রবিবার, ২০ অক্টোবর, ২০১৩

সর্বদলীয় সরকারের প্রস্তাব, না ফাঁদ?



সারা দেশের মানুষ যখন ২৫ অক্টোবর নিয়ে উদ্বিগ্ন, তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সর্বদলীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব দিয়েছেন এতে। টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে তিনি বিরোধী দলের প্রতি অংশগ্রহণপূর্বক মন্ত্রিসভায় তাদের সদস্যদের নাম চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর এ আহ্বান ইতিবাচক। তবে রূপরেখার বিষয়টি তিনি স্পষ্ট করেননি। এর আগে বিরোধীদলীয় নেতা ও সিনিয়র নেতারা প্রধানমন্ত্রীর অধীনে নির্বাচনে যাবেন নাবলে স্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছেন। তবে দেখা যায়, গত পাঁচ বছরে সরকার বিরোধী দলকে অনেকটাই কোণঠাসা করে রেখেছে। কথায় কথায় গ্রেফতার, আটক, নির্যাতন, গুম, খুনসহ নানাভাবে হয়রানি করেছে বিরোধীদলীয় নেতাদের। বিরোধী জোটের অন্যতম শরিক জামায়াতে ইসলামী ও তাদের ঘনিষ্ঠসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরকে রাজপথে নামতে দেয়নি। বিরোধী দলের যেকোনো কর্মসূচিতে নাশকতার অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিকভাবে ব্যবস্থা নিয়েছে। সারা দেশে বিএনপি-জামায়াতের হাজার হাজার নেতাকর্মীকে জেলে পুরেছে। সরকারের মেয়াদের শেষ সময়ে অনুষ্ঠিত সিটি করপোরেশন নির্বাচন গুলোতে বিএনপি প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছেন। সে হিসেবে বলা যায়, আগামী নির্বাচনে বিএনপির জন্য মাঠ অনেকখানি প্রস্তুত। আর ঢাকা সিটি করপোরেশনকে দুই ভাগ করলেও নির্বাচন দেয়ার সাহস পর্যন্ত করেনি সরকার। সরকার শঙ্কিত তার জনপ্রিয়তা কমে যাওয়া নিয়ে। সরকার যে কিছু দৃশ্যমান উন্নয়ন করেছে। কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, মুগদা হাসপাতাল, কুড়িল ফাইওভার, যাত্রাবাড়ী ফাইওভার ৩০ ভাগ কাজ বাকি রেখেই উদ্বোধন হয়েছে (যদিও এর উদ্যোগ বিএনপির সময়ে নেয়া)। হাতিরঝিলের কাজ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে শুরু হলেও সরকার এর কৃতিত্ব নিজেদের পকেটে পুরেছে। তারপরও সরকার শঙ্কিত বিগত বছরগুলোতে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো নিয়ে। এক নজরে ২০০৯ থেকে ২০১৩ (৩০ জুন) পর্যন্ত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাÑ বিচারবহির্ভূত হত্যা : ৬১০ জন; গুম : ৮৯; কারা হেফাজতে মৃত্যু : ৩০৯; নির্যাতনে আহত ও নিহত : ২৮৬; বিডিআর বিদ্রোহে সেনা কর্মকর্তা হত্যা : ৫৭; রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত : ১০৯৭; ১৪৪ ধারা জারি : ৩৭৭ বার; সাংবাদিক নির্যাতন : ১১৫৫টি; সীমান্তে বিএসএফ কর্তৃক হত্যা : ২৫৬; পোশাকশ্রমিক হত্যা : ১২৯৮; ধর্ষণ : ৩০৪৭; এসিড নিক্ষেপ : ৪৬২; গণপিটুনিতে মৃত্যু : ৬৫৫ জন (তথ্যসূত্র : অধিকার)। এ সরকারের সময়ে যেটা সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান, তা হচ্ছে বাহিনীর যথেচ্ছ ব্যবহার, বিশেষ করে সভা-সমাবেশসহ বিরোধী দলের রাজনৈতিক কার্যালয়সহ সর্বত্র এ বাহিনীর তাপ ব্যবহার। বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুককে পুলিশ দিয়ে পেটানো এবং সেই পুলিশ কর্মকর্তাদের পদোন্নতি, বিএনপি কার্যালয়ে ককটেল নাটক মঞ্চস্থ করে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ ১৪৮ জন নেতাকর্মীকে গ্রেফতার; রাজনৈতিক কর্মসূচিতে গুলি করে নেতাকর্মী হত্যা, নাটোরের বড়াইগ্রামের উপজেলা চেয়ারম্যান সানাউল্লাহ নূর বাবুকে প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যা, কমিশনার চৌধুরী আলম বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলী গুম, নিজ শয়নকক্ষে সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যা, ৭০ লাখ টাকাসহ মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এপিএস ফারুক আটক, কুইক রেন্টালের নামে ২৮ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি ইত্যাদি ঘটনা জনগণ ভুলবে কী করে? বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের একটি মন্তব্য গত বৃহস্পতিবার টেলিভিশনে শুনছিলাম, তিনি বলেছেন,‘সরকারপ্রধান একেক সময় একেক কথা বলছেন, আবার যা বলছেন তা তিনি পালন করছেন না। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনির খুনিদের গ্রেফতারে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম, অতঃপর সাড়ে ১৬ হাজার ঘণ্টা অতিবাহিত, ‘বেডরুমে নিরাপত্তা দেয়া সম্ভব নয়,’ মতিঝিলে হেফাজতকে সমাবেশ করার অনুমতি, অতঃপর আলো নিভিয়ে অপারেশন ফ্যাশ আউট। গণমাধ্যম স্বাধীন বলে মুখে ফেনা সরকারের বেশ কজন মন্ত্রীর, অতঃপর চ্যানেল ওয়ান, আমার দেশ, দিগন্ত ও ইসলামিক টিভি বন্ধ করে বিরোধী মত দমনের ষোলকলা পূর্ণ; ১০ টাকা সের চাল খাওয়ানোর প্রতিশ্রুতি, অতঃপর ৪৮-৫০ টাকায় তা খাওয়ানো; ইতোমধ্যে পেঁয়াজের দাম নটআউট ১১০। পদ্মা সেতু অবশ্যই এ সরকারের সময়ে শেষ করার ঘোষণা, অতঃপর দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্বব্যাংকের পিছুটান। শেয়ারবাজার লুটে ৩৩ লাখ বিনিয়োগকারীর অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়ার পর অতঃপর বিনিয়োগকারীদের ফটকাবাজ বলেছেন অর্থমন্ত্রী। হলমার্কের সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা ব্যাংক জালিয়াতি, অতঃপর অর্থমন্ত্রী বললেন, এটা কোনো অংকের অর্থ নয়। আইনি দোহাই দিয়ে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদ থেকে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে সরিয়ে অতঃপর নিজ কতৃত্বে এনে তা পরিচালনা। দলীয় আনুকূল্যে বিচারক নিয়োগ, অতঃপর সরকারদলীয় স্বার্থ সংরক্ষণ। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হতে আগ্রহ, এ কারণে প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের সমালোচনা। সঙ্কট উত্তরণে সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খানের ফর্মুলা, অতঃপর তার সমালোচনা। সরকারের সমালোচনা, অতঃপর বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তমকে নব্য রাজাকারের খেতাব। প্রবীণ সাংবাদিক এ বি এম মূসার সমালোচনা। বলা হয়, গণতন্ত্র সুরক্ষার জন্য একটি শক্তিশালী সুশীলসমাজের প্রয়োজন। কিন্তু এ সরকারের সময় সুশীলসমাজের অবস্থাও নাস্তানাবুদ। কথা বললেই সমালোচনা, তুচ্ছ তাচ্ছিল্য, হেয় প্রতিপন্ন করা। তাই যাদের আত্মসম্মানবোধ প্রবল, তারা মুখ বন্ধ রেখেছেন মাসের পর মাস। আর যারা সঙ্ঘাত হানাহানি বন্ধ করার লক্ষ্যে দেন সঙ্কট উত্তরণের ফর্মুলা, তারা হন নিগৃহীত। সবশেষ, সর্বদলীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব দিয়েছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী। ইতোমধ্যে জাতীয় পার্টি, জামায়াত, বিকল্প ধারা, কৃষক শ্রমিক জনতা দলÑ এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। প্রধান বিরোধী দলও তাদের প্রতিক্রিয়া জানাবে। অস্পষ্ট রূপরেখার এ প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই অন্য কাউকে সর্বদলীয় সরকারের প্রধানমন্ত্রী করবেন না। বিরোধী দলের সদস্যদের প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র, আইন ও তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিশ্চয়ই দেয়া হবে না। নির্বাচন কমিশন কি আরো স্বাধীন ও শক্তিশালী হবে? আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কার তত্ত্বাবধানে থাকবে? এ রকম গুরুত্বপূর্ণ নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। প্রস্তাব দেয়ার পর দিন ঘোষণা করা হলো সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধের। এর অর্থ কী? প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাব না মানলে আরো কঠোর পরিণতি! এটা কি সর্বদলীয় সরকারের প্রস্তাব, না নির্বাচনে অংশগ্রহণ করানো সুদূরপ্রসারী ফাঁদ? 


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads