প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিরোধী দলের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার টেলিসংলাপ নিয়ে অপরাজনীতির চেষ্টা চালাতে গিয়ে ক্ষমতাসীনরাই উল্টো ফেঁসে গেছেন বলে রাজনৈতিক অঙ্গনে এখন জোর আলোচনা চলছে। কারা এই সংলাপ প্রকাশ করেছে ক্ষমতাসীনদের বিভিন্ন বক্তব্যের মধ্য দিয়ে সে জিজ্ঞাসারও উত্তর বেরিয়ে এসেছে। একই সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে সংবিধানের নির্দেশনা লংঘন এবং তথ্য-প্রযুক্তি আইন অমান্য করার গুরুতর অভিযোগও উঠেছে। কারণ, আইন বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, সংবিধানের ৪৩ অনুচ্ছেদের (খ) উপ-অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রের প্রত্যেক নাগরিকের চিঠি-পত্র ও যোগাযোগের গোপনীয়তা রক্ষার অধিকারের বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়লেই কেবল সরকার কারো টেলিসংলাপ রেকর্ড করতে পারে। সেদিক থেকে দুই নেত্রীর টেলিসংলাপ অবশ্যই রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য হুমকির পর্যায়ে পড়ে না। তা সত্ত্বেও প্রধানত অশুভ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে রেকর্ড ও প্রচার করার মধ্য দিয়ে কেবল সংবিধানই লংঘন করা হয়নি, তথ্য-প্রযুক্তি আইনও অমান্য করা হয়েছে। উল্লেখ্য, ২০০৬ সালের তথ্য-প্রযুক্তি আইনের ৬৩ (১) ধারায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের সম্মতি বা অনুমতি না নিয়ে এ ধরনের কোনো কিছু রেকর্ড বা প্রচার করাকে ‘দ-নীয় অপরাধ’ বলা হয়েছে। তাছাড়া চলতি বছর তথ্য-প্রযুক্তি আইনে সংশোধনী এনে এ সংক্রান্ত অপরাধগুলোকে আমলযোগ্য ও জামিনের অযোগ্যও করেছে সরকার। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সব মিলিয়েই টেলিসংলাপ যারা রেকর্ড এবং প্রকাশ ও প্রচার করেছেন তাদের বিরুদ্ধে সংবিধান ও তথ্য-প্রযুক্তি আইনের অধীনে ব্যবস্থা নেয়া দরকার। তারা দ-নীয় অপরাধ করেছেন। বলা দরকার, এ ব্যাপারে প্রথম থেকেই আঙুল উঠেছে ক্ষমতাসীনদের দিকে। কারণ, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু থেকে ‘কালো বিড়াল’ নামে পরিচিত সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত তো বটেই, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, বন ও পরিবেশ মন্ত্রী হাছান মাহমুদ এবং আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ পর্যন্ত অনেকেই বলেছেন, দুই নেত্রীর এই টেলিসংলাপ নাকি ‘রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি’ এবং সে কারণে তা প্রকাশ ও প্রচার করা এবং জনগণকে জানতে দেয়া উচিত। এ ব্যাপারে সবশেষে জানান দিয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। গত বুধবার গণভবনে অনুষ্ঠিত এক দলীয় সমাবেশে কোনো লুকোছাপা না করে তিনি বলেছেন, বিএনপির তরফ থেকেই অনেক কিছু নাকি পত্রিকায় ছাপিয়ে দেয়া হয়েছিল। সেজন্যই প্রধানমন্ত্রী মনে করেছেন, সংলাপের পুরোটাই মানুষের শোনা ভালো।
বিষয়টি দুটি প্রধান রাজনৈতিক দলের বলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কথার পিঠে কথা বাড়ানোর পরিবর্তে এখানে বিশেষভাবে বলা দরকার, ঘটনাপ্রবাহে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে ক্ষমতাসীনরাই ওই টেলিসংলাপ রেকর্ড এবং প্রকাশ ও প্রচার করার পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। কারণ, সরকারের বিশেষ আয়োজন ও নির্দেশনা ছাড়া দুই নেত্রীর টেলি-সংলাপ রেকর্ড করা সম্ভব হওয়ার কথা নয়। যে সংস্থা বা দফতরই করে থাকুক না কেন, তাদের দিয়ে সরকারই করিয়েছে। তাছাড়া কয়েকজন মন্ত্রী ও নেতার বক্তব্য থেকেও বোঝা যাচ্ছে, এর পেছনে আসলে ক্ষমতাসীনরাই ছিলেন। আমরা বিষয়টিকে গুরুতর মনে করি। কারণ তারা শুধু ‘রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি’ বলে দুই নেত্রীর টেলি-সংলাপ প্রচার করেননি, করেছেনও যথেষ্ট সতর্ক সম্পাদনার পর। অভিযোগ উঠেছে, সম্পাদনার কাঁচি বেশি চালানো হয়েছে বেগম খালেদা জিয়ার বক্তব্যে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলের নেত্রী হিসেবে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হলেও তাকে রীতিমতো খলনায়িকা বানিয়ে ফেলার ন্যক্কারজনক চেষ্টা করেছেন তারা। এজন্যই খালেদা জিয়ার কথাগুলো অনেক বেশি জোরে শোনা গেছে। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রীকে মনে হয়েছে বিড়াল ছানার মতো মিউ মিউ করছেন তিনি। তাই বলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অবশ্য খুব সুবিধা করতে পারেননি। কারণ, হরতালের মতো গণতন্ত্রসম্মত কর্মসূচি সাংবিধানিক অধিকার হলেও তার সরকার প্রথম থেকেই কঠোরভাবে দমন করার পদক্ষেপ নিয়েছে। হরতাল তো বটেই, বিরোধী দলগুলো এমনকি মিছিল-সমাবেশ ও মানববন্ধন পর্যন্ত করতে পারছে না। প্রতিটি কর্মসূচিতে পুলিশ ও র্যাবের সঙ্গে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের গু-া-সন্ত্রাসীরা ঝাঁপিয়ে পড়ছে। ৬০ ঘণ্টার হরতাল চলাকালেও বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের হাত-পা ভেঙে ফেলার হুকুম জারি করেছেন আওয়ামী লীগের নেতারা। খালেদা জিয়ার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলার পরপর প্রধানমন্ত্রী নিজেও তার দলের নেতা-কর্মীদের রাজপথে পুলিশের ‘সঙ্গে সঙ্গে থাকার’ এবং পুলিশকে ‘সহযোগিতা করার’ হুকুম জারি করেছেন। এই ‘সহযোগিতা’ কীভাবে করা হবে এবং কীভাবে অনেক আগে থেকেই করা হচ্ছে সে সম্পর্কে নিশ্চয়ই নতুন করে বলার দরকার পড়ে না। একই কথা বলা যায় প্রধানমন্ত্রীর অন্য একটি জিজ্ঞাসার জবাবেও। কারণ, দেশের মানুষও দেখেছে, ৬০ ঘণ্টার হরতাল চলাকালে ‘অনেক মায়ের কোল’ কারা খালি করেছে। সুতরাং প্রধানমন্ত্রী যতোই ‘ধৈর্য’ ধরার কথা শোনাতে চান না কেন, মানুষ হত্যা আসলে কার ‘একমাত্র খেলা’ সে কথাটা দেশের মানুষ ভালোভাবেই জেনেছে। তাছাড়া টেলিসংলাপের কোনো পর্যায়েই খালেদা জিয়া ‘একেকবার একেক কথা’ বলেননি, ‘কন্ডিশন’ও নানা রকমের দেননি তিনি। বিরোধী দলের নেত্রী মূলত দুটি মাত্র কথাই বলেছেনÑ এক. ১৮ দলীয় জোটের নেতারা যেহেতু পুলিশের ধাওয়ার মুখে রয়েছেন সেহেতু একবারে শেষ মুহূর্তে তার একার পক্ষে হরতাল প্রত্যাহার করে প্রধানমন্ত্রীর দাওয়াত রক্ষা করা সম্ভব নয়। এবং দুই. প্রথমে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রীকে নীতিগতভাবে সম্মতি জানাতে হবে। এই সম্মতি জানালেই খালেদা জিয়া ৬০ ঘণ্টার হরতালের পর যে কোনোদিন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনায় বসতে রাজি আছেন। এখানে ‘একেকবার একেক কথা’ বললেন কখন বেগম জিয়া? ‘কন্ডিশন’ও তো মাত্র একটাই দিয়েছেন তিনিÑ সেটা নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের প্রশ্নে নীতিগতভাবে সম্মতি জানানোর জন্য। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী এই কন্ডিশনের ব্যাপারে ঠোঁটে আঙ্গুল চেপে রেখেছেন, একটি কথাও বলেননি।
সব মিলিয়েই টেলিসংলাপের মধ্য দিয়ে তেমন কিছু অর্জন করতে পারেননি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। লাল টেলিফোন নিয়ে মিথ্যাচার করা থেকে খালেদা জিয়াকে অভিযুক্ত করা এবং সংবিধান ও তথ্য-প্রযুক্তি আইন লংঘন করে টেলিসংলাপ প্রকাশ করে দেয়া পর্যন্ত প্রতিটি বিষয়ে তিনি বরং পরাজিত ও নিন্দিত হয়েছেন। এসব নিয়ে কথা বাড়ানোর পরিবর্তে আমরা শুধু বলতে চাই, সংবিধান এবং তথ্য-প্রযুক্তি আইন অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া দরকার, যারা দুই নেত্রীর ব্যক্তিগত টেলিসংলাপ রেকর্ড ও প্রকাশ করেছে। সে ব্যবস্থা না নেয়া হলে জনগণ একথাই জানবে, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য একই দেশে দু’ রকমের আইন প্রয়োগ করে চলেছে সরকার।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন