মঙ্গলবার, ৮ অক্টোবর, ২০১৩

স্বাধীন দেশের প্রশাসনে জমিদারতন্ত্রের কালোছায়া

স্বাধীন দেশের প্রশাসনে জমিদারতন্ত্রের কালোছায়া
কলম কাগজ নিয়ে এ প্রসঙ্গে লিখতে বসছি, এমন সময় টেবিলে থাকা একটি পুরনো ডায়রীর পাতা উল্টোতেই এমন কিছু স্মৃতি চোখে পড়ে, যে কারণে এ কলমটি উপস্থাপনের আগেভাগেই কিছু কথা না লিখে সংবরণ করতে পারছি না।
কেন যেন আমরা অনেকেই যা বলি, তা করি না। আবার যা করি, আমরা অনেকেই তা বলি না। নিজের দোষত্রুটি, দায়-দায়িত্ব, ন্যায়-অন্যায় না ভেবে অহরহ অন্যকে দোষারোপ ও নিন্দা জানাতেই বেশী পারঙ্গম হয়ে পড়ি এবং অনেক ক্ষেত্রে উৎসাহবোধ করি। নিজের ব্যাপারে সমালোচনা না করে অহরহ অন্যের অসম আলোচনায় নিজেকে ব্যস্ত রাখি। ফলশ্রুতিতে প্রতিনিয়ত আমাদের কথা, কাজ ও প্রতিশ্রুতির মধ্যে থেকে যাচ্ছে, বিশাল ফাঁকফোকর। যে কারণে ভেস্তে যাচ্ছে অনেক কিছুর পরিকল্পনা ও আশাবাদ। তদুপরি প্রায়শই মিথ্যার আবরণে হাবুডুবু খাচ্ছে বিস্তর ঢামাঢোল।
এখানে বিশেষ কোন সরকারের সময়ে প্রশাসনের স্বর্ণযুগ কারও সময়ে ব্যর্থতার যুগ, তামার যুগ, দুর্নীতি বা অবক্ষয়ের যুগ বলে আলোকপাত করতে চাচ্ছি না। কাহাকেও যেমন আকাশে নিক্ষেপ করা হয়নি, তেমনি আবার মাটিতেও ধপাস করে ফেলে দেয়া হয়নি। যে যাহাই বলুক না কেন, ৪২ বছরের আমলনামা কারও আজ পর্যন্ত না জানার তেমন কিছু অবশিষ্ট নেই। যার চর্বিত চর্বন করতে নিজেকেই বিব্রত বোধ মনে করি। তবে যা না বললেই নয় প্রশাসনের এমন কিছু দিকভ্রান্ত ঘটনার রেখাপাত করছি। একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের নাগরিক হয়ে, এতদিন যাবত সচিবালয় থেকে শুরু করে, পরিদফতর, অধিদফতর, করপোরেশন, জেলা ও উপজেলার অফিস আদালতে প্রশাসনিক কাজ করতে গিয়ে হরহামেশা মানুষ কিভাবে বৃটিশ, পাকিস্তান ও জমিদারদের সময়ের মতো নাজেহাল, উপেক্ষিত, বঞ্চিত, নিগৃৃত ও অহেতুক হয়রানি হচ্ছে এবং স্বাধীন বাংলাদেশের প্রশাসন ও কর্তাব্যক্তিদের নিকট হতে বছরের পর বছর কিভাবে অনাকাক্সিক্ষত অশুভ আচরণ, অবিচার ও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যতা হৃদয়ে ধারণ করে সহ্য করছে, এসব কিছু অবজ্ঞার সমাধানের লক্ষ্যে বলছি।
পত্র-পত্রিকা, মিডিয়া, টকশোতে প্রায় সময়েই দেখা যায়, এতদ বিষয়ে লেখক, কলামিস্ট, সাংবাদিক, গবেষক ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা অনেক সময় এগিয়ে আসতে দেখা গেলেও জাতির বিবেক  ও সমাজের দর্পণ হিসেবে পরিচিত প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের যেন চাহর হয় না। যদিও উনাদের কেহই বৃটিশ, পাকিস্তান ও জমিদার গোত্রের কেহ নহেন। উনারা এদেশেরই সুযোগ্য সন্তান ও গর্বিত সুনাগরিক।
৪২ বছর ধরেই প্রশাসনের দায়িত্বশীলরা যেমন সরকার ও মন্ত্রীদের ওপর দায়সারা বক্তব্য, ওজর-আপত্তি ও গোঁজামিল দাঁড় করিয়ে চলছে, তেমনি ক্ষমতাসীন সরকার, মন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন রাজনীতিকরা একই সুরে লাল ফিতার দৌরাত্ম্য বা আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কথা বলে এতসব কিছুর ধামাচাপা দিয়েই চলছে। প্রবাদে বলে, হিলে পাটায় ঘষাঘষি মরিচের জান শেষ। এসবই হচ্ছে, স্বাধীন দেশের প্রজাতন্ত্রের সরকার, প্রজাতন্ত্রের প্রশাসন ও প্রজাতন্ত্রের প্রজা সাধারণের অবস্থা।
এ ব্যাপারে প্রশাসনের চিহ্নিত খেতাবপ্রাপ্ত ও মার্কামারা সর্বনাশা দুর্নীতিবাজদের সম্পর্কে লিখতে যেমন কলম থামেনি, তেমনি প্রশাসনের সৎ, ন্যায়, নিষ্ঠাবান ও আদর্শপরায়ণদেরও যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন ও মূল্যায়ন করতেও কলম থেমে যায়নি। তাদের নাম ও পরিচিতি যেমন এ লেখায় পুরোটাতেই কুলাবেনা, তেমনি মার্কামারাদের নামের ফিরিস্তি এমন কয়েকটি কলামে সম্পন্ন না হওয়ারই কথা। অনেক বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে আমার মতো একজন অজানা, অচেনা ও নগণ্য ব্যক্তির কলাম দেশ, জাতি ও জনগণের কল্যাণে আজ প্রায় দীর্ঘ ২৬ বছর ধরে চলে আসছে। একজন লেখক, কলামিস্ট, ফ্রিল্যান্সার সাংবাদিক হিসেবে আমি সত্য উদঘাটনে প্রতিশ্রুতিপরায়ণ। (ঈড়সসরঃঃবফ ঃড় নব ঃৎঁব)
৩০ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন দেশের ভুখা, নাঙ্গা, অসহায় ও অন্য মানুষদের কাছ থেকে লুটেপুটে আহরিত অর্থখেকো হায়নাদের চালচিত্র তুলে না ধরলেও সমসাময়িক ওয়ান ইলেভেনে এর দৃষ্টান্ত কাগজে প্রকাশিত ও মিডিয়ায় প্রচারিত বাহনগুলোর প্রতিচ্ছবি ইতিহাসের নীরব সাক্ষী হয়ে রয়েছে। যদিও এ পর্যায়ে অনেকেই প্রতিচ্ছবিই মেঘে ঢাকা তারার মতো ঢেকে যাওয়ার কারণে আজও আলোর মুখ দেখেনি। তবে আবহাওয়াবিদরা বলেন, সবসময় তারা মেঘে ঢাকা থাকে না।
দুর্নীতি, অপকর্ম, অনিয়ম, অপসংস্কৃতি ও অন্যায়ের প্রতিবাদ করায় একজন মহকুমা প্রশাসকের (এসডিও) রোষানলের প্রেক্ষিতে একটি ছোট ঘটনা এখানে উল্লেখ না করলেই নয়। যদিও প্রায়শই লেখক, সাংবাদিক, কলামিস্ট ও সোচ্চার প্রতিবাদী ব্যক্তিদের জীবনে এসব কিছু আজ মামুলী ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বের ক্ষমতাধর মার্র্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউকিলিকসের পরিচালকের বিরুদ্ধে এতসব কিছু করলেও ইউকিলিকস সত্য উদঘাটনে চাপের মুখে সরে আজও যায়নি। ১৯৮৩ সনের ঘটনা। তখন আমি কিশোরগঞ্জ থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক নতুন দেশ পত্রিকার মালিক ও সম্পাদক ছিলাম। পত্রিকাটি চালানোর ব্যাপারে তখন অকপটে সকল প্রকার সাহায্য সহযোগিতা, বুদ্ধি পরামর্শ ও উৎসাহ প্রদান করেন কিশোরগঞ্জের তৎকালীন মহকুমা পুলিশ অফিসার (এসডিপিও) মাহবুবুর রহমান। মহকুমা জেলায় রূপান্তরিত হলে তিনি নেত্রকোনা জেলার পুলিশ সুপার হন। তিনি ডিএসপি হিসেবে পুলিশের চাকুরীতে যোগদানের পূর্বে একজন সুলেখক, প্রাবন্ধিক ও একটি কলেজের প্রভাষক ছিলেন। সেই সময় পত্রিকাটিতে কিশোরগঞ্জের মহকুমা প্রশাসকের অনিয়ম, দুর্নীতি ও অপসংস্কৃতিসহ কিছু দুর্বীনীত ঘটনার উল্লেখ করে হায়রে কপাল মন্দ চোখ থাকিতে অন্ধ শিরোনামে একটি লেখা প্রকাশিত হয়। লেখাটিতে তথ্য, তত্ত্ব, উপাত্তে বস্তুনিষ্ঠ বৈ কোন মিথ্যার অবলেহন না থাকাতে তিনি (এসডিও) এ নিয়ে ক্ষমতার তেমন কিছু ভাব দেখাননি। তখন দেশে সামরিক শাসন চলছিল। সে সময় উক্ত মহকুমা প্রশাসক কোন এক ব্যাপারে আমার জনৈক শিক্ষকের সাথে চরম দুর্ব্যবহার করেন এবং অবলীলাক্রমে অপমান করে অফিস থেকে বের করে দেন। এ ঘটনা জেনে সরাসরি উনার সাথে দেখা করে প্রতিবাদ করি। তিনি আমার সাথেও অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন। আমি তখন এ অপব্যবহারের প্রতিবাদ জানাই। পরবর্তী সময় ঈর্ষান্বিত হয়ে প্রতিবাদ করার জ্বালা সহ্য করতে না পেরে মহকুমা প্রশাসক আমার বিরুদ্ধে জেলা সামরিক আইন প্রশাসকের নিকট মিথ্যা, বানোয়াট, ভিত্তিহীন অভিযোগ করলে আমি তৎকালীন সময়ে ‘ক’ অঞ্চলের সামরিক আইন প্রশাসক মেজর জেনারেল আবদুর রহমান, এন.এস.আই মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আনোয়ার হেসেন, ডিজিডিএফআইয়ের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মাহমুদুল হাসানসহ প্রমুখ সামরিক ও বেসামরিক উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের শরণাপন্ন হই। তখন তাদের ন্যায়ানুগ হস্তক্ষেপে মিথ্যা অভিযোগ হতে অব্যাহতি লাভ করি। তাদের কাছ থেকে আইনানুগ ও ন্যায়সংগত সহযোগিতা না পেলে হয়তোবা আমাকে যথেষ্ট কষ্ট করতে হত। তাদের প্রতি আমার সনির্বন্ধ কৃতজ্ঞতা।
এতটুকু বলব, প্রশাসনের যেমন দুর্বীনীত ও খারাপ কর্মকর্তাদের কমতি নেই, তেমন ভাল ও ন্যায় নিষ্টাবানদেরও অভাব নেই।
এতসব কিছুর পর, আজকের প্রতিপাদ্য কলামের দিকে দৃষ্টি নিবন্ধ করছি। সরকার আসে, সরকার যায়। তবে সরকার পরিবর্তনের সাথে নিজ দোষ ও গুণে প্রশাসনের কর্মকর্তারা এদিক সেদিক ঘুরে বসলে বা সাময়িক সমস্যায় নিপতিত হলেও সরকারের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী ও অন্যান্যদের ন্যায়, সরকারি, গাড়ী, বাড়ী ও সরকারি অফিসসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা হারানোর মতো তেমন অবস্থার তিরোধানে একেবারে কমই চোখে পড়ে।
জগদ্দল পাথরের ন্যায় মাথার উপর চেপে বসা বৃটিশ আমলের ২০০ বছরের শাসনের নামে শোষণ এবং তাদের স্পৃষ্ট পাচাটা তাঁবেদার, জমিদার ও জমিদারতন্ত্রের ভয়াবহ নির্মমতা কারও না জানার কথা নয়। জমিদারদের খাজনা আদায়ের লোমহর্ষক হৃদয় বিদারক নির্যাতনের কাহিনী তাদের নায়েব, পাইক পেয়াদা, লাঠিয়াল বাহিনী, খাজাঞ্চী, তস্কর, ভাঁড়, চাটুকারদের অমানুষিক অত্যাচারে স্মৃতি চিহ্নিত টর্চার সেলের ধ্বংসপ্রাপ্ত দালানকোঠা আজও রক্তের কালিমা ধারণ করে রয়েছে। (চলবে)

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads