রবিবার, ২৭ অক্টোবর, ২০১৩

গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দল


এক সময় প্রায় সব দেশেই রাজা রাজত্ব করেছেন। রাজারা দাবি করেন, তাদের ক্ষমতার উৎস হলো বিধাতা। বিধাতার কাছ থেকে তারা পেয়েছেন প্রজা পালনের ক্ষমতা। অতীতে সব রাজা স্বৈরাচারী ছিলেন না। আবার সব রাজা যে প্রজা মনোরঞ্জক ছিলেন, তাও নয়। রাজাদের কিভাবে চলা উচিত, সে সম্পর্কে প্রাচীন যুগে অনেকে করেছেন গ্রন্থ রচনা। খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে রচিত কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে বলা হয়েছে- প্রজাসুখে সুখং রাজ্ঞঃ প্রজানাং চ হিতে হিতম। নাত্মপ্রিয়ং হিতং রাজ্ঞঃ প্রজানাং তু প্রিয়ং হিতম্ ॥টানা বাংলা করলে দাঁড়ায়, প্রজার সুখেই রাজার সুখ। প্রজার হিতে রাজার হিত। রাজার নিজের প্রিয় জিনিস বা কার্য হিত নয়। প্রজাদের যা প্রিয় তাই হলো প্রকৃত হিত। প্রাচীন যুগে এই উপমহাদেশে রাজা, অমাত্য ও প্রজা, এই তিনের মধ্যে সামঞ্জস্য রক্ষা করে চলত রাজ্যব্যবস্থা। রাজা স্বেচ্ছাচারী হলে তার বিরুদ্ধে অনেক সময় ঘটেছে প্রজাবিদ্রোহ। তবুও অতীতে অনেক সময় হয়েছে অত্যাচারী রাজার আবির্ভাব। হিন্দুধর্মে বলে, অত্যাচারী রাজার অত্যাচার বন্ধ করতে আবির্ভূত হন অবতার। রাজা কংস ছিলেন অত্যাচারী। তাকে বধ করেছিলেন অবতার শ্রীকৃষ্ণ। অর্থাৎ অতীতে চেষ্টা করা হয়েছে নানাভাবে রাজকর্তৃত্ব নিয়ন্ত্রণের। তবে অতীতে রাজনৈতিক দলের কোনো অস্তিত্ব ছিল না কোনো দেশেই। বিলাতে আমরা প্রথমে দেখতে পাই রাজনৈতিক দলেন কার্যকলাপ। এক দল চেয়েছে রাজার ক্ষমতা অক্ষুণœ রাখতে। আরেক দল চেয়েছে রাজার ক্ষমতা কমিয়ে প্রজার ক্ষমতা বাড়াতে। আমরা আধুনিক গণতন্ত্রের ধারণা পেয়েছি বিলাতের কাছ থেকে। এই ধারণা আমাদের ভেতর থেকে গড়ে ওঠা নয়। কিন্তু আমরা যেহেতু থেকেছি বিলাতের নিয়ন্ত্রণে, তাই বিলাতের কাছ থেকে পাওয়া ধারণা হয়ে উঠতে চেয়েছে আমাদের চেতনার অংশ। রাজনৈতিক দল বলতে বোঝায় এমন জনসংগঠন, যা চাই রাষ্ট্র-ক্ষমতা দখল করে নিজেদের আদর্শ অনুসারে দেশ চালাতে। একটা দেশে গণতন্ত্র নির্ভর করে জনমত, রাজনৈতিক দল এবং অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচনের ওপর। রাজনৈতিক দল চায় রাষ্ট্র-ক্ষমতা পেতে। কিন্তু সেই দলই রাষ্ট্র-ক্ষমতা পেতে পারে, যাদের দলীয় নীতি ভোট পেতে সাহায্য করে অন্যদের তুলনায় বেশি। অন্যদের তুলনায় বেশি ভোট না পেলে রাষ্ট্র-ক্ষমতা লাভ সম্ভব হয় না। সব গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচকমণ্ডলী একটি দলকে ভোট দেবার সময় বিচার করে দেখে সেই দলের নেতা, নীতি ও কর্মীবাহিনী কেমন। জনমত বদলায়। গণতন্ত্রে কোনো দল চিরকাল ক্ষমতায় থাকে না। এক দলের জায়গায় আরেক দল আসে ক্ষমতায়। গণতন্ত্রে দল বদলায় ভোটের মাধ্যমে। গণতন্ত্রের পক্ষে যতগুলো যুক্তি আছে, তার মধ্যে অন্যতম যুক্তি হলো ভোটের মাধ্যমে এক দলের হাত থেকে আরেক দলের হাতে ক্ষমতা যেতে পারে রক্তপাতহীনভাবে। তাই গণতন্ত্র হলো বিশেষভাবে কাম্য। সেদিন একটি টেলিটক শুনছিলাম। টেলিটকের বিষয় ছিল, রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়, উলুখড়ের প্রাণ যায়। বক্তারা বলতে চাচ্ছিলেন, বিএনপি ও আওয়ামী লীগের সঙ্ঘাতে ঘটবে সর্বসাধারণের ক্ষতি। সর্বসাধারণকে তারা রূপকভাবে বলছিলেন উলুখড়। কিন্তু বাংলাদেশে মানুষকে কি সত্যই বলা যায় উলুখড়? তাদের কি নেই বিচার শক্তি? বাংলাদেশের মানুষ রাজনীতি নিয়ে অনেক ভাবে। তাদের উলুখড় বলা যায় না। বক্তারা বলছিলেন বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে যে সঙ্ঘাত সৃষ্টির সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, তা কেবলই হতে যাচ্ছে ক্ষমতার লালসার কারণে। কিন্তু বিএনপি ও আওয়ামী লীগ উভয়েরই আছে আদর্শিক ভিন্নতা। এই দুটি দলের বিরোধ কেবলই ক্ষমতাকেন্দ্রিক নয়। রাজনীতিতে ক্ষমতার প্রশ্ন থাকবেই। কিন্তু সেই সাথে আসছে আবার দলীয় আদর্শের কথা। আওয়ামী লীগ বিশ্বাস করে বাঙালি জাতীয়তাবাদে। কিন্তু বিএনপি বিশ্বাস করে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে। এই দুই জাতীয়তাবাদ সমার্থক নয়। এটা হলো দুই দলের মধ্যে বড় রকমের দৃষ্টিভঙ্গিগত তফাৎ। বাঙালি জাতীয়তাবাদ আর বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ এক ব্যঞ্জনা বহন করে না। অর্থনীতির ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ এখনো ভাবে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ার কথা। কিন্তু বিএনপির আদর্শ হলো মিশ্র অর্থনীতি, যাতে থাকবে রাষ্ট্রিক নিয়ন্ত্রণ। কিন্তু বন্ধ হবে না ব্যক্তি উদ্যোগে উৎপাদন ও ব্যবসায়-বাণিজ্যের সুযোগ। আওয়ামী লীগ ১৯৭৫ সালে গড়তে চেয়েছিল এক দলের রাজত্ব (বাকশাল)। কিন্তু বিএনপি কোনো দিনই চায়নি এক দলের রাজত্ব। বিএনপির আদর্শ হয়েছে বহুদলীয় উদার গণতন্ত্র। আসলে এক দলের রাজত্ব হলো গণতন্ত্রের বরখেলাপ মাত্র। যেটা বিএনপি কখনোই রাজনৈতিক আদর্শ হিসেবে গ্রহণযোগ্য বলে মনে করে না। শেখ মুজিব বাকশাল গড়তে চেয়েছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির অনুকরণে। আওয়ামী লীগ বলেছে শেখ মুজিবের বাকশাল গঠনের লক্ষ্য ছিল দেশে দুঃখী মানুষের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার পর এই দুঃখী মানুষের গণতন্ত্রের ধারণা হারিয়েছে তার ভিত্তি। দল হিসেবে আওয়ামী লীগ হলো ভারত ঘেঁষা। কিন্তু বিএনপি তা নয়। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে পার্থক্যকে কেবল ক্ষমতার অভিলাষ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। কিন্তু টকশোতে বিজ্ঞ ব্যক্তিরা সেটাই যেন চাচ্ছিলেন প্রমাণ করতে। ১৯৬০-এর দশকে ভারতের গান্ধীবাদী রাজনীতিক বিনোবা ভাবে বলেন, রাজনীতি চায় না, লোকনীতি চায়। লোকনীতি বলতে তিনি বুঝান, দলবিহীন গণতন্ত্র। কিন্তু বাস্তবে তা সম্ভবপর বলে মনে হয় না। ভারতে ভাবা হচ্ছে না দলবিহীন গণতন্ত্রের কথা। দল ছাড়া গণতন্ত্র রূপ নিতে পারে স্বৈরতন্ত্রে। দল স্বৈরতন্ত্রের প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করে চলেছে সব গণতান্ত্রিক দেশে। অনেক দেশেই রাজা বা রানী আছেন, কিন্তু বাস্তবে তারা হারিয়ে ফেলেছেন রাজ্য শাসনের ক্ষমতা। তাদের চলতে হচ্ছে জনপ্রতিনিধির কথা শুনে। ব্রিটেন, নেদারল্যান্ডস, ডেনমার্ক, নরওয়ে, সুইডেনÑ এসব দেশে এখনো রাজতন্ত্র আছে। কিন্তু রাজতন্ত্র আগের মতো ক্ষমতাধর নয়। প্রতিষ্ঠা হতে পেরেছে জনপ্রতিনিধিদের শাসন। এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে থাকা দেশ জাপানে রাজা আছেন, কিন্তু তিনিও ভোগ করছেন না প্রাচীন যুগের রাজাদের মতো ক্ষমতা। কথাগুলো আমার মনে আসছে এ জন্য যে, টেলিটকে একজন প্রখ্যাত অধ্যাপককে বলতে শুনলাম, বাংলাভাষায় পলিটিকস্কে বলা হচ্ছে রাজনীতি। এ জন্য সৃষ্টি হতে পারছে সমস্যা। দলনেতাদের মধ্যে সৃষ্টি হতে পারছে কতকটা সেকেলে রাজা রাজা ভাব। কিন্তু আমার তা মনে হয় না। কারণ, রাজা যেসব দেশে আছেন, তারা এখন হয়ে পড়েছেন ক্ষমতাহীন। গণতন্ত্রে কেউ এখন হতে পারেন না আগের দিনের মতো রাজা। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের সঙ্কট সৃষ্টির মূলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়ে উঠেছে একটা সমস্যা। শেখ মুজিব যুদ্ধাপরাধীদের বিচর চাননি। কিন্তু তার তনয়া যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ওপর আরোপ করছেন খুবই গুরুত্ব। এতে দেশের জনমত হয়ে পড়েছে বিভক্ত। এই বিভক্তি সৃষ্টি করতে পারে গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি। আর তার ফলে স্থগিত হয়ে যেতে পারে বাংলাদেশের গণতন্ত্র। এক দিন রাজা রাজায় যুদ্ধ হতো। প্রাণ যেত প্রজাদের। কিন্তু এখন আর আগের মতো রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয় না। যুদ্ধ হয় দেশে দেশে। যুদ্ধ নিতে চায় সামগ্রিক যুদ্ধের রূপ (Total War), যাতে সামরিক ও বেসামরিক লোকের মধ্যে বিশেষ কোনো তফাৎ থাকে না। একটা দেশের সব নাগরিকই কমবেশি জড়িয়ে পড়ে যুদ্ধে। যেটা প্রাচীন রাজতন্ত্রে ঘটতে পারত না। মানুষ সভ্য হয়েছে, কিন্তু যুদ্ধ থামেনি। বিকাশ ঘটেছে মারণাস্ত্রের। জেনেভা কনভেনশন অনুসারে যুদ্ধ কোনো অপরাধ নয়। কিন্তু নির্বিচারে গণহত্যা যুদ্ধাপরাধ। অথচ আকাশ থেকে বোমা ফেললে মারা যায় বহু লোক। মারা যায় আবালবৃদ্ধবনিতা। কিন্তু তা বলে কেউ বিচার করতে চায় না বোমা নিক্ষেপকারী পাইলোটের। যদিও তার বোমা নিক্ষেপ হলো বহু বেসামরিক মানুষের মৃত্যুর কারণ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান হেরে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন জাপানের মন্ত্রী ছিলেন তোজো। যুদ্ধ শেষে তোজোর বিচার করা হয়েছিল যুদ্ধাপরাধী হিসেবে। তোজোর ফাঁসি হয়। কিন্তু জাপানের ওপর পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপের দরুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রু ম্যানের হয় না কোনো বিচার। যুদ্ধে যারা হেরে যায় কেবল তাদেরই হতে হয় যুদ্ধাপরাধী। যুদ্ধাপরাধের বিচার তাই অনেকের কাছে মনে হতে পারে প্রহসন মাত্র। টেলিটকে কাউকে বলতে শুনলামÑ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে ছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথা। কিন্তু আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে কেবল যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথা ছিল না। ছিল চালের দাম কমাবারও কথা। কিন্তু বাস্তবে কি সেটা হতে পেরেছে? ভারতকে বলতে শোনা গেল বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীর বিচার সমর্থনীয়। কিন্তু এই ভারতই সিমলা চুক্তি অনুসারে ১৯৭২ সালে ছেড়ে দিয়েছিল সব পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দীকে। যাদের মধ্যে ১৯৪ জন ছিলেন চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী। ভারত তাদের দেয়নি যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বিচার করতে। কিন্তু আজ সে নৈতিক সমর্থন দিচ্ছে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধী বিচারের। বাংলাদেশে সে যেন চাচ্ছে গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি সৃষ্টি হোক। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের সঙ্কট রাজনৈতিক দলের কারণে যতটা না হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি হতে পারছে ভারতের চক্রান্তের ফলে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশে সফর করতে আসার আগে বলেছিলেন, বাংলাদেশ হয়ে উঠতে চাচ্ছে একটি মুসলিম মৌলবাদী দেশ। তিনি বলেছিলেন, বাংলাদেশে শতকরা ২৫ ভাগ লোক এখন হয়ে উঠেছে জামায়াতে ইসলামীর সমর্থক। ভারত বাংলাদেশের ঘরোয়া রাজনীতিতে একের পর এক করে চলেছে মন্তব্য। আমরা ভারতের গণতন্ত্রকে শ্রদ্ধা করি। কিন্তু ভারত যেন চাচ্ছে না বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পাক। ভারত বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জন্য হয়ে উঠেছে সমস্যার কারণ। আমাদের অধ্যাপকেরা এখন অনেকেই যেন ভারতভক্ত। তারা টেলিটকে ভারতের সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করতে চান না। তাদের বক্তব্য শুনে মনে হয় বাংলাদেশে গণতন্ত্রের সঙ্কট সৃষ্টি হচ্ছে কেবলই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ কারণে, যেটা সত্য নয়। সব গণতান্ত্রিক দেশেই রাজনৈতিক দল আছে। আছে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। কিন্তু তা সৃষ্টি করছে না গণতন্ত্রের সঙ্কট। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে রাজনৈতিক দলের সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি। তবু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গড়ে উঠেছে রাজনৈতিক দল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক দলকে নির্ভর করেই চলেছে সে দেশের গণতন্ত্র। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চারজন প্রেসিডেন্ট নিহত হয়েছেন ঘাতকের গুলিতে। কিন্তু তাই বলে মার্কিন গণতন্ত্র হয়ে পড়েনি অকার্যকর। 


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads