সোমবার, ২১ অক্টোবর, ২০১৩

সংঘাত নয় শান্তি-সমৃদ্ধির জন্য দরকার সমঝোতা


গত মাত্র কয়েকদিনে দেশের রাজনৈতিক সঙ্কট আরো ঘনীভূত হয়েছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এর পেছনে যথারীতি প্রধান ভূমিকা রেখেছে সরকার। পবিত্র ঈদুল আযহার পর জনগণ যখন সঙ্কট কাটিয়ে সমঝোতার পরিবেশ সৃষ্টি করা হবে বলে আশা করেছিল, তখন সরকারের পক্ষ থেকে এমন কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে যেগুলো পরিস্থিতিকে উল্টো মারাত্মক করেছে। একটি উদাহরণ হিসেবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণের উল্লেখ করা যায়। গত ১৮ অক্টোবর দেয়া এই ভাষণে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবির বিষয়ে দূরে থাকুক, প্রধানমন্ত্রী  এমনকি নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের প্রশ্নটিকেও সুকৌশলে পাশ কাটিয়ে গেছেন। তিনি বরং সর্বদলীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব দিয়ে বলেছেন, সে সরকারের মন্ত্রিসভায় বিরোধী দলের প্রতিনিধিদেরও অংশ নেয়ার সুযোগ থাকবে। কথাটা শুনতে মন্দ না হলেও প্রধানমন্ত্রী কিন্তু জানাননি, ওই সর্বদলীয় সরকারের প্রধান কে হবেন এবং কিভাবে তাকে বাছাই বা মনোনীত করা হবে। মন্ত্রিসভায় কোন দলের কতজনকে অন্তর্ভুক্ত করা হবে এবং এতে বিরোধী দলকে সম্মানের সঙ্গে প্রতিনিধিত্বের কতটুকু সুযোগ দেয়া হবে এ সম্পর্কেও নীরব থেকেছেন প্রধানমন্ত্রী। কোন কোন ক্ষেত্রে এই সরকারের ক্ষমতা থাকবে এসব বিষয়েও কোনো কথা পাওয়া যায়নি প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে। প্রধানমন্ত্রী শুধু নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় সম্পর্কে ধারণা দিয়েছেন। সংবিধানের ১২৩ অনুচ্ছেদের ৩ দফার (ক) ও (খ) উপ-দফার উল্লেখ করে বলেছেন, ২৫ অক্টোরর থেকে ৯০ দিনের মধ্যে পরবর্তী সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। প্রধানমন্ত্রী আরো বলেছেন, নির্বাচনের ব্যাপারে তিনি সব দলের সঙ্গে, বিশেষ করে আওয়ামী মহাজোটের সঙ্গে আলোচনা করে রাষ্ট্রপতিকে লিখিত পরামর্শ দেবেন। এসবের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী যথেষ্ট উদারতা দেখিয়েছেন এবং সদিচ্ছার প্রকাশ ঘটিয়েছেন বলে মনে হলেও ভাষণের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে কিন্তু তেমন কিছুর প্রমাণ পাওয়া যায়নি। রাজনৈতিক সঙ্কটের প্রধান কারণটিরও সমাধান পাওয়া যায়নি তার ভাষণে। যেমন বিরোধী দল আন্দোলন করছে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল করার দাবিতে কিন্তু প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে কিছুই বলেননি। বেগম খালেদা জিয়া সরকারের নামের ব্যাপারে ছাড় দিয়ে বলে রেখেছেন, যে কোনো নামেই হোক না কেন, নির্বাচনকালীন সরকারকে নির্দলীয় হতে হবে এবং প্রধানমন্ত্রীর পদে শেখ হাসিনাকে রাখা চলবে না। কিন্তু এ দুটি বিষয়েও ‘এক চুল’ পরিমাণ ছাড় দেননি প্রধানমন্ত্রী। পরিকল্পিত সরকারকে ‘সর্বদলীয়’ বলেছেন সত্য কিন্তু বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে, সবই তার একার ইচ্ছার ওপর নির্ভর করবে। বড় কথা, প্রধানমন্ত্রী পদে তিনিই বহাল থাকবেন। অমন কোনো সরকারে বিরোধী দল যে অংশ নেবে না সে কথা নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না। ফলে পরিষ্কার হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী আদৌ চান না যে, বিরোধী দলকে নিয়ে সত্যিই তাকে তেমন কোনো সরকার গঠন করতে হোক। অর্থাৎ ‘সর্বদলীয়’ নামে যে সরকার গঠনের প্রস্তাব তিনি করেছেন সেটা আসলে হবে বর্তমান সরকারেরই অন্য রূপ। ওদিকে মুখে সমঝোতার কথা বললেও প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশ্য যে অন্য রকম তার প্রমাণ পাওয়া গেছে সরকারের অন্য একটি পদক্ষেপে। দৃশ্যমান ও যুক্তিসঙ্গত কোনো কারণ ছাড়াই ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ হঠাৎ ২০ অক্টোবর থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য রাজধানীতে সব ধরনের সভা-সমাবেশ ও মিছিল নিষিদ্ধ করেছে। কারণ হিসেবে পরস্পরবিরোধী কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সমাবেশকে কেন্দ্র করে সহিংসতার আশংকা ব্যক্ত করেছে ডিএমপি। বলেছে, এসব সভা-সমাবেশ ও কর্মসূচি পালিত হলে সাংঘর্ষিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে বলে ‘প্রতীয়মান’ হয়েছে। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ ১৮ দলীয় জোট এই নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছে, এর মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে গণতন্ত্রেরই টুঁটি টিপে ধরেছে সরকার। বিরোধী দলকে বাইরে রেখে একদলীয় নির্বাচন করার অশুভ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যেই চরম ফ্যাসিস্ট পদক্ষেপটি নেয়া হয়েছে। এই মন্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত করার সুযোগ নেই। কারণ, পরস্পরবিরোধী কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সমাবেশ ও কর্মসূচির কথা বলা হলেও অন্তরালের উদ্দেশ্য আসলে বিএনপির ডাকা ২৫ অক্টোবরের মহাসমাবেশকে বানচাল করা। একমাসেরও বেশি আগে বিএনপি এই কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে সারাদেশে জনগণের মধ্যে ব্যাপক সাড়া দেখেই সরকার ভয় পেয়েছে। আর সে কারণেই ক্ষমতাসীনরা সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি সৃষ্টির ধুয়া তুলেছেন। সরকারের নির্দেশে পুলিশের কাছেও সেটাই ‘প্রতীয়মান’ হয়েছে। অথচ বিএনপি প্রথম থেকেই বলে এসেছে, ২৫ অক্টোবরের মহাসমাবেশ হবে শান্তিপূর্ণ। কেবল বাধা দেয়া হলেই প্রতিরোধের কথা বলা হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে করণীয় যেখানে ছিল বাধাহীনভাবে মহাসমাবেশটিকে করতে দেয়া ক্ষমতাসীনরা সেখানে একইদিনে পাল্টা সমাবেশ ডেকে পুলিশের জন্য সুচিন্তিতভাবে অজুহাত তৈরি করেছেন। শেষ পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞাও জারি করিয়েছেন তারা। বলা বাহুল্য, গণতন্ত্রের প্রশ্নে সদিচ্ছা এবং নিজেদের জনসমর্থনের ব্যাপারে সামান্য আস্থা থাকলেও নিষেধাজ্ঞা আরোপের ফ্যাসিস্ট পন্থা অবলম্বনের পরিবর্তে তারা নিজেদের সমাবেশটিরও আয়োজন করতেন। তখন দেখা যেতো, জনসমর্থনের পাল্লা ভারী কোনদিকে। কিন্তু সে সৎ সাহস না দেখিয়ে তারা সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করেছেন। একই কারণে সমঝোতার সব আশাই নস্যাৎ হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য এটা অবশ্য মোটেও নতুন কোনো বিষয় বা পদক্ষেপ নয়। কারণ, এবার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বিরোধী দলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছেন তারা। বিক্ষোভ মিছিল-সমাবেশ তো বটেই, মানব বন্ধনের মতো শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিও পালন করতে দিচ্ছে না সরকার। পুলিশ ও র‌্যাবের পাশাপাশি আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের গুন্ডা-সন্ত্রাসীরাও মিছিল-সমাবেশের ওপর হামলা চালাচ্ছে। এভাবে সবদিক থেকেই সরকার ফ্যাসিস্ট শাসন কায়েম করেছে। সরকারের ফ্যাসিস্ট সে নীতিরই সর্বশেষ প্রকাশ ঘটেছে ২০ অক্টোবর আরোপিত নিষেধাজ্ঞার মধ্য দিয়ে। আমরা মনে করি, সরকার যে নীতি-কৌশল নিয়ে এগোচ্ছে এবং যে নিষ্ঠুরতার সঙ্গে দমন-নির্যাতন চালাচ্ছে তার ফলে সমঝোতা ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন দূরে থাকুক, রাজনৈতিক সংকট বরং সহিংসতারই কারণ হয়ে উঠবে। এজন্যই রাজনৈতিক সংকট কাটিয়ে ওঠার এবং সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীকে সদিচ্ছার প্রমাণ দিতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর উচিত অবিলম্বে সভা-সমাবেশের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয়া এবং ২৪ অক্টোবরের মধ্যে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল এবং নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের বিধান যুক্ত করার উদ্যোগ নেয়া। সময় যেহেতু দ্রুত শেষ হয়ে আসছে প্রধানমন্ত্রীকে সেহেতু সমঝোতার উদ্যোগ নিতে হবে এখনই। সম্ভব হলে আজকালের মধ্যেই।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads