বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী দীর্ঘ দিন ধরে বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে
দেশবাসীকে অনুরোধ করেছেন সংবিধানের আর্টিকেল ৭২ এবং ১২৩ ভালো করে পড়ার জন্য। জানি
না তার ওই আহ্বানে ক’জন সারা দিয়েছেন? তবে আমি বারবার পড়েছি, আর পড়েছি বলেই
দু-একটি কথা লেখার ইচ্ছা হলো।
আর্টিকেল ৭২(১) এ বলা আছে যে, ‘সরকারি বিজ্ঞপ্তি দ্বারা রাষ্ট্রপতি সংসদ আহ্বান, স্থগিত ও ভঙ্গ করিবেন এবং সংসদ আহ্বানকালে রাষ্ট্রপতি প্রথম বৈঠকের সময় ও স্থান নির্ধারণ করিবেন।’
‘তবে শর্ত থাকে যে, ১২৩ অনুচ্ছেদের (৩) দফার (ক) উপদফায় উল্লেখিত নব্বই দিন সময় ব্যতীত অন্য সময়ে সংসদের এক অধিবেশনের সমাপ্তি ও পরবর্তী অধিবেশনের প্রথম বৈঠকের মধ্যে ষাট দিনের অতিরিক্ত বিরতি থাকিবে না।’ ২৪ অক্টোবরের পরে উল্লিখিত ষাট দিনের নিয়ম বহাল থাকছে না পঞ্চাদশ সংশোধনীর কারণে।
৭২(৩) উপদফায় ‘রাষ্ট্রপতি পূর্বে ভাঙ্গিয়া না দিয়া থাকিলে প্রথম অধিবেশনের তারিখ হইতে পাঁচ বৎসর অতিবাহিত হইলে সংসদ ভাঙ্গিয়া যাইবে’।
‘তবে শর্ত থাকে যে, প্রজাতন্ত্র যুদ্ধে লিপ্ত থাকিলে আইন দ্বারা অনুরূপ মেয়াদ এক বৎসর এককালে বর্ধিত করা যাইতে পারে, তবে যুদ্ধ সমাপ্ত হইলে বর্ধিত মেয়াদ কোন ক্রমেই ছয় মাসের অধিক হইবে না’।
তবে আরো শর্ত থাকে যে, ‘এই দফার অধীনে তাহার দায়িত্ব পালনে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক লিখিতভাবে প্রদত্ত পরামর্শ অনুযায়ী কার্য করিবেন’।
সংবিধানের ৭২(১) বিশ্লেষণ করিলে এই মর্মে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, নির্ধারিত সংসদের প্রথম অধিবেশনের স্থান ও সময় মহামান্য রাষ্ট্রপতি নির্ধারণ করিবেন। পরবর্তীতে অধিবেশনসমূহ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধে ডাকা হবে। ৭২(৩) উপদফা মতে সংসদের জীবন হবে পাঁচ বৎসর। প্রথম অধিবেশনের দিন থেকে আয়ু গণনা হবে। বর্তমান সংসদ অধিবেশন ২০০৯ সালের ২৪ জানুয়ারি প্রথম বসে। ফলে ২৪ জানুয়ারি ২০১৪ পর্যন্ত আয়ু থাকার কথা বর্তমান সংসদের। কিন্তু সংবিধানের ১২৩(৩) (ক) এ ক্ষেত্রে সংসদের পাঁচ বৎসরের আয়ু তিন মাস কমিয়ে দিয়েছে। অর্থাৎ বর্তমান সংসদের আয়ু চার বৎসর ৯ মাস। যা বর্তমান সরকার পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে করেছেন। সুতরাং ২৪ অক্টোবর ২০১৩ সালের পর নতুনভাবে নির্বাচিত সংসদ ব্যতিরেকে বর্তমান সংসদের আর কোন অধিবেশন সংবিধানের ২১৩(৩)(ক) মতে বসতে পারবে না। আর এক অধিবেশন থেকে অন্য অধিবেশনের বিরতি ষাট দিনের বেশি হতে পারবে না মর্মে যে কথাটি ১২৩(৩)(ক) উপদফায় বলা আছে তা হলো চার বৎসর ৯ মাস সময়কালীন সময়ের মধ্যে ডাকা অধিবেশনের একটি থেকে অপরটির বিরতি ষাট দিনের বেশি হবে না। সুতরাং এ ক্ষেত্রে যেমন ষাট দিনের বাধ্যবাধকতা নাই, তেমনি ৯০ দিনও মেয়াদবহির্ভূত সময়কালীন সময়ে হিসাবে বিবেচিত হতে হবে। ফলে ২৪ অক্টোবর ২০১৩ এর পর বর্তমান সংসদ যেমন চলতে পারে না, তেমনি বিরতি দিয়ে নতুন করেও অধিবেশন ডাকা যাবে না (যদি বিদেশের সাথে যুগ্ধ শুরু না হয়)। ২৪ অক্টোবর বর্তমান সংসদের মেয়াদ শেষ।
সংবিধানের ১২৩ (৩) উপ অনুচ্ছেদে যা বলা আছে, সংসদ সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে।
(ক) মেয়াদ অবসানের কারণে সংসদ ভাঙ্গিয়া যাওয়ার ক্ষেত্রে ভাঙ্গিয়া যাইবার পূর্ববর্তী নব্বই দিনের মধ্যে এবং
(খ) মেয়াদ অবসান ব্যতীত অন্য কোনো কারণে সংসদ ভাঙ্গিয়া যাওয়ার ক্ষেত্রে ভাঙ্গিয়া যাওয়ার নব্বই দিনের মধ্যে সংসদ সদস্যদের নির্বাচন অনুষ্ঠান হইবে।
সুতরাং সংবিধানের ১২৩(৩) (খ) অনুচ্ছেদের কোথাও বর্তমান বিধান মতে পাঁচ বৎসর পূর্ণ হওয়ার তিন মাস পূর্ব হইতে সংসদ বহাল আছে এমন ধারণা করা যাবে না। মেয়াদ সমাপ্ত হওয়ার পূর্বে নব্বই দিন সংসদের আইনসম্মত আয়ু বহির্ভূত নব্বই দিন হিসাবেই গণ্য হইবে।
সংবিধানের ৭২ ও ১২৩ এই দুই অনুচ্ছেদের কোথাও ২৪ অক্টোবরের পর সংসদ অধিবেশন ডাকার কোনো সুযোগ রাখেনি। শুধু ব্যতিক্রম আছে, যদি দেশের সাথে অন্য কোনো দেশের যুদ্ধ বেধে যায় কেবল মাত্র তাহলে এবং তাও সীমাবদ্ধ সময়ের জন্য।
সংবিধানের ১২৩(৩)(ক) উপদফা মতে সংসদ ভেঙে যাবে ২৪ অক্টোবর ২০১৩ সালে। তা প্রধানমন্ত্রী ভাঙার অনুরোধ করেন বা না করেন। এমনকি যদি রাষ্ট্রপতিও সংসদ ২৪ অক্টোবর ২০১৩ সালের পূর্বে না ভাঙেন, তাহলেও ২৪ অক্টোবর সংসদ আপনায় ভেঙে গেছে মর্মে বিবেচিত হতে হবে বর্তমান বিধান মতে। এখানে মূল কথা হলো ২৪ অক্টোবর ২০১৩ সংসদ না ভাঙলে, ২৪ অক্টোবর ২০১৩ থেকে ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত সময়কালের জন্য সংসদকে মৃত সংসদ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। অর্থাৎ সংসদ এর অবসান হতো জানুয়ারি মাসের ২৪ তারিখ যদি পূর্বের নিয়ম বহাল থাকত সংবিধানে। বর্তমান নিয়মে সংসদ ভেঙে দিতে হবে মেয়াদ অবসানের নব্বই দিন পূর্বে। তাই এ ক্ষেত্রে বর্তমান সংসদের মেয়াদ হলো ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত। ২৪ জানুয়ারি ২০১৪ পর্যন্ত সংসদ বহাল আছে এমন বক্তব্য ঠিক নয়। আর অধিবেশন ডাকার প্রশ্নই ওঠে না। সংবিধানের ১২৩ (৩) (ক) উপদফায় এমনটাই লেখা আছে। ফলে বর্তমান সংবিধান মতে প্রদত্ত ব্যাখ্যা সঠিক ব্যাখ্যা বলে বিবেচিত হওয়া যৌক্তিক। এ বিষয়ে আবোলতাবোল বলার আর কোনো সুযোগ নেই।
প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যে বলেছিলেন সংবিধান থেকে একচুল পর্যন্ত সরার সুযোগ নেই। বিরোধীদলীয় নেতা বলেছেন, জনগণের দাবির কারণে যদি সরে না আসেন, তা হলে চুলমূল সব উড়ে যাবে (কথ্য ভাষায় বলেছেন সব চুলমূল উড়ে যাবে)। যদিও নানা ব্যাখ্যা শুনেছি এ বক্তব্যের। যা হোক, প্রধানমন্ত্রী ১৮ অক্টোবর জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে প্রমাণ করেছেন যে, বিরোধী দলের নেত্রীর সেদিনের বক্তব্যই সঠিক। কারণ প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যে সংবিধান থেকে সরে এসেছেন। সংবিধানে নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় সরকারের কোনো ব্যবস্থা নেই। এমনকি ৭২ বা ১২৩ এর কোনো অনুচ্ছেদেই প্রধানমন্ত্রীর এ ধরনের বক্তব্য সমর্থন করে না। তাই নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মানার মধ্যে বর্তমান সমস্যার সমাধান নিহিত আছে। অন্যথায় সঙ্ঘাত ছাড়া অন্য কিছু দেয়া সম্ভব নয়। সরে আসতে যখন রাজি হয়েছেন, তখন প্রধানমন্ত্রী সঠিক কাজটি করবেন এমনটাই এখন দেশবাসীর প্রত্যাশা।
তবুও ধন্যবাদ আপনাকে, আপনি সরে আসা শুরু করেছেন। আর একটু সরে আসুন। দেখবেন মানুষের উৎকণ্ঠা থাকবে না। নির্বাচনের জন্য পরিবেশ উৎসবমুখর হয়ে উঠবে। ক্ষমতায় কারা আসবে সেটা এ মুহূর্তে বড় কথা নয়। বড় কথা হলো সুষ্ঠু নির্বাচন। প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাব চালাকি না সদিচ্ছা তা স্পষ্ট হয়ে যাবে। প্রধানমন্ত্রী সর্বদলীয় সরকারের প্রস্তাব কিভাবে বাস্তবায়ন করবেন? এটা করা সম্ভব নয়।
বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে যদি সর্বদলীয় নির্বাচনকালীন সরকার প্রধান হিসেবে মেনে নেয় বিরোধী দল, তা হলে নিজেদের পা নিজেরা কুড়াল দিয়ে কাটার শামিল হবে। কারণ বেসামরিক প্রশাসন দলীয়, পুলিশ দলীয়, বিচারব্যবস্থা দলীয়, নির্বাচন কমিশন দলীয় (হাফিজ ও মোবারক জনতার মঞ্চের লোক)। এর পর বর্তমান প্রধানমন্ত্রী যদি হন নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় সরকার প্রধান, তা হলে কেমন নিরপেক্ষ নির্বাচন দেবেন প্রধানমন্ত্রী সেটা বুঝতে কারো বাকি থাকার কথা নয়। এত কিছুর পর এ দেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাতিকে সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দিতে যে অঙ্গীকার করেছেন, কোনোক্রমে তা বিশ্বাসযোগ্য বিবেচিত হয় না। প্রধানমন্ত্রী নিজেকে অনেক কৌশলী ও বুদ্ধিমতি ভাবেন, ভাবতেই পারেন। নিজেকে বুদ্ধিমতি আর কৌশলী ভাবা নিজের অধিকারের মধ্যে পড়ে। তবে অন্যকে বোকা ভাবা কিন্তু কোনো অধিকারের মধ্যে পড়ে না। বরং অপরকে বোকা ভাবার মাধ্যমে নিজেকে বোকা বানানোর সুযোগ বারবার ফিরে আসে তাদের জীবনে এমন কথাটি মনে রাখতে হবে।
প্রশ্ন হলো বর্তমান সমস্যার সমাধান কিভাবে করবেন প্রধানমন্ত্রী?
সমাধানের আদৌ কোনো ইচ্ছা তার আছে কি নাÑ সেটাই এখন বড় প্রশ্ন। নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় সরকার এক নতুন সরকার। প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবিত সরকার বাংলাদেশের সংবিধান সমর্থন করে না। প্রস্তাবটি তিনি সংবিধান থেকে সরে এসে দিয়েছেন। যখন সরে এসেছেন, তখন প্রধানমন্ত্রী বরং ৫৮(খ) সংবিধানে পুনঃসংযোজন করলেই ভালো করবেন। অর্থাৎ কেয়ারটেকার সরকারের পুনঃপ্রবর্তন করলেই তো সব ঝামেলা মিটে যায়। এখন প্রশ্ন হলো, ২৫ অক্টোবরের পর যেহেতু সংসদ থাকবে না, তা হলে কিভাবে করবেন সমস্যার সমাধান?
সংবিধানে সংশোধনীর মাধ্যমে না সমঝোতার মাধ্যমে? যদি সংশোধনীর মাধ্যমে করেন তা হলে সংবিধানে নতুন সংযোজন করতে হবে। সংবিধান সংশোধনের আর সময় নেই সরকারের হাতে, সমঝোতাই একমাত্র পথ। আপনাকে আরো বিবেচনায় নিতে হবে আপনি যদি সংশোধনী আনেন তাতে বিরোধী দল নির্দলীয় সরকারের দাবি ছেড়ে দিতে রাজি হবে না কোনোক্রমেই। কারণ সর্বদলীয় সরকার সম্পর্কে আপনার প্রদত্ত প্রস্তাব সঠতায় পরিপূর্ণ। বিরোধী দলের দাবি নিরপেক্ষ কেয়ারটেকার সরকার। কে হবেন সর্বদলীয় সরকারপ্রধান তা স্পষ্ট করেনি।
কোন কোন রাজনৈতিক দল নির্বাচনকালীন আপনার প্রস্তাবিত সর্বদলীয় সরকারের অংশ হবে প্রস্তাবে তা নেই। স্পষ্ট বক্তব্য না হওয়ায় প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাব সঙ্কীর্ণ ও অগ্রহণযোগ্য সবার কাছে, বিরোধী দলের কাছে তো বটেই। প্রধানমন্ত্রীর সর্বদলীয় সরকার সম্পর্কে (নির্বাচনকালীন) এ পর্যন্ত যা মনে হয়েছে, তাতে ওই সরকারকে বিরোধী দলগুলো আওয়ামী লীগ দলীয় সরকারই বলবে। তাই বিরোধী দলগুলো প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাব মানবে বা মেনে আলোচনায় বসবে তা আপাতত মনে হয় না। আর যদি সমঝোতার মাধ্যমে করতে চান, তা হলে বিরোধী দলকে আহ্বান করতে হবে আলোচনার জন্য। বিরোধী দল যদি রাজি থাকে আলোচনায় বসতে, তা হলে কেবল তখনই সম্ভব হবে সমঝোতায় পৌঁছাতে।
সংবিধান সংশোধন করার চেয়ে আলোচনা করে সমঝোতায় পৌঁছাই এখন সহজ হবে। অতি অল্পসময়ে সমস্যার সমাধান হবে। তবে সব কিছুই নির্ভর করে সরকারের সততার ওপর। পরিশেষে বলতে হয়, আন্দোলনরত বিরোধী দলগুলো প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় নির্বাচিত সরকারের দর্শন কোনোক্রমেই গ্রহণ করবে না।
সময় হাতে কম। অপেক্ষার সময় বোধকরি অতি দ্রুত অতিবাহিত হচ্ছে। সঠিক কাজটি সঠিক সময়ে করাই বাঞ্ছনীয়। আর তা সরকারকেই করতে হবে। সরকার যদি এ ক্ষেত্রে চালাকির আশ্রয় নেয় তা হলে নিজেদের ফাঁদে নিজেই পড়বে। মনে রাখতে হবে অতি চালাকের ভবিষ্যৎ কিন্তু ভালো নয়।
আর্টিকেল ৭২(১) এ বলা আছে যে, ‘সরকারি বিজ্ঞপ্তি দ্বারা রাষ্ট্রপতি সংসদ আহ্বান, স্থগিত ও ভঙ্গ করিবেন এবং সংসদ আহ্বানকালে রাষ্ট্রপতি প্রথম বৈঠকের সময় ও স্থান নির্ধারণ করিবেন।’
‘তবে শর্ত থাকে যে, ১২৩ অনুচ্ছেদের (৩) দফার (ক) উপদফায় উল্লেখিত নব্বই দিন সময় ব্যতীত অন্য সময়ে সংসদের এক অধিবেশনের সমাপ্তি ও পরবর্তী অধিবেশনের প্রথম বৈঠকের মধ্যে ষাট দিনের অতিরিক্ত বিরতি থাকিবে না।’ ২৪ অক্টোবরের পরে উল্লিখিত ষাট দিনের নিয়ম বহাল থাকছে না পঞ্চাদশ সংশোধনীর কারণে।
৭২(৩) উপদফায় ‘রাষ্ট্রপতি পূর্বে ভাঙ্গিয়া না দিয়া থাকিলে প্রথম অধিবেশনের তারিখ হইতে পাঁচ বৎসর অতিবাহিত হইলে সংসদ ভাঙ্গিয়া যাইবে’।
‘তবে শর্ত থাকে যে, প্রজাতন্ত্র যুদ্ধে লিপ্ত থাকিলে আইন দ্বারা অনুরূপ মেয়াদ এক বৎসর এককালে বর্ধিত করা যাইতে পারে, তবে যুদ্ধ সমাপ্ত হইলে বর্ধিত মেয়াদ কোন ক্রমেই ছয় মাসের অধিক হইবে না’।
তবে আরো শর্ত থাকে যে, ‘এই দফার অধীনে তাহার দায়িত্ব পালনে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক লিখিতভাবে প্রদত্ত পরামর্শ অনুযায়ী কার্য করিবেন’।
সংবিধানের ৭২(১) বিশ্লেষণ করিলে এই মর্মে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, নির্ধারিত সংসদের প্রথম অধিবেশনের স্থান ও সময় মহামান্য রাষ্ট্রপতি নির্ধারণ করিবেন। পরবর্তীতে অধিবেশনসমূহ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধে ডাকা হবে। ৭২(৩) উপদফা মতে সংসদের জীবন হবে পাঁচ বৎসর। প্রথম অধিবেশনের দিন থেকে আয়ু গণনা হবে। বর্তমান সংসদ অধিবেশন ২০০৯ সালের ২৪ জানুয়ারি প্রথম বসে। ফলে ২৪ জানুয়ারি ২০১৪ পর্যন্ত আয়ু থাকার কথা বর্তমান সংসদের। কিন্তু সংবিধানের ১২৩(৩) (ক) এ ক্ষেত্রে সংসদের পাঁচ বৎসরের আয়ু তিন মাস কমিয়ে দিয়েছে। অর্থাৎ বর্তমান সংসদের আয়ু চার বৎসর ৯ মাস। যা বর্তমান সরকার পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে করেছেন। সুতরাং ২৪ অক্টোবর ২০১৩ সালের পর নতুনভাবে নির্বাচিত সংসদ ব্যতিরেকে বর্তমান সংসদের আর কোন অধিবেশন সংবিধানের ২১৩(৩)(ক) মতে বসতে পারবে না। আর এক অধিবেশন থেকে অন্য অধিবেশনের বিরতি ষাট দিনের বেশি হতে পারবে না মর্মে যে কথাটি ১২৩(৩)(ক) উপদফায় বলা আছে তা হলো চার বৎসর ৯ মাস সময়কালীন সময়ের মধ্যে ডাকা অধিবেশনের একটি থেকে অপরটির বিরতি ষাট দিনের বেশি হবে না। সুতরাং এ ক্ষেত্রে যেমন ষাট দিনের বাধ্যবাধকতা নাই, তেমনি ৯০ দিনও মেয়াদবহির্ভূত সময়কালীন সময়ে হিসাবে বিবেচিত হতে হবে। ফলে ২৪ অক্টোবর ২০১৩ এর পর বর্তমান সংসদ যেমন চলতে পারে না, তেমনি বিরতি দিয়ে নতুন করেও অধিবেশন ডাকা যাবে না (যদি বিদেশের সাথে যুগ্ধ শুরু না হয়)। ২৪ অক্টোবর বর্তমান সংসদের মেয়াদ শেষ।
সংবিধানের ১২৩ (৩) উপ অনুচ্ছেদে যা বলা আছে, সংসদ সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে।
(ক) মেয়াদ অবসানের কারণে সংসদ ভাঙ্গিয়া যাওয়ার ক্ষেত্রে ভাঙ্গিয়া যাইবার পূর্ববর্তী নব্বই দিনের মধ্যে এবং
(খ) মেয়াদ অবসান ব্যতীত অন্য কোনো কারণে সংসদ ভাঙ্গিয়া যাওয়ার ক্ষেত্রে ভাঙ্গিয়া যাওয়ার নব্বই দিনের মধ্যে সংসদ সদস্যদের নির্বাচন অনুষ্ঠান হইবে।
সুতরাং সংবিধানের ১২৩(৩) (খ) অনুচ্ছেদের কোথাও বর্তমান বিধান মতে পাঁচ বৎসর পূর্ণ হওয়ার তিন মাস পূর্ব হইতে সংসদ বহাল আছে এমন ধারণা করা যাবে না। মেয়াদ সমাপ্ত হওয়ার পূর্বে নব্বই দিন সংসদের আইনসম্মত আয়ু বহির্ভূত নব্বই দিন হিসাবেই গণ্য হইবে।
সংবিধানের ৭২ ও ১২৩ এই দুই অনুচ্ছেদের কোথাও ২৪ অক্টোবরের পর সংসদ অধিবেশন ডাকার কোনো সুযোগ রাখেনি। শুধু ব্যতিক্রম আছে, যদি দেশের সাথে অন্য কোনো দেশের যুদ্ধ বেধে যায় কেবল মাত্র তাহলে এবং তাও সীমাবদ্ধ সময়ের জন্য।
সংবিধানের ১২৩(৩)(ক) উপদফা মতে সংসদ ভেঙে যাবে ২৪ অক্টোবর ২০১৩ সালে। তা প্রধানমন্ত্রী ভাঙার অনুরোধ করেন বা না করেন। এমনকি যদি রাষ্ট্রপতিও সংসদ ২৪ অক্টোবর ২০১৩ সালের পূর্বে না ভাঙেন, তাহলেও ২৪ অক্টোবর সংসদ আপনায় ভেঙে গেছে মর্মে বিবেচিত হতে হবে বর্তমান বিধান মতে। এখানে মূল কথা হলো ২৪ অক্টোবর ২০১৩ সংসদ না ভাঙলে, ২৪ অক্টোবর ২০১৩ থেকে ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত সময়কালের জন্য সংসদকে মৃত সংসদ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। অর্থাৎ সংসদ এর অবসান হতো জানুয়ারি মাসের ২৪ তারিখ যদি পূর্বের নিয়ম বহাল থাকত সংবিধানে। বর্তমান নিয়মে সংসদ ভেঙে দিতে হবে মেয়াদ অবসানের নব্বই দিন পূর্বে। তাই এ ক্ষেত্রে বর্তমান সংসদের মেয়াদ হলো ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত। ২৪ জানুয়ারি ২০১৪ পর্যন্ত সংসদ বহাল আছে এমন বক্তব্য ঠিক নয়। আর অধিবেশন ডাকার প্রশ্নই ওঠে না। সংবিধানের ১২৩ (৩) (ক) উপদফায় এমনটাই লেখা আছে। ফলে বর্তমান সংবিধান মতে প্রদত্ত ব্যাখ্যা সঠিক ব্যাখ্যা বলে বিবেচিত হওয়া যৌক্তিক। এ বিষয়ে আবোলতাবোল বলার আর কোনো সুযোগ নেই।
প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যে বলেছিলেন সংবিধান থেকে একচুল পর্যন্ত সরার সুযোগ নেই। বিরোধীদলীয় নেতা বলেছেন, জনগণের দাবির কারণে যদি সরে না আসেন, তা হলে চুলমূল সব উড়ে যাবে (কথ্য ভাষায় বলেছেন সব চুলমূল উড়ে যাবে)। যদিও নানা ব্যাখ্যা শুনেছি এ বক্তব্যের। যা হোক, প্রধানমন্ত্রী ১৮ অক্টোবর জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে প্রমাণ করেছেন যে, বিরোধী দলের নেত্রীর সেদিনের বক্তব্যই সঠিক। কারণ প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যে সংবিধান থেকে সরে এসেছেন। সংবিধানে নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় সরকারের কোনো ব্যবস্থা নেই। এমনকি ৭২ বা ১২৩ এর কোনো অনুচ্ছেদেই প্রধানমন্ত্রীর এ ধরনের বক্তব্য সমর্থন করে না। তাই নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মানার মধ্যে বর্তমান সমস্যার সমাধান নিহিত আছে। অন্যথায় সঙ্ঘাত ছাড়া অন্য কিছু দেয়া সম্ভব নয়। সরে আসতে যখন রাজি হয়েছেন, তখন প্রধানমন্ত্রী সঠিক কাজটি করবেন এমনটাই এখন দেশবাসীর প্রত্যাশা।
তবুও ধন্যবাদ আপনাকে, আপনি সরে আসা শুরু করেছেন। আর একটু সরে আসুন। দেখবেন মানুষের উৎকণ্ঠা থাকবে না। নির্বাচনের জন্য পরিবেশ উৎসবমুখর হয়ে উঠবে। ক্ষমতায় কারা আসবে সেটা এ মুহূর্তে বড় কথা নয়। বড় কথা হলো সুষ্ঠু নির্বাচন। প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাব চালাকি না সদিচ্ছা তা স্পষ্ট হয়ে যাবে। প্রধানমন্ত্রী সর্বদলীয় সরকারের প্রস্তাব কিভাবে বাস্তবায়ন করবেন? এটা করা সম্ভব নয়।
বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে যদি সর্বদলীয় নির্বাচনকালীন সরকার প্রধান হিসেবে মেনে নেয় বিরোধী দল, তা হলে নিজেদের পা নিজেরা কুড়াল দিয়ে কাটার শামিল হবে। কারণ বেসামরিক প্রশাসন দলীয়, পুলিশ দলীয়, বিচারব্যবস্থা দলীয়, নির্বাচন কমিশন দলীয় (হাফিজ ও মোবারক জনতার মঞ্চের লোক)। এর পর বর্তমান প্রধানমন্ত্রী যদি হন নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় সরকার প্রধান, তা হলে কেমন নিরপেক্ষ নির্বাচন দেবেন প্রধানমন্ত্রী সেটা বুঝতে কারো বাকি থাকার কথা নয়। এত কিছুর পর এ দেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাতিকে সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দিতে যে অঙ্গীকার করেছেন, কোনোক্রমে তা বিশ্বাসযোগ্য বিবেচিত হয় না। প্রধানমন্ত্রী নিজেকে অনেক কৌশলী ও বুদ্ধিমতি ভাবেন, ভাবতেই পারেন। নিজেকে বুদ্ধিমতি আর কৌশলী ভাবা নিজের অধিকারের মধ্যে পড়ে। তবে অন্যকে বোকা ভাবা কিন্তু কোনো অধিকারের মধ্যে পড়ে না। বরং অপরকে বোকা ভাবার মাধ্যমে নিজেকে বোকা বানানোর সুযোগ বারবার ফিরে আসে তাদের জীবনে এমন কথাটি মনে রাখতে হবে।
প্রশ্ন হলো বর্তমান সমস্যার সমাধান কিভাবে করবেন প্রধানমন্ত্রী?
সমাধানের আদৌ কোনো ইচ্ছা তার আছে কি নাÑ সেটাই এখন বড় প্রশ্ন। নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় সরকার এক নতুন সরকার। প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবিত সরকার বাংলাদেশের সংবিধান সমর্থন করে না। প্রস্তাবটি তিনি সংবিধান থেকে সরে এসে দিয়েছেন। যখন সরে এসেছেন, তখন প্রধানমন্ত্রী বরং ৫৮(খ) সংবিধানে পুনঃসংযোজন করলেই ভালো করবেন। অর্থাৎ কেয়ারটেকার সরকারের পুনঃপ্রবর্তন করলেই তো সব ঝামেলা মিটে যায়। এখন প্রশ্ন হলো, ২৫ অক্টোবরের পর যেহেতু সংসদ থাকবে না, তা হলে কিভাবে করবেন সমস্যার সমাধান?
সংবিধানে সংশোধনীর মাধ্যমে না সমঝোতার মাধ্যমে? যদি সংশোধনীর মাধ্যমে করেন তা হলে সংবিধানে নতুন সংযোজন করতে হবে। সংবিধান সংশোধনের আর সময় নেই সরকারের হাতে, সমঝোতাই একমাত্র পথ। আপনাকে আরো বিবেচনায় নিতে হবে আপনি যদি সংশোধনী আনেন তাতে বিরোধী দল নির্দলীয় সরকারের দাবি ছেড়ে দিতে রাজি হবে না কোনোক্রমেই। কারণ সর্বদলীয় সরকার সম্পর্কে আপনার প্রদত্ত প্রস্তাব সঠতায় পরিপূর্ণ। বিরোধী দলের দাবি নিরপেক্ষ কেয়ারটেকার সরকার। কে হবেন সর্বদলীয় সরকারপ্রধান তা স্পষ্ট করেনি।
কোন কোন রাজনৈতিক দল নির্বাচনকালীন আপনার প্রস্তাবিত সর্বদলীয় সরকারের অংশ হবে প্রস্তাবে তা নেই। স্পষ্ট বক্তব্য না হওয়ায় প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাব সঙ্কীর্ণ ও অগ্রহণযোগ্য সবার কাছে, বিরোধী দলের কাছে তো বটেই। প্রধানমন্ত্রীর সর্বদলীয় সরকার সম্পর্কে (নির্বাচনকালীন) এ পর্যন্ত যা মনে হয়েছে, তাতে ওই সরকারকে বিরোধী দলগুলো আওয়ামী লীগ দলীয় সরকারই বলবে। তাই বিরোধী দলগুলো প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাব মানবে বা মেনে আলোচনায় বসবে তা আপাতত মনে হয় না। আর যদি সমঝোতার মাধ্যমে করতে চান, তা হলে বিরোধী দলকে আহ্বান করতে হবে আলোচনার জন্য। বিরোধী দল যদি রাজি থাকে আলোচনায় বসতে, তা হলে কেবল তখনই সম্ভব হবে সমঝোতায় পৌঁছাতে।
সংবিধান সংশোধন করার চেয়ে আলোচনা করে সমঝোতায় পৌঁছাই এখন সহজ হবে। অতি অল্পসময়ে সমস্যার সমাধান হবে। তবে সব কিছুই নির্ভর করে সরকারের সততার ওপর। পরিশেষে বলতে হয়, আন্দোলনরত বিরোধী দলগুলো প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় নির্বাচিত সরকারের দর্শন কোনোক্রমেই গ্রহণ করবে না।
সময় হাতে কম। অপেক্ষার সময় বোধকরি অতি দ্রুত অতিবাহিত হচ্ছে। সঠিক কাজটি সঠিক সময়ে করাই বাঞ্ছনীয়। আর তা সরকারকেই করতে হবে। সরকার যদি এ ক্ষেত্রে চালাকির আশ্রয় নেয় তা হলে নিজেদের ফাঁদে নিজেই পড়বে। মনে রাখতে হবে অতি চালাকের ভবিষ্যৎ কিন্তু ভালো নয়।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন