১.
১/১১-এর সময়কালের ঘটনা প্রবাহ এখন দুঃখ ও বেদনার স্মৃতি। লগি-বৈঠার তা-বে মানুষ হত্যা করে লাশের উপর উল্লাস নৃত্য করার প্রেক্ষাপটে এসেছিল আজ থেকে সাত বছর আগের ১/১১ সেই কালো অধ্যায় এসেছিল রক্তাক্ত ২৮ অক্টোবরের নৃশংসতার মধ্য দিয়ে। তৎকালীন বিরোধী দল (আওয়ামী-নাস্তিক্যবাদী জোট) রাজনৈতিক ধারা ও স্বাভাবিকতাকে নস্যাৎ করে চরম অরাজকতা সৃষ্টি করায় পরিস্থিতি সকলের হাতছাড়া হয়ে যায়। সৃষ্টি হয় বিশেষ পরিস্থিতি। তখন জরুরি অবস্থা ছিল, সাংবিধানিক নিয়ম-কানুন স্থগিত ছিল। প্রয়োজনের খাতিরে অনেক কিছুই উলট-পালট করা হয়েছে সে সময়। সুপ্রিম কোর্টের রায়েও উদ্ভুত পরিস্থিতিকে বলা হয়েছিল ‘ডকট্রিন অব নেসেসিটি’। সেই পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তির একটি সুপ্ত প্রচেষ্টা কায়েমী মহলের মধ্যে এখনও দৃষ্টিগোচর হচ্ছে বলে অনেকেই বলাবলি করছেন।
বর্তমানে আবার জনমনে সন্দেহ দেখা দিয়েছে যে, গত ২৭ অক্টোবরের পর ঘটনা প্রবাহ কি তেমনই পরিস্থিতির দিকে চলে যাচ্ছে? সে প্রশ্ন অনেকেই উত্থাপন করতে শুরু করেছেন। কারণ, ২৭ অক্টোবরের পর ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচনের সাংবিধানিক বাধ্য-বাধকতার মধ্যে শাসন ব্যবস্থা প্রবেশ করেছে। এরই মধ্যে শেখ হাসিনার সরকার নিজের মতো করে সংবিধান সাজিয়ে রেখেছেন। ‘নির্বাচিত উত্তরাধিকার’ না আসা পর্যন্ত তিনি তাঁর পছন্দের মন্ত্রিসভাসহ স্বপদে বহাল থাকবেন সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৫৭(৩), ৫৮(৩) ও (৪) মোতাবেক। এই পরিবর্তন স্বচ্ছতা ও গ্রহণযোগ্যতার দিক থেকে উত্তীর্ণ নয়। যেভাবে সংক্ষিপ্ত সময়ে সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে একদলীয় বাকশাল কায়েম করেছিল শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগ; তেমনভাবেই অতি তাড়াতাড়ি বিদ্যমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বদলে দিয়ে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিধান একতরফা কায়েম করেছে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ। জনগণের একটি বিরাট অংশ বিরোধী নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে এই পরিবর্তন মেনে নেয় নি এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে সর্বাত্মক আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে।
শুধু তা-ই নয়, প্রধান বিরোধী দলের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ২৭ তারিখের পর থেকে বর্তমান সরকারকে ‘অবৈধ’ বলে ঘোষণা করেছেন। এখন ‘অবৈধ’ শব্দটিকে যদি তিনি প্রকৃত অর্থেই ‘মিন’ করেন, তাহলে সে সরকারের সঙ্গে সংলাপ, সমঝোতা বা আলোচনার অবকাশ থাকে না। তাঁর ভাষায় যে সরকার ‘অবৈধ’ হিসাবে উল্লেখিত, তার সঙ্গে আলোচনা করে ‘বৈধ’ দাবি আদায় করার বিষয়টি নৈতিক ও আইনগত দিক থেকে কতটুকু স্বচ্ছ হবে, সে প্রশ্নও থেকেই যাচ্ছে। ফলে পুরো পরিস্থিতিই একটি জটিল রাজনৈতিক ও সংবিধান সঙ্কটে নিপতিত হতে বাধ্য। এ অবস্থায় সরকারের অপরাপর প্রতিষ্ঠান যেমন, নির্বাচন কমিশন, আমলাতন্ত্র বা প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারিদের সামনে চলে আসবে নতুন দৃশ্যপট। সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও পালনের প্রশ্নে সমস্যার সম্মুখীন হওয়াও তাদের পক্ষে বিচিত্র কিছু হবে না। ইতোমধ্যে খবর পাওয়া যাচ্ছে প্রশাসনের নানা বিভাগে ও স্তরে আনুগত্যের অদল-বদল হচ্ছে; নিদেন পক্ষে দোদুল্যমানতা এসে ভর করছে। রাজনৈতিক অঙ্গনের বিভাজনজনিত চাপ এবং বৈধতার প্রসঙ্গটি কে কিভাবে সামলায় তার উপরও অনেকাংশে নির্ভর করছে সামনের দিনের শাসনের রূপ, চরিত্র, ধরন ও প্রকৃতি। বিশেষত নির্বাচন কমিশন, যাদের উপর রয়েছে জাতীয় নির্বাচনের মতো একটি বিশাল যজ্ঞ, তারা সরকার ও বিরোধী দলের দিক থেকে ধেয়ে আসা চাপ কতটুকু সমন্বয় করতে বা সামাল দিতে পারবে, সেটাও এক বড় প্রশ্ন। নির্বাচন কমিশনে চিত্তবৈকল্য ও বাইরের চাপের প্রভাবজনিত লক্ষণ দেখা গেলে আর যাই হোক, সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন কোনওভাবেই সম্ভব হবে না। ফলে সামনের দিনগুলোতে অবধারিতভাবেই ‘ডকট্রিন অব নেসেসিটি’র পদধ্বনি শুনতে পাওয়া যাচ্ছে। সরকারি দলের রাজনীতিবিদদের দীর্ঘসূত্রিতা ও সিদ্ধান্তহীনতা ঠেলতে ঠেলতে পরিস্থিতিকে যে খাদের কিনারে নিয়ে এসেছে, সেটা তারাই এখন মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পারছেন।
প্রসঙ্গত ২৬ তারিখ শেখ হাসিনা যে টেলিফোন কলটি বেগম খালেদা জিয়াকে করেছেন, সে ফোনকলটিই যদি আরও আগে করা হতো, তাহলে আলোচনা ও সমঝোতার অনেকটাই স্পেস বা জায়গা বা সুযোগ পাওয়া যেতো। এতো আন্দোলন, সংগ্রাম, আত্মত্যাগের দরকার হতো না। এখন আলোচনার স্পেস যেমন কমেছে, তেমনিভাবে পাল্লা দিতে হচ্ছে ৯০ দিনের কাঠামোর মধ্যে সব কিছু যথাযথ ও দ্রুততায় সম্পন্ন করার তাগিদের সঙ্গেও। সকল দলের অংশ গ্রহণ ছাড়া দেশ ও বিদেশে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে নাÑএই স্বতঃসিদ্ধ ও সর্ব মহলে উচ্চারিত কথাটিকে মান্য করার জন্য আলাপ-আলোচনা চালানো আর সেই আলাপকে সার্থক করে ৯০ দিনের বাধ্য-বাধকতার সময়সীমার মধ্যে নির্বাচন সম্পন্ন করার দ্রুতলয় কাজ বিদ্যমান সরকার দলীয় অনঢ় রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও বিভেদের পটভূমিতে কতটুকু সম্ভব হবে? যদি সেটা সম্ভব না হয়, তবে শুরু হয়ে যাবে সরকার কর্তৃক পরিকল্পিত একদলীয় নির্বাচনের বিরুদ্ধে সকল বিরোধী দলের অসহযোগ আন্দোলন। যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলবে। অতএব শেখ হাসিনা বা খালেদা জিয়ার ভাষণ এবং ফোনালাপের পরেও যে সঙ্কট বিরাজমান ছিল, সেটা থেকেই গেল। সরকারের পক্ষ থেকে চূড়ান্ত পর্যায়ে অর্থপূর্ণ আলোচনার লক্ষ্যে সরাসরি উদ্যোগ গ্রহণের বদলে ভাষণ-পরবর্তী ফোনালাপ বা নৈশভোজের দাওয়াত বিরোধী জোটের সর্বাত্মক আন্দোলনের গভীরতার সামনে জোরদার পদক্ষেপ বলেও বিবেচিত হচ্ছে না। তদুপরি, বিশেষজ্ঞ মহল থেকে বলা হচ্ছে শেখ হাসিনার প্রস্তাব সংবিধানসম্মত নয়। পক্ষান্তরে বেগম খালেদা জিয়ার প্রস্তাব সংবিধানসম্মত। সরকার দুই প্রস্তাবকে সামনে রেখে কোনও হোমওয়ার্ক করেনি। বিরোধী দলের দাবি ও প্রস্তাব না-মানার মধ্যেই তাদের মানসিকতা ও আচরণ ঘুরপাক খাচ্ছে। অতএব বিরোধী জোটকে আস্থা ও বিশ্বাসের মধ্যে এনে তাদের দাবিকে সম্মান জানানোর মাধ্যমে সঙ্কট সমাধান করা এবং পরিস্থিতিকে সামাল দেয়ার সরকারি উদ্যোগ সামান্যতম আশার সঞ্চার করতে ব্যর্থ হয়েছে। তদুপরি সরকারি দলের নেতা-পাতি-নেতারা যে উস্কানিমূলক ও বলদর্পী বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছে, তাতে পরিস্থিতি তারা নিজেরাই বিগড়ে দিচ্ছেন। প্রতিনিয়ত বিরোধী দল ও জোটকে হামলা-মামলায় জর্জরিত এবং অবজ্ঞা, অশ্রদ্ধা ও অসম্মান করছেন। একই সঙ্গে ছলে-বলে, আইনে-বেআইনে নেতৃবৃন্দকে নিধন করার প্রক্রিয়াও তারা জোরালোভাবে চালিয়ে যাচ্ছেন। এই আগ্রাসী, স্বৈরতান্ত্রিক, একগুঁয়েমিপূর্ণ তৎপরতা গণতান্ত্রিক সহনশীলতা ও সমঝোতার সম্পূর্ণ পরিপন্থী এবং বিরাট অন্তরায়।
২.
৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচনের কাউন্ট-ডাউন শুরু হওয়ায় সমঝোতায় উপনীত হওয়ার সময় ও স্পেস, উভয়টিই হ্রাস পাচ্ছে। এমন অবস্থায় আন্দোলন ও সংলাপ এক সঙ্গে চালানোর লক্ষ্যে বিরোধী দল ৬০ ঘণ্টার যে টানা হরতাল ডেকেছে সেটা গত (মঙ্গলবার) সন্ধ্যায় শেষ হয়েছে। অতীতের হরতালের চেয়ে এবার বিরোধীরা অনেক সক্রিয় ও সহিংস আচরণ করেছে এবং আরও হরতালমুখী হয়ে রয়েছে। সরকারও বিপুলভাবে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় প্রশাসনিক শক্তি নিয়োজিত করেছে। প্রশাসনযন্ত্র সর্বত্র বিরোধী নেতা-কর্মীদের যেভাবে ধাওয়া করছে, তাতে তারাও সমঝোতার প্রশ্নে সরকারের উপর আস্থা রাখতে পারছে না। আন্দোলনের পথ ছাড়া তাদের সামনে অন্য কোনওভাবে সঙ্কট সমাধানের পন্থা খোলা রাখে নি সরকার। এমন কি, হাসিনার ফোন পেয়ে খালেদা নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনার ফুরসতও পান নি। কারণ নেতাদের বাসায় বাসায় তখন পুলিশ হানা দিচ্ছিল এবং তারা তখন প্রবল পুলিশী চাপে বিচ্ছিন্ন ও বিব্রত ছিলেন। তাছাড়া অধিকাংশ শীর্ষস্থানীয় বিরোধী নেতা রয়েছেন কারাগারে। তাদেরকে ছাড়া ১৮ দলের পক্ষে অর্থবহ সংলাপে যাওয়াও সম্ভব নয়। ফলে সংলাপের পূর্বশর্ত ও সফলতার জন্য আটক নেতৃবৃন্দকে মুক্তি দেয়ার বিষয়টি জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণভাবে সামনে চলে এসেছে।
সর্বশেষ অবস্থায় সংঘাত ও উত্তেজনার সঙ্গে সঙ্গে জনজীবনে এসে যুক্ত হয়েছে চরম ভীতি, আতঙ্ক ও উৎকণ্ঠা। সাধারণ নাগরিক জীবন হরতালের চাপে ও সরকারের অবস্থানের মাঝখানে ‘পাটা-পুতার ঘষায় মরিচের জান শেষ’ অবস্থায় পড়ে গেছে। ব্যবসা বাণিজ্য, শিক্ষা, শিল্প, আমদানি-রফতানিসহ সর্বক্ষেত্রে পড়ছে বিরূপ প্রতিক্রিয়া। দ্রব্য-সামগ্রীর যোগান কমে দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাচ্ছে। সামনে দেশব্যাপী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার জন্য অপেক্ষমান কয়েক লক্ষ শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা ঘোরতর অনিশ্চয়তার সম্মুখীন হয়েছেন। অনুমান করা যাচ্ছে যে, রাজনৈতিক সঙ্কট সুনামী বা ক্যান্সারের মতো সমাজ, শিক্ষা, শিল্প, বাণিজ্যসহ সর্বত্র আঘাত হানছে। রাজনৈতিক অচলাবস্থার নেতিবাচক প্রভাব সমাজ ও অর্থনীতির প্রায়-সকল ক্ষেত্রকেই অচল কিংবা ভীতিপূর্ণ বা অনিশ্চিত বা সংঘাতময় করে ফেলছে। এই আত্মঘাতী ধারার পরবর্তী পর্যায় কি হবে, তা ভেবে সকলেই আকুল। আরও সংঘাত, আরও সঙ্কট, আরও অচলাবস্থা, জরুরি অবস্থা? নাকি হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো সমঝোতা?
মনে রাখা দরকার যে, সমঝোতার ট্রেন সময়মতো ধরতে পারেন নি সরকারপক্ষীয় রাজনীতিবিদগণ। তাদেরকে বার বার সংলাপ ও সমঝোতার জন্য দেশ-বিদেশ থেকে বলা হয়েছে। সময় থাকতে তারা ‘এক চুল’ ছাড় দেবেন না বলে হুঙ্কার দিয়েছিলেন। ছাড় না দিলে আলোচনা, সংলাপ বা সমঝোতার অর্থ কি! বিরোধী দল সরকারকে ‘অবৈধ’ বলেও তাদেরকে সম্মান জানিয়ে সংলাপে সাড়া দিচ্ছে। এটা তো এক ধরনের ছাড়। অর্থাৎ বিরোধীরা সংলাপ ও আন্দোলনের উভয় পথই খোলা রেখেছে। এমন কোনও ছাড়ের নজির এখন পর্যন্ত সরকারের পক্ষে রাখা হয়নি। সরকারকে এখন প্রমাণ করতে হবে যে, জনদাবির প্রতি তারা কতটুকু সম্মান জ্ঞাপনকারী ও সহানুভূতিশীল। এবং যে বিরোধী দল ও জোটের সঙ্গে তারা আলোচনা করবে, তার নেতৃবৃন্দকে হয়রানি বন্ধ করে এবং আটক শীর্ষ নেতাদের মুক্তি দিয়ে সংলাপে বসার সুযোগ দিতে সঙ্কট মোচনে তারা কতটুকু সদিচ্ছা পোষণ করেন। কারণ, নেতাদের ছাড়া কর্মীরা কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। আন্তরিক সংলাপ অনুষ্ঠানের জন্য উল্লেখিত কাজগুলো সম্পন্ন করার মাধ্যমে সরকারকে বিরোধী দলের আস্থা ও বিশ্বাসভাজন হতে হবে। বিশেষত রাজনৈতিক প্রতিহিংসামূলক মামলায় কারাবন্দি শীর্ষ নেতাদের মুক্তির ব্যাপারে সরকার এখন পর্যন্ত কোনও পদক্ষেপ নিচ্ছে না। বরং দেশ-বিদেশে সমালোচিত বিচার প্রক্রিয়াকে একদল পথভ্রষ্ট নাস্তিক-মুরতাদ-দেশবিরোধী তরুণের সাজানো চাপের মাধ্যমে জোরদার ও ন্যায়ভ্রষ্ট করা হচ্ছে। সরকার এখনও ব্যাপক জনতার দাবি আর ক্ষুদ্র কুচক্রীদের দাবির মধ্যে পার্থক্য করতে পারছে না। বরং অতিক্ষুদ্র ও নিন্দিত কুচক্রীদের দোসর হয়েই তারা পরিস্থিতিকে রসাতলে পাঠাচ্ছে। এই আত্মঘাতী সিদ্ধান্তের জন্য খোদ সরকারেরই বিরাট ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। দেশব্যাপী যেভাবে গণআন্দোলন সূচিত হচ্ছে, সেটার কবল থেকে সরকারকে ক্ষুদ্র কুচক্রীরা রক্ষা করতে পারবে না।
প্রসঙ্গত পাকিস্তানের সাবেক স্বৈরাচার আয়ুব খান যদি আলোচনার স্বার্থে চরম রাজনৈতিক শত্রু শেখ মুজিবকে মুক্তি দেয়ার নজির স্থাপন করতে পারে; তাহলে বর্তমান শাসকরা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে মুক্তি দিয়ে আলোচনা করতে পারবে না কেন? তাছাড়া বিশেষ আদালত, বিশেষ বিচারিক ব্যবস্থা ইত্যাদির মাধ্যমে বিশেষ একটি দল (জামায়াত)-এর নেতাদের বেছে বেছে শাস্তি দেয়ার উদ্যোগ যেখানে সর্বমহলে সমালোচিত, সেখানে তাদেরকে মুক্তি না-দেয়ার তো কোনও কারণ থাকতে পারে না। সমঝোতা ও সংলাপে বিশ্বাসী হলে এবং অর্থবহ সমাধান চাইলে কারাবন্দি শীর্ষ নেতাদের অতিদ্রুত মুক্তি দিয়ে সরকারকে সদিচ্ছার প্রমাণ দিতে হবে।
৩.
দেশের ভয়ানক ক্রান্তিকালে এখন নিম্ন পর্যায়ে কথা-বার্তা বা কালক্ষেপনের বিন্দু মাত্র ফুরসত নেই। সব কিছু করতে হবে শীর্ষ ও সর্বোচ্চ পর্যায়ে। কেননা, সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। এবং পরিস্থিতিও ছাই-চাপা আগুনের মতো হয়ে অচলাবস্থার শেষ প্রান্তে অবস্থান করছে; যেখানে রয়েছে অনিশ্চয়তার ঘোরতর কালো অন্ধকার। পুরো দেশ ও জাতিকে অচলাবস্থায় রেখে অন্ধকার অনিশ্চয়তায় ফেলে দেয়া যায় না। ফলে এখন শীর্ষ পর্যায়ে সিদ্ধান্তমূলক আলোচনা একান্ত জরুরি বিষয়। এক্ষেত্রে বিএনপি, আওয়ামী লীগ তথা সরকার ও বিরোধী জোটের শীর্ষ নেতৃত্বকে মুখোমুখি বসতে হবে। এই পরিস্থিতিতে একদলীয় স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম শক্তি জামায়াত শীর্ষ নেতৃত্বহীন অবস্থায় আছে। এরশাদের বিরুদ্ধে যখন তিনজোট ও জামায়াত যুগপদ আন্দোলন করেছে, তখন জামায়াতসহ সকলেই শীর্ষ পর্যায়ে আলোচনা, সংলাপ ও যোগাযোগ করেছে। যে কারণে স্বৈরশাহী এরশাদকে হটিয়ে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু করে গণতন্ত্রের নবঅভিযাত্রা সম্ভব হয়েছিল। আজকে যখন জাতীয় প্রয়োজনে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের ঐতিহাসিক আন্দোলন চলছে, তখন অত্যন্ত বিদ্বেষমূলক কারণে তত্ত্বাবধায়ক আন্দোলনের আদি নেতৃবৃন্দ কারাগারে আটক রয়েছেন। সেদিন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাস্টারমাইন্ড ছিলেন জামায়াতের তৎকালীন আমির অধ্যাপক গোলাম আযম। আন্দোলনের মাঠে সরব ছিলেন জামায়াতের তৎকালীন সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী এবং তৎকালীন ঢাকা মহানগর আমির আলী আহসান মুহম্মদ মুজাহিদ। রাজনৈতিক যোগাযোগ ও লিয়াজোঁর কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন জামায়াত নেতা মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ও আবদুল কাদের মোল্লা। গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও কুরআনের মর্যাদার জন্য বাংলার পথে-প্রান্তরে, আনাচে-কানাচে জনমত গঠন করেছিলেন গণমানুষের নন্দিত কণ্ঠস্বর মুফাসসিরে কুরআন আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী। নব্বই-এর সেই আন্দোলনের পর আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলনে শেখ হাসিনা নিজে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে। সেই আন্দোলনে শেখ হাসিনার রাজনৈতিক সাথী ছিলেন জামায়াত নেতৃবৃন্দ। আলী আহসান মুহম্মদ মুজাহিদসহ জামায়াতের বহু নেতা-কর্মী সেই আন্দোলনে কারা নির্যাতন ভোগ করেন। শত-শত নেতা কর্মী হতাহত হন। জামায়াত ও শিবির অকাতরে আন্দোলন করে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করেন। সেই শেখ হাসিনা যখন নিজের নেতৃত্ব দেয়া তত্ত্বাবধায়ক দাবি থেকে সরে এসে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা চালু করতে উদ্যত হন, জামায়াত তখনও সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে শেখ হাসিনার বিরোধিতা করে। বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে পুনরায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের এই হলো রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। দেখা যাচ্ছে, এদেশের গণতন্ত্রের প্রয়োজনে সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পূর্বশর্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলনের সূচনা থেকে আজ পর্যন্ত জামায়াতে ইসলামী এবং এর নেতৃবৃন্দ অবিচল ভূমিকা পালন করেছেন। এবং বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা ও সুষ্ঠু নির্বাচন ব্যবস্থার বিকাশে অব্যাহতভাবে ঐতিহাসিক অবদান রেখে চলেছেন।
বর্তমানে যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে চূড়ান্ত আন্দোলন চলছে তখন এ আন্দোলনের সূচনাকারী, আদি ও অগ্রণী নেতৃবৃন্দ প্রায়-সকলেই কারাগারে বন্দি জীবন কাটাচ্ছেন। তাদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের শাস্তিমূলক রায়ও ঘোষিত হয়েছে। একদিকে যখন তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার আন্দোলন আর অন্যদিকে এ্ আন্দোলনের মূল চিন্তাবিদ ও নেতৃত্বের তখন কারাভোগ এক সামঞ্জস্যহীন ঘটনা। এর ফলে রাজনৈতিক সঙ্কট মোচনে শীর্ষ স্থানীয় জাতীয় নেতৃবৃন্দ অংশগ্রহণের পথ রুদ্ধ করা হয়েছে এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার আন্দোলনের আদি ও অভিজ্ঞ নেতৃবৃেন্দর অবদানকে নস্যাৎ করা হয়েছে। কোনও কার্যকরী ও অর্থবহ সংলাপ বা সমঝোতার জন্য উভয় ব্যবস্থাই ক্ষতিকর। তাছাড়া আমরা যখন সংলাপ ও সমঝোতার কথা বলি তখন সেটা বিভিন্ন পক্ষের মধ্যেই সম্পন্ন হওয়ার তাগিদ প্রদান করি। একটি পক্ষকে কোণঠাসা ও বন্দি রেখে সংলাপ বা সমঝোতা হলে সেটা সকল পক্ষের মধ্যে হয়েছে, তা-ও বলা যায় না এবং নৈতিক ও আইনগতভাবে সিদ্ধ হয়েছে বলেও উল্লেখ করা যাবে না। এ অবস্থায় অর্থবহ ও কার্যকর সংলাপ এবং সমঝোতার জন্য জামায়াতের নেতৃবৃন্দের মুক্তি অপরিহার্য পূর্বশর্ত।
১৮ দলের নেতৃত্ব দিয়ে বেগম খালেদা জিয়া যে আন্দোলনের চূড়ান্ত পরিণতিতে নিয়ে এসেছেন, সেখানে শত শত জামায়াত-শিবির কর্মী জীবন দিয়েছেন; আন্দোলনকে ধরে রেখেছেন হাজার হাজার কর্মী এবং বেগবান করেছেন লক্ষ লক্ষ সমর্থক। সরকারের দলীয় ও প্রশাসনিক বাহিনীর চরম আক্রমণের মুখেও এই সংগঠিত জনশক্তি বিরোধী দলের আন্দোলন-সংগ্রামকে সীমাহীন ত্যাগের মাধ্যমে এগিয়ে নিয়েছেন। জোট নেত্রী এই বিশাল কর্মী-সমর্থক বাহিনীর আবেগ ও হৃদস্পন্দন নিশ্চয় অনুধাবন করবেন। তিনি কখনই জোটের নির্যাতিত নেতাদের প্রতি যে জুলুম-নির্যাতন করা হয়েছে, সেটাকে ভুলে যাবেন না এবং তাকে বিবেচনায় রেখেই আন্দোলন ও সংলাপের রূপরেখা প্রণয়ন করবেন। তিনি অবশ্যই চাইবেন, তাঁর নেতৃত্বাধীন ১৮টি গণতন্ত্রমনা দল তাদের শীর্ষ নেতৃত্বের অংশগ্রহণে চলমান আন্দোলনকে জোরদার ও সফল করবে এবং জোট নেত্রী হিসাবে তাঁর শক্তি বৃদ্ধিতে সাহায্য করবে। ফলে বন্দি জামায়াত নেতৃবৃন্দ মুক্ত হলে তাঁর শক্তি প্রভূত পরিমাণে বৃদ্ধি পাবে। তাঁর সংগ্রামের সাফল্যের সম্ভাবনা উজ্জ্বলতর হবে।
শেখ হাসিনার পক্ষে জামায়াত নেতৃবৃন্দকে মুক্তি দিয়ে আলোচনা-সংলাপ-সমঝোতার পথ উন্মুক্ত করা আরও সহজ। তাঁর সংগ্রামী পিতার জীবনেই এ রকম বহু ঘটনা ঘটেছে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ মাথায় নিয়েই তাঁর পিতা আয়ুব খানের বন্দি দশা থেকে মুক্তি পেয়ে নানা সংলাপ-আলোচনা ও সমঝোতা প্রচেষ্টায় অংশ নিয়েছিলেন। দেশ-বিদেশের পর্যবেক্ষণ ও আইনের কার্যক্রম দৃষ্টে জামায়াত নেতৃত্বের বিরুদ্ধে পরিচালিত মামলার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আজ আর কারও কাছে অজানা নয়। ইতিহাসের নানা পর্যায়ে ষড়যন্ত্রমূলক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলার শেষ পরিণতি একই রকম হয়েছে। হয় জনতা এসব মামলা আন্দোলনের তোড়ে ভাসিয়ে দিয়েছে; নয়তো সরকার আপস ও সমঝোতার লক্ষ্যে মামলা তুলে নিতে বাধ্য হয়েছে। এই দুই ঐতিহাসিক বিকল্পের বাইরে অন্য কোনও পন্থা অবলম্বন করা হলে সেটা সংলাপ-সমঝোতার প্রেক্ষাপটে আত্মঘাতী হয়ে দাঁড়াতে পারে। অতএব সরকার যদি আসলেই সংলাপ ও সমঝোতা চায়, তাহলে জামায়াতের কারা নির্যাতিত নেতৃবৃন্দের মুক্তি দিয়ে সদিচ্ছার প্রমাণ দিয়েই সেটা চাইবে।
৪.
বাংলাদেশ ও বিশ্বের সকলের মতো আমরা অবশ্যই বিশ্বাস করি, সংঘাত নয়, সমঝোতাই সঙ্কট উত্তরণের একমাত্র পথ। সমঝোতার জন্য প্রয়োজন পরিবেশ, উদারতা। বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের নায়ক নেলসন ম্যান্ডেলা সাদা মানুষদের কারাগারে ২৭ বছর বন্দি থেকেও তাদের সঙ্গে সমঝোতা করে কেবল দেশটির নেতাই হন নি, তাবৎ বিশ্বের নেতায় রূপান্তরিত হয়েছেন। সংলাপ ও সমঝোতার অর্থই হলো প্রতিপক্ষের সঙ্গে সম্মিলিত হয়ে সৌহার্দ্য বিস্তার করা। এই সৌহার্দ্যকে বাদ দিয়ে হিংসা, বিদ্বেষ, প্রতিপক্ষ নিধনে মদমত্ত হলে সংলাপ বা সমঝোতার সুযোগই থাকে না। যে সরকার দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে বাড়িছাড়া করেছে, তাঁর পুত্র তরুণ নেতা তারেক রহমানকে দেশছাড়া করেছে, প্রতিপক্ষকে হত্যা-নির্যাতন-বন্দি করেছে, সে সরকারকে ব্যক্তিগতভাবে ক্ষমা ঘোষণা করে তাদের সঙ্গে সমঝোতার প্রত্যাশা ব্যক্ত করে বেগম জিয়া রাষ্ট্রনায়কোচিত উদারতা ও মহত্ত্বের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। বাংলাদেশ ও উন্নত বিশ্বের গণতন্ত্রের সংগ্রামের ইতিহাসে বেগম জিয়ার এই স্মরণীয় অবদান স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ হয়ে থাকবে। দেশ ও জাতিকে সংঘাত ও বিভেদের কবল থেকে উত্তরণের জন্য বেগম জিয়ার ত্যাগ এবং সমঝোতা ও সমন্বয়ের উদ্যোগ ইতিহাসের সত্যরূপে চিহ্নিত হবে। এখন শেখ হাসিনাকেও উদার, সার্বজনীন মনোভাবের পরিচয় দিতে হবে। কারাবন্দি নেতাদের মুক্তি দিয়ে আলোচনার টেবিলে নিয়ে এসে সমঝোতার পথ বের করতে হবে। তাহলেই সঙ্কট সমাধানে তাঁর কৃতিত্ব প্রমাণিত হবে। সকলের মতো তাঁকেও এ সত্য অনুধাবন করতে হবে যে, তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার আন্দোলনের আদি ও অগ্রণী নেতাদের কারাবন্দি রেখে এ সংক্রান্ত অর্থবহ সংলাপ বা সমঝোতা সম্ভব হবে না। চলমান রাজনৈতিক সঙ্কটেরও অবসান হবে না। সকলের মধ্যে বাস্তবসম্মত চিন্তার উদয় ও সূত্রপাত হলেই বিদ্যমান অচলাবস্থার পরিসমাপ্তি ঘটবে। নচেৎ আন্দোলন-সংগ্রামের পরিণতি কোথায় গিয়ে ঠেকে, সেটা কেউই আগাম বলতে পারবে না। পরিস্থিতি এখন একেবারেই খাদের শেষ কিনারে চলে এসেছে। সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে অতিদ্রুত। চলমান সঙ্কট-সমস্যা ঘনীভূত হয়ে ক্রনিক হয়ে যাচ্ছে। এই অবস্থায় দায়িত্বশীল সংশ্লিষ্টদের মধ্যে আশু বোধোদয় ও শুভ বুদ্ধির উন্মেষ ঘটলেই দেশ-জাতি-সমাজ-মানুষ নিস্তার পাবে। সবাই শান্তি ও সুস্থিরতার সন্ধান পাবে। আশাবাদী মানুষ এখনও এমনভাবেই ইতিবাচক চিন্তা করছে। এবং প্রত্যাশা করছে ইতিবাচকতা সকলের মধ্যে বিস্তার লাভ করুক। এই ইতিবাচক প্রত্যাশাকে নস্যাৎ করে নেতিবাচক, হিংসাত্মক, আক্রমণাত্মক ও প্রতিপক্ষ নিধনমূলক আচরণ ও মানসিকতা বিজয়ী হলে পরিণতি কারও জন্যই মঙ্গলময় হবে না।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন