রবিবার, ৬ অক্টোবর, ২০১৩

সরকার যখন জনমতের বিপরীতে


সুন্দরবন এলাকার রামপাল তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পটি এখন দেশের সবচেয়ে আলোচিত ও বিতর্কিত ইস্যু। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী গত বৃহস্পতিবার জানিয়েছেন, সরকার রামপালে কয়লাচালিত ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। ভারতের সাথে যৌথ উদ্যোগে এ প্রকল্প সরকার বাস্তবায়ন করবেই। তিনি আরো বলেছেন, পরিবেশবিদেরা যাই বলুক সরকার এ প্রকল্প বাস্তবায়ন বাতিল করবে না। পরিবেশ অধিদফতর সম্প্রতি যে ইআইএ (এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট) স্টাডি দিয়েছে, তা বিভিন্ন মহল থেকে প্রবল সমালোচনার মুখে পড়েছে। তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী বলেছেন, আমরা পরিবেশবিদদের কথা শুনেছি এবং পরিবেশগত উদ্বেগ দূর করার পদক্ষেপ নেয়ার ব্যবস্থা করেছি। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত শনিবার রামপালে না গিয়েও কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় বসেই রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ ভিত্তি স্থাপন করেছেন। ভিত্তি স্থাপনের এ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরোধিতার পেছনে অন্য উদ্দেশ্য রয়েছে। তার সরকার পরিবেশের কোনো ক্ষতি করবে না। যারা এই বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের বিরোধিতা করছে, তারা জ্ঞানপাপী। 
সুন্দরবনের ১৪ কিলোমিটার দূরে রামপালে কয়লাভিত্তিক এই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের বিরোধিতা করে বাম সমর্থিত তেল-গ্যাস রক্ষা কমিটি সম্প্রতি লংমার্চ করেছে। লংমার্চকারী তেল-গ্যাস রক্ষা কমিটি বলছে, সুন্দরবনের একদম কাছে হওয়ায় এ প্রকল্প থেকে সৃষ্ট দূষণ বনের পরিবেশ ও প্রতিবেশের ক্ষতি করবে। ফলে জীববৈচিত্র্য নষ্ট হয়ে বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন ঝুঁকির মুখে পড়বে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপিও এই প্রকল্পের বিরোধিতা করছে। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদও বিএনপির সাথে সুর মিলিয়ে কথা বলেছেন। গত ২৯ সেপ্টেম্বর বোরবার বিকেল ৫টায় খুলনার জনসভায় বেগম খালেদা জিয়া বলেন, রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র হতে দেয়া হবে না। একই দিন সন্ধ্যার দিকে গণমাধ্যমে বিবৃতি পাঠিয়ে প্রকল্পটি বাতিলের দাবি জানান জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ। খালেদা জিয়া সুন্দরবন ও সেখানকার জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের আশঙ্কা ব্যক্ত করে এই প্রকল্পের বিরোধিতা করেন। এইচ এম এরশাদও এ প্রকল্পকে সুন্দরবন ধ্বংসের একটি আত্মঘাতী প্রকল্প বলে আখ্যায়িত করেন। 
তেল-গ্যাস রক্ষা কমিটির লংমার্চের সময় সাধারণ মানুষকে এই কমিটির দাবির প্রতি স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন জানাতে দেখা গেছে। বাম ধারার লোকদের সমর্থিত কোনো দল বা কমিটির কোনো সমাবেশে সাধারণত লোকসমাগম খুব কমই ঘটে। তবে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরোধিতা করে অনুষ্ঠিত লংমার্চে লোকসমাগম ছিল চোখে পড়ার মতো। এ থেকে কিছুটা হলেও অনুমান করা যায়, জনমত রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিপক্ষেই তুলনামূলকভাবে বেশি। কিন্তু জনমতের বিপক্ষে দাঁড়ানো এ সরকারের বরাবরের অভ্যাস। সরকার জেদ ধরে বসেছে, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ বাস্তবায়ন করা হবেই, যে যাই বলুক না কেন। 
সবচেয়ে বড় কথা সরকারের উচিত ছিল এ ধরনের বিতর্কিত একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে জনমত যাচাই করে নেয়া। কিন্তু এ সরকারের কাছে জনমত সব সময়ই উপেক্ষিত। এ প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রেও এ সত্যেরই প্রতিফলন রয়েছে। রামপালের ১৩২০ মেগাওয়াট শক্তিসম্পন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্রটির জন্য প্রয়োজনীয় ভূমির জন্য অ্যাকুইজেশন অর্ডারটি ইস্যু করা হয় ২০১০ সালের ২৭ ডিসেম্বর। ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্য কাদা-পানির বন সুন্দরবনের অতি নিকটের রামপালে এ বিদ্যুৎকেন্দ্রটি যৌথভাবে নির্মাণের জন্য একটি চুক্তি স্বাক্ষর হয় ভারতীয় কোম্পানি এনটিপিসি ও বাংলাদেশী কোম্পানি পিডিবির মধ্যে। এ চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয় ২০১২ সালের ২৯ জানুয়ারি। এরপর ইআইএ (এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট) সমীক্ষা পিডিবির ওয়েবসাইটে ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে প্রকাশ করা হয় জনমত যাচাইয়ের জন্য। এ থেকে বিষয়টি স্পষ্ট প্রকল্পের স্থান চিহ্নিত ও চূড়ান্তকরণের পর লোকদেখানো জনমত যাচাইয়ের আহ্বান করা হয়। এর আগেই প্রকল্পের স্থান চূড়ান্ত হয়ে যাওয়ায় জনমতের ওপর ভিত্তি করে বিকল্প কোনো স্থানে এ প্রকল্প স্থানান্তরের কোনো সুযোগই হাতে ছিল না। এ ক্ষেত্রে রামপালে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পরিবেশগত প্রভাব বিবেচনায় স্থাপিত হবে কি হবে নাÑ এ বিবেচনারও কোনো সুযোগ ছিল না। ২০১৩ সালের এপ্রিলে পিডিবি আয়োজিত জনমত বিনিময় অনুষ্ঠানে অনেক বিশেষজ্ঞ ও সংগঠন এর ইআইএ সমীক্ষা প্রত্যাখ্যান করে। পরিবেশ অধিদফতর ইআইএ অনুমোদন করেনি। কিন্তু ভারত ও বাংলাদেশ সরকার প্রকল্পটি অব্যাহত রেখেছে, বর্তমানে মাটি ভরাটের কাজ চলছে, যা বাস্তবায়ন করছে বিডিপি (বাংলাদেশ ডিজেল প্ল্যান্ট), যা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান। 
এটি সবারই জানা, একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ভয়াবহ পরিবেশ দূষণ সৃষ্টি করে। কোনো দেশেই আবাসন, কৃষি ও বনাঞ্চলের ২০-২৫ কিলোমিটারের কম দূরত্বের কোনো স্থানে বড় ধরনের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের অনুমোদন দেয়া হয় না। অথচ রামপাল সুন্দরবন থেকে মাত্র ১৪ কিলোমিটার দূরে ভারতীয় কোম্পানি এনটিপিসি বাংলাদেশের একটি কোম্পানির সাথে মিলে যৌথভাবে এই বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজে নামলেও এনটিপিসি তার দেশে কখনোই এ ধরনের সুযোগ পাবে না। কারণ ভারতের পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের ২০১০ সালের আগস্টে তৈরি করা কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণসংক্রান্ত ইআইএ ম্যানুয়েলে স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে : Location of the thermal power stations are avoided within 25 km of the outer periphery of the following : metropolitan Cities; National Park and Wildlife Sanctuaries; Ecolozically Sensitive areas like Tropical Forest, Biosphere Reserve, important lake and coastal areas rich in coral formation. 'অথচ এই ভারতে যা পরিবেশ দূষণের কারণে করা যায় না, ভারতেরই একটি কোম্পানি আজ বাংলাদেশের একটি কোম্পানিকে দিয়ে তাই জায়েজ করে বাস্তবায়ন করতে শুরু করেছে রামপাল বিদ্যুকেন্দ্রে। এই হচ্ছে বাংলাদেশের পরম বন্ধু ভারতবাসীর আন্তরিকতার নমুনা। জানি না, আমাদের প্রধানমন্ত্রী ভারতের এই ইআইএ ম্যানুয়েলটি পড়ে দেখেছেন কি না। পড়ে দেখলে নিশ্চয়ই তার এমনটি বলার সুযোগ থাকত না যে, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র সুন্দরবন থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে হলেও তা সুন্দরবনের পরিবেশ-প্রতিবেশের কোনো ক্ষতি করবে না। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ এমন অভিমতও প্রকাশ করেছেন, প্রকৃত প্রস্তাবে রামপালের দূরত্ব সুন্দরবন থেকে ১৪ কিলোমিটার নয়, বরং মাত্র ৯ কিলোমিটার। আমাদের ইআইএ এও স্বীকার করেছে যে, 'once it was a part of Sundarbans but had been evacuated by the settlers.'.' অতএব, বলাবাহুল্য, দূরত্ব যাই হোক, এক সময় যে রামপাল ছিল সুন্দরবনের অংশ, তাকে সুন্দরবনের অংশই থাকতে দেয়া উচিত; কারণ এর সাথে সুন্দরবনের ঘনিষ্ঠ সংশ্লিষ্টতা থাকাই স্বাভাবিক। কার্যত নদী ও খালের মাধ্যমে সুন্দরবনের সাথে এর ঘনিষ্ঠ সংযোগ রয়েছে। সে জন্যই রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের যেকোনো দূষণ সুন্দরবনের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে বাধ্য এবং রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের আগে পরিবেশের ওপর সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে ব্যাপক সমীক্ষা চালানো অপরিহার্য। 
সংশ্লিষ্ট তথ্যাভিজ্ঞদের মতে, ১৩২০ মেগাওয়াট শক্তিসম্পন্ন এই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণপূর্ব ও নির্মাণকালীন একটা প্রভাব রয়েছে। এটি নির্মাণ শেষ হতে সাড়ে চার বছর সময় নেবে। সরকার এই প্রকল্পের জন্য জোর করে ১৮৪৪ একর জমি অ্যাকোয়ার করেছে, যে জমি প্রধানত কৃষিজমি ও চিংড়ির ঘের। ইআইএ সমীক্ষা মতে, এলাকার জমি প্রধানত কৃষি ও চিংড়ি চাষে ব্যবহার হয়। সাধারণত সমীক্ষাভুক্ত এলাকার ৭৫ শতাংশই কৃষিজমি এবং প্রকল্প এলাকার ৯৫ শতাংশই কৃষিজমি। সমীক্ষা এলাকায় ধান উৎপাদনের পরিমাণ ৬২৩৫৩ টন। এবং প্রকল্প এলাকায় ধান উৎপাদন হয় ১২৫৫ টন। সমীক্ষা এলাকায় ধানবহির্ভূত শস্য উৎপাদনের পরিমাণ ১৪০৪৬১ টন। এলাকাটি সমৃদ্ধ মাছ উৎপাদন এলাকা বলেও ইআইএ সমীক্ষায় উল্লেখ আছে। এ সমীক্ষায় কী বিপুল পরিমাণ মাছ উৎপন্ন হয় তার বিস্তারিত পরিসংখ্যানে উল্লেখ রয়েছে। এর ফলে যে বিপুল ক্ষতি হবে সে কথাও ইআইএ সমীক্ষায় স্বীকার করা হয়। তবে সরকারকে খুশি করতে সমীক্ষায় এও বলা হয়, যা ক্ষতি হবে প্রকল্প থেকে পাওয়া উপকার এই ক্ষতিকে ছাপিয়ে যাবে। জানি না, এ সমীক্ষাকারীরা এ ধরনের মন্তব্য করার সময় পরিবেশগত ক্ষতির বিষয়টি তাদের বিবেচ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল কি না। থাকলে পরিবেশগত ক্ষতিকে তারা অপূরণীয় ক্ষতি বলেই বিবেচনা করতেন। তবে এ সমীক্ষায় নির্মাণপূর্ব ও নির্মাণকালে সুন্দরবনের ইকোসিস্টেমের ওপর যে বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি হবে সে কথাটি স্বীকার না করে পারেনি। এ সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়। 'If navigational, spillage, noise, speed, lighting, waste disposal rules regulations are not properly maintained, it many impact the Sundarbans ecosystems especially tiger, deer, crocodile, dolphins, mangroves etc.' 
এ সমীক্ষায় আরো স্বীকার করা হয়, জেটি নির্মাণের কারণে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কয়েকটি কাদাপানির বনগুচ্ছ নষ্ট হয়ে যাবে। নির্মাণ পর্যায়ে কঠিন বর্জ্য ও বর্জ্য পানি সেখানকার পানি দূষিত করবে। 
প্রকল্প চালু হওয়ার পরও তা যে পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কয়লাভিত্তিক এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি চালু থাকবে কমপক্ষে ২৫ বছর। এই সময়ে এ বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে। এ ক্ষেত্রে প্রথমেই আসে বিষাক্ত সালফার ও নাইট্রোজেন গ্যাসের প্রভাবের বিষয়টি। ইআইএ অনুসারে এই ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষম বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে প্রতিদিন ১৪২ টন সালফার ডাই-অক্সাইড ও ৮৫ টন নাইট্রোজেন অক্সাইডের উদগিরণ ঘটবে। স্পষ্টতই এর ফলে সুন্দরবন এলাকার বায়ুতে সালফার ডাই-অক্সাইড ও নাইট্রোজেন গ্যাসের ঘনত্ব বেড়ে যাবে। আর তা পুরো সুন্দরবন এলাকার পরিবেশ বিনষ্ট করার বড় একটি কারণ হয়ে দাঁড়াবে। কিন্তু ইআইএ এই সালফার ডাই-অক্সাইড ও নাইট্রোজেন গ্যাস উদগিরণের বিষয়টি অনুমোদনযোগ্য সীমার ভেতরে দেখানোর জন্য একটি কৌশল অবলম্বন করেছে। ইআইএ এনভায়রনমেন্ট কনজারভেশন রুল ১৯৯১ (ইসিআর ১৯৯১) অনুযায়ী সুন্দরবনকে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইকোলজিক্যাল এরিয়া হিসেবে না দেখিয়ে দেখিয়েছে একটি আবাসিক ও গ্রামীণ এলাকা হিসেবে। এ কৌশল অবলম্বন করে ইআইএ দাবি করেছে, যদিও এই প্রকল্প চালু হওয়ার পর এই অঞ্চলের বায়ুতে নাইট্রোজেন গ্যাসের ঘনত্বের পরিমাণ ৩ গুণ বেড়ে যাবে, তবুও ইসিআর ১৯৯১ অনুযায়ী তা ঊর্ধ্বসীমার নিচে থাকবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সুন্দরবনকে আমরা একটি আবাসিক ও গ্রামীণ এলাকা হিসেবে বিবেচনা করতে পারি কি না? যেখানে সুন্দরবন বিশ্বের বৃহত্তম একটি কাদা-জলের (ম্যানগ্রোভ) বন এবং সেখানে আমরা কী করে এই সুন্দরবনকে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইকোলজিক্যাল এরিয়াহিসেবে বিবেচনা না করে নিছক একটি রেসিডেনশিয়াল অ্যান্ড রুরাল এরিয়াহিসেবে বিবেচনা করতে পারি? এমনটি করার কারণ, রামপাল প্রকল্পটিকে পরিবেশগতভাবে জনসমক্ষে নিরাপদ বলে প্রতীয়মান করা। এইকভাবে আজ থেকে ৩০ বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসের ১২৩০ মেগাওয়াট শক্তিসম্পন্ন ফায়েট বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের সময় ১৯৭৯ সালের ফাইনাল এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট স্টেটমেন্টে (ইআইএস) এ কথা নিশ্চিত করা হয়েছিল নতুন এই ফায়েট বিদ্যুৎকেন্দ্র এর কাছের এলাকার বাদাম, অর্চার্ড ও সবজিক্ষেতের ওপর কোনো ধরনের ক্ষতি করবে না। এই বিদ্যুৎকেন্দ্র চালুর কয়েক বছর পর এর উৎপাদন ক্ষমতা বাড়িয়ে ১৬৯০ মেগাওয়াট করা হয়। এই বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বছরে ৩০ হাজার টন সালফার ডাই-অক্সাইডের উদগিরণ ঘটে। ফল দাঁড়াল বাদাম, অর্চার্ড ও সবজিক্ষেতের ওপর ব্যাপক ধ্বংসাত্মক প্রভাব। জানি না রামপাল একই ধরনের কিছু ঘটায় কি না আমাদের সুন্দরবন এলাকায়? 
হাফিংটন পোস্ট জানিয়েছে, ফায়েট বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বছরে ৩০ হাজার টন সালফার ডাই-অক্সাইড উদগিরণের ফলে এ কেন্দ্র থেকে ৪২ কিলোমিটার দূরের এলাকার গাছপালা ও কৃষির ওপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়েছে। তাহলে প্রশ্ন জাগে, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে দিনে ১৪২ টন কিংবা বছরে ৫২ হাজার টন সালফার ডাই-অক্সাইডের উদগিরণ ১৪ কিলোমিটার দূরের সুন্দরবনের গাছপালা ও কৃষির ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে ও পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট করবেÑ এমন আশঙ্কাই বড় হয়ে দেখা দেয়। এ অবস্থায় রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি করবে নাÑ প্রধানমন্ত্রীর এমন বক্তব্যের ওপর কী করে আস্থা রাখি? 
পরিবেশগত জটিল ক্রিয়া-বিক্রিয়া ও বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া ঘটে প্রকৃতিতে। সেসব প্রক্রিয়া বিশ্লেষণ করলেও আমরা একটি সত্যিই জানব, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নিশ্চিতভাবেই পরিবেশের ক্ষতি করবে বড় মাপে। সেসব জটিল প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের অবকাশ এ লেখায় অবশ্যই নেই। তবে আরেকটি সহজবোধ্য বিষয় উল্লেখ করে এ লেখার ইতি টানতে চাই। জানা গেছে, এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রয়োজনে প্রাক্কলিত হিসাব মতে, পশুর নদী থেকে ঘণ্টায় ৯১৫০ ঘনমিটার পানি তোলা হবে এবং নদীতে ঘণ্টায় ছাড়া হবে ৫১৫০ ঘনমিটার পানি। বলার অপেক্ষা রাখে না, এতে করে পশুর নদীর পানিতে বৈশিষ্ট্যগত পরিবর্তন আসবে। এর ফলে পানিতে লবণাক্ততা বেড়ে যেতে পারে, পলি পড়ার ধরন পাল্টে যেতে পারে, বন্যা ও স্রোতের আচরণে আসতে পারে বৈচিত্র্য। এর ফলে সে এলাকায় কী ধরনের পরিবেশগত পরিবর্তন আসবে, তা এখনো বোধগম্য নয়। কিন্তু ইআইএ পানি তোলার পরিমাণ নদীর পানির ১ শতাংশেরও কম উল্লেখ করে এ প্রকল্পকে জায়েজ করতে চেয়েছে। বিবেচনায় আনা হয়নি এর পরিবেশগত প্রভাবের বিষয়টি। 
এর পরও আছে পানিদূষণ, শব্দদূষণ, তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া, ছাইদূষণ, স্বাস্থ্য সমস্যাসহ আরো নানামাত্রিক বিরূপ প্রভাব নিয়ে আশঙ্কা। এসব বিবেচনায় জনমত এ প্রকল্পের বিরুদ্ধে বলেই মনে হয়। তবুও সরকারের প্রবল জেদÑ রামপাল বিদ্যুকেন্দ্র হবেই, কেউ তা ফেরাতে পারবে না। সর্বশেষ খবর হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী গত শনিবার রামপালে না গিয়েই ভেড়ামারা থেকেই এই প্রকল্পের ভিত্তি স্থাপন করেছেন। তেল-গ্যাস সুরক্ষা কমিটির নেতারা বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী জনগণের ভয়ে রামপাল না গিয়েই দূর থেকে এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভিত্তি স্থাপন করে এলেন। এ ব্যাপারে দেশবরেণ্য প্রবীণ সাংবাদিক এবিএম মূসা বলেছেন, কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা থেকে যদি রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র উদ্বোধন হয়, তবে আগামী নির্বাচনও এভাবে হবে রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে। 
একটি সরকারকে তখনই দক্ষ বলে আখ্যায়িত করা যায়, যখন সরকার জনগণের মন পাঠ করতে পারে, জনগণের চাওয়া-পাওয়ার তাপ-উত্তাপ উপলব্ধি করতে পারে এবং সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিয়ে তা বাস্তবায়নে এগিয়ে যায়। এর বিপরীত কিছু করতে যাওয়ার অপর অর্থ চরম বোকামি করে বিপদ ডেকে আনা। জনমতের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে পরিবেশগত বাস্তবতাকে অস্বীকার করে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে প্রধানমন্ত্রীর জেদ সে ধরনের এক চরম বোকামি। এমন একটি বোকামি করতে এ সরকারকে আমরা দেখেছিলাম অপ্রয়োজনে আড়িয়ল বিলে বঙ্গবন্ধুর নামে একটি বিমানবন্দর ও তৎসংলগ্ন একটি নগর গড়ে তোলার পদক্ষেপ নিয়ে; কিন্তু এক সময় সরকারকে নানা ঘটনা-দুর্ঘটনার জন্ম দিয়ে জনমতের প্রবল চাপের কাছে নতি স্বীকার করে সেখান থেকে লেজ গুটিয়ে ফেরত আসতে হয়। জানি না, রামপালে তেমনি কোনো ঘটনা ঘটার আশঙ্কায় আশঙ্কিত কি না এই সময়ের দেশবাসী? 
আসলে জনমতের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে জেদি আচরণ প্রদর্শন এ সরকারের একটি বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন আয়োজনের প্রশ্নটির কথাই ধরুন। সব বিরোধী দল এবং এমনকি মহাজোট সরকারের অনেক শরিক দলও নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের পক্ষে। প্রথম আলোর একটি জরিপ মতে, দেশের ৯০ শতাংশ মানুষ চায় দেশে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হোক। সুশীলসমাজও তাই চায়। তার পরও প্রবল এ জনমতের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সরকারের চরম জেদÑ দলীয় সরকারের অধীনেই হবে আগামী নির্বাচন। এই জেদি মনোভাব নিয়েই এ সরকারের বরাবরের চলা। এ ধরনের জেদি মনোভাব সাধারণ মানুষ যে পছন্দ করছে না, তা সাম্প্রতিক কয়েকটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে শাসক দলের ভরাডুবি থেকে স্পষ্ট হলেও সরকার তা স্বীকার করছে না; বরং সরকারের জেদের প্রাবল্য দিন দিন আরো বাড়ছে। এখনো দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করার ব্যাপারে সরকার মরিয়া ও চরম জেদি। কী করে তা সম্পন্ন করা যায়, তারই কূটকৌশল খোঁজায় ব্যস্ত সরকারের গোটা যন্ত্র এখন ব্যস্ত। ফলে ২৫ অক্টোবর বর্তমান সরকারের মেয়াদ শেষে দেশে কী ঘটে তা নিয়ে জনমনে শঙ্কা শুধু বাড়ছেই। সরকারের জেদি মনোভাব পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষ এখন দিশেহারা। তবে সরকার দিশেহারা কি না, মানুষ জানে না। 


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads