শুক্রবার, ১১ অক্টোবর, ২০১৩

আরো বেশিদিন ক্ষমতায় থাকার ফন্দি-ফিকির


এই সত্য অনেক আগেই প্রমাণিত হয়েছে, জনমত জরিপের মতো কোনো কিছু নিজেদের বিপক্ষে গেলেই আওয়ামী লীগের নেতারা তেড়ে ওঠেন। কিন্তু এবার একই সঙ্গে ভয়ও পেয়েছেন তারা। এ ব্যাপারে জানানও আবার তারাই দিচ্ছেন। যেমন একটি জাতীয় দৈনিকে ১০ অক্টোবর প্রকাশিত এক জনমত জরিপের রিপোর্টে জানানো হয়েছে, ৫০ দশমিক তিন শতাংশ মানুষ বিএনপিকে ভোট দিতে চান। অন্যদিকে আওয়ামী লীগকে ভোট দিতে চেয়েছেন ৩৬ দশমিক পাঁচ শতাংশ মানুষ। অন্য দলগুলোর মধ্যে জাতীয় পার্টিকে সাত শতাংশ এবং জামায়াতে ইসলামীকে দুই দশমিক নয় শতাংশ মানুষ ভোট দেবেন বলে জানিয়েছেন। তালিকায় আওয়ামী মহাজোটের আর কোনো দলের নাম-গন্ধ নেই। এ রিপোর্টটি দেখেই তেড়ে উঠেছেন ক্ষমতাসীনরা। উল্লেখযোগ্যদের মধ্যে সবার আগে দৃশ্যপটে এসেছেন ‘কালো বিড়াল’ নামে কুখ্যাত সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, সংবিধান সংশোধনের কর্মকা-ে প্রধান ভূমিকা রাখার কারণে যাকে ‘আওয়ামী মোড়ল’ হিসেবেও চিহ্নিত করা হয়েছে। জনমত জরিপের রিপোর্টটি প্রকাশিত হওয়ার দিনই এক অনুষ্ঠানে তিনি বলে বসেছেন, বিশেষ ওই দৈনিকটি নাকি ‘বিএনপির আলো’। এর বিচ্ছুরণ কখন কার দিকে যায় তার নাকি ঠিক নেই। এটা তাই সবার আলো নয়, ‘বিএনপির আলো’!
আরো কিছু ব্যঙ্গাত্মক এবং আক্রমণাত্মক কথাও বলেছেন মিস্টার সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। কিন্তু সেদিকে যাওয়ার আগে দুটি তথ্য স্মরণ করা দরকার। প্রথম তথ্যটি হলো, যে দৈনিকটিকে ধরে তিনি টানাটানি করেছেন তার সম্পাদক এক সময় মিস্টার সেনগুপ্তর সঙ্গে একই কমিউনিস্ট পার্টি করতেন। পার্থক্য হলো, মিস্টার সেনগুপ্ত যেখানে একজন নেতার ভূমিকা পালন করেছেন, ওই সম্পাদক সেখানে পার্টির সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। লগিÑবৈঠার হত্যা-সন্ত্রাস থেকে ১/১১ ঘটানো এবং দুই নেত্রীকে ‘মাইনাস’ করার চেষ্টায় ওই সম্পাদকের ভূমিকা ছিল বহুল আলোচিত। তখন কিন্তু ‘কমরেড’ সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে উচ্চবাচ্য করতে দেখা যায়নি। কারণ, দৈনিকটির ভূমিকা তখন তার পক্ষে ছিল। পাঠকদেরও নিশ্চয়ই মনে পড়বে, আওয়ামী লীগের ভেতরে ‘র‌্যাটস’ নামে বিখ্যাত হয়ে ওঠা যে চার নেতা শেখ হাসিনাকে ‘মাইনাস’ করার ব্যাপারে খুবই তৎপর ছিলেন মিস্টার সেনগুপ্ত ছিলেন তাদের একজনÑ ‘র‌্যাটস’-এর ‘এস’ অক্ষরটি দিয়ে সুরঞ্জিতকেই বোঝানো হতো। বাকি তিনজন ছিলেন আবদুর রাজ্জাক, আমির হোসেন আমু এবং তোফায়েল আহমেদ। তখন সমর্থন করলেও এবং মনে মনে প্রীত হলেও এবার একই দৈনিক ও তার সম্পাদকের বিরুদ্ধে তেড়ে ওঠার কারণ সম্পর্কে নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না। দৈনিকটির জনমতে বিএনপিই শুধু অনেক এগিয়ে যায়নি, জামায়াতে ইসলামীর মতো সেনগুপ্তদের চোখে ‘নিন্দিত ও ঘৃণিত’ একটি দলও প্রায় তিন শতাংশ ভোট পেয়ে গেছে! এমন ফলাফল মিস্টার সেনগুপ্তর পক্ষে আসলেও হজম করা খুব কঠিনÑ এমনকি অসম্ভবও! অথচ সে খবরই আগাম জানা গেছে দৈনিকটির জনমত জরিপ থেকে। মিস্টার সেনগুপ্তও সে কারণে দৈনিকটিকে ‘বিএনপির আলো’ বানিয়ে ছেড়েছেন। বলেছেন, এর বিচ্ছুরণ কখন কার দিকে যায় তার নাকি ঠিক নেই!
ক্ষমতাসীনদের এই প্রতিক্রিয়া কিন্তু অন্য একটি ঘটনাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। পাঠকদেরও মনে পড়তে পারে, ২০১০ সালের অক্টোবরে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরোধিতা করতে গিয়ে বেগম খালেদা জিয়া যখন দেশকে হানাহানির দিকে ঠেলে না দেয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন তখন তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছিলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হলে দেশ বিভক্ত হবেÑ এটা কারো কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ, ‘পুরো জাতি’ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চায়। বিশ্ববাসীরও এ বিচারের প্রতি সমর্থন রয়েছে। বিদেশী দুটি সংস্থার এবং ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার-এর জরিপের উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, এসব জরিপে দেখা গেছে, মাত্র ১২ শতাংশ মানুষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চায় না। অথচ বিরোধী দলের নেত্রী বলছেন, এই বিচার করে সরকার নাকি হানাহানির অপচেষ্টা করছে! অভিযোগটি প্রত্যাখ্যান করে খালেদা জিয়ার উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী সেবার বলেছিলেন, সারাদেশের মানুষ যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ তখন এ ধরনের বক্তব্য দিয়ে আপনি দেশকে হানাহানির দিকে ঠেলে দেবেন না।
প্রধানমন্ত্রীর কথাগুলোকে সঙ্গত কারণেই যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে হয়েছিল। বিদেশীদের ব্যাপারে শেখ হাসিনার বিশেষ আগ্রহের কথা দেশের শিশু-কিশোরদেরও জানা রয়েছে। তিনি যে যখন-তখন, এমনকি অজুহাত সৃষ্টি করে হলেও বিদেশে পাড়ি জমান এবং স্বদেশীদের চাইতে বিদেশীদের কথাতেই তার যে আস্থা অনেক বেশিÑ এসবও দেশবাসীর অজানা নয়। কথিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারেও তিনি তাই বিদেশী দুটি সংস্থাকে এবং দেশের একটি ইংরেজি দৈনিককে সাক্ষী মেনেছিলেন। তাদের জরিপ রিপোর্টের উদ্ধৃতি দিয়েছিলেন। অন্যদিকে বিভিন্ন বিষয়ে দেশী-বিদেশী আরো অনেক প্রতিষ্ঠানের রিপোর্টও মাঝে-মধ্যেই প্রকাশিত হয়। কিন্তু সেগুলোর সারকথা সরকারের পক্ষে যায় না বলে ভাষণে উদ্ধৃতি দেয়া দূরে থাকুক, প্রধানমন্ত্রী সে সব রিপোর্টের ব্যাপারে টুঁ শব্দটি পর্যন্ত করেন না। তিনি বরং উল্লেখ করেছিলেন বিদেশী দুটি সংস্থার কথিত জরিপ রিপোর্টের। ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার-এর একটি জরিপের কথাও বলেছিলেন তিনি। সেখানে নাকি মাত্র ১২ শতাংশ পাঠক জানিয়েছিলেন, তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চান না। প্রশ্ন উঠেছিল, স্বল্পশিক্ষিত মানুষের এই দেশে কতজন ডেইলি স্টার পড়েন? তাছাড়া কম্পিউটার এবং ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগই বা তখন কতজন মানুষের ছিল?
প্রশ্ন করার কারণ হলো, ডেইলি স্টার-এর মতো পত্রিকার পাঠকরা সাধারণত অভিজাত শ্রেণীর উচ্চ শিক্ষিত এবং দৈনিকটি অনলাইনে জরিপ করে থাকে। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, অনলাইন জরিপে কোনোদিনই তিন-চারশ’র বেশি পাঠক অংশ নেন না। কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রায় ১৬ কোটি মানুষের দেশে অভিজাত শ্রেণীর মাত্র তিন-চারশ পাঠকের মধ্যকার ৮৮ শতাংশের অভিমতকেই প্রধানমন্ত্রী ‘জনমত’ হিসেবে হাজির করেছিলেন। বোঝাতে চেয়েছিলেন যেন গোটা দেশের ৮৮ শতাংশ মানুষই কথিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে একেবারে দিওয়ানা হয়ে পড়েছে! যেন প্রধানমন্ত্রীও তাদের দাবির প্রতি সম্মান দেখানোর জন্যই বিচারের নামে নাটক সাজাতে ব্যস্ত রয়েছেন! অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী যদি একটু অনুগ্রহ করে নিজের আশপাশে তাকাতেন তাহলেও কিন্তু তাকে ‘জনমত’ জানার জন্য ডেইলি স্টার বা বিদেশী কোনো সংস্থার দ্বারস্থ হতে হতো না। কথাটা পরিষ্কার করার জন্য তার একমাত্র মেয়ের শ্বশুরকূলের কথাই ধরা যাক। প্রধানমন্ত্রী ওই পরিবারের সদস্যদের মধ্যে জরিপ চালাতে পারতেন কিংবা নিজেই তাদের জিজ্ঞাসা করে দেখতে পারতেন। তাহলেও তিনি জানতে পারতেন, আসলে এদেশের ঠিক কত শতাংশ মানুষ কথিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চায়। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী সে সহজ পথটিতে যাননিÑ তিনি সম্ভবত এই একটি বিষয়ে ‘স্বজনপ্রীতি’ করতে চাননি!
এবার আজকের মূল প্রসঙ্গ। ওপরে উল্লেখিত দলীয় অনুষ্ঠানে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত একই সঙ্গে বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগও তুলেছেন। এর কারণ, খালেদা জিয়া নাকি সংবিধান বিরোধী  বক্তব্য রেখে চলেছেন আর সংবিধানের বিরোধিতার অর্থই নাকি রাষ্ট্রদোহিতা! মিস্টার সেনগুপ্ত আরো বলেছেন, আগামী ২৪ অক্টোবর দেশে কি ঘটবে তা নিয়ে বিরোধী দল নাকি আতংক ছড়াচ্ছে। তিনি সেই সাথে ঘোষণা করেছেন, ২৪ অক্টোবরের পরও সংসদ চলবে, বর্তমান সরকারও থাকবে। সংবিধান অনুযায়ী আরেকজন নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী ছাড়া অন্য কারো কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের সুযোগ বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর নেই। সুতরাং বিরোধী দল বললেই শেখ হাসিনা চলে যাবেন না। যেতেও পারেন না। তিনিই প্রধানমন্ত্রীর পদে থাকবেন এবং তার সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে। সুতরাং ২৪ অক্টোবর দেশ গোল্লায় যাবে বলে দেশটাকে মগের মুল্লুক বানাবেন না।
কথাগুলো যে ব্যক্তি সুরঞ্জিত সেনগুপ্তর নয় বরং দলগতভাবে আওয়ামী লীগেরই তার প্রমাণ পাওয়া গেছে আগেরদিন, ৯ অক্টোবর। ক্ষমতাসীনরা সেদিন বুঝিয়ে দিয়েছেন, এখনও বিদ্যমান নবম জাতীয় সংসদ সহজে বিদায় নিচ্ছে না। অন্যদিকে বহুদিন ধরে কিন্তু শোনা যাচ্ছিল, ২৪ অক্টোবর অনুষ্ঠেয় অধিবেশনই এ সংসদের শেষ অধিবেশন হবে। লন্ডনে এক উপলক্ষে কথাটা প্রথমে বলেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেই থেকে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ২৫ অক্টোবরকে ঘিরে নানামুখী গুঞ্জন ও তৎপরতা চলে আসছিল। বিষয়টিকে আরো বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছিলেন স্পিকার ড. শিরীন শানমিন চৌধুরী। গত ১২ সেপ্টেম্বর সংসদের কার্য-উপদেষ্টা কমিটি বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী স্পিকার জানিয়েছিলেন, এবারের অধিবেশন চলবে ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত। সেটাই হবে সংসদের শেষ অধিবেশন। এরপর ২৫ অক্টোবর থেকে ২৪ জানুয়ারির মধ্যে পরবর্তী সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এভাবেই ২৪ অক্টোবর নবম জাতীয় সংসদের শেষ অধিবেশনের তারিখ হিসেবে নির্ধারিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বিরোধী দলের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল এবং নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের বিধান যুক্ত করে সংবিধান সংশোধন করার জন্য ২৪ অক্টোবর দিনটিকেই বেঁধে দিয়েছিলেন। ওইদিনের আগে আন্দোলনের পথে না যাওয়ারও ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি। সব মিলিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যেও অমন ধারণা ও আশাবাদেরই সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু সব আশার গুড়ে বালু ছিটিয়েছেন আওয়ামী লীগ ও তার মহাজোটের ডাকসাঁইটে নেতারা। গত ৯ অক্টোবরের সংসদ অধিবেশনে রীতিমতো তেড়ে উঠেছেন তারা। তোফায়েল আহমেদ ও সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত থেকে ইনু জাসদের মঈনুদ্দিন খান বাদল পর্যন্ত কয়েকজন নেতা এমনভাবে শোরগোল তুলেছেন যা শুনে মনে হয়েছে যেন তারিখটি খালেদা জিয়া বেঁধে দিয়েছেন! ঘোষণা প্রথমে যে প্রধানমন্ত্রীর মুখ থেকেই এসেছিল এবং তার পরিপ্রেক্ষিতেই যে ২৪ অক্টোবর তারিখটিকে ঘিরে তৎপরতা শুরু হয়েছিলÑ এসবের ধারেকাছেও যাননি তোফায়েল-সেনগুপ্ত এবং বাদল সাহেবরা। তারা বরং খালেদা জিয়ার ‘চ্যালেঞ্জ’ মোকাবিলার পাল্টা চ্যালেঞ্জ দিয়ে বসেছেন। বলেছেন, ‘সংবিধান অনুযায়ী’ আগামী বছরের ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত বর্তমান সংসদই বহাল থাকবে। তারপর সংবিধানের নির্দেশনা অনুযায়ী পরবর্তী সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। উল্লেখ্য, নেতাদের কেউই কিন্তু ২৪ জানুয়ারির পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলেননি।
সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে মূলত সংবিধানকে ধরে টানাটানি করার কারণে। মাত্র কিছুদিন আগেই সংবিধান থেকে ‘এক চুলও’ না নড়ার ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন প্রধানমন্ত্রী। এবার নানা কথার আড়ালে সেই ঘোষণার সূত্র ধরেই বেগম খালেদা জিয়ার উদ্দেশে পাল্টা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছেন তোফায়েল-সেনগুপ্ত এবং বাদল সাহেবরা। সঙ্গত কারণেই তাদের কথার পিঠে কথা উঠেছে এবং কথায় কথা কেবল বেড়েই চলেছে। দেখা যাচ্ছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের বিষয়টিকে প্রাধান্যে আনা হলেও বাস্তবে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে দরকারি প্রতিটি বিষয়েই যথেষ্ট ‘ফাঁক’ রেখেই সংবিধান সংশোধন করেছেন ক্ষমতাসীনরা। বর্তমান সংসদের মেয়াদ এবং পরবর্তী নির্বাচনের সময়সীমা এরকম দুটি বিষয়। ক্ষমতাসীনরা চাইলে ‘সংবিধান সম্মতভাবেই’ সংসদের মেয়াদকে টেনে ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারেন। তার আগেও যে কোনো সময় তারা ‘শেষ’ অধিবেশনে বসতে পারেন। নির্বাচনের ব্যাপারেও একই কথা সত্য। অর্থাৎ সবদিক থেকেই তারা নিজেদের মনের মতো করে সংবিধান সংশোধন করেছেন।
সংশয় ও আশংকার কারণ শুধু এটুকুই নয়। সংশোধিত সংবিধানে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তো রাখা হয়েছেই, জরুরি অবস্থা জারি করার ক্ষমতাও প্রধানমন্ত্রীর হাতেই রেখেছেন ক্ষমতাসীনরা। প্রয়োজন মনে করলে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে পরামর্শ করে যে কোনো সময় তিনি জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে এবং যতোদিন ইচ্ছা তা বহাল রাখতে পারেন। ওই সময় পর্যন্ত শেখ হাসিনা তো প্রধানমন্ত্রী পদে বহাল থাকবেনই, বহাল থাকবে বর্তমান সংসদও। কখনো সত্যিই ঘোষিত হলে জরুরি অবস্থার মেয়াদ কতদিন হবে অর্থাৎ কতদিন পর্যন্ত দেশকে জরুরি অবস্থার মধ্যে রাখা এবং নির্বাচন পিছিয়ে দেয়া যাবে এসব বিষয়ে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তরা কোনো সময়সীমা বেঁধে দেননি। সহজ কথায় এর ব্যাখ্যা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী যতোদিন মনে করবেন না যে, তার দল নির্বাচনে জিতবে এবং আবারও ক্ষমতায় আসতে পারবে ততদিন পর্যন্ত তিনি জরুরি অবস্থা বহাল রাখতে পারবেন। আর জরুরি অবস্থার অর্থ নিশ্চয়ই বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না। এ সময় বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের যথেচ্ছভাবে গ্রেফতার করা ও তাদের ওপর নিষ্ঠুর দমন-নির্যাতন চালানো যাবে। সবই করা যাবে ‘সংবিধান অনুযায়ীই’। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এভাবেই সংবিধানকে নিজেদের ইচ্ছা পূরণের হাতিয়ার বানিয়ে ছেড়েছেন ক্ষমতাসীনরা। তারা যে নিজেদের সুবিধা অনুযায়ী সংবিধানকে ব্যবহার করতেও কসুর করবেন না তারই প্রমাণ পাওয়া গেছে বুধবারের অধিবেশনে। সেদিন খালেদা জিয়ার কথিত হুঙ্কারের জবাব দিতে গিয়ে তোফায়েল সাহেবরা শুধু পাল্টা হুঙ্কারই শোনাননি, লম্ফঝম্পও যথষ্টই করেছেন। কথায় কথায় সংবিধানকে তো টেনে এনেছেনই।
বলা দরকার, দ্রুত ঘনীভূত হতে থাকা রাজনৈতিক সংকট কাটিয়ে উঠতে হলে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল এবং নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের বিধান যুক্ত করার বিকল্প নেই। এ উদ্দেশ্যে বিরোধী দলের সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছানোর জন্যও তাগিদ দেয়া হয়েছে।একই পরামর্শ এসেছে আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকেও। অন্যদিকে ক্ষমতাসীনরা সর্বশেষ উপলক্ষেও নিজেদের ফ্যাসিস্ট মনোভাবেরই পরিচয় দিয়েছেন। এর মাধ্যমে ক্ষমতাসীনদের সদিচ্ছার প্রকাশ ঘটেনি। গণতন্ত্রের পাশাপাশি শান্তি, স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির ব্যাপারে ন্যূনতম সদিচ্ছা থাকলেও তাদের উচিত প্রধানমন্ত্রীর দেয়া আগের ঘোষণা অনুযায়ী ২৪ অক্টোবর বর্তমান সংসদের সমাপ্তি ঘটানো এবং তার পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে ১০ম জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠান করা। সে নির্বাচন অবশ্যই সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্দলীয় সরকারের অধীনে হতে হবে। কিন্তু আশংকার কারণ হলো, মিস্টার সেনগুপ্তরা এখনো গণতন্ত্রসম্মত সে পথটিতে যেতে চাচ্ছেন না। তারা বরং একটি মাত্র জরিপের রিপোর্ট দেখেই ভয় পেয়ে গেছেন। তারা সেই সাথে নির্বাচন পিছিয়ে দেয়ার এবং অনির্দিষ্ট সময় ধরে নিজেদের ক্ষমতায় রাখার জন্যও ফন্দি আঁটতে শুরু করেছেন।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads