৯০ শতাংশ মুসলমানের দেশ হলেও বাংলাদেশের মুসলমানরা এবারের ঈদুল আজহায় স্বাভাবিক আনন্দ উপভোগ করতে পারেননি। মন্ত্রীদের মুখে বাগাড়ম্বরের সীমা না থাকলেও ঘরমুখো মানুষের ভোগান্তি এবারও ছিল বর্ণনাতীত। ট্রেন বাস ও লঞ্চের কোনোটিতেই মানুষ চরম কষ্ট না করে বাড়ি যেতে পারেনি। ওদিকে গরু-ছাগলের তো বটেই, আদা ও পেঁয়াজ থেকে শসা ও কাঁচা মরিচ পর্যন্ত প্রতিটি প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম রাতারাতি চলে গিয়েছিল সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার অনেক বাইরে। এসবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল সরকারের প্রচ- দমন-নির্যাতন ও গ্রেফতার অভিযান। এমন কোনো জেলা-উপজেলার নাম বলা যাবে না, যেখানে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীরা ধাওয়ার মুখে না পড়েছেন। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর অনেক নেতা-কর্মীকেই কোনো মামলা না থাকা সত্ত্বেও গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তাদের ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতন চালানো হয়েছে। খোদ রাজধানীতে ঢাকার সাবেক মেয়র এবং বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকার দুটি বাসভবনে তল্লাশি চালিয়েছে গোয়েন্দারা। কিন্তু কোনো কারণ দেখানো হয়নি। নয়া পল্টনে অবস্থিত বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ও ঘিরে রেখেছে পুলিশ। বলেছে, আইন-শৃংখলা রক্ষার স্বার্থেই নাকি ব্যবস্থাটি নেয়া হয়েছে! অর্থাৎ সব মিলিয়েই সরকার ঈদের সময় এবার দেশজুড়ে অতংকের রাজত্ব কায়েম করেছিল। যার ফলে বিরোধী দলের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে বলতে হয়েছে, ঈদে আনন্দ করার পরিবেশ নস্যাৎ করেছে সরকার।
একযোগে দেশের রাজনৈতিক সংকট ও সামনের অনিশ্চয়তা আলোচিত হয়েছে মানুষের মুখে মুখে। এরও কারণ ক্ষমতাসীনরাই তৈরি করেছেন। নির্বাচনকালীন সরকারের প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রী সংবিধান থেকে ‘এক চুলও’ নড়বেন না বলে ঘোষণা দেয়ার পর থেকেই কথায় কথায় সংবিধানের দোহাই দেয়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছেন তারা। ফলে সমঝোতা প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনাও নষ্ট হয়ে গেছে। বিরোধী দলের পক্ষ থেকে কঠোর কোনো আন্দোলনে যাওয়ার পরিবর্তে বারবার আলোচনার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। ঈদের প্রাক্কালেও প্রস্তাব দিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব। অন্যদিকে ক্ষমতাসীনরা যথারীতি সংবিধানের ‘হাই কোর্ট’ দেখিয়েছেন। বলেছেন, যে কোনো বিষয়ে আলোচনা করতে চাইলে বিরোধী দলকে আগে সংসদে যোগ দিতে হবে। কথাটার সঙ্গে অন্য একটি শর্তও জুড়ে দিয়েছেন তারা। বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক বা নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা ছাড়া যে কোনো বিষয়ে আলোচনা হতে পারে। কথাটা ঈদের পরদিন সর্বশেষ বলেছেন ‘কালো বিড়াল’ নামে কুখ্যাত হয়ে ওঠা মন্ত্রী এবং সরকারের সংবিধান বিষয়ক মুখপাত্র সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। পুনরাবৃত্তি করে তিনি বলেছেন, উচ্চ আদালতের রায়ের আলোকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হয়ে গেছে। তাছাড়া নির্বাচনকালীন সরকারের ব্যাপারেও সংবিধানে স্পষ্টভাবেই বলা আছে। সুতরাং এ নিয়ে আলোচনার কোনো সুযোগ নেই। তারা যে বিরোধী দলকে ছাড়াই নির্বাচন করবেন সে কথাটাও যথেষ্ট ঔদ্ধত্যের সঙ্গেই জানিয়ে দিয়েছেন মিস্টার সেনগুপ্ত। প্রধানমন্ত্রী নিজেও অত্যন্ত কঠোর ভাষায় বিরোধী দলকে উস্কানি দিয়ে চলেছেন। বলে বেড়াচ্ছেন, নির্বাচনে জিততে পারবে না জেনেই বিরোধী দল নাকি সংঘাতের উস্কানি দিচ্ছে এবং নির্বাচন বানচালের চেষ্টা চালাচ্ছে! অসাংবিধানিক সরকারকে দিয়ে ভয় দেখাতেও ভুল হয়নি প্রধানমন্ত্রীর।
এভাবেই পবিত্র ঈদুল আজহার আনন্দ থেকে জনগণকে বঞ্চিত করেছে সরকার। ঘটনাপ্রবাহে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে নির্বাচনকালীন সরকারের প্রশ্নে ক্ষমতাসীনদের মনোভাব। কারণ, প্রতিটি প্রশ্নে নিজেদের ইচ্ছা ও পরিকল্পনা অনুযায়ী সংবিধানের দোহাই তো দিচ্ছেনই, বিভিন্ন সময়ে নিজেদের দেয়া ঘোষণা থেকেও দিব্যি সরে এসেছেন তারা। উদাহরণ হিসেবে ২৫ অক্টোবরের কথা উল্লেখ করা যায়। তারিখটিকে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী স্মরণীয় করেছিলেন। বলেছিলেন, আগেরদিন অর্থাৎ ২৪ আক্টোবর বর্তমান সংসদের শেষ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হবে। এর পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথাও বলেছিলেন তিনি। তার সে ঘোষণার সূত্র ধরেই স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীও ১২ সেপ্টেম্বর সংসদে জানিয়েছিলেন, এবারের অধিবেশন চলবে ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত। সেটাই হবে শেষ অধিবেশন। এরপর ২৫ অক্টোবর থেকে ২৪ জানুয়ারির মধ্যে পরবর্তী সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু এরই মধ্যে সানাইয়ে নতুন সুর ধরেছেন ক্ষমতাসীনরা। ঈদ-পূর্ব সর্বশেষ অধিবেশনে আওয়ামী লীগের ডাকসাঁইটে নেতারা জানিয়ে দিয়েছেন, ‘সংবিধান অনুযায়ী’ আগামী বছরের ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত বর্তমান সংসদই বহাল থাকবে। তারপর সংবিধানের নির্দেশনা অনুযায়ী পরবর্তী সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
নেতারা তাই বলে কিন্তু ২৪ জানুয়ারির পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলেননি। এসব কারণেই নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে শুধু নয়, নির্বাচন আদৌ অনুষ্ঠিত হবে কি না তা নিয়েও গুরুতর সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ক্ষমতাসীনরা চাইলে ‘সংবিধানসম্মতভাবেই’ সংসদের মেয়াদকে টেনে ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত শুধু নয়, যে কোনো সময় পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারেন। সংাবিধানকে তারা সেভাবেই সংশোধন করে রেখেছেন। তাছাড়া সংশোধিত সংবিধানে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে শুধু নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবেই রাখা হয়নি, জরুরি অবস্থা জারি করার ক্ষমতাও প্রধানমন্ত্রীর হাতেই রেখেছেন ক্ষমতাসীনরা। প্রয়োজন মনে করলে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে পরামর্শ করে যে কোনো সময় তিনি জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে এবং যতোদিন ইচ্ছা তা বহাল রাখতে পারেন। ওই সময় পর্যন্ত শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী পদে বহাল থাকবেন, বহাল থাকবে বর্তমান সংসদও। তেমন অবস্থায় কতদিন পর্যন্ত দেশকে জরুরি অবস্থার মধ্যে রাখা এবং নির্বাচন পিছিয়ে দেয়া যাবে এসব বিষয়ে সংবিধানে কোনো সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয়নি। এর ব্যাখ্যায় বলা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী যতোদিন ইচ্ছা জরুরি অবস্থা বহাল রাখতে পারবেন। আর জরুরি অবস্থার অর্থ যে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের যথেচ্ছভাবে গ্রেফতার করা ও তাদের ওপর নিষ্ঠুর দমন-নির্যাতন চালানো সেকথা নিশ্চয়ই উল্লেখের অপেক্ষা রাখে না। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এভাবেই সংবিধানকে নিজেদের ইচ্ছা পূরণের হাতিয়ার বানিয়ে রেখেছেন ক্ষমতাসীনরা। একই কারণে কথায় কথায় ভয়-ডরও দেখিয়ে চলেছেন তারা।
ঘটনাপ্রবাহে অন্য একটি বিষয়ও লক্ষ্যণীয় হয়ে উঠেছে। সেটা বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার জন্য সরকারের মরিয়া চেষ্টা। ১৯৭৩ সালের যুদ্ধাপরাধ আইন সংশোধন করা থেকে কথিত আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল গঠন এবং সে ট্রাইব্যুনালকে দিয়ে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের ফাঁসির রায় ঘোষণা করানো পর্যন্ত অনেক কৌশলই অবলম্বন করেছেন তারা। কথিত তরুণ প্রজšে§র আড়ালে নাস্তিক-মুরতাদ ও চরম ইসলাম বি™ে^ষীদের ঘাড়েও সওয়ার হয়েছেন। এজন্যই প্রশ্ন উঠেছে, ক্ষমতাসীনরা বেছে বেছে কেবল জামায়াতে ইসলামীকেই প্রধান টার্গেট বানিয়েছেন কেন? উত্তরের পর্যালোচনায় প্রাধান্যে এসেছে ক্ষমতাসীনদের অক্ষমতার দিকটি। বহু বছর ধরে বহু ধরনের কসরত করেও জামায়াতকে ‘ম্যানেজ’ করতে পারেননি তারা। এজন্যই দলটিকে নির্মূল করার অভিযানে নেমেছেন তারা। প্রধান উদ্দেশ্য তাদের দুটিÑ এক. আবারও ক্ষমতায় আসার জন্য নির্বাচনের মাঠে নিজেদের অবস্থানকে নিরংকুশ করা; এবং দুই. বাংলাদেশকে ভারতের সম্পূর্ণ ইচ্ছাধীন রাষ্ট্রে পরিণত করা। দুটি উদ্দেশ্যই অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। ভারতের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে হলে আওয়ামী লীগকেই আবারও ক্ষমতায় আনতে হবে। আর সেজন্য প্রথমে নির্বাচনে জিততে হবে। অন্যদিকে জামায়াত শুধু ভারতের এজেন্ডা বাস্তবায়নের রিরুদ্ধেই কঠোর ভূমিকা পালন করে চলছে না, নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ের পথেও প্রবলভাবেই প্রতিবন্ধকের অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
এমন অবস্থা চলছে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। জামায়াতকে ‘ম্যানেজ’ করার এবং পক্ষে টেনে নেয়ার চেষ্টাও তারা চালিয়ে দেখেছেন। কিন্তু আওয়ামী ফাঁদে কখনো পা দেয়নি জামায়াত। উদাহরণ দেয়ার জন্য ১৯৯১ সালের নির্বাচন পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের উল্লেখ করা যায়। ওই নির্বাচনে সমমনাদের নিয়ে আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ১৪২টি আসন। অন্যদিকে বিএনপির আসন সংখ্যা ছিল ১৩৯টি। সরকার গঠন করার জন্য আওয়ামী লীগের দরকার ছিল নয়জন এমপির সমর্থন। অন্যদিকে বিএনপির দরকার ছিল ১১ জন এমপির সমর্থন। জামায়াত সেবার ১৮টি আসনে জিতেছিল। অর্থাৎ জামায়াত যাকে সমর্থন দেবে সে দলই সরকার গঠন করতে পারবে। অমন এক অবস্থায় সমর্থনের বিনিময়ে আওয়ামী লীগ জামায়াতকে চারজন মন্ত্রীর পদ দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। কয়েকটি মহিলা আসনের প্রলোভনও দেখিয়েছিল দলটি। আওয়ামী লীগের পক্ষে দুতিয়ালি করেছিলেন আমির হোসেন আমু। অন্য এক নেতা অধ্যাপক গোলাম আযমেরও দ্বারস্থ হয়েছিলেন। কিন্তু দেশপ্রেমিক জামায়াত আওয়ামী লীগের প্রস্তাবে রাজি হয়নি বরং মন্ত্রিত্বসহ কোনো রকম লাভ বা ফায়দা ছাড়াই শর্তহীন সমর্থন দিয়েছিল বিএনপিকে। সে কারণেই বিএনপির পক্ষে সরকার গঠন করা সম্ভব হয়েছিল। বেগম খালেদা জিয়া প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। সে সময় থেকেই আওয়ামী লীগ জামায়াতের বিরুদ্ধে লেগে আছে। মাঝখানে কেয়ারটেকার সরকারের দাবিতে বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে একযোগে আন্দোলন করলেও ‘রাগ’ পড়েনি আওয়ামী লীগের।
অন্যদিকে মূলত জামায়াতের দেশপ্রেমিক অবস্থান ও ভূমিকার কারণে বিএনপি আবারও জামায়াতকে সঙ্গে নিয়েছিল। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি ও জামায়াতের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা চারদলীয় জোটের কাছেই শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছিল আওয়ামী লীগ। দলটির আসন নেমে এসেছিল ৫৮টিতে। জোট সরকারের আমলে প্রধান বিরোধী দল হিসেবেও জনগণের স্বার্থে উল্লেখযোগ্য কোনো অবদানই রাখতে পারেনি আওয়ামী লীগ। সে কারণে একদিকে আওয়ামী লীগের জনসমর্থন নিচের দিকে নেমে গিয়েছিল অন্যদিকে জনপ্রিয়তা বেড়েছিল বিএনপি ও জামায়াতসহ চারদলীয় জোটের। ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ সব দেশের গোয়েন্দা সংস্থার সার্ভে বা অনুসন্ধানেই দেখা গিয়েছিল, ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভরাডুবি ঘটবে। এই ভরাডুবি শুধু আওয়ামী লীগের জন্য নয়, ভারতের জন্যও হজম করা সম্ভব ছিল না। কারণ, জোট সরকার প্রথম থেকেই ভারতের সম্প্রসারণবাদী পরিকল্পনার বিরুদ্ধে প্রতিরোধের প্রাচীর গড়ে তুলেছিল। এজন্যই দেশটি এগিয়েছিল ষড়যন্ত্রের পথে। বিশেষ করে জামায়াত-বিরোধী সুচিন্তিত পরিকল্পনার বিষয়টিকে গোপন রাখা যায়নি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে জামায়াতসহ ইসলামী দল ও সংগঠনগুলোর বলিষ্ঠ ভূমিকায় ভারতের নেতৃত্বে আধিপত্যবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তি যথেচ্ছভাবে ইচ্ছাপূরণ করতে পারছিল না বলেই ১/১১-এর মাধ্যমে ক্ষমতা দখল এবং ‘রোডম্যাপ’ বাস্তবায়নের চেষ্টা চালানো হয়েছিলÑ যার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল দেশপ্রেমিক ও ইসলামী দলগুলোকে, বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামীকে উৎখাত করা। কিন্তু হাজার চেষ্টা সত্ত্বেও সেটা সম্ভব হয়নি।
এই ব্যর্থতার পরই শুরু হয়েছিল নতুন ষড়যন্ত্র। এর শুরুটা করে গিয়েছিল সেনা সমর্থিত অবৈধ সরকার। ভারতের ইন্ধনে যুদ্ধাপরাধের মতো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সৃষ্ট ইস্যুতে জড়িয়ে জামায়াতে ইসলামীকে বিপদে ফেলার এবং সম্ভব হলে উৎখাত করার চেষ্টা চালিয়েছিলেন জেনারেল মইন উ’রা। আওয়ামী লীগ সরকারও ওই সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য মাঠে নেমেছে। এ ষড়যন্ত্রের কারণেই ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন ভ-ুল হয়ে গেছে। লগি-বৈঠার হত্যা-সন্ত্রাসের পেছনেও আওয়ামী লীগ এবং ভারতই প্রধান ভূমিকা রেখেছিল। জেনারেল মইন উ’কে দিয়ে ক্ষমতা দখল করানো থেকে ডিজিটাল নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসানো পর্যন্ত সবকিছু ঘটেছে সে ষড়যন্ত্রের ভিত্তিতে। কিন্তু এত কিছু করা সত্ত্বেও ভারতের পক্ষে সম্পূর্ণ ইচ্ছা পূরণ করা সম্ভব হয়নি। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর জামায়াতে ইসলামীসহ দেশপ্রেমিক দলগুলোর প্রতিরোধ বরং অনেক কঠিন ও প্রত্যক্ষ হয়েছিল। এই প্রতিরোধ ভেঙে দেয়ার উদ্দেশ্য থেকেই ভারত কথিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ইস্যুকে সামনে এনেছে। বাংলাদেশকে তাঁবেদার রাষ্ট্র বানানোর পরিকল্পনা বাস্তবায়নের শর্ত ও দায়বদ্ধতা রয়েছে বলে আওয়ামী লীগ সরকারও কথিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নামে তৎপর হয়ে উঠেছে। পরিষ্কার হয়ে গেছে, মূলত ভারতের উস্কানিতেই ক্ষমতাসীনরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নামে পাড়া মাতিয়ে বেড়াচ্ছেন। তাদের উদ্দেশ্য জাতিকে বিভক্ত করা এবং দেশে রাজনৈতিক সংঘাত অনিবার্য করা।
এখানে জামায়াতের ব্যাপারে ভারতীয়দের মনোভাব সম্পর্কে কিছু তথ্য স্মরণ করা দরকার। বাংলাদেশ সফরে আসার প্রাক্কালে ২০১১ সালের ২৯ জুন নয়াদিল্লীতে সিনিয়র সম্পাদকদের সঙ্গে এক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং-এর একটি মন্তব্য এরকম একটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ তথ্য। ওই বৈঠকে মনমোহন সিং বলেছিলেন, বাংলাদেশে ‘যে কোনো সময়’ রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটতে পারে। কিভাবে বা কারা এই পটপরিবর্তন ঘটানোর চেষ্টা করবে বা করছে সে প্রশ্নের উত্তরে না গিয়ে পরের নিঃশ্বাসেই মনমোহন সিং বলেছিলেন, বাংলাদেশের অন্তত ২৫ শতাংশ মানুষ জামায়াতে ইসলামীর সমর্থক এবং তারা তীব্র ভারতবিরোধী। পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইকেও টেনে এনেছিলেন মনমোহন সিং। বোঝাতে চেয়েছিলেন যেন আইএসআই-এর সহযোগিতায় জামায়াতে ইসলামী ‘পটপরিবর্তন’ তথা শেখ হাসিনার সরকারের পতন ঘটানোর আয়োজন সম্পন্ন করে ফেলেছে! অন্যদিকে অমন অনুমান আসলে মোটেও সত্য ছিল না। কারণ, জামায়াতের প্রতি সত্যিই ২৫ শতাংশ মানুষের সমর্থন থাকলে যতো ‘ডিজিটালই’ হোক না কেন, ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অন্তত ক্ষমতায় আসতে পারতো না। তাছাড়া জামায়াতের সঙ্গে দেশের প্রধান দল বিএনপিও ছিল। এই বাস্তবতা সত্ত্বেও মনমোহন সিং যেহেতু বাংলাদেশে আসার ঠিক প্রাক্কালে বলেছিলেন সেহেতু তার কথাটা নিয়ে পর্যালোচনাও যথেষ্টই হয়েছিল। মূল কথার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী আসলে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে সরাসরি ‘ধমক’ দিয়েছিলেন। বুঝিয়েছিলেন, কথা না শুনলে কিংবা ঘাড় বাঁকাতে চাইলে শেখ হাসিনা আর ক্ষমতায় থাকতে পারবেন না।
এখানেই ছিল প্রকৃত হিসাব-নিকাশের ব্যাপার। কারণ, লগি-বৈঠার হত্যা-সন্ত্রাসের অজুহাতে ১/১১ ঘটানো থেকে ডিজিটাল নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসানো এবং শেখ হাসিনার সরকারকে দিয়ে একের পর এক নিজের দাবি ও ইচ্ছা পূরণ করিয়ে নেয়া পর্যন্ত সবকিছুর পেছনে ভারতই প্রধান ভূমিকা পালন করে এসেছে। এ প্রচারণাও রয়েছে যে, ভারতের ইচ্ছা ও পছন্দের বাইরে অন্য কোনো দল বা নেতার পক্ষে বাংলাদেশের ক্ষমতায় যাওয়া সহজে সম্ভব নয়। অর্থাৎ ‘পটপরিবর্তন’ যদি ঘটেও যায় তাহলে তার পেছনেও প্রধান নির্ধারকের ভূমিকা থাকবে ভারতেরই। সে লক্ষ্যেই চেষ্টা চালাচ্ছেন ক্ষমতাসীনরা। এজন্য বিচারের নামে পাড়া মাতিয়েই তারা বসে থাকছেন না, সম্ভাব্য অন্য সব পন্থাতেও জামায়াতকে বিপন্ন করতে চাচ্ছেন। সবশেষে তারা জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার ভয়ংকর খেলায় মেতে উঠেছেন। একযোগে চলছে গোটা দেশকেই সংঘাতের দিকে ঠেলে দেয়ার চেষ্টা। পর্যবেক্ষকরা অবশ্য মনে করেন না যে, ভারতের এজেন্ডা বা পরিকল্পনা এবং ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছাই বাংলাদেশের জন্য শেষকথা হতে পারে। মাঝখানে জনগণের পাশাপাশি রয়েছে বিএনপি ও জামায়াতের মতে ব্যাপকভাবে জনসমর্থিত দলগুলো। রয়েছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও। সুতরাং সময় একেবারে পেরিয়ে যাওয়ার আগেই ক্ষমতাসীনদের উচিত জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার চেষ্টা থেকে সরে আসা এবং ২৪ অক্টোবরের মধ্যে বিরোধী দলের দাবি অনুযায়ী সংবিধানে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা সম্পর্কিত বিধান যুক্ত করা। তেমন সদিচ্ছার প্রকাশ তারা ঘটাচ্ছেন না বলেই জনগণের মধ্যে দ্রুত উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়ছে। ২৫ অক্টোবরের প্রাক্কালে গভীর উদ্বেগের সঙ্গে আমরা শুধু এটুকুই বলতে পারি, সমঝোতার পথে পা না বাড়ানোর ফলে রাজনৈতিক অঙ্গনে সংঘাত ছড়িয়ে পড়তে পারে আর একথা তো বলাই বাহুল্য যে, সহিংসতার পরিণতি সব সময় ভয়ঙ্করই হয়ে থাকে। এর কুফলও সাধারণত ক্ষমতাসীনদেরই ভোগ করতে হয়।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন