীয় নেতাকর্মীদের পকেটস্থ হয়। অনুসন্ধানে জানা যায়, একজন মেয়র বা চেয়ারম্যানের প্রথম দফা নির্বাচিত হওয়ার পর পরবর্তী দ্বিতীয় দফা নির্বাচনকালীন সময়ে সম্পদের বহু গুণ বৃদ্ধি ঘটে। ক্ষমতা ও পদ অন্যায়ভাবে ব্যবহারের মাধ্যমে সহজে অর্থ উপার্জনের যে পথ সৃষ্টি করা যায় তা বর্তমানে ব্যবসার মাধ্যমে সম্ভব না হওয়ায় ব্যবসায়ীরা অধিকহারে রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ছেন। আওয়ামী লীগ প্রধান যদিও সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপিসমর্থিত প্রার্থীদের বিজয়কে দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের যৌক্তিকতা হিসেবে দাঁড় করাচ্ছেন কিন্তু প্রধান বিরোধী দল বিএনপি আওয়ামী লীগ প্রধানের দাবির সাথে একমত নন। তাদের ভাষ্য মতে, স্থানীয় নির্বাচন ও জাতীয় নির্বাচন এক নয়। ইতঃপূর্বে দলীয় সরকারের অধীনে সিটি নির্বাচনে বিরোধীদলীয় প্রার্থীর বিজয়ের একাধিক নজির থাকলেও দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনে বিরোধী দলের বিজয়ের একটি নজিরও নেই। তারা আরো বলেন, সম্প্রতি অনুষ্ঠিত পাঁচটি সিটি নির্বাচন সম্পূর্ণ অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হলে, নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসন পক্ষপাতদুষ্ট না হলে এবং সেনা মোতায়েন করা গেলে ভোটের ব্যবধান আরো অধিক হতো। নির্বাচন কমিশন বিষয়ে বিএনপির নেতাদের সুনির্দিষ্ট বক্তব্য অনুযায়ী চারটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনের দিন দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত কোনো নির্বাচন কমিশনারকে তাদের কক্ষে পাওয়া যায়নি। সেদিন প্রধান নির্বাচন কমিশনার বেলা দেড়টায় তার কার্যালয়ে এসেছেন এমন তথ্যই পাওয়া যায়। নির্বাচন কমিশনের একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন যেকোনো নির্বাচনে ভোটগ্রহণ পর্ব শুরু হওয়ার পর সকালের দিকে অধিক অনিয়ম হয় এবং সে সংক্রান্ত যেকোনো অভিযোগ উপেক্ষা করার জন্যই ইচ্ছাপূর্বক তাদের কমিশনে বিলম্বে আগমন ঘটে। আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের বিপর্যয়কে সেভাবে গুরুত্ব দিয়ে না দেখলেও তার সরকারের প্রভাবশালী অর্থমন্ত্রী মুহিতের অভিমত অনুযায়ী এ বিপর্যয় সরকারের জন্য একটি অশনি সঙ্কেত। এ প্রসঙ্গে যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, সিটি করপোরেশন নির্বাচনে যে দল পরাজিত হবে তাদের জন্য এটি আগামী নির্বাচনে সতর্ক বার্তা হিসেবে কাজ করবে। আমাদের পার্শ্ববর্তী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারতসহ পৃথিবীর উন্নত দেশে নির্বাচন-পরবর্তী আনুষ্ঠানিক ফলাফল ঘোষণার আগে মূল প্রতিদ্বন্দ্বী দলের যেকোনো একটির শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে যখন নির্বাচনের জয়-পরাজয়ের ফলাফল স্পষ্ট হয়ে ওঠে তখন বিজিত প্রার্থী প্রথম যে দায়িত্বটি পালন করে থাকেন তা হলো বিজয়ী প্রার্থীকে অভিনন্দন জানিয়ে তার সাফল্য কামনা। ওই সব দেশের সাধারণ জনগণ এ কাজটিকে উন্নত মানসিকতা সম্পন্ন ইতিবাচক হিসেবে দেখে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য পৃথিবীর উন্নত গণতান্ত্রিক দেশের মতো আমরা আমাদের মন মানসিকতা সেভাবে উন্নত করতে পারিনি। আমরা পরাজয়কে পরাজয় হিসেবে না দেখে কারচুপি হিসেবে দেখি। এ সংস্কৃতি থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত সিটি করপোরেশন নির্বাচনে এ সংস্কৃতি থেকে আমরা কিছুটা বের হয়ে আসতে পারলেও জাতীয় নির্বাচনে পারব কি না সে বিষয়ে সংশয় রয়েছে। এ প্রসঙ্গে এক রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলেন, আমাদের বড় দুটি দলের শীর্ষ নেতৃত্বের একজনের সাথে অপরজনের যেখানে মুখ দেখাদেখি নেই এবং যেখানে একজনকে দেখলে অপরজন কথা না বলে এড়িয়ে চলেন সেখানে অভিনন্দন জানাবেন কিভাবে? সিলেট সিটি নির্বাচনের আনুষ্ঠানিকভাবে ফলাফল ঘোষণার আগে বিজিত মেয়র বদরুদ্দীন আহমেদ কামরান ফলাফল গ্রহণ করে যেভাবে বিজয়ী মেয়র আরিফুল হককে অভিনন্দন জানিয়ে উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন তা আমাদের রাজনৈতিক নেতারা অনুসরণ করতে পারলে রাজনৈতিক ময়দানে মারামারি, কাটাকাটি ও হানাহানির অবসান ঘটবে এমন আভাসই পাওয়া যায়। এ উদাহরণ দ্বারা অভিভূত হয়ে সিলেট স্থানীয় বিএনপির অনেক নেতার মন্তব্য এর দ্বারা বিজিত প্রার্থী কামরান আগামী নির্বাচনে বিজয়ের বীজ বপন করেছেন। সম্প্রতি একই দিনে অনুষ্ঠিত চার সিটি করপোরেশন নির্বাচনের অপর বৈশিষ্ট্য হলো রাজশাহীর বিজয়ী মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল, খুলনার বিজয়ী মেয়র মনিরুজ্জামান মনি এবং সিলেটের বিজয়ী মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী নির্বাচনের পর দিন ফুলের মালা ও মিষ্টি নিয়ে পরাজিত বিদায়ী মেয়রের বাড়িতে উপস্থিত হয়ে সামনের দিনে পথ চলায় তাদের সাহায্য ও সহযোগিতা কামনা করেন। তাদের এ উদারতা ও মহানুভবতা সব মহল কর্তৃক প্রশংসিত হয়েছে, যা প্রকারান্তরে তাদের সবার কাছে অধিক গ্রহণযোগ্য করতে সহায়ক বলে বিবেচিত হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বরিশালের বিজয়ী মেয়র আহসান হাবিব কামালের সঙ্কীর্ণতাকে অনেকে মেনে নিতে পারছেন না। সিটি করপোরেশনের একজন বিজিত প্রার্থী এবং তিনজন বিজয়ী প্রার্থী ফলাফল মেনে নিয়ে, অভিনন্দন জানিয়ে এবং পরাজিত প্রার্থীর বাড়িতে উপস্থিত হয়ে তাকে মিষ্টি খাইয়ে ও ফুলের তোড়া দিয়ে শুভেচ্ছা জানিয়ে আমাদের দেশের অতীত রাজনীতির সংস্কৃতির ব্যত্যয়ে যে দুর্লভ নজির সৃষ্টি করেছেন আমাদের জাতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে এটির প্রসারণ ঘটলে দেশের স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধি কোনোভাবে ব্যাহত হওয়ার অবস্থা সৃষ্টি হবে না। আওয়ামী লীগ দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর তাদের বিরুদ্ধে ব্যর্থতা, দুর্নীতি ও অনিয়মসংক্রান্ত যেসব অভিযোগ রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ, শেয়ারবাজার, পদ্মা সেতু দুর্নীতি, রেলের কালো বিড়াল দুর্নীতি, টেলিযোগাযোগ সংশ্লিষ্ট দুর্নীতি, প্রশ্নপত্র ফাঁস দুর্নীতি, সরকারের উচ্চপদে দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ দুর্নীতি প্রভৃতি। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, একটি বিশেষায়িত মন্ত্রণালয়ের সচিব পদে শুধু দলীয় বিবেচনায় প্রায় দুই শর কাছাকাছি জ্যেষ্ঠ, উৎকৃষ্ট, দক্ষ, মেধাবী ও সৎ কর্মকর্তাকে বঞ্চিত করে সার্বিক বিবেচনায় নিকৃষ্ট একজনকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। অনুরূপ অপর এক কর্মকর্তা দুই শতাধিক কর্মকর্তাকে অতিক্রান্ত করে রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গের সাংবিধানিক পদ লাভে সক্ষম হয়েছেন। এ ধরনের পাহাড়সম অভিযোগ রয়েছে। আওয়ামী লীগের ত্যাগী ও বঞ্চিত নেতাকর্মী এবং সমর্থকদের অভিমত ভোটের ময়দানে এসব অভিযোগ মোকাবেলার কোনো যুক্তিগ্রাহ্য বক্তব্য আছে কি? আর এ কথা নিশ্চিত বলা যায়, মোকাবেলা করার মতো যুক্তিগ্রাহ্য বক্তব্য না থাকলে বিপর্যয় অনিবার্য। সম্ভবত সে বিপর্যয়কে আঁচ করতে পেরেই আওয়ামী লীগ প্রধান দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে অনড়। কিন্তু তাকে ভুলে গেলে চলবে না তিনি যদি রাজনীতির মাঠে তার দলের সরব উপস্থিতি প্রত্যক্ষ করতে চান সে ক্ষেত্রে তাকে জনআকাক্সার প্রতি সম্মান দেখিয়ে সঠিক পথ বেছে নেয়াই উত্তম। আর সেই সঠিক পথ কী তা আজ আর কারো অজানা নয়।


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads