মঙ্গলবার, ২৯ অক্টোবর, ২০১৩

রাজনৈতিক দলন-পীড়ন এবং মিডিয়া সংস্কৃতি


বর্তমান সরকারের মেয়াদ পূর্ণতার দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছে। শেয়ারবাজারের হাজার হাজার কোটি টাকার লুটপাট, হলমার্ক অর্থ কেলেঙ্কারী, ডেসটিনি চাতুরী, অর্থলোপাটের মাধ্যমে পদ্মা সেতুকে আঁতুড়ঘরেই হত্যা, ছাত্রসংগঠনসহ দলীয় নেতাকর্মীদের আকাশচুম্বী দুর্নীতি ও সন্ত্রাস, হত্যা, খুন, গুমসহ দেশকে একটি কারাগারে পরিণতকরণ, ইসলামী তাহযিব-তমদ্দুনের মূলোৎপাটন, আলেম-উলামা এবং বিরোধী জোটের উপর অমানবিক দলন-পীড়নসহ হাজারো অভিযোগে অভিযুক্ত থাকলেও বিরোধী জোটের নমনীয় রাজনীতির কল্যাণে তারা বাহ্যিকভাবে অনেকটা সফলতার সাথেই তাদের ক্ষমতার মেয়াদ শেষ করতে যাচ্ছেন। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত কোন সরকারের মেয়াদ পূর্ণ করাটা নিঃসন্দেহে একটি ভালো দিক। কিন্তু এরপরে কি হতে যাচ্ছে! নির্বাচন হচ্ছে কি হচ্ছে না! নির্বাচন না হলে দেশের ভবিষ্যৎ কি! আবারো কি নতুন কোন মইনুদ্দীন-ফখরুদ্দীন নাকি তার চেয়েও আরো ভয়াবহ কিছু! আর যদি নির্বাচন হয়, তবে কিভাবে? সরকারের অধীনে নির্বাচন মানেই ভোট ডাকাতির মাধ্যমে ক্ষমতায় যাবার অভিযোগে বিরোধীজোটের নির্বাচন বর্জন। তারা নির্বাচন বর্জন করলে নির্বাচন কি আদৌ হওয়া সম্ভব? যদি বিরোধী জোট তাদের অধীনেই নির্বাচন করে তাহলে হাজারো লাশের মিছিল দেখার যেমন আশঙ্কা তেমনি ঈদের পরে কেয়ারটেকার সরকারের দাবীতে বিরোধী জোটের আন্দোলনের হুঙ্কারেও হত্যা, লাশ, ভাঙচুর, আগুন আর ধ্বংসযজ্ঞের আভাসে জনগণ ভীষণভাবে শংকিত। শুধু পরিণত বয়সের জনগণই নয়, পঞ্চম শ্রেণীর সমাপনী, অষ্টম শ্রেণীর জেএসসি- জেডিসিসহ সকল স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষার সময় এ ধরনের সঙ্কট শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত গোটা জাতিকে আতঙ্কিত করে তুলেছে।
বাংলাদেশ আমাদের হৃদয়ের ভূখ-, ভালবাসার ঠিকানা। অনেক স্বপ্ন আর আশা নিয়ে লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে এ প্রিয় জন্মভূমিকে আমরা মুক্ত করেছি বৃটিশের কবল থেকে এবং পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে বিতাড়িত করে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপটে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনেও আমাদের ভূমিকা প্রশংসনীয়। স্বাধীনতার বিয়াল্লিশ বছরের ইতিহাসে অনেক চড়াই উৎরাইয়ের মাঝেও অন্তত অর্ধেক সময় শিশুগণতন্ত্রের সাহচার্য পেয়েছি। আমরা আশা করেছিলাম, এ সম্ভাবনাময় শিশুটিকে বেড়ে ওঠার সুযোগ করে দেবেন আমাদের বর্তমান সরকার। কেননা একটা স্লোগান শুনতে খুবই মজার ‘গণতন্ত্রের মানসকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা।’ নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে অগণতান্ত্রিক ধারার বিলুপ্ত ঘটিয়ে কাক্সিক্ষত পদযাত্রা শুরু হয়েও আবারো প্রায় কুড়ি বছর পরে গণতন্ত্রের মানসকন্যার হাতেই তা হুমকির সম্মুখীন হবে এটা অন্তত জনগণ মেনে নিতে পারছে না। কেননা তিনিই তাঁর কথিত শত্রু বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীকে সাথে নিয়ে কেয়ারটেকার সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে কঠোর কর্মসূচি দিয়ে দেশকে অচল করে সে দাবী আদায়ে সফল হয়েছিলেন। অথচ সময়ের ব্যবধানে শুধুমাত্র নিজের ক্ষমতাকে অবৈধভাবে স্থায়ীরূপ দেবার মানসে তড়িঘড়ি করে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে টেয়ারটেকার সরকার আইন বাতিল করে দিয়ে এটাকে সংবিধান বহির্ভূত আইন হিসেবে আখ্যা দিচ্ছেন। আর এখন সংবিধান সংরক্ষণের দোহাই দিয়ে কেয়ারটেকার সরকারের দাবীকে অবৈধ ঘোষণা দিয়ে বিরোধী জোটকে নানাভাবে নির্যাতনের স্টিম রোলার চালিয়ে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছেন। অথচ বিরোধী জোটের সকল রাজনৈতিক দল শুধু নয়, খোদ মহাজোটের শরিক দলগুলোই তত্ত্বাবধায়ক বা নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে ছাড়া নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না বলে ঘোষণা দিচ্ছেন। এ অবস্থায় বর্তমান সরকারের হাতেই গণতন্ত্রের শবযাত্রা সম্পন্ন হবে বলেই বিশ্লেষকগণ আশঙ্কা করছেন।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পরে রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেট ও গাজীপুর সিটি নির্বাচনসহ স্থানীয় পর্যায়ের কিছু নির্বাচনের উপমা টেনে সরকার অবশ্য তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে বলছেন, তাদের অধীনেই সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব এবং ইতোমধ্যে তারা তার নমুনা প্রকাশ করতে সক্ষম হয়েছেন। কথাটা শুনতে অবশ্য ভালোই লাগে। দেশে যদি গণতান্ত্রিক সহনশীলতা প্রতিষ্ঠিত হয় তাহলে এর চেয়ে খুশির কথা আর কি হতে পারে? কিন্তু বিরোধী মতামতের প্রতি সরকারের সহনশীল মনোভাবের ব্যারোমিটারে এ যুক্তি ভীষণভাবে হাস্যকর বলে প্রমাণিত হচ্ছে। কেননা সিটি কর্পোরেশন হচ্ছে স্থানীয় নির্বাচন। মাত্র কয়েকটি স্থানে নির্বাচন হবার কারণে মিডিয়ার সচেতন চোখ ছিল সব ভোট কেন্দ্রেই। কারণ সারা দেশে যত মিডিয়া আছে সবাই ছিল মাত্র চার সিটিতে। কিন্তু যখন সারাদেশে নির্বাচন হবে তখন মিডিয়া কয়টা ভোটকেন্দ্রে সারাদিন থাকতে পারবে? কত হাজার ভোটকেন্দ্রের খবরই বা তারা প্রচার করতে পারবে? স্থানীয় নির্বাচনে সুষ্ঠুতার বড়াই করলেও ইতোমধ্যে মিডিয়ার চোখের আড়ালেও হাজার হাজার অনৈতিক ঘটনা ঘটেছে। অনেক ইউনিয়ন পরিষদের বিজয়ী প্রার্থীকে হটিয়ে আওয়ামী দলীয় প্রার্থীকে বিজয়ী ঘোষণা করার অভিযোগ রয়েছে। সুতরাং আওয়ামী সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হবার ঘোষণায় কোন বিবেকবান মানুষ অন্তত সাড়া দিবে না।
আদালত-তাদের রায়ে আরো দুইটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকার দ্বারা পরিচালনার সুপারিশ করেছেন। আওয়ামী লীগ সেটা মোটেও গ্রহণ করছে না। অনির্বাচিত সরকারের হাতে নির্বাচন করতে তারা নারাজ। আমিও ব্যক্তিগতভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির বিপক্ষে। কারণ রাজনৈতিক নেতারা পরস্পর পরস্পরকে বিশ্বাস করে না বলেই তারা কিছু অরাজনৈতিক ব্যক্তিকে ধরে আনে তাদের নির্বাচনটা পরিচালনা করতে। এতে রাজনৈতিক নেতাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য প্রশ্নবিদ্ধ হয়; যেটা সুষ্ঠু গণতন্ত্রের চর্চা কখনোই হতে পারে না। কিন্তু, আমাদের মত উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে যে পরিমাণ রাজনৈতিক অস্থিরতা সেখানে আমার ঐ যুক্তি কতটুকু ফলপ্রসূ তা সবাই জানে। কারণ দেশবাসী দেখেছে কীভাবে বিরোধী দলের কেন্দ্রীয় নেতাদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, কীভাবে প্রকাশ্য রাজপথে মানুষকে পিটিয়ে হত্যা করে লাশের উপর নাচানাচি করা হয়েছে। ২৮ অক্টোবরের বীভৎস দৃশ্য জনগণ এখনো ভোলেনি। কীভাবে বিরোধী দলের জনসভায় জনগণকে আসতে বাধা প্রদান করা হয়েছে। দৈনিক আমার দেশ, দিগন্ত টেলিভিশন, ইসলামিক টেলিভিশনসহ দেশের জনপ্রিয় কয়েকটি গণমাধ্যমকে কিভাবে বিনা অপরাধে কোন ধরনের আইনি নিষেধাজ্ঞা ছাড়াই শুধুমাত্র গায়ের জোরে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। নির্ভীক কলমসৈনিক মাহমুদুর রহমান এবং মানবাধিকার সংস্থার নেতা আদিলুর রহমানকে কতটা অন্যায়ভাবে গ্রেফতার করে অমানবিক নির্যাতন করা হয়েছে। সরকারের এসব কর্মকা- কী তাদেরকে বিশ্বাস করার সার্টিফিকেট। সরকার যদি এমন কার্যক্রম পরিচালনা করতো যাতে তাদের প্রতি বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরী হয় তাহলে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রশ্ন উঠানো অর্থহীন হতো। যে দেশে রানা প্লাজা ধ্বংস হলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নাড়াচাড়া তত্ত্ব প্রদান করে বিরোধী দলের ওপর দোষ চাপাতে ভুল করে না, যে দেশে খোদ মন্ত্রীর উস্কানিতে গার্মেন্টস শ্রমিকরা বিক্ষুব্ধ হলেও হেফাজতে ইসলামের আমীরসহ জামায়াত বিএনপিকে দায়ী করা হয় সেদেশে রাজনৈতিক নেতাদেরকে বিশ্বাস করার প্রশ্ন কতটুকু সমীচীন।
সরকারের নির্লজ্জ দলীয়করণ এর মাত্রা অতীতের তুলনায় অনেক বেশি হয়েছে বলে বিশ্লেষকগণ মনে করছেন। বিচারকার্য থেকে শুরু করে ঠিকাদারী আর চাকরির বাজারসহ সবখানে দুর্নীতির যে দৌরাত্ম্য তা দেশবাসী ভালোভাবেই প্রত্যক্ষ করেছে। এসব কাজ করেও তাদের অধীনে নির্বাচন করতে বলবে! একদিকে নির্বাচন নিয়ে টালবাহানা আরেকদিকে আন্দোলনের উস্কানি ভয়াবহ সঙ্কট দেখতে হবে আমাদের; যার দায় সরকার কোনোভাবেই এড়াতে পারে না। মাঝেমধ্যে সরকারের কোন কোন নেতা-নেত্রী সংলাপের কথা বললেও এখন তার উচ্চারণও বন্ধ হয়ে গেছে।
সাম্প্রতিককালে বিরোধী জোট বিশেষত বিরোধী জোটের প্রধানতম শরীকদল জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের ওপর যে নির্যাতনের স্টিম রোলার চালাচ্ছে তাতে বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক দেশ বলে বিশ্বাস করাটা প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না। সরকারের দৃষ্টিতে তারা যেন অন্য গ্রহ থেকে ভেসে আসা অন্য কোন নিষিদ্ধ প্রাণী; তাই যেখানেই তাদেরকে পাওয়া যাবে সেখানেই মারা হবে এবং গ্রেফতার করে জেলে পুরে রিমান্ডের নাম করে নির্যাতনের উল্লাস পার্টি উদযাপন করতে হবে। পুলিশ প্রশাসন ও র‌্যাব-এর প্রকাশ্য ঘোষণা, এদের নির্মূল করতে যা যা করা দরকার সকল প্রস্তুতিই আমাদের রয়েছে। বা! দেখে মনে হচ্ছে এটা নিষিদ্ধ কোন অপরাধী সংগঠন। বাংলাদেশে যেন আর কোন সমস্যাই নেই; সুখের হাওয়ায় দুলছে মানুষ। জামায়াত-শিবিরকে নিধন করতে পারলেই দেশ সুখী-সমৃদ্ধশালী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে।
এখন পুলিশ মানেই বিরোধী মহলের যম। দিনের আলোতে কিংবা রাতের অন্ধকারে যে কোন বাসা বাড়ি অথবা মেসে হানা দিয়ে শত শত ছাত্রকে শিবির সন্দেহে গ্রেফতার করতে পারলেই ব্যবসা জমজমাট। টাকার খেলা জমে ওঠে প্রকাশ্যে। মাদরাসার ছাত্র তো বটেই, বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবী, ইসলামিক স্টাডিজ কিংবা ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের ছাত্র হলেই আর কোন কথা নেই। নির্লজ্জভাবে জমে ওঠে গ্রেফতার বাণিজ্য। কুরআন হাদীসসহ ইসলাম কিংবা ইসলামের ইতিহাস সম্বলিত যে কোন বই পেলেই তা হয়ে ওঠে জিহাদী বই। ইমাম গাজ্জালী (রহ.) এর সৌভাগ্যের পরশমণি কিংবা ‘সরওয়ারে কায়েনাত’ নামক একটি সিরাতগ্রন্থ এবং ‘ভারতে মুসলিম শাসনের ইতিহাস’ জাতীয় গ্রন্থটি হাতে পেয়েই আমার বাসার পাশের এক মেস থেকে আমাদের বিভাগের প্রথম বর্ষে অধ্যয়নরত এক ছাত্রকে গ্রেফতার করলো পুলিশ। এগুলো নাকি জিহাদী বই। ইসলাম কিংবা মুসলমান নাম দেখলেই সেগুলো জিহাদী বই হয়ে যায়, হায়রে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশের প্রশাসক আর আইনশৃংখলা বাহিনী! নিভৃত পল্লীর নি¤œমধ্যবিত্ত ঘরের এ ছেলেটি গ্রেফতার বাণিজ্যে বাজি রাখতে পারেনি বলে দীর্ঘ আটমাস পরে জামিনের মুখ দেখলো। সারাদেশে এমন হাজার হাজার ঘটনায় সাধারণ মানুষ এখন আইন শৃংখলা বাহিনীকে আর আস্থার দৃষ্টিতে না দেখে বরং আতঙ্কের কারণ হিসেবে দেখছেন। প্রশাসনের এ ধরনের আচরণের কারণে পুলিশ-জনতা মুখোমুখি অবস্থানে চলে যেতে বসেছে। এটা একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য কতটা মানানসই তা উপলব্ধি করা জরুরি।
জামায়াতে ইসলামী যেন আওয়ামীলীগের আজন্ম শত্রু; বর্তমান সময়ে এটা যে কেউ মনে করতে পারে। অথচ শুধুমাত্র এদেশে গণতান্ত্রিক ধারা চালু করার স্বপ্নে জামায়াতের উদ্ভাবিত ফর্মূলাকে গ্রহণ করে আজকের যুদ্ধাপরাধী নামে অভিযুক্ত নেতাদের সাথে গলায়-গলা কাঁধে-কাঁধ মিলিয়ে তারা আন্দোলন করে কেয়ারটেকার সরকার বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবি আদায় করেছেন; যার অধীনে চারটি সফল নির্বাচনও সুসম্পন্ন হয়েছে। সর্বশেষ ইয়াজউদ্দীন-ফখরুদ্দীন-মইনুদ্দীন সাহেবদের আর্মি সমর্থিত সরকার ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে’ অনেকখানি প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। অবশ্য এ প্রশ্নবিদ্ধ সরকারের হাত ধরেই আজকের আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায়। এটা নাকি তাদের আন্দোলনেরই ফসল। যে ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্যে যুদ্ধাপরাধীদের বুকে টেনে নিয়ে আন্দোলন করা হলো, হরতাল ভাংচুর আর মিটিং-মিছিলে দেশ অচল করে দেয়া হলো সেই ব্যবস্থাটিকে কেউ কলংকিত করলো বলে কলংকমুক্ত করার প্রয়াস না চালিয়ে গলাটিপে হত্যা করা কতটা যুক্তি সঙ্গত হচ্ছে তা সুধী মহলকে ব্যাপকভাবে ভাবিয়ে তুলেছে। রসিকজন বিষয়টিকে এমনভাবেই বলছেন যে, ক্ষমতায় যাবার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করতে পারলে রাজাকাররাও যেমন বন্ধু হতে পারে, ঠিক একই কারণে রক্তাক্ত কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থাও বাতিল করা যুক্তিযুক্ত। আজ জামায়াতে ইসলামী বিরোধী জোট থেকে বেরিয়ে মহাজোটে গেলে কিংবা ১৮ দলীয় জোট থেকে বের হয়ে আলাদাভাবে নির্বাচন করার ঘোষণা দিলেও সমস্যার সমাধান হতে পারে বলেও কেউ কেউ মন্তব্য করেন।
তবে একথা স্মরণ রাখতেই হবে যে, অবিশ্বাস, পরচর্চা-পরনিন্দা, হিংসা, হানাহানি, পরিবারতন্ত্র, ব্যক্তিপুজা এবং পেশীশক্তিসমৃদ্ধ রাজনীতি থেকে দেশকে উদ্ধার করার জন্যে কেয়ারটেকার সরকারের জন্ম হয়েছিল, সেটাকে বেড়ে উঠতে না দিয়ে গলাটিপে হত্যা করার মাধ্যমে আবারো বাকশাল কিংবা নব্বই দশকের এরশাদীয় স্বৈরশাসনের একদলীয় গণতন্ত্রের দিকে এগিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা কতটা সফল হবে তা যেমন ভাবনার বিষয় তেমনি এ ধরনের পদক্ষেপ গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে নতুন কোন অধ্যায়ের সূচনা করলে তাতে বিস্ময়েরও কিছু থাকবে না। তাই কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতিকে উচ্ছেদ না করে বরং কলংকমুক্ত করার পদক্ষেপ নেয়াই সরকারের জন্যে বুদ্ধিমানের কাজ হবে বলে বিশ্লেষকগণ মনে করেন। সেই সাথে বিরোধী জোটের সাথে সহনশীল আচরণের মাধ্যমে গণতন্ত্রের মানস কন্যার উপাধির প্রতি সুবিচার করার পরামর্শ সুধীজনের। বিশেষ করে ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে পরিচালিত দল হিসেবে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের ভিত কোন অংশেই দুর্বল নয়; তাই জেল জুলুম আর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস দিয়ে তাদেরকে নির্মূল করার প্রচেষ্টা করে কোন সরকারই এদেশে টিকতে পারেনি তার প্রমাণ সকলের কাছেই স্পষ্ট।
বর্তমান সরকার সর্বস্তরে সন্ত্রাসী মাস্তানদের দমন, ঘুষ-দুর্নীতির মূলোৎপাটন, দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি রোধ করে দশ টাকা কেজি দরে চাল খাইয়ে জীবন যাত্রার মান সহজীকরণ; সার, কীটনাশক ও তেলসহ সুলভে (অনেক ক্ষেত্রে বিনামূল্যে) কৃষি উপকরণ সরবরাহ করার মাধ্যমে কৃষি সম্পদের উৎপাদন বাড়াতে প্রয়োজনীয় ভূর্তুকি প্রদানসহ ঘরে ঘরে চাকরি প্রদানের মাধ্যমে বেকারত্বের অভিশাঁপ থেকে দেশকে মুক্তকরণের মধ্যদিয়ে অত্যাধুনিক ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছে। কিন্তু ক্ষমতা হাতে পেয়েই তারা দিন বদলের নামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামবদল (যমুনা সেতুকে বঙ্গবন্ধু সেতুকরণ, চীন-মৈত্রী আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রকে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রকরণ, জাতীয় স্টেডিয়াম থেকে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ম্যুরাল উচ্ছেদ প্রভৃতি), ঘড়ির কাঁটা বদল, এমনকি দেশের মানচিত্র বদলেরও প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। জামায়াত-শিবিরিকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে প্রচার করা হলেও পুলিশী নির্যাতনের নির্মমতায় তারা যে ধৈর্যের পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে তা সত্যিই অবিশ্বাস্য। অথচ সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনের যে সন্ত্রাসী কর্মকা-ের ফিরিস্তি তা জাতিকে শুধু ভাবিয়েই তোলেনি বরং সে ব্যাপারে সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলের বক্তৃতা বিবৃতি প্রদানের মধ্যদিয়ে জাতিকে ব্যাপকভাবে হতাশও করেছে। শত শত বিশ্বজিৎরা আজ তাদের হাতে খুন হলেও বিচারের বাণী নিভৃতে কেঁদে বেড়াচ্ছে। এ সব বিষয় সরকার দলীয় নেতাদের বোধগম্য না হলেও জনগণের মধ্যে যে এর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে সাম্প্রতিকালের সিটি নির্বাচনে তার প্রমাণ মিলেছে। এসব বিষয়ে তাৎক্ষনিকভাবে সঠিক দিক নির্দেশনা দেবার ক্ষেত্রে গণমাধ্যমই উৎকৃষ্টতম মাধ্যম। তাদের দিকনির্দেশনায় সরকার ও বিরোধী দলসহ সকল জনগণের মধ্যে দেশপ্রেমের অনুভূতি জাগ্রত করার ক্ষেত্রেও গণমাধ্যম মৌলিক ভূমিকা রাখতে পারে।
বর্তমানে বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি চরম উৎকর্ষতার শীর্ষে অবস্থান করছে। পৃথিবী এখন ছোট হতে হতে হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। এ সময় আমাদেরকেও সংবাদ ও তথ্য প্রযুক্তির দিকে অবশ্যই উন্নয়ন ঘটাতে হবে। বর্তমানে সংবাদ মাধ্যমে গণসচেতনতা তৈরি যেমন সহজ হয়েছে তেমনি হলুদ সাংবাদিকতায় বিভ্রান্ত হবারও সুযোগ অনেক বেশি। বিভ্রান্ত ও মিথ্যা সংবাদের জন্য ঘটে যায় হাজারো বিবাদ; যা ফখরুদ্দীন-মইনউদ্দীন শাসনামল থেকে অদ্যাবধি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী দেশপ্রেমিক নেতাকর্মী থেকে শুরু করে সর্বস্তরেই মানবাধিকার লঙ্ঘন করে অমানবিক নির্যাতন করা হচ্ছে। অথচ মিডিয়া যেন রঙিন চশমার আড়ালে নিজেদের অবস্থান আবিষ্কারে ব্যস্ত। হলুদ সাংবাদিকতা ও বিভ্রান্ত সংবাদ এতটাই মারাত্মক যে, এজন্য সংবাদ সচেতন মুসলিম জনগোষ্ঠীও ইসলামের সূচনালগ্ন থেকে ধাপে ধাপে বহুমুখী ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। বিশেষ করে অলীদ ইবনে উকবা (রা.) কর্তৃক প্রেরিত ভুল সংবাদের ভিত্তিতেই মহানবী (স.) বনি মুস্তালিক গোত্রের মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দেবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে যাচ্ছিলেন। এছাড়া মারওয়ান কর্তৃক সংবাদ জালিয়াতির কারণে হযরত ওসমান (রা.) এর হত্যাকা- এবং একই প্রক্রিয়ায় কারবালার প্রান্তরে ইমাম হোসাইন (রা.) এর পরিবারের হৃদয় বিদারক ঘটনা ঘটে। পরবর্তীতে মিথ্যা ও ভুল সংবাদ পরিবেশনের প্রেক্ষিতে স্পেন বিজয়ী সেনাপতি মুসা বিন নুসাইর, তারিক বিন যিয়াদ এবং সিন্ধু বিজয়ী সেনাপতি মুহাম্মদ বিন কাসিমের ভাগ্যে জুটেছিল নির্মম পরিনতি, যা মুসলিম বিশ্বের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি সাধিত হয়েছে। গ্রানাডার মুসলমানদের নির্মম পরিণতি ও ‘এপ্রিল ফুল’সহ আধুনিক কালের হাজারো দুঃখজনক পরিনতির জন্য তথ্য বিভ্রাট ও হলুদ সাংবাদিকতাই দায়ী। এমনকি পলাশীর প্রান্তরে সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের মধ্যদিয়ে যেমন আমরা স্বাধীনতা হারিয়েছিলাম তেমনি শহীদ তিতুমীর, হাজী শরীয়তুল্লাহ, সাইয়্যেদ আহমদ ব্রেলভীসহ দেশপ্রেমিক সিপাহী জনতার হাজারো প্রচেষ্টা এবং গণসচেতনতার মাধ্যমেই এসেছিল ১৯০৫ সালের বাংলা বিভক্তিকরণ, ১৯৪৭ সালের পাকিস্তানের স্বাধীনতা। অতঃপর গণমাধ্যমের  গণসচেতনতা সৃষ্টির প্রয়াস এবং সচেতন জনগোষ্ঠীর আত্মদানের মধ্যদিয়ে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে আমাদের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়। বর্তমান তথ্য প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানে চরম উৎকর্ষতার যুগে শুধুমাত্র যোগ্যতা নয়, সততাসহ নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন সাংবাদিক, সংবাদপত্র এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়া  তথা সত্যসচেতন গণমাধ্যমের আজ বড় বেশি প্রয়োজন।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads