শুক্রবার, ২৫ অক্টোবর, ২০১৩

‘সুশীলদের টকশো এবং সরকার সমর্থকদের গাত্রজ্বালা’


‘সুশীলদের খানাপিনা শুরু হয়েছে, সাবধান হওয়ার এখনই সময়’ শিরোনামে শিক্ষাবিদ ও বিশ্লেষক আবদুল মান্নান সাহেবের একটি লেখা মনোযোগ সহকারে পড়ছিলাম। গত ১৫ তারিখ দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকায় লেখাটি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে ছাপা হয়েছে। মান্নান সাহেব উল্লেখ করেছেন, অতিতের যেকোন সময়ের তুলনায়  আওয়ামী লীগ এখন বহুগুণ চ্যালেঞ্জের সম্মুখিন। এবার তাদের প্রতিপক্ষ শুধু বিরোধীদলই নয় মিডিয়ার একটি বড় অংশ, বড় বড় করপোরেট হাউসগুলো, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের একটি শক্তিশালী অংশ, সাংবাদিকদের একাংশ এবং বাংলাদেশের সুশীল সমাজ। তিনি সুশীল সমাজের প্রতি তীর্যক দৃষ্টিতে তাকিয়েছেন। বলেছেন, মধ্যরাতের  টিভিটকশো  এবং পত্রপত্রিকার কলামে সুশীল সমাজ বর্তমান সরকারের ছিদ্রান্নেষণে মহাব্যস্ত। সুশীলদের নিয়ে আবদুল মান্নান সাহেবের এসব মন্তব্যের সাথে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মন্তব্যের মধ্যে একটা যোগসূত্র লক্ষ্য করা যায়। কিছুদিন পূর্বে সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনী তাদের নিজ বাসাতে খুন হবার পর প্রধানমন্ত্রী তার এক জনসভায় মন্তব্য করেছিলেন যে, তারা কারো বেডরুম পাহারা দেয়ার জন্য ক্ষমতায় আসেননি। প্রধানমন্ত্রীর এমন মন্তব্যের পর গোটাদেশে সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়। এমতোবস্থায় সুশীল সমাজ দেশের আইন শৃঙ্খলার অবনতি প্রশ্নে মতামত দিতে থাকলে প্রধানমন্ত্রী বলে বসলেন, জ্ঞানী-গুণী সুশীল সমাজ দিয়ে দেশ চলে না। রাত জেগে যারা টিভি টকশোগুলোতে অংশগ্রহণ করেন তাদের মস্তিষ্কের সুস্থতার ব্যাপারেও তিনি আশংকা করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর এমনসব মন্তব্যের ব্যাপারে আবদুল মান্নান  সাহেব কী বলবেন জানি না, তবে একজন বিশ্লেষক হিসেবে আপনার কাছে প্রধানমন্ত্রীর এসব কা--জ্ঞানহীন বক্তব্যের সঠিক ব্যাখ্যাও যে জাতি আপনার কাছে প্রত্যাশা করতে পারেন সেটা ভুলে গেলে চলে না।
মান্নœান সাহেবের লেখার তারিফ না করে পারা যায় না। অনেক হালকা বিষয়কে গুরুগম্ভীর করে এবং গুরুগম্ভীর বিষয়কে হালকা রসে পরিবেশন করার মারাত্মক জাদু আছে তার হাতে। গত ৪ সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার একটি খবরের বরাত দিয়ে তিনি লিখেছেন, বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে সোনালী ব্যাংকের প্রায় সতেরো হাজার কোটি টাকার ঋণ জালিয়াতি হয়েছে এর মধ্যে দশ হাজার কোটি টাকা মেরে দিয়েছে তৎকালীন জোট সরকারের মন্ত্রী এমপিরা। ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের প্রায় ছয়শ কোটি টাকা, অথবা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর পুত্রের মালিকানাধীন ডান্ডি ডাইংয়ের নামে নেয়া কোটি কোটি টাকা কোথায় গেলো? লন্ডনে যে এলাকায় তারেক রহমান থাকেন সেখানে মাসে ন্যূনতম চার হাজার পাউন্ড খরচ হয়, গত প্রায় পাঁচবছর ধরে যে বিশাল পরিমাণ অর্থ তারেক রহমানকে যোগান দেয়া হচ্ছে  তা কিভাবে আসে? এসব কথা সুশীল সমাজের কেউ আজ আর উত্থাপন করেন না বলে তিনি অভিযোগের ভঙ্গিতে তার লেখায় তুলে ধরেছেন ।
মান্নান সাহেবদের মতো এত প্রাজ্ঞ মানুষরা কেন যে নিমিষেই ভুলে যান যে, বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের পাহাড় সমান ঐসব দুর্নীতির কারণেই তো জনগণ তাদেরকে প্রত্যাখ্যান করেছে। শুধু প্রত্যাখ্যানই নয় তাদের বিরুদ্ধে এখনও বহু মামলা-হামলা, জেল-জুলুম, অত্যাচার-নির্যাতন রয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ কি করেছে? আওয়ামী লীগ দিনবদলের মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে জাতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার যে দুর্নীতি, হত্যা, খুন, অপহরণ ও ত্রাসের রাজত্ব কায়েম  করেছিল  তারই পুনরাবৃত্তি ঘটাবার জন্যই কি জনগণ আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছিল? না। বিগত সরকারের অপকর্মের পুনরুত্থান ঘটাবার জন্য জনসাধারণ যে আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়নি, এ কথাটা সুশীল সমাজের মনে রাখা জরুরী হয়ে পড়েছিল। আওয়মী লীগের কাছে মানুষের প্রত্যাশা ছিল দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে, গণতন্ত্র মুক্তি পাবে, নিত্যপণ্যের বাজার জনসাধারণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকবে, স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে, আইন-শৃঙ্খলার উন্নতি হবে, মানুষের গুণগত চিন্তা-ভাবনা বিকশিত হওয়ার পরিবেশ সৃষ্টি হবে। জনগণের এই সব প্রত্যাশা পুরণে আওয়মী লীগ সরকার সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছে। সামাজিক শৃঙ্খলার এতটাই অবনতি হয়েছে যে, মানুষ আজ নিজের শয়নকক্ষেও নিরাপদ বোধ করছে না। সে জন্য সুশীল সমাজ দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে  আলোচনা করার প্রয়োজন অনুভব করছেন মাত্র । সরকারের বিরোধিতা করছেন বলে তো মনে হয় না। এমন সমালোচনা বিগত সরকারের আমলেও ছিলো। তখনকার টিভি টকশো এবং পত্রপত্রিকার পাতা খুঁজলে তার প্রমাণ মিলবে। তখনকার সুশীল সমাজও সরকারের ছিদ্রান্নেষণে ব্যস্ত ছিলো বলে মান্নান সাহেবদের মতো অনেকেরই তখন মনে হয়েছিল।
মান্নান সাহেব তার লেখায় আর একটা মজার বিষয়ের অবতারণা করেছেন। তিনি বলেছেন মিথ্যা প্রচার প্রচরণার ক্ষেত্রে বিএনপি তিলকে তাল করতে পারঙ্গম সেই তুলনায় আওয়মী লীগ তালকে তিলও করতে পারে না। মান্নান সাহেবের এই কথাটা বাংলাদেশের কত শতাংশ মানুষ বিশ্বাস করবে তা তিনিই ভালো জানেন; তবে সেই প্রচারবিমুখ আওয়ামী লীগ রাতের অন্ধকারে ঢাকা শহরের বিলবোর্ডগুলো দখল করেছিল এবং কেনইবা রাতের অন্ধকারে আবার সেগুলো সরিয়ে ফেলেছে মান্নান সাহেবরা তার ব্যাখ্যায় মুখে কুলুপ এঁটেছেন। কেন এঁটেছেন সেটাও জনগণ ইতোমধ্যেই হৃদয়গমও করে ফেলেছে।
মান্নান সাহেবদের স্মরণে রাখা ভালো যে, অতিতের সরকার যেসব ব্যর্থতার দায় নিয়ে জনগণ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়েছে সেই ব্যর্থতার উপমা টেনে যদি বর্তমান সরকারও নিজেদের আকাশচুম্বি ব্যর্থতার বৈধতা খোঁজেন, তাহলে বাংলাদেশের জনগণ আবারও আওয়ামী লীগকে চিরদিনের জন্য ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে রেখে দেবে সেটি এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
মানুষ এখন রাজনীতিকদের কথায় আর আস্থা রাখতে পারছেন না। জনগণ এখন কাজে বিশ্বাস করতে শিখেছে। যাদের কথা ও কাজে মিল নাই পতন তাদের অনির্বায্য।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দোহায় দিয়ে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর উপর সরকারের দমন-নিপীড়ন চালানো ঠিক হচ্ছে না, এমন বক্তব্য দেশ-বিদেশের অনেক সচেতন মহল থেকেই প্রদান করা হচ্ছে কিন্তু সরকার সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করছেন না। ভ্রুক্ষেপ না করাটাই হয়তো সরকারের অস্তিত্ব সংকটের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে অনেকে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। কারণ এ দেশের  শতকরা ৯০ ভাগ মানুষ ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী । এ বিশাল জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগে এমন কিছু করা হলে সেটা যে জনগণ সহজে মেনে নিতে পারবেন না সে বিষয়টাও সরকারের মাথায় থাকা উচিত ছিল। ধর্মভিত্তিক রাজনীতি শুধু বাংলাদেশে নয় পৃথিবীর অনেক গণতান্ত্রিক দেশেই রয়েছে। হেফাজতের নারীনীতি নারীদেরকে মধ্যযুগে নয় আধুনিক যুগে ফিরে আনবে। মনে রাখতে হবে, হেফাজতের নারীনীতি সমাজে ঐশী তৈরি করে না বরং ঐশীদেরকে প্রতিরোধে সাহায্য করে। হেফাজতের তের দফা দাবির বহুপূর্ব থেকেই এদেশের ধর্মপ্রাণ মানুষদের চাহিদা অনুযায়ী বাংলাদেশে স্বতন্ত্র নারীশিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেছে সুতরাং আগামী দিনের রাজনীতিতে ধর্মকে বাদ দিয়ে পথচলার প্রত্যাশা  বাতুলতা মাত্র। আর হেফাজতের বিরুদ্ধে যত অপপ্রচারই চালানো হোক না কেন তা ধোপে টিকবে বলে মনে হয় না।
ধর্মীয় অনুশাসনের কথা বলতে গিয়ে হেফাজতের হুজুরেরা জঙ্গি বনে গেলেন। কে বা কারা পবিত্র কুরআন শরীফে আগুন দিলেন তার দায়ভারও হেফাজতের নিরীহ কর্মীদের উপর চাপিয়ে দেয়া হলো। এসব অপবাদের দায়িত্ব সরকার কখনই এড়াতে পারেন না বলে জনগণ এখন বিশ্বাস করেন। জনগণ এও বিশ্বাস করেন, রাতের অন্ধকারে শাপলা চত্বর থেকে হেফাজকে তাড়িয়ে দেয়ার  অর্থ যদি জঙ্গি তাড়ানোর অর্থ হয়, তাহলে বুঝতে হবে হেফাজত তাড়ানোর মাধ্যমে পক্ষান্তরে সরকার যে নিজেই নিজেকেই তাড়িয়েছে।  এই সরল সত্যটুকু মেনে নিতে কষ্ট হয় বলেই হয়তো সুশীল সমাজের বিরুদ্ধে আবদুল মান্নানদের এত গাত্রজ্বালা কি না তা-ও ভেবে দেখার মতো যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads