শনিবার, ১৯ অক্টোবর, ২০১৩

ঈমানদার হতাশ হতে পারে না


আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য মাল ও জান দিয়ে সংগ্রাম সাধনা করা, প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চালানোকেই আল্লাহর কোরআনে ‘জিহাদুন ফি সাবিলিল্লাহ’ বলা হয়েছে। আমরা বাংলায় যাকে ইসলামী আন্দোলন বলে থাকি। এই আন্দোলন নিছক রাজনৈতিক আন্দোলন নয়, নয় ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি লাভের নাম। মূলত এটা হলো আল্লাহ রাসূল ও আখেরাতের প্রতি ঈমানের অনিবার্য দাবি। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা আখেরাতের শেষ বিচারে আজাবে আলীম বা দোজখের বেদনাদায়ক শাস্তি থেকে নাজাতের জন্যেই এই জিহাদে অংশ গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন। সুরায়ে ছফের দ্বিতীয় রুকুর মাধ্যমে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা যে ভাষায় এ ব্যাপারে নির্দেশনা দিয়েছেন তা খুবই প্রণিধানযোগ্য। আল্লাহর ঘোষণা বা নির্দেশনাটি নি¤œরূপ :
“হে ঈমানদারগণ ! তোমাদেরকে কি এমন একটা ব্যবস্থার কথা বলব যা তোমাদেরকে আজাবে আলীম বা বেদনাদায়ক শাস্তি থেকে নিষ্কৃতি দেবে? (আর তা হলো) ঈমান আনো আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি (আর এর অনিবার্য দাবী অনুযায়ী) জিহাদ কর আল্লাহর পথে মাল দিয়ে এবং জান দিয়ে। এটাই তোমাদের জন্যে উত্তম যদি তোমরা প্রকৃত জ্ঞান লাভ করে থাক।”
এই নির্দেশনার পূর্বেই এর প্রতিদান সম্পর্কে বলতে গিয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেন, “তোমাদের গোনাহসমূহ মাফ করে দেয়া হবে। তোমাদের প্রবেশ করানো হবে এমন জান্নাতে যার পাদদেশ দিয়ে ঝরনা প্রবাহিত হবে। আর সেই সুরম্য জান্নাতে বসবাসের জন্যে থাকবে পূত-পবিত্র বাসস্থানসমূহ, এটাই সর্বোত্তম পুরস্কার। তবে এছাড়া আরো একটি পুরস্কার আছে যা তোমরা পছন্দ কর, আর তা হলো নিকটতম বিজয় (এই বিজয় সম্পর্কে) মুমিনদেরকে শুভ সংবাদ দাও।”
এই পুরস্কারটি পাওয়ার জন্যে করণীয় নির্দেশ করে আল্লাহ পরবর্তীতে বলেন, “হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর সাহায্যকারী হও, যেমন ঈসা (আ) হাওয়ারীদের লক্ষ্য করে বলেছিলেন, আল্লাহর পথে কারা হবে আমার সাহায্যকারী? উত্তরে হাওয়ারীগণ বলেছিল, আল্লাহর সাহায্যকারী আমরাই। অতঃপর বনি ইসরাঈলের একটি অংশ ঈমান আনল আর একটি অংশ ঈমান আনতে অস্বীকার করল। অতঃপর আমরা ঈমানদারদেরকে সাহায্য করলাম তাদের শত্রু পক্ষের উপর, ফলে চূড়ান্তভাবে তারাই হলো বিজয়ী।”
সূরায়ে ছফের উপরিউক্ত অংশটি ইসলামী আন্দোলনের সাথে সংশ্লিষ্ট সকলের কাছেই সুপরিচিত। আন্দোলনের অভ্যন্তরে এর চর্চাও বলতে গেলে বেশ উল্লেখযোগ্যই বলা যায়। তারপরও বর্তমান প্রেক্ষাপটে কোরআনের এই বিশেষ অংশটিকে নতুন করে অনুধাবনের প্রয়োজন আছে। আমরা একটু গভীরভাবে উপলব্ধির চেষ্টা করলে কয়েকটি বিষয় অত্যন্ত সুস্পষ্ট ভাবেই বুঝে আসতে বাধ্য :
(১) একমাত্র আখেরাতের নাজাত ও মুক্তির জন্যে, আজাবে আলীম থেকে বাঁচার জন্যেই আমাদেরকে ইসলাম প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে মালের কোরবানী ও জানের কোরবানী দিয়ে অংশগ্রহণ করতে হবে।
(২) আল্লাহ, রাসূল ও আখেরাতের প্রতি ঈমানের অনিবার্য দাবি এটাই।
(৩) এর প্রতিদান ফলের মধ্যে প্রধান বিষয় হলো গোনাহসমূহের মার্জনা এবং জান্নাত প্রাপ্তি। এই আন্দোলন ও সংগ্রামের চরম ও পরম চাওয়া পাওয়া এটাই।
(৪) মানুষের কাছে পছন্দনীয় বা লোভনীয় বিষয়টি হলো দুনিয়ায় আল্লাহর সাহায্যে দ্বীনের বিজয় দেখতে পাওয়া। এটাকে আল্লাহ তায়ালা অস্বীকার করেননি, বরং এ ব্যাপারে মুমিনদেরকে শুভ সংবাদ দিতে বলেছেন এবং এটা পাওয়ার জন্যে কিছু করণীয় বা শর্তও দিয়েছেন। তবে এটা মুখ্য উদ্দেশ্য বানাননি। মুখ্য উদ্দেশ্য বানিয়েছেন মাগফিরাত এবং জান্নাত প্রাপ্তিকেই।
ইসলামী আন্দোলনের সাফল্য ও ব্যর্থতার মাপকাঠিও এখান থেকেই আমরা নির্ণয় করতে পারি। ইসলামী আন্দোলনের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের যারা নিছক মাগফেরাতের ও জান্নাতের আশায় পরিচ্ছন্ন মনমগজ নিয়ে আল্লাহকে রাজি-খুশি করাকেই চরম ও পরম চাওয়া পাওয়া হিসেবে গ্রহণ করে আন্দোলনের মাঠে ময়দানে অনুকূল বা প্রতিকূল সব অবস্থায় নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে সাহস ও হিম্মতের সাথে ময়দানে টিকে থাকতে সক্ষম হয়, জাগতিক দৃষ্টিতে আন্দোলন বিজয়ী না হলেও ঐ ব্যক্তিরা সফলকাম। আল্লাহর দরবারে তাদেরকে ব্যর্থতার গ্লানি নিয়ে দাঁড়াতে হবে না। এই আস্থা যারা মনে প্রাণে লালন করে তাদেরকে কোন প্রতিকূলতাই হতাশ করতে পারবে না। আর এই দৃষ্টিকোণ থেকে যারা ইসলামী আন্দোলনকে গ্রহণ করে তাদের কাছে ব্যর্থতা বলে কোন প্রশ্নই থাকতে পারে না। পক্ষান্তরে এই দৃষ্টিকোণে ইসলামী আন্দোলনকে গ্রহণ না করে যারা কেবল রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেই বিচার বিশ্লেষণ করে অভ্যস্থ এবং এটাকেই মুখ্য উদ্দেশ্য গণ্য করে, আল্লাহর সাহায্য দ্বীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলন বিজয় লাভ করলে ও আল্লাহর কাছে ঐ সব  লোকেরা ব্যর্থ হিসেবে গণ্য হবে।
ইসলামী আন্দোলনের মূল গাইডবুক হলো আল কোরআন, আর গাইড হলেন জীবন্ত কোরআন হিসাবে জনাবে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.) তাই আজকের প্রেক্ষাপটে ময়দানের পরিস্থিতিকে সামনে রেখে আল্লাহর কোরআন এবং রাসূলের সীরাতকে সার্বক্ষণিকভাবে সামনে রাখতে হবে এবং এখান থেকেই পথ নির্দেশনা নিতে হবে।
রাসূল (সা.) এর মক্কা জীবনের যে পর্যায়ে ঈমানের ঘোষণা দেওয়া ছিল নেকড়ে বাঘের মুখের গ্রাস হিসাবে তুলে দেবার শামিল, সেই সময়ে যারা ঈমানের ঘোষণা দিয়ে তার উপর অটল অবিচল থাকার দৃষ্টান্ত স্থাপনে সক্ষম হয়েছেন। তাদের প্রসঙ্গে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা প্রশংসাসূচক ভাষায় সাহায্যের শুভ সংবাদসহ বলেন, “সন্দেহ নেই যারা এই মর্মে ঘোষণা দিয়েছে যে আল্লাহ আমাদের রব অতঃপর (চরম প্রতিকূলতা সত্ত্বে¡ও) এর উপর দৃঢ়ভাবে অটল ও অবিচল থাকছে, তাদের উপর আল্লাহর পক্ষ থেকে নাজিল হয় রহমতের ফেরেস্তা (তারা তাদেরকে অভয় বাণী শুনিয়ে) বলে তোমরা ভয় করনা দুশ্চিন্তা কর না” তোমরা জান্নাতের শুভ সংবাদ গ্রহণ কর যে জান্নাতের ব্যাপারে তোমাদেরকে ওয়াদা করা হয়েছে। ওখানে তোমরা যা চাইবে তাই পাবে দয়ালু ও ক্ষমাশীল আল্লাহর পক্ষ থেকে মেহমানদারী স্বরূপ। (সূরা হা-মীম আস সাজদা-৩০, ৩১, ৩২)
উক্ত নির্দেশনাবলীর পরিপূরক নির্দেশনা পাওয়া যায় আল্লাহ পাকের নি¤েœাক্ত ঘোষণাটির মাঝে “তোমরা কি ভেবে নিয়েছ, এমনিতেই জান্নাতে প্রবেশ করবে? আর তোমাদের উপর এখনও সেই অবস্থা আসেনি যে অবস্থা বা প্রতিকূল পরিস্থিতি এসেছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর। তাদের উপর বিপদের উপর বিপদ এসেছে, এমনকি ঐ বিপদসমূহ ভূমিকম্পের রূপ নিয়েছে, সেই প্রচ- প্রতিকূল পরিস্থিতিতে রাসূল এবং তার সাথীসঙ্গীগণ আর্তচিৎকার করে বলে উঠেছে, আল্লাহর সাহায্য কখন কোথায় কিভাবে আসবে? এহেন অবস্থায় আল্লাহর পক্ষ থেকে অভয় দিয়ে বলা হয়েছে, তোমরা জেনে নাও আল্লাহর সাহায্য অবশ্যই অতি নিকটে”। (সূরা বাকারা আয়াত ২১৪)
সংকট যত গভীর ও প্রকট হয়, আল্লাহর সাহায্য হয় ততই নিকটবর্তী। যেমন রাতের অন্ধকার যতই গভীর হয় ভোরের সূর্যোদয় হয় ততই নিকটবর্তী। আমাদের প্রিয়নবী (সা.) পরীক্ষা চাইতে নিষেধ করেছেন, কিন্তু এরপরও যদি পরীক্ষা এসেই যায় সেক্ষেত্রে আল্লাহর উপর ভরসা করে ছবর এবং  এস্তেকামাতের সাথে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার জন্যে চেষ্টা করার নির্দেশও দিয়েছেন।
যদিও আমরা এখনও রাসূল (সা.) এর আন্দোলনের মক্কী জীবনের স্তরেই আছি। অর্থাৎ সংগ্রাম যুগে আছি, বিজয় যুগের প্রত্যাশা বুকে নিয়েই এই স্তর অতিক্রম করে যেতে হবে আরো অনেক অনেক দূরে। তবুও
আল্লাহর ঘোষণা : “আল্লাহর সাহায্য অতি নিকটে” প্রতি পূর্ণ আস্থা রাখতে হবে। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ইসলামী আন্দোলনের দৃষ্টিতে আমরা এখন মক্কী অধ্যায়ের শেষ প্রান্তে অবস্থান করছি। কিন্তু মাঝে মধ্যে মাদানী  অধ্যায়ের সাথেও কিঞ্চিত দেখা সাক্ষাৎ আমাদের ঘটে থাকে। এই অবস্থায় রাসূলে খোদার প্রতি ওহুদ যুদ্ধের পটভূমিতে নাজিলকৃত নির্দেশনা থেকে আমরাও কিছু শিক্ষণীয় বিষয় গ্রহণ করতে পারি।
“তোমরা ভগ্নোৎসাহ হয়োনা, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়োনা। তোমরাই হবে বিজয়ী যদি হও সত্যিকারের ঈমানদার।” “যদি তোমরা কিছুটা আঘাত প্রাপ্ত হয়ে থাকো, তবে অন্যরাও তো অনুরূপ আঘাত প্রাপ্ত হয়েছে। এই দিনের (সুদিন অথবা দুর্দিন) আমিই আবর্তন বিবর্তন ঘটিয়ে থাকি মানুষের মাঝে। এটা করে থাকি এজন্যে আল্লাহ এর মাধ্যমে ঈমানদারদেরকে প্রকাশ করতে চান, আরো চান তোমাদের মধ্য থেকে কিছু লোককে শহীদ হিসাবে গ্রহণ করতে। আল্লাহ জালেমদের ভালবাসেন না। এতে আল্লাহর এ ইচ্ছাও কার্যকর ছিল যে তিনি ঈমানদারদেরকে পৃথক করে দিয়ে কাফেরদের মূলোৎপাটন করবেন। তোমরা কি এটা ভেবে বসে আছ যে, এমনিতেই জান্নাতে পৌঁছে যাবে আর আল্লাহ তো এখনও এটা প্রকাশ করেননি যে তোমাদের মধ্যে কারা আল্লাহর পথে জিহাদকারী আর কারা ছবরকারী” (সূরায়ে আলে ইমরান ১৩৯Ñ১৪২ আয়াত)।
ওহুদ যুদ্ধে বিষয়ের পর বড় রকমের বিপর্যয়ের মুখোমুখী হতে হয় মুসলিম বাহিনীকে। হযরত হামযা (রা.)সহ ৭০ জন সাহাবা (রা: আ:) শাহাদত বরণ করেন। স্বয়ং নবী করীম (সা.আ.সালাম)। গুরুতরভাবে আহত হন, তার দান্দান মোবারক শহীদ হয়। অত্যন্ত চাতুর্যের সাথে মুসলমানদের নৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিকভাবে দূর করে দেওয়ার জন্যে কাফের মুশরিকদের পক্ষ থেকে গুজব ছড়িয়ে দেওয়া যে “মুহাম্মদ (সা.)  নিহত হয়েছেন। উল্লেখিত ঘটনা প্রবাহকে কেন্দ্র করে মুসলিম বাহিনীর মধ্যে যে মনস্তাত্বিক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল, আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা সেটাকে সামনে রেখেই উপরোল্লিখিত আয়াতসমূহের মাধ্যমে রাসূল (সা.)  এর মাধ্যমে তার সাথী সঙ্গীদেরকে বাস্তবসম্মত হেদায়াত বা দিক নির্দেশনা দান করেন। তার প্রথম বিষয়টিই হলো প্রতিপক্ষের আঘাতে ভেঙ্গে পড়া চলবেনা, ভগ্নোৎসাহ হওয়া যাবে না, সত্যিকারে ঈমানদার হলে চূড়ান্ত পর্যায়ে বিজয় তাদেরই হবে। দ্বিতীয় পর্যায়ে বলা হয়েছে, লড়াই সংগ্রামে তো কেবল এক তরফা আঘাত প্রাপ্তির ঘটনাই ঘটে না। সবসময় একপক্ষই সুবিধা পায় না। আঘাত এবং সুবিধা অসুবিধা উভয়কেই স্পর্শ করে। সুদিন দুর্দিনের মুখোমুখি সবাইকেই হতে হয়। এই সুদিন আর দুর্দিনের আবর্তন ও বিবর্তন পুরোটাই আল্লাহর  একক নিয়ন্ত্রণে। তিনিই মানুষের দুর্দিনকে সুদিনে পরিণত করেন। আবার সুদিনকে পরিণত করেন দুর্দিনে।  সূরায়ে হাশরে এটাকেই এভাবে বলা হয়েছে, “অবশ্যই কষ্টকর সময়ের সাথেই রয়েছে সহজ সময়ের আগমনী বার্তা। অবশ্যই কষ্টের পরে আছে সুদিনের সম্ভাবনা।” অতএব চরম প্রতিকূল অবস্থাকে স্থায়ী বিপদ মনে করে হতাশা নিরাশায় ভোগার কোন কারণ নেই।
আল্লাহর পরিকল্পনার ভিত্তিতেই মুমিনদের উপর মাঝে মধ্যে দুর্দিন দুরবস্থা এসে থাকে। আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে অসংখ্য ঘোষণা আছে, “আমরা অবশ্যই তোমাদের পরীক্ষা নিয়ে ছাড়বো ভয়ভীতির পরিস্থিতি সৃষ্টি করে, ক্ষুধার মাধ্যমে, মানবসম্পদের এবং সন্তানের ক্ষতির মাধ্যমে। ঐ সব ছবরকারীদেরকে শুভসংবাদ দাও যারা বিপদ আপদে আক্রান্ত হলে বলে থাকে, আমরা তো একমাত্র আল্লাহর জন্যে এবং তাঁর কাছেই তো ফিরে যেতে হবে। এদেরই উপর বর্ষিত হয় আল্লাহর রহমত এবং আশীর্বাদ আর এরাই হলো সৎ পথ প্রাপ্ত।”
আমাদের আলোচিত সূরায়ে আলে ইমরানের আয়াতসমূহের দ্বিতীয় বিষয়ের সমর্থনেই সূরায়ে বাকারার এই অংশটুকুর উদ্ধৃতি দেয়া হলো। সুরায়ে মুহাম্মদে এই কথাটি এভাবে বলা হয়েছে, তোমাদের মধ্য কে আল্লাহর পথে সংগ্রামী আর কে ছবরকারী, এটা পরিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত আমি অবশ্যই তোমাদের পরীক্ষা করে ছাড়ব।” ওহুদদের বিপর্যয়ের পটভূমিতে আল্লাহ বলছেন এরূপ ঘটনার নেপথ্যে উদ্দেশ্য হল “আল্লাহ পরিষ্কার করতে চান কারা ঈমানদার, আর কিছু লোককে কবুল করতে চান শহীদ হিসাবে। ঈমানদারকে ছাটাই বাছাইয়ের মাধ্যমে আল্লাহ চান খাঁটি ঈমানদারদের মাধ্যমে খাদবিহীন ঈমানদারদের মাধ্যম কুফরী শক্তির চূড়ান্ত পরাজয় নিশ্চিত করতে। যা বাস্তবে ঘটেছিল মক্কা বিজয়ের পরে।
সাময়িকভাবে ঈমানদারদের উপর ইসলাম বিরোধী শক্তির দাপট বা দৌরাত্ম্য দেখে এটা ভাবার কোন কারণ নেই যে আল্লাহ বোধ হয় তাদের পক্ষ নিয়েছেন। এরূপ ধারণা যাতে কোন মুহূর্তে ঈমানদারদের হৃদয় মনকে স্পর্শ করতে না পারে সেজন্যেই আল্লাহ তায়ালা অত্যন্ত স্পষ্টভাষায় ঘোষণা করেছেন “আল্লাহ জালেমদেরকে ভালবাসেন না।”
এরপরেই আল্লাহ তায়ালা ঈমানদারদের ঈমানী চেতনাকে জাগ্রত করার জন্যে বলেছেন, আল্লাহর কাছে এটা অবশ্যই স্পষ্ট হতে হবে যে তার পথে কারা সংগ্রামী আর কারা ছবরকারী। এছাড়া জান্নাত লাভের আশা করার কোনই যৌক্তিকতা নেই। মুখে জান্নাত লাভের উদ্দেশ্যে শাহাদাতের কামনা করা আর বাস্তবে  এর মুখোমুখি হওয়া এককথা নয়। 
রাসূল (সা.) এর আহত হওয়ার পর কাফের মুশরিকদের পক্ষ থেকে তার নিহত হওয়ার গুজবে সৃষ্ট মনমানসিকতাকে সামনে রেখে আল্লাহর পক্ষ থেকে আগত নির্দেশনা খুবই তাৎপর্যবহ। “মুহাম্মদ (সা) তো আল্লাহর রাসূল বৈ আর কিছু নয়। তার আগেও তো অনেক রাসূল দুনিয়ায় এসেছেন, আবার বিদায় হয়ে গেছেন। তিনি যদি স্বাভাবিক ভাবে মৃত্যুবরণ করেন অথবা শহীদ হন (কাফেরদের হাতে নিহত হন) তাহলে কি তোমরা (দ্বীন ত্যাগ করে) পূর্বের অবস্থায় (জাহেলী) ফিরে যাবে? যারা এভাবে পূর্বাবস্থায় ফিরে যাবে তারা আল্লাহর কোনই ক্ষতি করতে পারবেনা। আল্লাহ অতিসত্তর শোকরগোজার কারীদের পুরস্কৃত করবেন”।
আল্লাহর রাসূলের স্বাভাবিকভাবে মৃত্যুবরণ বা শত্রুর হাতে শাহাদাত বরণের পরও যদি ইসলাম প্রতিষ্ঠার কাজ থেকে পিছু হটার কোন যুক্তি না থাকে, হতাশা নিরাশার শিকার হওয়ার কোন যুক্তি না থাকে, তাহলে আজকের এই দিনে ইসলামী আন্দোলনের প্রথম সারির কিছু লোককে দুনিয়া থেকে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মাধ্যমে সরিয়ে দিলেই ইসলামী আন্দোলন শেষ হয়ে যাবে, ইসলামের আওয়াজ স্তব্ধ হয়ে যাবে এমনটি ভাবার আদৌ কোন সুযোগ নেই। ইসলামী আন্দোলন কোন ব্যক্তি কেন্দ্রীক আন্দোলন নয়। এটা সম্পূর্ণ রূপে একটি আদর্শবাদী আন্দোলন, যে আদর্শ আন্দোলনের মূল পথিকৃত শেষ নবী মুহাম্মদ (সা.) সহ সমস্ত আম্বিয়ায় কেরাম এবং তাদের সার্থক উত্তরসুরী, যারা ইতিহাসে সিদ্দিকীন সালেহীন এবং শুহাদা হিসাবে পরিচিত। আজকের আন্দোলন তারই ধারাবাহিকতা।
হযরত হোসাইন (রা.) এর শাহাদাতের পটভূমিতেই উমাইয়া রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার আবির্ভাব ঘটে ইসলামের ইতিহাসে পঞ্চম খলিফায়ে রাশেদ ওমর ইবনে আবদুল আজিজের, যিনি ইতিহাসে দ্বিতীয় ওমর হিসাবে পরিচিত। হযরত মাহবুবে রব্বানী মোজাদ্দেদে আলফে সানীর তৈরী করা পটভূমিতেই আবির্ভাব ঘটে বাদশাহ আলমগীরের। আজকের তুরস্কের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যারা সমাসীন তাদের এ পর্যায়ে আসার পটভূমি তৈরীতে সাইয়েদ বদিউজ্জামান নূরসীর ভূমিকাকে কেউ অস্বীকার করতে পারবে না।
আগামী দিনের বাংলাদেশে ইনশাআল্লাহ ইসলাম একটি বিজয়ী শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবেই। আর তা হবে ঐ পটভূমিতে যে পটভূমি তৈরিতে ভূমিকা রেখেছেন, কঠোর পরিশ্রম করেছেন নাম জানা অজানা আল্লাহর অনেক নিবেদিত প্রাণ বান্দা যার যথার্থ মূল্যায়নে ইসলামী আন্দোলনের নতুন প্রজন্মের মধ্যে কোন দ্বিধা সংশয় আছে বলে মনে হয় না। তাদের ময়দানের আপোষহীন ও অকুতোভয় ভূমিকা থেকে এটাই প্রতীয়মান হয়। অতএব আজকের এই সংকটকালকে যদি গভীর অন্ধকার রজনীর সাথে তুলনা করি তা হলে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলতে দ্বিধা নেই, এই অমানিশার নিকষ অন্ধকার ভেদ করে ভোরের সূর্য্য উদয়ের আর বেশি বাকি নেই। অতএব ঘুমন্ত লোকেরা জেগে ওঠে আল্লাহর সান্নিধ্যে দাঁড়িয়ে থাক, রুকু ও সাজদার মাধ্যমে তার দ্বারে ধরনা দাও তাঁরই সাহায্য কামনা কর। তাঁর নৈকট্য লাভের এটি একটি দূর্লভ মুহূর্ত। আল্লাহর সাহায্য পাওয়ার উপযুক্ত সময়ও এটাই। “সাজদাবনত হও এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভ কর।” স্মরণ কর আল্লাহর ঘোষণা, “(আরবী হবে)” যদি তোমরা আল্লাহকে সাহায্য কর তাহলে আল্লাহ তোমাদেরকে সাহায্য করবেন।” আর আল্লাহর সাহায্য পাওয়া গেলে কে আছে এমন যে তার দ্বীনের বিজয় ঠেকাতে পারে!
আজকের দিনে শুধু বাংলাদেশেই নয় দুনিয়ার সর্বত্রই ইসলামী আদর্শের পতাকাবাহীরা ঈমানের অগ্নি পরীক্ষার মধ্য দিয়ে জীবন যাপনে বাধ্য হচ্ছে। এটা ইতিহাসের শেষ অধ্যায় নয়। এই অধ্যায়ের পরেই আসছে “খেলাফত আলা মিনহাজি ন্নবুয়ত” বা নবী (সা.)-এর পদাঙ্ক অনুসারী খেলাফতের শাসন ব্যবস্থা।” বর্তমান সংকট ইসলামী আদর্শের পতাকাবাহীদের জন্যে কোন দুঃসংবাদ বহন করছে এমনটি ভাবার কোন কারণ নেই। বরং এটা আগামী দিনের ইসলামী আদর্শের বিজয়ের হাতছানি। একজন ঈমানদার মুসলমানকে এই বিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে সকল হতাশা নিরাশার জাল ছিন্ন করে সকল জড়তা কাটিয়ে গা ঝাড়া দিয়ে উঠতে হবে। এটাই সময়ের দাবি, এটাই ঈমানের দাবি।
আল্লাহ আমাদের সকলের সিনাকে তার পক্ষ থেকে নাজিলকৃত কোরআনী হেদায়াত উপলব্ধির জন্যে খুলে দিন। চলমান বিশ্ব পরিস্থিতির আসল পরিনতি উপলব্ধি করার মত ঈমানী ফেরাসাত ও দ্বীনি বাছিরাত দান করে। অন্ধকারে আলোকবর্তিকা হাতে মানবতার ত্রাণকর্তা হিসাবে ভূমিকা পালনে আরো বেশি বেশি যোগ্যতা, ক্ষমতা ও গভীর দূরদৃষ্টি দান করুন। মহান আল্লাহর দরবারে প্রাণ উজার করে দিন রাত এই দোয়াই করছি। জানি দোয়া কখনও বৃথা যায় না। কোরআন মূলত আল্লাহর ইবাদতের একটি উল্লেখযোগ্য দিক। আমরা এই দোয়ার মাধ্যমে আল্লাহর কাছে যা চাই তা সাথে সাথে না পেয়েই যেন আশাহত না হই। দোয়া তো ইবাদত, তার প্রতিদান তো আল্লাহ অবশ্যই দিবেন। তাছাড়া দোয়া আল্লাহর নৈকট্য লাভের উপায় এবং এটাই নগদ প্রাপ্তি। বাকি আমাদের চাওয়া পাওয়ার ব্যাপারটা কখন কিভাবে দিলে আমাদের জন্য অধিকতর কার্যকর হবে তা আল্লাহ আমাদের চেয়ে ভালো বুঝেন। তিনি এক জায়গায় আমাদেরকে অভয় দিয়ে বলেন, “(আরবী হবে) তোমাদের শত্রুদের ব্যাপারে আল্লাহই সবচেয়ে বেশি অবগত আছেন এবং তিনিই তোমাদের অভিভাবক হিসাবে এবং সাহায্যকারী হিসেবে যথেষ্ট। যে আল্লাহ দ্ব্যর্থহীন ভাষায় এই ঘোষণা দিয়েছেন যথা সময়ে তার সাহায্য আসবেই, এ ব্যাপারে কোন ঈমানদারের মনে সন্দেহ সংশয় থাকতে পারে না।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads