শনিবার, ৫ অক্টোবর, ২০১৩

আবারো প্রশ্নবিদ্ধ রায়!

বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালএকেবারে সব কিছু ছাপিয়ে ইতোমধ্যেই সারা বিশ্বে ব্যাপক সুনামঅর্জন করেছেন। তারা যখনই এক একটি রায় ঘোষণা করছেন, তখনই বিশ্ব মিডিয়ায় ফলাও করে তাদের রায়ের অনুপুঙ্খ বিচার-বিশ্লেষণ প্রকাশিত হচ্ছে। সেসব বিচার-বিশ্লেষণে এ ট্রাইব্যুনাল সম্পর্কে অনুকূল তেমন কিছু পাওয়া যাচ্ছে না। আবার এ কথাও সত্য যে, দেশীয় বা আন্তর্জাতিক মিডিয়া বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালসম্পর্কে কী বলল বা না বলল, তাতে আমাদের কী যায়-আসে। আমরা স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ। আমাদের সংবিধান আছে। বিচার-আচার, ট্রাইব্যুনালÑ এ নিয়ে আমাদের নিজস্ব বিধিবিধান আছে। আমরা কেন এসব বিষয়ে অপরের দ্বারস্থ হতে যাবো। ফলে আমরা জয় বাংলা ধ্বনি দিয়ে কিংবা শাহবাগে কিছু লোক জোগাড় করে কোলাহল করতেই পারি। এখন হচ্ছেও তাই। আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল’ ‘কথিতযুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে যাচ্ছেন। সে বিচারে একমাত্র কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় হয়েছিল। কিন্তু সেটিই বা কেমন করে হয়? ‘কথিতযুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য যে ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়েছে, তাদের বোধ করি, মৃত্যুদণ্ড দেয়া ছাড়া বিকল্প আর কোনো পথ নেই। কাদের মোল্লার যখন অপরাধের মাত্রাবিবেচনা করে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল রায় দেন; তখন থেকেই বাংলাদেশে এক চমৎকার নাটকের সূত্রপাত হয়। শাহবাগে হঠাৎ করেই মাস দুই ধরে এক জজবার আয়োজন করে সরকার। সে ব্যবস্থা চমৎকার। সেখানে দিনরাত্রি উচ্ছৃঙ্খল তরুণ-তরুণীদের নাচগান, লাঠিখেলা, মেয়েদের মল্লযুদ্ধ ও নারী-পুরুষ নির্বিশেষে অকাতরে রাতযাপন শুরু হয়ে যায়। তরুণদের কাছে এমন ব্যাপার মজার ঘটনা বৈকি। তারা দাবি করতে থাকে ট্রাইব্যুনালের রায় কাদের মোল্লার সাজা বড় কম হয়ে গেছে। তাকে মৃত্যুদণ্ড দিতেই হবে। ট্রাইব্যুনালের পরে আপিলের জন্য উচ্চ আদালত। সরকার ফট করে আইন সংশোধন করল। তাতে বলা হলো, উচ্চ আদালতে সরকারও আপিল করতে পারবে। তার আগে বিধান ছিল উচ্চ আদালতে শুধু দণ্ডিতরাই আপিল করতে পারবেন। ফলে সরকার আপিল করল। তরুণ-তরুণীদের শাহবাগে রাত কাটানো সব সুযোগ-সুবিধার আয়োজন সরকারই করল। সরকারের লোকেরা অর্থ, খাদ্য, পানি দিলো। ভ্রাম্যমাণ টয়লেটের ব্যবস্থা করল। রাত শেষে ঝাড়ুদারেরা যা পেল, তা আমাদের সব সংস্কৃতি ও শুচির বিরোধী। কিন্তু সাপ্লাই লাইন অব্যাহত থাকল। আর প্রধানমন্ত্রী নিজে বললেন, বিচারকদের উচিত জনগণ কী চায়, সে অনুযায়ী রায় দেয়া। অর্থাৎ রায় হবে জনগণের, আদালতের নয়। বাংলাদেশের আদালত অতটা শক্তিশালী বলে মনে হয় না। এ আদালতই যে সর্বজন বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে পেরেছেন এমন কথাও বলা যায় না। শাহবাগে কয়েক হাজার তরুণ-তরুণীর নৃত্যগীত ও অবাধ আচার জনমতের প্রতিফলন হতে পারে না। তাদের সংখ্যা যদি লক্ষও হয়ে থাকে, তা হলেও না। বাংলাদেশের ১৫ কোটি ৯৯ লাখ মানুষের মতামত শাহবাগে প্রতিফলিত হলো, এমন কথা বলা নির্বোধের উক্তির শামিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী সে কথাই বললেন। তারপর আর কিছুই থেমে থাকল না। জনাব আবদুল কাদের মোল্লা, নিজেকে নির্দোষ দাবি করে উচ্চ আদালতে আপিল করলেন। সরকারও আপিল করল। এবং এ রকম পরিস্থিতিতে উচ্চ আদালত কী রায় দিতে পারে তা যেন আমরা প্রায় নিশ্চিতই ছিলাম। উচ্চ আদালত প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশিত শাহবাগী জনতার আকাক্সার কথা মনে রেখেই হোক, অথবা তা বিবেচনা না করেই হোক, আবদুল কাদের মোল্লার সাজা বাড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করলেন। এর রায় শিরোধার্য। কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে তা ছিল অকল্পনীয়। আদালতের দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া সাধারণ মানুষের বিচার পাওয়ার আর তো কোনো পথ নেই। উচ্চতর আদালত এই যে কাদের মোল্লার শাস্তি বাড়িয়ে দিলেন, তাতে একটি জিনিস প্রমাণ হলো যে, বিচারিক ট্রাইব্যুনাল যথেষ্ট বিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। ফলে সাজা বাড়িয়ে দিতে হলো। যাবজ্জীবন থেকে মৃত্যুদণ্ড। এরপর আন্তর্জাতিক বিচারকহীন বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালরায়ের পর রায় দিয়ে যেতে থাকলেন। তারা নিজেরাই দিলেন। জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির দণ্ড, যা বিলকুল সাফ। শাহবাগের কোথাকার কে এক ইমরান মিষ্টি বিতরণ করল। পেশায় সে চিকিৎসক। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সে চাকরিরত। শাহবাগী আন্দোলনের সময় সে এসে বাণী দিয়ে চলে যেত। পত্রিকায় রিপোর্ট দেখলাম, তাদের দখলে ছিল বেশ কিছু ক্যাবিন। সেখানে রাতভর যা হতো, তা বর্ণনার অতীত। মাঝে মধ্যে ইমরান সরকারের আবির্ভাব ঘটত। বাণী দিয়ে খুব দামি গাড়িতে চড়ে সে উধাও হয়ে যেত। এখনো টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে সেই ছাত্রলীগারের চেহারা দেখি। এসব টিভি কেন্দ্রের মালিক ও সাংবাদিকদের জন্য আমার কখনো কখনো ভারি করুণা হয়। কি না করতে তারা বাধ্য হচ্ছে! কোনো কোনো সাংবাদিকহয়তো এটি করে আনন্দ পেয়েছেন কিংবা এটিই তাদের আদর্শ। আদর্শ বলে কি সাংবাদিকতা পেশায় সত্যি আর কিছু অবশিষ্ট আছে? সিনিয়র সিটিজেনদের মধ্যে এক মূসা (এবিএম মূসা) ভাই আর প্রৌঢ়ত্বে পা দেয়া আমরা কিছু সাধারণ মানুষ। যারা কলম পিষে খাই। পেশায় সাংবাদিক বা শিক্ষক। সাথে ড. আসিফ নজরুল আর ড. পিয়াস করিম। তাদেরও হেনস্তার কোনো শেষ নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আসিফ নজরুলের কক্ষ ভাঙচুর হয়েছে। পিয়াস করিমকে নানা ধরনের হুমকি দেয়া হয়েছে ও হচ্ছে। আর আমরা দু-চারজন কলম পেশা মজুর চিল্লিয়েই যাচ্ছি। এটুকুই সংবাদ। বাকি আর কোনো সুসংবাদ নেই। কিন্তু বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালআর কোনো রায়ে ভুল করেননি। কাদের মোল্লার পর আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিচারে রায়ের প্রশ্ন এলো। এবং প্রধানমন্ত্রী যে রকমটি আশা করেছিলেন, ট্রাইব্যুনাল দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর সে রকম একটি রায় ঘোষণা করলেন। মৃত্যুদণ্ড। এরপর ট্রাইব্যুনাল উচ্চ আদালতে গিয়ে অধিকতর সাজা গ্রহণের সুযোগ থেকে সবাইকেই রহিত করলেন। একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমার মনে হয়, জামায়াত নেতা মোহাম্মদ কামারুজ্জামান, আবদুল কাদের মোল্লা, আল্লামা দেলাওয়ার হোসেইন সাঈদীÑ এরা সত্যি সত্যি সবাই কি একই মাপের অপরাধ করেছেন, যার জন্য তাদের সবাইকে মৃত্যুদণ্ড বরণ করতে হবে? আমি ব্যক্তিগতভাবে মৃত্যুদণ্ডের বিরোধী। মৃত্যুদণ্ড কোনো সাজা নয়। শাস্তি যদি কাউকে দিতেই হয়, তা হলে তাকে এক হাজার বছরের কারাদণ্ড দেয়া যেতে পারে। পৃথিবীর বহু দেশ মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। বর্তমান সরকারের বিবেচনামতে, কানাডায় বাস করেন শেখ মুজিব হত্যাকারীদের একজন। প্রধানমন্ত্রী নিজে তাকে ফেরত দেয়ার জন্য আকুল আবেদন করেছিলেন কানাডীয় সরকারের কাছে। কানাডার আইন হচ্ছে, অভিবাসী কোনো ব্যক্তিকে স্বদেশে ফেরত পাঠালে তিনি যদি মৃত্যুদণ্ডের হুমকির সম্মুখীন হন, তবে তাকে কানাডীয় সরকার ফেরত দেবে না। এ আইনের কথা জানার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দারুণ কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন, তা হলে বাংলাদেশের বহু অপরাধীকে তিনি কানাডায় পাঠিয়ে দেবেন, যাতে তাদের কোনো দণ্ড না হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও বলব, যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল কিছুতেই বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকল না। প্রথম রায়ের আগে বিচারপতি নিজামুল হক ও প্রবাসী জিয়াউদ্দিনের স্কাইপ সংলাপের মধ্য দিয়ে এ বিতর্কের সূত্রপাত। নিজামুল হকের ট্রাইব্যুনাল ত্যাগের মধ্য দিয়ে সেই বিতর্কিত অবস্থা প্রমাণিত হয়। এরপর আসে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর রায় প্রসঙ্গ। সে রায়ও আগেই ফাঁস হয়ে যায়। এ রায় কোথায় লেখা হয়েছে, আইন মন্ত্রণালয়ের কোনো কম্পিউটারে তা রক্ষিত আছে, তার বিস্তারিত বিবরণ জানা যায়। আগের দিন যদি এ রায়ের কপি আইন মন্ত্রণালয়ে কম্পিউটারে পাওয়া যায়, তা হলে স্বাভাবিকভাবেই ধরে নেয়া যায় যে, আইন মন্ত্রণালয়ে এ রায়ের খসড়া তৈরি হয়েছে, ট্রাইব্যুনাল কেবল তা পাঠ করে দিয়েছে। পরিস্থিতি সত্যি সত্যি ছিল গুরুতর। তা আরো রহস্যাবৃত হলো যখন ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার নিজেও বিষয়টি স্বীকার করলেন। তিনি জানান, ট্রাইব্যুনালের কম্পিউটার থেকে রায়টি ফাঁস হয়েছে। স্বীকার না করে বোধ করি আর কোনো উপায় ছিল না। তা না হলে প্রমাণ হতো, রায়টি সত্যি সত্যি আইন মন্ত্রণালয় লিখে দিয়েছে অর্থাৎ বিতর্ক এখানেও বাঁধল। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে আদালতে দাঁড়িয়ে এ রায় লেখার জন্য আইন মন্ত্রণালয়কে ধন্যবাদ জানান। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পরিবার এবং ওয়েবসাইটে দাবি করা হচ্ছিল যে, রায়টি আইন মন্ত্রণালয়ের লিখে দেয়া। কিন্তু ট্রাইব্যুনাল নিজে যদি স্বীকার করে নেয় যে, তাদের কম্পিউটার থেকে রায় ফাঁস হয়ে গেছে, তা হলে বিষয়টি কী পর্যায়ে আসে? ট্রাইব্যুনাল থেকে যদি ফাঁস হয়, তবে তা আইন মন্ত্রণালয়ের কম্পিউটারে যেতেই পারে। আর সেখান থেকে যেতে পারে এ দিকে-ও দিকে। সে ক্ষেত্রে আইন মন্ত্রণালয় তো তা অস্বীকার করতে পারেই যে, ‘রায় আমরা লিখে দিইনি। ট্রাইব্যুনাল থেকেই ফাঁস হয়েছে। ঘটনা যা-ই হোক, এ থেকে আবারো ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম প্রশ্নবিদ্ধই থাকল। শাক দিয়ে বোধ করি বেশিক্ষণ মাছ ঢেকে রাখা যায় না। হ পাদটীকা রায় ফাঁস সম্পর্কে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, ‘আমার মনে হয়, যাদের হাতে এ রায় প্রথমে দেখা গেছে, তারাই এই ফাঁসের সাথে জড়িত।অর্থাৎ সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পরিবার ও তার আইনজীবীরা এর সাথে জড়িত। যে নির্বাচনের মাধ্যমে আজ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত, সেই নির্বাচনের প্রধান নির্বাচন কমিশনার ছিলেন এ টি এম শামসুল হুদা। নির্বাচনে যখন দেখা গেল যে, ভোটারসংখ্যা এক শআর ভোট পড়েছে দেড় শ। আর রাস্তাঘাটে পাওয়া যেতে শুরু করল ব্যালট পেপারের মুড়ি, তখন তিনি ঘোষণা দিলেন মুড়ি যার কাছে পাওয়া যাবে, ধরে নেয়া হবে যে, সেই ভোট জালিয়াতি করেছে। এ রকম গোঁজামিল দিয়েই চলছে আওয়ামী লীগের সরকার ও তাদের শাসনকার্য। 


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads