রবিবার, ২৭ অক্টোবর, ২০১৩

তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে সৃষ্ট সঙ্কট ও জনস্বার্থ

আবদুর রহমান
ষাটের দশকের শেষপ্রান্তে তুমুল ছাত্র ও গণ-আন্দোলনের বছরেই শিক্ষাজীবনের ইতি টেনে চাকরিতে যোগদান করি। প্রখ্যাত ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমেদসহ অন্যদের সাথে ব্যক্তিগত পরিচয়ের সূত্রে তাদের কর্মকাণ্ড খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ ও অংশগ্রহণের বিরল সৌভাগ্য আমার হয়েছে। তদুপরি ৭০-এর সাধারণ নির্বাচন থেকে ২০০৮ পর্যন্ত প্রায় সব জাতীয় নির্বাচন কাজে অংশগ্রহণ করেছি। ৩১ বছর ধরে যারা দেশ শাসন করেছেন এবং এখনো করছেন তারা বিভিন্ন সময়ে একই সাংবিধানিক প্রশ্নে বিরোধী দলে থাকাবস্থায় যে সমাধান দাবি করেন ক্ষমতায় গিয়ে ওই একই প্রশ্নে বিপরীত সমাধানের কথা বলায় বিুব্ধ মনে এ লেখা লিখছি। ক্ষমতায় যাওয়ার পথকে মসৃণ করার লক্ষ্য নিয়ে সাময়িক সমাধান হিসেবে অসাংবিধানিক দাবি মানার জন্য ১৭৩ দিন হরতাল, ৪৫ দিন অসহযোগ আন্দোলন ও সর্বোপরি পঞ্চম জাতীয় সংসদ থেকে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে ১৪৭ জন এমপি ১৯৯৪ সালে পদত্যাগের মাধ্যমে সংসদকে অকেজো করে দেন। এভাবে সাংবিধানিক সঙ্কট সৃষ্টি করা হয়েছিল। তা থেকে পরিত্রাণের জন্য তৎকালীন বিএনপি সরকার নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য সংবিধানের যে ত্রয়োদশ সংশোধনী পাস করেছিল, সব পক্ষই সেটা মেনে নিয়েছিল। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় গিয়েই আওয়ামী লীগের এক আইনজীবী ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের জন্য হাইকোর্টে রিট করেন। রিটটি ২০০৪ সালে হাইকোর্টে খারিজ হয়ে যাওয়ায় তিনি সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেন। তিনি মৃত্যুবরণ করায় আরেক আওয়ামী আইনজীবী রিটে পক্ষভুক্ত হন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার তাকে হাইকোর্টে বিচারপতিরূপে নিয়োগ দিয়েছে। তখন তার স্থলে আওয়ামী লীগের আরেক আইনজীবী রিটের পক্ষভুক্ত হয়ে শুনানিতে অংশ নেন। জাতির ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ মামলায় তিনবার বাদি পরিবর্তনের সুযোগ দেয়া হলো কেন। ১৯৯৪-১৯৯৬ সালে যেসব আওয়ামী ঘরানার আইনজীবী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলনের পক্ষে ছিলেন, তাদের ১০-১২ জনকে ১৯৯৬ সালে হাইকোর্টে বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। ১৯০৯ সালে আবার ক্ষমতায় গিয়ে তাদের চারজনকে পদোন্নতি দিয়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের নিয়োগদানের মাধ্যমে সাতজন বিচারপতির ফুল বেঞ্চে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের ব্যবস্থা করা হয়। এই চারজনের মধ্যে বিচারপতি এ বি এম খাইরুল হককে তিনজন সিনিয়রকে ডিঙিয়ে ১০ মাসের জন্য প্রধান বিচারপতি পদে পদোন্নতি দেয়া হয়। তিনি অবসরে যাওয়ার ১৫ দিন আগে ওই রিটের শুনানি করেন। শুনানিতে সুপ্রিম কোর্টকে পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করার জন্য আটজন প্রখ্যাত আইনজীবীকে এমিকাস কিউরি নিয়োগ দেয়া হয়। এদের মধ্যে ড. কামাল হোসেন, ড. এম. জহির, ব্যারিস্টার রফিক-উল হক, ব্যারিস্টার আমীরুল ইসলাম, ব্যারিস্টার রুকন উদ্দিন মাহমুদ, ব্যারিস্টার কিউ সি আজমালুল হোসেন, বিচারপতি টি এইচ খান, খন্দকার মাহবুব উদ্দিন ছিলেন। রিটের শুনানিতে আজমালুল হোসেন ছাড়া সাতজন এমিকাস কিউরি দেশের বৃহত্তর স্বার্থে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে মতামত ব্যক্ত করেন। অবাক করার মতো বিষয় এই যে, রায়ে তাদের মতামতকে অগ্রাহ্য করে আওয়ামী লীগের নিয়োগকৃত চারজন বিচারপতি তত্ত্বাবধায়ক সরকার অবৈধ ঘোষণা করেন এবং বিএনপি আমলে নিয়োগ করা তিনজন সিনিয়র বিচারপতি বৈধ বলে রায় দেন। তবে এমিকাস কিউরিদের মতামতের ওপর গুরুত্ব দিয়ে নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে হানাহানি বন্ধে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠানের পক্ষে অভিমত ব্যক্ত করা হয়। তবে সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার বিধান ত্রয়োদশ সংশোধনীতে থাকায় রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের পছন্দনীয় বিচারপতিকে প্রধান বিচারপতি করার প্রবণতা বিবেচনায় পরবর্তী দুটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান কে হবেন তা নির্ধারণের ভার সংসদের হাতে ন্যস্ত করা হয়। অথচ ত্রয়োদশ সংশোধনীতে একমাত্র সর্বশেষ প্রধান বিচারপতিই প্রধান উপদেষ্টা হতে পারতেন না, তার আগে অবসর গ্রহণকারী চারজন প্রধান বিচারপতি বা আপিল বিভাগের বিচারপতিও প্রধান উপদেষ্টা হতে পারতেন। কাজেই প্রধান বিচারপতির ওই যুক্তি টেকে না। আওয়ামী লীগ সরকার এই রায়ের যে অংশটুকু তাদের পক্ষে যায় তা পালনের জন্য তড়িঘড়ি করে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের আগেই সংক্ষিপ্ত রায়ের এক মাসের মধ্যে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ঐকমত্যে না পৌঁছেই ৩০/০৬/২০১১ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করে নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে মারাত্মক সঙ্কট সৃষ্টি করেছে। জনগণ আরো বেশি দুঃখ পেয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আন্দোলনে এবং পরে বাতিলে সংসদ নেত্রী হিসেবে প্রধানমন্ত্রী ও স্পিকার হিসেবে রাষ্ট্রপতির ভূমিকায়। আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা যে দাবিতে ১৯৯৪ সালে সংসদ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন, তারাই ১৭ বছর পরে সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলে নেতৃত্ব দেয় কোন নৈতিকতায়। জনগণ বিশ্বাস করে, নির্বাচনপূর্ব জরিপে অনুকূল ফলাফল পাওয়াতেই সরকার পাঁচটি সিটি করপোরেশনে মেয়াদ পূর্তির আগেই নির্বাচন দেয়। পরাজিত হওয়ার পর প্রথমে বলা হলো, গণতন্ত্রের জয় হয়েছে। এই সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন যে সম্ভব তা আবারো প্রমাণিত হয়েছে। কয়েক দিন পরে বলা হলো, জনগণ ভুল করে সৎ ও যোগ্য লোককে ভোট না দিয়ে সন্ত্রাসী ও দুর্নীতিবাজদের ভোট দিয়েছে। শুধু তাই নয়, প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত আক্ষেপের সুরে বললেন, ভালো কাজ করেও যদি ভোট না পাওয়া যায় তাহলে কী করার আছে। কয়েক দিন পরেই দাবি করা হলো, চারটি জরিপে তথ্য পাওয়া গেছে যে, আগামী নির্বাচনে তারাই জয়ী হবে, মাঠপর্যায়ে হাওয়া ঘুরে গেছে। শুধু উন্নয়ন করেই যদি ভোট পাওয়া যেত তাহলে সাবেক অর্থমন্ত্রী মরহুম সাইফুর রহমান ১২ বছর অর্থমন্ত্রী থাকাকালে সিলেটের যে উন্নয়ন করেছিলেন তাতে ২০০৮ সালে জীবনের শেষ নির্বাচনে তার পরাজিত হওয়ার কথা ছিল না। অথচ আরিফুল হক চৌধুরী সাড়ে চার বছর পরে সাইফুর রহমানের উন্নয়নকে পুঁজি করে সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জয়লাভ করে তাক লাগিয়ে দেন। জনমত কী কারণে বিরুদ্ধে যেতে পারে তা আগেই অনুধাবন করার মতো রাজনৈতিক প্রজ্ঞা আমাদের দেশের অনেক নেতার নেই বিধায় আজ রাজনীতির এই অবস্থা। উন্নয়নের পরেও জনমত কী কারণে আওয়ামী লীগের বিপক্ষে গেছে তার সঠিক কারণ অনুসন্ধান না করে নিজের অধীনে নির্বাচন দিয়ে জয় লাভে সমস্যার সমাধান হবে না, রাজনৈতিক সাফল্য হিসেবেও বিবেচিত হবে না। সবার মতামত উপেক্ষা করে নিজেদের ১৭ বছর আগের অবস্থানের বিপরীতে অবস্থান নিয়ে কার স্বার্থে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করা হলো। গত চারটি নির্বাচনে কোনো দলই পর পর দুবার নির্বাচনে জয়ী হতে পারেনি বিবেচনায় বিচারপতিরা দুটি নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার করার মতামত দিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতার বাইরে থাকতে ইচ্ছুক নয় বিধায় সুপ্রিম কোর্টের অভিমত ও সব সাধারণ নাগরিকের মতামতের তোয়াক্কা না করেই সঙ্কট সৃষ্টি করেছে। সমস্যাটা তাদেরই সংসদের মাধ্যমে সমাধান করতে হবে।


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads