বুধবার, ৩০ অক্টোবর, ২০১৩

বল আবার প্রধানমন্ত্রীর কোর্টে


দুই নেত্রীর ফোনালাপ এখন সবার জানা। তাদের পালস রেটও বোঝা হয়ে গেছে। দাওয়াত দেয়ার জন্য ফোনালাপে তারা এত কথা বলতে গেলেন কেন? তারা কি ফোনেই সংলাপ-সমঝোতা-আপসরফা শেষ করতে চেয়েছেন। না, তা চাননি। তাহলে কি মনের ভেতর জমাট বাঁধা ক্ষোভগুলো উগড়ে দেয়াটাই লক্ষ্য ছিল। যেভাবেই মূল্যায়ন করা হোক, বিরোধীদলীয় নেতা ফোনালাপে বেশি সিমপ্যাথি পাবেন। এটা পাবেন বাগি¦তণ্ডায় জিতে যাওয়ার জন্য নয়, বিরোধীদলীয় অবস্থানের জন্য। রাজনৈতিভাবে মজলুম হওয়ার কারণে। তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত থাকার জন্যও। আমরা ভুলে যেতে চাই নাÑ সংলাপের পথ ধরে এ দেশে রাজনৈতিক সঙ্কটের সমাধান হওয়ার তেমন কোনো নজির নেই। তারপরও আমরা সংলাপ ও সমঝোতার পক্ষে। এই পক্ষে থাকার যুক্তি একটাই, ‘যদিসমাধানের কোনো পথ খুঁজে পাওয়া যায়। হতেও তো পারেÑ এ প্রক্রিয়ায় বরফ গলবে। 
এখন রাজনীতি যেখানে এসে ঠেকেছে সেখান থেকে সঙ্কট উত্তরণের সহজ পথ বেরোবে বলে মনে হয় না। এর কারণ ১৪ দল বর্তমান রাজনৈতিক সঙ্কটকে বিপ্লব-প্রতিবিপ্লবের ধারায় ফেলার একটা ব্যর্থ চেষ্টা চালাচ্ছে। বর্তমান সমস্যাকে রাজনৈতিক সঙ্কটের পর্যায়ে রেখে সমাধানের পথ খুঁজলে রাজনৈতিক দিশা মিলতো। সাংবিধানিক সঙ্কটের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে ভাবলেও নিস্তার ছিল। দুই দল ও জোটের ভেতর ক্ষমতার দ্বন্দ্ব বললেও একটা আশাবাদ জন্ম নিত। বিপ্লব-প্রতিবিপ্লবের প্রশ্ন ওঠার পর এখন আর সহজ পথে কোনো আশাবাদ নেই। 
বিপ্লবীরা অর্থাৎ ক্ষমতাসীন ১৪ দলীয় জোট বিপ্লব রক্ষার সংগ্রামের ব্রত নিয়ে প্রতিবিপ্লবী শক্তি অর্থাৎ বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটকে ঠেকানোর যুদ্ধে নেমেছে। এ যুদ্ধ আর সংলাপ দিয়ে শেষ হবে না। রাজপথই বলে দেবে কারা বিপ্লবী, কারা প্রতিবিপ্লবী। ১৪ দল যে বিপ্লবের কথা শোনাচ্ছে তা যদি কালমার্কস, লেনিন কিংবা চেয়ারম্যান মাও শুনতেন তাহলে আত্মহত্যা করতে চাইতেন। এখন সম্ভবত তারা কবরেও অস্বস্তিবোধ করছেন। 
বেগম খালেদা জিয়া ১৯৯০ সালে রাজপথ মাড়িয়ে একটি সফল গণ-অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেয়ার অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন। চারবার বিরোধী দলে থেকে লড়াই করার অভিজ্ঞতা তার রয়েছে। দুই দফা পূর্ণকালীন, আরেক দফা খণ্ডকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। যাদের সাথে তিনি রাজনীতি করে রাজপথে ও ক্ষমতায় সময় অতিবাহিত করেছেন তারা এখন তাকে বিপ্লব শেখাচ্ছেন। এরাই এরশাদকে বরণ করেছিলেন। এরশাদের পাতানো নির্বাচনে খালেদা জিয়াকে রাজপথে রেখে এরাই অংশ নিয়েছেন। আগের দিন ফতোয়া দিয়েছিলেন, যারা স্বৈরাচারের পাতানো নির্বাচনে যাবে তারা মীরজাফর বা জাতীয় বেঈমান হিসেবে চিহ্নিত হবে। এর পরেও তারাই মইন-ফখরুদ্দীনদের মতো লোকদেরও আশীর্বাদ নিয়েছেন। সেই ছদ্মবেশী সামরিক সরকারকে তাদের আন্দোলনের ফসল বলেছেন। এখন সেই ১৪ দলীয় শক্তি যাদের মধ্যে পতিত বাম, উচ্ছিষ্টভোগী কমিউনিস্ট, বোল পাল্টানো তথাকথিত সমাজতন্ত্রীরাই বিপ্লবী সেজে গেছেন। যারা বড় দলের কোলবালিশ হওয়া ছাড়াও রাজনৈতিকভাবে গণবিছিন্ন, চরিত্রগতভাবে উঁচু স্তরের চাঁদাবাজ, শ্রেণিচরিত্র যাদের বুর্জোয়া, অবস্থা যাদের স্খলিত আদর্শবাদী তারাই এখন ফ্যাসিবাদ, আধিপত্যবাদ ও স্বৈরাচারের তৈরি করা নর্দমার ডোবায় আপাদমস্তক নিমজ্জিত। 
বর্তমান সরকার মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়া সরকার। বর্তমান সংসদ মেয়াদপূর্ণ হওয়া সংসদ। এই সরকার নৈতিকভাবে দেউলিয়া। তারা যখন কাচের ঘরে বসে অন্যদের ঢিল ছুড়ে মজা পান তখন অদূরে কোথাও বসে শয়তানও পিশাচের মতো কুটিল হাসি হাসে। আর ১৪ দল যখন সংবিধান রক্ষা ও কাতুকুতু মার্কা বিপ্লবের গল্প শোনায় তখন ভূতপ্রেতও অট্টহাসি দিয়ে গড়াগড়ি খায়। বাস্তবে দেশে এখন কোনো নির্বাচিত ও গণস্বীকৃত সরকার নেই। যারা আছেন তারা তাদের ইচ্ছায় একতরফা সংবিধান সংশোধন করে ক্ষমতা জবরদখল করে আছেন। দেশকে আজ সাংবিধানিক সঙ্কট ও শূন্যতায় ফেলে দিয়েছেন। 
খালেদা জিয়া কোন পথে হাঁটবেনÑ সেটা তার ব্যাপার। তবে রাজপথে শক্তির ভারসাম্য সৃষ্টি করতে না পারলে কোনো সুফল ঘরে তোলা যাবে না। যারা মনে করছেনÑ শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রেখে নির্বাচন করলেও ১৮ দলীয় জোট বিজয় লাভ করে সরকার গঠন করবেÑ তারা একটা মৌলিক ভুলের রাজ্যে বসবাস করছেন। কারো ভুলে যাওয়া উচিত নয়, বাংলাদেশের রাজনীতিকে দিল্লির দরবারে কারা সঁপে দিয়েছেন। মেয়াদ শেষেও ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকার একরোখা জিদ কাদের। এখন সমঝোতার নাটাইটাও ড্যান মজিনারা দিল্লির কাছে সোপর্দ করতে চান। খেলাটা যেন সাম্রাজ্যবাদের সাথে আধিপত্যবাদের মেলবন্ধনের খেলা। ১৬ কোটি মানুষ পিন্ডিকে সালাম দিয়ে দিল্লিকে কুর্নিশ করবে, আর সেটাকে বলা হবে প্রতিবিপ্লবী ঠেকিয়ে বিপ্লব রক্ষা করাÑ এটাকে হজম করা কিভাবে সম্ভব? দিল্লি যখন একজন নেত্রীকে তাদের জন্য ১৬ কোটি মানুষের চেয়েও বেশি প্রয়োজনীয় ভাবে, অন্যজনকে দুশমন বিবেচনা করে, তখন সবাইকে ভাবতে হবে আধিপত্যবাদের রাডার আমাদের নাকের ডগার কত দূর পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। এমনিতে অর্থনৈতিক শোষণ গলা পর্যন্ত পৌঁছেছে। সাংস্কৃতিক গোলামির বিরাট হাঁ আমাদের স্বকীয় অস্তিত্ব গিলে খাচ্ছে। তার ওপর কূটনৈতিক আধিপত্য ও রাজনৈতিক নিপীড়ন যোগ হলে আমাদের সার্বভৌমত্বের অহম ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে, যা ইতোমধ্যে অংশত হয়ে গেছে। 
আগেই উল্লেখ করেছি, মহাজোট সরকার ঠাণ্ডা মাথায় আদালতের দোহাই দিয়ে দেশে একটি সাংবিধানিক সঙ্কট সৃষ্টি করেছে। এখন সেটাকে আঁকড়ে থাকার জন্য হেন অপচেষ্টা নেই করছে না। সঙ্কট যারা সৃষ্টি করেছে, তাদেরই সমাধান করা উচিত। নিজেদের সৃষ্ট সঙ্কট থেকে নিজেরা উত্তরণের পথ না খুঁজে বিরোধী দলকে দায়ী করে কোনো লাভ নেই। সব বিতর্ক সামনে রেখেও আমাদের পরামর্শÑ বর্তমান সঙ্কটকে সাংবিধানিক এবং রাজনৈতিক সঙ্কট হিসেবে বিবেচনা করা উচিত। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এই সঙ্কটের জন্ম দেয়া হয়েছে অত্যন্ত চাতুর্যের সাথে, যেমনটি বাকশাল করার প্রেক্ষাপটে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে গণতন্ত্র হত্যা করা হয়েছিল। এখন ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির মতো সংবিধানের দোহাই অর্থহীন। এখনো ছিটানো থুথু গিলতে না চাইলে প্রধানমন্ত্রীকে সসম্মানে আঁকড়ে থাকা পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিতে হবে। নির্দলীয় সরকার প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করে সবার অংশগ্রহণে সাধারণ নির্বাচনের পথ করে দেয়া ছাড়া সহজ কোনো পথ খোলা নেই। 
আমরা জানি, রাষ্ট্রশক্তি ব্যবহার করে আধিপত্যবাদের আশীর্বাদ নিয়ে একটা পাতানো ভোটারবিহীন নির্বাচন করে ফেলা হয়তো অসম্ভব নয়; কিন্তু ক্ষমতাকে নিরাপদ করা, ১৬ কোটি মানুষকে পোষ মানানো কোনোভাবেই সম্ভব নয়। আরো রক্ত ঝরার আগে বোধোদয় না ঘটলে খেসারত অনেক বেশি অসহনীয় হয়ে যেতে পারে। এখন সংলাপের পথে সমঝোতা চাইলে প্রধানমন্ত্রীকেই আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার পরিচয় দিতে হবে। এক দিকে দায়টা সরকারের, অন্য দিকে বিরোধীদলীয় নেত্রী বল প্রধানমন্ত্রীর কোর্টে ঠেলে দিয়েছেন। 
বিরোধী জোট অবশ্যই চাইবেÑ সরকার মিটিং, মিছিল ও জনসভার ওপর যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে তা ঘোষণা দিয়ে প্রত্যাহার করুক। বিরোধী দলের যেসব নেতা ও কর্মীকে রাজনৈতিক কারণে গ্রেফতার করেছে, হুলিয়া জারি করে রেখেছে, মিথ্যা মামলায় জড়ানো হয়েছে তা প্রত্যাহার করার ঘোষণা দিক। বন্ধ করে দেয়া বিরোধীদলীয় কিংবা ভিন্নমতের মিডিয়ার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করাও সঙ্গত। প্রধানমন্ত্রীর নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যাপারে নীতিগত একমত হওয়ার ঘোষণা দেয়ার দায়ও বাড়ল। দমন-পীড়ন বন্ধ করে পুলিশ ও প্রশাসনের ওপর হস্তক্ষেপ না করে তাদের নিরপেক্ষ ভূমিকা পালনের সুযোগ করে দেয়া সময়ের দাবি। নির্বাচন কমিশনের ওপর প্রভাব বিস্তারের যে দৃশ্য-অদৃশ্য ধারা চলছে তা বন্ধ হোক। ১৪ দলীয় পাল্টা কর্মসূচি দেয়ার এবং বিভিন্ন নেতার অশোভন মন্তব্য দেয়া বন্ধ করা প্রয়োজন। বিরোধী দলকে আলোচনায় বসাতে চাইলে সরকারকে নমনীয় হতেই হবে। নমনীয় না হয়ে বিদেশীদের আশীর্বাদে ও এরশাদকে বি টিমে খেলার সুযোগ করে দিয়ে একতরফা নির্বাচনের দিকে এগোলে দেশের ভাগ্য নির্ধারণে তৃতীয় শক্তির উপস্থিতি অনিবার্য হয়ে যাবে। এর দায় পুরোটা প্রধানমন্ত্রীকে নিতে হবে। 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads