সোমবার, ২১ অক্টোবর, ২০১৩

প্রধানমন্ত্রীর সর্বদলীয় সরকার ও দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা


সংসদের মেয়াদ পূর্তির প্রেক্ষাপটে ২৪ অক্টোবর-উত্তর রাজনৈতিক অবস্থাকে সামনে রেখে বেশ কিছুদিন ধরে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তপ্ত হতে শুরু করেছে। এর মধ্যে আওয়ামীপন্থী এবং ইসলামবিদ্বেষী কিছু কিছু গণমাধ্যমের অপপ্রচার সারা দেশে এক আতঙ্কজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। তারা জামায়াত-শিবির ও হেফাজতে ইসলামসহ দেশের ইসলামী শক্তিগুলোকে সন্ত্রাসী ও জঙ্গী আখ্যা দিয়ে নানা কাল্পনিক গল্প তৈরী করে দেশবাসীকে তাদের বিরুদ্ধে একদিকে উস্কিয়ে দেয়ার প্রয়াস শুরু করে অন্যদিকে তাদের রণপ্রস্তুতিরও মিথ্যা বানোয়াট কাহিনী প্রচার করে জাতিকে বিভ্রান্ত করতে থাকে। তারা এই মর্মেও মিথ্যাচার প্রচার করতে থাকে যে, জামায়াত-শিবির তাদের নেতা-কর্মীদের ঈদের ছুটি বাতিল করেছে এবং তারা পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকারী স্থাপনায় আঘাত হানার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাদের সাথে বিএনপি, ছাত্রদল ও যুব দলের কর্মীরাও সরকারের বিরুদ্ধে ধ্বংসাত্মক কর্মকা-ে যোগ দিচ্ছে। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের দুঃশাসন-অত্যাচার, নিপীড়ন, হামলা-মামলা, স্বৈরাচার দুর্নীতি প্রভৃতিতে বীতশ্রদ্ধ দেশবাসী যখন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে আসন্ন সাধারণ নির্বাচনে অবাধ ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের জন্য উদগ্রীব তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হঠাৎ করে ঘোষণা করলেন যে, তিনি ১৮ অক্টোবর জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবেন। অনেকেই ভেবেছিলেন যে, তার এই ভাষণে হয়তো নির্দলীয় সরকারের একটা রূপরেখা থাকবে এবং তার দল এক তরফা নির্বাচনের যে ছক তৈরি করেছেন তা থেকে তিনি সরে আসবেন। দেশ সংঘাত সংঘর্ষ থেকে রক্ষা পাবে। কিন্তু মানুষের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। অবশ্য একটি বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী তার পূর্বের অবস্থান থেকে সরে এসে একটা চমক সৃষ্টি করেছেন বলে মনে হয়। তিনি নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় সরকারের ঘোষণা দিয়েছেন। বিরোধীদলীয় নেত্রীকে তিনি তার প্রস্তাবিত সরকারে মন্ত্রী হিসেবে অন্তর্ভুক্তির জন্য প্রতিনিধি মনোনয়নের আহ্বান জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর এই প্রস্তাবটি সম্পূর্ণ নতুন ও আনুষ্ঠানিক। এর আগে তিনি একবার লন্ডনে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কথা বলেছিলেন। কিন্তু তার গঠনপ্রণালী অস্পষ্ট ছিল। এখন তিনি পরিষ্কারভাবেই বলেছেন যে, সব দল থেকে প্রতিনিধি নিয়ে নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় সরকার গঠন করা হবে। অবশ্য তার এই প্রস্তাবেও অনেক অস্পষ্টতা এখনো আছে। সর্বদলীয় বলতে তিনি কোন কোন দলকে বুঝাচ্ছেন তা তিনি পরিষ্কার করেননি। তার এক প্রভাবশালী মন্ত্রী বলেছেন যে, সংসদে প্রাপ্ত আসন সংখ্যার অনুপাতে প্রস্তাবিত সরকারে প্রতিনিধি নেয়া হবে। তার কথা যদি সত্য হয় তা হলে বিএনপি’র ভাগে একটির বেশী মন্ত্রিত্ব জুটবে না। কেননা মন্ত্রীর সংখ্যা যদি ১০ জন হয় তাহলে বিদ্যমান অনুপাত অনুযায়ী বিএনপি’র প্রতিনিধিত্ব এক দশমাংশের বেশী নয়। ১৮ দলীয় জোটের অন্যান্য শরিক, যাদের সংসদে প্রতিনিধিত্ব আছে তারা তো অনুপাতে আসার প্রশ্নই নেই। এই অবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর সর্বদলীয় মন্ত্রী সভার ১০ সদস্যের ৯ জনই হবেন আওয়ামী লীগের বা মহাজোটের, এরশাদের দল জাতীয় পার্টিকে একজন মন্ত্রী দেয়াও হতে পারে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী কে হবেন? শেখ হাসিনা তার প্রস্তাবে বিস্তারিত না বললেও তার দলের নেতারা বহুদিন থেকেই বলে আসছেন যে, বর্তমান প্রধানমন্ত্রীই নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান থাকবেন। আবার ১৮ তারিখের ভাষণে তিনি যে প্রস্তাব দিয়েছেন তারপর তার দলের সাধারণ সম্পাদক ও এলজিআরডি মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফ, পরিবেশমন্ত্রী ড. হাসান মাহমুদ, দফতরবিহীন মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম প্রমুখ কোনও রকম দ্ব্যর্থবোধকতার অবকাশ না রেখেই বলেছেন যে, সর্বদলীয় সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনাই থাকবেন। তাদের দলের ওয়ার্কিং কমিটির সিদ্ধান্তও তাই।
আমি সংবিধান বিশেষজ্ঞ নই। কিন্তু বাংলা ও ইংরেজী দু’টি ভাষাতেই সংবিধানের প্রতিটি লাইন ও বাক্য পড়ার আমার সুযোগ হয়েছে। এতে কোথাও আমি নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় সরকারের বিধান পাইনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর আগে বলেছিলেন যে, তিনি সংবিধান থেকে একচুলও নড়বেন না। কিন্তু তার দেয়া নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় সরকারের এই প্রস্তাবটি প্রমাণ করে যে, তিনি একচুল নয়, সংবিধান থেকে বহু যোজন দূরে চলে এসেছেন। এটা আমার কাছে একটি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি বলে মনে হয়। মুখে তিনি নিজের শক্তি-সামর্থ্য এবং অদম্য স্পৃহা ও অনমনীয় যত মনোভাবই প্রকাশ করেন না কেন বিরোধী দলের অবস্থান এবং স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের প্রস্তুতি সম্ভবত তাকে ভীত-সন্ত্রস্ত ও দুর্বল করে তুলেছে এবং এর অভিব্যক্তির প্রতিফলন ঘটেছে তার প্রস্তাবে। কেউ কেউ একে "ঈধসবষং যবধফ রহ ঃযব ঃবহঃ' বলে মনে করেন। উটের মাথা অত্যন্ত উঁচু, এই মাথা যদি একবার তাঁবুতে ঢুকতে পারে তাহলে পাছা ঢুকাটা সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায় মাত্র। বিরোধী দল যদি গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা, স্বৈরাচারের পতন, দলীয় ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের অবসান, জুলুম, নির্যাতন ও হামলা-মামলা বন্ধ করা এবং নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে অবাধ নির্বাচনের দাবি আদায়ের আন্দোলন আরো জোরদার করতে পারে তাহলে উটের পাছা তাঁবুতে ঢোকার গতি অবশ্যই ত্বরান্বিত হবে। আমি যা দেখেছি আওয়ামী লীগের বশংবদ ও ‘র’য়ের উচ্ছিষ্টভোগী কতিপয় সাংবাদিক বুদ্ধিজীবী, আইনজীবী এবং এই দলটি ও তার অঙ্গসংগঠনের অবৈধ সুবিধাভোগী কতিপয় নেতাকর্মী ছাড়া জাতি এখন দুর্নীতিবাজ, জালিম ও স্বৈরাচারী এই সরকারর কবল থেকে মুক্তি চায় এবং তারা আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত। কেয়ারটেকার সরকার চায় ৯০ শতাংশ ভোটার।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সর্বদলীয় সরকারের প্রস্তাবটিকে জাতি একটি ভাঁওতাবাজি বলে মনে করে। এর অনেকগুলো কারণ রয়েছে। প্রথমতঃ সর্বদলীয় বলে এবং তার সাথে এমপি হবার শর্ত জুড়ে দিয়ে তিনি একটি চাল চেলেছেন। তার এই চালটি ফাঁস করে দিয়েছেন তার দলের নেতারা। তারা বলেছেন যে, প্রস্তাবিত সরকারের মন্ত্রী নেয়া হবে সংসদে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে। শেখ হাসিনা নিশ্চয়ই জানেন যে বিগত নির্বাচনে জেনারেল মঈন উ আহমেদের আশীর্বাদ, ভারতীয় টাকার বস্তা ও উপদেশ এবং নির্বাচন কমিশনের পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি ও তার দল সংসদে তিন-চতুর্থাংশ আসনেরও বেশি পেয়ে জয়ী হয়েছেন। এখন যদি আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে তার প্রস্তাবিত সরকার গঠিত হয় তাহলে সেই সরকার আওয়ামী লীগের সরকারই হবে। বড়জোর বিএনপি থেকে একজন এবং জাতীয় পার্টি থেকে একজন আসতে পারে। এই প্রতিনিধিত্ব যদি প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যার ভিত্তিতে হয় তাহলে বিএনপি, জামায়াত ও আঠারদলীয় জোট মন্ত্রিসভার প্রায় অর্ধেক সদস্য পেতে পারে। কিন্তু তা হবার নয়। এখানে বিলিয়ন ডলারের যে প্রশ্নটি উঠেছে সেটি হচ্ছে এই সরকারের প্রধানমন্ত্রী কে হবেন? আগেই বলেছি শেখ হাসিনা পরিষ্কার না করলেও তার সভাসদ, দলের নির্বাহী কমিটি এবং ঘনিষ্ঠ জনেরা এটা পরিষ্কার করে দিয়েছেন যে, তিনিই হবেন প্রধানমন্ত্রী। শেখ হাসিনার লালিত অভিলাষও তাই। ২০০৭ সালে ২২ জানুয়ারি জাতীয় নির্বাচন হবার কথা ছিল। তখনকার সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনের অব্যবহিত পূর্বে অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির কেয়ারটেকার সরকারের প্রধান হবার কথা ছিল। আওয়ামী লীগের কাছে এই অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি, বিচারপতি কেএম হাসান গ্রহণযোগ্য হননি। কেন না তার চাকরি জীবনের আগে, প্রায় ৩২ বছর পূর্বে তিনি জাতীয়তাবাদী আইনজীবী সমিতির সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। যদিও পরবর্তী, বিচারিক কার্যক্রম কোথাও তার দলীয় আনুগত্যের, দলপ্রীতির অথবা বিএনপি’র প্রতি সহানুভূতির কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। আওয়ামী লীগের কাছে সংবিধানের ৫৮(গ) ধারার ৩, ৪, ৫ উপ-ধারায় বর্ণিত প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ সংক্রান্ত কোন বিধানই গ্রহণযোগ্য না হওয়ায় অবশেষে প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ (৬) উপ-ধারা বলে নিজ দায়িত্বের অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি বিএনপি’র সক্রিয় নেতা বা কর্মী ছিলেন না অথবা এমপিও ছিলেন না। যেমন আমাদের আজকের প্রেসিডেন্ট জনাব আব্দুল হামিদ আওয়ামী লীগের একজন এমপি ও সংসদের স্পীকার ছিলেন। জনাব ইয়াজউদ্দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জাতীয়তাবাদী শিক্ষকদের সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন, ‘এটাই ছিল তার অপরাধ এবং এই অপরাধে শেখ হাসিনা একজন প্রবীণ শিক্ষক ও দেশের রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিনকে ব্যঙ্গ করে সবসময় ‘ইয়েস উদ্দিন’ বলে অভিহিত করতেন। তার এই অবজ্ঞা, উপেক্ষা ও অপমানের জন্য তখন কেউ তার বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করেননি। এখন যেমন তার, এমনকি তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে কেউ হাসি-তামাশা করলেও মানহানির মামলা ঠুকে দেয়া হয় এবং আদালত স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে জেল-জরিমানা দেয়। শেখ হাসিনা ও তার দলের অনমনীয় অবস্থান দেশব্যাপী হরতাল, অবরোধ, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ এবং নৈরাজ্য সৃষ্টির এই ঘটনা বেশিদিন আগের নয়। তাদের এই আন্দোলন ১/১১ সৃষ্টি করেছিল এবং সেনাসমর্থিত কেয়ারটেকার সরকার গঠনে প্রধান ভূমিকা পালন করেছিল। শেখ হাসিনা নিজেই এ সরকারকে তার আন্দোলনের ফসল বলেছিলেন এবং ঐ সরকারের সাফল্যকে তার দলের সাফল্য এবং ব্যর্থতাকে তার দলের ব্যর্থতা অভিহিত করে মঈন উদ্দিন-ফখরুদ্দীনের সরকারকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করার জন্য নিজ দলের নেতা-কর্মীদের নির্দেশ দিয়েছিলেন। তার আন্দোলনের ফসল এই সরকারই যখন তাকে গ্রেফতার করল এবং দেশের নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে হুমকি বলে তাকে আখ্যায়িত করে প্রেসরিলিজ জারি করল তখনই তারা খরাপ হয়ে গেল। এবং শুধু তারা নয়, পুরো তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থাই তার কাছে চক্ষুশূল হয়ে পড়লো এবং তিনি উচ্চ আদালতের রায়ের দোহাই দিয়ে রায় প্রকাশের আগেই তড়িঘড়ি সংবিধান সংশোধন করে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধান সংযোজন করলেন। ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত তিনি জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে কেয়ারটেকার সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য তুমুল আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন এবং ২৭৩ দিন হরতাল করে দেশব্যাপী অবরোধ, নৈরাজ্য, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের সৃষ্টি করে নির্দলীয়, নিরপেক্ষ সরকার আদায় করে যে রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন দেশ-বিদেশের মানুষ তা এখনও ভোলেনি। কিন্তু এই সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে প্রথমবার ক্ষমতায় এসে তিনি যে দুঃশাসন, অত্যাচার, নির্যাতন ও দুর্নীতির রেকর্ড গড়লেন তাতে দ্বিতীয়বার নির্চাচনে দেশের মানুষ তাকে ক্ষমতায় পাঠায়নি। এ জন্য তিনি তারই পছন্দের নিয়োগপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি, প্রধান উপদেষ্টা এবং প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ পুলিশ বাহিনী, সেনাবাহিনী, বিডিআর বাহিনী সবাইকে পাইকারীহারে বেঈমান, বিশ্বাসঘাতক বলে গালি দিলেন। এই গালি গোপনে ছিল না, প্রকাশ্যে ছিল। ২০০১ সালের নির্বাচনে তার পরাজয়কে তিনি মানতে পারেননি এবং ২০০৭ সালের নির্বাচনে তার ভরাডুবির আশঙ্কায় তিনি দেশে সন্ত্রাস, নৈরাজ্যের সৃষ্টি করে সেনাসমর্থিত কেয়ারটেকার সরকজারকে নিয়ে আসেন। ঐ সরকারের আমলে দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার রাষ্ট্রীয় সম্পত্তির অপচয়, খুন-হত্যা প্রভৃতির অপরাধে তার বিরুদ্ধে মামলা হয়, তিনি গ্রেফতার হন এবং তাকে নির্বাসিত করার চেষ্টাও চলে। ঐ সময়ে বেগম খালেদা জিয়াকেও গ্রেফতার করা হয়েছিল এবং দেশকে বিরাজনীতিকরণের একটি অপচেষ্টা চলে। শেখ হাসিনার মধ্যে তখনই তত্ত্বাবধায়ক বিরোধী একটি শক্ত মনোভাব গড়ে উঠে। তিনি বুঝতে পারেন যে, ক্ষমতায় থাকাকালে তিনি যত অপকর্ম করেছেন বা করবেন তত্ত্বাবধায়ক আমলে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে এবং তাকে জবাবদিহিতার সম্মুখীনও করা হতে পারে। আবার নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে তার পক্ষে ক্ষমতায় যাওয়া কঠিনও হয়ে যেতে পারে। এই অবস্থায় তিনি পিতার অনুকরণে দলন-পীড়ন ও একদলীয় শাসন ব্যবস্থার দিকে এগুতে শুরু করেন এবং তারই ধারাবাহিকতায় বিএনপি-জামায়াত জোটে প্রথম ভাঙন এবং পরে দল দুটিকে নিশ্চিহ্নকরণের পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
আমি এখানে ২০০৮ সালের নির্বাচনের কিছু প্রতিধ্বনি শুনতে পাই। ঐ নির্বাচনের আগে বিএনপি অফিস বন্ধ করে রাখা হয়েছিল। সরকারি নির্দেশে নির্বাচন কমিশনের তরফ থেকে বিএনপিকে দ্বিখ-িত করার চেষ্টা হয়েছিল। তাকে নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে দেয়া হয়নি। নির্বাচনের মাসখানেক আগে মাত্র বিএনপি অফিসের তালা খুলে দেয়া হয়েছিল এবং খুলে দেয়ার জন্য হাইকোর্টে মামলাও করতে হয়েছিল। এখন আমি প্রায় ঐ পরিবেশই দেখতে পাচ্ছি। তবে একটি ভিন্ন আবহে। জামায়াতের কেন্দ্রীয় ও মহানগর দফতর সরকার তিন বছর ধরে অঘোষিতভাবে বন্ধ করে রেখেছে, সেখানে দলের নেতা-কর্মীরা প্রবেশ করতে পারেন না। সাদা পোশাক ও ইউনিফর্ম পরা র‌্যাব-পুলিশ বাহিনী সেখানে পাহারা দিচ্ছে। জেলা-উপজেলার অবস্থাও প্রায় একই। বিএনপি অফিসের সামনে দিয়ে যখন যাই তখন পুলিশ পাহারায় গণতন্ত্রের নমুনা কিছু দেখা যায়। বলা হচ্ছে নির্বাচনের আর তিন মাস বাকী। বিএনপি বলুন আর জামায়াত বলুন কিংবা ইসলামী ঐক্যজোট বা হেফাজত অথবা অন্য কোন বিরোধী দলÑ তাদের কোন নেতাকর্মী এখন বাসায় ঘুমাতে পারেন না। তারা কোথাও একত্র হলে বলা হয় যে, তারা নাশকতার পরিকল্পনা করছেন এবং তাদের গ্রেফতার করা হয়। তাদের সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকারগুলো থেকে বঞ্চিত করে রাখা হয়েছে। আমি আইয়ুব খানের স্বৈরাচার দেখেছি, ইয়াহিয়া খানের স্বেচ্ছাচার ও দমন-নিপীড়ন দেখেছি। স্বাধীনতা উত্তর শেখ মুজিব সরকারের বিরোধীদলের উপর নির্যাতন দেখেছি, এরশাদের ক্ষমতালিপ্সা, দুর্নীতি, দলন-নিপীড়ন এবং স্বৈরতন্ত্র দেখেছি। কিন্তু বর্তমান মহাজোট সরকারের দুঃশাসনের সাথে কাউকে তুলনা করতে পারি না।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচনকালীন জাতীয় সরকারের প্রস্তাব দিয়ে নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টির যে নতুন ঘোষণা দিয়েছেন তাকে বিশ্বাসযোগ্য মনে করার কারণ আমি খুঁজে পাচ্ছি না। তার প্রস্তাবের ১৯ ঘণ্টার মধ্যেই তিনি রাজধানীতে সভা-সমাবেশ, মিছিল, মানববন্ধন, এমনকি ঘরোয়া রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনের উপরেও নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। গত পরশু পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের জাতীয় কনভেনশন অনুষ্ঠানের কথা ছিল। বেলা তিনটা থেকে অনুষ্ঠিতব্য এই সম্মেলনের অনুমতি সময়মত পুলিশ দেয়নি। সারাদেশ থেকে এখানে প্রতিনিধি আসার কথা ছিল। একজন আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে আমারও যাবার কথা ছিল। সম্মেলন অনুষ্ঠানের অনুমতি নিয়ে পুলিশ প্রশাসনের গড়িমসির কারণে দেশের বহু অঞ্চল থেকে প্রতিনিধিরা আসতে পারেননি। আমার পক্ষেও যাওয়া সম্ভব হয়নি। দুপুরে যখন পুলিশ অনুমতি দেয় তখন বলা হয় যে, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে এই অনুমতি দেয়া হয়েছে। এত্থেকে পরিষ্কার বুঝা যায় যে, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশেই পুলিশ কর্তৃপক্ষ মিটিং-মিছিল, সভা-সমাবেশ, মানববন্ধন প্রভৃতির ন্যায় মৌলিক রাজনৈতিক অধিকারগুলো থেকে দেশের মানুষকে বঞ্চিত করছেন। এ ধরনের একজন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনকালে নিরপেক্ষ থাকবেন এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সমুন্নত রাখবেন তা কিভাবে আশা করা যায়? তার অতীত ও বর্তমান এই আশাবাদের অনুকূলে নয়। বাংলাদেশে এখন এমন কোন প্রতিষ্ঠান নেই যা তিনি দলীয়করণ করেননি। উপজেলা পরিষদকে তিনি অকার্যকর করে জেলা পরিষদে দলীয় লোক বসিয়ে দিয়েছেন। বেসামরিক প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন থেকে শুরু করে সর্বত্র তার দলীয় লোকেরা প্রচ- প্রতাপে ক্ষমতাসীন। তার ও তার দলের লোকদের কথায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী উঠবস করে। পুলিশ বিজিবিতে অথবা অন্য সরকারি দফতরসমূহ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গত পাঁচ বছরে যত লোক নিয়োগ দেয়া হয়েছে তার ৯৫ শতাংশই তার দল ও অঙ্গ-সংগঠনের ক্যাডার। তিনি দেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবেও কাজ করছেন এবং এই প্রেক্ষিতে সশস্ত্র বাহিনীও তার নিয়ন্ত্রণে রয়েছেন। এই অবস্থায় অতি রাজনৈতিক একটি প্রশাসন এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর ন্যায় প্রবল শক্তিধর, কলহপ্রিয়, আক্রমণপ্রবণ প্রতিহিংসাপরায়ণ ও রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট একজন ব্যক্তির অধীনে এবং এমপিদের স্ব স্ব পদে রেখে একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হতে পারে না। পুলিশ অথবা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদিচ্ছা থাকলেও তাদের পক্ষে নিরপেক্ষ হওয়া সম্ভবপর নয়। সর্বদলীয় নয় নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারই এর একমাত্র সমাধান। আঠার দলীয় জোট যদি তাদের আন্দোলন তীব্র করতে পারে, ভয়-ভীতি উপেক্ষা করতে পারে তাহলে এই লক্ষ্য অর্জন করা অসম্ভব কিছু নয়। কারণ যে বিরোধী দল সামান্য ঝাঁকুনি দিয়ে রানা প্লাজার মতো নয়তলার একটি বিশাল ভবন ফেলে দিতে পারে তাদের পক্ষে কিছুই অসম্ভব নয়। তবে নাড়াটা একটু জোরে দিতে হবে বলে আমার বিশ্বাস। সিভিল ও পুলিশ প্রশাসনের পুনর্বিন্যাস, নির্বাচন কমিশনের পুনর্গঠন এবং ভোটার তালিকা সংশোধন/ হালনাগাদকরণের প্রশ্ন এর পরেই আসবে। সময় অত্যন্ত দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে সংঘাত সংঘর্ষ নয়, শান্তি স্বস্তিই দেশবাসীর কাম্য।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads