জাতির উদ্দেশে দেয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাষণে সর্বদলীয় সরকারের প্রস্তাব এবং তার পরপর বিরোধী দলের নেত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের রূপরেখা জনগণকে খুবই আশান্বিত করেছিল। বিএনপির পক্ষ আওয়ামী লীগের কাছে সংলাপের আহ্বান জানিয়ে চিঠি পাঠানোর পর জাতীয় সংসদে বেগম জিয়ার উপস্থাপিত রূপরেখা অনুষ্ঠানিকভাবে উত্থাপন করার ফলেও আশাবাদের সৃষ্টি হয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূতদের তৎপরতাও ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। সব মিলিয়েই মনে হচ্ছিল যেন সঙ্কট কাটিয়ে উঠে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের সমভাবনা সৃষ্টি হতে যাচ্ছে। মনে হচ্ছিল, বিরোধী দল যেহেতু আগ বাড়িয়ে সমঝোতার জন্য উদ্যোগ নিয়েছে সেহেতু ক্ষমতাসীনদের মনোভাবেও নমনীয়তা দেখা যাবে। অন্যদিকে সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী পর্যন্ত কারো বক্তব্য ও শারীরিক ভাষাতেই তেমন ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে না। বিশেষ করে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের ব্যাপারে তারা সমঝোতামুখী মনোভাবের প্রকাশ ঘটাচ্ছেন না। পরিবর্তে সংঘাতকেই তারা অনিবার্য করে চলেছেন। হঠাৎ করে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা এর বড় প্রমাণ। প্রধানমন্ত্রী ভাষণ দেয়ার একদিন পর প্রথমে রাজধানীতে এবং তার পর চট্টগ্রাম, বগুড়া. খুলনা ও বরিশালসহ দেশের প্রায় সব মহানগরী ও জেলা শহরেই সরকার সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। অজুহাত হিসেবে আবারও একই সময়ে পরস্পর বিরোধী রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি এবং নাগরিকদের জানমালের নিরাপত্তার কথা বলেছে পুলিশ। পুলিশের নেয়া রণপ্রস্তুতির সচিত্র রিপোর্টও প্রকাশিত হয়েছে সংবাদপত্রে। আপত্তি ও প্রতিবাদ উঠেছে সরকারের উদ্দেশ্যের কারণে। দেখা যাচ্ছে, ঢাকা, চট্টগ্রাম ও বরিশালসহ বিভিন্ন মহানগরীতে সমাবেশের পাল্টা কর্মসূচি ঘোষণা করে পরিস্থিতিকে সংঘাতমুখী করেছে আসলে আওয়ামী লীগ। উদাহরণ দেয়ার জন্য বিএনপির মহাসমাবেশের কথা উল্লেখ করা যায়। একমাসেরও বেশি আগে বিএনপি ২৫ অক্টোবর মহাসমাবেশ করার ঘোষণা দিয়েছিল। অন্যদিকে আওয়ামী লীগও ২৫ অক্টোবরই পাল্টা সমাবেশ ডেকে বসেছে। চট্টগ্রামেও বিএনপি প্রথমে লালদীঘি ময়দানে সমাবেশ করার অনুমতি চেয়ে আবেদন করেছিল। আওয়ামী লীগ হঠাৎ একই লালদীঘি ময়দানে তিনদিনের কর্মসূচির ঘোষণা দিয়ে বসেছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই পুলিশের কাছে ‘প্রতীয়মান’ হয়েছে, সাংঘর্ষিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। একই অবস্থা অন্য জেলাগুলোতেও সৃষ্টি করেছে আওয়ামী লীগ। সরকারি দলের এসব কর্মসূচিকেই পুলিশ সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করার অজুহাত বানিয়েছে। নাগরিকদের জানমালের নিরাপত্তার জন্যও দরদ উথলে উঠেছে পুলিশের। কর্তব্য যেখানে ছিল শান্তিপূর্ণভাবে মহাসমাবেশ অনুষ্ঠানের ব্যাপারে সহায়তা করা, পুলিশ সেখানে সব সমাবেশকেই নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। পুলিশের হুকুমে রাজনৈতিক দলগুলো এমনকি মানব বন্ধনের মতো শান্তিপূর্ণ কোনো কর্মসূচিও পালন করতে পারছে না।
বলাই বাহুল্য, পুলিশকে সামনে রেখে নিষেধাজ্ঞা আসলে সরকারই আরোপ করেছে। আপত্তির কারণ হলো, এবারই প্রথম নয়, ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বিরোধী দলকে মিছিল এবং সভা-সমাবেশ করতে দিচ্ছে না সরকার। পুলিশকে নামাচ্ছে গু-াবাহিনীর মতো। পুলিশও মিছিল-সমাবেশের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। আগের মতো এখন আর শুধু লাঠিচার্জ বা টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ করেই থেমে পড়ছে না পুলিশ, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সরাসরি গুলী করছে। কথিত যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতে ইসলামীর অনেকে তো মারা গেছেনই, অনেক উপলক্ষে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারাও গুলীবিদ্ধ হয়েছেন। চলতি বছরের ৬ ও ১১ মার্চের মতো কোনো কোনো সমাবেশকে কেন্দ্র করে দেড়-দুই-আড়াইশ পর্যন্ত নেতা-কর্মীকে হাসপাতালে পাঠিয়েছে পুলিশ। জামায়াত নেতা মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায়ের প্রতিক্রিয়ার মতো ঘটনাপ্রবাহে মৃত্যু ঘটেছে শ’ দেড়েক মানুষের। পুলিশ এমনকি নারী ও শিশুদেরও ছাড় দেয়নি। পুলিশকে এবং সেই সঙ্গে র্যাবকে দিয়ে শুধু নয়, বর্তমান সরকারের আমলে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের গু-া-সন্ত্রাসীদের দিয়েও বিরোধী দলের ওপর হামলা চালানো হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে একই স্থানে পাল্টা সমাবেশ ডেকে ভ-ুল করা হচ্ছে বিরোধী দলের পূর্বঘোষিত কর্মসূচিÑ যেভাবে ২৫ অক্টোবরকে কেন্দ্র করে পদক্ষেপ নিয়েছে আওয়ামী লীগ। একযোগে চলছে মিথ্যা মামলা দায়ের ও গ্রেফতার করার অভিযান। বিএনপি ও জামায়াতসহ বিরোধী দলের নেতা-কর্মীরা বহুদিন ধরে বাসাবাড়িতেও থাকতে পারছেন না। অনেকে আবার গুম ও গুপ্তহত্যারও শিকার হচ্ছেন। পুলিশকে দিয়ে তল্ল¬াশি চালানোর নামে সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর অফিস তছনছ করছে। তালাও ঝুলিয়ে দিচ্ছে। জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় অফিসে ২০১০ সালের জুন মাস থেকে তালা ঝুলছে। বিএনপির কেন্দ্রীয় অফিসেও একবার তালা লাগানো হয়েছে। অর্থাৎ সব দিক থেকেই সরকার চরম ফ্যাসিস্ট শাসন কায়েম করেছে। সে নীতিরই সর্বশেষ প্রকাশ ঘটেছে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করার মধ্য দিয়ে।
আমরা সভা-সমাবেশের ওপর চাপানো নিষেধাজ্ঞার এবং বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের ওপর চলমান নিষ্ঠুর দমন-নির্যাতন ও গ্রেফতারের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা জানাই এবং মনে করি, এই নীতি ও কর্মকা- সরাসরি গণতন্ত্রবিরোধী। গণতান্ত্রিক কোনো রাষ্ট্রে এভাবে বিরোধী দলকে দমন করার কর্মকা- চলতে পারে না। আমাদের মতে নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসায় সরকারের এখন বরং অনেক নমনীয় হওয়া উচিত। সেই সঙ্গে উচিত সভা-সমাবেশের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা এবং পুলিশের লাগাম টেনে ধরা। সরকার গণতন্ত্রসম্মত পথে ফিরে না এলে গণতন্ত্র রক্ষার এবং জাতীয় ঐক্য, সার্বভৌমত্ব ও শান্তি নিশ্চিত করার জন্য জনগণকেই রাজপথে নেমে আসতে হবে। তেমন অবস্থায় দেশে ছড়িয়ে পড়তে পারে সহিংসতা, যার পরিণতি ক্ষমতাসীনদের জন্য শুভ হবে না। এজন্যই সময় থাকতে সরকারের উচিত আন্তরিকতার সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা চালানো। বিরোধী দল হাত বাড়িয়ে দেয়ায় সমঝোতার বিষয়টি এখন সম্পূর্ণরূপে ক্ষমতাসীনদের ওপরই নির্ভর করছে। আমরা আশা করতে চাই, বিশেষ করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এ ব্যাপারে কোনো ভুল করবেন না। কারণ, ভুলের মাশুল দীর্ঘদিন ধরে তাকেই গুণতে হতে পারে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন